
ভ্রমণ সাহিত্যের দশ দিগন্ত
‘ভ্রমণ সাহিত্য’ সাহিত্যের বিশেষ ধারা হিসাবে স্বীকৃত। পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ ভাষার অনেক বিখ্যাত লেখকগণ ভ্রমণ সহিত্য লিখেছেন। আবার অনেক লেখক আছেন শুধুমাত্র ভ্রমণ সাহিত্য লিখেই বিখ্যাত হয়েছেন। বাঙলা ভাষার ভ্রমণ সাহিত্যও বেশ সমৃদ্ধ। এই সমৃদ্ধির বুনিয়াদ অবশ্য বিখ্যাত কয়েকজন সাহিত্যিকের হাতে গড়া। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অন্নদাশংকর রায়, সৈয়দ মুজতবা আলীর মত সাহিত্যিক অনন্য সাধারণ ভ্রমণ সাহিত্য লিখেছেন যা এখন পর্যন্ত কেউ অতিক্রম করতে পারেননি। পরবর্তীকালে দুই বাঙলার অনেক জনপ্রিয় লেখক বাঙলা ভ্রমণ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
বাঙলা ভাষার সবচাইতে আদি ভ্রমণ সাহিত্য লেখেন বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (১৮৮৭-১৯৪৯ খ্রি.)। এই লেখকের ‘কালনা থেকে রংপুর’ নামক লেখাটিকে বাঙলা ভাষার প্রথম কোনো ভ্রমণ কাহিনীর প্রকাশিত রূপ বলা যায়। এটি কতটা ভ্রমণ সাহিত্য হয়ে উঠেছিল সে বিবেচনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এটি ছিল একটি ব্যতিক্রমী ভ্রমণ অভিজ্ঞতার প্রথম ভাষারূপ। একই সাথে বলা প্রয়োজন এর ভাষারীতিও ছিল বাঙলা আদি গদ্যভাষায়। উল্লেখ্য, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পিতামহ। ‘কালনা থেকে রংপুর’ ভ্রমণের ব্যাপ্তি ছিল ২৭ দিন। প্রায় একশ’ আশি বছর পূর্বে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে লেখক নৌপথে পশ্চিমবঙ্গের কালনা থেকে রংপুরে গিয়েছিলেন, তারই বর্ণনা রয়েছে লেখাটিতে। এটি মূলত দিনপঞ্জি হিসাবে লেখা। তখনো বাঙলা গদ্যভাষা পরিণত হয়নি। সাহিত্যিক রূপও গড়ে উঠেনি। ফলে এই ভ্রমণ কাহিনীতে আমরা দেখি দাড়ি, কমা ইত্যাদি বিরামচিহ্নের ব্যবহার নেই। শব্দ ও বাক্য গঠন অপরিণত। ‘কালনা থেকে রংপুর’ এর ভাষারূপ এর একটা দৃষ্টান্ত:
“…১২৪৭ সাল তারিখ ১৫ কার্ত্তিক মোং কালনার গঞ্জ হইতে শ্রীতিলকচন্দ্র কুণ্ডুর তহবিলের শ্রীবেঙ্গু মাজির নৌকায় আরোহণ হইয়া ঐ দিবষ আন্দাজ দিবা এক প্রহরের সময় নৌকা খুলিয়া রাত্র আন্দাজ ছয় দণ্ডের সময় মোং শ্রীপাট নবদ্বিপের পূর্ব আন্দাজ দুই ক্রোষ পথ দূরে নৌকা লাগান হইল- তথায় পাক করিয়া আহারাদি করিয়া রাত্রে থাকা গেল ইতি…।”
কী বিচিত্র ভাষারূপ ছিল আমাদের প্রিয় বাঙলা ভাষার! এরপরও আরো বেশ কিছু পদ্য বা কাব্যের ঢংয়ে ভ্রমণ কাহিনী লেখা হয়েছে যার মধ্যে অনেক কল্পনামিশ্রিত বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। ফলে এগুলোকে সার্থক ভ্রমণ সাহিত্য বলা চলে না। বাঙলা ভাষার ভ্রমণ সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক অন্নদাশংকর রায়ের ভাষায়— ‘ভ্রমণ কাহিনী থেকে কোনো কোনো প্রসঙ্গ বাদ যেতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে কাল্পনিক উপাখ্যান মিশিয়ে দেওয়া উচিত নয়।’ এমন কল্পনা মিশ্রিত গদ্য বা পদ্যে লেখা বহু বাঙলা ভ্রমণ কাহিনীর নিদর্শন আছে। আধুনিক ভ্রমণ কাহিনীর অন্যতম রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভ্রমণ কাহিনী সম্পর্কে তার একটি উক্তি প্রণীধানযোগ্য। তিনি লিখছেন— ‘ভ্রমণবৃত্তান্তের একটা মস্ত সুবিধা এই যে, তার মধ্যে অবিশ্রাম গতি আছে অথচ প্লটের বন্ধন নেই- মনের একটি অবারিত স্বাধীনতা পাওয়া যায়।’ এই প্লটের বন্ধন থেকে মুক্তি এবং মনের অবারিত স্বাধীনতা শুধু লেখকের নয়, পাঠকেরও বটে।
অন্নদাশংকর রায় একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘সম্প্রতি প্রবন্ধ লেখকদের এক সম্মেলনে ভ্রমণ কাহিনীকারদেরও আসন দেওয়া হয়েছিল। তখন এই প্রশ্নটা আমার মনে ওঠে, ভ্রমণ কাহিনী কি প্রবন্ধের ঘরের পিসি, না কথাসাহিত্যের ঘরের মাসি? না একাধারে দুই?’
