
ব্যাকরণ সমৃদ্ধ সুখী রমণীগণ : সময়ের সত্যস্পর্শী শিল্পস্বর
অনার্য নাঈম বর্তমান সময়দর্শী সচেতন প্রয়াসী একজন সাহসী কবি। তিনি সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ সহযোগে পর্যবেক্ষণ করেন স্রোতময় সময়ের চালচিত্র এবং তারই প্রেক্ষাপটে বিবেকশাসিত বোধ ও বুদ্ধি সহযোগে নির্মাণ করেন কবিতা। তাঁর রচিত চারটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে “ব্যাকরণ সমৃদ্ধ সুখী রমণীগণ” অন্যতম একটি কাব্যগ্রন্থ। ২০২২ সালের বইমেলায় ‘প্রতিকথা’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় এই কাব্যগ্রন্থটি। শিশির মল্লিকের আঁকা নান্দনিক প্রচ্ছদ সম্বলিত কাব্যটিতে মোট চল্লিশটি কবিতা সন্নিবেশিত হয়েছে। বইটি উৎসর্গ করা হয় গল্পকার সালেহা সুলতানাকে।
এই কাব্যে কবি সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণশীল মনন ও মেধা সহযোগে বৈশ্বিক রাজনীতির আবর্তন, বিপণন, যুদ্ধ প্রভৃতির পাশাপাশি প্রেম, বিরহবোধের অনুষঙ্গে নির্মাণ করেছেন কবিতা। বিষয় ও প্রকরণগুণে কাব্যটি পাঠকপ্রিয়তার যোগ্যতা অর্জন করেছে নিঃসন্দেহে।
কাব্যটির নামাকরণ “ব্যাকরণ সমৃদ্ধ সুখী রমণীগণ” চরণটি “ষত্ব বিধানের নাভি” কবিতার অংশ। অসাধারণ মাধুর্যগুণ সমৃদ্ধ এই কবিতাটি। কবির অভিজ্ঞানে রমণীয় পরিচ্ছদ শাড়ি একটি ব্যাকরণিক প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে থাকে সুভাষিত রমণীর শব্দ, শরীরে যার নান্দনিক সৌন্দর্য কবিকে একজন প্রেমিকরূপে জন্ম দেয়। ষত্ব বিধানের নাভি কবিকে সকল কর্ম ভুলে স্থিত করে সান্নিধ্য কামনায়:
উৎকৃষ্ট ব্যাকরণের নিয়মে তোমার / সুকোমল পেটের মাঝে এক টুকরো নাভিতে/ ষত্ব বিধানের আওতায় গুঁজে রাখো শাড়ি।*** এই সব সুভাষিত শব্দের শরীরে/ সন্ধির সান্নিধ্য কামনা করি/ ভুলে যাই বিচ্ছেদের কথা;/ ভুলে যাই অসম্পূর্ণ বাক্য গঠনের কথা/ এই ব্যাকরণ নিশ্চয় সুখী করে তোমাদের/ এইসব ব্যাকরণ-সমৃদ্ধ সুখী রমণীগণ/ আমাকে য-ত্ব বিধানে আটকে রাখে;/ আটকে রাখে চোখ ষ-ত্ব বিধানের নাভি।
কবিতায় রোমান্টিক আবহের সাথে সাথে রূঢ় বাস্তবতার কঠিন সোপানে পদচিহ্ন এঁকেছেন কবি অনার্য নাঈম। এই কাব্যের ‘দখলদার’, ‘আমার কেটে যাওয়া দিন’, ‘নিকট ইতিহাস’ কবিতায় প্রাচীনতায় সমর্পিত লুপ্ত সময়, দ্ব্যর্থ প্রেম, অতীত-আচরিত জীবনকথন পাঠকের মননে পৌঁছে দেয় নস্টালজিক আবহের ঘ্রাণ।
পৃথিবীর নিকটতম ইতিহাস-/ আগুনের ব্যবহার এইতো সেদিন; /এইতো সেদিন কৃষিকাজ ছিলো/ আমাদের মৌলিক নেশা; গতরে মাটির ঘ্রাণ যেন -(নিকট ইতিহাস)
