
মঞ্জু সরকারের ‘রাজনৈতিক গল্প’: আত্মবিরোধী মানুষের প্রতিকৃতি
একজন মানুষের জীবন অতিবাহিত শিল্পযাপনে। একজন শিল্পীর সমগ্র সত্তা উচাটন মানুষের মঙ্গল চেতনায়। এমন অন্যতম মানুষ, শিল্পী মঞ্জু সরকার। মঞ্জু সরকারের ‘রাজনৈতিক গল্প’ শির্ষক গল্পসংকলটির প্রতিটি গল্প পড়ে এমন আন্দোলিত হয়েছিলাম যে, অন্তর্গত দ্বন্দ্ব ও গ্লানিতে বিমূঢ় হয়েছিলাম। সেই অন্তর্দ্বন্দ্বের অভিঘাতে চিন্তাশৃঙ্খলা কিছুক্ষণ গতিমুখহীন থেকেছে। ভাবনার দ্রবণ কিছুটা থিতিয়ে এলে তা গতিমুখ খুঁজে পেয়েছে বটে, কিন্তু আত্মগ্লানি, ঘৃণা, অন্তরদহন ও দ্রোহব্যঞ্জক কিছু অনুভব মননে জাঁকিয়ে তুলেছে মানুষের স্বরূপ, অস্তিত্ব ও নিয়তির প্রসঙ্গটাকে নৈরাশ্যজনক রূপে। সাথে কিছু জিজ্ঞাসাও প্রাণবন্ত তখন। মানুষের সমাজে ‘রাজনীতি’ বোধের উৎপত্তি কবে এবং কেন? রাজনীতি ব্যাপারটি সমাজে কেন টিকে আছে? রাজনীতি মানুষের জন্য কি করে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর চটজলদি পেয়ে যাব আশা করি না, চটজলদি পেতে প্রত্যাশাও করি না, কারণ তা অজ্ঞেয়প্রায় মানুষপ্রকৃতির সাথে লগ্ন বিষয়। রাজনীতির ধারণাটি মানুষের সভ্য হওয়ার, তার সভ্যতার অগ্রগমনের পথরেখার সাথে সংশ্লিষ্ট নিশ্চয়। সভ্যতা ধারণাটি স্বয়ং হতাশাজনকরূপে ভীষণ বৈপরিত্যপূর্ণ। সভ্যতার স্বরূপ কিংবা প্রতিমূর্তি নির্মিত মানুষপ্রকৃতিরই স্বরূপে; ফলে মানুষেরই মতো সভ্যতার অবয়বটিও আশা-নিরাশার। মানুষের মঙ্গল চেতনার এক অমোঘ পথরেখার নাম রাজনীতি। রাজনীতির এটি এক দিক। রাজনীতি স্বয়ং শঠের ছল। এ হল রাজনীতির আরেক দিক। তাহলে মানুষের রাজনৈতিক গল্পটা আসলে কেমন? রাজনীতির দুটি দিকই আসলে মানুষপ্রকৃতির দুটি দিক। মানুষ সতত মঙ্গলকামী এবং মানুষেরা মূলত শঠ। মঙ্গলকামীরাও শঠ আর শঠেরাও মঙ্গল চেতনায় আচ্ছন্ন হয়। মানুষপ্রকৃতির এই বৈপরিত্যকে না বুঝলে মঞ্জু সরকারের গল্প কেন, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র কিংবা অর্থব্যবস্থা—কোনো কিছুরই থা পাওয়া যাবে না। মঞ্জু সরকারের গল্পের মর্মকথা মানুষের স্বরূপ চেনাতে চায়। মানুষের চরিত্র, স্বভাব কিংবা প্রকৃতি, যে অভিধাতেই চিনি না-কেন, মঞ্জু সরকারের গল্প মানুষের স্বরূপকে হতাশাব্যঞ্জক রূপে আমাদের সামনে উম্মোচিত করে। আমাদের সামনে মানে মানুষের সামনে। মানুষকে নগ্ন করে মানুষের সবটা দেখাতে চায়।
রাজনীতি মানুষের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষাকে উদযাপনের দিকে নিতে চায়। কিন্তু, রাজনীতির ছল মানুষমঙ্গল চেতনার পথকে সংকীর্ণ করে দিলে তার নাম হয় আত্মপরতা। সংকীর্ণ ধারার নদীতে ঝাঁপ দিলে পঙ্কিলতা বাড়ে, পঙ্কজ ফলে না। পরার্থপরতার পথ ভিন্ন জীবনের রূপ, রস কিংবা গন্ধের কোনো মানপরিস্থিতি চিহ্নিত করা যায় না। তখন সৌন্দর্য কেবলই মাকাল। একটি বৃত্ত, এখানে পুনরাবৃত্তি আছে এবং আছে পূর্ণতার সাপেক্ষ ফাঁকি। পূর্ণতা নিশ্চয় সার্থকতার নামান্তর নয়। মানুষ ও সমাজ, পরস্পর প্রতিমুখী ধাঁধাশীল প্রতিবিম্ব। মানুষ সত্তার ভিতরে তার বহু সত্তা। মানুষ ফলত বহুত্বের স্মারক, বিচিত্র আর বিপরীত ধর্মিতার আধার এবং ইতি ও নেতির পাশার দান। কে জানে, কখন কোন গুটি উঠে আসে খেলোয়াড়ের হাতে আর নির্ধারিত হয়ে যায় মানুষের জয়-পরাজয়। সরল দেখায় মনে হতে পারে—গুটি কেবল দু’ধরনের, ভালো ও মন্দের, সৎ ও অসতের, নেতি ও ইতির, আলো ও আঁধারের; এইরূপ বাইনারি প্রপঞ্চের। কিন্তু, এই পাশার দান ও খেলোয়াড়ের হাতের কারসাজি এতোটা সরল নয় কখনোই। ভালোর কতো