
বিদ্রোহী’র নজরুল
কল্পনায় সর্ববিস্তারী “আমি” সত্তাকে সত্য জ্ঞান করা যে রোমান্টিকতা ব্যক্তিকে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করে সকল কিছুকে ছাপিয়ে ভাবতে বসায় কিংবা বলতে শেখায় তার সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক উদাহরণ সদ্য রচনার একশত বছর পরেও উচ্চ শিরে সগৌরবে মাথা তুলে স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সমান গ্রহণযোগ্যতা ও আবেদনে অনন্য ও কালজয়ী সৃষ্টি দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) “বিদ্রোহী” কবিতা (১৯২১)। যা অনড়, যা অবিচল, যা রক্তচক্ষু রাঙা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বিদ্রোহী কবিতার একশত বছর পূর্ণ হয় যা গুরুত্ব ও প্রাধান্যের দাবীতে অনন্যসাধারণ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলা সাহিত্যের ব্যঞ্জনার সমারোহে। কবিতাটি আপন ধর্মে স্থিত অসাধারণত্বে নিজেই একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়, একটি সম্পূর্ণ যুগধর্মের পূর্বরাগ, একটি জীবনবোধের ধারনা এবং একটি চেতনার স্বরুপ যা প্রজন্মের মানসিক সংগঠনে স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তিসত্তা গঠন ও নিজস্ব বোধ ও বিধান তৈরির কাঠামোগত সংঘঠন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রাখে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর ভূমিকা। এই অধ্যায়টি লিখে যায় ও বলে একজন নজরুলের স্বতন্ত্র ও যুগাবতার ভূমিকা।
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
১৯২১ সালের ডিসেম্বর, ক্রিসমাসের রাত। কলকাতার ৩/৪সি, তালতলা লেনের বাড়িতে বসে কাঠ পেন্সিলে এই কালজয়ী কবিতা লিখতে শুরু করেন সদ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত বিধ্বস্ত বাইশ বছরের যুবক কাজী নজরুল ইসলাম, যে নজরুল আপাদমস্তক সময়-স্থান ও বাস্তবতার রূঢ়তার সমন্বয়ে একজন আহত বাঘ, প্রলয় শিখার মতো প্রজ্বলিত হয়ে যা জ্বালিয়ে ধ্বংস করতে চায় অপশোষণ, সকল অসুন্দর সকল অন্যায়কে। অযৌক্তিক খেয়ালী বিধাতা তথা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে অগ্নিদ্বগ্ধ প্রশ্নাহত অস্থির নজরুল সম্ভবত মধ্যরাতে কবিতাটি লেখা শুরু করেছিলেন কলকাতায় অবস্থানকালীন সময়ে। কারণ তিনি ১৯২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ পরবর্তী কালে সৈনিক জীবন থেকে সরে এসে ভিন্ন পথের সন্ধানে অন্য জিজ্ঞাসায় কলকাতায় জীবন যাপন শুরু করেছিলেন যেখানে কমরেড মুজফফর আহমেদ ছিলেন তাঁর জীবন ভাগাভাগির আধার। কলকাতায় ডিসেম্বরের সেই রাতে কবিতা লেখার পরের দিন সকালে প্রথম পড়ে শুনিয়েছিলেন তার বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমদকে। ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’ বইয়ে কমরেড মুজফফর আহমেদ লিখেছেন, ”আসলে বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়।
