
বিংশ শতাব্দীতে বাঙালি মুসলমানের ধর্মাশ্রিত ভাববাদী দর্শন
ভদ্রবাহু (খ্রি.পূ. ৪৩৩-৩৫৭) বাংলাদেশের আদি দার্শনিক। তাঁর জন্ম পুণ্ড্রবর্ধনে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (খ্রিস্টপূর্ব ৩৪০-২৯৮) উপদেষ্টা হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর প্রভাবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসন ত্যাগ করে দিগম্বর জৈন সন্ন্যাসী হিসেবে জীবনযাপন করেছেন। ভদ্রবাহুর গ্রন্থ কল্পসূত্র বাঙালির আদি দর্শনচিন্তার নিদর্শন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অতীশ দীপঙ্কর দার্শনিক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শান্তরক্ষিত এবং কমলশীলের দার্শনিক হিসাবে যথেষ্ট সুনাম ছিল। বাংলাদেশে ন্যায় এবং নব্যন্যায় দর্শনের চর্চা হয়েছে। ১২শ শতাব্দীতে গাঙ্গেশ উপাধ্যায় নবদ্বীপে নব্যন্যায়ের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তাকে কেন্দ্র করেই নব্য ন্যায়ের যাত্রা শুরু। তত্ত্বচিন্তামণি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। পরাবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব, নীতিতত্ত্বের উপর প্রাচীন ন্যায় গুরুত্ব আরোপ করে। গাঙ্গেশ উপাধ্যায়ের তত্ত্বচিন্তামণি গ্রন্থকে কেন্দ্র করে বঙ্গে যে নব্যন্যায়ের চর্চা শুরু হয়েছিল তার মূল উৎস ছিল উদয়নাচার্যের ন্যায়কুমাঞ্জলি ও আত্মতত্ত্ববিবেক গ্রন্থের মধ্যে। নব্যন্যায়ের ইতিহাসে উদয়নাচার্য আদি পুরুষ। বাংলাদেশে নব্যন্যায় চর্চায় বাসুদেব সার্বভৌম এর অবদান স্মরণযোগ্য।
অনিরুদ্ধ ভট্ট ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর বাঙালি দার্শনিক। তিনি বল্লাল সেনের শিক্ষক এবং ধর্মাধিকরণিক ছিলেন। লক্ষণ সেনের মন্ত্রী পরিষদে ছিলেন হলায়ুধ। কথিত আছে শাসন কার্যের সুবিধার জন্য রাজ্যকে রাঢ়, বরেন্দ্র, বঙ্গ, বাগড়ী ও মিথিলা এই পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করার কাজটি সেন আমলে তিনি করেন। শৈব, বৈষ্ণব, মীমাংসা দর্শনে সুপণ্ডিত ছিলেন হলায়ুধ। ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনের মহাবিশেষজ্ঞ চন্দ্রকান্ত তর্কালংকারের জন্ম ময়মনসিংহ জেলায়। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, যশোর ও খুলনা জেলায় নব্য ন্যায়ের চর্চা বেশি হয়েছে। হরিদাশ ন্যায়ালঙ্কার, ষোল শতকের রঘুনাথ শিরোমণি, কণাদ তর্কবাগীশ এবং সতেরো শতকের জগদীশ তর্কালঙ্কার এবং জয়রাম পঞ্চানন, হরিনাম তর্কবাগীশ, গদাধর ভট্টাচার্য প্রমুখ ছিলেন নব্যন্যায়পন্থী বিখ্যাত বাঙালি দার্শনিক। প্রকাশানন্দ স্বরস্বতী, বিজ্ঞান ভিক্ষু, মধুসূদন স্বরস্বতী দার্শনিক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
মধ্যযুগে চর্যাগীতি থেকে শুরু করে মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী সুফি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সন্ধান করা হয় জীবনের শ্রেয় ও জগতের পরমসত্তার। মধ্যযুগের অন্যতম কবি-দার্শনিক হলেন জয়দেব। যদিও তাঁর অমূল্য গ্রন্থ গীত গোবিন্দ সংস্কৃত ভাষায় রচিত। বাঙালী সুফিশাস্ত্রের গ্রন্থগুলোতে জীবন জিজ্ঞাসা, নৈতিকতা, সমাজে মানুষের অবস্থান ইত্যাদি দার্শনিক প্রশ্নাদির উপস্থিতি দেখা যায়। মধ্যযুগে বাঙালি মুসলমানের দর্শন সমৃদ্ধ গ্রন্থগুলোর মধ্যে ফয়জুল্লাহর গোরক্ষ বিজয়, মীর সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানপ্রদীপ, জ্ঞান চৌতির্শা, হাজী মুহম্মদের নূরনামা, মোহসেন আলির মোকাম-মঞ্জিল কথা, শেখ মনসুরের সির্নামা, শেখ জাহিদের আদ্যপরিচয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব গ্রন্থের মধ্যে বাঙলার সুফী শাস্ত্রের বিবরণ ও তত্ত্ব পাওয়া যায়। হাজী মুহম্মদ ছিলেন দার্শনিক কবি। তাঁর নূরনামা একটি দার্শনিক গ্রন্থ। বাঙালি সুফি-সাধকদের গ্রন্থের মধ্যে সৃষ্টিতত্ত্ব, শূন্যতত্ত্ব, স্রষ্টাতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, জীবন জিজ্ঞাসা গুরুত্বের সঙ্গে স্থান করে নিয়েছে।
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের কাব্যে পরিণামতাত্ত্বিক নীতিশাস্ত্র, মুসলিম নীতিশাস্ত্র কথা, দাম্পত্য নীতিশাস্ত্র, জ্যোতিষমূলক নীতিশাস্ত্র, বৈঠকী নীতিশাস্ত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।১ মুসলমান কবিদের কাব্যের মূল ভিত্তি হচ্ছে শাস্ত্র। মধ্যযুগে বাঙালি মুসলিম পরিমাণতাত্ত্বিক নীতিশাস্ত্রের লেখকদের মধ্যে শেখ ফয়জুল্লাহ (ষোড়শ শতক), মুহম্মদ খান (অনু ১৫৮০-১৬৫০), মুজাফ্ফর (১৬০০-১৬৮০), শেখ চান্দ (১৬৭৫-১৭৪৫), সৈয়দ নূরুদ্দীন (১৭২৫-১৮০০), মুহম্মদ কাসিম (১৭৩০-১৮১০, বদিউদ্দীন (অঠারো শতক) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
