
বাড়ির দলিল
সেই কখন থেকেই নফর আলি পায়চারি করছেন। উঠোন থেকে বারান্দা, তারপর গোয়ালঘর পর্যন্ত। নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা আধ-ময়লা পুরনো গামছাটা দিয়ে বার বার কপালের, মুখের এবং বুকের ঘাম মুছেন। মাঝে মাঝে মাথাটা চুলকান। তার এমন অবস্থা দেখে যে কেউই বুঝবে যে, মস্তবড় একটা সমস্যা নিয়ে কৃষক নফর আলি মুহুর্তগুলো অতিক্রান্ত করছেন।
সামান্য ক’শতক জমি আছে নফর আলির। এগুলোর সাথে আরো কিছু বর্গা চাষাবাদ করে কোন মতে তার দিনগুলো চলছে। চলছে আর কি! নুন আনতে পান্থা ফুরোয়। বাবার আমল থেকে এভাবেই তার অবস্থা। দাদাকে দেখেননি। কিন্তু বাবার কাছ থেকে শুনেছেন, বৃটিশ আমলে তাদের বেশ জমিজমা ছিল। খেয়ে পরে মোটামুটি ভালোই চলে যেতো। ঈদে পার্বনে বাড়তি আয়োজন আপ্যায়নও চলতো। কিন্তু দেশ ভাগের পরে সেনানিবাস করার জন্য তাদের সব জমাজমিগুলো একোয়ার করা হয়। তাদের প্রায় সব সম্পত্তিই হাতছাড়া হয়ে যায়। উপযুক্ত মূল্য দেয়ার কথা থাকলেও সে আর কিছুই পাওয়া যায়নি। একে তো নতুন দেশ। তার উপর আর্মির ক্যান্টনমেন্ট তৈরীর জন্য একোয়ার করা হয়েছে। প্রাপ্য মূল্যের জন্য সরকারি অফিসে হাঁটতে হাঁটতে জুতার তলা ক্ষয় হয়েছে, জুতা নষ্ট হয়েছে। মূল্য তো পাওয়া যায়নি, ভাগ্য ভালো যে, অবশেষে প্রাণে বাঁচা গেছে। আর্মির একোয়ার। আবার মূল্য দেবে? বৃটিশরা ছেড়ে ফেলে যায় এ দেশটি। তার কিছুদিন যেতে না যেতেই দেশ নিয়ে নেয় আর্মিরা তাদের দখলে। এর চেয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর নীলকর গোষ্ঠীই মনে হয় ভালো ছিল। এক ‘খান সাহেব’-এর পর আরেক ‘খান সাহেব’ ক্ষমতায় আসে আর আমজনতাকে ভেড়ার পালের মতো দৌঁড়ায়, ভয় দেখায়। জনতার নাকের ডগায় মুলা ঝুলিয়ে উন্নয়ন উন্নতির ফিরিস্তি শোনায়, বায়স্কোপ দেখায়। শাসন করে, শোষণ করে। কিন্তু পূর্ব-বাংলার এই জনগোষ্ঠীকে চাষা-ভূষা ছাড়া মানুষ বলে মোটেই গণ্য করে না। টুপি আর টিকি আলাদা করার জন্য তারা আলাদা রাষ্ট্র তৈরী করে। দু’টি রাষ্ট্রের জন্মের পূর্বেই জন্ম হয় হিংসার। একের প্রতি অন্যের ঘৃণার জন্ম হয় আর একটা দেশ আরেকটা দেশের চিরশত্রুতে পরিণত হয়। তার সাথে সেই খান সাহেবরা এই ব-দ্বীপ পূর্ববাংলা অংশকে মনে করে চাষা-ভূষা আর মাছলিভোগী বাঙাল। ওদের গায়ে তারা মাছের গন্ধ তো পায়-ই, ধূতি টিকির ছবিও যেন দেখতে পায়। একমাত্র টুপিওয়ালা যেন তারাই। তারাই যেন পবিত্র, পাক-পাকিজা গোষ্ঠী। অতএব এ অঞ্চলে শিল্প কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না গড়ে এখানে সেনানিবাস গড়ে তোলা হয়। আর সাধারণ কৃষকদের ক্ষেতের ফসলি জমি সরকারি ভাবে হুকুম দখলের নাম করে কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করা হয় কৃষকদেরকে।
নফর আলির দাদারও কপাল পুড়েছিল সেই পবিত্র, পাকপাকিজা খান সাহেবদের অগ্নিচক্ষুর কু’নজরে। নিজের সব জমিজমা হারিয়ে সেই শোকের আগুনে তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে অবশেষে তিনি পরপারে পাড়ি জমান। তার ছেলে অর্থাৎ নফর আলির বাবাও সেই দগদগে ঘা এর ক্ষত নিয়েই নিজের পুষ্যিদলকে কোন মতে আহার জুঠিয়ে অন্তত বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। অবশেষে এখন নফর আলি সেই ময়দানেই যেন জীবন যুদ্ধ করে চলেছেন।