যে রূপ কিংবা মন্দেরও কতো যে সুরৎ! আবার মন্দেরও ভালো থাকে আর ভালোরও মন্ধ থাকে। মানুষের দ্বিধাও হয়ে ওঠে শ্রেণিকৃত আর ভালো-মন্দের, মঙ্গলামঙ্গলের মানদণ্ডও অনির্ণেয়। মানুষের এই ধাঁধাশীল অসহায়ত্ব। এই প্রপঞ্চের ভিতর থেকে গজিয়ে ওঠে মানুষের ঈশ্বর ধারণা। মানুষের ঈশ্বর ধারণা মূলত তার অধরা, না-বোঝা কিংবা বুঝতে না-চাওয়া তার অস্মিতা। মানুষের অস্মিতা অবয়বহীন, মায়া; কিন্তু বাস্তব। মানুষের বাস্তবতাও সেই সাপেক্ষে মায়া। মানুষের এই কুয়াশাচ্ছন্ন স্বরূপ ধারণার ভিতরে যা কিছু ক্রিয়াশীল, তার সকলই বৈপরিত্যপূর্ণ; কিন্তু এই বৈপরিত্য একদমই নিরীহ নয়, দ্বন্দ্বশীল। দ্বন্দ্বশীল বললেও মনে হতে পারে তা যেন কিছুটা লীলাপূর্ণ রোমঞ্চকর পরিস্থিতি, কিন্তু মোটেই তা নয়। এই পরিস্থিতি একেবারেই সংঘাতশীল। মানুষের এই সংঘাতশীল বৈপরিত্য তার প্রকৃতিজ, সহজাত গুণ কিংবা দোষ। গুণ নাকি দোষ? এই প্রশ্নের সহজ উত্তরে স্থির হওয়া যায় না। এর মধ্যেই সৌন্দর্য সাধনাও চলে মানুষ কুলে। সকল মানুষ সৌন্দর্য পিপাসু, কিছু মাত্রায় সকলেই স্রষ্টা, কিন্তু, সকলেই শিল্পী নয়। শিল্পীর সৌন্দর্য চেতনা সর্বদাই সৎ ও মাঙ্গলিকতার নিশ্চয়তা দেয় না। মানুষ ও মানুষের মধ্য থেকে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে বেড়ে ওঠা কিছু মানুষ, যারা শিল্পী, তাদের সত্তার দ্বান্দ্বিকতাও পরিশেষে ধাঁধাশীল আধেয়। মঞ্জু সরকার তো শিল্পী। শিল্পীর দ্বান্দ্বিক ও ধাঁধাশীল সত্তায় তথা তার অস্তিত্বে যাপনের কর্ষণে বোধে ফলে ওঠে এইসব গল্পকথা। তার গল্প মানুষের মঙ্গলের কথা বলতে চায় নাকি ব্যর্থতা ও পরাজয়ে দ্রোহী করতে চায়? সৎ ও মঙ্গলচেতনার পরাজয়ে শঠের ও খলের উল্লাসে বিমূঢ় হবে মানুষ নাকি আখেরে মানুষের দ্রোহই জিতে যাবে? মানুষ কি কেবল এই দ্বিবিধ প্রবণতার একটিকেই বেছে নেয় নাকি তার ভিতরে এই দ্বিবিধ প্রবণতার যৌথসহাবস্থান থাকে? এই দ্বিবিধ প্রবণতা কি মানুষের ভিতরে যুগপৎ ক্রিয়াশীল থাকে? যদি তেমনটিই হয়ে থাকে, তবে, এই বৈপরিত্যপূর্ণ প্রবণতার সহাবস্থানে ও যুগপৎ ক্রিয়াশীলতায় আসলে মানুষ কী করে? বার বার নিজের কাছে হেরে যাওয়া মানুষ এই প্রবাদটিকে চিরায়ত করে রেখেছে যে, সর্বদাই মানুষের শঠ প্রবণতাই হেরে যায়। সর্বদাই, আখেরে ভালোই জিতবে—এই ধারণার মধ্যে নিশ্চিত আত্মপ্রবঞ্চনা আছে। কিংবা মন্দের কদাচিৎ বিজয়ও এই মানুষেরা মানতে রাজি নয়। যখন এই বৈপরিত্যের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সত্তার মানুষেরা সমাজ নির্মাণ করে আর চুক্তিবদ্ধ হয় আত্মমঙ্গলাকাঙ্ক্ষার সংস্থিত পন্থায় তখন তারা এক গোলকধাঁধায় আটকা পড়ে আজন্মমৃত্যুকালে। মানুষের সমাজে এই বৈপরিত্যের দ্বন্দ্ব কখনো শেষ হয় না। ফলে মানুষের গল্পেরও শেষ নেই। মানুষের গল্পের প্রাণ আছে এই দ্বন্দ্বের ভিতরেই। এই দ্বন্দ্বের দোলায় মানুষের ‘মানুষ’ হওয়ার কাঙ্ক্ষাটি কখনো কখনো পরিহাসে পারিণত হয়। মানুষ সত্তার ধারণা যখন মরীচিকা প্রায়, ছুঁতে গেলেই নাই ধরনের তার পরিণতি যখন, তখন মানুষ তার সমগ্র বৈপরিত্য দিয়ে নির্মাণ করতে চায় তার দৃশ্যমান অবয়ব আর তার নাম দেয় সমাজ। ফলত, সমাজ জটিল ও সংঘাতশীল। আখেরে সমাজ ধারণার মাঝেও মানুষের স্বরূপ কেমন অধরা থেকে যেতে থাকে মানুষের মেকি শুভাকাঙ্ক্ষী মনোরচনার ভিতরে। আমরা যেমন দেখি, মা তার দুষ্ট সন্তানের পরিপোষণের সার্থে প্রয়োজনে শিষ্ট সন্তানটিকেও বঞ্চিত করতে পিছ-পা হয় না। মানুষ তার শুভপ্রত্যাশার আড়ালেই তার অসুরবৃত্তি কিংবা