আল কোরান, হাদিস এবং ফেকাহ শাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে মধ্যযুগে মুসলমান কবিদের কাব্যে ‘মুসলিম নীতিশাস্ত্র কথা’ গড়ে ওঠেছে। এসব মুসলিম কবিদের মধ্যে শেখ সুলায়মান (ষেড়শ শতক), আলাওল (১৫৯৭-১৬৭৩), মুহম্মদ নেয়াজ (সতেরো শতক), আশরাফ, (আঠারো শতক), শেখ পরাণ (আঠারো শতক), হেয়াত মামুদ (আঠারো শতক), মুহম্মদ মুকিম (১৭০০-১৭৮০), মুহম্মদ আলী (আঠারো শতক), বালক ফকির (আঠারো শতক), কবি নজীব (আঠারো শতক), আবদুল্লাহ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য কবির কাব্যে নীতিশাস্ত্র বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছে।২ শেখ সুলায়মানের অসিয়তনামা কাব্য নীতিকথা ও নানা উপদেশের সমন্বয়ে গড়ে ওঠেছে। আলাওল বাঙালি মুসলিম কবিদের মধ্যে অন্যতম। পদ্মাবতী তাঁর অনন্য সৃষ্টি। তোহফা আলাওলের একটি বিশিষ্ট নীতিকাব্য। কবি এ কাব্যের বাংলা নাম দিয়েছেন তত্ত্ব উপদেশ। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাটের কবি হেয়াত মামুদ বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট নীতি কবি। তাঁর জঙ্গনামা, চিত্তউত্থান বা সর্বভেদবাণী, হিতজ্ঞানবাণী, আম্বিয়াবাণী উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
দাম্পত্য জীবনকে সুখী-সুন্দর করে গড়ে তোলাই মধ্যযুগের বাঙালি কবিদের মূল উদ্দেশ্য। এসব নীতিশাস্ত্রমূলক কাব্যকে দাম্পত্য নীতিশাস্ত্র হিসাবে অভিহিত করা যায়। ফকির খাকী, সৈয়দ গাজী, আইনউদ্দীন, আবদুন নবী, মনোহর, হায়াত মাহমুদ, শাহ আলী, মজিলা খান, গোপাল দাস, নরোত্তম দাস প্রমুখের কাব্যগ্রন্থগুলো দাম্পত্য নীতি প্রধান।৩ জ্যোতিষশাস্ত্র-মূলক নীতিশাস্ত্র মধ্যযুগে বাঙালি মুসলিম কবিদের কাব্যে বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এ-ধারার কবিদের মধ্যে মুজাম্মিল, আবদুল গণি, কবি উমর, সৈয়দ মুহম্মদ, মুহম্মদ রফি, হোসেন ফকির প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কবি মুহম্মদ খান একজন উল্লেখযোগ্য নীতিশাস্ত্রকার। তাঁর সত্যকলি বিবাদ সংবাদ কাব্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে নীতিশিক্ষা। সপ্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিমের দুররা মজলিশ কাব্যটি নীতি শিক্ষামূলক। আঠারো শতকের কবি হেয়াত মামুদের সর্বভেদবাণী একটি নীতিকাব্য। মধ্যযুগে বাঙালি মুসলিম কবিদের নীতিশাস্ত্রমূলক কাব্যগুলো জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই নীতিশাস্ত্র মূলক কাব্যগুলো বাঙালির নীতিদর্শনের প্রাথমিক উৎস হিসাবে বিবেচনা করা যায়।
মধ্যেযুগের বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশ ঘটে। হোসেন শাহী শাসনামলে শ্রী চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম-দর্শন জনপ্রিয় করেন। চৈতন্যদেবের কোনো গ্রন্থ নেই। সংস্কৃত ভাষায় মাত্র আটটি শ্লোকের মাধ্যমে তিনি বিধৃত করেন তাঁর প্রেমাত্মক মানবতাবাদী দর্শন। চৈতন্যদেবের অনুসারিরা তাঁর ভক্তি প্রেম ও বাণীকে সংগ্রহ করে চৈতন্য ভাগবত, চৈতন্য চরিতামৃত, চৈতন্য মঙ্গল ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন। এসব গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে তাঁর ধর্ম-দর্শন। চৈতন্যদেবের দর্শন চিন্তায় মাধ্বাচার্য, বল্লভ ভট্ট, রামানুজ ও বৌদ্ধ ও সুফি দর্শনের প্রভাব স্পষ্ট। তাঁর মতে জীবাত্মা ও জগৎ পরস্পর ভিন্ন কিন্তু ঈশ্বর সাথে সম্বন্ধ সাপেক্ষে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল।
চৈতন্যদেবের অন্যতম শিষ্য সনাতন গোস্বামী সুলতান হোসেন শাহীর ‘দবীর খাস’ অর্থাৎ ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। আর সনাতনের ভাই রূপ গোস্বামী ছিলেন ‘সাকর মল্লিক’ অর্থাৎ রাজস্ব বিভাগের অধিকর্তা। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এরা বৈষ্ণব ধর্ম-দর্শন চর্চা করেছেন। সনাতন, রূপ এবং জীব গোস্বামীর গ্রন্থগুলো অবলম্বন করেই গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের দার্শনিক মত গড়ে ওঠেছে। জীব গোস্বামীর তত্ত্ব-সন্দর্ভ, ভগবৎ-সন্দর্ভ, পরমাত্ম-সন্দর্ভ, কৃষ্ণ-সন্দর্ভ, ভক্তি-সন্দর্ভ ও প্রীতি-সন্দর্ভের মধ্যে দিয়েই প্রধানত গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণের সকল মতবাদ তথা রাধাবাদের দার্শনিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। গোস্বামীদের গ্রন্থাবলিতে পৌরাণিক তত্ত্ব, দর্শন, কান্তিবিদ্যা এবং ব্যাকরণ আলোচিত হয়েছে।৪
