
ভাবের ভেতর দিয়ে নিজেকে কবিতায় স্থাপন করতে হয়
প্রতিকথা’র এবারের আয়োজন এ সময়ের ১২জন কবির কবিতাভাবনা। কবিতা কী, কবিতার কাঠামো ও স্বর, শব্দের নান্দনিক প্রয়োগ; কবিতার এমন নানান বৈচিত্র নিয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও চিন্তার আলোকে রচনা করেছেন তাঁরা কবিতাভাবনা। এর সাথে রয়েছে তাঁদের স্বনির্বাচিত পাঁচটি করে কবিতা। প্রথম পর্বে প্রকাশিত হল ছয়জন কবির কবিতাভাবনা এবং কবিতা।
১.
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিশীলতা, সমসাময়িক ঘটনা, নারী নির্যাতন, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনাসহ চিরায়ত কিছু বিষয় আমার কবিতায় থাকে। আমার কবিতায় এসব নিয়েই গল্প লুকিয়ে থাকে। এসব গল্পে আমার নিজস্ব আবিষ্কৃত শব্দের বেশি ব্যবহার থাকে। শব্দচয়ন, গতি ও অলঙ্কার প্রয়োগে আমি গ্রামীণমুখী। তবে শহরকে একেবারে দূরে ঠেলে দিয়ে নয়। গ্রামীণ আর শহুরে জীবন থেকে অব্যহৃত শব্দ খুঁটে খুঁটে বের করে কবিতায় ব্যবহার করি। অলঙ্কারের ক্ষেত্রেও তাই। কবিতায় সবসময় আমি একটা গল্প বলতে চাই, তা হোক যতো ক্ষুদ্র। আর সেটাকে অনেক যত্ন করে চিত্রময় রূপ দিয়ে ফ্রেমে বাঁধাই করি। এতে করে একটা পূর্ণ বার্তা পাঠকের কাছে পৌছানোর প্রয়াস থাকে। সেই বার্তাটা আলো আঁধারের রহস্যের মতো নয়। এ জায়গাটিতে আমার কবিতা আলোর মতো স্পষ্ট করে তুলতে চেষ্টা করি। দূর্বোধ্য ও দূরূহতা থেকে আমি কবিতাকে দূরে রাখতে পছন্দ করি। কবিতা লেখার সময় আমার কান গভীরভাবে নিবিষ্ট থাকে নদীর স্রোতের কাছে। নদীর মিষ্টি অথবা শাণিত এমনকি বিক্ষুব্ধ স্রোতটা আমি শব্দে গেঁথে নিতে চেষ্টা করি। কবিতা আমার কাছে দূর্দান্ত গতিশীল একটি ব্যাপার—অবাধ্য স্রোতের মতোই অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটে চলা—এই ছুটে চলার ভেতর জীবন থাকে—সাহস থাকে—বিপ্লব থাকে—সুর থাকে—ছন্দ থাকে—ভাঙা-গড়ার আনন্দ-বেদনা-বোধের গভীরতা থাকে।
২.
