
ভাল থেকো রূপপুর, ভাল থেকো
ঈশ্বরদী নামটি আমার কাছে শৈশব থেকে এক আলাদা এক দ্যোতনা তৈরী করত। আজও করে। রেলে চড়ে ঈশ্বরদী যাওয়ার স্বপ্ন ছেলেবেলা থেকেই। হয়ত কোন লেখা পড়ে বা কারো কাছে গল্প শুনে ঈশ্বরদীর প্রতি আকর্ষণ তৈরী হয়েছিল। হতে পারে এর বিশাল রেলওয়ে জংশন, পদ্মা নদী, পাকশী এলাকা, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কিংবা রূপপুর এর কথাই বেশি আসত। ভাবনার মধ্যেই ছিল এতকিছু কিন্তু সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তবে এবার ঈশ্বরদী যাওয়ার সুযোগ এসে গেল। বন্ধু ও ভাগ্নে সোহেল সিলেট থেকে এসেছে। সে প্রস্তাব করল কোথাও বেড়িয়ে আসার। বিশেষত সম্প্রতি সে ফটোগ্রাফিতে বেশ মজেছে। বেড়ানো ও ফটোগ্রাফি একসাথে দুই কাজ। তার ইচ্ছে উত্তরবঙ্গ যাওয়ার। শেষ পর্যন্ত আমরা ঠিক করলাম ঈশ্বরদী যাব। অবশ্যই স্বপ্নের রেল গাড়িতে চড়ে।
৮ এপ্রিল, ২০১৪-এর এক সুন্দর সকাল। আমরা ঢাকা বিমানবন্দর থেকে খুলনাগামী সুন্দরবন প্রভাতী আন্তঃনগর ট্রেনে ঈশ্বরদী উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। ৬:২০-এ কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি ঠিক ৬ টা ৫০ মিনিটে বিমানবন্দর স্টেশন কাঁপিয়ে প্রবেশ করে। সোহেলও একই সময়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে স্টেশনে এসে পৌঁছায়। ট্রেনের টাইমিং একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও আমাদের দেশে প্রায়শই এর ব্যাতয় ঘটে। এক সময় বহুল আলোচিত কথা ‘নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে’এই বাক্য দিয়ে ট্রেনের সময়সূচীর বিশৃঙ্খলার আভাস পাওয়া যায়। এখন অবশ্য ব্রিটিশ আমলের টাইমিং এর অনেক উন্নতি হয়েছে।

রেলের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অনেক মানুষের সাথে যেমন পরিচয় ঘটে, তেমনি পরিচিত মানুষের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে ফুরফুরা মেজাজে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। গন্তব্য যতই দূরের হোক, ভাল ভ্রমণসঙ্গী থাকা মানে সময় কীভাবে কাটবে তা টেরও পাওয়া যাবে না। পথিমধ্যে যমুনাসেতু পড়েছে যা বাংলাদেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এই সেতুতে দেশের মানুষ কতটাকা কতভাবে যে সারচার্জ হিসাবে দিয়েছিল! স্বপ্নে বুক বেঁধেছিল তখনকার সরকারের কথায়। মূলা ঝুলানো হয়েছিল এই যমুনা ব্রীজ হলে কৃষকরা যেমন যথাযথভাবে ফসলের দাম পাবে, ক্রেতারাও অনেক ন্যায্য মূল্যে কৃষিপণ্য ক্রয় করতে পারবে। কারণ পরিবহন খরচ যেমন কমবে তেমনি খুব দ্রুত কৃষক তার পণ্য শহরে বিক্রি করতে পারবে। বাস্তবে এর কিছুই ঘটেনি। বরং শহুরে দালালচক্র অতি সহজে যমুনা ব্রিজ পাড়ি দিয়ে গ্রামের দালাল চক্রের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। অথচ প্রকৃত কৃষক আরো বঞ্চিত হয়েছে তার ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে। অপরদিকে ক্রেতাদের দিনকে দিন চড়া দামে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে। আমাদের শাসকচক্র এভাবেই মানুষের সাথে নানা সময়ে, নানাভাবে ধোঁকা দিয়ে, প্রতারণা করে বড় বড় স্বপ্ন দেখিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করে।
বিবিধ বিষয় নিয়ে আড্ডায় এত মশুগুল ছিলাম যে কখন যে ঈশ্বরদী পৌঁছে গেলাম টের পেলাম না। অবশ্য ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ১১ টা অতিক্রম করে গেছে। সুন্দরবন প্রভাতী যখন ঈশ্বরদীর প্লাটর্ফমে প্রবেশ করছিল তখন দুয়েকজন যাত্রী বললেন- ট্রেনটি সময়ের আগেই পৌঁছে গেছে! আমরা ট্রেন থেকে নেমে বিশাল একটি ফুট ওভারব্রীজ ধরে ঈশ্বরদী শহরে প্রবেশ করি। সোহেল যাত্রাপথে বেশকিছু ফটোগ্রাফি করে। আমি ট্রেন থেকে নেমে রাজনৈতিক সংগঠক আবুল হাসান রুবেলকে ফোন দিই। সে ঈশ্বরদীরই ছেলে। জানতে চাই ইশ্বরদীতে কোথায় থাকবো এবং কী দেখবো ইত্যাদি। রুবেল জানায় রেলস্টেশনের কাছে, জামে মসজিদের সাথে হোটেল ইশ্বরদী হলো ভাল হোটেল। দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি বিবরণও দেয় সে।
হোটেল ঈশ্বরদীর ভাড়া একটি উপজেলা শহরের অনুপাতে বেশিই মনে হল। এটা একচেটিয়া ব্যবসার কারণে হয়েছে। বাকি হোটেলগুলো অবস্থা নাজুক। ইপিজেড সহ আরো কিছু শিল্প-কারখানা এবং বিভিন্ন যাত্রীদের রেল ভ্রমণের সময়সূচী রক্ষার জন্য অনেকেই স্টেশনের একেবারে লাগোয়া এই হোটেলে রাত্রিযাপন করে।

আমাদেরকে তিনতলায় একটি কক্ষ দেয়া হয়। কিন্তু কক্ষটিতে সরাসরি সূর্যালোক এসে পড়ায় ভয়ানক গরম লাগল। কিছুক্ষণ পরে আমরা স্টেশনে চলে যাই। স্টেশন সংলগ্ন একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সারি। এরপর বৈকালী মিষ্টান্ন ঘরে চমৎকার স্বাদের মিষ্টি চেখে দেখি। মিষ্টিগুলো আমাদের সামনেই গরম গরম চিনির সিরাপে ভিজিয়ে তোলা হচ্ছে। মালিক জানান, এগুলো ইরানী স্পন্জ মিষ্টি! আমার ভ্রমণসঙ্গীতো পারলে এখনই অর্ডার দিয়ে দেয় ঢাকা ও সিলেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য। হোটেলের কক্ষে ফেরার পথে স্টেশন সংলগ্ন বাজার থেকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আতাফল, বেল, সফেদা ইত্যাদি কিনে নিয়ে আসি। ফল বিক্রেতা বয়স্ক মানুষ। আমাদের হার্ডিঞ্জ ব্রিজে এখনই যাওয়ার কথা শুনে পিতৃসুলভ মমতায় বারণ করেন, ‘সাবধান, এই রোদে যাবে না, মারা পড়বে!’
আমরা হোটেলে ফিরে আসি। আরেকটু রোদ কমে এলে বেরুবো ভাবছি। নানা আলাপে সময় কাটে। খানিকটা ঘুমের চেষ্টা করি। কিন্তু উত্তরবঙ্গের ভয়ানক গরম ও মাঝে মাঝে নছিমনের ভটভটি শব্দের কারণে চেষ্টা করেও তন্দ্রাকে ঘুমে পরিণত করতে ব্যর্থ হই। এছাড়া লাগোয়া বিশাল জংশনের একটু পর পর ট্রেন আসা-যাওয়ার ‘নান্দনিক’শব্দতো আছেই।
বিকেলে একটা ব্যাটারীচালিত টমটম নিয়ে রওয়ায়ানা দিই পাকশীর উদ্দেশ্যে। যেখানে পদ্মা নদীর উপর অবস্থিত বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন সেতু রয়েছে। ঈশ্বরদী থেকে পাকসীর দূরত্ব প্রায় ৫ কি.মি.। পথিমধ্যে পড়ে রূপপুর মোড়। এইখানেই কর্মযজ্ঞ চলছে ১৫০ একরের বিশাল এলাকাজুড়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের। আমরা প্রধান সড়ক ধরে এগিয়ে প্রথমে মহাসড়কের উপর লালন সেতু ও তার থেকে ডান দিকে ৩০০ মিটারের মধ্যে রেলওয়ের হার্ডিঞ্জ সেতুর দেখা পাই। একেবারে সেতুর গোড়াতেই টমটমওয়ালা আমাদের নামিয়ে দেন। আলোকচিত্রী নেমেই যথারীতি ক্লিক করতে শুরু করে। একটা বিশাল মৌচাকের ছবি এদিক সেদিক করে সে খুব মনোযোগ দিয়ে তুলছিল। আমি এখানে স্থাপিত সাইনবোর্ডটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। এখানে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া আছে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১.৮১ কি.মি.। কলকাতার সাথে পূর্ববাংলার যোগাযোগের জন্য ১৯১৫ সালে এই রেলসেতুটি নির্মাণ কাজ শেষ করে ব্রিটিশ সরকার। স্থানীয় প্রশাসক মি. হার্ডিঞ্জ এর নির্মাতা। শত বছরের পুরনো সেতুটি দুই লেনে তৈরী। পায়ে হাঁটার রাস্তাও আছে। আমরা সিঁড়ি উঠতে গিয়ে দেখি কাঁটাতার দিয়ে উঠার পথ বন্ধ করে রাখা। স্থানীয় লোকজন জানান, সরকারী কোন বড় কর্তার মেয়ে উপরে উঠলে কয়েকটি বখাটে ছেলে উত্যক্ত করায় এটি দিয়ে পথচারীরর চলাচল একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মাথা ব্যাথা নিরসনে মাথা কেটে ফেলা আরকি।