সে সাথে তিনি বর্ণনা করতে সমর্থ হোন বিপন্ন সময়ের পটভূমি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্লিপ্ত দুর্বৃত্তায়নের ক্লেদজ-বৈকল্যকে। ‘আমরা অযথাই বেঁচে আছি’, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’, ‘বিভ্রান্তির আঙুল ‘কবিতায় সেই ভাষ্যই উচ্চারিত হয়েছে। তেমনি ‘একটি রাষ্ট্রের প্রস্তাবনা’ কবিতার অংশবিশেষ :
পৃথিবীতে বাসযোগ্য কোন রাষ্ট্র নেই।/ ** আমি একা নই সাতশ’ কোটি মানুষ/ নিতান্তই বসে বসে মৃত্যুর প্রহর গোনে/ অথবা বিছানায় শুয়ে থাকে/ অথবা একটি বাসযোগ্য রাষ্ট্রের স্বপ্ন দ্যাখে।/ ** আমরা প্রত্যেকেই জানি / আমাদের সুখগুলো হরণ করেছে/ সংবিধানের কোন্ কোন্ অনুচ্ছেদ। কেন শাসনকাঠামোর ধারা বেয়ে/ চুঁইয়ে পড়ে অসুখের ফোঁটা আমাদের মুখে।
প্রেম, দ্রোহ, রাজনীতিজনিত আশা-ব্যর্থতার যুগপৎ মিথষ্ক্রিয়ায় তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে যাপিত জীবনের অপ্রাপ্তিজনিত বিরহ-বেদনার প্রামাণ্য স্বাক্ষর।
অনার্য নাঈম নির্বিত্তের অস্তিত্বহীনতার সংকটাপন্নের নেপথ্যে ক্রিয়াশীল ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থাকেই নির্দেশ করেন:
আমাদের কৃষকেরা জলভাত খায়;/ *** জলভাত খেতে খেতে হাসিমুখে মরে যায়।/ *** সেই সব কৃষকের ঘাম দিয়ে/ আমাদের নির্ধারকগণ/ বাড়ি কেনে বেগমপাড়ায়–/ বেগমপাড়া আমাদের ধর্ষিত বাংলাদেশ। অথচ বেগমের জারজ মালিকানার/ সন্তানেরাও মালিক হয়ে ওঠেছে / বাংলাদেশের। -(বেগমপাড়া)
অনার্য নাঈমের কবিতা সুবিধাবাদী সমাজের বাহ্যিক চাকচিক্যের বৈপরীত্যে উন্মোচন করে এ দেশের মলিন জীর্ণ বিরূপতা যা ফানুসের মতোই ঠুনকো। ‘আমাদের স্বাস্থ্য সেবা’ কবিতায় সে চিত্রের সত্যভাষ্য ধ্বনিত :
আমাদের স্বাস্থ্য বলে কিছু নেই;/ আপনারা যা দেখেন তা / দুঃশাসনের পরিণতি মাত্র। ***তবুও আমরা ট্যাক্স দেই/ জরুরি প্রয়োজনে দান করি বেতনের অংশবিশেষ। / *** আমরা টেলিভিশনে সংবাদ দেখি-/ কতটা উন্নয়ন হলো আমাদের স্বাস্থ্য ;/ আমরা হাততালি দেই;/ আমরা সরকারকে সাধুবাদ দেই;/ কিছুক্ষণ পরেই সংবাদ শেষ হয়ে যায়। / ‘ উন্নয়ন’ এবং ‘উন্নতি’ শব্দদ্বয় / দূরবর্তী পাহাড়ে মিলিয়ে যায়।
ফ্যাসিবাদের কোনঠাসায় দিশেহারা শোষিত সম্প্রদায়। সত্যকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার প্রবঞ্চনায় লিপ্ত ফ্যাসিস্টরা। বাস্তবতার নিরিখে কবির সাহসী কণ্ঠ উচ্চকিত হয়েছে “শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’ কবিতায় :
