
বিচ্ছিন্নতায় বসবাস
এক.
আমরা প্রত্যেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি। ক্রমেই, প্রতিদিন। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি আমাদের নিজস্ব অক্ষরেখা-দ্রাঘিমারেখা থেকে। ভালোবাসব বলে একদা আমরা গড়ে তুলেছিলাম যেসব গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র; সেসব থেকে। আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি আমাদের কেন্দ্র থেকে। এমনকি প্রান্ত থেকেও। হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমাদের নির্মিত ও পুঞ্জীভূত ব্যক্তিগত ও যৌথ স্বপ্ন থেকে। আমাদের দেখা ও অদেখা জগৎ থেকে। আমাদের সম্ভাবনা থেকে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি আমরা পরস্পরের কাছ থেকে। আমি তোমার কাছ থেকে। এবং অবশ্যই তুমি আমার কাছ থেকে। ভেবে দেখলাম, আমাদের পেছনের গল্পগুলো মূলত বিচ্ছিন্নতার, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার। বর্তমানের গল্পগুলো, তা-ও বিচ্ছিন্নতার। এবং যে গল্পগুলো সময়ের হুইসেল বাজাতে বাজাতে কোনো একদিন আমাদের জীবনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠার প্রত্যাশায় সম্ভাবনার জরায়ুতে ভ্রূণ হয়ে বাড়তে শুরু করেছে, আমাদের অনাগতকালের সে গল্পগুলোও নিশ্চিতভাবে বিচ্ছিন্নতার। আমরা চোখে চোখ রাখি চোখ সরিয়ে নেওয়ার জন্য, ঠোঁটে ঠোঁট রাখি ঠোঁট সরিয়ে নেওয়ার জন্য এবং নিশ্বাসে নিশ্বাস রাখি, তা-ও একটু পরেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব বলে। আর যখন কোনো এক নিস্তব্ধ বিকেল, বর্ণিল সন্ধ্যা, রক্তিম ভোর অথবা রাত্রিনিশীথে প্রেম ও কামের ভেলা ভাসিয়ে আমরা শরীরে শরীর মাখি, আমরা হয়ে যাই আদিম, বর্তমান ও ভবিষ্যতের আনন্দভুবনের মালিক, তার কিছুক্ষণ পরেই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই, আমাদের নির্মিত আনন্দভুবন থেকে। মিলনের নামে আমাদের পা থেকে মাথা অবধি লেপ্টে থাকে কেবলই বিচ্ছিন্নতার সুখ। আমি, তুমি, সে- আমরা সবাই মূলত ক্রমাগত বিচ্ছিন্নতার খণ্ড খণ্ড উপাখ্যানই রচনা করে চলেছি। নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করছি একটা বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতি। আমাদের বিছানায়, সাজঘরে, বৈঠকখানায়, ঘরজুড়ে, ঘরের বাইরে, সমাজে, রাষ্ট্রে, এমনকি গোটা পৃথিবীজুড়ে কেবলই বিচ্ছিন্নতা।
তুমি তো জানো, সময়টা এখন বিশ্বায়নের। বিশ্বায়ন প্রেমিকেরা পৃথিবীর একটা আদুরে ও রোমান্টিক নাম দিয়েছে। পৃথিবীকে ওরা ডাকে বিশ্বগ্রাম বলে। আমি জানি না, এখনো জানা হয়নি, প্রথম দিন পৃথিবীর এ রোমান্টিক নাম শুনে বাংলাদেশের অথবা ঠিক বাংলাদেশের মতোই অন্য কোনো দেশের কোনো এক সবুজ-শ্যামল প্রান্তিক গ্রামের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছিল কি না। কিন্তু আমার মন বলছে, হলেও হতে পারে। কেননা, এ বিশ্বায়নই আমাদের গ্রামগুলোকে বিচ্ছিন্ন করেছে গ্রামীণ হৃদ্যতা, উষ্ণতার অনুভব থেকে। গ্রাম্য সহজ-সরল ভালোবাসা থেকে। নিঃস্বার্থ, নির্মল গ্রামীণ একতাবোধ থেকে। যেগুলো না থাকলে গ্রাম আর গ্রাম থাকে না। থাকতে পারে না। আর বিশ্বায়নের হৃদয় যদি সত্যি সত্যি গ্রামীণ হৃদ্যতা, উষ্ণতা আর ভালোবাসায় টইটম্বুরই হবে, তবে জালিম ইসরায়েল, সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল ইসরায়েল, বছরের পর বছরজুড়ে যখন গাজায় ক্রমাগত বোমা হামলা করে, ফুটফুটে শিশুদের শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলতুলে নরম অপরিণত মাংসপিণ্ড, বইয়ে দেয় রক্তের বন্যা, ভয়ার্ত শিশুরা ভুলে যায় প্রতিদিনের স্বতঃস্ফূর্ত হাসি, কান্না, ক্ষুধা, এমনকি মায়ের স্তনচোষা, নীল আকাশটা বেদনার চাদর হয়ে ঝুলে থাকে পৃথিবীর ওপর, তারপর সে আকাশটা ফুটে হতে থাকে নিপীড়িত মানুষের উল্লম্বমুখী চিৎকারে, মানবাধিকার তার অন্তর্বাস খুলে নেংটা হয়ে ঘুরতে থাকে ফিলিস্তিনজুড়ে, এখানে-ওখানে, তখনো মানবাধিকার ফেরি করে বেড়ানো রাষ্ট্র আমেরিকা-ব্রিটেন করপোরেট পুঁজির উদ্বৃত্তমূল্যে কীভাবে মদ-মাংসে আদিম উষ্ণতার ব্যাকরণ নির্মাণ অব্যাহত রাখে! করপোরেট বিশ্বায়নের রাজা-রানীরা পুঁজিপণ্যে ধ্যানগ্রস্ত থাকে! তখনো সারা পৃথিবী কী করে নিমগ্ন থাকে শান্তিপূর্ণ নীরবতায়! তাহলে এ বিশ্বায়ন আসলে প্রেম, ভালোবাসার বিশ্বায়ন নয়, মানবিকতার বিশ্বায়ন নয়, বরং প্রেম-ভালোবাসা-মানবিকতার বিপরীতে পুঁজি-পণ্যের দুবৃর্ত্তপনার বিশ্বায়ন, ভোগের বিশ্বায়ন, যুদ্ধের বিশ্বায়ন এবং এক অবশ্যম্ভাবী বিচ্ছিন্নতার বিশ্বায়ন।
আমাদের বলা হয়েছিল, বিশ্বায়ন এলে দূরত্ব ঘুচে যাবে পৃথিবীর। মানুষ আরও কাছাকাছি আসবে। পরস্পরের। সাদা-কালো সমাজ বর্ণহীন হবে। এক কাতারে দাঁড়াবেন নারী-পুরুষ। কোনো একদিন। সে কোনো একদিন তো আর এলই না আমাদের জীবনে। উল্টো একুশ শতকেও যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলিতে কালোদের শরীর থেকে জীবন বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবর বেরোয় নিয়মিত বিরতিতে। ধর্মভিত্তিক বিভাজন আর বিচ্ছিন্নতার চলমান উদাহরণ হিসেবে ইরাক, সিরিয়া অথবা আফগানিস্তান বিস্তৃত হয় গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয়। এদিকে বিশ্বায়নের কথার ফুলঝুরি চলতে চলতেই, শুধু শহরে নয়, অনেক দূরের, সবুজ-শ্যামল প্রান্তরে গ্রামের ঘরে ঘরেও ঢুকে পড়ল করপোরেট বিশ্বসৌন্দর্যবেনিয়ারা। তারা এখন নিয়মিত সৌন্দর্য-ধারণা ফেরি করে বেড়ায়। টিভি বিজ্ঞাপনে। নাটক, সিনেমায়। আর সে বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা দেখে দেখে আমাদের গ্রামের সহজ-সরল কালো-শ্যামলা মেয়েগুলি, যারা রূপবাণিজ্যের রাজনীতিটা হয়তো কোনো দিনই জানবে না, বুঝবে না, তারা রূপ-লাবণ্যের বিশ্বায়িত রূপ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন ভেবে ভেবে অধিবাসী হয়ে ওঠে এক মনখারাপের দুনিয়ার। তারপর একসময় সৌন্দর্যের সে বিশ্বায়িত স্বপ্নে নিজেরাও বিভোর হয়। ত্বক ফরসাকারী ক্রিম কিনে নিয়মিত অপচয় করে হাতখরচের টাকা, আয় ও সঞ্চয়। এভাবে আমাদের শ্যামল গ্রামের দরিদ্র মেয়েদের টাকায়ও স্ফীত হতে থাকে সৌন্দর্যবেনিয়াদের বুকপকেট। আর অন্যদিকে প্রতিদিনের দারিদ্র্য আর অপুষ্টিতে ম্রিয়মাণ আমাদের তরুণীদের বুক অতটা উন্নত নয় বলে, যতখানি উন্নত হলে সাড়ে তিন হাত শরীরে সৌন্দর্যের বিশ্বায়ন হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়, ব্যয়বহুল কসমেটিক সার্জারির বিজ্ঞাপন দেখে দেখে শেষ পর্যন্ত বিপণিবিতানে ছোটে, কিনে আনে ফোমসমেত অন্তর্বাস। পণ্যবিপণনের প্রকাশ্য ও গোপন এজেন্ডা নিয়ে বসে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আসর। গজ-ফিতা দিয়ে মেপে মেপে ঠিক করে দেওয়া হয় শরীর-সৌন্দর্যের জ্যামিতিক রেখা। সেসব রেখার নিচে বিচ্ছিন্ন হয়ে কী এক অদৃশ্য অনুভবে কাতরাতে থাকে আমাদের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মেধা ও মনন। আর আমাদের কিশোর-তরুণেরা? সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি বিজ্ঞাপনের রঙিন দুনিয়ায় রগরগে যৌনতা ফেরি হতে দেখে নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক একটি মানবিক পৃথিবী নির্মাণের ভাবনা থেকে ছিটকে পড়ে। কাম-যৌনতার পুরুষতান্ত্রিক সামাজিকায়নে এদের কেউ কেউ হয়ে ওঠে মাংসের দোকানের কসাই অথবা সম্ভাব্য ক্রেতা। নারীরা সহকর্মী, বন্ধু, সহযাত্রী হওয়ার বদলে ওদের চোখে হয়ে ওঠে কসাইয়ের দোকানে লোহার শিকে ঝুলে থাকা কাঁচা মাংস। এসবে কোনো আপত্তি না থাকলেও বেইজিং ঘোষণা, নারী উন্নয়ন নীতিমালা, সংবিধান, ইত্যাদির ব্যবচ্ছেদ করার জন্য পবিত্র ধর্মের হেফাজতের নামে বিপুল হিংস্রতায় দাঁড়িয়ে থাকে চর্মচক্ষুবিশিষ্ট একদল অন্ধ মানুষ। একসময় তারা ধর্মের নামে ধর্ম থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর এভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আমাদের অতীত, বর্তমান ও অনাগতকালের প্রজন্ম। একটি বাসযোগ্য নিরাপদ পৃথিবী থেকে। স্বাধীন-আনন্দময় গতিশীল জীবনের স্পর্শ থেকে।
এবার একটা রাস্তার কথা বলি। রাস্তাটা ছিল কাঁচা। দীর্ঘসময়। বর্ষাকালে গাড়ি তো দূরে থাক, হাঁটাও যেত না সে রাস্তা দিয়ে। আমাদের গ্রামের ঠিক হৃদয়ের মাঝ দিয়ে যাওয়া সেই রাস্তাটা একদিন পাকা হয়ে গেল। আমাদের যোগাযোগ স্থাপিত হলো বড় শহরের সঙ্গে। শুনেছি, রাস্তা পাকা করার কাজে বিশ্বব্যাংক ঋণসাহায্য দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মহানুভবতায় আমরা গ্রামের সব মানুষ কৃতজ্ঞতার পাহাড় তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। রাস্তার কাজ শুরুর দিন মিলাদেরও আয়োজন করা হয়েছিল। সেদিন মোনাজাতে গরিব দেশগুলোকে ঋণগ্রস্ত করার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের আরও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দোয়া করা হয়েছিল কি না, তা আজ আর মনে নেই। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের নাম ধরে যে দোয়া করেছিলেন, সেটা খুব মনে পড়ছে। তো রাস্তা তো হলো। আমরাও সবাই খুশিতে ‘বাকুম বাকুম’ করছি। হঠাৎ দেখি পাশের বাড়ির আসগর চাচার মন খারাপ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ গরুর গাড়ি চলা নিষিদ্ধ করেছে। আর আসগর চাচার আট সদস্যবিশিষ্ট পরিবারটির ভরণপোষণ নির্ভর করত ওই গরুর গাড়ির ওপর। আমার এখনো মনে আছে, চাচা গরুর গাড়ি চালাতে চালাতে দরাজ কণ্ঠে গাইতেন, আবদুল আলীম, আব্বাসউদ্দীনের গান। রাস্তা পাকা হওয়ার পরপরই চাচা বিচ্ছিন্ন হলেন তাঁর আদি জীবিকা থেকে। আর আমরা চাচার দিলখোলা সুরের মূর্ছনা থেকে। যে মূর্ছনা প্রায় প্রতিদিন ভোরে, সন্ধ্যায়, অথবা রাতে অনেক দূর থেকেও মোহিত করত, আমাদের, এ ছোট্ট গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশুদের।
কাঁচা রাস্তা পাকা হওয়ার সপ্তাহ না যেতেই ছুটে আসতে থাকল ছোট ছোট শহুরে ট্রাক। এর আগে এ গ্রামের মানুষ খুব কদাচিৎ দেখেছে মোটরগাড়ি, ট্রাক, ইত্যাদি। মালবোঝাই ট্রাক। বাহারি পণ্যের সমাহার। সবই রঙিন প্যাকেটজাত। লোকজন খুব উৎসাহ নিয়ে চেয়ে থাকে। ট্রাকের লোকজন মাল খালাস করে। দোকানে দোকানে রেখে যায়। বলা যায়, সেই থেকে শুরু। অন্য রকম এক বিচ্ছিন্নতার। এখন আমাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট টং দোকানটিতেও ঝুলে থাকে রাশি রাশি মিনিপ্যাক। টিভি বিজ্ঞাপন আর মোড়কের বিনিময়ে এখন গ্রামের নিরক্ষর কিশোর-কিশোরীরাও জেনে গেছে যে সাবানেরও হারাম-হালাল আছে। সাবানেরও ধর্ম আছে। আর আমাদের শিশুরা ডাবের বিশুদ্ধ-স্বাস্থ্যকর পানির বদলে বোতলজাত কোমল পানীয়র জন্য বায়না ধরে। জ্যৈষ্ঠ মাসের আম-কাঁঠালের বদলে পান করে প্যাকেটজাত ‘জুস’। আমাদের কিশোরী মেয়েরা পাড়ার দোকান থেকে বাড়ি ফিরে রং ফরসাকারী ক্ষতিকর ক্রিমের মিনিপ্যাক নিয়ে। আর উঠতি বয়সের বালকেরা বয়োজ্যেষ্ঠদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেনে পর্নো সিডি। মায়েরা গোয়ালে দাঁড়িয়ে থাকা গাইয়ের ওলানের কথা ভুলে গিয়ে স্বপ্ন দেখেন গুঁড়ো দুধের। তাঁদের শিশুদের জন্য। গুঁড়ো দুধের মোড়কে মায়ের বুকের দুধ শিশুর আদর্শ খাবার লেখা থাকলেও, নিরক্ষরতার কারণে, বেশির ভাগ মা-ই সেটা পড়তে পারেন না। ফলে কিনতে পারুন আর না পারুন, গুঁড়ো দুধের প্রতিই মোহটা বিস্তৃত হতে হতে হতাশারও জন্ম নেয়। সে হতাশা কখনো কখনো আকাশসমান উঁচু হয়। বিশ্বব্যাংকের ঋণে তৈরি একটা পাকা রাস্তা বদলে দেয় একটি প্রান্তিক গ্রামের চেহারা। আমাদের গ্রামটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকে আমাদের আদিগ্রাম থেকে।
এখন আমি খুব ছোট করে বলব এক রুস্তম আলীর গল্প। বাংলাদেশের কোনো এক সবুজাবৃত গ্রামের এক সহজ-সরল রুস্তম। ধরে নাও গ্রামটি আমাদেরই। রুস্তমের ঘুম ভাঙত। প্রতিদিন। রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ হয়ে নতুন ভোরের রক্তিম আলোকচ্ছটা পুবাকাশে ছড়িয়ে পড়ার আগেই। তারপর রুস্তম ছুটে যেত সবুজের টানে, সবুজ দূর্বা ঘাস মাড়িয়ে, সবুজ মাঠে। নতুন করে সবুজ ফলাবে বলে। রুস্তমের চোখে ছিল অগণিত সবুজ স্বপ্ন। সেসব স্বপ্নের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত সোনালি ধানেরা। আর শেফালী নামের মেয়েটি, যাকে রুস্তম বউ বলে ডাকত, ভালোবেসে, আদর করে, সে ছিল ঘরে এবং ঘরের বাইরে নিরবচ্ছিন্ন কর্ষণে আর সুবজের স্বপ্ন বোনায় এক অনিবার্য সহযোদ্ধা। রুস্তমের। অথবা রুস্তম-শেফালীর। কখনো মাঠফাটা রোদে পুড়ে, আবার কখনো বৃষ্টিতে ভিজে দিনের শেষে ক্লান্ত রুস্তম এক কাপ চা পান করার উদ্দেশে ছুটে যেত বাড়ির অদূরে রহিমের দোকানে। যাওয়ার আগে শেফালীর চোখে চোখ রেখে বলত- অহনই ফিরুম, চা’টা মুখে দিয়েই। শেফালীও হেসে বিদায় দিত। কিছুক্ষণ পরেই বরণ করবে বলে। বুকের উষ্ণতা দিয়ে। রুস্তম শেফালীর চোখের ভাষা বুঝত বলেই ফিরে আসত চায়ের নেশার সমাপ্তি টেনেই, অন্য রকম নেশার টানে, যে নেশায় রুস্তম একা নয়, শেফালীও সমানভাবে অংশীদার হতো। রাতের পর রাত।
একদিন রহিম কিনে আনল একটা একুশ ইঞ্চির টেলিভিশন। সাদা-কালো নয়; রঙিন। বউয়ের নামে তোলা ক্ষুদ্রঋণের টাকায়। তত দিনে গ্রামীণ ছোট বাজারটিতে ডিশ অ্যান্টেনার সংযোগও এসে গেছে। মাসিক তিনশ’ টাকায় রহিম খুলে দিল তার নিয়মিত খদ্দেরদের জন্য এক রঙিন দুনিয়া। চির সবুজের বিপরীতে সে রঙিন দুনিয়া দেখে রুস্তমও পুলকিত হয়। ফিরে গিয়ে গল্প করে বউয়ের সঙ্গে। রুস্তমের মনের পুলক ছড়িয়ে পড়ে শেফালীর ভেতর। রঙিন দুনিয়ার মানুষদের নানা কিসিমের আদর-সোহাগের দু-একটা ছবকও দেয়। বউকে। রাতের আবছা আলোয় লোকটার শিক্ষা-দীক্ষা আর নিজের ওপর মাস্টারিতে তরক্কি দেখে শেফালীও খুশি হয়। পরের রাতগুলোতেও আশা নিয়ে বসে থাকে। আরও নতুন নতুন ছবকের। এক সময় শেফালী টের পায়, তার অপেক্ষার সময় দিন দিন দীর্ঘতর হচ্ছে। কখনো কখনো রাত বারোটা বাজে। তখনো রুস্তম আর ঘরে ফেরে না। কারণ, তখনো রুস্তমের মনের তালিকায় কমপক্ষে এক থেকে দুটি হিন্দি ছবির নাম ঝুলে থাকে। আর চোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে ভাসতে থাকে রঙিন তারকারা, মাধুরী, ঐশ্বরিয়া, ক্যাটরিনা কাইফ অথবা সাকিরা। মনের অজান্তেই রুস্তম হয়ে ওঠে শাহরুখ, সালমান অথবা হৃতিক। অপেক্ষাকাতর শেফালী ঘরে বসে স্বপ্ন বোনে। নতুন করে। ঘরের মানুষকে ঘরে ফিরিয়ে আনার। একটা রঙিন টেলিভিশন কেনার। কিন্তু খেতে আগের মতো ভালো ফসল হয় না বলে, শেফালীর গোলায় কোনো উদ্বৃত্ত থাকে না। টেলিভিশনও কেনা হয় না। রুস্তমও আর ঘরে ফেরে না। সময়মতো। বিশ্বায়নের রঙিন দুনিয়া বিচ্ছিন্ন করে রাখে শুধু এক রুস্তম-শেফালী দম্পতিকে নয়; শত শত গ্রামীণ রুস্তম-শেফালীদের। যারা প্রত্যেকেই একসময় ঘরে ফিরত সন্ধ্যা নামার আগেই।
দুই.
এটা ঠিক যে আমি বিচ্ছিন্নতার কথা বলছি বলে আমাকে কেউ কেউ ভীষণ হতাশাবাদী মনে করবে। সেটা করতেই পারে। সে রকম ভাববার অধিকার সবার আছে। তোমারও নিশ্চয় আছে। তুমিও ভাবতে পারো, তোমার মতো করে। আমি তারপরও বলব, খুব জোর দিয়ে বলব, খুব বিশ্বস্ততার সঙ্গে বলব, আমাদের গল্পগুলো শতভাগ বিচ্ছিন্নতার। আমার মায়ের গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। মা বিয়ে করেছিলেন কিশোরী বয়সে। যে বয়সে এখনকার শিশু-কিশোররা কানামাছি-গোল্লাছুট খেলে। সবুজ ঘাস মাড়িয়ে, খেতের আল দিয়ে, অথবা ধানখেতের মাঝ দিয়ে, মেঘলা দিনে, বৃষ্টিতে ভিজে, অথবা চাঁদনি রাতে এ-পাড়া ও-পাড়া চষে বেড়ায়। আর আমাদের নাগরিক শিশুরা কম্পিউটার-ট্যাব নিয়ে অন্য দুনিয়ায় মেতে থাকে। টম অ্যান্ড জেরি দেখে, কিংবা মা অথবা দাদুর সঙ্গে বসে হিন্দি সিরিয়ালে নিমগ্ন থাকে। মায়ের বিয়ের পর মাকে সুপাত্রস্থ করতে পেরে যখন তাঁর বাবা-মা অথবা বড় ভাই সুখনিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন, তখন কেউ টের না পেলেও অন্য সব মেয়ের মতোই মা নিশ্চয় টের পেয়েছিলেন, অন্তত ভেতরে ভেতরে, মনে মনে, আসলে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তাঁর দুর্বার শৈশব থেকে, খেলার সাথীদের কাছ থেকে, আরও একটু শিক্ষিত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থেকে, তাঁর খুব খুব পরিচিত বাড়ির উঠোন, সজনে গাছ, আমবাগান, ঘরের কোণের চড়ুই পাখি, প্রতিদিন সাঁতরে বেড়ানো পুকর এবং শীতের নরম সূর্যালো অথবা চাঁদনী রাত থেকে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন পিঠাপিঠি ভাইবোনদের কাছ থেকে। তারপর তাঁর জীবনসঙ্গী মানে আমাদের বাবা এবং তিনি মিলে যখন পরস্পরের বিচ্ছিন্নতাগুলোকে মুছতে শুরু করলেন, একটু একটু করে, বাংলাদেশের জনসংখ্যায় যুক্ত হলো আরও চারটি শিশুর। মানে জন্ম হলো আমাদের তিন ভাই ও এক বোনের। ভাইবোনদের মধ্যে আমি সবার ছোট। সালটা ১৯৭১। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ। ইতিহাসটা তো তুমি জানোই, তখন সারা দেশে তাণ্ডব চালাচ্ছে পিশাচ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমাদের পূর্ব প্রজন্মের রক্ত-মাংস নিয়ে এক বীভৎস খেলায় মেতে উঠেছে তারা। সঙ্গে আছে তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনী। বাবা চলে গেছেন যুদ্ধে। পাকিস্তানি বর্বরদের রুখে দাঁড়ানোর দুর্বিনীত ইচ্ছায়। একটা পতাকার স্বপ্নে। একটা ভূখণ্ডের স্বপ্নে। হয়তো বা শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তিরও স্বপ্ন ছিল। কিন্তু যুদ্ধটা শেষ হওয়ার আগেই, লাল-সবুজের পাতাকটা মুক্ত আকাশে পতপত করে ওড়ার আগেই, একদিন সকালে খবর এল, বাবা নেই। বাবাকে খুন করেছে, পাকিস্তানি বাহিনী, একটু আগে, বাড়ির কাছে, খালের পাড়ে। ততক্ষণে একজন স্বপ্নবান মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার রক্তকণিকায় লাল হয়ে উঠেছে আমাদের বাড়ির পাশে প্রবহমান খালের পানি। কে বলেছে পানির কোনো রং আর গন্ধ নেই। মিথ্যা কথা। বাবার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া রক্তস্রোত খালের পানিকে সেদিন দিয়েছিল এক নতুন মর্যাদা, নতুন রং, গন্ধ আর স্বাদ। আর মা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন, চিরদিনের জন্য, বাবার কাছ থেকে। যার সঙ্গে সারা জীবন একসঙ্গে থাকবেন বলে হয়তো একটা রঙিন স্বপ্ন প্রকাশ্যে অথবা গোপনে পুষে রেখেছিলেন। আমাদের মা। একই সঙ্গে আমরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম একটি বাবাময় ভুবন থেকে। আমাদের মাথার ওপর স্নেহময় বর্ণিল আকাশটার অর্ধেক টুকরো টুকরো হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকে খালের পানিতে, তারপর ভাসতে ভাসতে খাল থেকে নদী, নদী থেকে সমুদ্র, সমুদ্র থেকে ছুটতে থাকে কোনো এক অজানা গন্তব্যে। বাবা, এখন আমাদের কাছে বিচ্ছিন্ন স্মৃতি, আর আমাদের সন্তানদের কাছে ইতিহাস। তাও আবার বিচ্ছিন্ন, নিয়মিত পড়া হয় না-এমন এক ইতিহাস।
শুনেছি আমার বয়স তখন এক বছরও হয়নি। আমি কি তখন বাবা ডাকতে শিখেছি? কী জানি! হয়তো শিখেছিলাম! বড় ভাই আর বোনের বাবা ডাক শুনে শুনে। অথবা একবারেই শেখা হয়নি। শব্দটি। কিন্তু এটা তো সত্য যে ১৯৭১ আমার প্রাত্যহিক ব্যবহারিক শব্দভাণ্ডারে ‘বাবা’ শব্দটি যুক্ত করার সুযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। এই আমাকে। আর আমরা সব ক’টি ভাইবোন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম বাবার আদর, ভালোবাসা, বকুনি, শরীরের ঘ্রাণ, হাত ধরে হাঁটা, বুকের ওপর ঘুমিয়ে পড়া, সাঁতার শেখা, পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া, এ রকম আরও কত কিছু থেকে। আমার খুব মনে আছে। এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন। জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। পরীক্ষা কেন্দ্রের দোতলা থেকে তাকালে চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। তখন ছিল শীতকাল। রাতভর শীতের কুয়াশারা কী এক অজানা মায়ায় নেমে এসেছিল পৃথিবীতে। শীতের নরম রোদ তখনো সবুজ ঘাসে জমে থাকা শিশির-বিন্দুদের মুছে দিতে সক্ষম হয়নি। পুরো মাঠটাই চিকচিক করে জ্বলছিল সূর্যের আলোয়। মাঠের প্রান্তে দাঁড়ানো শত শত পুরুষ-স্বজন। পরীক্ষা শেষে মাঠের সে সবুজ গালিচা পার হয়ে দেখি সব বন্ধুর বাবারা দাঁড়িয়ে আছেন। উদ্বিগ্নতা আর উৎসাহ নিয়ে। কিন্তু আমার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে নেই। কারণ আমার তো আর বাবা ছিল না। আর মা তো পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণেই বিচ্ছিন্ন। নারী হিসেবে। জনপরিসর থেকে। তখনকার মফস্বল শহরে। বিশ্বাস করো, এর আগে আমার নিজেকে এতটা বিচ্ছিন্ন, এতটা একা আর কখনো মনে হয়নি। বন্ধুরা সব যখন যে যার বাবার হাত ধরে ধরে বাড়ির দিকে পা ফেলছিল, আমি বিচ্ছিন্ন হয়েই দাঁড়িয়ে রইলাম। সবুজ মাঠের প্রান্তে। কতক্ষণ ধরে আজ আর মনে নেই। কারণ সে স্মৃতিটাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, আমার অন্তরের দিনলিপি থেকে।
আগেই বলেছি, মায়ের বিয়ে হয়েছিল কিশোরী বয়সে। আর মুক্তিযুদ্ধ মাকে বিধবা করেছে ঊনিশের সিঁড়ি পার না হতেই। আমার সে টিনেজ মা, এক গ্রামীণ বিধবা তরুণী, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে এখন যাঁর সব চুল সাদা ধবধবে, যাঁর একটি চোখ অন্ধ, আরেকটিও বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, দৃষ্টিক্ষমতা থেকে, যাঁর শরীরে ক্রমেই বাসা বাঁধছে কতিপয় বার্ধক্যজনিত রোগ, সে সময় আগলে ধরলেন চার শিশুসন্তানকে। যে বয়সে এখনকার তরুণ-তরুণীরা প্রেম-রোমান্সের নানা সমীকরণের সঙ্গে পরিচিত হওয়া শুরু করে, ডেট করে, থরথর হয়ে কাঁপে এবং কাঁপায়, সে বয়সে আমার মা প্রেম-রোমান্সের রঙিন দুনিয়া থেকে শতভাগ বিচ্ছিন্ন হলেন, বাধ্যতামূলকভাবে মনোনিবেশ করলেন, নতুন এক আরোপিত স্বপ্নে। চার শিশুসন্তানকে মানুষ করার ব্রতে। এরই মধ্যে আমার শহরে থাকা মা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন যাবতীয় শহুরেপনা থেকে। শহরের বৈদ্যুতিক আলো, পাখা, ওয়াসার পানি, সংযুক্ত শৌচাগার, গোসলখানা, সিনেমা হল, সাদা-কালো টিভি, ঘরের কাছের বাহারি পণ্যসমেত দোকান এবং আরও অসংখ্য বর্ণিল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে। কারণ, সামাজিক ব্যাকরণেই তিনি এসে উঠেছেন স্বামীবিহীন স্বামীর বাড়িতে। আমাদের গ্রামে। যেটাকে আমরাও আমাদের নিজেদের বাড়ি বলেই জানি।
আমার এখনো মনে আছে। স্পষ্ট মনে আছে। আমরা যে ঘরটিতে থাকতাম, আমাদের শোবার ঘরে একটা মাঝারি আকারের খাট ছিল। ওই খাটে আমরা চার ভাইবোন এবং মা, মোট পাঁচজন, গাদাগাদি করে, কাতারবন্দি হয়ে ঘুমাতাম। এমন গাদাগাদি আর কাতারবন্দি হয়ে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা বরিশাল-পটুয়াখালীর লঞ্চে প্রতি রাতেই নিম্নবিত্ত নারী-পুরুষদের হয়। আমাদেরও হয়েছিল। শৈশবে ও কৈশোরে। পার্থক্যটা হচ্ছে, আমরা পরিচিত ছিলাম, সহোদর ছিলাম। লঞ্চের সেসব যাত্রী হয়তো পরস্পর পরিচিত নয়। সহোদরও নয়। তবু সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের সে গাদাগাদি জীবনে তখন সম্ভবত কারও কষ্ট হয়নি। আমরা বরং আনন্দেই ছিলাম। আমরা উপভোগ করতাম আমাদের সহোদরদের গলা জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকা, ঘুমোনো, শরীরের গন্ধ, স্পর্শ ও নিরন্তর খুনসুটি। শুধু গ্রীষ্মের দাবদাহ বেড়ে গেল, প্রকৃতি গরিব-অবান্ধব হয়ে উঠলে, আমাদের পিঠ ও বিছানা ভিজে একাকার হয়ে যেত। এখনো খুব মনে পড়ে, মা সারা রাত পাখা নাড়াতেন। ওটা এতখানি অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল যে মা ঘুমিয়ে পড়লেও পাখাসহ তাঁর হাত নড়তেই থাকত। মায়ের কি তখন খুব হাত ব্যথা হতো, কখনো কখনো-জানা হয়নি, জিজ্ঞেস করাও হয়নি।
একদিন হঠাৎ দেখি আমাদের গাদাগাদি-কাতারবন্দি জীবনে সদস্য সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। প্রথমে বড় জন। মানে বড় ভাই। বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে উঠলেন ছাত্রাবাসে। বাড়ির অদূরে। বৃত্তি পরীক্ষা শেষ হলো। কিন্তু তার আর ফেরা হলো না মাঝারি খাটের গাদাগাদি জীবনে। তারপর একদিন গ্রাম ছেড়ে শহরে গেলেন। রাজধানী ঢাকায়। আমিও এক সময় হোস্টেলে উঠলাম। মেজো ভাই দূরের মফস্বল কলেজের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে লজিং বাড়িতে। আর বোন? পড়ালেখার পর্ব পুরোটা শেষ না করেই বিয়ে-সংসারের নামে অন্য বাড়িতে। বরিশালের লঞ্চের ডেকের মতো যে খাটটি একদা প্রতিরাতে গাদাগাদি করা সহোদরদের উষ্ণতায় ভরে উঠত, ঘামে সিক্ত হতো, একঝাঁক সহোদরের ঝগড়া আর খুনসুটিতে দুলে উঠত, আমাদের টিকে থাকার লড়াই, সামাজিক-আর্থনীতিক প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, শৈশবের সে প্রিয় খাটটিকে বিশাল শূন্য মাঠে পরিণত করল। সঙ্গে মা হয়ে গেলেন একা। আবারও। আর আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। প্রায় কাছাকাছি সময়ে। মা কি তখন সে শূন্য মাঠে, সে পুরোনো খাটটিতে শুয়ে-বসে, গভীর রাতে, কেঁদেছিলেন, হঠাৎ হঠাৎ, অথবা নিয়মিত, ঘুমিয়ে পড়ার আগে- কোনো দিন জিজ্ঞেস করা হয়নি। কিন্তু ’৭১-উত্তর সবাইকে যে একই পাটাতনে নিয়ে এসেছিলেন, আমাদের মা, সে পাটাতন থেকে আমাদের বিচ্ছিন্নতা কিছুতেই ঠেকানো যায়নি। মা ঠেকাতে পারেননি। আমরাও না। বরং আমাদের বিচ্ছিন্নতাগুলো আরও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। কালের পরিক্রমায়। শ্রেণির বিচারে। মাত্রার বিচারে। সংস্কৃতির বিচারে। তুমি তো জানো, বিত্তের মধ্যেও বিত্ত থাকে, বিত্তের কাঠামো থাকে, কাঠামোর স্তরায়ণ থাকে, দৃশ্য-অদৃশ্য, সে বিত্তের কারণেই আমাদের সহোদরদের বিচ্ছিন্নতাগুলো আর একরৈখিক থাকেনি। ধীরে ধীরে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। মানে আমরা আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। পরস্পরের কাছ থেকে। বিভিন্নভাবে। কারণ, প্রতিষ্ঠা আর টিকে থাকার দৌড়ে আমরা একদিন যে খাট থেকে পড়ে গিয়েছিলাম, ইচ্ছা করে, সে সময় আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াটা হয়তো একই রকম ছিল। স্বপ্নটাও হয়তো। কিন্তু তারপর আর কিছুই এক থাকেনি। আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এক থাকেনি। আমাদের সামাজিক যোগ্যতা এক থাকেনি। সামাজিক-আর্থনীতিক সম্ভাবনাগুলোও এক থাকেনি। শ্রেণির মধ্যেই শ্রেণির জন্ম আর কি। মা নিশ্চয় চাইতেন, আমরা একসঙ্গে থাকি। এক খাটে না হোক, অন্তত এক ঘরে। এক ঘরে না হোক, অন্তত একই বাড়িতে। কিন্তু মা চাইলেই তো হবে না। হয়নিও। কারণ, আমাদের বেড়ে ওঠা বাজার সংস্কৃতির যুগে। এক অচেনা নগরে। এ বাজার, এ নগর, এর গণমাধ্যম আমাদের প্রত্যেককেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের গল্প শুনিয়েছে। যূথবদ্ধ জীবনের বদলে একাকী জীবনের কথা বলেছে। প্রায় অনবরতভাবে। প্রতিদিন। আমাদের শিখিয়েছে বিচ্ছিন্নতার সংগীত। সে সংগীতটাই আমাদের জীবনসংগীত হয়ে গেল। আমাদেরই অজান্তে।
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল। ঘটনাটি আমাদের সহোদরদের বস্তুগত বিচ্ছিন্নতার উদাহরণ হতে পারে। অনেক দিন আগে, না ঠিক অনেক দিন আগে নয়, বছর দু-এক আগে, একবার মেজো ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ল। বড় দুর্ঘটনা নয়। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কোনোমতে বাসায় ফিরে এল সে। তার বাসায়। আমরা অন্য সহোদরেরা যে যেখানে থাকি, সেখান থেকে তার বাসা খুব বেশি দূরে নয়। বড়জোর এক ঘণ্টার পথ। জ্যাম থাকলে আরও এক ঘণ্টা। কিন্তু মেজোকে দেখতে যেতে আমাদের কারও কারও দুদিনেরও বেশি সময় লেগেছে। বিষয়টা এমন নয় যে সেদিন এ শহরের আকাশে সূর্য ওঠেনি, রাত পোহায়নি, গাড়ি চলেনি, রিকশার বেল বাজেনি, অথবা বিরোধী দল হরতাল ডেকে সবকিছু অচল করে রেখেছিল কিংবা বিরোধী দলের ভয়ে সরকারি অদৃশ্য নির্দেশে সবকিছু থেমে ছিল সেদিন। না, তেমন কিছুই ঘটেনি। তারপরও আমরা ভীষণ দেরিতে গিয়েছিলাম মেজোকে দেখতে। কারণ, সেদিন আমাদের ব্যক্তিগত গাড়িচালক ছুটিতে ছিল। আর আমরা তত দিনে পাবলিক বাসে চড়তে ভুলে গেছি। কদাচিৎ চড়লেও ঠাসা-ঠাসা মানুষের ঘামের গন্ধে আমরা এখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠি। আমাদের নাক বন্ধ হয়ে আসে। আমরা বিচ্ছিন্ন হতে হতে ইতিমধ্যে ভুলে গেছি যে একদিন এ নগরের পাবলিক বাসে আমাদের শরীরবিন্দুও সচল হতো। ওগুলো আমাদেরও বাহন ছিল। বাসে উঠলে আমাদেরও বগলের নিচে হঠাৎ হঠাৎ জন্ম নিত ঘামের ফোয়ারা। আমাদের বগলের কাছ দিয়ে এসে কোনো কোনো দিন অতিষ্ঠ হয়ে নীরবে সটকে পড়ত আমাদের সহযাত্রীরা। বুঝতেই পারছ, আমাদের বিচ্ছিন্নতার ব্যাপ্তি কতখানি হলে আমাদের এক ঘণ্টার অনিবার্য পথ আটচল্লিশ ঘণ্টার হয়ে ওঠে। আসলে এ বিচ্ছিন্নতা সময়ের নয়; এ বিচ্ছিন্নতা বস্তুগত। একই জরায়ুতে আমাদের প্রথম বেড়ে ওঠা হলেও দুনিয়ার ব্যাকরণে আমাদের মধ্যে যে বস্তুগত ব্যবধান তৈরি হয়েছে, সেটিই আমাদের হৃদায়ানুভূতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে আমাদের শৈশবের আকুতি, যে আকুতি নিয়ে একদা আমরা সহোদরেরা পরস্পরের খুব কাছে ছিলাম।
আমরা এখন ভাইবোনেরা সব ফেসবুক বন্ধু। আমাদের সন্তানেরাও নিজেরা নিজেদের এবং আমাদের বন্ধু। ফেসবুকেই। আমরা প্রতিদিন অনলাইনে বসি। অথবা মুঠোফোনে। ফেসবুক নিউজফিডে ছবি, স্ট্যাটাস দেখে দেখে লাইক দিই। মন্তব্য-প্রতি মন্তব্য করি। কিন্তু আমাদের সত্যিকারের দেখা হয় না। কথা হয় না। হলেও কদাচিৎ। বেশির ভাগ মোবাইলে। সামনাসামনি, একেবারে কম। কথাবার্তার সময় আমাদের হৃদয়রেখা আর গলার স্বরের ওঠানামা দেখে আমাদের ফেলে আসা স্মৃতিরা হোঁচট খায়, আমাদের অতীত সম্পর্কজনিত উষ্ণতা লজ্জায় রং বদলায়। এ নাগরিক শহরে এখন আমাদের কারও সময় নেই। আমরা ছুটছি। প্রতিদিন। আমরা এ নিরন্তর ছুটে চলার একটা নামও দিয়েছি। আমরা একে বলছি জীবিকার লড়াই। শৈশবে আমরা যারা ভাইবোনেরা একসঙ্গে ঘুমাতাম, গায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষে, সে ভাইবোনেরা সবাই জীবিকার লড়াইয়ের নামে এখন বিচ্ছিন্নতা যাপন করছি, এ নাগরিক শহরে। আর আমার মা কখনো এ বাড়িতে, কখনো ও বাড়িতে থেকেও মূলত বিচ্ছিন্নই থাকেন। নিজের জগতে। অথবা এখন তাঁর নিজের জগৎ বলেই হয়তো কিছু নেই। আমাদের আনুষ্ঠানিক দেখাশোনা, গালগল্পের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বিচ্ছিন্নতাই মূলধারা। এখন। আমাদের মধ্যে। আমরা সবাই এখন বিচ্ছিন্নতার সন্তান অথবা বিচ্ছিন্নতা আমাদের প্রেমিক-প্রেমিকা। বিচ্ছিন্নতাই এক অনিবার্য নিয়তি। বিচ্ছিন্নতায় বসবাস-আমার, তোমার, আমাদের। এ পৃথিবীর।
অলংকরণ- নিরব মনসুর