
বাণিজ্য ও জ্ঞানচর্চা
চিন্তার ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় কোনো স্থানে বাণিজ্যের প্রসারের পর জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে। বাণিজ্যের উন্নতির জন্যে জ্ঞানের প্রয়োজন। জ্ঞান ছাড়া বাণিজ্যের প্রসার ঘটে না। বাণিজ্যে সমৃদ্ধ নগরীতে জ্ঞান-বিজ্ঞান উন্নত ছিলো। বাণিজ্য নগরীতে বহু মানুষের আগমন ঘটে বহু উদ্দেশ্যে। ফলে এক অঞ্চলের মানুষের সাথে অন্য অঞ্চলের ভাব আদানপ্রদান হয়। পুরাতন চিন্তার সাথে নতুন চিন্তার যোগ ঘটে, মানুষ নতুন করে ভাবতে শিখে। নতুন নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয়।
৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এশিয়া মাইনরে ছিলো সমৃদ্ধ বাণিজ্য নগরী। ভূমির মালিকদের হাতে এশিয়া মাইনরের ক্ষমতা থাকলেও পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ীদের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। এ সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এশিয়া মাইনরে সমৃদ্ধি অর্জন করে। মিশরের সাথে এশিয়া মাইনরের সুসম্পর্ক ছিলো। এশিয়া মাইনরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে মিশরের ভূমিকা স্মরণীয়। পৃথিবীর অনত্যম চিন্তাবিদ, দর্শন এবং পদার্থ বিজ্ঞানের জনক থ্যালিসের (৬২৪-৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে) জন্ম এশিয়া মাইনরের বাণিজ্যে সমৃদ্ধ নগরী মাইলেটাসে। থ্যালিস ভারতবর্ষের গৌতম বুদ্ধ, অজিত কেশকম্বল, পকুধ কচ্চায়, সঞ্জয় বেলঠি এদের সমসাময়িক। অজিত কেশকম্বল জড়বাদী দার্শনিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
এশিয়া মাইনরের ছোট দ্বীপ আইওনিয়া। আইওনিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলো। থ্যালিস, এ্যানাক্সিমেনডার, এ্যানাক্সিমিনিস এশিয়া মাইনরের আইওনিয়া দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তাদের দর্শনকে একত্রে আওয়ানিয়ান দর্শন বলা হয়।
ইউরোপীয় দর্শনে থ্যালিসই প্রথম পদার্থকে অবলম্বন করে বিশ্ব সৃষ্টি, উৎপত্তি ও পরিণতি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। অতিপ্রাকৃতিক আসমানী শক্তির উপর নির্ভর না করে তিনি বলেছিলেন পানি থেকে সবকিছুর উৎপত্তি আবার পানিতেই সবকিছু বিলীন হয়ে যায়। তিনি জ্যোর্তিবিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। গণিত এবং জ্যামিতির জ্ঞান তিনি মিশর থেকে পেয়েছিলেন। এ্যানাক্সিমেন্ডার এবং এ্যানাক্সিমিনিস জগতের আদি উপদানের সন্ধান করেছেন। আইওনিয়ান দার্শনিকদের আগেই ভারতীয়রা বলেছিলেন- আগুন, পানি, বায়ু ও মাটির সাহায্যে বিশ্বের সবকিছু সৃষ্টি হয় আবার সবকিছু বিলীনও হয়।
নীল, টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মিশর এবং মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিলো। সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো নদীকে কেন্দ্র করে। ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মিশরীয়রা লিখতে শুরু করে। ব্যাবিলনে প্রায় একই সময়ে লিখনপদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। হরপ্পা এবং মহেনজোদারো ছিলো নগরকেন্দ্রিক বাণিজ্য কেন্দ্র। কোনো স্থানে আসমানী শক্তির সাহায্যে জ্ঞানের বিকাশ ঘটেনি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের পূর্বে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং উন্নত জীবনপদ্ধতি শুরু হয়েছে। গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের পেছনের ছিলো ব্যবসা-বাণিজ্য। গ্রিসের নগরগুলো ছিলো সমুদ্রতীরবর্তী। এশিয়া মাইনর, সিসিলি এবং ইতালির সমুদ্রতীরবর্তী নগরগুলো ছিলো সমৃদ্ধ। অর্থ-বিত্তে, শক্তিতে প্রভাবশালী হওয়ায় চিন্তার জগতে গ্রিকরা অনন্য অবদান রাখে। গণিতবিদ পিথাগোরাস, হেরাক্লিটাস, জেনো, পারমানাইডিস, এম্পিডক্লিস, ডেমোক্রিটাস, লিউসিপাস, প্রোটাগোসার, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটলের মতো বিশ্বখ্যাত দার্শনিক-চিন্তাবিদের জন্ম হয়েছিলো। প্লেটোর ‘একাডেমিয়া’ বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ধরা হয়। আধুনিককালে বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বোঝায় প্লেটোর একাডেমি সে অর্থেই বিশ্ববিদ্যালয়। অ্যারিস্টটল প্লেটোর একাডেমির ছাত্র ছিলেন। প্লেটোর একাডেমিতে গণিত, শরীরচর্চা এবং সঙ্গীত বাধ্যতামূলক ছিলো। প্লেটোর মৃত্যুর পর অ্যারিস্টটল প্রতিষ্ঠা করেন লাইসিয়াম।
গ্রিসের নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এথেন্স এবং স্পার্টার অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিলো কৃষি, কুটিরশিল্প, খনিজ পদার্থ এবং সামুদ্রিক বাণিজ্য। অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি ছিলো যুদ্ধে পরাজিত বন্দিদের দাস হিসেবে নিয়ে এসে উৎপাদন কাজে সম্পৃক্ত করা এবং সামুদ্রিক বাণিজ্যপোতের উপর আক্রমণ ও লুণ্ঠন। প্লেটোর সময়ে এথেন্সের সাড়ে চার লক্ষ নাগরিকের মধ্যে আড়াই লক্ষ ছিলো দাস। দাসদের কোনো নাগরিক অধিকার ছিলো না। নারী ছিলো সবদিক থেকে বঞ্চিত। দাস শ্রম এবং লুটপাটের সম্পদের উপর গ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো।