কোনো কিছু লেখার আগে তা আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে—তাকে কিভাবে ধরবো—সেটা একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমি তাতে সম্পূর্ণ নিমগ্ন হওয়ার চেষ্টা করি। বলতে পারি ধ্যানী হয়ে উঠি। কখনো তা ধরতে পারি—কখনো পারি না। যা বলতে চেয়েছি তা যদি শব্দ ছন্দ মাত্রা গতি সবকিছুর সমন্বয়ে শৈল্পিক করে স্পষ্ট করে বলতে পারি, ভালো লাগে—স্বস্তি অনুভব করি। কিন্তু সবসময় তা পারি না। পারা যায় না। তখন এক অস্বস্তি ও যন্ত্রণা আমাকে ভীষণভাবে তাড়া করে ফেরে। অন্য আর কিছুতে মন বসাতে পারি না। অধরা কবিতা আমার ভেতর বিক্ষুব্ধ ঝড়ের মতো হয়ে ওঠে। ভেতরে ভেতরে আমি বিধ্বস্ত হতে থাকি। হতে পারে এ আমার অপারগতা। আমার মাথার ভেতর কবিতা হয়ে উঠবে বলে যা কিছু ঘুরপাক খায়—তা আমার সব সময় ধরা হয়ে ওঠে না। এটা খুব যন্ত্রণার। আবার অনেক সময় যুতসই শব্দ না পেলে কবিতাকে কবিতা মনে হয় না। শব্দের ব্যবহারের উপর কবিতার গতি অনেকখানি নির্ভর করে। গতিই তো কবিতা। ফলে একটা ভালো কবিতা হয়ে উঠতে গতির ব্যাপক প্রয়োজন রয়েছে। গতির সাথে ছন্দ মাত্রা অলঙ্কার—এসবের সফল সমন্বয় গুরুত্বপূর্ণ। কোনোটার একটু এদিক ওদিক ঘটলেই দূর্দান্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনাময় কবিতারও অপমৃত্যু ঘটে যায়। আমার কাছে কবিতা পুরো সাধনার মতো। ফলে কবিতা আমার কাছে সাধারণ কোনো ব্যাপার নয়। নিজের ভেতর-বাইরের আপন-প্রকাশ। আত্মাই যদি হয় আমার সর্বস্ব বা আমার সত্তাই যদি হই আমি—তাহলে আমার কবিতা তো আমিই। হয়তো সেটা সব সময়ই এই সত্য পুরোটা ধারণ করে না। বিষয় এখানে বড় একটা ভূমিকা রাখে। আয়নার সামনে নিজেকে যেভাবে দেখা যায়, কবিতায় সেভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়—ভাবের ভেতর দিয়েই নিজেকে কবিতায় স্থাপন করতে হয়। আর এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। ফলে আগের কবিতা আর পরের কবিতা এর মধ্যে অনেক পার্থক্য ঘটে যায়। নিজেকে—নিজের চিন্তাকে—নিজের ভাবকে—নিজের প্রেমকে সার্বজনীন করে তুলতে পারাটা একজন কবির বড় শক্তি। এটা আমাকে ভাবায়। কবিতাকে সহজ সাবলীল এবং বোধগম্য করে রাখতেই বেশি পছন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। জটিল বৃত্তে বন্দি করে আলোছায়ার ভেতর কবিতাকে আটকাতে ইচ্ছে করে না। আর এটা যেন নিজেকেই অস্বচ্ছ ও অন্ধকারে রেখে দেয়া—ফলে যে বার্তাটি পাঠকের কাছে দিতে চাই, তা অধরাই থেকে যায়। এটা অনেক সময় নিজেকে প্রকাশের ক্ষেত্রে হয়—নিজেকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেও খানিকটা সরিয়ে রাখার মতো ব্যাপার। আমি যে এটা থেকে আমার কবিতাকে পুরোপুরি মুক্ত রাখতে পারি, তাও নয়। আমার কিছু কবিতার ভেতরও রহস্যময়তা আছে। দেশ-কাল-রাজনীতি অনেক সময় আলোছায়ার একটা রহস্য কবিতার মধ্যে গেঁথে দিতে হয়। রহস্যের আশ্রয় নিতে হয়—সত্যভাষণ গভীরে রাখতে হয়—সমুদ্রের গভীরতার মতো।
৩.