তার প্রকৃতিগত পাশবিকতাকেই পুষ্ট করে চলে অন্তরালে, কিন্তু প্রকাশ্যে চলে তার শুভের জয়গান! প্রকৃতির সন্তান অন্যান্য পশু কিংবা প্রাণিরই মতো মানুষ কি মূলত পশু নয়? এই প্রশ্নের মীমাংসায় গেলে আখেরে মানুষের সভ্যতা, ইতিহাস ও সমাজ-উন্মার্গের অহংকার ধূলিস্মাৎ হয়ে যায়। মানুষ এই প্রশ্নসমূহকে এড়াতেই চায় বোধহয়। ফলে, মনে হতে পারে, এমন মনে করাই হয় যে, মানুষ কতো সরল! প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে এভাবে মানুষ বুঝতে গেলে সমাজ বোঝা যায় না। আর সমাজের জটিলতাকে সত্যতায় যাচাই করতে করতে, এভাবে সমাজ বুঝতে গেলে আর মানুষ বোঝা হয় না। তখন মানুষই থাকে অধরা। ফলে মঞ্জু সরকারের গল্পগুলো মানুষের জন্য আসলে কী করে! মানুষকে বদলে দিতে পারে? সমাজের বদলের নামে আসলে মানুষ কিসের বদল ঘটাতে চায়, মানুষের বদল প্রসঙ্গকে পাশ কাটিয়ে? ফলে, বরং, মানুষকে মানুষের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হয়। এই রাজনৈতিক গল্পগুলো এই কাজটিই করে; মানুষকে মানুষেরই মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। এ মূলত মানুষকে মানুষ বোঝানোরই প্রচেষ্টা। মানুষ বুঝে নিলে বরং সমাজ বোঝা সহজতর হতে পারে। সমাজবোধে কোথাও খামতি থেকে গেলে বরং মানুষ বোধের অসম্পূর্ণতাকে অনুসন্ধানে আনা জরুরি। কালে ও চর্যার পরিসরে মানুষ এতো ব্যাপ্ত যে তার সবটুকুকে একসাথে দৃষ্টিতে দেখা তো দূরের প্রসঙ্গ, তাকে বোধেই ধরা যায় না সামগ্রিক অবয়ব ও স্বরূপে। ফলে মানুষ সংকীর্ণ হতে থাকে। সে কালিক ও স্থানিক বিভাজনে সমগ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বরূপ সন্ধানে মাতে। সংকীর্ণ মানুষ এই অধরাকে ধরতে নির্মাণ করে এক যন্ত্র, তার নাম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের ফাঁদে কি মানুষ ধরা যায়? সংকীর্ণ মানুষকে ধরা যায় বোধহয়, কিংবা মানুষের কদর্যের ক্যানভাস হয়ে ওঠে মূলত রাষ্ট্রযন্ত্র। আর এই যন্ত্রের যে পরিচালন পদ্ধতি, তার নাম রাজনীতি। সমাজে মানুষের যে ব্যাপকবিস্তৃত সম্পর্ক জাল তথা সমাজকাঠামো, রাজনীতি তার স্বার্থচিহ্নিত সূত্রটিকেই চিহ্নিত করে। ফলে সমাজকাঠামোর ব্যাপকতাকে রাজনীতির সংকীর্ণ অবয়বে চেনা যায় না। সে কারণেই রাজনীতিও তখন মানুষের ব্যাপ্ত অবয়বকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু, এই স্বার্থচিহ্নিত মানুষের আদলটি প্রকটিত হয় দারুণভাবে। ফলে শিল্পীও তখন মানুষের ছবি আঁকতে গেলে, মানুষের কথা বলতে গেলে এই রাষ্ট্রযন্ত্রের কথাই বলে। তখন তার ভিতরে রাজনীতির যে ধারণা ক্রিয়াশীল থাকে তাও যথার্থ উদার থাকে না। কিন্তু, মানুষের সামগ্রিক সমাজকাঠামোকে বুঝবার মননকৌশলই কি প্রকৃত অর্থে রাজনীতি বলে চিহ্নিত হবার কথা নয়? হ্যাঁ, সেটাই তো হবার কথা, কিন্তু, রাজনীতি মানুষের ত্রস্ত প্রবণতায় সংর্কীণ আদলেই মননে, বোধ ও চর্চায় রূপ পেয়েছে। সমগ্রকে ধরা হয়তো দার্শনিকের কাজ। এখানে কেবল রাজনীতি ও অর্থনীতির কার্যকারণসূত্র নির্ণয়ই যথার্থ কথা নয়। কিন্তু, মহৎ শিল্পী তো দ্রষ্টাও হয়ে থাকেন। তবু, দার্শনিক কিংবা মহৎ শিল্পী-দ্রষ্টা যিনি, তিনিও, কখনোই মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, রাষ্ট্র—এইসবের যে বিপরীত প্রবণতা, স্বভাবসিদ্ধ বৈপরিত্য, এই বৃত্ত কিংবা গোলকধাঁধার বাহিরে যেতে পারে না। মানুষের রাজনীতি ও জৈবিকতার দ্বন্দ্ব-তৎপরতা তথা অর্থনীতির মূলমন্ত্র নির্ধারণ করতে পারাটাই আদর্শ মানুষের আদল চিহ্নিত করণে যথেষ্ট