আমরা পদ্মার পাড়ের বালির চর ধরে নদীর একেবারে কাছে চলে যাই। উপরে রেড অক্সাইড রঙের বিশাল ধাতব হার্ডিঞ্জ সেতু। মুড়ি-চানাচুর, বাদাম, শসা বিক্রেতারা তাদের ক্ষুদ্র পসরা সাজিয়ে বসেছেন। অপেক্ষা করছেন বিকেলবেলার স্থানীয় ভ্রমণকারীদের জন্য। নদীর ঘাটে বেশ কয়েকটি নৌকা দেখতে পাই। দুয়েকটি নৌকা আমাদের সাধাসাধি করে নদীভ্রমণের জন্য। ১৫ মিনিট পদ্মা ঘুরিয়ে আনবে ১০০ টাকায়। প্রখর রৌদ্রে আমি ও সোহেল না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এরমধ্যে একটি ফাইবারের তৈরী ইঞ্জিন নৌকা ঘাটে ভিড়ে। সেখান থেকে দুজন যুবক নেমে আমাদের কাছে আসে। এরাও তাদের বোটে ভ্রমণের জন্য আহ্বান জানায়। আমরা ‘না’ সূচক জবাব দিই। ইতোমধ্যে তারা স্থানীয় দোকানদার ও নৌকাওয়ালাদের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। গল্পের বিষয়বস্তু তাদের ক্ষমতা বলে তারা পদ্মার এই পাড়কে কিভাবে একটা ব্যবসা ও ‘বিনোদন কেন্দ্রে’পরিণত করবে তাই বলছিল। বুঝতে পারলাম এরা খানিকটা প্রভাবশালী ব্যক্তি। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে কিছুটা গায়ের জোরে কথা বলছে। কিংবা সরাসরি ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এরা যখন হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচের এই স্থানটি পরিষ্কার করে, বিশাল আকারের রঙিন ছাতা টাঙ্গিয়ে রেস্টুরেন্টসহ নানা ব্যবসার ফন্দিফিকিরের কথা বলছিল তখন বয়স্ক এক খাবার বিক্রেতা ও আরো দু’একজন হকারের মুখটা শুকিয়ে যাচ্ছিল। তারা হয়ত ভাবছে, এদের দাপটে ব্যবসা করতে পারবেতো? শঙ্কিত থাকলেও দোকানীরা এদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিল ক্ষমতাবানদের ‘মেঘা প্রজেক্টের’। নিরাপত্তার প্রয়োজনে মন্দ প্রভাবশালীকেও দূর্বলের সমর্থন দিতে হয় অনেক সময়। আমরা যখন চলে আসছিলাম তখন ক্ষমতাবানদের একজন পাবনার আঞ্চলিক ভাষার টানে বলছিল ‘ভাইয়েরা নৌকা চড়লেন না যে! না হয় বিনে পয়সায় ঘুরিয়ে আনতাম আপনাদের!’

আমরা নদী থেকে মূল রাস্তায় উঠার পথে নদীর পাড়ে একজন শসা বিক্রেতার কাছ থেকে শসা কিনে খাই। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার থেকে নদীর ওপারে সোলেমান খাঁ’র মাজারে জমজমাট মেলা বসবে। এখন থেকেই লোকজন আসা শুরু হয়েছে। বছরে দুইবার মেলা হয়। লক্ষ লোকের সমাগম ঘটে। বাউল গান ও নানা পসরায় জমজমাট হয়ে উঠে নদীর ওপারের সোলেমান খাঁর মাজার এলাকা। আমরা যখন পাকশীর রাস্তায় উঠতে যাবো তখন নদীর ঘাটে দুইজন মলিন কাপড় পড়া নারী ও পুরুষ দেখতে পাই। পুরুষটি দীর্ঘ শশ্রুমন্ডিত, সাথে একটি ঝোলা। বুঝতে পারি এরা সোলেমান খাঁর মেলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম, তারা সারাদেশের মাজারে মাজারে, আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে জীবন কাটান। পীর-ফকির-আউল-বাউল-সাধু-সন্নাসীদের ভক্ত এরা। এরাই জীবন্ত রেখেছেন অনেক বিখ্যাত-অখ্যাত মাজার ও আখড়াকে। মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানো এমনি বহু মানুষ আছেন। খুব জানতে ইচ্ছে হলো এই ‘মুক্ত’ যাযাবরের জীবন কী সুখের?
