
বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক
সমাজ ও সভ্যতার মাপকাঠি কি- এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি। আবার বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি হলো একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভিব্যক্তি বিশেষ। অতএব এক এক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থানুযায়ী বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির চেহারা ভিন্ন হওয়ায় স্বাভাবিক।
‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ পত্রিকা এ সত্যের আলোকে সমাজের অতীত ও বর্তমানকে দেখে। যার নিরীখে দেশের ভবিষ্যত অগ্রগতি বা বিকাশের সম্ভাবনাকে তরান্বিত করার প্রত্যয় রাখে। সমাজের মূল চালিকা শক্তি হলো উৎপাদন পদ্ধতি তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। যাকে ঘিরে মানুষে মানুষে সম্পর্কের যে যোগসূত্র তৈরি হয়- তা মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ধরন ও বিবিধ বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে- যা মানুষের চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে (অর্থাৎ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি) প্রভাবিত করে। আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ঘিরে যে সামাজিক সম্পর্ক ও রাজনৈতিক তৎপরতা বিরাজিত রয়েছে তারই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় আমরা জাড়িত হই। একে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির আলোকে বিকাশ না অনগ্রসরতা তা ভাবার আছে বৈকি!
কেন এমন একটি প্রসঙ্গ নিয়ে আমরা কাজ করছি বা ভাবছি প্রশ্ন আসতে পারে; আসাটা স্বাভাবিক। আমরা আমাদের সমাজ উন্নয়নের একেবারে মৌলিক ও গোড়ার বিষয় হিসেবে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার দৈনতাকে দায়ী করি। কারণ বিপরীত দিক থেকে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থাকে বিকশিত হতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। অনেকের আপত্তি করার যুক্তি রয়েছে এই যে, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চায় আমরা পিছিয়ে নেই। ‘আমাদের বেশির ভাগ অভিভাবকই তার সন্তানদের ডাক্তার কিংবা প্রকৌশলী বানানোর লক্ষ্যে বিজ্ঞান ক্লাসে পড়ান। এছাড়াও প্রযুক্তির সব ধরনের উপকরণ হাতের কাছে পাবার জন্য বিশ্ববাজার উন্মুক্ত রাখা আছে। ঘরে ঘরে এসব পণ্য পৌঁছে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে স্যাটেলাইট প্রেরণ ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনসহ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনাকে নিয়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি চর্চার বড়াই করা যেতে পারে। যেতে পারে ইন্টারনেট সেবা মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে দেয়ার সাফল্য গাথা। কিন্তু এসবই বিজ্ঞান চর্চার খুব শক্তিশালী প্রমাণ দাবী করে আত্মতৃপ্ত হবার কারণ নেই। আমরা একটু পেছনে গিয়ে যদি দেখি তাহলে যা খুঁজে পাব তা হলো অর্থনৈতিক লাভালাভ ও বিশ্ববাণিজ্যের স্বার্থ ছাড়া কিছু নয়। যার অংশীদারিত্বে দেশের একটি গোষ্ঠী ও দলীয় রাজনীতি এককার হয়ে আছে। যা বুঝার জন্য খুব বেশি ডিগ্রির প্রয়োজন নেই।
বিজ্ঞান যেভাবে প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাজে স্বাচ্ছন্দ আনে তেমনি সংস্কৃতি আনে মানুষের জীবনাচারে সম্প্রীতি-সহিষ্ণুতা-ঔদার্য-উন্নত চিন্তা ও মননশীল চর্চার বেগ। মানব কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতার বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারা না পারার মধ্য দিয়েও আমরা একটি সমাজের অগ্রসরতা ও অনগ্রসরতা পরিমাপ করতে পাারি। যা সারবস্তুতে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার প্রসঙ্গই বটে। অতএব বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিকে বলতে পারি সমাজের বিকাশ পরিমাপের কষ্টিপাথর।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্যেকার ফারাকটি যদি আমরা বুঝে থাকি তাবে প্রযুক্তিগত সুবিধা লাভকে আমরা বিজ্ঞান চর্চা বলতে পারি না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের হাতে আসে বটে কিন্তু মাথায় প্রবেশ করে না। মাথায় প্রবেশ করার জন্য যে জ্ঞান চর্চা দরকার এবং তার জন্য যে উন্মুক্ত পরিবেশ তৈরি করা দরকার; তা আমরা কতটুকু করছি- সেটাই হলো আমাদের বিজ্ঞান চর্চার দৌড় পরিমাপের আসল বিষয়। এই জায়গাটিতে সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের চর্চার ঐক্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক সুনিবিড়ভাবে জড়িত এবং সুঘনিষ্ঠ।
বিজ্ঞানের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বাজার বা অর্থনৈতিক স্রোতধারাকে গতিশীল করলেও মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ বয়ে আনলেও তা মানুষের হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত সংস্কার-বিশ্বাস বা মূল্যবোধে বাহ্যিক পরিবর্তন আনলেও তার মৌলিক পরিবর্তন আনে না। তার জন্য রাজনৈতিক প্রপাগাণ্ডা বা কর্মসূচী অবশ্যই থাকতে হয়। নতুবা প্রগতির পথে এগুনো অসম্ভবই বলা চলে। তবে রাজনৈতিক শক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি প্রতিক্রিয়াপন্থী হয় সেক্ষেত্রে প্রাচীন সংস্কার ও বিশ্বাসে জনগণকে আবদ্ধ রেখে নিজেদের গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থে তা করবে না তার প্রমাণ বিশ্ব রাজনীতিতে বহু রয়েছে তার উল্লেখ থেকে বিরত থাকছি।
আমাদের স্বাধীনতা পূর্বাবস্থা ও স্বাধীনতাত্তোর সময়কালকে যদি পর্যালোচনায় করি, লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান চর্চা একটি জনগোষ্ঠীর দেশপ্রেম ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সাথে বেশ নিবিড়ভাবে যুক্ত বা সম্পর্কিত। সর্বোপরি একটি রাজনৈতিক ভাবাদর্শের মাধ্যমেই কেবল তার গতি-প্রকৃতি নির্ণিত হয়। আমরা আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ও বর্তমান রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের মাঝে বিকাশ ও দুর্দশার চিত্র খুঁজে পাব। সেই পর্যালোচনা করতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই; আমরা আজ এটুকু উপলব্ধি করি যে, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান চর্চার জন্য সর্বাগ্রে মানুষের মুক্তচিন্তা ও প্রচলিত যেকোনো মত-পথের পর্যালোচনা-আলোচনা কিংবা সমালোচনা করার সুযোগ অবারিত রাখা জরুরী। যেকোনো বিষয়কে যুক্তিনির্ভর ও কল্যাণমুখী চেতনা দ্বারা পর্যালোচনা করার সুযোগ তথা মানুষ ও পরিবেশের কল্যাণকে সামনে রেখে উদার ও গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন মুক্ত পরিবেশের সুরক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা সবকিছুর দ্বৈততার মাঝে বাঁচি তেমনি সংস্কৃতির বিপরীতে অপসংস্কৃতি কিংবা বিজ্ঞানের বিপরীতে অপবিজ্ঞানের চর্চা ও বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারি না। প্রাকৃতিক সুর-অসুরের বাস্তবতা এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যাকে এড়িয়ে যাই-ই বা কি করে! কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট যে অপসংস্কৃতি ও অপবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি দুইয়ের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি একদিকে জনস্বার্থ এবং অন্যদিকে ব্যক্তি-দল বা গোষ্ঠী স্বার্থের নিগড়ে বাঁধা- যা রাজনৈতিক স্বার্থ আকারে সমাজ বা জাতীয় জীবনে দ্বান্দ্বিকতা লাভ করে। অর্থাৎ বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির রয়েছে শ্রেণী প্রকৃতি। যাকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। তাই বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চা নিষ্কণ্টক নয় বরং কন্টকাকীর্ণই বলা যায়।
আমরা যখন সমাজে বিরাজিত ধনী গরীবের বৈষম্য, অপশাসন-শোষণ, দুর্নীতি, নৈরাজ্য, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিরোধিতা করি এবং বিপরীতে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বলি তখন আমরা নিজেরা একটি পক্ষে দাঁড়িয়ে যাই। যদিও জানি যে সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের আশ্রয়-প্রশ্রয়-পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো রকম দুর্নীতি-সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা কিংবা নৈরাজ্য সম্ভব নয়। উপরন্তু এসবের মাধ্যমে শ্রেণী মেরুকরণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যদি থাকে অর্থাৎ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের চরিত্র বিনির্মাণের স্বপ্ন কেউ দেখে থাকে তবে তার বিপরীতে সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান চর্চা কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ তৈরির প্রচেষ্টা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। তবুও মানুষের স্বপ্ন কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ও সমাজ। ফলে এ দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই এগিয়ে নিতে হবে প্রগতিমুখী বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চাকে।
সমাজ ক্রমবিকাশমান। মানুষের জ্ঞানও সেই সাথে অগ্রসরমান। ফলে পুরানো চিন্তা বা জ্ঞানের সাথে তার যোগসূত্র ও বিচ্ছেদ দুই-ই বহমান। মানুষ পারিবারিক ও সামাজিক সংস্কার দ্বারা চালিত বলেই রাজনৈতিক দর্শনের দ্বারা জনগণের চেতনাকে উন্নত করার প্রয়াস একান্ত প্রয়োজন। অবশ্যই সেই রাজনীতির চরিত্র হতে হবে জনকল্যাণমুখী কোন গোষ্ঠী, দল বা সম্প্রদায়ের জন্য নয়।
আমরা জানি, বিজ্ঞান বস্তুগত সত্যকে স্বীকৃতি দেয়, সংস্কৃতি দেয় ভাব-বস্তু ও আধ্যাত্মিকসহ মানব চিন্তা ও মানব সৃষ্ট সমস্ত ধারণাকে। আপতিক দৃষ্টিতে দুয়ের বিরোধাভাস লক্ষিত হলেও সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান একে অন্যের পরিপূরক ও প্রভাবক। আমরা যখন বিজ্ঞান বা বিজ্ঞান মনস্কতার কথা বলি তখন তার একটা সহজ সংজ্ঞা দিতে পারি। বলতে পারি পরীক্ষা নিরীক্ষা লব্ধ জ্ঞানই বিজ্ঞান। কিন্তু যখনই সংস্কৃতির কথা বলি তখন খুব সহজভাবে তার উত্তর দিতে পারি না। কেননা সংস্কৃতি কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে উপস্থাপন করে না বরং মানুষের ভাষা-জীবন-যাপন-সৃষ্টি-কৃষ্টি-আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক-ভাব ও বস্তুবাদী চেতনা সমেত সামগ্রিক অবস্থাকে বোঝায়। তাই সাংস্কৃতিক বিকাশ বলতে একটি জাতির সামগ্রিক বিকাশকে বোঝায়। মানুষের চেতনাগত বিকাশ তার আর্থ-রাজনৈতিক অগ্রসরতার উপর নির্ভরশীল। রাজনৈতিক অগ্রসরতা বা বিকাশ ব্যতিত বিজ্ঞানচর্চা বা বিজ্ঞানমনস্ক জাতিগঠন অসম্ভব বলেই আমরা মনে করি।
আমরা যদি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখতে পাই পরাধীনতার ঐতিহ্য। পরশাসনে শাসিত হবার ঐতিহ্য। আর্য আগমন থেকে শুরু করে সর্বশেষ পাকিস্তানী শাসন পর্যন্ত ছিল প্রত্যক্ষ শাসন। ফলে তাদের অনুশাসিত বিভিন্ন নীতি নৈতিকতা, ভাষা, ধর্মীয় ও ভাবাদর্শগত মূল্যবোধ এ জনপদের মানুষের আচার আচরণ চিন্তা ও মননে এনেছে বৈচিত্র্য। মেনে নেয়া ও না মানার বিভিন্ন ইতিহাস থাকলেও তার মাঝে মেনে নেয়ার চৈতন্য এবং প্রভু দেশের সংস্কৃতি ও জীবনবোধ আমাদের আকৃষ্ট করেছে, অনুগত করেছে। তা এখনকার সামাজিক মানুষের মধ্যেও বহমান। আমেরিকা কানাডা বা ইউরোপের যে কোন দেশে যেয়ে সেটেলড হওয়ার দৌড় দেখে তা বোঝা যায়। এবং এটি শিক্ষিত অংশের মধ্যেই বেশি লক্ষনীয়।
এর কারণ সবাই জানি যে, আমরা তাদের থেকে পিছিয়ে থাকা উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ে উন্নত দেশগুলোর যে বিশ্বরাজনীতি রয়েছে আমরা তার বাইরে নই। ফলে আমরা কোনো না কোনোভাবে তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ফলে আমাদের বিকাশ চ্যালেজিং তাতে সন্দেহ নেই। তাকে মোকাবেলা করে এগিয়ে যাবার মতো দেশপ্রেমী রাজনৈতিক দর্শন ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতিগঠন ছাড়া, উন্নত সাংস্কৃতিক জীবন-যাপন ও মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়া ছাড়া এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা অসম্ভব। কিন্তু এগুতে হলে এ চ্যালেঞ্জ আমাদের গ্রহণ করেই এগুতে হবে। আর তার প্রস্তুতি স্বরূপ বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তচিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি করা সর্বাগ্রে জরুরী। কারণ এ দুয়ের চর্চা ব্যাতীত আমরা বিশ্বলোকে আমাদের গৌরবের কিছুই রেখে যেতে পারি না।
জীবন হয়ে উঠুক বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিময়। এ দুয়ের উপস্থিতি ব্যতিত মানুষ প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণীর সমতুল্য বৈ কিছু নয় বলেই আমরা মনে করি।
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মদিন ৩০ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ এবং ‘শিক্ষালোক’-এর যৌথ আয়োজনে ৩ ডিসেম্বর ২০২১ সন্ধ্যায় ঢাকায় সিদীপ (সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন এন্ড প্র্যাকটিসেস) সভাকক্ষে আলোচনাসভায় উপস্থাপিত প্রবন্ধ।