দুই বছর আগে নফর আলি তার বসত বাড়ির দলিল বন্ধক রেখে, জুতদারের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ এনেছিলেন। মাত্র এক বছর মেয়াদের কথা বা চুক্তি থাকলেও এখন দুই বছর গড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ নফর আলি তা শোধ করতে না পারায় আগামি এক সপ্তাহের মধ্যে তার এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। এই দুশ্চিন্তায় নফর আলি ঘামছেন আর শরীরের ঘাম মুছে মুছে প্রহর পার করছেন।
কেমন একটা তীব্র উষ্ণতা নফর আলিকে ঘিরে যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। আর এই তীব্র উষ্ণতায়ই নফর আলি অবিরাম ঘামছেন। এই উষ্ণতা নফর আলির কোন এক কষ্টের। তিন পুরুষ ধরে জমে থাকা এই কষ্ট। সবকিছুই ছিল, তবু নিজেদের সবকিছু হারানোর কষ্ট। দাদার আমলে তাদের প্রচুর পরিমান এইসব জমিজমাগুলো যদি হাতছাড়া না হতো। অথবা তখন এগুলোর উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যেতো, তা হলে আজ হয়তো নফর আলি তার পরিবারবর্গ নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খেতে পারতেন। ঐ তো বৃটিশ আমলে রেলওয়ের রাস্তা করার জন্য পাশের গ্রামের ছমির শেখের দাদার সামান্য কিছু ভূমি হুকুমদখল করে নিয়েছিল গভর্ণমেণ্ট। তখন সেই ভূমির যে মূল্য দিয়েছিল তা দিয়ে আশেপাশের এলাকায় এবং পূর্ব গ্রামের উত্তরের হাওরে অনেক জমিজমা ক্রয় করে রেখেছিলেন ছমির শেখের দাদা। নগদ মূল্য ছাড়াও তিনি পেয়েছিলেন কোম্পানীর কিছু শেয়ার। যা দিয়ে তারা এতদঞ্চলের শেখ হয়ে গেলেন। এখন তার নাতিপুতিরা পায়ের উপর ঠ্যাং চড়িয়ে বসে বসে খাচ্ছে আর এ অঞ্চলে দাপটের সাথে প্রতাপশালী প্রভাবশালী পরিবার হিসাবে গণ্য হচ্ছে- প্রভুত্ব খাটাচ্ছে। অথচ নফর আলির দাদার জমাজমি আরো বেশিই হুকুম দখল করে নিয়েছে এই পবিত্র ‘খান সাহেব’রা। এ যেন ক্যান্টনমেন্টের জন্য নয়, বা সরকারি কাজের জন্য নয়- নদী ভাঙ্গনে খেয়ে ফেলেছে নফর আলির দাদার জমিগুলো, আর সাথে তার কপালও। নফর আলি জানেন না যে, অথবা তার এটা বুঝতে খুবই কষ্ট হয়। কেন যে এই টুপি টিকি আর লুঙ্গি-ধূতি ভেদাভেদ করে একটা দেশকে ভেঙ্গে দু’ভাগে ভাগ করা হলো? আর কেনই বা এই ভূ-ভাগের সাধারণ মানুষগুলোকে দিনের পর দিন, এক ঘৃণ্য হিংসার গহব্বরে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে! তকি টিকি অথবা ঐ গোরা গতরের হেঁটওয়ালা সামান্য কিছু লোকজনের কারসাজিতে বা তাদের ব্যাক্তিগত চালাকি আর হিংসার আগুনে আজ যুগ যুগ ধরে জ্বলতে হচ্ছে এ নাতিশিতোষ্ণ অঞ্চলের অতি সাধারণ মানুষগুলোকে।
এতোসব রাজনীতি নিয়ে নফর আলির ভাববার বিষয় নয়। দরকারও নাই। তবে এখন মনের জ্বালা যন্ত্রণা আর কষ্টে এগুলো তার মনে উঁকি-ঝুকি দেয়, এলোমেলো ভাবনা ভাবে সে। যদিও এগুলো দিয়ে মাথায় প্যাঁচ লাগিয়ে এ মুহুর্তের তার সমস্যাগুলোর কোন সুরাহা হবে না। খান সাহেবরা ক্যান্টনমেন্ট করছে চির শত্রু টিকিওয়ালাদের সাথে লড়বার শক্তি সঞ্চয়ের জন্য। আর ওদিকে ঐ অন্য অংশ বা সেই দেশ গড়ে তুলছে শিল্প-কারখানা আর বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। হবে না? হবেই তো! দেখতে হবে তো, কোথায় কী হচ্ছে? ও ভাগে তারা তাদের প্রধানমন্ত্রী করেছে পণ্ডিত লোক দেখে। আর এ ভাগে দেশের ক্ষমতায় ঝেকে বসেছে বন্দুকওয়ালা খান সাহেব।