১৯৭১ সালে পাকবাহিনী সোলেমান খাঁ নামক ‘পাগল’ ব্যক্তিটিকে গুলি করে হত্যা করে। স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, সোলেমান পাগলাকে পাকবাহিনী বেশ কয়েকবার গুলি করে পদ্মা নদীতে ফেলে দিলেও অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে উঠেন। তার রক্ষাকবজ তাবিজটি যখন বাহু থেকে খসে পড়ে নদীর অতল জলে হারিয়ে যায়, তখনই পাকবাহিনীর একটি গুলি এসে সোলেমান খাঁ’র মৃত্যু ঘটায়।
এক কি.মি. পথ হাঁটার পর মনে হলো পাকসী বাজার পৌঁছাতে আরো এক কি.মি. হাঁটতে হবে। পথে যেতে যেতে চোখে পড়লো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে’র বাঙলো কুটির। এখানে রাশান ও দেশীয় আমলা, প্রকৌশলী, কর্মকর্তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সোহেল এখানে একটি গাছে বড় আকারের বিরল প্রজাতির দুটি পাখির ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, অদূর ভবিষ্যতে এই গাছ ও পাখি থাকবেতো? বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদরে স্পষ্ট ক্ষতির দিক তুলে ধরার পরও প্রকল্পের কাজ পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলেছে। অথচ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চেরনোবিল সহ বেশ কয়েকটি দূর্ঘটনার জন্য ‘নামডাকওয়ালা’ দেশ রাশিয়া। জাপানের মত উন্নত প্রযুক্তির দেশের ফুকুশিমা দূর্ঘটনার দগদগে ঘা এখনো শুকোয়নি। পৃথিবীর অনেক দেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে দূরে আসছে আর আমরা মহা উৎসাহ ও উল্লাসে এগিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যত দিক নির্দেশনা কী হবে এখনো স্পষ্ট নয়। এত সুন্দর পদ্মা, পাকশী অঞ্চল, গাছগাছালিপূর্ণ গোটা ইশ্বরদিই ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে শুধু তাই নয়, কখনো দূর্ঘটনা ঘটলে গোটা দেশের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চলই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
আমরা আবারো হাঁটতে থাকি পাকশীর দিকে। ইতোমধ্যে কালমেঘ ‘প্রবল প্রতাপশালী’ ক্ষমতাবানদের মত দখল নিয়েছে পুরো ঈশ্বরদীর আকাশ। খুব দ্রুত বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল। আমরা পথের পাশে নিঃসঙ্গ একটি টং দোকানের শেডের নিচে আশ্রয় নিই। তরুণ দোকানী ও তার থেকেও বয়েসে আরেক তরুণ মিলে দাবা খেলছিল। ইতোমধ্যে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য একজন লেইসফিতাওয়ালা এসে আমাদের সাথে দোকানে আশ্রয় নেন। বৃষ্টি এবার ব্যাপক আকার নিল। সেই সাথে শিলাবৃষ্টি। যেভাবে মেঘের সাজ দেখলাম তাতে মনে হচ্ছে বৃষ্টি দীর্ঘায়িত হবে। আমরা প্রায় ঘন্টা দেড়েক দাঁড়িয়ে, বসে গল্প করে কাটাই দোকানটিতে। এরমধ্যে থেমে থেমে চারবার শিলাবৃষ্টি হয়। বৃষ্টি চলে বিরামহীন। প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়ায় সময় কাটানোর সুযোগে আমরা দোকানদার ও লেইসফিতাওয়ালার সাথে নানা প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করি। দুই তরুণ দাবাড়ু খেলায় মগ্ন থাকলেও আমাদের সাথে টুকটাক কথাও বলছিল। দোকানী একটু বেশি পাকা খেলোয়াড়। কারণ ইতোমধ্যে একটি খেলায় সে জিতে গেছে। আরেকটি খেলা শুরু হয়েছে। দাবায় চাল দিতে দিতে দোকানী আমাদের উদ্দেশ্যে বলে, দাবা খেলায় নাকি বুদ্ধি বাড়ে কিন্তু কই সেতো তার জীবনে প্রমাণ পাচ্ছে না? বাস্তব জীবনে সে শুধুই মার খেয়ে যাচ্ছে। মৃদু হাসির মাধ্যমে বলার চেষ্টা করি আমরাও এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি!
কথায় কথায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা আসে। ওরাই জানায়, এই প্রকল্পে অধিকাংশ জায়গাই রেলওয়ের। বাকি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ব্যক্তি বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে। প্রকল্পের জন্য নদী ড্রেজিং করা হচ্ছে। কারণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুল্লীর জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন। দোকানদার ও লেইসফিতাওয়ালা শঙ্কিত এই প্রকল্পে স্থানীয় মানুষদের নিরাপত্তা নিয়ে। অবশ্য তারা একই সাথে আশাবাদী, এর মাধ্যমে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান হতে পারে। তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদুৎ পাবে। আমাদের কাছে এই বিষয়টি নিয়ে তারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আমরা যতটুকু জানি তাই বলতে চেষ্টা করি। বিপদজনকই হবে এই প্রকল্প। কারণ এত ঘনবসতিপূর্ণ দেশের কোথাও এমন ঝুকিপূর্ণ প্রজেক্ট নেয়ার যৌক্তিকতা নেই। বিদুৎ আমাদের খুব প্রয়োজন। তাই বলে জনবসতিকে ঝুকিপূর্ণ করে, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে নয়। তরুণ দোকানী হেসে বলে, বুঝতে পারছি দাবার বুদ্ধি আর বাস্তবের বুদ্ধির বড় তফাৎ। হেসে বলি, ঠিক তাই। আর নিজেরা কারো ঘুটিতে পরিণত হলেতো কথাই নেই।