হয় না। ফলে, মানুষের দার্শনিকতাও মানুষ ধারণার কোনো কূল-কিনারা করতে পারেন না। মহান কথাশিল্পী যিনি, তিনি কেবল অতীত ও বর্তমানের বয়ানই রচনা করেন না, তারা হয়তো ভবিষ্যদ্দ্রষ্টাই হন এবং মানুষের মঙ্গলজনক ভবিষ্যতের রূপরেখা আঁকতে পারেন; কিন্তু, মানুষের সভ্যতার বয়ান তো অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে মূলত একই থাকে; তাই নয় কি? ফলত, মনে হয় যে, তারা তাদের কল্প-ভবিষ্যতে গিয়েও মূলত ভূতই দেখেন আর লেখেন অনুত্তীর্ণ মানুষের গল্পই। বরং বলা ভালো যে, তখন মূলত, ভূত তথা বর্তমানই ভবিষ্যতে রূপায়িত হয়, বা ভূতই তখন ভবিষ্যতের অতীত হয়ে পুনঃ জন্ম নেয়, আর তখন মানুষ ও সমাজ স্বয়ম জাতিস্মর। জাতিস্মর, সে-ও এক বৃত্ত। এই জাতিস্মরের বিবৃতি থেকেও মানুষের আশাশীল ভবিষ্যতের রূপরেখা পাওয়া যায় না। ফলে প্রশ্ন তো জাগতেই পারে, শিল্পীর দেখা ভবিষ্যৎ কেমন? মানুষের ভবিষ্যৎ কি এই বৃত্তের বাহিরে যেতে পারে? কিংবা মানুষের ভবিষ্যৎ কি একই কিংবা আরেক অনুরূপ বৃত্তে গিয়ে পতিত হয় না? এই-ই তো মানুষের সমাজ-সভ্যতার পরিবৃত্ত; নয়? এই পরিবৃত্তে কান পাতলেই শোনা যায় মানুষের রাজনৈতিক গল্পকথাসমূহ যা কিছুতেই মানুষের অহংগাথা নয়। মানুষের সামাজিক ইতিহাস, ইতিহাসের বৈবর্তনিক পরিরেখা, সভ্যতার পরিবর্তরীতির মৌলকথা আর মানুষের সংস্কৃতি নির্মাণের অহংকার; এই সবই মূলত মানুষের রাজনৈতিক গল্পের অন্তর, সাঁস। মানুষের গল্পগুলো স্থানিক পরিচয় অতিক্রম করে তখন বৈশ্বিক ও মহাস্থানিকও হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক গল্প মূলত মানুষের ধাঁধাশীল যাপনবয়ান। মানুষ তার এমন ধাঁধাশীল যাপনে আবিষ্কার করে ফেলে তার কিছু মৌলিক অনুভব—আত্মগ্লানি, ঘৃণা, অন্তরদহন, দ্রোহ; আরো অনেক কিছু… মঞ্জু সরকার কি তার গল্পে অতীত ও ভূতের ভিতরে ভবিষ্যৎ দেখান? তিনি কি দ্রষ্টা? রাজনৈতিক গল্পসমূহ কি লেখক মঞ্জু সরকারকে দ্রষ্টারূপে চিহ্নিত করবে? এই প্রশ্নের মীমাংসার জন্যও মানুষের মাঝে নানান সাহিত্যতাত্ত্বিক পদ্ধতি ও মনোভঙ্গি বিরাজমান। সেও মানুষের সংকীর্ণ বা সীমায়িত স্বরূপের আরেক ঝলক। ফলে সাহিত্যের, সাহিত্যিকারের ও শিল্পীর কীর্তিগুণ বিচারের ময়দানে সেও এক রাজনীতিরই প্রসঙ্গ তুলে আনে। ফলে শিল্পের বিচারেও অপরিহার্য ও শেষ কথা বলে কিছু হয় না। এও মানুষের দ্বিধা ও দ্বান্দ্বিকতারই ফসল। এই-ই সব সাহিত্যে উঠে আসে। মানুষের দ্বান্দ্বিক স্বরূপের নিরিখে মানুষের অতীত, ভূত ও ভবিষ্যৎ একাকার হাতে পারে এখানে। সাহিত্য হয়তো আয়নাই হতে চায়, কখনো পারেও বটে। কিন্তু, মানুষের আত্মদেখার চোখ যদি বিভ্রান্ত হয় কিংবা কোনো কিছুর দ্বারা স্বার্থপক্ষের অধীন হয়ে পড়ে তো সে হয়তো আত্মদর্শনে বিফল হবেই। ফলে, তখন শিল্পীর ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা হবার প্রচেষ্টা বাতুলতা। কিন্তু, তবু, মঞ্জু সরকার মানুষের দ্বান্দ্বিক স্বরূপটিকেই দেখান তার গল্পে। ফলে মানুষের অমোঘ ভবিষ্যৎ চিত্রিত হয় গল্পে বর্ণিত মানুষের অতীত ও বর্তমান সংঘটনাসমূহের বয়ানে।
