
বিস্ময়ের শুভার্থী কবি মাহমুদ মিটুল
বই : বিস্ময় মুছে দিওনা ॥ ধরণ: কাব্যগ্রন্থ ॥ লেখক : মাহমুদ মিটুল
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ॥ প্রকাশনা: আগুনমুখা ॥ প্রচ্ছদ: কাঠুরিয়া কামরুল
‘সুন্দরের ভাষা জানি না/ ভাষা দাও ভাষা দিও/ লিখে দেবো সমস্ত সুন্দর’ – এই প্রত্যয়ের কবি মাহমুদ মিটুল। তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের নাম ‘বিস্ময় মুছে দিও না’। কাব্য শিরোনামের এই ‘বিস্ময়’ শব্দের দ্যোতিত অর্থের মাঝে তিনি বেঁধেছেন ধ্রুপদী কাব্যচিন্তার এক বৃহৎ পরিসর।
গ্রন্থের মূল কবিতাপর্বে প্রবেশের পূর্বে, এমনকি সূচিপত্রেরও আগে উৎসর্গপত্রের ধারায় লিখিত প্রথম কবিতা ‘বন্দনা’র প্রথম তিন লাইন আমরা উপরে উদ্ধৃত করেছি। উদ্ধৃতাংশে প্রথমে রয়েছে তাঁর অজ্ঞতাজনিত অসামর্থ্যের কৈফিয়ত (সুন্দরের ভাষা জানি না)। মাঝে রয়েছে ইংরেজি ঘরানায় কাব্যদেবীর Invocation- ‘ভাষা দাও, ভাষা দিও’। শেষে রয়েছে কবিতার শক্তিমত্তা জ্ঞাপক প্রত্যাশা-জারিত প্রতিশ্রুতি- ‘লিখে দেবো সমস্ত সুন্দর’। বন্দনাতে উচ্চারণের এই তিনপর্বই কবি মাহমুদ মিটুলের বিস্ময়ের শাশ্বত ও সীমাহীন তিন উৎস। এই তিন উৎসের বিস্ময়ই শিল্পের মাতৃজঠর। এমনটাই ভাবেন মাহমুদ মিটুল। তাই তাঁর কাব্যের শিরোনাম ‘বিস্ময় মুছে দিও না’ প্রকারান্তরে কাব্যের মাতৃজঠরকে বাঁচিয়ে রাখারই এক আকুতি।
অসামর্থ্যের কৈফিয়ত সংশ্লিষ্ট যে বিস্ময় মাহমুদ মিটুল প্রথম উচ্চারণ করেছেন সে অসামর্থ্যের প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ছিলো এমন-
মানুষের ভাষাটুকু অর্থ দিয়ে বদ্ধ চারি ধারে,
ঘুরে মানুষের চতুর্দিকে। অবিরত রাত্রিদিন
মানবের প্রয়োজনে প্রাণ তার হয়ে আসে ক্ষীণ।
পরিস্ফুট তত্ত্ব তার সীমা দেয় ভাবের চরণে;
ধূলি ছাড়ি একেবারে ঊর্ধ্বমুখে অনন্তগগনে
উড়িতে সে নাহি পারে সংগীতের মতন স্বাধীন
মেলি দিয়া সপ্তসুর সপ্তপক্ষ অর্থভারহীন।
এই বিস্ময়ের কেন্দ্রে রয়েছে সসীম ও অসীমের পারস্পরিকতা। আমার ভাষা সসীম, অথচ আমার ভাবরাশি অসীম। এই সসীম ভাষা নিয়ে অসীম ভাবরাশির সামনে দাঁড়ালে দুয়ের মধ্যকার ‘দুস্তর পারাবার’ দেখে যে বিস্ময় দাঁড়ায় মাহমুদ মিটুল সেই বিস্ময়ের কথাই তার বন্দনায় প্রথম উচ্চারণ করেছেন। গ্রন্থভুক্ত অনেক কবিতা কবির এই বিস্ময়ভাবনা থেকে জন্ম নেয়া।
প্রথম কবিতা ‘আমি’তে কবির অভিব্যক্ত সসীমের প্রতিনিধি ‘জ্বলন্ত সোডিয়াম বাতি’ এবং ‘দেহাধারে প্রবাহমান রক্তস্রোত’ বিলীন কালের সীমানায়। কবির ‘আমি’ দেহাধারের মধ্য দিয়ে এই সীমাহীনতায় পৌঁছতে যে অনিবার্য মহাযাত্রার অধীন- সেই অধীনতার বা দাসত্বের বিপরীতে তিনি মূঢ় ও বিস্মিত। এই বিস্ময় থেকে উচ্চারিত তাঁর উচ্চারণ- ‘আলো অন্ধকারের দাসত্বে আমি/ আমি কোথায়? কোথায় চলে যাই?’। একই রকম বিস্ময়ের প্রতিধ্বনি ‘এই জনমে’ কবিতায়। সসীম ‘আয়ুর জ্বালা’ অসীম ‘মায়ার কাছে’ বাধ্যগতভাবে সমর্পণ করার মুহূর্তেও তাঁর একই রকম বিস্ময়জাত উচ্চারণ-
থাকবে জানি রঙের বাহার
থাকবে সকল রূপশোভা
মায়ার কাছে সঁপে দিয়ে আয়ুর জ্বালা
হচ্ছি কেবল লোপাট শূন্য-
সসীমের অক্ষমতা হলো অসীমকে ধারণের, অসীমকে বোঝানোর ভাষা সসীমের নেই। সংকট এখানে, আবার কবির সম্ভাবনাও এখানে। এই সংকটকে চ্যালেঞ্জ করেই কবি তাঁর শিল্পের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলেন। মাঝে মাঝে এই সংকটের উচ্চারণই হতে পারে সে সম্ভাবনার ঘোষণা। কবি মাহমুদ মিটুলের সেরকম একটি ঘোষণা উদ্ধৃত করা যাক ‘অমীমাংশিত’কবিতা থেকে-
শব্দের সংকটে বোঝানো গেলো না
ফুলের প্রতীক ব্যয়ে বোঝানো গেলো না
…………………………………
পুরাকালের গল্পছলে বোঝানো গেলো না
………………………………….