ইউরোপের মধ্যযুগে জ্ঞানের বাতি টিমটিম করে জ্বলছিলো চার্চ নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থায়। নিয়ন্ত্রিত পথে জ্ঞানের চর্চা হয় না। মধ্যযুগে জ্ঞানের চর্চা হয়েছে চার্চের নির্দেশিত পথে। চার্চের নির্দেশ অমান্যকারীর জন্য ছিলো চরম দণ্ড। হত্যা নির্যাতন কোনো কিছুই বাদ ছিলো না। ১২৩৩ সালে পোপ নবম গ্রোগোরি (১২২৭-১২৪১) ধর্মবিচারসভা (Inquisition) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই ধর্মসভা পৃথিবীর বহু সূর্যসন্তানকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। ইতালীর তুলুজে লুচিলিও ভালিনিকে নাস্তিকতার অভিযোগ এনে প্রথমে তাঁর জিহ্বা ছিড়ে ফেলা হয়েছিল, পরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় ১৬১৯ সালে। স্বাধীন মতপ্রকাশের দায়ে দক্ষিণ ইতালির নোলা নগরের বাসিন্দা ব্রুনোকে (১৫৪৮-১৬০০) আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। কবি মার্লোর (১৫৬৪-১৫৯৩) বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল। কবি, নাট্যকার, বিজ্ঞানীসহ অসংখ্য স্বাধীন চিন্তাবিদ ধর্মবিচারসভার (Inquisition) তথাকথিত বিচারে অভিযুক্ত হয়েছেন। ১৬৩৩ সালে গ্যালিলিওকে স্বাধীন মতপ্রকাশের দায়ে দণ্ডিত করেছিল। গ্যালিলিও তাঁর আবিষ্কারকে অমূলক বলে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে দণ্ড থেকে রক্ষা পান এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে তিনি আর কখনো এই মত ব্যক্ত করবেন না যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। গণিতবিদ হাইপেসিয়ার করুণ মৃত্যুদণ্ড মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো।
১২০৪ সালে ক্রুসেডাররা কনস্টান্টিনোপোল দখল করার পর অ্যারিস্টটলের গ্রিক ভাষায় লেখা গ্রন্থগুলো ইউরোপে নেয়া হয় এবং সেন্ট টমাসের পর্যবেক্ষণে এগুলো ল্যাটিনে অনুবাদ করা হয়। এর দুই শতাব্দী পরে তুর্কীরা আবার কনস্টান্টিনোপোলের দিকে অগ্রসর হলে গ্রিক পণ্ডিতগণ ইতালিতে আশ্রয় নেন এবং ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। গ্রিক সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের অনেক মৌলিক গ্রন্থ আরবের পণ্ডিতগণ অনুবাদ ও সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। মুসলমানদের সাহায্যে ভারতীয় সংখ্যা, শূন্য, দশমিক ও ঋণাত্মক সংখ্যার ব্যবহার ইউরোপীয়দের কাছে পৌঁছে। ফলে ইউরোপীয়দের কাছে জ্ঞানের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। অর্থাৎ প্রাচীন সভ্যতার জ্ঞানভাণ্ডার রেনেসাঁসের প্রাণ। গ্রিক ক্লাসিক্যাল গ্রন্থগুলো আরবিতে অনূদিত হয়েছিল। এগুলো পরবর্তী সময়ে ল্যাটিনে অনূদিত হয়। আরবি এবং ল্যাটিন জানা ইহুদি পণ্ডিতগণও অনুবাদকর্মে সহযোগিতা করেছিলেন। এ-সময় গ্রিক ভাষায় দক্ষতা অর্জনের প্রবণতাও দেখা দিয়েছিল।
আরবি ভাষা থেকে অনূদিত গ্রিক লজিক ও দর্শনকে কেন্দ্র করে প্রধানত স্কলাস্টিক দর্শনের শুরু। নবম শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত স্কলাস্টিসিজমের ব্যাপ্তিকাল হিসাবে ধরা হয়। স্কলাস্টিসিজমে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির উপর নির্ভরতা ছিল বেশি। আসমানী বিশ্বাসের কাছে মানুষের যুক্তি-বুদ্ধি ছিল নস্যি।
সমুদ্রকেন্দ্রিক বাণিজ্যের ফলে নতুন নতুন ভৌগোলিক আবিষ্কার মানুষকে নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত করে। জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ভূগোল সম্পর্কে মানুষ আধুনিক পদ্ধতিতে জ্ঞান লাভ করে। এই জ্ঞানের উপর নির্ভর করে নতুন বাণিজ্য উপনিবেশ স্থাপনের লক্ষ্যে স্পেনের রাজা আর রাণী ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে তিনটি জাহাজ ও নগদ অর্থ দিয়ে ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে সমুদ্রপথে ভারতবর্ষে আসার সহজ পথ আবিষ্কারের নির্দেশ দেন। কলম্বাস ভারতে আসতে গিয়ে বাহামা দ্বীপে পৌঁছেন। কলম্বাসের খুঁজে পাওয়া দেশের নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তিনি দেশ খুঁজতে এসে পেয়েছেন মহাদেশ। এর পাঁচ বছর পর পর্তুগালের রাজা ভাস্কো-দা-গামাকে সমুদ্রপথে ভারতে আসার সহজ পথ আবিষ্কারের নির্দেশ দেন। ভাস্কো-দা-গামা ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে চারটি জাহাজ ও তিনজন দোভাষী নিয়ে লিসবন থেকে যাত্রা শুরু করে ২৩ দিন পর ভারতের পশ্চিম উপকূলে পৌঁছেছিলেন। ইউরোপ-আমেরিকা তখন বিশ্বে বাণিজ্য করছে। বাণিজ্যের সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানও হয়েছে। নতুনকে জানার আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। ভৌগোলিক আবিষ্কার এবং নতুনকে জানার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে দিয়ে রেনেসাঁসের সূচনা হয়। ইতালির ফ্লোরেন্স নগরে রেনেসাঁসের যাত্রা শুরু হলেও এই আন্দোলন ইউরোপে ছড়িয়ে যায় পনের ও ষোল শতকে। সামন্ততন্ত্র থেকে এ-সময় ইউরোপে ধনতন্ত্রের বিকাশ শুরু হয়।
ধনতন্ত্রের বিকাশের সাথে রেনেসাঁ সম্পর্কিত। রেনেসাঁস কোন জনপ্রিয় আন্দোলন ছিল না। স্বল্পসংখ্যক পণ্ডিত এবং শিল্পীদের নিয়ে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। কিছু উদার পৃষ্ঠপোষক, বিশেষ করে মেডিসি এবং মানবতাবাদী পোপের উৎসাহে তাঁরা এই আন্দোলন শুরু করেন। ইউরোপের সব দেশে একই সময়ে রেনেসাঁস হয়নি। ধনতন্ত্রের বিকাশও ইউরোপের সব দেশে একই সময়ে হয়নি। প্রথম ফ্রান্সিসের পৃষ্ঠপোষকতায় ফ্রান্সে রেনেসাঁসের শুরু হয়। ইংল্যান্ডের রেনেসাঁ সপ্তম হেনরি ও হাম্পারের সমর্থন পায়। ক্যাথলিক ধর্মের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও স্পেনে রেনেসাঁসের বিকাশ ঘটে।
রেনেসাঁস ফরাসি শব্দ। এর অর্থ পুনর্জাগরণ বা পুনরুজ্জীবন। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত অভিধানে রেনেসাঁ সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৪, ১৫, ১৬ শতকের ইউরোপে প্রাচীন গ্রিক জ্ঞানবিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে সাহিত্য, চিত্রকলা ইত্যাদির পুনরুজ্জীবন; পুনর্জন্ম। রেনেসাঁ সম্পর্কে বাংলা একাডেমি প্রণীত অর্থ Oxford Advanced Learner’s Dictionary of Current English – এ সমর্থন পাওয়া যায়। বাংলা একাডেমির সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধানে রেনেসাঁ সম্পর্কে লেখা হয়েছে, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উন্নীত হয়েছে এমন অবস্থা। রেনেসাঁর সঙ্গে আধুনিকতার সম্পর্ক নিবিড়। বার্ট্রান্ড রাসেল রেনেসাঁর সংজ্ঞা দিয়ে লিখেছেন, “আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইতালিতে যে আন্দোলন শুরু হয় তাকে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ নামে অভিহিত করা হয়।” রেনেসাঁর ফলে মানুষ স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখে। জর্জো ভাসারি-ই নবজাগরণ বা নবজন্ম ঘটানো সৃষ্টিসম্ভব মনস্বীতা অর্থে ‘রেনেসাঁস’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মানবপ্রেম ও ইহজাগতিকতা। প্রাচীন গ্রীক সাহিত্য ও দর্শনের অন্যতম ভিত্তি ছিল ইহজাগতিকতা।
রেনেসাঁসের ফলে গ্রিক ও রোমান মহাকাব্য, নাটক, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা ইউরোপীয় চিন্তা-চেতনায় নতুন প্রণোদনার সৃষ্টি করে। মর্ত্যের মানুষ প্রকৃতিকে অনুসরণ-অনুরণন করে নতুন নতুন সৃষ্টি করতে পারে। এই আত্মপ্রত্যয় থেকে বতিচেল্লির ভেনাসে, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসায়, রাফায়েলের লেডায়, মাইকেলএঞ্জেলোর এ্যাপোলো ও ডেভিডে, দান্তের বিয়াত্রিচে ও পোত্রার্কের লারায় অমরাবতীর সৌন্দর্যের প্রতিফলন দেখা যায়। প্রকৃতি ও মানুষ এখানে মুখ্য।
ইতালীর ফ্লোরেন্স শহর থেকে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের শুরু। ফোরেন্স ছিল শিল্প, সাহিত্য এবং চারুকলা চর্চার প্রধান কেন্দ্র। তের শতকেই ইতালির ফ্লোরেন্স নগরীতে অভিজাতশ্রেণী, ধনী-বণিক শ্রেণী এবং নিম্ন শ্রেণী বিদ্যমান ছিল। ফ্লোরেন্সের রেনেসাঁসের সময় সেখানে ধনতন্ত্র বিদ্যমান। ইতালির মিলান, ভেনিস, ফ্লোরেন্স, পাপাল ডোমেইন (পোপ-রাজ্য) এবং নেপলস নামে বড় পাঁচটি শহর ছিল। এছাড়াও ছিল বেশ কিছু ছোট ছোট শহর। বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবেই শহরগুলোর গুরুত্ব ছিল, বিশেষ করে নৌবাণিজ্যে। বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে ইতালিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ দ্রুত হয়।
ইউরোপের আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা রেনেসাঁকে ত্বরান্বিত করে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা মানুষের জীবন-যাত্রা সহজ করে। বিজ্ঞানের প্রভাবে মানুষের নানামুখী প্রশ্নের উত্তর শুধু প্রাচীন ধর্মনির্ভর দর্শন ও সাহিত্যনির্ভর জ্ঞান থেকে পাওয়া যায় না। বেকন, গ্যালিলিও, কোপারনিকাস, কেপলার, ব্রুনো, নিউটন মানুষের বিচিত্র সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। নতুন নতুন জ্ঞানের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষ অথরিটির পরিবর্তে প্রকৃতিনির্ভর জ্ঞানের উপর নির্ভর করেছে।
ব্যবহারিক বিজ্ঞানের গুরুত্ব বাড়ায় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) চিত্রশিল্পী হিসাবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, স্থপতি, শরীর বিজ্ঞানী এবং ভূতত্ত্ববিদ। ব্যবহারিক বিজ্ঞানে তাঁর অবদান অনেক। টলেমির মতবাদ অস্বীকার করে স্বাধীন মতপ্রকাশ করেন কোপারনিকাস (১৪৭৪-১৫৪৩)। কোপারনিকাস ও টলেমির মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন টাইকো ব্রাহে (১৫৪৬-১৬০১)। লিওনার্দো এবং গ্যালিলিও কামান এবং দুর্গ নির্মাণের কলাকৌশল উন্নতি করতে সক্ষম হওয়ায় তাঁদের সরকারি চাকরি হয়েছিল। কোপারনিকাস, কেপলার ও গ্যালিলিও-এর মতবাদ পূর্ণতা পায় আইজ্যাক নিউটনের (১৬৪২-১৭২৭) আবিষ্কারের মধ্যে। নিউটন মনে করতেন- বিশ্বপ্রকৃতিতে সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে, প্রকৃতি-প্রপঞ্চ খামখেয়ালি নয়, তাদের পরস্পরের সম্পর্কে রয়েছে গভীর যোগসূত্র ও শৃঙ্খলা। রেনেসাঁসের অন্যতম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হলেন নিকোলো মেকিয়াভেলি (১৪৬৭-১৫২৭)। হবস (১৫৮৮-১৬৭৯), লক (১৬৩২-১৭০৪), রুশোর (১৭১২-৭৮) রাষ্ট্রচিন্তা মানুষকে নতুনভাবে চিন্তা করতে প্রণোদিত করে।
রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে দর্শনের ইতিহাসে রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০) প্রথম পদার্থ বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দর্শন রচনা করেছেন। জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত দেকার্তের প্রথম গ্রন্থ ট্রিটিজ-অন-দ্য-ওয়ার্ল্ড। গ্যালিলিওর জীবনের চরম পরিণতি দেখে দেকার্ত এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেননি। শিক্ষাজীবন শেষে দেকার্ত সৈনিক হিসাবে চাকরি করেছেন কিছু সময়। ক্যাথলিক সেনাবাহিনীতেও তিনি যোগদান করেছিলেন। তিনি সবকিছু নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। এমনকি নিজের অস্তিত্ব নিয়েও দেকার্তের সংশয় ছিল। সংশয়কে তিনি পদ্ধতি হিসাবে নিয়ে নিশ্চিত সত্যে পৌঁছাতে চান। ব্রুনোর natura naturans এবং natura naturata পরবর্তী সময়ে একই অর্থে স্পিনোজা ব্যবহার করেছেন। লাইবনিজের মনাডতত্ত্বে এই শব্দ দুটির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। দেকার্ত, স্পিনোজা, লাইবনিজকে যুক্তিবাদী দার্শনিক হিসাবে অভিহিত করা যায়। এঁরা সবাই যুক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা মনে করতেন ঈশ্বরের মত মানুষও যুক্তি বা শুদ্ধ চৈতন্যের অধিকারী।
ইউরোপের রেনেসাঁসের চারশত বৎসর পর বাংলার রেনেসাঁ। ইউরোপের রেনেসাঁ শুরু হয়েছিল নৌবাণিজ্য নগরী ইতালি থেকে। বাংলার রেনেসাঁসের শুরু কলকাতা থেকে। ইউরোপের রেনেসাঁস ছিল গ্রিক, রোমান সভ্যতা সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ধনতন্ত্রের বিকাশের ফল। বাংলার রেনেসাঁস হল ইউরোপের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং কলকাতায় ধনতান্ত্রিক জীবনের সূচনালগ্নে। সুশোভন সরকার বাংলার রেনেসাঁস সম্পর্কে লিখেছেন, “ব্রিটিশ শাসন, বুর্জোয়া অর্থনীতি এবং আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব প্রথম অনুভূত হয় বাংলাতেই। এই প্রভাবের ফলে বাংলায় এক নবজাগরণের সূচনা হয়, যা বাংলার রেনেসাঁস নামে পরিচিত।” বাংলার রেনেসাঁস ইউরোপের অনুকরণ নয়। বাংলার রেনেসাঁসের আগে ইউরোপে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট ভাগ হয়েছে। ফরাসি বিপ্লব হয়েছে। আমেরিকা স্বাধীনতা লাভ করেছে। চার্চের ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বেড়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা সারা বিশ্বে সমুদ্রপথে বাণিজ্য করছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছে। ব্যবহারিক বিজ্ঞান মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করেছে। ফলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছে। এ অবস্থায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসার এবং ইংরেজদের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শ এবং সহযোগিতা ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় রেনেসাঁসের শুরু হয়। অগাস্ট কোঁতে, বেনথাম, জন স্টুয়ার্ট মিল, রুশো, ভলতেয়ার, হবস্, লক, এডাম স্মিথ বঙ্গীয় রেনেসাঁর প্রেরণা ছিল।
বাংলার রেনেসাঁসের আগে ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন ছিল। মোঘল যুগের শেষে ভারতে তখন গড়ে উঠেছিল সামন্ততান্ত্রিক অচলায়ন- যা জীবনের মুক্ত স্রোত অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, ঝাড়-ফুঁক, মন্ত্র-তন্ত্রের অর্থহীন বাঁধনে গড়ে উঠেছিল এক অনড়, অচল, রুদ্ধস্রোত জীবনযাত্রা। বংলায় তখন নবাবি শাসন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে শাসকের কোনো সম্পর্ক ছিল না। জমিদার এবং জায়গিরদারদের সীমাহীন অত্যাচারে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা রুদ্ধ হয়ে আসে। রাজসভা ছিল বিলাসে এবং আত্মকলহে লিপ্ত। এই সময়েই বাণিজ্য উপলক্ষে ইংরেজদের ভারতবর্ষে আগমন ঘটে। ১৭৬৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লীর সম্রাট শাহ্ আলমের নিকট থেকে বাংলা, বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানী সনদ লাভ করে। ইউরোপে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। সমুদ্র নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা-বাণিজ্য তাদের দখলে। সমুদ্রপথেই ইংরেজরা ভারতবর্ষে বাণিজ্য করতে আসে। পর্তুগিজ, ফরাসি ও ইয়াংকিরা বাংলায় বাণিজ্য করেছে।
সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং পলাশীর মাঠে যুদ্ধ না হলেও বাংলার শাসনভার ইংরেজদের হাতে চলে যেত বলে আহমদ শরীফ মনে করেন। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,
“মীরজাফর-জগৎশেঠ-রাজবল্লভ ষড়যন্ত্র না করলেও, পলাশীতে যুদ্ধ না হলেও, ইউরোপীয় যে-কোন কোম্পানি ভারত দখল করতই। তার প্রমাণ, অনুরূপ ষড়যন্ত্রের সুযোগ না পেয়েও একশ’ বছরের মধ্যে বিশাল ভারতবর্ষ এক রকম বিনা যুদ্ধেই ইংরেজের পদানত হয়েছিল। এ সূত্রে গোয়া, দমন, দিউ, কারিকল, মাহে, পণ্ডীচেরী, চন্দননগর প্রভৃতি এলাকায় পর্তুগিজ ও ফরাসীর অধিকার স্মর্তব্য।” [১]
পলাশীর মাঠের যুদ্ধে এদেশের সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেনি। কথিত আছে মানুষ যুদ্ধ দেখতে গিয়েছিল। জনগণের রাষ্ট্র অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী চেতনা তখনো এদেশের মানুষের মধ্যে বিকশিত হয়নি। পলাশীর মাঠে যুদ্ধের পর প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসর ইংরেজরা শাসন করবে না-কি শোষণ করবে এই সিদ্ধান্ত নিতে সময় লেগেছে। ১৭৯৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসন এবং শোষণ এক সঙ্গে চালায়। বাণিজ্যিক কোম্পানি শাসক শ্রেণিতে পরিণত হয়।
ইংরেজদের ভারতবর্ষে আগমনের পূর্বে অর্থাৎ ১৬৯০ সাল পর্যন্ত কলকাতা ছিল গ্রাম। ভাস্কো-দা-গামা সমুদ্রপথে ভারতবর্ষে আসার প্রায় দুইশত বৎসর পর জব চার্নক ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে সুতানুটি গ্রাম ক্রয় করে কলকাতা শহরের পত্তন করেন। ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন,
