
বিনিময়
নেতার গলির বাসা থেকে বড় রাস্তার মোড়ে আসতে আসতেই সময় লেগে গেল। তখন বিকেলের রোদ দেয়াল থেকে বিদায় নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘড়িতে সময় খুব বেশি নয়। বিকাল পৌনে পাঁচটা। কিন্তু শীতের বিকেল এখন হলুদ, একটু পরেই মড়া ঘাসের মতো বিবর্ণ হলুদ তারপর অন্ধকারের কাছে আত্মসমর্পনের জন্য প্রস্তুত। বাতাসে হালকা হিম তারপরও শিলুর মনে হয় ভেতরে সে ঘামছে। উত্তেজনায় এবং দুশ্চিন্তায়। উত্তেজনা তার সমস্যার একটা সুরাহা অতি আসন্ন, আর দুশ্চিন্তা ঠিক সময় মতো পৌঁছানো নিয়ে।
শিলু আর নিজেকে বাঁধতে না পেরে দ্রুত নিশ্বাস নিয়ে বলে- আচ্ছা ওনাকে পাওয়া যাবে তো।
নেতা আশ্বস্ত করেন- চিন্তা করছো কেন। কোন সমস্যা নেই। ওদের আসল অফিস শুরুই হয় পাঁচটার পরে।
শিলু একটু আশ্বস্ত হয়। সামান্য স্থির হয়ে শরীর ঢিলা দিয়ে বসে। এতক্ষণ সে উত্তেজনা আর উৎকন্ঠায় ভালো করে বসতেও পারেনি। ভেতরে বকুটা তার প্রচন্ড লাফাচ্ছিল যেন ছিটকে বের হয়ে আসবে। আর সে এমনভাবে পিট টান করে বসে ছিল যেন তার এই টান টান শিরদাড়াই রিক্সা দ্রুত এগিয়ে নেবে। নেতার বাসাটা পুরোনো ঢাকার গলির ভেতর। কয়েকটা সর্পিল গলি পার হয়ে আসতে হয়। তিনি অবশ্য যেখানে থাকেন সেটা একেবারে গলি বলা হলে রাস্তাটাকে খানিকটা অপমান করা হবে। তার বাসার সামনের রাস্তায় গাড়ি আসে। তবে আসার যে ব্যবস্থা তাতে গাড়ি না আসাটাই স্বস্তির ও যুক্তির। নেতার গাড়ি আছে। তবে গ্যারেজ নেই। তিনি এখানে গাড়ি রাখেন না। গাড়ি রাখেন ভাড়া করা গ্যারেজে। খানিকটা রিক্সা করে গাড়ির কাছে আসেন। শারীরিক সমস্যা বেশি হলে গাড়ি তার কাছে আসে। আজ নেতার শরীরটা বেশি ভালো নেই। গলাটা ভাঙ্গা। বুক থেকে গলা অব্দি একটা ঘরঘর আওয়াজ উঠছে। মাঝে মাঝে গলা খাকারি দিয়ে তিনি কাশ ও গলা পরিষ্কার করছেন। বোঝা যায় নেতার ঠান্ডা লেগেছে। তবু তিনি গাড়িতে উঠেননি। রিক্সা করেই যাচ্ছেন। শিলুর গাড়ি নেই। কিন্তু নেতাকে নিয়ে যেতে হবে তাই গাড়ির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল। নেতা রাজি হননি।
মুচকি হেসে বলেছে -আমি মাটির মানুষ সব রকমে অভ্যস্ত আছি। তুমি চিন্তা করো না। রিক্সা দিয়ে দুজনে ঠিক মতোই চলে যেতে পারব।
নেতা যে মাটির মানুষ তা বুঝতে শিলু এক লহমও দেরি হয়নি। নেতা এইখানে গলির ভেতর একটা আধা-পাকা ঘরে থাকেন। এটা তার বাপ দাদার ভিটা। এখানের মানুষগুলোর সাথে তার সম্পর্ক বটগাছ আর স্বর্ণলতার মতো। তিনি বটবৃক্ষ হয়ে তাদের ছায়া দেন। এরা স্বর্ণলতার মতো সেই বটবৃক্ষকে পেচিয়ে উপরের দিকে উঠে আকাসের নীলের দিকে তাকায়। যদি নেতা না থাকতেন তবে ঐ গলির পাশে বহমান যে নোংরা কালো ড্রেন, পচা নর্দমা সেখানে