উপরে যেমনটি বলা হলো, তার কি কোনো মানে দাঁড়ায়? কিছু জ্ঞাপনযোগ্য হয় অর্থবৈভবে? হয়, মানেও দাঁড়ায়, কিন্তু অর্থটুকু আর সংজ্ঞায়নের মতো অল্পকথায় সারৎসারে বলা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কবিতার দুটি লাইন তরজমার বেলায় যতোগুলো লাইন লিখিয়ে নিতে পারে এবং অবশেষেও যেমন সব বলা হয়ে ওঠে না, তেমনি এই কথাগুলো। কখনো আমরা এমন কিছু অনুভব করি যা আমাদেরকে অনির্দিষ্ট বহুভাবনামুখে এনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। তখন অনেক কথা বলেও প্রকৃত অনুভবটুকু বলা হয়ে ওঠে না। কথায় জ্বালা জুড়ায় না। খুব নীরব হয়ে থাকলে হয়তো তার কিছু উপশম হয়, কিন্তু চূড়ান্ত সুরাহা হয় না। এমন পরিস্থিতির নামই বোধহয় ‘গুম হয়ে থাকা’। তবু, এই বলতে না-পারা কিংবা প্রকৃতই বুঝতে না-পারার মধ্যেও একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত থাকে অনুভবের, আর তা হলো মানুষের প্রতি, সমাজের বা রাষ্ট্রের প্রতি এবং পরিশেষে নিজের প্রতি মানুষের অনাস্থা। অনাস্থা জাঁকিয়ে তোলে অন্তরগত নৈরাশ্যকে, প্রতিপালন করে চলে গোকুলে বাড়া ঘাতকরূপ ভিতর-বাহিরের নৈঃসঙ্গকে আত্মঘাতী রূপে এবং এই পরিস্থিতিকে সমাজতাত্ত্বিকগণ নাম দিতে পারেন ‘বিচ্ছিন্নতা বোধ’। এই বোধের কাছে মানুষ নিঃসহায়! পুঁজিশাসিত আধুনিক বা উত্তরাধুনিক সমাজে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের চেতনায় পুষ্টিসাধনের সাথে সমান্তরালে বাড়ে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা বোধ। সমাজ বাস্তবতায় একের বোধ অন্যকে তখন বিশেষ স্পর্শ করে না কিংবা এই নৈরাশ্যজনক একান্ত বোধটুকু অন্যতে সঞ্চার হবার সুযোগও তৈরি হয় না, হতে দেয় না তা সমাজ ও রাষ্ট্রিক বাস্তবতা। তখন শিল্প-সাহিত্যই পারে একের অনুভবটুকুকে বহুজনে সঞ্চারিত করতে, ছড়িয়ে দিতে। রুগ্ন সমাজকাঠামোয় এভাবেই সাহিত্য-শিল্প মালার সুতার মতো গেঁথে চলে মানুষের আন্তঃসম্পর্ককে। সমাজকাঠামোর রুগ্নতাকে সারিয়ে তুলতে পারে, তুলতে চায়। দ্রোহ কিংবা বিপ্লবের সুতিকাগারও হতে পারে এই মাধ্যম। বিপ্লবীর গোপন শিক্ষকের ভূমিকায় তখন শিল্প-সাহিত্য। তবে, তেমন কাজের, উপযোগিতার সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন খুব কম লেখকই। এমন উৎকর্ষে সৃজিত হলে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ আর ‘কাজের শিল্প’ এক রেখায় এসে মিশে যায়; তখন শিল্প বিষয়ে এমন দ্বিমুখী তাত্ত্বিক ভাবনার আর কোনো বিরোধ কিংবা বিতর্ক থাকে না। এমন সৃজনের অন্যতম স্রষ্টা হলেন কথাসাহিত্যকার মঞ্জু সরকার। তার রাজনৈতিক গল্পের নিবিড় পাঠান্ত অনুভব পাঠাককে এমন অনুসিদ্ধান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে।
রাজনৈতিক গল্প নিয়ে কথা আরো বাকি। মূলত ‘রাজনৈতিক গল্প’ নিয়ে কথা পাড়লেও কেবল সংকলিত গল্পগুলোতেই গণ্ডীবদ্ধ থাকা সম্ভব হয় নি আসলে আলোচনার খাতিরেই। ফলে কথাচ্ছলে কথামূল গিয়ে ঠেকেছে, ঠেকছে লেখকের সামগ্রিক ছোটগল্প সম্ভারে। প্রকৃতই এই ‘রাজনৈতিক গল্প’ সম্ভারের আলোচনায় গণ্ডীবদ্ধ থেকে ‘রাজনৈতিক গল্প’র আলোচনা ও তাৎপর্যার্থ যথাথর্তরূপে জ্ঞাপিত হচ্ছিলো না। এখানে যে কথাটা বলতে বলছি তার অর্থ গ্রন্থের নামকরণের সার্থকতা বিচার নয়, বরং গল্পগুলো নির্বাচনের কালে নির্বাচক তার চিন্তায় রাজনীতির যে বোধ ও ধারণা পুষে রেখে গল্পগুলো নির্বাচন করেছিলেন তা নিয়েও কিছু কথা। এমন আলোচনা কিংবা সমালোচনার ছলেই কিছুটা ছোঁয়া যাবে রাজনৈতিক গল্পের ধারণাকাঠামোকে। আমার মনে হয়েছে নির্বাচনের বেলায় রাজনীতির একটি সংকীর্ণ ধারণাকাঠামোই এই গল্পগুলো নির্বাচনে তাড়িত করেছে নির্বাচককে। নতুবা, মঞ্জ সরকারের গল্পসম্ভারের আরো কতো গল্পই না এই সংকলনে গ্রন্থিত হতে পারতো রাজনৈতিক গল্প হিসেবে। অধিক উদাহরণ দেবার দরকার পড়বে না, কেবল একটি উদাহরণেই ধরা পড়বে আমার এই অনুযোগের প্ররিপ্রেক্ষিতটি। লেখকের ‘রূপান্তরের গল্পকথা’ গ্রন্থ থেকে একটি গল্প দলেবলে ও বিলবোর্ডেও হুমায়ুন সংকলিত হয়েছে। আমার জিজ্ঞাস্য, উক্ত গ্রন্থের টাকার উপরে মেয়েটি গল্পটি কেন এই সংকলনে স্থান পেলো না? রাজনীতির সাথে ‘ক্ষমতা’ বিষয়টিকেই প্রধানত আশ্লিষ্ট করা কর্তব্য। এবং এবারে মোক্ষম প্রশ্ন—মানুষের কোন অনুষঙ্গটি আসলে ক্ষমতার অনুষঙ্গ নয়? মহামতি কার্ল মার্ক্সের ‘ক্যাপিটাল’ কি কেবল অর্থনীতির গ্রন্থ, রাজনীতির নয়? ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যদি হয়ে থাকে সর্বহারা আর পুঁজিপতিদের মধ্যে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি যখন এখানে কেবল বানরের রুটি ভাগের ভূমিকায় তখন রাজনীতি কীভাবে অর্থনীতির আলোচ্যের বাহিরে থাকতে পারে? ক্ষুধা ও ক্ষুধার্তের গল্পটিও কি রাজনৈতিক গল্প নয়? বাস্তুহারা দেহপসারিনীটির গল্পও কি রাজনৈতিক গল্প নয়? একজন কিশোরের কিংবা কিশোরীর, সংসারে সংগ্রামশীল পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের কিংবা একজন প্রৌঢ়ের গল্পও কি রাজনৈতিক গল্প নয়? রাজনীতির পরিসীমা কি এতোই সংকীর্ণ! উৎপাদন কাঠামো যখন মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপকার তখন সমাজ, সংস্কৃতির রূপান্তর তথা বিকাশ কিংবা অবক্ষয় পরিপ্রেক্ষিত কীভাবে অর্থনীতি ও রাজনীতি ধারণাকাঠামোর বাহিরে থাকতে পারে? ফলে, ‘রূপান্তরের গল্পকথা’র দলেবলে ও বিলবোর্ডেও হুমায়ুন গল্পটির মতো টাকার উপরে মেয়েটিও খুব যৌক্তিকভাবে রাজনৈতিক গল্প হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এবং শুধু তা-ই নয়, ‘রূপান্তরের গল্পকথা’ স্বয়ং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক গল্পের অভিধা পেতে পারে, কেন না, মানুষ নিয়ে বলা যেকোনো কথাই রাজনীতির উঠনে পা রাখে, রাখেই। ফলে, জন্মেই মানুষ রাজনৈতিক প্রাণি—মহামহিম দার্শনিক এ্যারিস্টটলের এই দাবি নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু অস্বীকার করা চলে না। রাজনীতি সর্বদাই ক্ষমতাকেন্দ্রিক, কিন্তু, রাজনীতি কেবলই রাষ্ট্র ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক নয়। মানুষের প্রাত্যহিক সকল উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সাথেই রাজনীতি সংশ্লিষ্ট এবং সংশ্লিষ্ট থাকে মানুষের ক্ষমতার দ্বন্দ্বও। রাজনীতির বীজ সম্ভবত উপ্ত আছে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা ও তার আত্মরচিত কিংবা এমনভাবে বলাই যেতে পারে যে, মানুষের আত্মচরিত ফাঁদরূপ স্বয়ম স্বার্থ বুদ্ধির ভিতরে। তবে, ক্ষমতার ধারণাটি হয়তো মানুষের রাজনীতিচেতনার উন্মেষপূর্বকাল থেকেই মানুষের সমাজে বিরাজিত, কিন্তু হয়তো তা মানুষের চেতনায় তা ছিলো অনাবিষ্কৃত ও সহজাত সুপ্তরিপু হিসেবে। এ নিয়ে ভিন্ন মত চলতেই পারে, কিন্তু দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল মানুষের সমাজের ক্ষমতাকাঠামো ও ক্ষমতার ক্রিয়াপদ্ধতির যে ধারণা দেন, তা সহসাই নাকচ করে দেয়া যায় না এবং ক্ষমতা বিষয়ে কোনো একক সিদ্ধান্তে স্থিরও হওয়া যায় না। ফলে, মানুষ ও মানুষের সমাজের উন্মেষ ও লয়কালের মধ্যস্থিত সংঘটিত, সংঘটিতব্য সমগ্র পরিস্থিতি, সকল বাস্তবতায় ও মানুষের সকলরূপ অস্তিত্বের সাথেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। এখন তবে একটি অনুসিদ্ধান্ত দিতেই পারি যে, মানুষের গল্পমাত্রই রাজনৈতিক গল্প। নয় কি? মঞ্জু সরকার তবে মানুষের গল্পই লিখেছেন, মানুষের জন্য, আত্মপ্রতিকৃতির বয়ানরূপে!