দেশ ভাগ হওয়া বা গোরাদের শাসন শেষ হওয়ার কয়েক বছর পরেই নফর আলির দাদা মারা গেলেন। তারপর তার বাবা কোন মতে নফর আলিদের নিয়ে সংসার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে খান সাহেবদের সাথে এই মৎসভোগী বাঙালদের আর পোষাল না। এরা মৎসভোগী, এরা বাঙাল ঠিক-ই। কিন্তু এরা যে নাগামরিচের মতো ঝাল আর বেলের মতো শক্ত, তা খান সাহেবরা টের পেল অনেকটা বিলম্বে।
ঘন ঘন আর বেশি বেশি ক্যান্টনমেন্ট গড়ে তুলে আর গদা দিয়ে যে দাবিয়ে রাখা যায় না তা তাদের রুটি গোস্তের মগজে প্রবেশ করতে খুব বেশি সময় লেগেছিল। তারা যে পথে হাঁটলো, সে পথ বুটের তলায় বড় বেমানান হয়ে দাঁড়ালো। প্রথমেই তারা কোকিলকে কাকের ভাষায় কা কা ডাকতে আদেশ করে বড় দুঃখজনকভাবে হার মানতে হলো। তারপরও খান সাহেবরা ডাণ্ডা আর বুট দিয়ে চালিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারপর আরও বেশি ভুলের খেসারত তাদের দিতে হলো একেবারে মাথা নত করে।
নফর আলি উত্থাল একাত্তরে মুক্তিকামী নেতার আহ্বানে ঝাপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। বয়স তখন যুবকের। তখন টগবগে যৌবন তার। রক্তে তখন মৎসভোগী বাঙালির রুই-কাতলার ঘাই। ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে’ এই বাক্যটা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল নফর আলির বুকে- হৃৎপিণ্ডে। কারন তার শরীরের ঐ জায়গাটাতে প্রচুর পরিমানে উষ্ণ রক্ত আছে। অতএব তাই নিয়ে সে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তির লড়াইয়ে, স্বাধীনতার যুদ্ধে। এই যুদ্ধে নফর আলি একটা স্বাধীন দেশ পেলেন ঠিকই। তবে পিশাচদের হাতে তার বাবাকে প্রাণ দিতে হলো। নফর আলির যুদ্ধে যাবার খবর যখন চারিদিকে চাউর হয়। দালাল রাজাকাররা যখন জেনে ফেলে এই সংবাদ। তখন তার বাড়িতে দোসরদের সহযোগীতায় পাঞ্জাবি বেলুচি সৈন্য আর ক্যাপ্টেনদের আগমন ঘটে । নফর আলিকে না পেয়ে ধরে নিয়ে যায় তার বাবাকে। সাতদিন ধরে অকথ্য নির্যাতন করে তাদের ক্যাম্পে। অবশেষে যখন তিনি চেতনাহীন, তখন গুলি করে বুকখানা ঝাজরা করে দেয়। কিন্তু এই দাপট খুব বেশিদিন টেকে না। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এদেশের নফর আলিদের হাতে তাদের ভাগ্য লিখা হয়ে যায়। অবশেষে তিরান্নব্বই হাজার খানসেনা আর তাদের এ দেশীয় দোসর মিলিয়ে প্রায় এক লক্ষের অধিক হানাদার কা-পুরুষরা মাথা নত করে অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। দেশ স্বাধীন হয়। নফর আলির প্রিয় নেতা, জাতির পিতা, খানসাহেবদের আবদ্ধ শিকলঘেরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন, স্বদেশে- স্বজাতির কাছে। জনকের ইচ্ছা এবং সাধনা ছিল, এদেশে আর কখনো যুদ্ধ হবে না। দেশের উৎপাদনশীল ভূমি, আর জনগনের প্রয়োজনীয় জমি দখল করে কেবল গড়ে উঠবে না ক্যান্টনমেন্ট অথবা অনুৎপাদনশীল কোন প্রতিষ্ঠান। আবদি জমি নষ্ট করে সেখানে অনাবাদি অনুৎপাদনশীল কিছু করার দরকার হবে না। আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশের স্বর্থ রক্ষা করার জন্য সৈন্য