কীটের মতো পড়ে থাকতে হতো মানুষগুলোকে। ঐ গু গন্ধের নিচে চাপা দিয়ে রাখতে হতো স্বপ্নগুলো। শুধু নেতা তার বাপ-দাদারা এখানকার মানুষের জন্য জানে কোরবান হয়েছিল। সে কথা যেমন জানে এখানকার মানুষ তেমন জানে কাক পক্ষী আর দালানের ইট। শুধু এই হৃদয়ের টান আর নাড়ীর বন্ধনের মানুষগুলোর জন্য নেতার এই গলির ভেতর পড়ে থাকা। নেতা তো উচ্চ কণ্ঠেই বলেন- এখানকার মানুষ তাকে নেতা বানিয়েছে এদের জন্য তার স্বর্বস্ব উৎসর্গকৃত।
হ্যাঁ এই ধূলোর মতো, নর্দমার কীটের মতো মানুষগুলোর জন্যই নেতার এই আত্মদান। তা না হলে নেতার বাড়ি রয়েছে অভিজাত ঢাকায়ও। বারিধারায় তার আলিশান বাড়ি। গ্যারেজ, চোখ জুরানো নন্দনকানন, গেটে দারোয়ান। ভেতরে শেকলে বাঁধা এলশিয়ান কুকুর। সব ছেড়ে নেতার এই সাধারণ জীবন, দীন বেশ। সে বাড়িতে অবশ্য নেতার বংশধর, ছেলে, নাতিপুতিরা থাকেন। নেতা অবশ্য তার ছেলে নাতি পুতিদের উপর খুবই বিরক্ত নিজের রক্তের টান শেকড়ের টানকে অস্বীকার করে কিসের আবার ভোগ বিলাস, বিত্ত বৈভব। তবে আজকাল ছেলেপেলেরা কি আর কথা শোনে!
নেতার বিরাট ক্ষমতা। তবে নেতা অবশ্য বলেন জনগণ ক্ষমতার উৎস। জনগণই সব। এটা বোঝেন বলেই নেতার এত ভক্ত, শিষ্য, এত নাম, এত অনুরাগী। নেতার বর্ষীয়ান হয়েছেন। বয়স হলে নাকি সব ফুটুস। কিন্তু নেতার কিছুই ফুটুস হয়নি। তার ব্যক্তিত্ব, পাহাড়ের মতো তার উচ্চতা তাকে দিন দিন আরও পোক্ত জায়গায় নিয়ে গেছে। শুধু গাল ভরা নেতা শব্দ নিয়ে তিনি নেতা নন। যেমন তার ক্ষমতা তেমনি দেখতেও তিনি নেতা। লম্বা চওড়া দেহ, গৌর রং। এখন অবশ্য বয়সের জন্য লম্বা চেহারার চেয়ালের কাছে দুটো ভাজ আর গলার কাছে ভাজ জমেছে, পুরো ঠোটের নীচের থুতনিটা একটু ঝুলে গেছে। না তাতে নেতাকে চামচিকার মতো দেখান না। নেতার মাথায় কোন টাক নেই। উল্টো করে আচড়ে রাখা সফেদ চুলে, চোয়ালের বাইরে আর একটা ঝুলানো পাশনা চোয়ালে তাকে কেশর ফেলানো সিংহের মতোই দেখায়। যদিও কেশর থাকে সিংহীর কিন্তু নেতার তুলনা একমাত্র সিংহই। বনের রাজা সিংহের মতো নেতা এ গলিতে থাকেন, সাধারণ মানুষের কথা ভাবেন শুধু তাই নয়। নেতা প্রকৃতই মাটির মানুষ। মানুষের যে কোন সমস্যার সমাধান করেন। না, না নেতা কোন স্বার্থ খুঁজেন না, নিস্বার্থভাবে ঝাপিয়ে পড়েন। নেতার এই অতি মানবীয় গুণের প্রশংসায় অভিভুত হয়ে সুরাইয়া আক্তার শিলুর নেতার কাছে আগমন এবং আজকের এই সফল অভিযানের সফর। নেতা তার পাশে বসে আছেন। নেতাকে একটু দুর্বল দেখাচ্ছে। নেতার বয়স হয়েছে। নেতাদের বয়স আর কে গোনে। নেতার বয়সও গোনা নেই। তবে সম্প্রতি নেতার গুণমুগ্ধরা কেক কেটে তার বাহাত্তরতম জন্মদিন পালন করেছে। তবে কেউ কেউ বলে বুড়ার আশি বছর বয়স। এসব দুর্জনের কথা, বাড়াবাড়ি। নেতার ক্ষমতার প্রতি ইর্ষা আর লোভ।
সুরাইয়া আক্তার শিলু ছোটবেলার মুখস্ত করা বাগধারার সেই ইদুর কপালী। অথবা তার অবস্থা বর্ণনায় সেই প্রবাদকেও ধার করা যায় ‘অভাগী যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়’। এই অভাগীর ভাগ্যের জং ধরা তলাটা চাবি দিয়ে খুলতেই নেতার বটবৃক্ষের ছায়ার তলে তার আশ্রয় গ্রহণ।
শিলুর বয়স বিয়াল্লিশ। ডির্ভোসী।
সোনার হরিণ একটা সরকারী চাকুরী তার দখলে। চাকরিটা সম্মানজনক। ভালো পদ। তবে এখন তার সমস্যা চলছে। সমস্যা বেশ জটিল।
সরকারী চাকরি এখন সরকারী না হয়ে দলের। আর দলের কর্মীদের গোস্যার ভেতরে তাকে থাকতে হচ্ছে পাঁচ বছর ধরে। এই গোস্যার কারণ অবশ্য দল নয়। সে সাইনবোর্ড হারিয়েছে পাঁচ বছর। সবাই তাকে মনে করে মালিক ছাড়া বিপনী বিতান। ঐখানে সবাই কেনা বেচা করতে চায় । আর সেখানটাতেই বড় গোলমাল।
সরকারী চাকরি চাইলেই একেবারে ডিসমিস করে পথের কাঙ্গালিনি করা যায় না। তবে টাইট দেয়া যায়। নাকানি, চুবানি খাইয়ে একেবারে নাস্তানাবুদ করা যায়। মেয়ের সাইনবোর্ড নেই, ডির্ভোসী সুতরাং ‘ডালমে কুছ কালা’ তো আছেই। ভালো মেয়ের কি আর ডিভোর্স হয়! এরকম অসতী দাগা খাওয়া মেয়ে কারো কথা শুনে না। মাথা উচা করে কথা কয়। কারো মুঠোয়ও থাকে না তাকে তো শিক্ষা দিতেই হয়। হারে হারে বুঝিয়ে দিতে হয় স্বাধীনতার সুখ, মাথা তুলে হাঁটার উদ্ধত্য। শিলুর সে সুখ বুঝে নিতে হচ্ছে কড়ায় গন্ডায়। সে এখন সব সময় বিরোধীদলের ঘনিষ্ঠ কর্মী। গত সরকারের আমলে সে ছিল বিরোধীলের ডেডিকেটেড কর্মী। এই সরকারের সময়েও সে বিরোধীদলের ডেডিকেটেড কর্মী। গতবারে তাই তার টেবিল ছিল না। বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হয়ে তার নাকের ডগার সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো দাগী আসামীর ফাসির দাড়ি। ফাসি তার গলায় কেটে কেটে বসে যায়নি এবং মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ঝুলে থাকতে হয়নি। এক সময় বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সে একটা টেবিল পেয়েছে, বসেছে। কিন্তু তার বিভাগীয় মামলার সুরাহা হয়নি।
নতুন সরকার এসেছে। এবার তার ভালো থাকার কথা। কিন্তু এখন তার ঘোর দুর্দিন আরো ঘন হয়েছে। খুব সাবধানী পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে। সে গত সরকারের ঘনিষ্ঠ লোক ছিলো। এখন তার জন্য ফাসির আদেশ আবার অপেক্ষমান আছে।