অবশেষে বৃষ্টি একটু ধরে আসে। লেইসফিতাওয়ালা তার ক্ষতি কিছুটা পোষাতে এই বৃষ্টির মধ্যেও দৌঁড়ে চলে গেল পাকশী বাজারের দিকে। আমরাও প্রথমে দ্রুত হেঁটে, পরে দৌঁড়াতে থাকি পাকশীর দিকে। কারণ বৃষ্টি আবার শুরু হয়ে গেছে। অতঃপর দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে পাকশী বাজারে পৌঁছে যাই। পাকসী বাজারে একটি চা দোকানে বসে আদাসহ কড়া লিকারের রং চা পান করে শরীরটা বেশ চাঙ্গা লাগে। এখানে একজন অকৃতদার ব্যক্তির সাথে অন্য স্থানীয় দু’জন ব্যক্তি, যাদের দেখে মনে হয় তারা হয়ত কৃষিজীবী হবেন, আলাপচারিতা শুনে আমরা মনোযোগী হয়ে উঠি। অকৃতদার ছোটখাটো মানুষটিকে উচ্চারণে কলকাতার লোক বলে ভ্রম হবে। তিনি পাবনারই স্থানীয় বাসিন্দা। পাকশীতে হয়ত অনেককাল থেকে বসবাস করছেন। অনুমান করি, তিনি হয়ত শিক্ষকতা করেন। অথবা রাজনীতির সাথেও যুক্ত থাকতে পারেন। অন্য দু’জন লোকের একজন খুব আগ্রহের সাথে বিরতিহীনভাবে তার জীবনের নানা বিবরণ সংগ্রহ করছিল। যেন একটা বিরাট আবিষ্কার। প্রশ্নকারী ব্যক্তিটি একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছিল, অকৃতদার লোকটি সুন্দরভাবে গুছিয়ে, এতটকু রাগ প্রকাশ না করে একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্নকারী যখন বলল, আপনি বিয়ে না করে আরেকজনের (স্ত্রীর) হক নষ্ট করলেন কেন? আমি তখন ভাবছিলাম, অকৃতদার লোকটি বোধহয় এবার ক্ষ্যাপেই গেলেন! কিন্তু তিনি সুন্দরভাবে বললেন, পরিবারের ও সমাজের কিছু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়ে গেল। তাই বিয়েথা করা হয়নি। এদের আলাপচারিতা থেকে শোনা গেল অকৃতদার মানুষটি কখনো তার নিজস্ব বাসা অথবা মসজিদের সাথে লাগোয়া একটি ঘরে থাকেন। বাসায় নিজেই রান্না-বান্না করে খান। মসজিদে থাকলে ইমাম সাহেব রান্না করেন। ইমাম সাহেব ডাকেন বলে তাকে নামাজ পড়তে হয় দুই বা তিন ওয়াক্ত। প্রশ্নকারী উসখুশ করছিল আরো কিছু একটা বলার জন্য। আমি জানি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্নকারী বিয়ে প্রসঙ্গই নিয়ে আসবে। অথবা এই সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন। সিনেমার লং শটের মত লোকটিও রাগ না করে ধীরে ধীরে উত্তর দিবেন। আমরা মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়ে এত বেশি আগ্রহী যে অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে বিয়ে কেন করা হয়নি তা নিয়ে নানা জটিল প্রশ্ন, এরপর বিয়ে হলে বাচ্চা কেন হচ্ছে না তা নিয়ে নানা বায়োকেমিস্টি, এরপর বাচ্চা হলে ছেলে না মেয়ে, ফর্সা না কাল ইত্যাদি জেনেটিক্স নিয়ে নানা গবেষণা চলতেই থাকবে। এসব করতে করতে এক সময় জীবনেরই সময় ফুরিয়ে আসে।

সবমিলিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ঠান্ডা আবহাওয়ায় একের পর এক কড়া লিকারের চা সহযোগে সিনেমার লং শটের গল্পটা যখন দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠছিলো তখনই বৃষ্টিটা কমে আসে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে আরো অনেক আগেই। এই বৃষ্টির রাতে ঈশ্বরদী যাওয়ার কোন যানবাহন পাব কীনা তাই নিয়ে কিছুটা শঙ্কা ছিল। ফলে আমরা চায়ের দোকানে প্রশ্নকারীর এমন আকুল ঔৎসুক্য ও অকৃতদার ব্যক্তিটির অসীম ধৈর্য্য নিয়ে, এতটুকু রাগ না করে উত্তর দেয়ার মধ্যে এক মজার বিষয় আবিষ্কারের আনন্দ ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হই। পাকসী বাজার থেকে ঈশ্বরদী জংশন যাওয়ার জন্য টমটম বা সিনএজি কিছুই নেই। বৃষ্টি এখন নেই কিন্তু হিমেল বাতাস বইছে। বৃষ্টি আবার শুরু হবে মনে হচ্ছে। রিক্সা আছে, তাই নিয়ে ইপিজেড আসি। এখান থেকে টমটম পাই। ইপিজেডের শ্রমিকদের সাথে শেয়ার করে টমটমে চড়ে ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে ফিরে আসি। ততক্ষণে আবারো তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