কথার এই পর্যায়ে বক্তব্যের কেন্দ্রে, ভূমিকার কেন্দ্রাবদ্ধ কিন্তু ক্রেন্দ্রাতিগ বয়নাভিমুখ তথা কথার বৃত্তে ফিরে আসি। কথা বলছিলাম মানুষের স্বভাবের বৈপরিত্য, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতশীলতা নিয়ে। দ্বান্দ্বিকতাকে মানুষ এড়াতে পারে না। প্রকৃতির অংশ হিসেবে, প্রাণিকুলের সদস্য হিসেবে ও মানবসমাজের রূপকার হিসেবে দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি মানুষের অস্তিত্বে অমোঘ। অমোঘ মানুষের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক সংঘাতও। পূর্বেই বলেছি, মনে হতে পারে এই দ্বন্দ্বটি আসলে বাইনারি, কিন্তু এই বানারির অন্তর্দ্বন্দ্ব আসলে বহুস্তরিত, বহুমুখী ও বিচিত্র চরিত্রের। এই চারিত্রিক বিচিত্রতার কারণেই মানুষ খুব সহজেই ভাববাদী হতে পারে এবং হতে পারে চরম যুক্তিনিষ্ট ও কার্যকারণের দাস তথা বস্তুবাদী। মানুষের সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহও এই বৈপরিত্যপূর্ণ চরিত্রের। ফলে প্রাতিষ্ঠান হিসেবে কেবল রাষ্ট্রই নয়, সমাজের প্রথা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সামাজিক-সাস্কৃতিক সংস্কারসমূহও স্বয়ং আরেক দ্বন্দ্বমূলক পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে রূপান্তরিত হয়। মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের এই হাতিয়ারগুলো একসময় ফ্রাঙ্কেনস্টাইন রূপে আবির্ভূত হয়, মানুষ বাঁধা পড়ে নিজেরই জালে। বেড়া ক্ষেত খেতে থাকে। রুশোর সামাজিক চুক্তির ধারণা যখন আধুনিক রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা পায় তখন রাষ্ট্র আর সর্বমাঙ্গলিক, প্রজাপালক থাকে না; বরং রাষ্ট্র যন্ত্ররূপেও স্বয়ংক্রিয়তা অর্জন করে এর অন্তর্গত ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। প্রথা, প্রতিষ্ঠানসমূহ রূপান্তরিত হয় বটে অবস্থাগত রূপে, কিন্তু এর দ্বান্দ্বিক চরিত্রের কোনো রূপান্তর হয় না। ফলে, সামাজিকক্রিয়াশীলতা সর্বদাই গতির সাথে স্থিতিরও যুগপৎ ব্যবস্থা। আসলে বলতে চাইছি মঞ্জু সরকারের গল্পগুলো মানুষের দ্বান্দ্বিক প্রকৃতিকেই জলজ্যান্ত ক্রিয়াশীলরূপে আমাদের দেখিয়ে দেয়। মানুষের এই প্রকৃতিজ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতপ্রবণতা রাজনীতির ধারণাকে আর গতানুগতিক বিবেচনা অনুরূপ সরল ও সংকীর্ণ বিবেচিত হতে পারে না।
কিছু প্রশ্ন আমাকে বিমূঢ় করে। কেন একটি রাষ্ট্র অন্য আরেকটি রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, অনেক অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়? কেন একজন মানুষ অপর মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে যখন তা তার পর্যাপ্তই রয়েছে? কেন সম্পদশালীকে আরো বেশি সম্পদের মালিক হতে হয় আর কেন তার সম্পদলিপ্সায় কোনো সীমা নির্ধারণ করতে পারে না সে? আসলে কিছু প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন মূলত একটাই; মানুষ আসলে কেন আত্মঘাতী হয়? সার প্রশ্ন; কেন মানুষ আত্মবিরোধী? তার আত্মবিরোধের মূল তবে প্রকৃতিই? এই আত্মবিরোধের কি কোনো সুরাহা নেই? মানুষের আত্মবিরোধ কি নিয়তির মতো, অমোঘ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে মানুষের সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্ব পাঠ অবশ্য জরুরি। জরুরি মানুষের ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতাকে জানা। ইতিহাসের দ্বান্দ্বিকতা অধ্যয়ন তো আসলে কার্যকারণ বিধিসিদ্ধ সাংস্কৃতিক বিবর্তনেরই অধ্যয়ন। ফলে, মঞ্জু সরকারের ‘রাজনৈতিক গল্প’ সংকলনের গল্পগুলোই শুধু নয়, তার অন্যান্য গল্পগুলোও যেমন ‘মৃত্যুবাণ’, ‘অবিনাশী আয়োজন’, ‘রূপান্তরের গল্পকথা’, ‘অগস্ত্যযাত্রা ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থসমূহ-সহ সামগ্রিক গল্পসম্ভারের বিষয়বৈভবকে এই সংস্কৃতির