
বাতাসের বুদবুদে সেলাই করি অনাঘ্রাত শব্দরেণু
প্রতিকথা’র এবারের আয়োজন এ সময়ের ১২জন কবির কবিতাভাবনা। কবিতা কী, কবিতার কাঠামো ও স্বর, শব্দের নান্দনিক প্রয়োগ; কবিতার এমন নানান বৈচিত্র নিয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও চিন্তার আলোকে রচনা করেছেন তাঁরা কবিতাভাবনা। এর সাথে রয়েছে তাঁদের স্বনির্বাচিত পাঁচটি করে কবিতা। গত সপ্তাহে প্রথম পর্বে প্রকাশিত হয় ছয়জন কবির কবিতাভাবনা এবং কবিতা। এ-সপ্তাহে প্রকাশিত হল ছয়জনের।
যখন আমি আমার আবেগ এবং অনুভূতি আর কোন মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারি না, তখন আমার জন্য পড়ে থাকে কেবল কবিতার খোলা প্রান্তর। আমি যা ভাবি কিংবা বলতে চাই তারও অধিক কিছুটা রুদ্ধ-বাষ্প, নিঃসীম সুখ-স্রোত, এক আকাশ বুনোজোছনায় অথবা তুষার-জমাট বিষাদ, শব্দজালে বুনার এ এক আদিমতম স্পৃহা। আমি শব্দের অধিক কিছু তালাশ করি না আমার ভাবনায়, চিত্রকল্পের বাড়ান্ত সীমানায় শুধু রোপন করি ভাবনার নিঃশ্বাস। তাই কবিতা আমার কাছে মননশীলতার সবচে পরিণত পরিচয়, যুগান্তে। মানুষের সাথে অন্য প্রাণীদের পার্থক্য শুধুমাত্র শব্দ ব্যবহারের নিপুণতায়, কথায় বা বাক্যে; আর মানুষের ব্যবহৃত শব্দমালার সবচে শৈল্পিক প্রক্ষেপণ হল কবিতা। কবিতার এই সংজ্ঞা আমি রীতিমত হৃদয়ে লালন করি, বিশ্বাস করি এবং সেই শিহরণে কবিতা লিখি। আমি কবিতায় শব্দ ব্যবহারের পাশাপাশি চিত্রকল্প ফাদতে ভালোবাসি। আমি বিশ্বাস করি, কবিতা হল পেইন্টিং এর অনুবাদ। অনেক প্রিয় আর্টিষ্ট আমার কবিতার অনুপ্রেরণা বরাবর। এমনও হয় আমি কোন পেইন্টিং দেখেই কবিতা লিখেছি। পুরো কবিতা জুড়ে তেলরঙ আর ছোপছোপ হাহাকার। কবি’র জীবন যেমন আমাকে টানে তেমনি আর্টিষ্টের জীবন আমাকে সবসময় মুগ্ধ করেছে। অন্ধকার আর মৃত্যু আমার প্রিয় বিষয়। আমি যেন অন্ধকারে দেখতে পাই ভালো। কফিরঙা শব্দসমূহ অন্ধকারে ছড়িয়ে দু’হাত ঘণ করে চিত্রকল্প তৈরি করি। আকাশ, সমুদ্র, নক্ষত্র আর বাতাসের বুদবুদে সেলাই করি অনাঘ্রাত শব্দরেণু। আমি গদ্য লেখার বাসনা সব সময় হৃদয়ে ধারণ করি, তবুও শব্দের বিভ্রম আমাকে ঠিকই ঠেলে ফেলে কবিতার খাদে, আমি পড়ে রই এবং আওড়াতে থাকি আমার অস্তিত্বে সংবেদনশীল শব্দজটের প্রতিটি গ্রন্থি; জীবনানন্দের কৌশলে অথবা মান্নান সৈয়দের কৌতুহলে।
কামরুল বসিরের পাঁচটি কবিতা
যে জানালায় বসে ভ্যান গগ স্টারি নাইট এঁকেছিল
কেউ যখন প্রজনন অঙ্গ দিয়ে সৌজন্যতা দেখায়
আমি তখন ষ্টারি নাইট শুনি আইবাডে আর
দুটো শামুকের বিবর্তন পিরিয়ডের কেসহিষ্ট্রিতে নিমগ্ন
রই; যদিও পতাকার অন্য নাম এখানে অন্তর্বাস।