কবিতায় নানামাত্রিক বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। জীবনেরও নানা বাঁক থাকে। নদীরও তাই। চর্যাপদ থেকে এই সময়কালে কবিতা নদীর মতো বহু পথ ঘুরেছে—বহু বাঁক খেয়েছে—বহু রূপ পরিবর্তন করেছে—বহু রূপ ধরেছে। গভীরতা ও অর্থবহতাও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা পেয়েছে। ফলে সময়ের সিঁড়ি ধরে কবিতায় নতুন নানা বিষয় যুক্ত হয়েছে। অন্তর্জগত আর বহির্জগত সবই কবিতায় স্থান করে নিয়েছে। অন্তরের আত্ম-সাধনা, প্রেমের একান্তু বেদনা, খাঁটুনি শ্রমিকজীবন আর ধর্ষিতা নারীর যন্ত্রণা অপমান, রাজনীতির শুদ্ধতা অশুদ্ধতা সবই কবিতার বিষয়। একসময় প্রেম আর ধর্মচেতনাতেই বন্দি ছিলো কবিতা। কবিতা সে সীমাবদ্ধতার প্রাচীর ভেঙে জীবন-সমাজ-রাষ্ট্রের অলিগলিতে অবাধে ঢুকে পড়েছে। আন্তর্জাতিক আবহ কবিতা এখন ধারণ করে। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে দেশ আর বিদেশ সবই কবির জানার ভেতরে চলে এসেছে। কবিতাও তা ধারণ করছে। ফলে কবিতা সীমানার কাঁটাতার ভেঙে বিশ্বের হয়ে উঠছে। তেমনি নিজের কবিতা নিজের কাছেও নানারকম বাঁক নেয়। নিজেকেই নিজের অতিক্রম করতে হয়। নিজেকেই নিজের বৃত্ত ভাঙতে হয়। তা না হলে কবিতা নিজের কাছেই গতি হারায়। আমি চেষ্টা করি আমার কবিতায় প্রতিনিয়ত এই পরিবর্তন আনতে বা বাঁক খেলার খেলাটা খেলতে। নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে বিশ্বায়ন কবিতায় ধরার চেষ্টা থাকে আমার।
৪.
নতুনকে গ্রহণে অনেক সমস্যা থাকে। সহজে কেউ মেনে নিতে চান না। তাতে কর্ণপাত করার প্রয়োজনও অনুভব করিনি। যেমন কিছুদিন আগে আমি একটা কবিতা লিখেছি ‘টালা সুখ’। প্রত্যন্ত গ্রামীণ এক নারী যখন তার প্রিয়জনকে বহু বছর পরে হঠাৎ দেখে সারামুখে আনন্দ উচ্ছ্বাস ফুটিয়ে বলে ‘তোমাকে দেখে আমার জানটা টালা হয়্যা গ্যালো’। ‘টালা’টা তখন বহু বর্ণিল সুখ ও শান্তির সমার্থক শব্দ হয়ে ওঠে। আবার যখন বলি ‘পাকা কুঁচফলের মতো যৌবনাস্তন’—এটাও কিন্তু অব্যবহৃত। আমি কবিতায় এরকম অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার করতে পছন্দ করি। সুষম ও নির্বাচিত শব্দ ব্যবহারে আমার ঝোঁক বেশি। যেমন পাটকাঠির লাউজাংলা, সিঁধেল চোর, ঘরের পোটনি, মাজিভাই, দুঃখিনী গড়াই, কচুরিপাতার মতো টানা টানা চোখের বউটি, স্যাঁতস্যাঁতে মাটির উঠোন, কিশোরিক চাঁদ, কুঁচি দিয়ে পরা সাদাকালো শাড়ি, গরিবানা বালিশ, বিষণ্ন মেঘ, নদীর চরে বালির মেদ—আবহমান গ্রামবাংলা থেকে কুড়ানো শব্দের যেমন প্রচুর ব্যবহার আছে, তেমনি শহরের পোর্স্টমর্টেম, হেরিটেজ, লেটেস্ট মডেলের মুঠোফোন, পোস্টার প্রিন্সবাজার, অ্যাকুরিয়াম, ফ্রেমবন্দি প্রভৃতি শব্দ। আমি চাই কবিতায় ব্যঞ্জনা থেকে ব্যঞ্জনাতীত ধ্বনিকুঞ্জ তৈরি করতে। কবিতার ফর্ম ব্যবহারে মুক্তদৃষ্টির পথিক আমি। রবীন্দ্রনাথের শ্যামলী, পত্রপুট ও পুনশ্চ মুক্তফর্মে লেখা। সমর সেন ও দাউদ হায়দার এ ফর্মের কবি। গতানুগতিকতাকেই সবাই গ্রহণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। একজন কবির কাজই তো হল গতানুগতিক থেকে বের হয়ে এসে নতুন বার্তা শোনানো। সময়ের প্রবল স্রোতের তোড়ে গতানুগতিকবৃত্ত ভেঙে নতুন আসে—এই আসাটা অনিবার্য—এটাই কবিতার শক্তি। সেই চেষ্টাটা সবারই থাকে—আমি ব্যক্তিগতভাবে তা মনে করি। কেউ হয়তো পারেন, কেউ পারেন না। যিনি পারেন সমকালে তাকে প্রশংসার চেয়ে তিরস্কারই বেশি পেতে হয়। এটা সবকালেই ছিলো। এখনো আছে। সবকালেই নতুনকে কেউ সহজে গ্রহণ করতে চাননি। সে দেশে হোক আর বিদেশে হোক। সব দেশের কবির ক্ষেত্রেই একই রকম নিয়তি বহন করে। বোদলেয়ার, ব্লেকের মতো বিখ্যাত কবিতারাও এ-থেকে মুক্তি পাননি। আমাদের মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দ সব বড় কবিকেও এই যন্ত্রণাকে কম-বেশি সহ্য করতে হয়েছে। কবিতায় নতুনকে ধারণ করার একটা শক্তি ও সাহস থাকতে হয়। সময়ের সস্তাস্রোতে সাময়িক প্রশংসা পেলেও, কালের যাত্রায় তা স্থায়ী হয় না। কবিতায় জোর করে জটিল ও দূরূহভাব তৈরি করা আমার কাছে ভালো লাগে না। কবিতা পণ্ডিতি করার জায়গা নয়। এসব থেকে কবিতার মুক্তি ঘটে গেছে বহু আগেই। রবীন্দ্রবৃত্ত ভাঙতে ত্রিশে কবিতায় যে দূরূহতা তৈরি হয়েছিল, সে-বৃত্তও একসময় ভেঙে গেছে। নতুন ধারা নতুন বিষয় কবিতায় স্থান করে নিয়েছে। এই যে নতুন ধারা বলছি—এর ভেতরেও আবার নানামাত্রিক বাঁক আছে—কবিতা প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল—নতুন রূপে নতুন রঙে—এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই।
আমার কবিতায় দৈনন্দিন জীবন বাস্তবতা—দুঃখ-কষ্ট বেশি আছে। প্রতিদিন যে জীবন দেখি, যে সমাজ দেখি—দেশের যে দুঃখময় করুণ ছবি দেখি—তাকেই কবিতা করে তুলতে চেষ্টা করি। চেতনায় অন্তঃর্জগতে থাকে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম-ইতিহাস-ঐতিহ্য।
৫.
প্রথমে যে কথা বলছিলাম, আমার কবিতা আমার আত্মা—আমার সত্তা—হয়তো আমিই। এই দেশ-দেশের মাটি-মানুষ আমার প্রেম সবই তো আমার আত্মা—আমার সত্তায় গ্রোথিত। এসব বাদ দিয়ে তো আমি কেউ নই—আমি তো আমাকে দেখি না। এসবই বিশেষ ভাষা, শিল্প-শৈলী ও প্রতিকীতে আমার কবিতা হয়ে ওঠে। আর এ কবিতার ভেতরেই আমি আমাকে দেখি। আমার কবিতা ক্ষতবিক্ষত-আহাজারি-আর্তনাদের অসহনীয় ছবি, কখনো আবার সুরেলা নদী, পাখির গান, সবুজ ফসলের মাঠ, আমার প্রেম-বিরহ-আনন্দ—বেদনা। আসলে কবিতায় ‘আমি’ একটি সত্তা—যে নিজের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত বোঝাপপোড়া করে—করতে থাকে—এই বোঝাপোড়ার ভেতর দিয়েই কবিতা ব্যক্তিক থেকে সার্বজনীন হয়ে ওঠে। আমার কবিতায় সে চেষ্টাটাই থাকে।
রকিবুল হাসানের পাঁচটি কবিতা
পুড়ে যায় পুষ্পাঞ্জলি
প্রমত্ত নদীও শুকায়—জীবনের গান থামে
একদিন কূল ভেঙে ভেঙে খেয়েছে যে
প্রেমের শরীর—আর্তনাদ ভালোবেসে।
অবাধ্য যৌবন সেও তো হারায়
লোভের আগুনে পুড়েছে নগর সহস্র বছর
এখনো পুড়ছে—পুড়ে যায় পুষ্পাঞ্জলি।
মোহও তো ডোবে—পেয়ে গেলে সব,
সবই তো পড়ে থাকে—থাকে না কিছুই;
কেন তবে স্বার্থের খেলায় তরুপের তাস!