মুজফফর আহমদ আরো লিখেছেন,
তখন নজরুল আর আমি নীচের তলার পূব দিকের, অর্থাৎ বাড়ীর নিচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোনের ঘরটি নিয়ে থাকি। এই ঘরেই কাজী নজরুল ইসলাম তার ”বিদ্রোহী” কবিতাটি লিখেছিল। সে কবিতাটি লিখেছিল রাত্রিতে। রাত্রির কোন সময়ে তা আমি জানিনে। রাত দশটার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটি কবিতা লিখেছে।…পুরো কবিতাটি সে তখন আমায় পড়ে শোনাল।.. বিদ্রোহী কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা।
পেন্সিলে লেখা ১৩৯ পঙক্তির ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আগেই অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য’র আগ্রহে ১৯২২ সালের ৬ই জানুয়ারি শুক্রবার সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয় যার কারণে সপ্তাহে ওই কাগজটি দুইবার মুদ্রণ করতে হয়েছিল। পরবর্তীতে ‘মোসলেম ভারত’-এর কার্তিক সংখ্যায় সেটা ছাপা হলেও সেই সংখ্যাটি বের হয়েছিল ফাল্গুন মাসে।
মুজফফর আহমদ লিখেছেন,
বিদ্রোহী ছাপা হওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সাক্ষাৎকারের কথাও শ্রী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন এবং নজরুলের মুখে শুনেই লিখেছেন। তাতে আছে, কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পরে তিনি নজরুলকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। অপরদিকে ‘বিদ্রোহী’ ছাপা হওয়ার পর কবি মোহিতলাল মজুমদার দাবী করেছিলেন যে, তার “মানসী” পত্রিকায় ছাপা ‘আমি’ শীর্ষক একটি লেখার ভাব নিয়ে কবিতাটি লিখেছে। কিন্তু কোনো ঋণ স্বীকার করেনি।
এই প্রসঙ্গে মুজজফর আহমদ বলেছেন,
…একবার মাত্র শুনে এত দীর্ঘকাল পরে সে ‘আমি’র ভাবসম্পদ নিয়ে বা চুরি করে যে বিদ্রোহী রচনা করেছিল, আমি তা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনে। …এটা আমি মানতে রাজী আছি, মোহিতলালকে লেখাটি পড়তে শুনে তার মনে হয়তো এ কথাটা আসতে পারে যে, এই ধরনের একটা কবিতা লেখা যায়।
‘আমি’র ভাব নিয়ে এতবড় মহা সৃষ্টি যে সম্ভব নয়, এবং এই নবচিন্তার নব ধারার যাত্রার সূচনা যে মৌলিক চিন্তা ছাড়া অসম্ভব তার পক্ষে মতামত দিয়েছেন সমালোচক-সহ অনেকেই। কারণ বিদ্রোহী কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহ চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। ভারতীয় এবং এশীয় পুরাণ ও ইতিহাসের আধার থেকে উপাত্ত সংগ্রহ ও আত্মীকরণ করে নজরুল আপনার মাঝে স্থিত ও প্রতিষ্ঠিত প্রবল বিদ্রোহ বাণী কবিতায় উচ্চারণ করেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতবর্ষের ব্যক্তির জন্য অনিরাপদ ও নৈরাজ্যপূর্ণ অপশোষণ ও জনজীবনে তার প্রভাব এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব ইত্যাদি নজরুলকে বিদ্রোহী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেছন থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে।