কিম্ভূত অগ্নি দাহ করে আমাজান—ব্রাত্যের লাশ ঠ্যালে
গুজব-মহাপতি, কাস্মিরের বিভিন্ন ধারা নিয়ে কথা বলেন মহান্তগণ;
যে সর্বনাশের উর্দিতে স্বস্তিকা ছিল সেখানে চকচকে
তে’তলা আরাধনা প্রাসাদ, যে ভূখন্ডে অহিংসতা ছিল
সেখানে নেমেছে বেয়ানট রুধির—
মানুষ বর্গা দেয় মানুষের শ্রেনী, উজাড় উৎপ্রেক্ষার বায়ূকলে।
একজন কালাযাদুগরের মতো নিজের ভবিষ্যতে জ্বেলেছি
সালফারের মৃদাঙ্গ ত্রিভূজ, রাষ্ট্র বিক্রি করছে
তামাটে শিশুখাদ্য, নিছক যে বালুকাবেলায় জলপরী
খেলা করতো, সেখানে গ্যাসিও নোঙর—
মানুষ যেন মানুষের চিরশত্রু হয়ে মানুষ করছে বধ
নির্দয় পাশবিকতা বুকে নিয়ে ঘুরছে দাম্ভিক শ্বাপদ—
স্বপ্নে পাওয়া কবিতা-১
কয়েকটি হাঁস জোছনায়, ম্যানর পার্কের হ্রদে সাঁতার কাটে, রুপার মতো চাঁদের আলো তাদের শাদা আর বাদামী পালক ছুয়ে গেলে—দূরতম ম্যাপল গাছটি ভাবে, এখন জোছনা আর হেমন্তের শেষপাতাঝরা একত্রে বিষাদ পুষে এনেছে; অথচ সবাই সঙ্গত একা।
গাছটি একা, চাঁদ একা, জোছনা একা, হাঁসেরা পৃথক পৃথক একা; এমনকি যে ঘাসের উপর আমি বসে তার সবুজ আর শিশির ক্রমন্বয়ে একা—
একটি শাদা হাঁস হঠাৎ বিছিন্ন হয়ে হ্রদের মধ্যখানে তাদের নিবাসে ফিরে যায়, আমার বন্ধু যেমন একটু আগে আমাকে পাগল ভেবে একা একা বাড়ী ফিরে গেল, শুধু গুটিকয়েক শীতের বাতাস রেখে। আমি শাদা হাসটিকে আমার ফিরে যাওয়া বন্ধু ভেবে নিই—আমি জোছনাকে হেমন্ত ভেবে আবারও নিবন্ধিত হই আলো অন্ধকারের খেলায়।
হঠাৎ ম্যাপল গাছটি থেকে একটি পাখি ডেকে উঠে, আমি যেহেতু পাখিবিশারদ নই তাই অন্যসব পাখির আওয়াজ থেকে এই ক্রমব্যাথাতুর শব্দকে আলাদা করতে পারি না। আমি শুধু চিনি অস্কার ওয়াইন্ডের সেই বুলবুলিপাখিটিকে তাই এই শব্দটিও তার গান ভেবে কিছুটা মনোযোগ পাঠিয়ে দিই আবছা অন্ধকারের ম্যাপল শাখায়!
দৃষ্টি আর মনোযোগ পাঠানোর পর আমি অতঃপর একা হয়ে যাই পুনর্বার—হয়তো এভাবেই মানুষ আর প্রকৃতি পরস্পর সম্পর্ক করে অনাদিকাল; হয়ত নির্জনতার যে হলকা সেখানে একটি হাঁস আর একটি বুলবুলির ডেকে উঠা জোছনার বন্দনাও হতে পারে।
দূরের পাবে একটা মদ্যপ হল্লা। একাকিত্বের ভয়ে একা মানুষেরা সমগোত্রীয় মানুষের গ্লাসে গ্লানি ঢালছে। সবাই পরস্পরেকে বুঝিয়ে চলেছে আমি তোমার সামাজিক পরিক্রমায় একটা দীর্ঘ আক্ষেপ।
রাত বেড়ে চলে, বুলবুলিটির গান অস্পষ্ট হয়ে আসে। জোছনা ফিকে হতে হতে ঢলে পড়ে অস্তাচলে—শাদা হাঁসেরা আর বাদামী হাসেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে হ্রদের মাঝখানের ঝোপে চলে যায়।
আমি শুধু কিছুটা শীতের বাতাস পকেটে পুরে জ্যাকেটের জিপার লাগিয়ে উঠে দাঁড়াই, আমাকে যেতে হবে সামাজিক মানুষজীবনে!!