সার্থক ভ্রমণ কাহিনীকে একাধারে দুই’ই বলা চলে। কারণ একটি সার্থক ভ্রমণ সাহিত্যে একাধারে নানা বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনার চমৎকারিত্ব যেমন থাকে, প্রয়োজনীয় তথ্য যেমন থাকে— তেমনি বিচিত্র ও বাস্তব মানব চরিত্রের চিরকালীন রূপ দেয়ারও সুযোগ থাকে। স্থানের সাথে ঘটনার বর্ণনা, পরিবেশের বর্ণনা এবং একই সাথে বাস্তব মানবিক জীবনের বর্ণনার গুণে একটি সাধারণ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা সাহিত্যও অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে। বাঙলা ভাষায় প্রথম সার্থক ও ধ্রুপদী ভ্রমণ সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৪০-১৮৮৯) এর ‘পালামৌ’ তারই একটি দৃষ্টান্ত। এটি ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ১৯৮০-৮২ সালের মধ্যে ছয় কিস্তিতে প্রথম প্রকাশিত হয়। বিহারের ছোট নাগপুরের একটি জঙ্গলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতার অসাধারণ সাহিত্যিক রূপ ‘পালামৌ’ যা আজো ব্যাপক পাঠকপ্রিয় একটি লেখা।
ভ্রমণকাহিনী নানা বিষয় ও বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। কেউ ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন তীর্থ ভ্রমণ নিয়ে, কেউ লিখেছেন ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক কোন স্থান ভ্রমণ নিয়ে, কেউ নানা জাতিসত্তা বা আদিবাসীদের জীবন-সংস্কৃতি নিয়ে, কেউ বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে, কেউ পালা-পার্বন, উৎসব অথবা শুধুমাত্র কোন পর্যটন কেন্দ্রকে নিয়ে। কোন কোন লেখক একটা দেশের উল্লেখিত প্রায় সব বিষয়কে অধীত করে ভ্রমণকাহিণী লিখেছেন। এর সাথে একটি দেশের জীবন-সংগ্রাম, নানা ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে রাজনৈতিক ঘটনাবলীও যুক্ত করে সার্থক ভ্রমণ সাহিত্য রচনা করেছেন।
বাঙলা ভাষার কম আলোচিত অথচ সার্থক কিছু ভ্রমণ কাহিনী সম্পর্কে জানা যাক। রাজেন্দ্র মোহন বসু ‘কাশ্মীর কুসুম’ নামে একটি চমৎকার ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে। ব্যতিক্রমী ভ্রমণ কাহিনীর সাথে দুর্লভ ছবি সংযুক্ত করে দুর্গাচরণ রক্ষিতের বই ‘সচিত্র ভারত প্রদক্ষিণ’ [১৯০৩ খ্রি.] একটি উল্লেখ করার মত ভ্রমণ কাহিনী। ১৮৮৮-এ লিখিত শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘ইংলন্ডের ডায়েরি’ ভ্রমণ সাহিত্যের রস রয়েছে। ধর্মগুরুদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘পরিব্রাজক’ একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ মহেন্দ্রনাথের ‘বদ্রীনারায়ণের পথে’ও ভ্রমণসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রমণবৃত্তান্ত বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যা ১৮৯৮ খ্রিষ্টাবে প্রকাশিত ‘আত্মজীবনী’তে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
সেই যুগে নারীরাও পৃথিবীর পথে শুধু পা ফেলেননি ভ্রমণ কাহিনীও লিখেছেন। বাঙলা সাহিত্যে একজন নারী কর্তৃক লিখিত প্রথম ভ্রমণ কাহিনী হচ্ছে কৃষ্ণভাবিনী দাস রচিত ‘ইংলন্ডে বঙ্গমহিলা’। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণভাবিনী ইংল্যান্ডে যান। ইংল্যান্ডে তাঁর আট বছর অবস্থানকালীন সময়ের নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন এই ভ্রমণ কাহিনী। লেখাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ খিষ্টাব্দে। যদিও বইয়ে কোথাও লেখকের নাম ছিল না। তারপরও এটিই বাঙলা সাহিত্যে প্রথম কোন নারী কর্তৃক লেখা ভ্রমণ কাহিনী। ‘ইংলন্ডে বঙ্গমহিলা’ বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে লেখা কোন বাঙালি নারীর প্রথম ভ্রমণকাহিনী হলে স্বদেশ নিয়ে লেখা বঙ্গ নারীর প্রথম ভ্রমণ কাহিনী কোনটি? ‘আর্য্যাবর্ত্তে বঙ্গমহিলা’ নামক গ্রন্থটি ভারত ভ্রমণ নিয়ে লেখা। লেখক প্রসন্নময়ী দেবী। প্রকাশকাল ১৮৮৮।