বাণিজ্য উপলক্ষ্যে ব্রিটিশ, ডাচ এবং আমেরিকানদের আগমনের ফলে বাংলায় নতুন যুগের সূচনা হয়। তাদের চিন্তা-চেতনা ও দর্শন দিয়ে এদেশের মানুষ প্রভাবিত হয়। পাশ্চাত্যের দর্শন, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন চিন্তা-চেতনা ও উন্নত জীবনবোধ দিয়ে এদেশের মানুষ যে অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে সংক্ষেপে তাকেই বেঙ্গল রেনেসাঁস বলে। বাংলাদেশের লোকায়ত, বেদ-বেদান্ত, বৌদ্ধ, জৈন, সাংখ্য, ন্যায়, মীমাংসা, বৈষ্ণব, বাউল দর্শন ঊনবিংশ শতাব্দীতে সম্পূর্ণ বদলে যেতে থাকে। কিন্তু সম্পূর্ণ বদলায় না। লোকায়ত চিন্তা বৃহত্তর গণসমাজে সামান্য হলেও থেকে যায়। বেদ-বেদান্ত, উপনিষদের চিন্তা দিয়েও উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁসের প্রধান প্রধান চিন্তানায়কেরা প্রভাবিত ছিল। এ ক্ষেত্রে রাজা রামমোহনের নাম সবার আগেই আসে। ব্রিস্টলের Arnos Vale Cemetery-তে রাজা রামমোহন রায়ের সমাধিতে লেখা রয়েছে, Philosopher, Reformer, Patriot, Scholar, A founder father of Indian Renaissance.
ঊনিশ শতকে অগাস্ট কোঁতে, স্যামুয়েল লব, জেমস গোডেস এবং হেনরী কটনের প্রত্যক্ষবাদ দিয়ে হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিওর শিষ্যরা প্রভাবিত ছিলেন। ডিরোজিওর অনুরাগী রসিক কৃষ্ণ মল্লিক (১৮১০-১৮৫৭), দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জী (১৮১৪-১৮৭৪), রাধানাথ সিকদার (১৮১৩-১৮৭০) প্রমুখের চিন্তায় প্রত্যক্ষবাদের ছাপ স্পষ্ট।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার রেনেসাঁস আন্দোলনের অনেক চিন্তাবিদ ইউরোপের উপযোগবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), কেশবচন্দ্র সেনের (১৮৩৩-১৮৮৪) চিন্তা-চেতনায় উপযোগবাদের ছাপ স্পষ্ট। এরা বেদ-বেদান্ত ও উপনিষদের প্রভাব ত্যাগ করতে পারেন নাই। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আত্মতত্ত্ববিদ্যা গ্রন্থে লিখেছেন, “জীবাত্মা পরমাত্মা হইতে ভিন্ন।”৫ এই মত শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ সমর্থন করে না। দেবেন্দ্রনাথের ঠাকুরের উপর জার্মান দার্শনিক হেগেলেরও প্রভাব রয়েছে। অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন প্রত্যক্ষবাদী। অক্ষয়কুমার দত্তের চিন্তা সম্পর্কে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “আমি খুঁজিতেছি, ঈশ্বরের সহিত আমার কি সম্বন্ধ ; আর তিনি খুঁজিতেছেন, বাহ্য বস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির কি সম্বন্ধ;—আকাশ পাতাল প্রভেদ!”৬ অক্ষয় কুমার দত্তকে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ নীতিশিক্ষকও বলা হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৪-১৮৯৪) চিন্তার জগতে প্রাচীন ভারতীয় উপাদান থাকলেও তাঁর মধ্যে উপযোগবাদী প্রবণতা দেখা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সাংখ্যদর্শন’ পড়লে তাকে ভারতীয় দার্শনিক বলেই মনে হয়। আবার তাঁকে উপযোগবাদী বলা যায়, ‘চিত্তশুদ্ধি’, ‘জ্ঞান’, ‘মনুষ্যত’ কি পড়লে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে উপযোগবাদী ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলিম দার্শনিকরাও ইউরোপীয় চিন্তাচেতনা দিয়ে প্রভাবিত হলেও কোরান এবং হাদিস থেকে তাদের বিচ্যুতি হয়নি। বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে নবাব আব্দুল লতিফের (১৮২৮-১৮৯৬) চিন্তা-চেতনায় উপযোগবাদের ছাপ রয়েছে। তিনি মুসলিম সমাজকে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদলে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য ইংরেজি শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৮৬৪ সালে নবাব আব্দুল লতিফ কলকাতায় মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। ‘মহামেডান লিটারারি সোসাইটি’ উচ্চবিত্ত মুসলমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। নবাব আবদুল লতিফের মত সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৮-১৯২৮) উপযোগবাদী নীতি অবলম্বন করে মুসলামন সমাজকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছেন। ইসলাম ধর্মের মূলনীতিকে আদর্শ হিসাবে নিয়েছিলেন আব্দুল লতিফ এবং সৈয়দ আমীর আলী। সৈয়দ আমীর আলীর The Spirit of Islam, A Short History of the Saracens, The Ethics of Islam ইত্যাদি গ্রন্থে তিনি ইসলামী চিন্তা-চেতনাকে সমর্থন করেছেন।
উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালির দর্শনচিন্তায় ইউরোপীয় চিন্তার সাথে বেদ-বেদান্ত উপনিষদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিংশ শতাব্দীতে বাঙালি মুসলমানের দর্শনচিন্তায় ধর্মাশ্রিত ভাববাদ, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা এবং ধর্মাশ্রিত ভাববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ বস্তুবাদের সমন্বয়ে সমন্বয়ী দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির দর্শনচিন্তায় এই তিন ধারার চিন্তার উপস্থিতি ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রতিনিধিত্বশীয় বিশিষ্ট বাঙালি মুসলমানের দর্শনচিন্তায় এই তিন ধারার উপস্থিতি দেখা যায়। এদের কারো কারো চিন্তায় কখনো ধর্মাশ্রিত ভাববাদী চিন্তার প্রভাব বেশি আবার কারো চিন্তা বাস্তববাদী। কারো কারো চিন্তায় সমন্বয়ি ধারার উপস্থিতি দেখা যায়। এই প্রবন্ধে বিংশ শতাব্দীর প্রতিনিধিত্বশীল চারজন বাঙালি মুসলমানের ধর্মাশ্রিত ভাববাদী দর্শন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই চারজন দার্শনিক হলেন খানবাহাদুর আহছানউল্লাহ, মোহম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল হাশিম এবং দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ।
বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (১৮৭৩-১৯৬৫) প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শন নিয়ে প্রথম এম. এ পাশ করেন। স্কুলে শিক্ষকতা এবং শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে চাকরি জীবন শেষ করে অবসর জীবনে তিনি পুস্তক ব্যবসা শুরু করেন এবং শেষ জীবনে জন্মস্থান নলতায় এসে সমাজসেবা কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। বাঙালিদের মধ্যে তিনি প্রথম আই ই এস পদে উন্নীত হয়েছিলেন। পরীক্ষার খাতায় রোল নম্বর প্রবর্তন সহ তিনি শিক্ষাখাতে কিছু সংস্কারমূলক কাজ করেছেন। বঙ্গীয় সুফিবাদ দিয়ে তিনি প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর চিন্তায় জ্ঞানবিদ্যা, অধিবিদ্যা এবং মূল্যবিদ্যা বিশেষভাবে রয়েছে। তিনি মনে করেন স্বজ্ঞার সাহায্যে জ্ঞান হয়। জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়া হিসাবে তিনি ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা এবং বুদ্ধির গুরুত্ব স্বীকার করেন নি। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য জ্ঞানলাভের কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের জন্য বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতা কার্যকরি নয়। ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে হয়। জ্ঞান কি এবং কোন্ জ্ঞানের সাহায্যে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় এ সম্পর্র্কে খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা লিখেছেন,
এল্ম বলিতে বুঝিতে হইবে ঐ জ্ঞান, যাদ্বারা খোদার রহমানিয়তের পরিচয় পাওয়া যায়, যে জ্ঞান দ্বারা খোদার নৈকট্য লাভ করা যায়, যে জ্ঞান দ্বারা মানুষকে খোদার রঙে রাঙ্গাইতে পারা যায়, যে জ্ঞান দ্বারা তাঁহার সংযোগ বা সাযুজ্য লাভ করা যায়, যে জ্ঞান দ্বারা তন্ময়তা হাছেল করা যায়, যে জ্ঞান দ্বারা স্রষ্টার প্রেমের নিদর্শন গোচরীভূত হয়, যে জ্ঞান দ্বারা মানুষ স্বীয় হাস্তির খবর ভুলিয়া গিয়া খোদার এককত্বের গভীরতম সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়- এককথায় যে জ্ঞান দ্বারা ইছলামের তাওহীদের গভীরতম প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায়।৭
খোদার নৈকট্য লাভের জন্য খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা পূর্ণজ্ঞান লাভ করতে চেয়েছেন। অভিজ্ঞতার সাহায্যে পূর্ণ জ্ঞান হয় না। বুদ্ধিও পূর্ণ জ্ঞান দিতে পারে না। বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতাকে জ্ঞানলাভের মাধ্যম হিসাবে তিনি স্বীকার করেছেন। কিন্তু পূর্ণ জ্ঞানলাভের জন্য তিনি স্বজ্ঞার উপর নির্ভর করেছেন। পূর্ণ জ্ঞানের সাহায্যেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে তিনি লেখেছেন, “কেবল মানসিক জ্ঞান মানবকে পূর্ণত্ব দিতে পারে না। মানুষ দেহ, মন ও আত্মার সমষ্টি, যে জ্ঞান দ্বারা দেহ, মন ও আত্মা পুষ্ট হয়, সেই প্রকৃত জ্ঞান। যে জ্ঞান স্রষ্টা ও সৃষ্টির দূরত্ব নষ্ট করিয়া যোগ সাধনের সহায়তা করে, সে জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান।”৮ ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা অনেক সময় প্রতারিত করে। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বস্তুকে সবসময় সঠিকভাবে জানা যায় না। অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জন লক মনে করেন, অভিজ্ঞতাপূর্ব কোনো অন্তরধারণা আমাদের মনের মধ্যে নেই এবং অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। তিনি মনে করতেন, অভিজ্ঞতার পূবে আমাদের মন সাদা কাগজের মত থাকে। আর এই অভিজ্ঞতা আসে সংবেদ এবং অন্তর্দর্শন থেকে। খানবাহাদুর আহছানউল্লা আধুনিক ইউরোপের অভিজ্ঞতাবাদীদের মত সমর্থন করেন না।
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার জ্ঞানবিদ্যা, অধিবিদ্যা এবং মূল্যবিদ্যা আলোচনা করলে দেখা যায় তিনি ছিলে ধর্মকেন্দ্রিক ভাববাদী দার্শনিক। জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ হিসাবে স্বজ্ঞাবাদ গ্রহণ করেছেন তিনি যুক্তির সাহায্যে পরমসত্তাকে প্রমাণ করার জন্য। অধিবিদ্যার বিষয়গুলোতে তিনি যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অধ্যাত্মবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তিনি মূল্যবিদ্যার বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার দর্শনে যুক্তির চেয়ে বিশ্বাস প্রবল। ধর্মকেন্দ্রিক ভাববাদী দর্শন শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস নির্ভর হয়। কিন্তু দর্শন যুক্তি-তর্ক এবং সমন্বয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লার দর্শন যুক্তিহীন নয়, তবে বিশ্বাস নির্ভর।
বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে অন্যতম ভাববাদী দার্শনিক মোহম্মদ বরকতুল্লাহ (১৮৯৮-১৯৭৪) প্রথম দর্শনের পরিভাষা এবং পাশ্চাত্যের দার্শনিক পদ্ধতি ব্যবহার করে বাংলা ভাষায় দর্শনচর্চা করেছেন। তাঁর রচনার মধ্যে জগৎ ও জীবন, জড়প্রকৃতি ও মনোজগৎ, আত্মা ও পরমাত্মা, ইহলোক ও পরলোক ইত্যাদি দার্শনিক প্রশ্ন স্থান পেয়েছে। প্রথম জীবনে তিনি পাশ্চাত্য দর্শনের অনুপ্রেরণায় দর্শনচর্চা করেছেন পরবর্তী জীবনে তিনি ধর্মীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। বরকতুল্লাহর দর্শনচিন্তা সম্পর্কে হরিদাস ভট্টাচার্য লিখেছেন, “তাঁহার লেখার মধ্যে যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শবাদ ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাতে তাঁহার নিজের ধর্ম্মপ্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়।”৯ জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় মোহম্মদ বরকতুল্লাহ স্বজ্ঞাবাদ গ্রহণ করেছেন। স্বজ্ঞাবাদ গ্রহণ করার আগে তিনি বুদ্ধিবাদ এবং অভিজ্ঞতাবাদের সমালোচনা করে বলেছেন, বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতার সাহায্যে পূর্ণ জ্ঞান হয় না। স্বজ্ঞার নাম দিয়েছেন তিনি অতীন্দ্রিয় অনুভবশক্তি। এই অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তির নামই স্বজ্ঞা (Intuition)। বুদ্ধি, সংস্কার এবং ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে সমালোচনা করে মোহম্মদ বরকতুল্লাহ অতীন্দ্রিয় অনুভবের সমর্থন করে লিখেছেন,
বুদ্ধি-বৃত্তি ও সংস্কার ব্যতীত মানুষের ভিতর আরও একটি ক্ষমতা আছে, যাহাকে আমরা অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তি (Intuition) বলিতে পারি। ইন্দ্রিয়ের সাহায্য ব্যতীতও যে আমরা অনেক জিনিষ অনুভব করিতে পারি, তাহা প্রত্যেকেই মনে মনে বুঝিতে পারিতেছেন। এই যে আমি ভাবিতেছি, এই যে আমি জীবিত আছি বলিয়া বিশ্বাস করিতেছি, এই যে আমি পূর্ব্বেও যে ছিলাম এখনও সেই আছি, এ সমস্ত জ্ঞান কোন ইন্দ্রিয়লব্ধ নহে। উহা আমাদের ঐ ভিতরকার অনুভব শক্তির ফল। ভিতরকার স্বাভাবিক অনুভব শক্তি দ্বারাই আমরা নিজের অস্তিত্ব ও চেতনা সম্বন্ধে নিজে কৃতনিশ্চয়। আমাদের নিজ সত্তা ও বুদ্ধির সত্তা সম্বন্ধে অতীন্দ্রিয় অনুভবশক্তি (Intuition) ব্যতীত আর অন্য কোন প্রমাণ নাই।১০
বরকতুল্লাহর অতীন্দ্রিয় অনুভূতির সাহায্যে অতীত-বর্তমান, ভূত-ভবিষ্যত, সবকিছু সম্পর্কে জানা যায়। এ-সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “অতীন্দ্রিয় অনুভূতির নিকট ভূত ভবিষ্যত বর্তমান বলিয়া কিছু সীমা নির্দ্দেশ নাই। উহা সকল কালের সকল দেশের যা কিছু বাস্তব তাহা প্রত্যক্ষ করিতে পারে।”১১
মানুষকে তিনি অসীম ক্ষমতাবান মানুষ হিসাবে দেখেছেন। অতীন্দ্রিয় অনুভূতি সম্পন্ন মানুষের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “মানুষের অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তি (Intuitio) যখন পরিণত অবস্থায় উপনীত হয়, তখন তাহার মনোজগৎ নাকি স্বর্গীয় আলোকমালায় উদ্ভাসিত হইয়া ওঠে। সেই আলোকে সে দেখিতে পায় তাহার নিজ স্বরূপ; অর্থাৎ বিশ্বলোকে তাহার স্থান কোথায়, বিশ্বের সহিত তাহার সংযোগ, অসীমে আর সসীমে কি যোগাযোগ, এ সমস্ত সে অনুভব করিয়া প্রাণে বিপুল আনন্দ উপভোগ করিতে থাকে।”১২
মোহম্মদ বরকতুল্লাহর অতীন্দ্রিয় অনুভব শক্তি শেষ পর্যন্ত জ্ঞান লাভের বাহন না হয়ে বিশ্বাসের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। সুফি, পির, ফকির ও বাউলেরা সাধনার মাধ্যমে পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলনের কথা বলেছেন। মানবাত্মা ও পরমাত্মাকে অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায় না। অতীন্দ্রিয় অনুভূতির সাহায্যেও পরমাত্মার ও মানবাত্মার সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান পাওয়া যায় না।
বরকতুল্লাহর জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়া অতীন্দ্রিয় অনুভূতি শক্তি অর্থাৎ স্বজ্ঞা সম্পর্কে প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক আবদুল হক লিখেছেন, “দর্শনালোচনা আরম্ভ করে তিনি কার্যত দর্শনকে বর্জন করেছেন, কেননা দর্শনের প্রধান কথা যুক্তি প্রমাণ। কোনো দর্শনই বিজ্ঞান ও তার যুক্তি প্রমাণকে উপেক্ষা করে অথবা তার বিরোধিতা করে দাঁড়াতে পারে না।”১৩ বরকতুল্লাহর নীতিচিন্তা, শিক্ষাচিন্তা এবং সমাজচিন্তায় তিনি বিজ্ঞান এবং ধর্মের সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন। সমাজচিন্তায় দেখা যায় মোহম্মদ বরকতুল্লাহ কার্ল মার্কসের সমাজতান্ত্রিক মতবাদ গ্রহণও করেন নি আবার বর্জনও করেন নি। তিনি শোষণ মুক্তির কথা বলেছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাসে আস্থাশীল ও আধ্যাত্মিক অনুভূতিসম্পন্ন মোহম্মদ বরকতুল্লাহ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বিরোধী ছিলেন না। প্রগতিবিরোধী হিসাবেও তাঁকে চিহ্নিত করা যায় না। তিনি ধর্মে বিশ্বাস করতেন আবার বিজ্ঞানের উপর আস্থাশীল ছিলেন। বিজ্ঞান এবং ধর্ম এ দুয়ের মধ্যে তিনি সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। মানুষের ধর্ম্ম, পারস্য প্রতিভা গ্রন্থে মোহম্মদ বরকতুল্লাহর দর্শন চিন্তা যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর পরবর্তী রচনায় সে ধারা অব্যাহত ছিল এমন দাবি করা যায় না। “বিশ শতকের বিশ-ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে তিনি যে মুক্তদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন এবং মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুক্তবুদ্ধি চর্চার অংশীদার হয়েছেন পঞ্চাশের দশকে এসে তা অব্যাহত থাকেনি।”১৪ কারবালা, নবীগৃহ সংবাদ, নয়াজাতি স্রষ্টা হযরত মোহাম্মদ, হযরত ওসমান, বাংলা সাহিত্যের মুসলিম ধারা মোহম্মদ বরকতুল্লাহ গ্রন্থ। এসব গ্রন্থে দর্শনচর্চা হয়েছে এমন দাবি করা যায় না। প্রথম জীবনে তিনি দর্শন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা শুরু করেছিলেন। শেষ জীবনে এসে ধর্মীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হন।
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম ধর্মাশ্রিত ভাববাদী দার্শনিক আবুল হাশিম (১৯০৫- ১৯৭৪)। তিনি ইসলাম ধর্মের উপর সম্পূর্ণরূপে আস্থাশীল ছিলেন। তাঁর জ্ঞানবিদ্যা, অধিবিদ্য এবং মূল্যবিদ্যা আলোচনায় দেখা যায় তিনি পারিবারিক ধর্ম বিশ্বাসকে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি দর্শনচর্চা করেছেন।
ইসলাম ধর্মের উপর পূর্ণ আস্থাশীল হয়েও আবুল হাশিম গৌতম বুদ্ধকে অন্যতম পয়গম্বর বলে মনে করতেন। কিন্তু তিনি মনে করতেন বুদ্ধের বাণী পরবর্তী সময়ে সঙ্কলন হওয়ার কারণে বিকৃতি ঘটেছে। আবুল হাশিম সব ধর্মের প্রবর্তককে শ্রদ্ধা করলেও তিনি মনে করেন, “ইসলাম এমন এক বিজ্ঞান যা দ্বারা মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।”১৫ ধর্মকে তিনি জীবনের খণ্ডিত প্রকাশ রূপে দেখেননি, দেখেছেন সমগ্ররূপে। “ধর্ম সব বিজ্ঞানের বিজ্ঞান। ইচ্ছা করুক আর নাই করুক, সৃষ্টির কোন কিছুই দ্বীন বা ধর্ম বা প্রকৃতির নিয়ম-কানুনের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে না।”১৬ আবুল হাশিমের মতে আল কুরআনের পর আর কোনো আসমানী কিতাব মানব জাতির জন্য আসবে না। তিনি মনে করেন,
পবিত্র কুরআনের ওহী সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিসালাতের পরিসমাপ্তি ঘটে। এতে কেউ কেউ মনে করেন যে, আসমানী নির্দেশ লাভের প্রত্যক্ষ উৎস হিসাবে ধ্বনি স্বজ্ঞা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। উন্নত জীবনের অধিকারী বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি এরূপ অভিজ্ঞতা লাভ করতে থাকবেন। তবে এটা হবে ওহী থেকে কিছুটা নিম্নস্তরের। ইসলামী পরিভাষায় একে বলা হয় ইলহাম।১৭
আবুল হাশিম জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ হিসাবে স্বজ্ঞাবাদ গ্রহণ করার আগে তিনি ইউরোপীয় দার্শনিকদের বুদ্ধিবাদ এবং অভিজ্ঞতাবাদের সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, অভিজ্ঞতার সাহায্যে সঠিক জ্ঞান পাওয়া যায় না। অভিজ্ঞতা আমাদের পূর্ণ জ্ঞান দেয় না। অভিজ্ঞতা বহিরিন্দ্রিয় নির্ভর। তাঁর মতে, “পাঁচটি বহিরিন্দ্রিয়ই প্রত্যক্ষ অনুভূতির একমাত্র উৎস নয়। বহিরিন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা স্থূল ও জড় বস্তুর আকার আকৃতি দেখি। কিন্তু স্বজ্ঞার মাধ্যমে আমরা পরিচিত হই বস্তু বা দৃশ্যের প্রকৃত বা আসল রূপের সঙ্গে। বহিরিন্দ্রিয়সমূহ আমাদের মনে সত্যের আপেক্ষিক ধারণা জন্মায়। কিন্তু স্বজ্ঞা আমাদের মনে বস্তুর পরম ও চরম স্বরূপের প্রতিফলন করে।”১৮ তিনি মনে করেন, পৃথিবীর সব আবিষ্কার স্বজ্ঞা নির্ভর। আবুল হাশিম লিখেছেন, “নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, এডিসনের বৈদ্যুতিক শক্তির ব্যবহার, শেক্সপীয়র ও কালিদাসের মহাকাব্য, ডারউইনের বির্বতনবাদ, কার্ল মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব এগুলোর কোনটিই আত্মমুখী যুক্তি ও বুদ্ধির অবদান নয়, এগুলো হচ্ছে প্রত্যক্ষ উপলব্ধির ফল।”১৯ এই উপলব্ধিই হচ্ছে স্বজ্ঞা। আবুল হাশিম মনে করেন, নিউটন সারা জীবন আপেল গাছ থেকে পড়তে দেখেছেন। তিনি হঠাৎই উপলব্ধি করেছেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণেই আপেল মাটিতে পড়ে।
আবুল হাশিমের রাষ্ট্র চিন্তায় আমরা দেখি তিনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের পক্ষে ছিলেন না। তিনি সমাজতন্ত্রকেও আদর্শ মতবাদ মনে করেননি। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে তিনি অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। আবুল হাশিম ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন। ইসলামিক রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করার আগে তিনি গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “নাসিকা গণনার রাজনীতিকে বলা হয় গণতন্ত্র।”২০ আবুল হাশিম আধুনিক ইউরোপের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে মদিনার শাসন ব্যবস্থার তুলনা করে লিখেছেন, “যা নিয়ে অতিমাত্রায় গর্ববোধ করা হয়, পশ্চিমা গণতন্ত্রের সেই সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতাকে মদিনার সে কালের মুসলিম সমাজের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সঙ্গে তুলনা করা আর তুচ্ছের সঙ্গে মহামহিমের এবং কপটতা ও কৃত্রিমতার সঙ্গে সত্যের তুলনা করা একই কথা।”২১ আবুল হাশিমের ইসলামী গণতন্ত্রে অভিজাতরা মিলে নেতা নির্বাচন করার কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলোতে এই পদ্ধতি ছিল। গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলোতে নারী এবং উৎপাদক শ্রেণীর ভোটের অধিকার ছিলো না। রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের কোনো সম্পর্কও ছিল না। সাধারণ নাগরিকেরা ছিল উৎপাদক শ্রেণি। শাসক শ্রেণি অভিজাত। আবুল হাশিম একটি উপমার সাহায্যে অভিজাততন্ত্র সমর্থনে লিখেছেন, “দুধ ঘুঁটলে উপরে সর পড়ে। এভাবে সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা সবসময়ই সমাজের শীর্ষে অবস্থান করেন। তাই যদি উদ্দেশ্য সৎ হয় তবে নেতা নির্বাচন করার জন্য কোন আনুষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রয়োজন হয় না।”২২ আবুল হাশিমের নেতা নির্বাচন করার পদ্ধতিকে জামাত-ই-ইসলামি এবং সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলের নেতা নির্বাচন করার পদ্ধতির সঙ্গে তুলনা করে আবদুল হক লিখেছেন,
জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে ঠিক নয়, ইসলামের প্রথম যুগে যে পদ্ধতিতে খলিফাবৃন্দ নির্বাচিত হতেন এবং মজলিস-ই-সুরার সহায়তায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন আল্লাহর খলিফা হিসেবে, সেই পদ্ধতিকে তিনি আদর্শ বিবেচনা করেছেন। আবুল হাশিমের এই মতবাদ জামাত-ই-ইসলামি এবং অন্যান্য ধর্মবাদী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক আদর্শের অনুরূপ বলা অসঙ্গত নয়।২৩
ধর্মাশ্রিত ভাববাদী দার্শনিক আবুল হাশিম ছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক নেতা। জ্ঞানের প্রাথমিক উৎস হিসেবে আবুল হাশিম অভিজ্ঞতার কথা স্বীকার করলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি ইন্দ্রিয় সংবেদনমূলক জ্ঞানকে বর্জন করেছেন। তিনি স্বজ্ঞাকে বুদ্ধির উপর স্থান দিয়েছেন। আবুল হাশিমের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের সাথে আল-গাযালীর জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের মিল পাওয়া যায়। আল-গাযালীর মতে, অতীন্দ্রিয় সত্তার জ্ঞান হচ্ছে উচ্চস্তরের জ্ঞান। আবুল হাশিমও অতীন্দ্রিয় সত্তার জ্ঞানকে উচ্চস্তরে স্থান দিয়েছেন। আবুল হাশিমের মতে, কুরআনের জ্ঞানই সর্বোচ্চ জ্ঞান। জ্ঞানতত্ত্বে স্বজ্ঞাবাদের সাহায্যে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণ করেছেন। তিনি রাজনীতি করেছেন অধিক সংখ্যক মানুষের সুখের জন্য। কিন্তু তিনি গণতন্ত্র পছন্দ করতেন না। গণতন্ত্রকে তিনি নাসিকা গণনার পদ্ধতি বলে উপহাস করেছিলেন।
বাংলাদেশের অন্যতম ভাববাদী দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (১৯০৬-১৯৯৯)। তিনি মনে করেন মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছে। মানুষের মধ্যে দিয়ে আল্লাহ নিজেকে প্রকাশ করেছেন। সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে স্রষ্টার প্রকাশ। আল্লাহ শুধু মানুষ সৃষ্টি করেনি এ দুনিয়া সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্রহ্মান্ডের প্রতিটি ধুলিকনা আল্লাহ্র সৃষ্টি। জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ হিসাবে তিনি স্বজ্ঞাবাদ গ্রহণ করেছেন ইসলামের একেশ্বরবাদ সমর্থন করার জন্য। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ মনে করেন বিশ্বের সব সৃষ্টির মূলে স্বজ্ঞা কাজ করে। বিজ্ঞানের আবিষ্কারকেও তিনি স্বজ্ঞাজাত বলে মনে করেন। এ-প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন,