গড়ে তোলা হবে। কারো প্রতি আমাদের বৈরীতা থাকবে না। সবার প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে মানুষের উন্নত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য। সেনা হবে, সৈন্য হবে দেশের উন্নয়নের জন্য। তারাও আপামর জনতার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ গড়ার কাজে, দেশের উন্নয়নের কাজে এগিয়ে আসবে। শরিক হবে এবং দেশ ও মানুষেরই কল্যাণে কাজ করে যাবে। হয়েছিলও তাই। কিন্তু! কিন্তু বেঈমান মিরজাফর তখনও যে অবশিষ্ট কিছু এখানে রয়ে গেছে, তাই জনকেরও এবং তার সন্তানদেরও মেনে নিতে হয়েছিল করুন নিষ্ঠুরতাকে!
দাদার আমল থেকে নফর আলিদের শুধু দিয়েই যেতে হচ্ছে। পাওয়ার হিসাবে তার কোন স্থিতি নাই। নফর আলিও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে নিজের বাবাসহ সর্বস্ব হারালেন। তবে নিজে পেলেন পরম একটা বস্তু, একটা অমূল্য সম্পদ, স্বাধীনতা। কিন্তু সামান্য কিছু দিনের মাথায়ও সে স্বাধীনতা বিপন্ন হবে জাতির পিতাকে নিশংস হত্যার মাধ্যমে তা তার ছিল ধারনাতীত। এ যেন আবার সেই সম্পদ হারানোর ট্রাজেডি!
শুরু হলো এ দেশের উল্টোদিকে ফিরে চলা। নফর আলিদের মতো যারা এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছিল, তাদের যেন লুট হয়ে গেল সব কিছু। তাদের আবার কোনঠাসা হয়ে পড়ে থাকতে হলো। কেবল প্রাণ খানা নিয়ে বেঁচেবর্তে কোন মতে যেন থাকতে হলো। যদিও অনেকেই আর সে ন্যুনতম বাঁচার অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন।
এমনি দূর্দিন কালে নফর আলি তার স্ত্রী ছেলে মেয়েসহ সাত সদস্যের পরিবারকে চালিয়ে নিতে, বাঁচিয়ে রাখতে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারন এছাড়া তখন নফর আলির সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না। তার স্ত্রী মারাত্মক দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। ভালো চিকিৎসা দরকার। তৈমুর মৃধা নফর আলির একজন শুভাকাঙ্খী বলা যায়। তবে তারও শক্তি সামর্থ খুব সীমিত। নিজের এমন কোন সামর্থ নাই যে, নফর আলিকে মোটা ধাঁচের কোন একটা সাহায্য করবে। তবে অনেক ভেবে চিন্তে এবং হিসাব নিকাশ শেষে তৈমুর মৃধা নফর আলিকে নিয়ে যায় লতিফ মুন্সির কাছে। এই লতিফের নাম শুনে প্রথমেই নফর আলি একটা দীর্ঘ নাআআ… উচ্চারণে চিৎকার করে ওঠেন। পরে অবশ্য শান্ত হন। আর তারও পরে তৈমুর মৃধার অনুরোধে পুরোটাই একমত হন। লতিফ মুন্সি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি খান সেনাদের দোসর ছিল। গত ক’বছর সে উঠপাখির মতো মুখ লুকিয়ে ঘাপটি মেরে ছিল। এখন আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। শুরু করেছে জোতদার মহাজনী ব্যবসা। মুলত সুদের ব্যবসাই মুখ্য। তার কাছেই নফর আলির বসত বাড়ির দলিল জমা রেখে চড়া সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। খুব চড়া দামে সুদ দিতে হবে। না পারলে এবং একবছর মেয়াদে সমস্ত টাকা পরিশোধ না হলে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। পরিষ্কার শর্ত। এই শর্তের মধ্যে আর কোন ধারা উপধারা নাই। তবুও লতিফ মুন্সি নফর আলিকে এই অতিরিক্ত এতো দিন সময় দিয়েছে এটারও অন্য কিছু ব্যাক্তিগত উপধারা আছে বৈ কি!