মৃত্যুর মন্ত্র জপে বোঝানো গেলো না
কবিতার ফাঁস পড়ে বোঝানো গেলো না
না বোঝাতে পারার এই যন্ত্রণাজারিত উচ্চারণ একটি অধিদৈবিক শক্তিতে শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিয়েছে সেই সম্ভাবনার বাণী যে, এ অসীমকে বোঝানোর সামান্য শক্তি যদি থেকে থাকে তা কবিরই আছে, আর কারোর নেই।
কবি মাহমুদ মিটুলের কবিতায় প্রতিভাত বিস্ময়ের দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে অসীমের সান্নিধ্যে পৌঁছানোর কাব্যিক অধিকার ও অসীমের শক্তির আবাহন (Invocation)- ‘ভাষা দাও, ভাষা দিও’। অসীমের সাথে একাত্মিকতায় অর্জিত এ বিস্ময় প্রকাশ পেয়েছে এবং এই বিস্ময়ের শক্তিকে আত্মকেন্দ্রে আবাহন করা হয়েছে গ্রন্থের বেশ কয়েকটি কবিতায়। ‘সৃষ্টি অবারিত’ কবিতায় এই বিস্ময় থেকে সৃজিত উচ্চারণ-
নিজেই এবার বসেছি আসনে স্রষ্টার
ভাঙা গড়ার অদ্ভূত মত্ততায়
নিপুণ দক্ষতায়
নতুন মাধুর্যে
বিচিত্র ভঙ্গিতে
করে চলছি সৃষ্টি পুনঃ পুনঃ তোমাকেই।
প্রেমের অবয়বে সেই অসীমের জন্য দেয়া এক কাব্যিক নাম ‘শাশ্বতী শোনো’ কবিতা। প্রেমের অবয়বে মানবিক মিলনের চিত্রকল্পে এখানেও রয়েছে কবির অসীমে মিশে যাওয়ার কল্পনা ও বিস্ময়জাত উচ্ছ্বাস-
ও-শাশ্বতী নদী
শোনো কানে কানে খুব গোপনে
মিশে যাবো একদিন হঠাৎ দুজনে
সীমারেখা ভুলে গিয়ে মিল মোহনায়।
এমন সান্নিধ্যের আবাহনে আরাধ্য অসীমের উদ্দেশ্যে ‘উৎকণ্ঠা’ কবিতায় পুনরায় আবাহন-শব্দমালা-
এসো, মিশে যাই
একে অন্যের যন্ত্রণায়
হারাই নিশ্চল মরণোপাড়ে
ডানার ক্লান্তি ভারে
উড়ে উড়ে সুনিশ্চিত।
মাহমুদ মিটুলের সৃজনশক্তি ও সৃজনশৈলীর উৎসে বিস্ময়ের তৃতীয় স্তর মানবিক ঘটনার প্রতিবিন্দুকে শিল্পের মর্যাদায় পৌঁছে দিয়ে সীমার মাঝে অসীমকে বেঁধে ফেলার প্রয়াস পায়- অর্থাৎ পূর্বোক্ত দুই ধাপের বিস্ময়জাত শক্তির ওপর দাঁড়িয়ে লিখতে শুরু করে ‘সমস্ত সুন্দর’।
কবির এই ত্রিবিধ কিংবা ত্রিস্তর বিস্ময়বোধ মানবিক অভিজ্ঞতার সকল ঘটনাকে কবিতার অনুভবে রূপান্তর করে দেয়। তখন শিল্প বা সৌন্দর্যের মহিমায় পৌঁছতে কোনো ঘটনাকে বা কোনো আয়োজনকে খুব মহামহিম কিছু হতে হয় না। কবি তখন কবিতায় গল্পের ধারণা দিতে গিয়ে সচ্ছন্দে বলতে পারেন-
গল্পটা খুব বেশি নয়
বড়োজোর একটি স্পর্শ চমক কিংবা
পুকুরে শাপলার ধীর পচনের মতো
রকেট পৃথিবীতে শ্লথ একটি রিক্সায়
মুহূর্ত রূপসীর দানে প্রাপ্ত অন্ধত্ব
……………………………….