বর্তমান কালে স্বজ্ঞা বা Intuition নিয়ে যে সব আলোচনা হচ্ছে তাতে দেখা যায় স্বজ্ঞার মাধ্যমেই এই বিশ্বের সবগুলো আবিষ্কার সম্ভবপর হয়েছে। আইনষ্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ এবং নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের নীতি পঞ্চেন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে অথবা যুক্তির প্রয়োগের ফলে আবিষ্কৃত হয়নি। একটা আপেলের পক্ষে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। আমরা তাকে বোঁটা থেকে মাটির পানে ধাবিত হতে দেখি কিন্তু তার এবংবিধ কর্মের কোন কারণ নির্ণয় করতে পারিনে। নিউটন তার স্বজ্ঞার আলোকে তাকে পৃথিবীর আকর্ষণ বলে নির্ণয় করেন। পরবর্তীকালে গণনার সাহায্যে এ-প্রকল্প আরও দৃঢ়তর হয়। তেমনি আইনষ্টাইনও স্বজ্ঞার মাধ্যমে আপেক্ষিকতাবাদের নীতি আবিষ্কার করেছিলেন।২৪
বিজ্ঞানের জ্ঞানের উপর দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সম্পূর্ণভাবে আস্থা রাখেন নি। তিনি লিখেছেন, “বিজ্ঞানের জ্ঞানই জ্ঞানের একমাত্র পথ নয়। বিচার-বুদ্ধির বাইরে, বোধির মাধ্যমে জ্ঞানলাভ সম্ভব।”২৫ জ্ঞানের সঙ্গে সত্যের সম্পর্ক রয়েছে। যা সত্য তাই জ্ঞান। আবার যে বিষয়ে জ্ঞান হয় তাই সত্য। বিজ্ঞান জড়বাদ সমর্থন করে। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ভাববাদী মুসলিম দার্শনিক। এ সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য, “জড়বাদী দর্শনে জ্ঞানের একমাত্র পদ্ধতি ভূয়োদর্শন অথবা ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান।”২৬ বিজ্ঞানের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে তিনি গ্রহণ করেননি।
নিশ্চিত জ্ঞানলাভ সম্পর্কে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, “পরম সত্তা আল্লাহ্ তাঁর প্রকাশের এক স্তরে নূর-ই-মুহম্মদী নামে যেমন প্রকাশিত, তেমনি জ্ঞানের ক্ষেত্রে পঞ্চেন্দ্রিয়জ জ্ঞানের দ্বন্দ্ব উপলব্ধি করে মানুষ যখন রাসূলে আকরাম জনাব আহমদ মুস্তফার নির্দেশিত পন্থায় সত্যিকার জ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়, তখন সে আদর্শ-মানবের জীবনধারা তার জীবনে সম্পূর্ণ রূপায়িত করেই পরম সত্তা সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়।”২৭ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের বর্ণনা দিয়ে আনিসুজ্জামান লিখেছেন,
দেওয়ান আজরফ পাশ্চাত্য ও পাশ্চ্য দর্শনের বিভিন্ন জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করে জ্ঞানতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব মতবাদ গড়ে তুলেছেন। তিনি পূর্ণ জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে এককভাবে বুদ্ধিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ, বিচারবাদ, এমনকি স্বজ্ঞাবাদ গ্রহণ করেন নি বরং ক্ষেত্রবিশেষে জ্ঞানোৎপত্তি বিষয়ক এ সবকটি মতকেই একই সাথে বিবেচনায় নিয়েছেন এবং ওয়াহীর আলোকে এগুলোকে সমন্বিত করে গ্রহণ করেছেন।২৮
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ হিসাবে স্বজ্ঞা, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা বা বিচারবাদকে একমাত্র মতবাদ হিসাবে গ্রহণ করেননি। তিনি মনে করেন এদের একটিকে গ্রহণ করলে বা একটির দিকে ঝোঁক বেশি হলে মানব সমাজের ক্ষতি হয়। তিনি মনে করেন, “জ্ঞানের ক্ষেত্রেও স্বজ্ঞা, বিচার-বুদ্ধি ও প্রয়োগের যথাযথ স্থান নির্দেশ করে তাদের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করলেই সত্যিকারের জ্ঞানলাভের সুযোগ ও সুবিধা হয়, মানুষ সত্যের সংগে পরিচয় লাভে হয় ধন্য।”২৯ প্রাশ্চাত্য প্রতিচ্যের সব জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদের সমালোচনা করে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ মনে করেন আল কোরআনের জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ। এ জন্য তাঁর স্বজ্ঞাবাদ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। বিশ্বাস এবং দর্শন এক বিষয় নয়। বিশ্বাসে যুক্তির স্থান নেই। যুক্তিকে নির্ভর করেই দর্শন। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ যুক্তি দিয়ে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন মাত্র।
জর্জ বার্কলী ধর্মীয় প্রেরণা থেকে দর্শন চর্চা করেছেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্যই তিনি জড়বাদ খণ্ডন করেছেন। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা, মোহম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল হাশিম এবং দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ যুক্তি দিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করেছেন। জর্জ বার্কলীর মত ধর্মাশ্রিত বাঙালি মুসলিম ভাববাদী দার্শনিকরাও জড়বাদ বর্জন করেছেন। বার্কলী ভাববাদী হয়েও বুদ্ধিবাদ সমর্থন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের চারজন ধর্মাশ্রিত ভাববাদী দার্শনিক ছিলেন স্বজ্ঞাবাদী। ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যই বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল এই চার ধর্মাশ্রিত ভাববাদী দার্শনিক দর্শনচর্চা করেছেন।