নগ্ন সত্যিদর্শন : স্মৃতি কখনও পরিমাপ জানে না!
বারবার ফিরে আসা কনজারভেটিভের পেজ আমাকে লাইক দিতে বলে
অথচ আমি তো মানুষের খুব কাছাকাছি—
যে সৈকতে নগ্নতা বৈধ সেখানে চক্ষু ফেলে এসে
কোমরের দড়ি বাঁধি সযত্নে;
সাদা চামড়ার ঘ্রাণ আর ম্যাপলের বার্নিশ উড়ে যায় দূর সমুদ্রে
তখনও আমি উবু হওয়া তরুণী নিতম্বে হালকার বালুকার
ঝাপটা-ঝাপটি দেখি আর এক এক করে এড়িয়ে যাই
অহেতুক রিকোয়েস্টগুলি;
কোথায় কোন পাহাড়ের আড়ালে সম্ভ্রম হারিয়ে ছিল এক আইরিশ তরুণী
কোথায় কোন বাতাসে প্রথম শীৎকার ছিল মোহবিদ্ধ এক টলটলে আঠারোর
কোথায় কোন নিঃশ্বাস এখনও বিষঘাম—
আমি এসব নাগরিক কাগজে পড়ি, চ্যানেল ঘুরিয়ে দেখি আর
সনাক্ত করি, বেঁচে থাকার প্রলোভন কতটা চাকচিক্যের হতে পারে!
মাঝে মাঝে ঘুমের মত রাত নামে
মাঝে মাঝে রাতের মত ঘুম নামে দুচোখে
মাঝে মাঝে অহেতুক মন কেঁদে উঠে নিছক বাতিল স্মৃতিতে—
পূব দেশীয় এক জলপাই রঙের কন্যা, যাকে অপুষ্টির কারণে বালিকা ভ্রম হতো
তাকে কতবার বলেছিলাম তোমার নোয়ানো সবুজ আমাকে দেখাও
কুন্তলপাশ ভেঙে পড়ে যে অঞ্চলে সেখানে আমার আদর নাও একটু ক্ষণ
তাঁতের বারো হাত শাড়ির মধ্যম প্যাচে আমাকে আমরণ বেঁধে রাখো—
জোড়া ভ্রুর কিছুটা ধনুকে মেলতে দাও আমার পৌরুষ;
সে নারী আমাকে তার লজ্জার তোরাণ পেরুতে দেইনি
সে নারী জানতো না, সুখের মোহময় বৈচিত্র্য আর সৌন্দর্যর পুরকাহণ
আমাকে অভুক্ত রেখে সেও ছিল উপবাসী—
আমি শুধু তার ঝলসে যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখেছিলাম!
আজ, কনজারভেটিভের পেজটা আমাকে সেই মুখ মনে করিয়ে দিল;
আজ সমুদ্রপাড়ের নগ্নতা মনে করিয়ে দিল—ভোগ শুধুই সময়ের বিলাস
সত্যিকারের ভালোবাসা অসীম কোন আক্ষেপ
যার জন্য সারাজীবন তৃষা বয়ে বেড়ানো যায়।
বিবেক, তুমি কি সহমরনের এ্যাটোমিক পিরানহা!
ডেইলি সানের ভিডিও পেজে আজ পুড়ে যাওয়া একটি
কোয়েলাকে উদ্ধারে একজন অষ্ট্রেলিয়ান নারীর
তৎপরতা দেখছিলাম। ধূয়া আর ধূমের মধ্যে থেকে
মিডিয়ার বাহারী ক্যামেরাগ্রাফির কূয়াশায় তার এই
মহত্ত্ব পৃথিবীব্যাপি বাহবা’র জৌলুসে ঘৃতাহুতি দিচ্ছিল, সময়ব্যাপি—
আহা! কতটা দরদ আর প্রাণীপ্রেমের দূরন্ত আয়োজন!