“১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ২৩ শে ডিসেম্বর দিবসে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কার্য্যাধ্যক্ষ জব চার্ণক বাঙ্গালার সুবাদারের সহিত বিবাদ করিয়া, হুগলীর কুঠী পরিত্যাগ পূর্ব্বক, ব্রাহ্মণী পত্নী সমভিব্যাহারে, হুগলীর ১২ ক্রোশ দক্ষিণস্থিত গঙ্গাতীরবর্ত্তী সুতানুটী নামক গ্রামে আসিয়া এক নিম্ববৃক্ষতলে আপনার শিবীর ও নতুন কুঠীর ভিত্তি স্থাপন করেন। তৎপরে চার্ণক কিছু দিনের জন্য সেখান হইতেও তাড়িত হইয়া হিজলীর নিকটে গিয়া কুঠী স্থাপন করিয়া ছিলেন; কিন্তু পুনরায় ১৬৯০ সালের আগস্ট মাসে ফিরিয়া আসিয়া সুতানুটীতে কুঠী নির্ম্মাণ করেন। ইহাই কালে মহানগরী কলিকাতারূপে পরিণত হইয়াছে।” [২]
প্রথম দিকে কলকাতা ছিল বাণিজ্যিক নগরী। পরে ইংরেজ সরকার কলকাতাকে রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করে। বাণিজ্যিক নগরী কলকাতা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্রে পরিণত হয়। ভারতবর্ষের শিক্ষিত মানুষ কলকাতায় আসা শুরু করে। ইংরেজদের সংস্পর্শে কলকাতা নগরগামী মানুষের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। জমিদার, ব্যবসায়ী, মহাজন, শিক্ষিত চাকুরে, উকিল, গোমস্তা, দেওয়ান, দালাল ও দোকানদারের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় কলকাতা শহর। উনিশ শতকের প্রথমদিকেই বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে কলকাতা বিকশিত হল, বাড়ির ভাড়া, জমির দাম গেল বেড়ে, জীবিকার প্রয়োজনে নানা ভাষাভাষী লোক এসে ভিড় জমাল এখানে, ফলে লোকসংখ্যাও বাড়তে লাগল দ্রুত। ইংরেজদের সংস্পর্শে ও সহযোগিতায় এবং সহমর্মিতায় কলকাতা শহরের নব্য ধনিক, বণিক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, উকিল, মোক্তার, শিক্ষকের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার রেনেসাঁসের সূচনা হয়।
ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ও অন্যান্য ব্যবহারিক প্রয়োজনে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজি শিক্ষা অনিবার্য হয়ে ওঠে। ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তিরা যেহেতু সমাজে বিশেষ সম্ভ্রম পেতে লাগল, তাই অশিক্ষিত পটু একদল লোকও এইসময় ইংরেজি শিক্ষা বিতরণ করে দু’পয়সা করে নিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় ইংরেজি শিক্ষা জ্ঞানার্জনের জন্য নয়, শুধুমাত্র জীবিকানির্বাহ ও সেই সূত্রে সৌভাগ্যের দ্বার খোলার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ইংরেজি স্কুল স্থাপিত হয়। বাড়িতে শিক্ষক রেখেও কলকাতার নব্য ধণিক শ্রেণী সন্তানের ইংরেজি শিক্ষা নিশ্চিত করে। “সুবিধা বুঝিয়া কয়েজন ফিরিঙ্গি কলকাতার স্থানে স্থানে ইংরাজী স্কুল স্থাপন করিলেন।” [৩] বাঙালিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। বাঙালিদের মধ্যে রামজয় দত্ত প্রথম ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রাজা রামমোহন রায় ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে নিজ ব্যয়ে হেদুয়া পুস্করিণীর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রামমোহন রায়ের অনুরূপ জগমোহন বসু ভবানীপুরে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে একটি স্কুল স্থাপন করেন। ইংরেজি জানা লোকের চাকরি-ব্যবসা সবকিছুতেই একচেটিয়া অধিকার ছিল। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ফলে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে এদেশের মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের নামই রেনেসাঁস।
ইউরোপের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতা শহরের ইংরেজি জানা বাঙালিদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইংরেজ-শাসন ও তদধিক ইংরেজি শিক্ষা আঘাত হেনেছে বাঙালির ভাব-জীবন ও চিন্তাজীবনের মূলে, তার আত্মতৃপ্তির মানসদুর্গে। আঘাত হেনেছে আচারসর্বস্ব, পুঞ্জীভূত অনাচার, অজস্ত্র বিধি-নিষেধের আকর ধর্মে এবং নাড়া দিয়েছে প্রথাজীর্ণ, অবসাদগ্রস্ত, হাজারো কুসংস্কারে আচ্ছন্ন বাঙালি সমাজকে। রাজা রামমোহন রায় ১৮১৪ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেন। রাজা রামমোহন রায় সংস্কারপন্থীদের নিয়ে ১৮১৫ সালে ‘আত্মীয়-সভা’ স্থাপন করেন। প্রথমদিকে এ সভার অধিবেশন রামমোহনের বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হতো। কলকাতা শহরের ধনীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয় রামমোহনের রায়ের আত্মীয়-সভা। এই সভায় বৈদান্তিক আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হতো। আত্মীয় সভায় শিবপ্রসাদ মিশ্র বেদ পাঠ করতেন এবং গোবিন্দ মালা ব্রহ্মসঙ্গীত করতেন। লোকনিন্দার ভয়ে অনেকে আত্মীয় সভা ত্যাগ করেছিলেন। সমালোচকরা আত্মীয় সভার সদস্যদের নাস্তিক হিসেবে অভিহিত করতো। সমালাচনা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, ব্রজমোহন মজুমদার, হলধর বসু, নন্দকিশোর বসু প্রমুখ রামমোহন রায়ের সঙ্গে ছিলেন। [৪]
বহু ভাষায় পারদর্শী রামমোহন রায় ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের অগ্রনায়ক ছিলেন। তিনি আরবি, ফার্সি ভাষায় পত্রপত্রিকা সম্পাদনা ও গ্রন্থ লিখেছেন। ‘সংবাদকৌমুদ’ এবং ফার্সি ভাষায় ‘মিরাট আল আকবর’ নামে দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছেন। ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে রামমোহন রায়ের বেদান্ত দর্শনের অনুবাদ, ১৮১৫; বেদান্তসার এবং কেন ও ঈশোপনিষদের অনুবাদ, ১৮১৬; কঠ, মুণ্ডক ও মাণ্ডুক্যোপণিষদের অনুবাদ এবং হিন্দু একেশ্বরবাদ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ ইংরেজি ও বাংলাতে, ১৮১৭; সতীদাহ সম্বন্ধীয় বিচার পুস্তক, বৈষ্ণব গোম্বামীর সহিত বিচার পুস্তক, গায়ত্রীয় ব্যাখ্যা পুস্তক এবং সতীদাহ সম্বন্ধীয় পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদ, ১৮১৮; সতীদাহ সম্বন্ধীয় পুস্তক, মণ্ডুক ও সতীদাহ সম্বন্ধীয় পুস্তকের ইংরেজি অনুবাদ, ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয়। ফার্সি ভাষায় রচিত ‘তুহ্ফাত্-উল্-মুআহ্হিদীন’ (একেশ্বর বিশ্বাসীদিগকে উপহার) এবং আরবি ভাষায় রচিত ‘মানাজারাতুল আদিয়ান’ তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থ। রামমোহন রায় প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক ছিলেন। কলকাতা শহরেই তাঁর ছিল ছয়টি বাড়ি। রামমোহন রায় ইংরেজি শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করলেও ধর্মহীন শিক্ষাকে পছন্দ করতেন না। এ-সম্পর্কে প্রচলিত গল্পে আছে, একদিন কোনো একজন রাজা রামমোহন রায়কে এসে বললেন, ‘দেওয়ানজি, অমুক আগে ছিল Polytheist, তারপর হইয়াছিল diest, এখন হইয়াছে atheist.’ রামমোহন রায় হাসিয়া বলিলেন, ‘শেষে বোধ হয় হইবে beast।’ [৫] রামমোহন রায়কে দিল্লীর বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর ’রাজা’ উপাধি দিয়ে বাদশার দূত নিযুক্ত করে বিলাতে পাঠিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়েছে। ব্রিস্টলের Arnos Vale Cemetery-তে তাঁর সমাধি রয়েছে। ব্রিস্টলের Arnos Vale Cemetery-তে প্রবেশের মুখেই রাজার সমাধি। রাজা রামমোহন রায়ের সমাধিতে লেখা রয়েছে, Philosopher, Reformer, Patriot, Scholar, A founder father of Indian Renaissance. Arnos Vale Cemetery-তে প্রতিবছর রাজার জন্মদিনে উৎসব হয়। ব্রিস্টলের স্থানীয় লোকজন এই উৎসবের আয়োজন করে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা রেনেসাঁসের আরেক ব্যক্তিত্ব দ্বারকানাথ ঠাকুর। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে রামমোহনের সখ্যতা ছিল। ’তিনি রামমোহন রায় কর্তৃক প্রচারিত একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হইয়াছিলেন এবং তাহাই শ্রেষ্ঠ বলিয়া মনে করিতেন বটে, কিন্তু তিনি স্বীয় পরিবারে প্রচলিত পূজাদি কখনও তুলিয়া দেন নাই।’ দ্বারকানাথ ছিলেন পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণার অনুসারী আধুনিক মানুষ। দেওয়ানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ’কার টেগোর এন্ড কোং’, ’ইউনিয়ন ব্যাংক’ নামের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক, বীমা এবং জাহাজের ব্যবসা করে তিনি প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে কোম্পানির কর্তা ব্যক্তিদের ভাগ্য নির্ধারিত হত। বিলাতেও দ্বারকানাথ ঠাকুর বিলাসী জীবনযাপন করেছেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “পিতা ইংলন্ডে থাকিতে তাঁহার হাত খরচের জন্য মাসিক লাখ টাকা করিয়া তাঁহাকে পাঠাইতে হইত।” [৬] ভারতে দুর্ভিক্ষ, মহামারী থাকলেও দ্বারকানাথ ঠাকুরের বিলাসী জীবনের অর্থ ভারতবর্ষ থেকেই গিয়েছে।
ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে ১৮১৭ সালে স্থাপিত হয় হিন্দু কলেজ। হিন্দু কলেজ কমিটিতে রামমোহন রায় ছিলেন না। হিন্দু কলেজ ছিল এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র। এছাড়া এদেশে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশে হিন্দু কলেজের অবদান সবচেয়ে বেশি। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনে শিক্ষিত এই কলেজের শিক্ষার্থীরা বাংলার চিরায়ত জীবনধারায় ছন্দপতন ঘটায়। এ ক্ষেত্রে হিন্দু কলেজের শিক্ষক হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিওর আবদান স্মরণযোগ্য। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, “ডিরোজিওর সংশ্রবে আসিয়া হিন্দু কলেজের ছাত্রগণের মনে মহাবিপ্লব ঘটিতে লাগিল। তিনি তাহাদিগকে লইয়া একাডেমিক এসোসিয়েশন নামে একটি সভা স্থাপন করিলেন”। [৭] রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, হরচন্দ্র ঘোষসহ অনেকেই ছিলেন এই সভার প্রধান বক্তা। সংস্কারগ্রস্ত সমাজে ডিরোজিওর চলার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। তাঁকে স্রোতের বিপরীতে জ্ঞানের নৌকা চালাতে হয়েছে। শিবনাথ শাস্ত্রী এ-সম্পর্কে লিখেছেন,
“তখন শহরে বৃন্দাবন ঘোষাল নামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছিল। সে ব্রাহ্মণের কাজকর্ম্ম কিছু ছিল না, প্রাতে গঙ্গাস্নান করিয়া কোশাকুশি হস্তে ধনীদের বাড়ীতে বাড়ীতে ঘুরিত এবং এই সংবাদ ঘরে ঘরে দিয়া আসিত। সে বলিয়া বেড়াইত যে, ডিরোজিও ছেলেদিগকে বলেন, ঈশ্বর নাই, ধর্ম্মাধর্ম্ম নাই, পিতামাতাকে মান্য করা অবশ্য কর্ত্তব্য নয়, ভাই বোনে বিবাহ হওয়াতে দোষ নাই, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সহিত ডিরোজিওর ভগিনীর বিবাহ হইবে ইত্যাদি ইত্যাদি।” [৮]
হিন্দু কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিরোজিওর প্রভাব ছিল। তারা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে আলোকিত হয়। সংস্কারগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলে। প্রশ্ন করার অভ্যাস হিন্দু কলেজের শিক্ষার্থী বিশেষ করে ডিরোজিওর শিষ্যদের মধ্যে দেখা যায়। রসিককৃষ্ণ মল্লিক ছিলেন হিন্দু কলেজের শিক্ষার্থী এবং ডিরোজিওর শিষ্য। তিনি কলকাতার সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তিনি গঙ্গা মানেন না।
“তৎকালে কলিকাতা সুপ্রিমকোর্টে হিন্দু সাক্ষীদিগকে তামা, তুলসী ও গঙ্গাজল স্পর্শ করিয়া শপথপূর্ব্বক সাক্ষ্য দিতে হইত। তামা, তুলসী ও গঙ্গাজল আনিবার জন্য একজন উড়িয়া ব্রাহ্মণ নিযুক্ত ছিল। আমরা প্রথমে কলিকাতাতে আসিয়া তাহাকে যখন দেখিয়াছি, তখন তাহার বৃদ্ধাবস্থা। ঐ উড়িয়া ব্রাহ্মণ একখানি তাম্রকুণ্ডে করিয়া তুলসী ও গঙ্গাজল লইয়া সাক্ষীদের সম্মুখে আনিয়া ধরিত, তাহা স্পর্শ করিয়া হিন্দু সাক্ষীদিগকে শপথ করিতে হইত। যখন এই নিয়ম ছিল, তখন একবার কোনও এক মোকদ্দমাতে সাক্ষী হইয়া বালক রসিককৃষ্ণকে সুপ্রিম কোর্টে উপস্থিত হইতে হয়। তিনি সাক্ষ্য দিতে দাঁড়াইলে উড়িয়া ব্রাহ্মণ প্রথামত তাম্রকুণ্ড লইয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু মধ্যে এক বিষম সংকট উপস্থিত। রসিককৃষ্ণ তামা তুলসী গঙ্গাজল স্পর্শ করিতে চাহিলেন না; স্থিরভাবে দণ্ডায়মান হইয়া ভাবিতে লাগিলেন। আদালত সুদ্ধ লোক বিস্ময়ে মগ্ন হইলেন। বিচারপতি কারণ জিজ্ঞাসা করাতে রসিক বলিলেন – ‘আমি গঙ্গা মানি না।’ যখন ইন্টারপ্রিটার উচ্চৈঃস্বরে ইংরাজীতে অনুবাদ করিয়া জজকে শুনাইলেন- তখন একেবারে চারিদিকে ইস্ ইস্ শব্দ উঠিয়া গেল; হিন্দু শ্রোতৃগণ কানে হাত দিলেন। অর্দ্ধদণ্ডের মধ্যে এই সংবাদ সহরে ছড়াইয়া পড়িল। ‘মল্লিকদের বাটীর ছেলে প্রকাশ্যে আদালতে দাঁড়াইয়া বলিয়াছে গঙ্গা মানি না; ঘোর কলি উপস্থিত, দেখ কলেজের শিক্ষার কি ফল!” [৯]
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এ রকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। মদ্যপান, গরুর মাংস খেয়ে ব্রাহ্মণের বাড়িতে অবশিষ্টাংশ নিক্ষেপ ইত্যাদি। সনাতন ধর্মের সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন ইয়ংবেঙ্গলরা। ডিরোজিওর শিষ্যদের ‘ইয়ংবেঙ্গল’ নামে অভিহিত করা হত। বিজ্ঞানমনস্ক পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাবেই প্রশ্ন করার সক্ষমতা ইয়ংবেঙ্গলরা অর্জন করেছিল।
বিপরীত চরিত্রে রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বর গুপ্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রমুখ রক্ষণশীল হিন্দু নেতৃবৃন্দের প্রভাবে হিন্দু সমাজ আরো রক্ষণশীল হয়েছে। সংস্কারপন্থী একটি গ্রুপও সক্রিয় ছিল। বিপরীত মেরুতে ছিল জ্বীনে-পরীতে, প্রেত-পেত্মীতে, দেও-দানবে, পীর-মুরশিদ, মাজার-দরগা-কবর ও অলৌকিক-অতিপ্রাকৃতিক আসমানী শক্তিতে বিশ্বাসী বিপুলসংখ্যক মুসলিম। নারী তখন অন্ধকারে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি। সন্তান উৎপাদন এবং পুরুষের সেবা করাই যেন নারীর ধর্ম। রেনেসাঁস নারী স্বাধীনতার দ্বার উন্মোচন করতে সহায়তা করে। নারী ঘরের বাইরে আসে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে প্রথম দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অনুমতি দেয়নি। এ সময় কলকাতার কিছু দূরে শ্রীরামপুরে মর্সম্যান, কেরি ও ওয়ার্ড নামে তিনজন পাদ্রি মিশন স্থাপন করেন। শ্রীরামপুর তখন ছিল দিনেমারদের অধীনে। ভারতবর্ষে ১৮০২ সালে পীতাম্বর নামে একজন সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রথম খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। পাদ্রিরা আর্থিক সুযোগসুবিধাসহ নানা ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করে মানুষকে ধর্মান্তরিত করেছে। পরবর্তী সময়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তসহ অনেক বিখ্যাত মানুষও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। এরা প্রত্যেকেই ইংরেজদের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পেছনে পারলৌকিক জীবনের চেয়ে ইহলৌকিক জীবনধর্ম বেশি কাজ করেছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় শহরকেন্দ্রিক শিক্ষিত মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক অস্থিরতা প্রবলভাবে দেখা যায়। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে আলোকিত এবং সনাতনী চিন্তা-চেতনা তাড়িত হওয়ার ফলে এই অস্থিরতা দেখা দেয়। রামমোহন রায়, কেশবচন্দ্র সেন, বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ প্রমুখের জীবন ছিল ধর্মীয় আধ্যাত্মিক অস্থিরতায় পূর্ণ। কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত অভিজাতদের মাঝে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের স্থান হয়নি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর আধ্যাত্মিকতায় মুগ্ধ হয়ে একবার ব্রাহ্ম উৎসবে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু পাছে শ্রীরামকৃষ্ণের স্বল্প-বসন অভিজাত অতিথিদের বিরক্তির কারণ ঘটায়, তাই তিনি সে আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেন। কেশবচন্দ্রের সঙ্গে রামকৃষ্ণের সখ্যতা হয়েছিল। কেশবচন্দ্রই কলকাতার ইংরেজি শিক্ষিত অভিজাত মানুষের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ বাংলা ভাষায় ধর্মতত্ত্বের ব্যাখ্যা করতেন। ভগবৎ প্রেমে বিভোর হয়ে তিনি নৃত্য করে, গান গেয়ে ভগবান ও ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে আলোচনা করতেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট প্রবলভাবে দেখা দেয়। প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বাঙালি মুসমানেরা লালন করেনা, আবার আরবিয় সংস্কৃতিও নয়। ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েও এরা ইসলামের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি সঠিকভাবে পালনে অনেকটাই অক্ষম। উত্তরাধিকার সংস্কৃতি বর্জনও করতে পারেনা। মুহম্মদ এনামুল হক এই ইসলামের নাম দিয়েছেন, ‘লৌকিক ইসলাম’।
বঙ্গীয় রেনেসাঁসের ফলে ধর্মীয় দৃষ্টিতে দ্বিধাবিভক্ত বাঙালি হিন্দরা শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে যায়। আধুনিক শিক্ষায় তারা আলোকিত হয়। পিছিয়ে যায় বাঙালি মুসলমান। কিন্তু এরাও পুনরুজ্জীবন চায়। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি মুসলিমের চিন্তা চেতনায় যুক্তিবাদী মতাদর্শ দেখা যায়। এ ধারার প্রধান প্রবক্তা ছিলেন দেলওয়ার হোসেন (১৮৪০-১৯১৩)। মুসলিম সমাজকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহী করে তুলেন নবাব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমির আলী। এরা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও এদের মন ছিল সুদুর আরবে। নবাব আবদুল লতিফের ‘মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি’ উচ্চবিত্ত মুসলমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। উর্দু, ফার্সি, ইংরেজিতে এই সভায় আলোচনা হলেও বাংলার স্থান ছিল না। একদল মুসলিম তখন ভারতবর্ষকে ’দারুল হরব’ ঘোষণা দিয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করেছিলেন। সে সময় নবাব আবদুল লতিফের অনুরোধে মৌলভী কেরামত আলী জৌনপুরি (১৮০০-১৮৭৩) এক সভায় ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষকে ‘দারুল ইসলাম’ বলে ঘোষণা করেন। নবাব আবদুল লতিফের মত সৈয়দ আমীর আলী মুসলমান সমাজকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছেন। কিন্তু এরা কেউ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বলেননি।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালির দর্শনচর্চায় পাশ্চাত্যের আধুনিক দর্শন ও প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের বেদ-বেদান্ত উপনিষদের প্রভাব দেখা যায়। বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাবও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালির দর্শনচিন্তায় রয়েছে। পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন বাঙালিরা কতক নিয়েছে আবার কতক বাদ দিয়েছে। রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাদের দর্শনে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের প্রভাবই বেশি। বেদ, উপনিষদ, গীতা, রামায়ন, মহাভারত, ত্রিপিটক ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি দার্শনিকদের মনন জগতে অধিক ক্রিয়াশীল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলমানেরা ইউরোপের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তাদের চেতনা জগতে ছিল কোরান-হাদিস। তারা কোরান-হাদিসকে অবলম্বন করেই এ অঞ্চলের মানুষের মুক্তি চেয়েছেন। হিন্দু এবং ব্রাহ্ম নেতারা বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ ত্যাগ করতে পারেনি তেমনি মুসলমানেরাও কোরান-হাদিস ত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনা লালন করতে পারেননি। কিছু ব্যতিক্রম হয়তো ছিল কিন্তু সে ব্যতিক্রম কখনো সামনের কাতারে দাঁড়ায়নি।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও সমন্বয়ে দুই ধারায় দর্শনচর্চা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের দর্শনচিন্তায় আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনের প্রভাব থাকলেও বেদ-বেদান্ত, উপনিষদের প্রভাব বেশি। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলিম দার্শনিকদের দর্শনচিন্তায় ইউরোপীয় দর্শনের প্রভাব থাকলেও কোরান এবং হাদিসই তাঁদের দর্শনের মূল উৎস ছিল। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই জগৎ এবং জীবন-জিজ্ঞাসায় কোরান এবং হাদিসকে মূলনীতি হিসাবে নিয়েছেন। তারা কোরান এবং হাদিসের ওপর নির্ভর করে জগৎ ও জীবনের রহস্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন।
ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জ্ঞানের বিকাশের মূল কেন্দ্র ছিলো বাণিজ্যিক নগরী কলকাতা। কলকাতায় আগে বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে পরে জ্ঞানের বিকাশ। বিংশ শতাব্দীতে ঢাকাকেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের পেছনে কাজ করেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। বাংলাদেশের শিক্ষানগরী হিসেবে পরিচিত স্থানে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা কখনোই অগ্রসর ছিলো না। আধুনিক ইউরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারের পেছনে কাজ করেছে বাণিজ্য।
তথ্যনির্দেশ :
১. আহমদ শরীফ, সমাজ-সংস্কৃতির স্বরূপ, (সংকলক, ড. নেহাল করিম), (ঢাকা : বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১২), পৃ. ৯০
২. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, (কলকাতা, নিউ এজ পাবলিশার্স, ১৯৫৫), পৃ. ১০
৩. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৩
৪. নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মহারাজা রামমোহন রায় এবং ধম্ম, সমাজ, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তাঁহার উপদেশ ও মতামত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৮
৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০
৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৭
৭. শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ,প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৭
৮. প্রাগুক্ত, পৃ. ১০২- ১০৩
৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ১২০- ১২১