ঈশ্বর বিরোধীতাই পারে মানুষকে স্ব মহিমায় উদ্ভাসত করতে, যে খেয়ালী ঈশ্বর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হয়ে পদদলিত করছে প্রান্তিকের মৌলিক অধিকার। তাই নজরুল বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন সেই স্বঘোষিত ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তথা ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে এবং অচেতন ঘুমন্ত শৃঙ্খলপরা আমিত্বের বিরুদ্ধে। এখানে নজরুল তার বিদ্রোহকে সঙ্গত কারণেই ‘আমি’ প্রতীকে ব্যঞ্জনাময় করেছেন যার প্রকৃত অর্থ একটি সংশোধিত স্বাধীন শক্তি, যে অন্যায়ের সামনে যমদূত, বন্ধুর সামনে প্রেমময়। নজরুল এই আমি’কে বা নিজেকে অপাজেয়রুপে উপলব্ধি করে আত্মশক্তিকে উদ্বোধিত করে বলেছেন, “আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস… মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ… আমি চপল মেয়ের চকিত চাহুনী, ছল করে দেখা অনুক্ষণ”।
নজরুল এই কবিতার প্রথম স্তবকেই প্রসঙ্গত উত্থাপন করছেন মহাবিশ্ব, মহাকাশ, চন্দ্রসূর্য, গ্রহতারা, ভূলোক দ্যুলোক, খোদার আসন, বিশ্ববিধাত্রী, চির বিস্ময়, রাজটীকা, রুদ্র ভগবান আর দীপ্ত জয়শ্রীর কথা। তিনি বোধ করি অন্যায় ও অপশোষণের বিরুদ্ধে নিজের ভেতরে মধ্যরাতে ন্যায়পরায়ণ বিধাতাকে উপস্থিত পেয়েছেন এবং নিজের সত্তায় স্রষ্টার শক্তিমান অস্তিত্বকে অনুভব করেছেন যে স্রষ্টা প্রেমে প্রেমিক আর অন্যায়কারীর অন্যায়ে ত্রাস। কবি সহসাই যেন সৃষ্টি ও ধ্বংসের আধার সৃষ্টিকর্তার বহুরুপী আকার ও সত্তার উপস্থিতিতে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন সর্বময়ী সত্তা রুপে। তিনি কবিতায় বার বার তাই বলেছেন, “আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ”।
যে সৃষ্টিকর্তাকে আমরা অন্যত্র খুঁজে ফিরি, তাঁর সঠিক ঠিকানা স্রষ্টার সৃষ্টির ভেতরেই নিহিত। ব্যক্তির ভেতরে যতটা কল্যাণমুখী স্বচ্ছতা রয়েছে ঠিক ততোখানি সে ব্যক্তির ভেতরে বিধাতা বিদ্যমান, আর যতখানি নেতিবাচকতা রয়েছে ততোখানি বিধাতা তার থেকে দূরে। স্বমহিমায় উদ্ভাসিত কল্যাণী সত্তা তাই নিজের ভেতরেই তার স্রষ্টাকে খুঁজে পান যেমনটা পেয়েছেন কবি নজরুল। তাঁর বিদ্রোহী মূলত কল্যাণময়ী বিধাতারই হুঙ্কার, আর আমি সত্তা রোমান্টিক নজরুলের আড়ালে মূলত সর্ববিস্তারী সৃষ্টিকর্তা যার বিচরণ সকল যুগে সকল কালে, সকল অবস্থানে সকল অবয়বে, সমান ও ধ্রুব, চির উন্নত। এই জাগরিত স্রষ্টা আবির্ভূত হন বিশেষ বিশেষ রুপে বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ কার্য সিদ্ধ করার জন্য আর এক্ষেত্রে স্রষ্টার আবির্ভাব হওয়া উৎপীড়িতের ক্রন্দন থামানোর জন্য যেখানে বিধাতা ক্ষেত্র বিশেষে সৃষ্টিমূখর আবার ক্ষেত্র বিশেষ অন্যায়কারীর সম্মুখে ধ্বংসকারী।
কবিতার বক্তব্যের অনুক্রম অনুযায়ী কবিতাটিকে মোট দশটি স্তবকে ভাগ করা যায়। প্রথম স্তবকে আমি’-র শক্তিমত্তার পাশাপাশি রয়েছে বিজয়ের প্রত্যয়, আর এই বিজয়ের জন্য প্রয়োজন আঘাতকারীর। আমি’-র ধ্বংসাত্মক রূপ, যা কবিতাটির ১১ থেকে ২৭ পঙক্তি পর্যন্ত- “আমি ঝ্ঞা, আমি ঘূর্ণি। আমি পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি”।
কবিতায় শক্তির উদ্বোধন ও সংহারচিত্রের পরই শুরু হলো মিলনের নৃত্যপাগল ছন্দ। ২৮ থেকে ৩৭ পঙক্তি পর্যন্ত আমিসত্তা এক মুক্ত জীবনান্দ হয়ে পাগলপারা হয়, যে শত্রুর সাথে গলাগলি করে, আবার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে। তবে তারপর পরবর্তী দুই পঙক্তিতে আমিসত্তা আবার মহামারী, ভীত, শাসন-ত্রাসন ও সংহার রূপে আবির্ভূত হয় কবিতায়। তারপর ৪২ থেকে ৫১ সংখ্যক পঙক্তিতে আবার আছে উদ্দাম ইতিবাচকতা, হোমশিখা, উপাসনা, নিশাবসানের আকাঙ্ক্ষা। আর এই অংশের ৪৯তম পঙক্তিতেই আছে সেই জাদুকরী বাক্য- `মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য’।
এই কবিতায় অসংখ্য পৌরানিক রুপকের ব্যবহার দেখা যায়। কবিতাটিতে অলংকারের প্রয়োগ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, নজরুল ছিলেন একজন গভীর জ্ঞানের পূজারী। প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ছাড়াই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত মাত্র ২১ বছর বয়সী তরুণ নজরুল ভারতীয় ও গ্রীক পুরাণের ওপর দখল অর্জন করেছিলেন যথেচ্ছ। এই কবিতায় যেসব ঐতিহ্য ও পুরাণের ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভূলোক (পৃথিবী) দ্যুলোক (স্বর্গ) আর গোলক (বিষ্ণুলোক অথবা স্বর্গে বিষ্ণু বা কৃষ্ণের বাসস্থান), রুদ্র ভগবান (বজ্রের দেবতা, গ্রীক মিথের ‘থর’ এর মতো ক্ষেপে গেলে বজ্র ছুড়ে মারেন যিনি)।
কবি কবিতায় নিজেকে নটরাজ (অসুর বধের পর করা তাণ্ডব নৃত্যের উদ্ভাবক) আর পৃথ্বির (পৃথু ছিলেন অত্রি বংশের অত্যাচারী রাজা বেন এর পুত্র। রাজা বেন এর মৃত্যুর পর তার ডান বাহু থেকে পৃথুর জন্ম। সে পৃথিবীকে বশ করেন) অভিশাপ বলেছেন। তাছাড়া তিনি কবিতায় আমি সত্তার ধ্বংসাত্মক ও ক্ষমতাবান রুপ বর্ণনায় চেঙ্গিস খান (মঙ্গোলিয়ান সম্রাট এবং দুর্ধর্ষ সমরনায়ক। যুবক চেঙ্গিসের স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় আরেক গোত্র প্রধান। চেঙ্গিস খান তার নিজ গোত্রকে পুনর্গঠিত করে অপহরণকারী গোত্রকে নৃশংসভাবে পরাস্ত করে স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। এরপর অন্যান্য মোঙ্গল গোত্রদের একীভূত করে অর্ধেক বিশ্ব জয় করেন।) অর্ফিয়াসের বাঁশি (গ্রীক পুরাণানুসারে অর্ফিয়াস ছিল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব সুর স্রষ্টা। দেবতাদের পরে মরণশীলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সুরের জাদুকর এই অর্ফিয়াস। মূলত সে ছিল একজন বাংশীবাদক। বাঁশির নাম ছিল লাইর। দেবতা হারমিসের তৈরি এ বাঁশির পূর্ণতা পেয়েছে