
ভালোবাসার ণ-ত্ব ষ-ত্ব
সখি, ভাবনা কাহারে বলে। সখি, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ভালোবাসা ভালোবাসা…
সখি, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়।
ছাদে খাটো দেয়ালটায় কনুই ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে চোখ বুঁজে গাইছে বর্ষা।
দেয়ালের উপর বসে ভাঁজ করা দু’হাঁটুতে মুখ ঠেকিয়ে শুনছে ঝিলমিল। রাবীন্দ্রিক আবেশে এপাশ-ওপাশ দুলছেও।
তিন লাইন গেয়ে চোখ খুলে ভ্রু জোড়া নাচালো বর্ষা।
সে অর্থ না বুঝে ঝিলমিল বললো, কি রে! থামলি কেন সই?
ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি টেনে বর্ষা বলে, তবে দে না আমার প্রশ্নের জবাব…। ভালোবাসা কারে কয়?
ছোট্ট এক লাফে দেয়াল থেকে নামে ঝিলমিল। দুহাত নাড়িয়ে বলে, এ আর এমন কি কঠিন বলা! যে বাসাতে বসার ঘরে বড় একখানা জানালা রয়েছে আর শোবার ঘর লাগোয়া এক চিলতে বারান্দা, সেই তো একটা ভালো… …বাসা।
আগের দুষ্টু হাসি টেনে রেখেই গান ধরে ফের বর্ষা।
সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ।
যেন গানে গানে গুপ্তধন খোঁজার ধাঁধা লিখে গেছেন রবি ঠাকুর; দু’লাইন গেয়ে তেমন চোখেমুখে তাকালো বর্ষা।
এর অর্থ এবার বুঝেছে ঝিলমিল; এ ধাঁধার জট খুলতে হবে। রোদে পিঠ ঘুরিয়ে আকাশে তাকিয়ে বললো,
তোমাকে ভালোবাসি তাই
প্রতিদিন ভালোবেসে যাই
বিনা কারণে
ব্যালকনি নির্জনে
মনে মনে
তুমিও জানো না এমন গোপনে
তোমাকে পাই
তোমাকে হারাই
আরিব্বাহ! এর নাম তবে ভালোবাসা বলছিস? এতো এক তরফা? ভ্রুকুটি নিয়ে বর্ষার আরেকদফা প্রশ্ন।
পক্ষ তো একটাই হবে। আর সেটা ভালোবাসার পক্ষ। যেন প্রেমের থিসিস জমা দিয়ে এবার ডিফেন্স দিচ্ছে, ঝিলমিলের কণ্ঠে তেমন প্রস্তুতি।
এমন তো হতে পারে ভালোবাসা একটা আজীবন খোঁজ, পাওয়ার আগ পর্যন্ত! বর্ষা আনমনে বলে উঠলো।
– পাওয়াটা একটা ভ্রম হতে পারে কিন্তু।
– তুই কিন্তু কঠিন করে দিচ্ছিস সবটা! সব গুলিয়ে যাচ্ছে এবার…।
যেন রবি ঠাকুরকে এক হাত দেখে নিচ্ছে চেহারায় এমন রহস্য মেখে ঝিলমিল বলে, ভালোবাসা একটা অভ্যস্ততাও হতে পারে কারো কাছে। মানে নিয়ম মেনে নিয়ম করে ভালোবাসতে হবে তাই ভালোবাসা।
– আচ্ছা! তবে তুই বলছিস ওই সেই ঘণ্টা বেজে উঠবে মনে? আচমকা যেদিন চারপাশ ঘোলা হয়ে যাবে শুধু কানে দূরে কোথাও থেকে একটা ঢং ঢং শোনা যাবে, তবেই তা ভালোবাসা? নইলে সবটাই মিছে! সবটাই ভ্রম?
– জানিস, এই গানটা না প্রায় একশ চল্লিশ কি দেড়শ বছর পুরনো! তবু এখনও সুরে-বেসুরে গুনগুন হবেই কারো না কারো মনে। রবি ঠাকুর যে প্রশ্ন ছুড়ে গেছেন, তার উত্তর একেকজনের বেলায় একেক হবে। যদি একই হতো, তবে গানটা লেখার প্রয়োজন রবি ঠাকুরেরও হত না আর।
– তার মানে কেউ ভালোবেসে প্রগলভ তো কেউ ভালোবেসে মৌন। কেউ ভালোবেসে ভেসেই গেল তো কেউ ভালোবেসে সামলে নিল।
– আর কী বুঝলি?
– উমমম! ভালোবাসা প্রথম দেখায় হতে পারে, কিন্তু কারো বেলায় চোখের সামনে দেখাদেখি নেই তবুও তো ভালোবাসা… আর যে দেখতেই পায় না সেও তো পারে… … ভালোবাসতে। ভালোবাসা শুনে হতে পারে; কিন্তু যে শোনে না সেও তো ভালোবাসতে পারে।
– তাহলে রবি বাবুর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছিস একটু একটু করে?
– তুই যে বললি, ভালোবাসা একটা ভ্রম… তার মানে মরিচীকার মত? সাথে সাথে রয়েছে আসলে নেই…! আবার এমনও হতে পারে, ভালোবাসা খুব কাছে রয়েছে, বার বার ডাকছে, সে ডাক বড্ড সত্যি; কিন্তু কেউ সে ভালোবাসা বুঝলই না। আর না বুঝে বুঝে সে সারাজীবন ভালোবাসারই অন্বেষণ করে গেল!… কি রে! এখনও আকাশেই তাকিয়ে রইলি! ওখানে ভালোবাসা রয়েছে নাকি!
বর্ষার টিপ্পনিতে চোখ বুঁজে ফেললো ঝিলমিল। তবে মুখটা সূর্যমুখীর মত উপরের দিকে ভাসিয়ে রাখলো। আলগোছে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো, জানিস, কেউ কেউ বলে ভালোবাসায় ভুল-শুদ্ধ বলে কিছু নেই। ভালোবাসা শুধু ভালোবাসাই।
– হুম! অর্থ্যাৎ ভালোবাসায় হেরেও জেতা যায়? ভালোবাসা কারো জন্য অর্জন তো কারো জন্য বিসর্জন… এসবই বলতে চাইছিস তো?
– একদম… এই তো খুব বুঝেছিস! অবশ্য তুই যে এই বিকেল হতে না হতে ছাদে উঠে ভালোবাসার গান ধরিস দোতলার নতুন ভাড়াটে ছেলেটা ছাদে এলো কি না সে খোঁজে তা কিন্তু আমি ঠিক ধরে ফেলেছি…।
– ধ্যাৎ!
ভালোবাসার অর্থ নিয়ে দুই সখির খুনসুটি চলতেই থাকে। ওরা কেউ খেয়ালই করেনি দোতলার ছেলেটা এর মধ্যে ছাদে উঠে ওদের থেকে আড়ালে বসে ভালোবাসার যত ণ-ত্ব ষ-ত্ব তত্ত্ব লিখে চলেছে। কার জন্য লিখছে? কে জানে …। বাতাসে তখনও ভেসে ভেসে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে বর্ষার গান আর ঝিলমিলের হাসি।
তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া খেলিয়া মরিতে চায়
না জানে বেদন, না জানে রোদন, না জানে সাধের যাতনা যত।
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায়।
আমার মতন সুখী কে আছে। আয় সখী, আয় আমার কাছে
সুখী হৃদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ।