
বিজ্ঞানি জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকীতে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনা
বাঙালি বিজ্ঞানিদের মধ্যে যিনি সকলের প্রিয় তিনি বাংলাদেশের বিক্রমপুরে (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) রাঢ়িখালের বিজ্ঞানি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। পুরো ভারতবর্ষে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার তিনি পথিকৃৎ। তাঁর জন্ম ময়মনসিংহে ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ালেখা ফরিদপুরে। পরে কোলকাতা হয়ে কেমব্রিজে যান। পরাধীন ভারতের অন্তর্গত পশ্চাদপদ বাংলার সন্তান হওয়ায় পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর হাতে তাঁকে অনেক বৈষম্যের শিকার হতে হয়। কিন্তু সকল বৈষম্যকে অতিক্রম করে তিনি জয় করে নিতে পেরেছিলেন বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা। আর ভোলেননি কখনো তাঁর মাতৃভূমি বাংলাকে। তিনি শুধুমাত্র একজন বিজ্ঞানি ছিলেন না, ছিলেন অনেক মানবিক গুণে ভাস্বর এক মহান মানুষ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে বাংলাদেশে আমাদের এই মহান বিজ্ঞানি উল্লেখযোগ্যভাবে আলোচিত ও চর্চিত হন না। এবার জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ছোটকাগজ ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ এবং শিক্ষাবিষয়ক বুলেটিন ‘শিক্ষালোক’-এর একটি যৌথ আয়োজন সেক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মদিন ৩০ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ এবং ‘শিক্ষালোক’ ৩ ডিসেম্বর ২০২১ সন্ধ্যায় সিদীপ (সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন এন্ড প্র্যাকটিসেস) সভাকক্ষে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এতে ‘জগদীশচন্দ্র বসুর পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক ফল’ শীর্ষক ভিডিও-রেকর্ডেড আলোচনা উপস্থাপন করেন ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’র প্রধান সম্পাদক বিজ্ঞানি ও লেখক আশরাফ আহমেদ এবং ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক’ শীর্ষক লিখিত আলোচনা উপস্থাপন করেন চিত্রশিল্পী শিশির মল্লিক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন লেখক-গবেষক সালেহা বেগম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালন করেন ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’র সম্পাদক আলমগীর খান এবং নির্বাহী সম্পাদক নাজনীন সাথী।
আশরাফ আহমেদ তার ভিডিওতে রেকর্ড করে পাঠানো আলোচনায় বলেন, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। তিনি অদৃশ্য আলোকের শক্তি পরীক্ষায় ও এ নিয়ে তাঁর গবেষণার নানা দিক বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন- তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে তাঁর গবেষণা পরবর্তী বিজ্ঞানিদের সাধনার মাধ্যমে আজকের মাইক্রোওয়েভ, ফাইভ-জি ও অন্যান্য আবিষ্কার নিয়ে এসেছে যার সুফল আমরা এখন ভোগ করছি। গাছের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য তিনি যেসব যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিলেন তার গুরুত্ব অপরিসীম।
বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় চিত্রশিল্পী শিশির মল্লিক বলেন, আমাদের দেশে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির বহুল ব্যবহার থাকলেও বৈজ্ঞানিক চিন্তার চর্চা নেই। বিজ্ঞানকে এখানে সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ফলে প্রকৃত বিজ্ঞানচেতনা গড়ে ওঠে না। কোনো দেশ ও জাতি উন্নতি অর্জন করতে পারে না যদি বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির যথার্থ মেলবন্ধন তৈরি না হয়। তিনি বলেন, “জীবন হয়ে উঠুক বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিময়। এ দুয়ের উপস্থিতি ব্যতীত মানুষ প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণীর সমতুল্য বৈ কিছু নয় বলেই আমরা মনে করি।”
প্রখ্যাত সাংবাদিক সৈয়দ বদরুল আহসান অনলাইনে বলেন, বিষয় হিসেবে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে ও প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে হবে। তিনি বিজ্ঞানি জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী পালনের গুরুত্ব উল্লেখ করেন।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. মো. আমিন উদ্দিন মৃধা অনলাইনে আলোচনায় অংশ নিয়ে বিজ্ঞানচিন্তাকে দেশের মানুষের মাঝে সর্বস্তরে পৌঁছে দেয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শাহজাহান ভুঁইয়া বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি পরস্পর নির্ভরশীল। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। আবার নতুন প্রযুক্তি যে সাংস্কৃতিক অস্থিরতা তৈরি করে বিজ্ঞান আমাদেরকে তা থেকে মুক্তিরও পথ দেখাতে পারে।
‘জনবিজ্ঞান’ সাময়িকীর সম্পাদক আইয়ুব হোসেন বলেন, বিজ্ঞানি জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন একজন দ্রোহী মানুষ যিনি ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর বেতনের বৈষম্যের প্রতিবাদে তিন বৎসর বেতন না নিয়ে কলেজে পড়িয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন জেদী মানুষ, যে কাজ ধরেছেন তা শেষ না করে ছাড়েননি। তাঁকে নিয়ে আলোচনা ও চর্চা অনেক প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
কবি সৈকত হাবিব বলেন, জগধীশচন্দ্র বসু যখন বেতারযন্ত্র আবিষ্কার করেন উনি তা পেটেন্ট করেননি, কারণ তিনি মনে করেছেন এটি কারো ব্যক্তিগত মুনাফার জিনিস নয়, বরং বিশ্ব মানবতার সম্পদ। গ্রামীণ পাঠশালায় পড়া ও বাংলার জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠা জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর উদ্ভিদ সম্পর্কে মৌল ধারণা লাভ করেছেন ভারতীয় দর্শনের সর্বপ্রাণবাদ থেকে। দর্শনের এ বিষয়কে তিনি যে বিজ্ঞানে রূপান্তর করলেন, তা এক সাংস্কৃতিক অর্জনও।
এছাড়া অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন লেখক ও সমাজকর্মী সিরাজুদ দাহার খান, শিক্ষাসংবাদ পত্রিকার সম্পাদক দেওয়ান মামুনূর রশীদ, এসএসসির জন্য রসায়নবিদ্যার লেখক বিদ্যুৎ কুমার রায়, লেখক ফয়সাল আহমেদ ও কবি রিয়াজ মাহমুদ। জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার অংশবিশেষ আবৃত্তি করেন মিঠুন দেব।
অনুষ্ঠানের সভাপতি লেখক-গবেষক সালেহা বেগম শিল্পসাহিত্যের সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের সম্পর্ক তুলে ধরেন এবং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর জীবনব্যাপী বন্ধুত্বের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি জগদীশচন্দ্রকে নিয়ে এ ধরনের উদ্যোগ, কার্যক্রম ও আলোচনা নিয়মিত হওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন।
লেখক, শিল্পী ও বিজ্ঞানমনস্ক বিভিন্ন মানুষের উপস্থিতিতে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। অন্যান্যের মধ্যে এতে উপস্থিত ছিলেন বার্ড-কুমিল্লার সাবেক পরিচালক ফজলুল বারি, কবি হানিফ রাশেদীন, কবি অনার্য নাঈম, চিত্রশিল্পী বিপ্লব দত্ত, চিত্রশিল্পী শামীম আকন্দ, সাংবাদিক ও চিত্রনির্মাতা রঞ্জন মল্লিক, বিসিএসআইআর-এর কর্মকর্তা নাহিদ জামান, লেখক তাপস বড়ুয়া, লেখক মারুফ ইসলামসহ আরো অনেকে।
ছোটকাগজ ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ তাদের ফ্রেব্রুয়ারি ২০২০-এর ১ম সংখ্যাটিতে প্রচ্ছদ করেছিল বিজ্ঞানি জামাল নজরুল ইসলাম। ২য় সংখ্যায় তারা প্রচ্ছদ করেছে বিজ্ঞানি জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে।
‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি’ এবং সিদীপের শিক্ষা বিষয়ক বুলেটিন ‘শিক্ষালোক’ যৌথভাবে ২০২১এর ফেব্রুয়ারিতে ‘ভাষার লড়াই: বাংলায় জ্ঞানচর্চা’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল যেখানে তারা বলেছিল জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা মূলত মাতৃভাষায় হতে হবে এবং সেদিকটা বিবেচনা করে আমাদের শিক্ষা-পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ‘জগদীশচন্দ্র বসুর পরীক্ষা-নিরীক্ষার আধুনিক ফল’ ও ‘বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক’ বিষয়ক এবারকার আলোচনা অনুষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রমে আরেকটি মাত্রা যোগ করলো।