অর্ফিয়াসের কাছে। কথিত আছে, তার সুর শুনে প্রাণীকুল থেমে যেতো, নদীর গতিপথ বদলে যেতো। গাছপালা তার শিকড় ছিঁড়ে সামনে এগিয়ে যেতো, পাথর থেকে ঝরে পড়তো কান্না। এমনও হয়েছে যে অর্ফিয়াসের সুর শুনে দেবতাদের যুদ্ধ থেমে গেছে। ঝরে যাওয়া ফুলগুলো আবার হেসেছে। অর্ফিয়াস ছিল দেবতা অ্যাপোলোর পুত্র। অর্ফিয়াসের মাতা ছিল ক্যালিওপ যিনি ছিল পিরাসের কন্যা) ও ইস্রাফিল এর বাঁশির উল্লেখ করেছেন (ইসলাম ধর্ম মতে কেয়ামত বা মহাপ্রলয় শুরুর আগে হযরত ইসরাফিল (আ:) নামক ফেরেস্তা শৃঙ্গায় ফু দেবেন) যা ক্ষমতা ও ধ্বংসের ভয়াল দৃশ্যপট অঙ্কন করে ভাবের কল্পলোকে এক অবিস্মরণীয় হুশিয়ারি প্রদান করে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার অলংকরণের সার্থকতার পাশাপাশি রুপকের ব্যবহার ও ভাষা নির্মাণে কবির দক্ষতার পরিচয়ই ছড়িয়ে আছে সর্বত্রই। শব্দ ব্যবহারে কবি তৎসম শব্দের সঙ্গে তদ্ভব, দেশী শব্দ এবং তার সঙ্গে হিন্দি, আরবি ও ফারসি শব্দের সহজ মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। ‘দুর্দম’-এর সঙ্গে ‘হর্দম হ্যায় হর্দমে’র একেবারে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ঘটিয়েছেন। ‘অরুণে’র সঙ্গে ‘খুন’ মিলে অরুণখুন হয়ে গেছে। ভাব ও ভাবনা প্রকাশের ক্ষেত্রেও কবি নির্বাচিত শব্দাবলি তাঁর ভাবনার অনুগামী হয়ে উঠেছে। কবি যখন রুদ্রবিপ্লবী হয়ে ভাঙ্গার নেশায় মেতে উঠেছেন তখন কবিতায় তাঁর শব্দ প্রয়োগ হয়েছে সেই ভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন-
আমি মহামারী’, ‘আমি ভীত এ ধরিত্রীর।
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার, আমি উষন চির-অধির।
অথবা,
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
অথচ কবি যখন রোমান্টিক তখন কবি ব্যবহৃত শব্দগুলিও আশ্চর্যভাবে লঘুচপল। যেমন-
আমি উচ্ছ্বল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!
অথবা,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন!
বোধন বাঁশির সুর যা ব্যক্তির সীমায় অসীমের প্রবল হাতছানি দিয়ে ডাকে মহাযজ্ঞের তরে, যা চির সংসপ্তক, যা রাষ্ট্র-সমাজ-সংসারের উর্ধ্বে ব্যক্তির সম্ভাব্য সম্ভাবনার সকল দ্বার উন্মোচন করে তাঁর জঠরের স্বার্থবাদী ক্ষুদ্রতার শেকড় ছিড়ে বের করে আনে আত্মার রক্তচক্ষু ভয়াল অথচ শীতল-সজীব-সরব অস্তিত্বের আহ্বান যা কর্ণের মধ্য দিয়ে অন্তরে পৌঁছে অন্তর্যামীর সাথে সুন্দরের ও সত্যিকারের ধর্মের নামে যোগসূত্র স্থাপন করে ব্যক্তিকে বিশ্ববিধাতার অংশবিশেষ রুপে প্রতিস্থাপিত করে- তার আওয়াজ কানে গিয়েছিল কাজী নজরুল ইসলামের। তারই প্রতিফলন চির সাম্যবাদী বাঁধনহারা নজরুলের কালজয়ী সর্বকালের হুশিয়ারী বিদ্রোহী, যা শত বছরে নয়, আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণ ঘটাবে সহস্র বছর অনাগত অন্ধকার জুড়ে।
আর নজরুল একটি যুগ, কাল ও নব জাগরণের দ্রীপ্ত শিখা রবে চিরন্তন।