মানুষের বিবেকের এ এক সুপ্ত অভিকর্ষ—
সুসভ্য বৈভবের মধ্যকার অমিয় বৃত্তান্ত;
অথচ, বহুদিন ধরে আমার চোখ পুড়ে যাচ্ছে মানুষের চামড়ার লেলিহানে—
আমার ঘ্রাণশক্তিকে উপেক্ষা করে বারুদ আর বুলেটে
নেমে আসছে মানুষ পোড়ার জান্তব দহন—
বিবেক মহাজন তালাবদ্ধ হয়ে হাতড়াচ্ছে ব্যাকুল হয়ে
বিলুপ্ত প্রহেলিকা!
তাহলে কি শুধু জমানো রসদের বিনিময় আমরা চাইছি সমগোত্রীয় সমকাম!
বিপন্ন মানুষেরা আর নয় কোন প্রথাগত প্রাণদ;
তাদের বিস্ফোরিত পুজ হাডসন নদীতে ধুয়ে আমরা
মাখছি সভ্যতার পারফিউম!
তোমাকে প্রশ্ন বিবেক, তোমাকে আমি শুধু মাংসপিন্ড
না ভেবে ভাবছি প্রভেদের নিক্তি আর সহমরনের
এ্যাটোমিক পিরানহা!
আমি জানি এ প্রশ্নে ঘুমন্ত তুমি এবং তোমার সারথীবর্গ
নিরবতা ভালো থাকার আশ্চর্য ভাগফল ভেবে
আবারও চোখ বুলাবে ডেইলি সানের মানবিক পর্দায়—
অথচ অজস্র ঘৃণা নিয়ে আফ্রিকা আর মধ্য এশিয়া মেতে থাকবে তোমাদের
সৃষ্ট প্রথাগত যুদ্ধবিহারে—
যারা তোমাদের সমগোত্রীয় নয়।
সুখী যুবরাজের চোখ
যেখানে নিঃস্প্রভ একাদশী বর্তুল
রেডলাইনে হেটে বেড়ানো হলুদমুখি গিনিপিগ, আর
পকেট ফুটো করে শুধু বিয়োগ হওয়া ঈষৎ পেনিমুদ্রা—
সেখানে চককাটা হাওয়াই শার্টের বোতাম খুলে মধ্যবয়সী যে কবি
পুরোদস্তুর আসমানে তাকিয়ে,
তার বিষন্নতা কতটা বদলাতে পারে পারিপার্শ্বিক!
আমি এ প্রশ্ন করেছিলাম সেই ভুলে যাওয়া সুখী যুবরাজকে একবার;
আমি তাকে গল্পের ছলে বলেছিলাম,
তোমার নিলকান্তমণি চোখজোড়া যে রাত্রীতে ম্যাগপাইটি খুলে নিল,
সে রাতেও তুমি সুখী হয়েছিলে কি-না!
যুবরাজ আমাকে নরওয়েজিয়ান রুপকথার একটা স্থুল বর্ণনা শেষে শুধু বলেছিল,
মানুষের সুখে শোক ঢেকে যায় নিয়ত।
কারো দীর্ঘশ্বাস কতটা ঘণ তার উপর তার যাপনের পরিমিতিবোধ;
কেউ কেউ অপেক্ষা করে বন্ধুর, কারো কাছে দুঃখ শুধুই
পোড়া হৃদয়ের জান্তব বিভৎসতা—
একে একে নামফলকের মদ ফুরিয়ে ‘বারবার’ জ্যাকেটের তামাটে
স্ন্যাপবাটনের মতো ম্লান হয় পরিণত বিভেদ;
ক্রমে ক্রমে একাদশী মিলিয়ে যায় নিকশ শেষরাতে,
ম্যাগপাইটি অসহ্য তুষারপাতে পরিত্যাগ করে নিজস্ব খোলস;
যুবরাজ অন্ধ হয়ে কবি’র কন্দরে ঢুকে ছিনিয়ে নেয় শতরন্জীর সবকটা রঙ—
প্রাণের তরে এই প্রেমময় উপাখ্যানে আনত হয় যাবতীয় উষ্ণিষ।
আমার মনে পড়ে কোন এক সন্ধ্যায় যে প্রাচ্যদেশীয় বালিকাযুগলকে
আমি শুনিয়েছিলাম মহৎ এ হৃদয়বৃত্তান্ত আর
তাদের চকচকে মুক্তো দানার মতো অশ্রুবিন্দু
আমার পরিতোষক হিসাবে রেখেছিলাম সংরক্ষিত নষ্টাজিয়ায়—
তার কোনো এক সৎকার, এই প্রান্ত মহাদেশে আজ হয়ে গেল নিভৃতে আরেকবার।