বুকে হাত দিয়ে দেখো—নিজেকে চিনতে
পারো কিনা—জীবন বড়াই বড়ই ঠুনকো
ভালোবাসাটুকু থাকে—আর থাকে না কিছুই।
আমার শ্মশানদাহ আমারই থাকুক
আমার অন্তরবেদনা আমারই থাকুক
আমার শ্মশানদাহ আমারই থাকুক
আমার কলিজা কেটে কেটে যারা
সালাদ বানিয়ে তৃপ্তি করে খেয়ে গেলো
তারাও ভালো থাকুক—ভালো থাকুক সবাই
আমার ভরাট বুকে বর্ষা নদীর মতো
থৈ থৈ স্বপ্ন ছিল
প্রবল মাতাল স্রোতে ভেসে গেলো সব
পুকুরভর্তি মাছের মতো অচেনা হাওরে
তবুও ভালো থাকুক অধিকার হরণের গল্প
অন্ধকার মুখোশে নিজেকে ঢেকে
যারা চেতনার কথা বলে
যারা নতুন যৌবন দেবে বলে স্বপ্ন বুননের
প্রতিশ্রুতির গোলাপ পাপড়ি ছড়ায়
দুমুখো গোখরা হয়ে মসৃণ সড়কে
জীবন চালায়—ভালো থাকুক তারা
ভালো থাকুক সবাই
ভগ্নস্তূপে বাসা বাঁধে কতো সাধের যৌবন
নিঃস্বজনের অন্তরে কতো অন্তর্জ্বলা
অন্তরবেদনা কে কার চেনে বলো
সুখনদী খুঁজতে খুঁজতে সব পাখিই তো
দুঃখনদীর গহীনে হারায়
আমার অন্তরবেদনা আমারই থাকুক
আমার শ্মশানদাহ আমারই থাকুক
কবিতা কি যূথিকা যৌবনা নদী
কবিতা এতোটা নিদ্রাহীন—কে কবে বুঝেছে
শিশিরের মতো সারারাত কি অদ্ভুত নীরবে
উপমা রূপক কুচি দিয়ে শাড়ি পরা সুদর্শনা
রমণীর মতো কবিতা কি যূথিকা যৌবনা নদী!