তার আবার বড় সমস্যা হচ্ছে বিয়াল্লিসের শরীর থেকে তার যৌবন অপসৃত সন্ধ্যার মতো অন্ধকারে মিলিয়ে যায়নি। এখনও তার দেহে মধ্য দুপুরের রোদ আর তাপ। উচ্চতায় সে সামান্য বেটে। রং শ্যামলা আর একটু কঠিন করে বললে কালোই বলতে হয়। চেহারায় বাঙালি নারীর গড়পড়তা লাবণ্য। একটু পরু ঠোট টেউ খেলানো যেন অসমাপ্তর কিছু কথা বলার অপেক্ষায়। মাথায় ঘন কালো চুল পিঠের উপর সাপের ফনা হয়ে দুলে থাকে। দুচোখের তার কলো চকচকে। যেন কিছু প্রশ্ন ঝুলে আছে স্থায়ীভাবে। তবে অপূর্ব অসাধারণ বক্ষ তার। যেন সঠিক মাপের ছাচে নিখুঁত করে গড়ে তুলেছে কোনো দক্ষ ভাস্কর। সবকিছু অতিক্রম করে নতুন দায়ের কোপ বসিয়ে দেয় চোখে।
এই বিষম শরীর তাকে টেবিল ছাড়া করে। ফাসির দড়ি দেখায়। রাজনৈতিক দলের কর্মী বানায়। প্রতিপক্ষ তাকে প্রতিদিন ফুটবল বানায়। ইচ্ছেমতো গোলপোষ্টে ঢোকায়। কখনও এই কখনও ঐ। রাজনীতির এইসব খেলায় আগে মেয়েলোক ছিল না। খেলাটা ছিল পুরুষের। এখন আর মেয়ে পুরুষ নেই। রাজনীতির প্রতিপক্ষ সবাই, যাকে খুশি তাকেই কোরবানীর খাসি বানানো যায়। আর মেয়ে মানুষ কি আর এখন লেদার মতো পড়ে থাকে নাকি। রাজনীতির সুবিধা, দলের নাম ভাঙ্গিয়ে কাম আর হালুয়া রুটির ভাগ কি না নেয় নাকি! তবে আর মেয়েলোক ফাসির আসামি হবে না কেন। সে অবশ্য দলের সুবিধা নেয়নি। নাম ভাঙ্গিয়ে ক্ষমতা দেখিয়ে কোন টেবিলও বাগায়নি। কিন্তু সেসব বলে কি লাভ। এমন একটা বেওয়ারিশ শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বসের নাকের ডগার সামনে দিয়ে আসে যায়। নিজেকে কাজের লোক মনে করে ফুটানি মারে। বসের পায়ের কাছে বসে যায় না। প্রভাবশালী কলিগ ভাইদের বড় ভাই মান্য করে দেয়া-থোয়া করে না। এটা কি কম অপরাধ! সেই অপরাধের দন্ড নিয়ে এবারও যখন তার ফাসির হুকুম সময়ের ব্যাপার মাত্র। তখন সে নানাভাবে চেষ্টা করছে দড়িটাকে অদৃশ্য করতে। চাকরিটা টিকিয়ে রাখা তার খুবই দরকার। তার ছেলেটা পড়ে ক্লাশ এইটে তার খরচ, নিজের খরচ। এই ঢাকা শহর রাক্ষসের মতো পয়সা গিলে। চাকরি ছাড়া এখানে একদিনও টেকা যাবে না। তাই ছুটতে হচ্ছে দিদ্বিদিক। সাহায্য করতে এগিয়ে কেউ আসেনি এমন নাফরমানী কথা বলা যাবে না। তবে সাহায্য তো আর দরিয়ার পানি না যে কোন বিনিময় মূল্য ছাড়াই লোটা লোটা ঢেলে দেয়া যায়। এর জন্য কিছু লাগে। যাকে ভদ্র ভাষায় বলা হয় গিভ এন্ড টেক। এই গিভ এন্ড টেক শব্দটা ভালোভাবেই শিখেছে শিলু একেবারে হাড় মাংস দিয়ে। এখানে যাই করা হোক না কেন, যে যত দরদেই ফেটে পড়ুক না বিনিময় ছাড়া কিছু নেই। বিনিময়ের জন্য মালের প্রয়োজন। মাল মানে টাকা, মাল মানে নারী। আর তার জন্য মাল হলো টাকা অথবা শরীর। তার টাকা নেই বোঝাই যায়। চাকরি করে কার কয়টা টাকা জমে। তাই ইঙ্গিতটা সরাসরি শরীরের দিকে। কেউ কেউ অবশ্য আরো একটু ভালোমানুষী দেখিয়ে বিয়ের প্রস্তাবও রাখে। স্বামী নামক সাইনবোর্ডটা এত কঠিন জিনিস আগে বুঝতে পারেনি শিলু। তাহলে মদ আর নারীতে ফানা হয়ে যাওয়া ঔ লোকটাকে ঘৃণা করলেও সাইনবোর্ডটা ঝুলিয়েই রাখতো যেমন ঝুলিয়ে রাখে এ শহরের হাজার হাজার মানুষ। এসব বিনিময়ের ঘোরপ্যাচ আর ইঙ্গিতের লু হাওয়ায় সে ঘোরে। স্টেশনে স্টেশনে ঘোরে। কিন্তু বিষয় ঐ একটাই দাও আর নাও।