দ্বান্দ্বিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। সংস্কৃতিই তো মানুষের দ্বিতীয় প্রকৃতি। নয়? এমন প্রশ্নকে প্রশ্রয় দেয়ার কোনো অর্থ নেই, প্রয়োজনও নেই। সংস্কৃতির মানুষের দ্বিতীয় প্রকৃতি ও তার দ্বিতীয় সত্তা। মানুষের প্রকৃতিজ সকল প্রবণতা ও স্বভাবসমূহ ফলে ওঠে ধীরে ধীরে তার সংস্কৃতির ভিতরে তার দ্বিতীয় সত্তারূপে, অমোঘ নিয়তির মতো ও কিছুটা আত্মসৃজিত। এই আত্মসৃজন ক্ষমতাই মানুষের ভরসাস্থান। এই আত্মসৃজন ক্ষমতার কাছেই মানুষের প্রত্যাশা এবং এ-ই মানুষের সকল শুভ প্রবণতা ও সদগুণের আধার। মানুষের সকল মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার বীজ এই আত্মসৃজন ক্ষমতার ভিতরে উপ্ত হয় আশা, প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও আত্মনির্মাণকল্পরূপে। মানুষের এই পরিচয়ই তার দ্বিতীয় ঈশ্বরের রূপ কেন না, প্রকৃতিই মানুষের প্রথম ঈশ্বর)। মানুষের আত্মসৃজন ক্ষমতার ভিতরেই ফলে ওঠে প্রকৃতিজ মানুষ ধারণার বাহিরে আরেক মানুষ ধারণা, যা মূলত মানুষাদর্শ। এই মানুষই মানুষের আরাধ্য। এই আরাধ্য ও অধর মানুষ যতোক্ষণ পর্যন্ত মানুষের সমাজে বিজয়ী না হচ্ছে, বা বার বারই হেরে যাচ্ছে ততোক্ষণ পর্যন্তই মানুষের আত্মগ্লানি, অন্তর্দহন ও দ্রোহবোধের প্রশান্তি নেই। যতোদিন থাকবে এই আদর্শ মানুষ অধর, ততোদিন থাকবে মানুষের সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি চেতনার মৌল প্রয়াস মানুষের সভ্যতার ধারণাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করার দিকে। আর সেই সভ্যতার ধারণার মধ্যে থাকবে মানুষের আত্মসৃজন ক্ষমতার ব্যর্থতার অনুসন্ধান। মানুষের প্রকৃতিজ স্বভাব ও তার আত্মসৃজন ক্ষমতার দ্বন্দ্বই কি মানুষের বাইনারি আত্মবিরোধের মূল? তবে, প্রকৃতিজ স্বভাবের কাছে মানুষ বার বারই হেরে গেলে মানুষের বৈপরিত্যপূর্ণ প্রকৃতির কাছে মানুষের সভ্যতা ধারণাটির আর কোনো অবধারিত ইতিবাচক অর্থদ্যোতনা থাকে না। সভ্যতা তখন ইতি ও নেতির দোলায় দ্বিধান্বিত। ফলে মানুষের সভ্য হয়েও আর তার স্বস্তি নেই। আদর্শরূপে আত্মসৃজনে ব্যর্থতার গ্লানি মানুষকে তার সৃজিত সভ্যতার ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেই। আধুনিক হয়ে কিংবা উত্তরাধুনিক হয়েও, এমন কি, নৈরাজ্যিক সমাজবাস্তবতা থেকে বির্বতিত আধুনিক রাষ্ট্রে এসেও মানুষের আত্মবিরোধের কোপ সে সামলাতে পারবে না, পারছে না। এমন পরিপ্রেক্ষিতে মঞ্জু সরকারের ক্ষমতার সাথে থাকা, স্বতন্ত্র মানুষ, প্রিয় দেশবাসী, বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত আত্মীয়স্বজন, শান্তিপ্রিয় একজন ও মুক্তিযোদ্ধা আবকরের সেই গল্পটা গল্পসমূহে চিত্রিত প্রধান চরিত্রদের জীবন বাস্তবতা মানুষের সকল অহংকারকে ফিকে করে তোলে, নৈরাশ্যের সান্ধ্য আলো-আঁধারীতে মানুষকে মজাতে চায় অলোকেশ্বরের আত্মপ্রবোধরূপ মিথ্যায় ও ফাঁকিতে। এ মূলত আত্মপ্রবঞ্চনাই। নিজের কাছে হেরে যাওয়া মানুষেরা ঈশ্বর বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। সেও তো চোরাবালি। কিছু কি আছে যা মানুষের তলিয়ে যাওয়ার মুখে শক্ত ভূমি হতে পারে! হেরে গেলে বিজেতা ও বিজিত উভয়েই হেরে যায় যে! মানুষ হয়তো প্রকৃতই হেরে যেতে চায় না। তার প্রকৃতিজ স্বভাবের বিপরিতে তার আত্মসৃজন ক্ষমতাকে সে জয়ী করে তুলতে চায়। ফলে, মানুষের চরিত্রে দ্রোহপ্রবণতা আরেক সত্যি হয়ে বেঁচে আদর্শায়িত অধর মানুষের বিজয় কামনায় আরূঢ় রণরথে। দ্রোহের আঁচে সত্তাকে সকলেই রাঙিয়ে তুলতে পারে না, এও সত্যি। তখন মানুষের অনুভবে, বোধে গ্লানি নামের অভিব্যক্তি মুদ্রিত হয়। তখন মানুষের গ্লানিবোধ ও দ্রোহের আঁচ না পাওয়া পরিস্থিতির যে কবল, তাকে অন্তর্দ্বন্দ্ব রূপে চিহ্নিত করে সে স্বয়ং। ফলে, মঞ্জু সরকারের গল্পসমূহ ‘রাজনৈতিক গল্প’ শিরোনামেই নয় কেবল, বরং মানুষের গল্প হয়েই অধিক অর্থজ্ঞাপক, সফল।