প্রতিটি কবিতা ভূমিষ্ঠমাত্রই ব্যাকুল তৃষ্ণায়
পৃথিবীকে দেখে—তাকে তুলে নেয় বুকে
আঁতুড় ঘরে—হৃদয়ের বসতিতে গহীন সুন্দরে
কবিতা জন্মায় আবেগ ও চেতনার অগ্নিকাচুম্বনে।
আমার কবিতা হাওর-বাঁওড়ের লাল শাপলা
তুমি তাকে গেঁথে নিও ভোরের স্নানের পরে
ভেজা চুলে—কাঁচামাটি পথে ছড়িয়ে পড়ুক;
রৌদ্রের সুঘ্রাণ ঢেউবতী অন্তরলাবণ্যে নিদ্রাহীন।
আমি তেমন কেউ নই
আমি তো বলেছি—আমি তেমন কেউ নই—
আমার জন্য তোমাদের অনেক দুঃখ থাকবে
ভালোবাসা থাকবে—অপেক্ষা থাকবে—বুনোফুলের ঘ্রাণ থাকবে
বুকের ভেতর বিদীর্ণ ব্যথা থাকবে—এসব থাকতে নেই।
আমি কারো মাথায় কখনো রাখিনি নির্ভরতার হাত
কাউকে কখনো বুকে করে হাঁটিনি স্বপ্নসৌধ ধরবো বলে;
রাত নিভে গেলেও পারিনি দিতে
ক্ষুধার আগুনপোড়া মুখে
শাকসবজিমাখা সাধাসিধে আউশ ধানের একমুঠো ভাত।
আমি তো প্রাডো গাড়িতে এ নগরে আসিনি—
চাকচিক্যময় পোশাক পরেও আসিনি—
অপেক্ষায় ছিল না কোন প্রাসাদ;
ছেঁড়া জুতো প্যান্ট পরে এসেছি শূন্য চোখে ফোসকা পায়ে
একটা মানুষও থাকেনি আমার জন্য চোখ পেতে।
কোন হিসাব করিনি কোনদিন—হিসাবের কড়ি নিয়ে
হিসাব শিখিনি—শুধু চেয়েছি অভাবের অংক মুছে যাক
জীবন থেকে—অনাহারের গন্ধ যেন না থাকে মুখে;
কিছুই পারিনি—পারার মতো আমি তেমন কেউ নই।
আমি তো বলেছি—আমি তেমন কেউ নই
আমার প্রাণহীন নিথর শরীরের জন্য
ক্ষণিক মুহূর্তের জন্য মঞ্চ বানানোর কোনো প্রয়োজন নেই;
অনর্থক শব্দ সাজানো ছাড়া আমি আর কিছুই পারিনি।
আমি কারো জন্য কিছুই করিনি
একমুঠো ভাতের জন্য আমি এ শহরে এসেছি—
অবজ্ঞাকে ভালোবাসা ভেবে আজো ধুলাবালি শরীরে পথ হাঁটি;
আমাকে কেন ভালোবাসতে হবে—আমি তো কিছুই করিনি।
আমি তো বলেছি—আমি তেমন কেউ নই
যদি চলে যাই মৃত্যুবন্যায়—
লোকদেখানো বেদনায় বুক ভেঙো না;
নিথর শরীর যদি বেশি ভারি হয়ে যায় কষ্ট নিয়ো না কখনো
আমার সন্তান নিয়ে যাবে জবাফুল পরীর বাড়িতে।
অদ্ভুত অভিযাত্রা
বিবর্ণ ঘাসের মতো কবিতা হারিয়ে ফেলছে সতেজ ঘ্রাণ
প্রতিদিন সুন্দরের প্রথম চুম্বন হয়ে নকশি শাড়ির মতো
অজস্র কবিতার পংঙ্ক্তি হয়ে নতুন চরের মতো জেগে ওঠা
বালুকা বর্ণমালা দুঃখে নিজেকে লুকায় ধর্ষিতা
জননীর মতো—সবুজ ঘাসের ডগায় রক্তশিশিরে ভোর নামে
অদ্ভুত দুঃসংবাদে—বিষাক্ত ছোবল এখন স্বপ্নমৌতাত যৌবনে
বিকৃতসড়কে শেকড়ছেঁড়া এ এক অদ্ভুত অভিযাত্রা
হাছন লালন পীর মুর্শীদ ভাটিয়ালি একতারা কাঁদে
‘হায়রে আমার মন মাতানো দেশ’
পিতৃহীন অসহায় বালিকার মতো কাঁদে আমার স্বদেশ
অগ্নিকা বারুদে জ্বলে ওঠো কবিতাকুমারী
পদ্মা মেঘনা গড়াই জননীর বুকে
প্রাণঘাতি ছোবল নতুন শকুনের
অনেক মূল্যে কেনা জমিন এখন রক্তাক্ত ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল
অগ্নিশিখা হয়ে জ্বলে ওঠো স্পর্ধিত কবিতা—প্রতিটি নিঃশ্বাস
বুকের ভেতর পাথরের মতো ভারি ভয়াবহ দুঃসহ যন্ত্রণা—
তীরবিদ্ধ জননী—বুকের ভেতর কষ্টে কাতরায় স্বদেশ আমার