শেষ পর্যন্ত শিলু সন্ধান পেয়েছে এই মাটির মানুষ, দরদী নেতার। সন্ধান পেয়েছে কি নেসেসিটি ইজ দ্যা মাদার অফ ইনভেনশন এই টেনশলেশনের যথার্থ মর্ম উদ্ধার করে সে সন্ধান করে নিয়েছে। বহু কাঠ খড় পোড়ানোর বিনিময়ে তার এ রত্ন লাভ। সে শুনতে পেয়েছে নেতার ঐ এক বিঘত করতলের নীচে পাঁচটা, দশটা সচিব ভেদা মাছ। আর তার ঐ তদবির আর এমন কি বড় তদবির। ওয়ান টু-এর ব্যাপার। সে তো আর মফস্বল থেকে ঢাকায় বদলী চায় না, টু পাইসের টেবিল চায় না, অবৈধ প্রমোশনও চায় না। চায় শুধু নিজের টেবিলের সামনের চেয়ারটা একটু শক্ত করতে। এটা আর এমন কি। শিলু এতদিন যা শুনছে তা তো সে এখন চোখেই দেখতে পাচ্ছে। নেতার কি বিশাল নেট ওয়ার্ক। চোখের ইশারার কত তাৎপর্য।
শিলু আরো খুশি এই প্রথম তদবিরে তার কাছে কিছুই চাওয়া হয়নি। কোনো বিনিময়ের প্রয়োজন হচ্ছে না, না কিছুই লাগছে না। অন্তর দিয়ে নেতা তার অন্তরের দুঃখ বুঝতে পেরেছে। আর তাতেই তার কাজ করে দিচ্ছে। শুধু দিচ্ছে বললে হবে না। হাসিমুখে প্রাণ দিয়ে করে দিচ্ছে। শিলু খুব চিন্তায় ছিল। কিন্তু তার এ অবস্থান পোক্ত করার অভিযানে কিছুই খরচ করতে হচ্ছে না। অর্থ যা তার নেই সেটা দিতে হচ্ছে না আর যৌবন যা সে দিতে চায় না। যার জন্য তার এই তকলিফ। তাও দেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। নেতা তার সব সমস্যার সমাধান করে দিবে। আর বিনিময়ে সে কিছুই চায় না। শিলুর কল্যাণই তার একমাত্র লক্ষ্য।
নেতার কথা বলতে গেলে অবশ্য বলতে হয় চ্যালাদের কাছ থেকে জেনেই বা চ্যালা ধরেই সে এতটুকু আদায় করে নিচ্ছে তা নয়। নেতাকে সে আগে থেকে চিনতো। নেতাকে তো চেনে পুরো বাংলাদেশই। তবে সে রকম চেনা নয়। নেতার সাথে বহু আগে তার জানাশোনা ছিল। তখন অবশ্য নেতা এমন বাঘা নেতা হয়ে উঠেননি। শিলুও তখন একটু আধটু রাজনীতি করতো। দলের একনিষ্ঠ কর্মী ছিল সে। তাকে এখন বিরোধী দলের কর্মী বলে সাজানো হলেও আর এ কারণে তার এই দুর্গতি হলেও সংগোপন সত্য হলো সে যখন রাজনীতি করতো তখন আজকের এই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিই করতো। আর তখনই তার সাথে নেতার সামান্য জানাশোনা ছিল। সেটা অবশ্য অনেক আগের কথা। এখন তার কাছে দলের চেয়ে ভাত অনেক বেশি প্রয়োজনের, ছেলের ভবিষ্যৎ অনেক বেশি চিন্তার আর এই চাকরি টিকিয়ে রাখা অনেক বেশি দরকারী। এ সব দরকারী বিষয়ের কাছে রাজনীতি বহু আগেই বানের পানিতে নৌকার খুলে যাওয়া পাটাতনের মতো ভেসে গেছে।