আগামীকাল সারাদিন পাবনা শহর ঘুরে এসে রাতে ঈশ্বরদী থেকে ট্রেন ধরব এমনই ভাবনা ছিল আমাদের। রাত বারোটার সুন্দরবন এক্সপ্রেসের টিকেট কাটা হয়। স্টেশনের লাগোয়া রাস্তার পাশে এবার পাল এর মিষ্টির দোকানে জিলিপি-সন্দেশ দিয়ে আমাদের চমৎকার ভোগ হয়। ছোট্ট দোকান কিন্তু বিক্রি বাট্টা দারুণ জমজমাট। বেশ খানিকক্ষণ রেলস্টেশনে কাটিয়ে একটু আগে ভাগেই হোটেল ক্ষণিকায় রাতের আহার সারি। এটিই সেই রেস্টুরেন্ট যেটি চালু হওয়ার পর কখনো বন্ধ হয়নি। গতকাল ম্যানেজার না থাকাতে প্রথমবারের মত বন্ধ হয়েছিল। ভাগ্যিস আমরা গতকাল আসিনি।
রাতে আর আড্ডা তেমন জমেনি। ভোর সকালেই দু’জন ঘুম থেকে জেগে উঠি। তুমুল বৃষ্টির পরও হোটেলের কক্ষটি তেমন ঠান্ডা হয়নি। তবে আগুনের উত্তপ্ত অবস্থা থেকে অনেকটা শীতল হয়েছে। সকালে পাল-এর মিষ্টির দোকানে নাস্তা সারি। হোটেলে ফিরে এসে ব্যাগ গোছগাছ করে বেড়িয়ে পড়ি। আমরা আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা কিছুটা পরিবর্তন করি। ট্রেনের টিকিট ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আমরা পাবনা থেকে ঈশ্বরদী ফিরে না এসে ওখান থেকেই ঢাকার বাসে চড়ব।
সকাল ৯ টায় একটি লোকাল বাসে চড়ে আমরা পাবনা শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। ২৬ কি.মি. রাস্তা তখন ভাড়া ছিল ২৫ টাকা। থেমে থেমে যায় বলে সময় লাগে ১ ঘন্টা। বাসটি যখন শহরের প্রধান সড়কে প্রবেশ করে তখন চোখে পড়ে ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরী। পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার তাঁতিবন্দের জমিদার ছিলেন গঙ্গা গোবিন্দ চৌধুরী। তাঁর ছেলে বরদা গোবিন্দ চৌধুরী নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি একটি ছেলে দত্তক নিয়েছিলেন। সেই ছেলের নামানুসারে অন্নদা গোবিন্দ গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর পাবনা আসলে অন্নদা গোবিন্দ গ্রন্থাগারে একটি দিন কাটাব বলে মনে মনে ভেবে রাখি। চোখে পড়ে ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী এডোয়ার্ড কলেজ। সময়াভাবে এই দুটো স্থানে এবার যাওয়া হচ্ছে না। বর্তমানে একটি বৃহৎ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরীকে আর্থিক সহায়তা করছে। ব্যতিক্রম বাদে আমাদের দেশের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কৃতি বা দানশীলতায় অত্যন্ত পশ্চাদপদ ও কৃপণ। অবশ্য এই ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটিও নাকি গোটা পাবনাতে যে পরিমাণ জমি ক্রয় করেছে এবং যখন আরো বিস্তার করতে চাইছিল, সরকার বাধ্য হয়েছে এদের কাছে জমি বিক্রি নিষিদ্ধ করতে। ব্যবসা বিস্তারের জন্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এমনই আগ্রাসী ভূমিকা সারা দুনিয়ায়।
আমরা কাছাড়ীপাড়ায় অবস্থিত আদালত ভবনের সামনে বাস থেকে নেমে পড়ি। ব্রিটিশের সময়কার পুরাতন আদালত ভবনের ছবি তুলে আমরা একটা টমটম নিয়ে একে একে ঘুরে দেখি জোড়বাংলা মন্দির, হেমায়েতপুরের অবস্থিত পাবনা মানসিক হাসপাতাল, শ্রী অনুকুল চন্দ্র ঠাকুরের আশ্রম এবং সূচিত্রা সেনের বাড়ি।
জোড়বাংলা মন্দিরটি একজন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী উনিশ শতকে স্থাপন করেন। চমৎকার স্থাপত্য নকশাঁর একটি মন্দির। রামায়ণ ও মহাভারতের অনেক কাহিনীকে পোড়ামাটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মন্দিরটি বাউন্ডারী দেয়াল দিয়ে ঘেরা হলেও অরক্ষিত অবস্থাতে পড়ে আছে। অনেক ইট খসে পড়ছে, নষ্ট হয়ে গেছে অনেক পোড়ামাটির কাজ। তখনো প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের অধীনে ছিলনা মন্দিরটি। এমনকি স্থানীয় মন্দির কমিটির অধীনেও নেই। একেবারে বেওয়ারিশ অবস্থা আরকি। আমরা যখন মন্দিরের স্থাপত্য নকশাঁ নিয়ে ছবি তোলায় মগ্ন, এমন সময় স্থানীয় দু’জন তরুণী নিজে থেকে এসে আমাদের সাথে কথা বলে। একজন তরুণী গৃহিনী ও কোলে একটি শিশু। অপরজন অক্ষোকৃত কম বয়েসী তরুণী। পাবনা এডোয়ার্ড কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। তার কোলেও একটি ছোট্ট শিশু। তারা দু’জন আত্মীয়। আলাপের শুরুতেই তারা জানতে চান, আমরা হিন্দু না মুসলমান? ধর্মতত্ত্বের জটিল আলোচনা এড়ানোর জন্য সংক্ষেপে বলি, আমরা মুসলমান। এবার যেন আরও সহজ হয় তাদের কথা বলাটা। সোহেলের গলায় লম্বা লেন্সের একটি ক্যামেরা ঝুলে ছিল। এরকম লম্বা লেন্সওয়ালা ক্যামেরা দেখে প্রায়ই মানুষ শখের ফটোগ্রাফারকেও ভুল করে সাংবাদিক ভাবে। যথারীতি তারা জিজ্ঞেস করে আমরা সাংবাদিক কীনা। আমি বলি না, আমরা সাংবাদিক নই। এবারের প্রশ্ন তবে কী আমরা লেখালেখির জন্য এসেছি? এবার ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দিই। সঙ্গে যোগ করি লেখালেখির সাথে পাবনার দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর আলোকচিত্র সংগ্রহ করছি। বেশ খানিকক্ষণ থেকে তরুণীদ্বয় বিদায় নেয়। আমি মন্দিরের ভেতর থেকে লক্ষ্য করছিলাম, পাঞ্জাবী-পাজামা পরা শশ্রুমন্ডিত একজন বয়স্ক ভদ্রলোক মন্দিরের গেটের বিপরীত দিকের একটি বাড়ির দেয়ালে বসে আমাদের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলেন আর বেশ আয়েশ করে সিগারেট টানছিলেন। আমরা গেট থেকে বেরুতেই তিনি জানতে চাইলেন, আমরা পর্যটক কীনা। আমরা ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দিই। এরপর তিনি জোড়বাংলা মন্দিরের প্রত্মতাত্ত্বিক গুরুত্বের কথা বললেন। তিনি তার পরিচয় দিলেন প্রত্মতত্ব অধিদপ্তরের একজন কর্মচারী হিসাবে। বর্তমানে অবসর নেয়ার সময় হয়েছে। তাই পাবনাতে নিজ জেলাতেই আছেন। নাম তোবাদ আলী। তিনি উত্তরবঙ্গের তাজহাট জমিদার বাড়ি, নাটোরের দীঘাপতিয়া জমিদারবাড়ী, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, বাঘা মসজিদে চাকুরী সুবাদে ছিলেন। বাংলাদেশ থেকে প্রত্মসম্পদ পাচারের বিষয়টি তিনি গুরুত্বের সাথে বললেন। শত শত কোটি টাকার এই সম্পদ একটা চক্র বিদেশে পাচার করছে বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আমরা তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এবার হেমায়েতপুরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াই। তোবাদ আলী এগিয়ে আসেন আমাদের সাথে। খানিকটা আসার পর তিনি একজন লোককে সালাম দিলেন, কিন্তু লোকটি তার সালামের প্রতিউত্তর দিল না। এরপর তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ভাই, আমি আপনাকে সালাম দিয়েছি। তারপর লোকটি যেন বাধ্য হয়ে শুধুমাত্র ‘অলাইকুম’ বলে সালামের প্রত্যুত্তর দেয়। তোবাদ আলীই আমাদের বলেন, ইনি আমাদের এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার। আমরা ‘ও আচ্ছা’ বলে এগিয়ে যাই। এরপর আরেকটি লোক, সম্ভবত ওয়ার্ড কমিশনারের প্রধান চেলা হবে, আমাদের কাছে বেশ সামরিক মেজাজে জানতে চায়, আমরা কোথা থেকে এসেছি? কেন এসেছি? আমরা জবাব দিলে বলে ‘আচ্ছা যান’। আমাদের মনে হলো যেন হঠাৎ করে বিনা অনুমতিতে সেনানিবাসে প্রবেশ করে ফেলেছি। অবশ্য সারাদেশেই কমিশনার ও তার চেলাচামুন্ডারা এমনই হয়। এরা প্রত্যেকেই তাদের এলাকাকে এক একটা ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ বানিয়ে রাখতে চায়। এসব কমিশনারতো আবার এলাকার জনগণের বিরুদ্ধে প্রায় সময় একটা না একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে রাখে। সোহেলের সেই লম্বা চোঙ্গওয়ালা ক্যামেরাই কীনা এত প্রশ্নের কারণ, কে জানে?

এবার হেমায়েতপুরে পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও অনুকুল চন্দ্র ঠাকুরের আশ্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। বিশাল এলাকাজুড়ে পাবনা মানসিক হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে ১৯৫৭ সালে। পাবনা মানসিক হাসপাতালে রোগীদের প্রতি অবহেলার নানা অভিযোগ আছে। আবার অনেক রোগী সুস্থ হয়েও বৎসরের পর বৎসর এখানে পড়ে আছেন, পরিবারের কেউ তাঁদের নিতে আসেনা। হাসপাতাল থেকে অতি সন্নিকটে বিখ্যাত সাধক শ্রী অনুকুল চন্দ্র ঠাকুরের বিশাল আশ্রম। এখানে গিয়ে ইতিহাস পড়ে জানতে পারি হাসপাতালের পুরো জায়গাটি আশ্রমের জমিতেই গড়ে তোলা হয়েছে।
একই টমটমযোগে আমরা আমাদের এবারকার মত শেষ দ্রষ্টব্য সূচিত্রা সেনের বাড়িতে আসি। তখন একটি রাজনৈতিক দলের লোকজন এটি দখল করে স্কুল চালাচ্ছিল। পরে অবশ্য সরকার এটি অধিকগ্রহণ করে। স্কুলে ক্লাস চলছে তাই ভেতরে যাওয়া সমীচিন মনে করলাম না আমরা। সোহেল ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে। রূপালী পর্দার দূর্দান্ত জনপ্রিয় নায়িকা সূচিত্রা সেনের অনেক স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়ি এখন অবশ্য জাদুরঘর।
