
বৃষ্টি ও রমণীদ্বয়
হুড়মুড় করে বৃষ্টিটা নেমেই পড়লো। নামার ধরন দেখে মনে হচ্ছে সহজে থামবে না। অনেকক্ষণ ধরে মেঘ জমেছিলো। বেশ জাঁকিয়ে বসেছিলো হালকা একটা আঁধার। বৃষ্টি নামার পর তা ফিকে হয়ে এলো।
বর্ষাটা এবার বড়ো বাড় বেড়েছে। “এসো হে বৈশাখ” বলে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবার অবসরও ঠিকমতো দিলো না। ঝুপঝাপ নেমে পড়লো বৃষ্টিরা। আজ ভাদ্রের একত্রিশ। পুরো পাঁচটি মাস বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই।
বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে টুকটাক কয়েকটা কথার আওয়াজ কানে এলো। ঘরের বাইরে বোধহয় কেউ বেড়া ঘেঁষে দাড়িয়ে বৃষ্টি থেকে গা বাঁচাবার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা নৈমিত্তিক। রাস্তার কাছেই এই ঘর। তাই বৃষ্টি এলেই দু’চার জন দৌড়ে আসেন গা বাঁচাতে। দরোজা খুলে গলা বাড়িয়ে দেখলাম দু’জন মহিলা একটা খোলা ছাতাকে নীচু করে ধরে ছিটকে আসা বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটাগুলোকে ঠেকাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে এখানে দাঁড়ানো অর্থহীন হয়ে যাবে।
কিন্ত তাঁদেরকে ভেতরে এসে বসার কথা বলতে গিয়ে থমকে গেলাম। ঘরে আমি একা। দু’জন ভদ্র মহিলাকে কি করে ঘরে আসতে বলি? তাঁরাও বা কি ভাববেন? শেষে বৃষ্টি আরো তীব্র হচ্ছে দেখে সব সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে বললাম, “আমনেরা গরে আই বইয়্যেন।”
তাঁদের মধ্যে নড়াচড়ার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। তাই আবার বললাম, “মা-বোইন ব্যাকের আছে। এরুম করি বারে খাড়াই থাইকলে খারাপ দেয়া যায়। আমনেরা গরে আই বইয়্যেন।”
এবার কাজ হলো। ওঁরা ঘরে এসে বসলেন।
আমি কি করবো ঠিক করতে না পেরে মাথা নীচু করে একটা বইয়ের পাতা ওল্টাতে শুরু করলাম। এভাবেই চলছিলো। হঠাৎ একটা শিশু কেঁদে ওঠায় সেদিকে তাকালাম। এক জনের কোলে একটা ছোট্ট ছেলে। বছরখানেক হতে পারে বয়স। পরনে ছিটকাপড়ের শার্ট আর লাল হাফ প্যান্ট। দু’জন অনেক চেষ্টা করে শিশুটির কান্না থামালেন। খুব সম্ভব ঠাণ্ডায় তার সমস্যা হচ্ছে।
আমি আবার মাথা নীচু করে বইয়ের পাতা ওল্টাতে থাকলাম। একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই বাড়ি আমনে গো নি?”
মাথা নীচু করেই জবাব দিলাম, “জ্বে।”
-কন কেলাসে হড়েন?
-বি.এ. কেলাসে।
-মাশকল্লা। আল্লা বাঁচাক। আমনেরা বাই বোইন ক’জন?
-চাইর বাই, দুই বোইন।
-আমনে ব্যাকের বড় নি?
-জে।
-বোইন কুনুগারে বিয়া দিছেন নি?
-জে না।
-মা-বাপ আছে ত’ আল্লায় রাইক্লে?
-জে।
কথায় কথায় বেশ সহজ হয়ে আসে পরিবেশ। আমি যাঁর সাথে কথা বলছিলাম তাঁর বয়স তেত্রিশ/চৌত্রিশ বছর হবে। বোরখা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। পায়ের কাছে আধভেজা একটা ছোট বস্তা। কোলের কাছে কাপড়ের পুঁটলি ধরা। ছাতাটা দরোজার পাশে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো। জিজ্ঞাসা করলাম, “আমনে গো বাড়ি কোনায়?”
-আঙ্গো বাড়ি বা-জী মাইজদীর হচ্ছুমে।
পাশের জনকে দেখিয়ে বললেন, “ইগা আঁর ঝি। আর কোলের গা নাতি। এ্যাদ্দিন আঙ্গো বাড়িত বেড়াইছে। অন্ জামাইরগো বাড়িত লই যাইয়্যের। জামাইর গো বাড়ি আমনে ছিনবেন। রাস্তার আঁডের কাছে। তনু মিয়া জমাদারের বাড়ি।”
আমি এই ফাঁকে মেয়েটার দিকে তাকালাম। বয়স খুব বেশী হলে ষোল/সতেরো বছর হবে। গায়ের রং শ্যামলা। ভিজে থাকায় একটু ফর্সা লাগছে। ছিমছাম চেহারা দেখে অনায়াসে বলে দেয়া যাবে এ মেয়ে বাঙালি ঘরের। একটা নির্ভেজাল সারল্য আছে চেহারায়।
জিজ্ঞাসা করলাম, “আমনের ঝিয়ের জামাই কি কাম করে?”