নেতা হচ্ছেন প্রকৃত একজন মানুষ। ঐ সামান্য পরিচয়কে তিনি মনে রেখেছেন, মূল্যায়ন করেছেন এবং দলের জন্য ঐ সামান্য কাজকেই অনেক বড় করে দেখেছেন। নেতার কাছে আসতে হয়েছে কয়েক দিনই। ভালো করে বুঝিয়ে বলতে হয়েছে কোথায় হাত দিতে হবে। কোন জায়গা থেকে ফেলতে হবে তদবিরের বোমাটা। নেতা মেধাবী মানুষ। সব তার নখদর্পনে। বুঝে নিয়েছেন কোনখানে রয়েছে চাবিকাঠি। নেতা চায় কাজটা একেবারে অতি দ্রুত হোক। আর তাই নিজেই অভিযানে অংশ নিয়েছে। এখন তারা যাচ্ছে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের দিকে। আজই হয়তো কাজটা হয়ে যাবে। নেতার বাড়ি থেকে এই বড় রাস্তার মোড়ে আসতে লাগা সময়টুকু তাই শিলুর এত উত্তেজনার এত উদ্বিগ্নতার। নেতাকে এভাবে নিয়ে যাওয়া তো আর যা তা কথা নয়। কারণ নেতার সময়ের বড়ই অভাব। বহুকষ্টে আজকের এ সময়টুকু বের করা সম্ভব হয়েছে। অবশ্য স্বীকার করে শিলু নেতা তাকে খুব খুশি মনেই সময় দিয়েছে। তাকে খুব বেশি তোয়াজ তোষামোদ করতে হয়নি এবং শিলুকে কথাও দিয়েছে যে কোন প্রয়োজনে শিলুকে সময় দেবে।
রিক্সা এগিয়ে যাচ্ছে। নাজিমুদ্দিন রোড পার হয়ে রিক্সা এখন দোয়েল চত্ত্বরের দিকে। বিকেলটা সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছে। আর একটু পরেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে যাবে। ভেতরে শিলু আবার উত্তেজনা বোধ করে। একবার ভাবে নেতাকে জিজ্ঞেস করবে ওনাকে পাওয়া যাবে কি না? কিন্তু করে না। নেতার মনটা ভালো। বেশ প্রসন্ন মনে তিনি শিলুর সাথে কথা বলছেন। যদিও তার গলাটা একটু ভাঙ্গা। ভাঙ্গা হলেও নেতা কথা বললে গম গম আওয়াজ হয়। খুব ভরাট কন্ঠ নেতার। একেবারে নেতার যোগ্য কন্ঠস্বর। শিলুর সাথে আসলে তিনি কথা বলছেন না। শিলুকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন।
শোন, তুমি কোন চিন্তা করবে না। ঐ একটা চাকরি ঠিক করা আর তোমার বসকে একটু ধাতানি দেয়া আমার আসল কোন উদ্দেশ্যই নয়। এটা করার দরকার তাই করছি। এটার পর তোমাকে আমি বিদেশে একটা ট্রেনিং নিয়ে দেব।
না, না আমার জন্য আপনাকে এতো কষ্ট করতে হবে না। শুধু চাকরিটা ঠিক করে দিলেই আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
তোমার চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তোমার চিন্তা আমার। আর তোমার ছেলের ভবিষ্যৎ কিভাবে ভালো হবে সেটাও আমি চিন্তা করে রেখেছি।
ছেলের কথায় শিলুর খুব উৎসাহ বাড়ে। ঐ একটা ছেলের জন্যই সব, এত যুদ্ধ, এত কসরত, সাপ-লুডু খেলা। নেতা একজন দূর দৃষ্টি সম্পন্ন লোক। শিলুর ছেলের জন্যও তিনি চিন্তা করেছেন। কি অবাক ব্যাপার শিলু একবারও বলেনি অথচ তিনি ভাবছেন । আহা এই না হলে নেতা!
কি ভেবেছেন?
ভেবেছি ওকে শিশু শিল্পীদের দলে রেখে বাইরে থেকে একটু ঘুরিয়ে আনবো। তাতে ওর মেধাটা বাড়বে। বাইরের দেশের শিশুদের দেখে ও অনেক শিখতে পারবে।
কিন্তু ও তো কোন শিল্পী নয়।
নেতা শিলুর কথার উত্তর দেন না। কি একটু ভেবে বলেন- আচ্ছা ওর বয়স জানি কত বলেছিলে।
দশ বছর।
হ্যাঁ একেবারে পারফেক্ট। কথা বলতে বলতে নেতার গলাটা আবার একটু ঘরঘর করে। দুবার গলা খাকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করেন।
আপনার বোধহয় বেশ ঠান্ডা লেগেছে।
না, ঠান্ডা আর কি। তবে শীত আসলে বুকটা একটু ভারী লাগে। কাশটা জ্বালায়।
শিলু একটু চিন্তা করে তারপর বলে- বিদেশে যাওয়াটা তো ওর জন্য খুবই বড় ব্যাপার। তবে ওকে তো ভালো টিচার রেখে পড়ানো দরকার। অনেক কষ্ট করে ওকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াই। সেখানেই প্রচুর খরচ, ভালো টিচার রাখতে পারি না, টিচার হাইলি এক্সপ্রেনসিভ।
নেতা গলাটা কাশ দিয়ে পরিষ্কার করেন- খরচের চিন্তা তোমাকে কে করতে বলেছে। আমি আছি না।
রিক্সাটা একটু ঝাকি খায়। শিলুর শরীর দোলে। নেতার শরীরের সাথে বাড়ি খায়। পিছনের রিক্সা এসে জোরে ধাক্কা লাগায়। নেতার শরীরের নিন্মাংশ রিক্সার সিট থেকে উর্ধ্বে উঠে যায় দুটো হাত সামনের দিকে প্রসারিত হয়ে ২০০ মিটার বাটারফ্লাই সাতারে ঝাপ দেয়া প্রতিযোগীর মতো দেখায়। শিলু দুহাত বাড়িয়ে নেতাকে ধরে সিটে বসায়। একটু ভয়ও পায়। এ বয়সে নেতা যদি পড়ে যান আর তার জন্য ব্যথা পান তাহলে লজ্জার কোন শেষ থাকবে না। শিলু ভালো করে নেতাকে ধরে বলে- ব্যথা পাননি তো।
আরে না, না আমি কি এত নরম নাকি।
শিলু হাসে। নেতার এই দৃঢ়তা দেখে তার ভালো লাগে। নেতাকে তো শক্ত হতেই হবে।
পথ আর বেশি নেই আর একটু। শিলু আবার উত্তেজনা বোধ করে। ভেতরটা কাঁপে। কাজটা হবে তো। হবে না কেন এতো বড় একজন নেতা।
নেতার হাতটা শিলু এখনও ধরে রেখেছে, শেষ বিকেলের বাতাসটা কুয়াশায় ভেজা। আসন্ন সন্ধ্যা কেমন আচ্ছন্ন করা, মন খারাপ করা আর স্মৃতি জাগানিয়া। শিলু সেদিকে তাকিয়ে একটু আনমনা হয়। এ জীবন এ যুদ্ধ কত আর। কত আর ক্ষয়ে যাওয়া।
নেতা আবার বলে- দেখ শিলু। তোমার কোনো কিছু নিয়েই তুমি আমার সাথে সংকোচ করবে না। মন খুলে সব বলবে। বল তোমার জন্য আর কি করতে পারি।
শিলু সুন্দর করে হাসে- আমার জন্য এখন আর কিছুই করতে হবে না। শুধু চাকরির এই সমস্যাটাই মিটিয়ে দেন। প্রতিবার আমাকে এই বিরোধী দলের কর্মী বানিয়ে এই অত্যাচার নির্যাতন আসলেই আর সহ্য হচ্ছে না। মানসিকভাবে আমি খুব ভেঙ্গে পড়েছি। সত্যি আমি খুব ক্লান্ত।
আহা। ওটা নিয়ে ভাবছো কেন ওটা তো আজই শেষ করে দেব।
আপনি তো আমার জন্য অনেক করছেন। বিনিময়ে আমি তো আপনাকে কিছুই দিতে পারব না।
বিনিময় ভাবছো কেন।
না ভাবছি না কিন্তু নিজেকে তো ঋণী মনে হয়।
নেতা খলখল করে হাসেন হাসিতে কাশ আটকে খসখস আওয়াজ ওঠে-
কি যে বল তোমার আবার ঋণ কি। তোমাকে সব করে দেব। তোমার কিছু ভাবতে হবে না।
শিলু কৃতজ্ঞতায় মাটি হয়ে যায়। কি বলবে ভেবে পায় না। তারপর বলে -আপনি বড় মানুষ। আপনার কোন উপকার আমি হয়তো করতে পারবো না তবে ঐ যে পিপড়া আর ঘুঘুর গল্পটা শুনেছেন না। আর ঐ সিংহ আর ইদুরের গল্পটা। অনেক সময় ছোটকেও বড়র প্রয়োজন হয়। তেমনি আমিও যদি কোন কাজে লাগি জান দিয়ে করে দেব।
না তোমাকে কিছু করতে হবে না। শুধু একটা কথা, শুধু একটা জিনিস চাই।
নেতাকে বেশ উত্তেজিত দেখায়। মুখে যেন সব রক্ত চলে এসেছে।
শিলু নেতার দিকে তাকিয়ে বলে- কি জিনিস?
নেতার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে এ্যাজমা রোগীর মতো শ্বাস টান ওঠে। গলার ঘরঘরে আওয়াজে কথা আটকে গোতগোত শব্দ হয়। তারপর শিলুর হাতে হাত রেখে ভাঙ্গা গমগমে আওয়াজে বলে- একবার শুধু দেখতে চাই। বলতে গিয়ে শিলুর মনে হয় নেতার গলার কাছে দম আটকে যাচ্ছে। নেতার এ দম আটকে যাওয়া দেখে শিলুর ভয় লাগে আবার খুব অবাকও লাগে নেতা এরকম করছেন কেন!
কিছুই না বুঝে বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে বলে- কি দেখতে চান?
নেতা শিলুর হাতের ওপর আর একটা হাত রেখে দুই হাতে শিলুর হাত চেপে ধরে বলে- বিশ্বাস করো এত সুন্দর আমি জীবনেও দেখিনি। কোনদিন দেখিনি।
নেতার হাতটাকে শিলুর বেশ গরম মনে হয়। শিলু না বোঝা দৃষ্টি নিয়ে চোয়ালের পাশ দিয়ে আর একটা ঝোলানো চেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঝুলানো থুতনিটা আকুতিতে আরো একটু ঝোলানো দেখায়। কেশর ফেলানো নেতাকে এ মুহূর্তে শিলুর কাছে ওলা বেড়ালের মতো লাগে।
নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তার মুখ থেকে বের হয়- কি সুন্দর?
শিলুর হাতের ভেতর থাকা নেতার হাতটার কম্পন টের পায় শিলু। নেতা তখন গদগদ কন্ঠে বলেন- ঐ যে তোমার শাড়ির ওপর দিয়েও যা দেখা যাচ্ছে। সত্যি আমি জীবনে এত সুন্দর দেখিনি। সত্যি বলছি শিলু আমি ধরবও না, ছোবও না, কিছু করব না। একবার শুধু দেখব। দিবে শিলু একবার শুধু দেখতে।
তখন সন্ধ্যা। শিলুর হাতের ভেতর নেতার অস্বাভাবিক গরম হাত প্রবল বেগে কাঁপছে। আর রিক্সা একেবারে সচিবালয়ের কাছাকাছি।