গল্পটা এইপ কিংবা ডাইনোসর বিলোপের নয়
শুধু একটি লাউ ফুলের ধবধবে শোভা;
……………………………………..
গল্পটা কোনো দেশ বিজয়ের নয়
কেবল দুজনের একসাথে হেসে ওঠা
কবির চেতনায় আবশ্যিক এ ‘বিস্ময়’ এভাবে ‘পুকুরে শাপলার ধীর পচন’কে, ‘একটি লাউফুলের ধবধবে শোভা’কে পৌঁছে দিতে পারে সেই মহিমায় যেখানে দার্শনিকরা ‘অনেক চিন্তার অপচয়ে’ও পৌঁছান না।
এই বিস্ময়ের উপর ভর করে মানবিক অভিজ্ঞতার প্রতি ঘটনাবিন্দু হয়ে উঠতে পারে কবিতা, হয়ে উঠতে পারে শিল্প। তাই বিস্ময়বোধের ওপর দাঁড়িয়েই কীটস বলতে পারেন ‘Beauty is truth, truth beauty’। কেননা এ বিস্ময়ের আশ্রয়ে দুর্ভিক্ষের করুণ দুঃখগুলোও শিল্পীর হাতে রূপান্তর হয় কালজয়ী শিল্প ও সুন্দরের প্রতিরূপে, যেমনটা হয়েছে জয়নুল আবেদীনের হাতে। এই বিস্ময়ের আশ্রয়েই ইরাকের আবু গারাইব কারাগারে সংঘটিত মানবেতিহাসের অন্যতম জঘন্য নির্যাতন শিল্পীর হাতে রূপান্তর হয় অনিন্দ্য শিল্পে।
মাহমুদ মিটুলের অনেক কবিতাই সমস্ত সুন্দর লিখে দেয়ার প্রয়াসে এই বিস্ময়াশ্রিত জীবনের তুচ্ছ তুচ্ছ ঘটনার শিল্পরূপ। মুঠোফোনে অপরিচিত কণ্ঠস্বর এভাবে শিল্পিত কবিতা (দ্বৈববাদ)। উচ্চারিত হয়-
মুঠোফোনে অপরিচিতার কণ্ঠস্বর
জন্ম দেয় চিরহরিৎ কল্পনার
যেনো নগ্ন কোনো বনতরুপথে
সঙ্গিতার কুহ কুহ আবহ
এভাবেই কবির অনুভব দৈনন্দিনতা মুক্ত হয়ে সাবলিমিটি লাভ করে। ‘পুরোনো খবরের কাগজের ওপর/ পরে থাকা বিস্কুটের গুড়ো’ খেয়ে চলা আরশোলার দৃশ্য (আরশোলা আমার সহোদর), ‘ছাড়া ভিটার মতো নির্জন গভীর রাত’ এর দৃশ্য, ‘জেলেনীর দীর্ঘশ্বাস’, ‘রাতজাগা পেঁচা-বাদুর’(জীবনের আড়ম্বর)- এসবই কবিতার চেতনায় লালিত বিস্ময়ের আধার। ‘বিস্ময়’ এর মালিকের আবাহনে প্রাপ্ত ভাষায় এমন সকল বিস্ময়াধারের শব্দরূপ ‘বিস্ময় মুছে দিও না’র বেশিরভাগ কবিতা।
তাইতো কবির আবেদন- বিস্ময় মুছে দিও না। ‘বিপন্ন বিস্ময়’গুলো নাড়া দিয়েছিলো জীবনানন্দকে। তিনি বিপন্ন বিস্ময়কে জীয়নমাটিতে জ্যান্ত করে দিয়ে গেছেন বাঙলা সাহিত্যের জন্য। জীবনানন্দের দ্বিপ্রজন্ম ব্যবধানের অনুজ কবি মাহমুদ মিটুল সেই বিস্ময়ের শুভকামনায়-শুভার্থিতায় সাজিয়েছেন একগুচ্ছ কবিতা তাঁর ‘বিস্ময় মুছে দিও না’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে। এই কবিতাগুচ্ছ পাঠ করে আমাদেরও প্রতীতি শিল্পের অনুভব ও বোধ জেগে ওঠার জন্য আবশ্যিক বিস্ময়টুকু এই জগতজমিন থেকে হারিয়ে না যাক।