বিংশ শতাব্দীতে বাঙলা ভাষায় অনেকগুলো চমৎকার ভ্রমণ সাহিত্য আমাদের একই সাথে দেশ ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাথে যেমন পরিচয় ঘটিয়েছে তেমনি সাহিত্যের নান্দনিক বোধে আমরা আনন্দ লাভ করেছি। এবার আমি বিশ শতকের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ সাহিত্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। প্রথমেই যে গ্রন্থটির কথা বলব সেটি হচ্ছে ভারতীয় প্রথম ভূ-পর্যটক বিমল মুখার্জির লেখা ‘দু চাকায় দুনিয়া’। ১৯২৬ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত সাইকেলে বিমল মুখার্জি পৃথিবীর প্রায় সবগুলো মহাদেশ ঘুরে ঘুরে একটি অনন্য সাধারণ ভ্রমণ সাহিত্য লেখেন ‘দু চাকায় দুনিয়া’ নামে । যদিও এটি প্রকাশিত হয় তাঁর বিস্ময়কর ভ্রমণ সমাপ্ত করার ৫০ বছর পর ১৯৮৬ সালে। সাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ করতে গিয়ে লেখকের বিচিত্র দেশ, প্রকৃতি, কষ্টকর ও বিপদসঙ্কুল পথের যাত্রার বর্ণনা এবং অসাধারণ সুন্দর সব মানবিক অভিজ্ঞতার কথা পড়ে পাঠক নিশ্চিতভাবে মুগ্ধ হবেন। এটি পাঠ করে পাঠক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলবেন— ‘ঘরকুনো বাঙালি’ও এমন ব্যতিক্রমী ও সাহসী ভ্রমণও করতে পারে? অবশ্য বিমল মুখার্জিদের পথ ধরে বাঙালি তার ঘরকুনো অপবাদ ঘুচিয়ে ফেলেছে অনেকদিন হল।
বাঙলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই বাঙলা ভ্রমণ সাহিত্যকে সবচাইতে বেশি সমৃদ্ধ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়রি’, ‘জাপানযাত্রী’, ‘পশ্চিমযাত্রীর ডায়রি’, ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’, ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘পারস্যে’ এবং ‘পথের সঞ্চয়’ আজো ভ্রমণ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নির্দশন হিবেবে বিবেচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বভাবসুলভ লেখনীতে বিভিন্ন স্থানের বর্ণনা, একট একটা জাতিসত্ত্বার নিজস্বতার পরিচয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়, সর্বোপরি বিচিত্র মানুষের কথা অসাধারণ মানবিক দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ সাহিত্যের অসাধারণ বর্ণনা ও এর ভাব সম্পদ আমাদের মননশীলতার বোধকে সমৃদ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ সাহিত্যের আকর্ষণীয় ভাষারীতি এবং বাধা-বন্ধনহীন প্রকাশভঙ্গি আধুনিক ভ্রমণ সাহিত্য রচয়িতাদের অনুকরণীয় একটি দৃষ্টান্ত।
এরপর যার কথা বলতে হয় তিনি হচ্ছেন অন্নদাশংকর রায়। তাঁর বহুল পঠিত ‘পথে প্রবাসে’ গ্রন্থটি অনন্য সাধারণ ভ্রমণ একটি সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। তাঁর অপর বিখ্যাত ভ্রমণ বৃত্তান্ত হচ্ছে ‘জাপানে’। অন্নদাশংকর রায়ের ভ্রমণ সাহিত্য পাঠেও আমাদের দারুণ সুখকর অভিজ্ঞতা হয়। অসাধারণ গদ্যশৈলীর সাথে পৃথিবীর রুপ-রস-গন্ধ এবং মানুষকে দেখার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের কাছে এক বিমুগ্ধ বিস্ময়।
বাঙলা ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হচ্ছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। অন্যান্য সাহিত্য কর্মের সাথে মুজতবা আলীর ভ্রমণ সাহিত্যও বাঙলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে বিপুল জনপ্রিয়। তাঁর আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতার উপর লেখা ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থটিকে চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা দেয়া হয়। এটিই তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। সৈয়দ মুজতবা আলী নাকি বলতেন, তিনি যত দেশ ভ্রমণ করেছেন সব দায়ে পড়ে। পারলে তিনি ঘর থেকে বেরই হতেন না। শুধু আনন্দ ভ্রমণের জন্য তিনি নাকি কখনো বাড়ি ছেড়ে বের হননি। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সৈয়দ মুজতবা আলীর কথাতে হয়ত সত্যতা আছে। উচ্চ শিক্ষা অর্জন কিংবা শিক্ষকতা পেশা নিয়ে তিনি জার্মানি বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন, কখনো গিয়েছেন মিশর, কখনো পাশের দেশ আফগানিস্তান। প্রতিটি দেশে তাঁর অভিজ্ঞতার বিবরণ তিনি অসাধারণ গদ্য শৈলীতে লিখে রেখেছেন। যা হয়ে উঠেছে আশ্চর্য সুন্দর ভ্রমণ সাহিত্য। সৈয়দ মুজতবা আলীর অন্যান্য সাহিত্যেও নানা ভাবে ভ্রমণের অনুসঙ্গ এসেছে। তবে নিছক ভ্রমণ সাহিত্য হিসাবে ‘দেশে বিদেশে’ ছাড়াও ‘জলে-ডাঙায়’, ‘চাচা কাহিনী’ এবং ‘মুসাফির’ উল্লেখযোগ্য তিনটি গ্রন্থ।
বর্তমান সময়ে মইনুস সুলতান ভিন্নধর্মী কাহিনী ও নিজস্ব একটা ভাষাভঙ্গিতে ভ্রমণ কাহিনী লিখে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন। এছাড়া ফারুক মঈনুদ্দিনও বেশ জনপ্রিয় একজন ভ্রমণ লেখক।
অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে অনেকেই এখন ভ্রমণ কাহিনী লিখছেন। কিছু কিছু লেখা গুণে ও মানে চমৎকার। তবে সাহিত্যমান সম্পন্ন ভ্রমণ কাহিনী এই সময়ে খুব বেশি লেখা হচ্ছে বলে মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ ও নবীণ অনেক লেখকদের বেশ কিছু অসাধারণ ভ্রমণ কাহিনী গ্রন্থাকারে বেরিয়েছে। পরবর্তী কোন এক সময় আমরা বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সমসাময়িক লেখকদের ভ্রমণ সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করব।
আরেকজন বিখ্যাত লেখকের কথা বলে আজকের আলোচনা শেষ করব। এই লেখক হিন্দিভাষী হলেও তাঁর সহজ সাবলীল বাঙলা অনুবাদের কারণে বাঙলাভাষী পাঠকের কাছে সমান জনপ্রিয়। আমরা বলছি বিখ্যাত পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন ও তাঁর ভ্রমণ সাহিত্যের কথা। তিনি বেশ কিছু কালজয়ী ভ্রমণ সাহিত্য লিখেছেন যা ভ্রমণ সাহিত্য পাঠকদের অবশ্য পাঠ্য। বহুভাষাবিদ রাহুল সাংকৃত্যায়ন হিন্দি, উর্দু, বাংলা, পালি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, তিব্বতি ও রুশ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। জীবনে প্রায় পুরোটাই তিনি ভ্রমণ করে কাটিয়েছেন। দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছর ধরে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে লিখেছেন ‘তিব্বতে সোয়া বছর’, ‘আমার লাদাখ যাত্রা’, ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’-এর মত চিরায়ত ভ্রমণ সাহিত্য। রাহুল সাংকৃত্যায়ন রাশিয়া, ইরান, ইউরোপ, জাপান ও শ্রীলংকার উপর ভ্রমণ সাহিত্য বা তথ্যমূলক গ্রন্থ লিখেছেন। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী এবং সরস অথচ পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণে রাহুলের প্রত্যেটা লেখা অনন্য। বিষয়ের গভীরতা, ভাষাশৈলী এবং অসাধারণ অনুবাদের গুণে মূল হিন্দিতে লেখা রাহুলের প্রত্যেকটি অনুবাদ গ্রন্থ বাঙলা ভাষাভাষী পাঠকের নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে।
চিরায়ত বাঙলা ভ্রমণ সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ হলেও এর ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত দুয়েকটি লেখা আমাদের চোখে পড়লেও এখনও বাঙলা ভাষার কয়েকজন প্রধান লেখকের কালজয়ী ভ্রমণ সাহিত্যই বিরামহীন আলো দিয়ে চলেছে। তবে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক উপলব্ধি এবং গভীর মানবিক চেতনার উন্মেষের মধ্য দিয়ে বাঙলা ভ্রমণ সাহিত্য আবার তার নতুন সৃষ্টিশীল পথের সন্ধান পাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।