যে কোন ইস্যুকেই আমরা/ আরেকটা ইস্যু দিয়ে ঢেকে দিই/ যেন বিষয়টা চালাক শেয়ালের / শিকারের সাথে লুকোচুরি খেলা।
সংঘাত বিক্ষুব্ধ সময়ের সারথী আমরা সবাই। কবিও সে সংঘাতের বাইরে নন। মতবাদের মতভেদের উত্তাল ঢেউয়ে প্লাবিত বিশ্ব। সামন্তবাদ,পুঁজিবাদ, বুর্জোয়ার কোপানলে ভেঙে যাচ্ছে সব স্বস্তির ভিত। কবির শোণিতধারায় প্রবাহিত হয় সেই ভাঙনের উত্তাল ঢেউ:
এ সংঘাত সময়ের সাথে/ এ সংঘাত মার্ক্স-লেনিন-মাও-হোক্সার সাথে/ আমার বক্তব্য প্রবেশ করে ভারতীয় উপমহাদেশে/ বামপন্থী দালালের সাথে আমার সংঘাত/প্রচণ্ড সংঘাত আমার রক্তের মধ্যে/ আমি সেই বয়ে চলা নদী/ যার পানি পান করে পৃথিবীর সমস্ত শোষিত মানুষ- / সামন্তবাদের গ্লাসে। (আমার রক্তের মধ্যে)
‘রাজনৈতিক আগুন’, ‘বয়ে চলে কাল নিরবধি বেদনা স্থির’, ‘তুমি দাঁড়িয়েছিলে একা’ কবিতায় কবির মনলোক বিক্ষিপ্ততায় সমর্পিত; কেননা মানুষ্য যাপনে কেবল বেদনাই স্থির যা অনপনেয়। আর মানুষের জন্য একটাই পরম সত্য, যা কবি কবিতার চরণে বলেছেন- ‘শেষ পর্যন্ত মানুষ একা/ জীবিত অথবা মৃত।’ -(তুমি দাঁড়িয়েছিলে একা)
প্রেম বিষয়ক কয়েকটি কবিতা যেমন- ‘দূর নিয়ন্ত্রণিত প্রেম-১’, ‘দূর নিয়ন্ত্রিত প্রেম -২’, ‘এখনো মেলেনি দেখা’, ‘দ্বিধা’, ‘বৈশাখে কথা বলি আষাঢ়ের সাথে’, ‘তোমাকে স্পর্শ করলে’ প্রভৃতিতে প্রেম জীবনের অনুষঙ্গরূপে প্রতীয়মান। প্রেমের শূচিস্নিগ্ধ পরশে দূরীভুত হয় সকল অসাম্য:
তুমি স্পর্ধা দিলে অর্জিত হয় স্বাধীনতা/ হাতে উঠে আসে দুর্নীতিবিরোধী ইশতেহার/ তুমি স্পর্ধা দিলে রচিত হয় গান অথবা কবিতা/ জনপ্রিয় হয় মার্ক্স এবং সাম্যবাদ/ সুতরাং তোমাকে স্পর্শ করলে/ তুমিও চাইবে না আমি দূরে চলে যাই….(তোমাকে স্পর্শ করলে)
অনার্য নাঈম কবিতার প্রকরণ নির্মাণে অভিনব নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হয়েছেন। উপমা-রূপক-চিত্রকল্প প্রয়োগে তিনি সিদ্ধহস্ত। কয়েকটি দৃষ্টান্ত :
১. ছেঁড়া বস্ত্রের মতো মলিন/ মুখটাকে লুকিয়ে রাখি। (তোমার ঠোঁট দুটো বন্ধ কেনো)
২. এক একটি শুকনো পাতা- তোমার মরে যাওয়া মন। (তোমার বাড়ির উঠান)
৩.গতরে মাটির ঘ্রাণ যেন / মৌচাকে জমে থাকা মধুর সোপান। (নিকট ইতিহাস)
৪. ভালোবাসা যেন ভাতের বলকের মতো/ সমস্ত এশিয়া জুড়ে/ শিশুদের নাগালের বাইরে রাখা। (আমরা সকলেই সূর্যমুখী)
অনার্য নাঈমের কাব্যগ্রন্থটি বিষয় বিচারে ও প্রকরণশৈলী গুণে অনবদ্য একটি শিল্পরূপে প্রতিভাত। কবির সাহসী পদক্ষেপের বহিঃপ্রকাশ “ব্যাকরণ সমৃদ্ধ সুখী রমণীগণ”; যা সময়ের প্রামাণ্য স্মারক ও শক্তিধর হাতিয়ার।