ঘুরে দেখা হলনা পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলাজুড়ে বাংলাদেশের সবচাইতে বড় ও প্রাকৃতির সম্পদে সমৃদ্ধ চলন বিল। দৃষ্টিনন্দন তাড়াশ জমিদার বাড়ি ও শীতলাই জমিদার বাড়ি পরেরবার পাবনা ভ্রমণের জন্য রেখে গেলাম। সময় না থাকায় পাবনার-সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্পকে কাছে থেকে দেখা হলনা। এটাও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রাখলাম পরেরবার ভ্রমণের জন্য।
দুপুরের আহারপর্ব সারা হয় ‘শাপলা’ রেস্টুরেন্টে। পাবনায় প্যরাডাইস সুইটস বিখ্যাত। এখানে এসে এর ভিড় ভাট্টা থেকে তার প্রমাণ পেলাম। ঢাকার বাস টার্মিনালের দিকে যাত্রা করি। টমটম চালক আবার শ্যামলী পরিবহনের বাস চালক। টমটম চালনা পার্ট টাইম কাজ। বেশ ফূর্তিবাজ মানুষ। কথার মধ্যেই আছেন। অল্প সময়ের মধ্যে যাত্রীদের সাথে আলাপ জমে উঠে তার। তিনি জানান, আজ ২১ হাজার টাকাসহ কাগজপত্র পেয়েছিলেন তার টমটমের পেছনের আসনে। এগুলো তিনি অনেক কষ্ট করে যাত্রীকে খুঁজে ফেরত দিয়ে এলেন। টাকা ও কাগজপত্র ফেরত পেয়ে ভদ্রলোক তাকে ১ হাজার টাকা বখশিস দিতে চেয়েছিল। তিনি তা নেননি। টমটম চালাতে চালাতে তিনি গল্প করে যান। গতকাল সিঙ্গারা খাওয়া প্রতিযোগিতায় এক বসায় ৬৫টা সিঙ্গারা খেয়েছেন! অন্য এক যাত্রী জিজ্ঞেস করল, এটা কী করে করলেন? উত্তরে তিনি রহস্য করে বলেন, টেকনিক আছে ভাই, সবকিছুর একটা টেকনিক আছে। তিনি টেকনিকটির রহস্য হয়ত একটু পরে খোলাসা করতেন কিন্তু ইতোমধ্যে আমরা বাস টার্মিনালে চলে এসেছি। এখানে এসে টমটম চালকের প্রতি বিভিন্ন লোকের সম্বোধনে বুঝতে পারলাম তিনি শুধুই আমুদে আর ব্যতিক্রমী চালক নন এলাকায় জনপ্রিয়ও বটে। হয়ত এই বৈশিষ্ট্যের কারেণই জনপ্রিয়। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে টিকেট কেটে ঢাকার বাসে চড়ে বসি।
বাসটি শহর ছেড়ে মহাসড়ক ধরে দ্রুত চলে যাচ্ছে সুন্দর প্রকৃতিকে পেছনে ফেলে। চোখে ভাসছে রূপপুরের প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের কথা। রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎ প্রকল্প নিয়ে নানা শঙ্কার কথা মনে আসছে। মনে পড়ছে সেই চায়ের দোকানের উপভোগ্য আড্ডার কথা, যেখানে আমরা কেবলই শ্রোতা ছিলাম। মনে পড়ছে পদ্মাপাড়ের কথা। সেই স্বপ্নের ঈশ্বরদীর কথা। বিশাল রেল জংশরে কথা। হার্ডিঞ্জ সেতু ও লালন সেতুর কথা। সব মিলিয়ে পদ্মাপাড়ের গাছপালা ঘেরা সুন্দর প্রকৃতির কথাই বার বার মনে পড়ছিল। মনে বড় সংশয় ও ভয় জাগে, এই প্রকৃতি ও সৌন্দর্য টিকে থাকবে তো? প্রাণ-প্রকৃতিকে ভাল রাখা ও মানুষের ভাল থাকার মধ্যেইতো মানবজন্মের সার্থকথা। কিন্তু আমরা মানুষেরাই বার বার শঙ্কার কালমেঘ দিয়ে ঢেকে দিই মানুষের বেঁচে থাকার আনন্দকে। বাসের জানালা দিয়ে চলমান প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে খুব মনে পড়ছে হুমায়ুন আজাদের একটি কবিতার কথা:
ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়াালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো
চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়ার হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক আড়িয়াল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।
পাদটীকা: রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎ প্রকল্প দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। দেশের উন্নতি কে না চায়? প্রতিনিয়ত শঙ্কা হয়, তাৎক্ষণিক উন্নতির মোহে পড়ে এবং দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে চোখ-কান বন্ধ রাখলে এদেশের মানুষের দশা না হয় আফ্রিকার মত? আল্লামা ইকবালের কবিতার মত শূণ্যগর্ভ দেশাত্মবোধে ‘সারা বিশ্বে অনন্য দেশ আমার’ বা ‘সারে জহাঁ সে অচ্ছা’ বলে নিশ্চিত থাকলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিটা কিন্তু আমাদেরই। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের। কেনিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ড জেমো কেনিয়াত্তির সেই বিখ্যাত উক্তিটি আরেকবার স্মরণ করি:
“প্রথম যখন ধর্মপ্রচারকেরা এল তখন আমাদের ছিল জমি, তাদের ছিল বাইবেল। তারা আমাদের শেখালো কী করে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে হয়। একদিন যখন আমরা চোখ খুললাম তখন দেখি আমাদের কাছে বাইবেল আর ওদের কাছে আমাদের জমি”।