লতিফ মুন্সিকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে যায় স্বাধীনতার পরে। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। তাকে মেরে ফেলতে উদ্ধত হয়েছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু নফর আলি তা করতে বারণ করেন এবং তাকে বিচারের আওতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সেই কৃতজ্ঞতাটুকু আজ জানাতে চায় লতিফ মুন্সি। আর অন্য আরেকটা উপধারাও আছে। মুন্সির বড় ছেলে বিকলাঙ্গ অথচ বখাটে আহাদের জন্য নফর আলির সোমত্ত ছোট মেয়েটাকে নিতে চান। নফর আলি বছর দুই আগে লতিফ মুন্সির কাছ থেকে মূলত প্রধান যে প্রয়োজনে টাকাগুলো এনেছিলেন, তার সে কাজে টাকাগুলো ব্যবহৃত হলেও ফলাফলটা ভালো হয়নি। নিজের স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেননি। গত দেড় বছর যাবৎ তিনজন ছেলে আর দুইজন মেয়েকে সহ সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে দু’টো মেয়েই প্রায় বিবাহযোগ্য। ছেলেগুলো এর ছ্টো। লেখা পড়ায় আছে। তবে তা আর কত? গ্রামে থাকেন। অভাবী সংসার। নিজে তো আর তেমন কিছুই করতে পারলেন না!
নফর আলি মাথার, মুখের, ঘাড়ের ঘাম মুছেন। ঘামে তার সমস্ত গামছা ভিজে জবুথবু হয়ে গেছে। আসলে আবহাওয়াটা খুব গরম, না তার নিজেরই বিশেষ এই কারণে গরম লাগছে তা নফর আলি আন্দাজ করতে পারেন না। নফর আলি নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে করেন। তার দু’চোখের সামনে কেবল নিজের ছেলে মেয়ে, বাড়ি, দলিল এসব দেখতে পান। এক সময় নফর আলি মাটিতে বসে পড়েন। আষাঢ়ের ধারার মতো যেন ঘামের ধারা নেমে আসে নফর আলির সারা শরীরে। একটু বমি বমি লাগে। আরও যেন কেমন কেমন করে তার। কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন সব কিছু থেমে যায়। থেমে যায় নফর আলির হৃৎপিণ্ডটাও।
ছেলে মেয়েদের হাউমাউ কান্নাকাটি চিৎকার শুনে পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই আসেন। সাদা সফেদ একখানা চাদরে ঢেকে দেন নফর আলির লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা সারা দেহখানা। তারপর এ খবর পৌঁছে যায় আশে পাশের গ্রামেও। খবর পেয়ে লতিফ মুন্সি তৈমুর মৃধাকে সাথে নিয়ে তাড়াতাড়ি আসে নফর আলির বাড়িতে। সাথে আসে তার বিকলাঙ্গ বখাটে ছেলে আহাদও। বাড়ির দলিলখানাও সাথে নিয়ে আসতে ভুলে না লতিফ মুন্সি।