-কইয়্যেন না বা-জী। হেই কতা কইলে আর রাইতদিন নাই।
-কা, কি অইছে?
-আগে ডেল্টা জুট মেইলে কাম কইত্তো। আইজ দুই মাস গর বইডা। অসুক। মা-গায় তাবিজ কইচ্ছে।
-তো-বা। মা কেমনে হুতেরে তাবিজ করে!
এবার মেয়েটা মুখ খুললো- “নিজের মা’র লগে কজ্যিয়া করি আঙ্গো বাড়িত যাই তিন মাস আছিলো। আঙ্গো লাই যদি ট্যাঁয়া খরচ করে এই ডরে তাবিজ করি এক্কারে নিজের কাছে লই গেছে। হিয়ানে যাইবার হরে অসুকে ধইচ্ছে। খোনার আইনছিলাম তাবিজ তুইলবার লাই। বারো গা তুইলছে। খোদার কি গজব! বালিশের তলে তাবিজ। গর দুয়ারে তাবিজ। চুলার মুখে তাবিজ। ঘাঁট কূলে তাবিজ।”
আমি বিস্মিত হবার ভান করতেই মেয়ের মা বললেন, “তাবিজ করি হুতেরে নি কোঁচ্ছাত ভইচ্ছে। লাব অইছে কি? অ’ন যে অসুকে মরের! হুত মইল্যে ডন্ডিটা অইবো কার? আঁর ঝির কি অইবো? হেতির কোয়াল কি লই যাইতো হাইরবো নি? আল্লার তান আল্লায় চাইবো।”
আবার কথাহীনতা এসে ভর করে। বাইরে তখনো তুমুল বৃষ্টি। এই সরলমতি রমণীদ্বয়ের সারল্যের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হলো। এঁরা সরল বিশ্বাসে আপন ভেবে ঘরের কথা পরের কাছে বলে যাচ্ছেন। আমার সংসারী মন নিয়ে তা কখনো করতে পারতাম না। কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, “বাবু রে কি ঝড়ি লাইগছে। থাইমবার কোনো নাম নিশান আছে নি?”
-আখেরি জাবানা, বা-জী। আল্লাহর গজব হইড়ছে। বৈশাগ মাসে শুরু অইছে। অ’ন ভাদর মাস। এক্কানা খেমা আছে নি!
আমি আখেরি জামানা তত্ত্বের ধারে কাছেও গেলাম না। বললাম, “এতো ঝড়ি অইলে চাইলের দাম বাড়ি যাইবো।”
-আর বাড়নের বাদ আছে নি? দশ ট্যাঁয়া, এগারো ট্যাঁয়া অই গেছে। আহারে আল্লা, কি দেইকলাম। আর কি অইলো? ছ’আনা সের চাইল দেইকছি।
-হেই সব কতা কই অন আর লাব আছে নি?
-ঠিক কইছেন। এই কতা কইলে কি আর দাম কইমবো নি?
-রিলিফের গম হাইছেন নি?
-খালি তিন সের হাইছি। এগুন হাইছি যেন্ও শোকর আল্লার দরবারে। গম আইলেই শান্তি নাই। চেয়ারমেনে বেচে এক্কানদি, মেম্বরে বেচে এক্কানদি। গরীবের লাই কিছু থায় না।
-সামনে ত’ আবার বোট আইয়্যের। বোট দিবেন কারে?
-চেয়ারমেনের বোট নি?
-না, এমপি’র বোট।
-বোট দি কি লাব? জিনিস ফত্রের দাম ত’ কইমতো ন’। আরো বাইড়বো।
-হিয়ার লাই বুজি বোট দিতেন ন’?
-এত কতা কইতাম হাইত্তাম ন’ বা-জী।
কথার ফাঁকে মেয়েটা বললো, “ঝড়ি থাইমছে। ছলেন।”
-চল। ঝড়ি ন’ অইলে এতক্কনে গাউব্বার হোল হার অই যাইতাম।
তারপর ব্যস্ত হয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চলে যাবার জন্য তৈরী হলেন। যাবার আগে বললেন, “যাইয়্যের বা-জী। ম্যালা কতা কইছি। মনে কিছু নিয়েন না। দোয়া করি, আল্লা আমনেরে হায়াত দেক। বিদ্যা বুদ্দি দেক।”
আমি তন্ময় হয়ে তাঁদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
অনন্তপুর, মাইজদী বাজার, নোয়াখালী।
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ।