
বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণ কোন অর্থে, কতটা গুরুত্বপূর্ণ
বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১৯১৪—১৯৫১)-এর অবদান কী এবং কেনই-বা আমরা তাঁকে স্মরণ করবো, এমন প্রশ্ন যে-কারো মনে জাগা স্বাভাবিক। তিনটি উপন্যাস, কয়েকটি ছোটগল্প, একটি উপন্যাসের অনুবাদ, একটি পত্র-প্রবন্ধ, কিছু কবিতা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও লোকসাহিত্য সংগ্রহ এবং সর্বশেষ-আবিস্কৃত অগ্রন্থিত১ একটি পুস্তকের লেখাপত্র নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ-এর সাহিত্যিক জীবন। এই অল্প রচনায় কতোটুকু গুরুত্বের দাবি রাখতে পারেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ? আমাদের ধারণা, একজন লেখক শুধু একটি লেখার জন্যও গুরুত্বের দাবিদার হতে পারেন, যদি লেখাটি সত্যিকার ‘লেখা’ হয় এবং তাতে চিন্তা ও উপস্থাপনাগত নতুনত্ব থাকে। আসলে এই সব কিছুই নির্ভর করে লেখক কিভাবে জীবনকে দেখেন এবং পাঠককে কিভাবে দেখাতে চান তার ওপর। সেদিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে অদ্বৈত মল্লবর্মণ গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখেন। এ-কথার পক্ষে এখানে তাঁর তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৫৬) উপন্যাসটির কথা উল্লেখ করতে চাই। কারণ ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি জন্ম পরিবেশ ঘিরে তাঁর উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম’ (অচিন্ত্য, ২০১৪ : ২৯)। আবার তিতাসের জন্যই অদ্বৈত পাঠকমহলে পরিচিত ও নন্দিত হয়েছেন। অনেকে মনে করেন, ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও তিতাস একটি নদীর নাম একে অপরের পরিপূরক। এই উপন্যাস থেকে তিনি প্রায় কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন।’ (দেবীপ্রসাদ, ২০০৮ : ৭৭) এই উপন্যাসের জন্য তিনি ‘কিংবদন্তি’তে পরিণত হয়েছেন কিনা সেটা বড় কথা নয়; মূল কথা হলো তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের জন্যই অদ্বৈত যে বাংলা সাহিত্যে মর্যাদাবান আসন অর্জন করেছেন, তা এখন প্রায় সর্বজনস্বীকৃত। নদী ও জীবনের যুগলবন্দি যতো উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে লেখা হয়েছে তা থেকে অদ্বৈতের তিতাস একটি নদীর নাম স্বতন্ত্র মর্যাদায় ভাস্বর। কেননা, খোলাসা করে বললে বলতে হয়, কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০)-এর নদীবক্ষে (১৯১৯), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০)-এর ইছামতি (১৯৫০), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১)-এর কালিন্দী (১৯৪০), হুমায়ুন কবির (১৯০৬-১৯৬৯)-এর নদী ও নারী (১৯৫২), সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১)-এর এ কূল ভাঙ্গে ও কূল গড়ে (১৯৭১), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)-এর পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৩৬), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০)-এর মহানন্দা (১৯৫৫), অমিয়ভূষণ মজুমদার (১৯১৮-২০০১)-এর মধু সাধু খাঁ (১৯৮৮), কাজী আফসার উদ্দীন আহমদ (১৯২১-১৯৭৫)-এর চর-ভাঙা চর (১৯৫১) সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮)-এর গঙ্গা (১৯৫৭), শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯২৬-১৯৯৭)-এর কাশবনের কন্যা (১৯৫৪), আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩)-এর পদ্মার পলিদ্বীপ (১৯৮৬), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৩)-এর কর্ণফুলী (১৯৬২), দেবেশ রায় (জন্ম. ১৯৬৩)-এর তিস্তাপারের বৃত্তান্ত (১৯৮৮)সহ জল ও জীবন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে যতো উপন্যাস রচিত হয়েছে, সেগুলো থেকে অদ্বৈতের তিতাস একটি নদীর নাম স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে আলাদা ও অনবদ্য। ‘সন্দেহ নেই, নদী নির্ভর বাংলা কথান্যাসের ধারায় নানা কারণেই তিতাস একটি নদীর নাম অর্জন করেছে বিশিষ্টতা।’ (বিশ্বজিৎ, ২০০৫ : ২১৭) জল ও জীবনের সম্পর্ক নির্মাণে অদ্বৈতের ‘দেখাটাই’ অন্যদের ‘দেখা’ থেকে ভিন্ন। ‘তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ যেভাবে তিতাসের জনজীবন, নদীপথ, নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোর বর্ণনায় স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রত্যক্ষ জীবনরস সঞ্জীবিত করতে পেরেছেন তা চর-ভাঙ্গা চর-এ নেই।’ (অনীক, ২০০৫ : ২১২) অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস জল ও জীবনের বিকল্প নন্দন। এক্ষেত্রে আমরা কথাসাহিত্যিক কায়েস আহমেদ এর বিবেচনা স্মরণ করতে পারি। কায়েস আহমেদ তাঁর ‘ঘূর্ণির টান ও নিরাবেগ বোঝাপড়া’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন :
বঙ্গদেশের গ্রাম সমাজের ভাঙা-গড়া সামন্তবাদের অবক্ষয়ের পাশাপাশি মাথা মুড়ানো নব্য ধনিক শ্রেণীর উত্থানের বাস্তব ছবিটি পাওয়ার জন্যে একজন অমার্কসবাদী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কি খাঁটি জেলে পরিবারে জন্ম ও আত্মপরিচয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল অদ্বৈত মল্লবর্মণের কাছেই হাত পাততে হয়। কোন মার্কসবাদী লেখকের হাত দিয়ে তা বেরোয়নি। এমন যে বিপুল শক্তিধর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর বিশাল ব্যাপক সাহিত্য জগতে এই জীবনের সন্ধান মেলে না। জেলে জীবন নিয়ে লেখা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র পাশাপাশি অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পড়লেই বোঝা যায় একটি শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের রচনা অপরটি অপেক্ষাকৃত কম শক্তিমান হাতের লেখা হলেও তা ভেতর থেকে লেখা।[…] অবশ্য অদ্বৈত মল্লবর্মণে জেলে জীবনের যে বিশ্বস্ত পরিচয় মেলে সেই অর্থে খাঁটি কৃষক জীবন তারাশঙ্করেও নেই, আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি (এ ব্যাপারে সবেধন নীলমণি শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পটি)। (কায়েস, ২০০১ : ২৬৩)।
কায়েস আহমেদের মন্তব্য এই কারণে এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ‘ভেতর থেকে লেখা’ কথাটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। শিল্প-সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি তথা জীবনটাকে ‘ভেতর থেকে দেখা’ বিষয়টি ব্যাপক গুরুত্বের দাবি রাখে। দার্শনিকভাবেও ‘দেখা’ ব্যাপারটিই চিন্তার কেন্দ্রীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ‘ভেতর থেকে দেখা’—অর্থাৎ খাঁটি ও গভীরভাবে দেখার ও লেখার ক্ষমতা অদ্বৈতের ছিল। তিনি জলের চোখে জল, মাটির চোখে মাটি দেখেছেন। তিনি শহরের চোখে গ্রাম কিংবা গ্রামের চোখে শহর কিংবা মধ্যবিত্তের চোখে নিম্নবিত্ত বা নিম্নবিত্তের চোখে উচ্চবর্গকে দেখেননি। কেননা, ‘তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর আশৈশব-অর্জিত অভিজ্ঞতারই শিল্পিতরূপ দিয়েছেন। যে জীবনপরিবেশে তিনি লালিত-পালিত ও বর্ধিত হয়েছেন, সে জীবনকেই তিনি মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় এ উপন্যাসের ক্যানভাসে অঙ্কন করেছেন।’ (গিয়াস, ২০০২ : ১১) তাঁর যাপিত জীবনাভিজ্ঞতার প্রতিফলিত রূপই তাঁর সাহিত্য। আর কেবল ভেতর থেকে দেখা নয়, সেই ‘দেখা’কে যথার্থরূপে সাহিত্যে তিনি উপস্থাপন করতে সক্ষমও হয়েছিলেন। তাই কায়েস আহমেদ উল্লেখ করেছেন, ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণে জেলে জীবনের যে বিশ্বস্ত পরিচয় মেলে সেই অর্থে খাঁটি কৃষক জীবন তারাশঙ্করেও নেই’—মানে যে জেলে জীবনকে তিনি তাঁর সাহিত্যে উপস্থাপন করেছেন তা ‘ভেতর থেকে দেখা’ ও লেখা খাঁটি জেলে জীবন। তার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা বা আরোপিত ব্যাপার নেই। আর অদ্বৈত মল্লবর্মণ যেভাবে জেলে জীবনের বিশ্বস্ত পরিচয় দিয়েছেন তা তারাশঙ্করের কৃষকজীবনে নেই, ব্যাপারটাকে আমরা সেভাবে দেখতে নারাজ। আমাদের দাবি, জলজীবন বা জল সংশ্লিষ্ট জীবনের ওপরে উল্লিখিত যতো উপন্যাস রচিত হয়েছে তার মধ্যে ‘ভেতর থেকে দেখা’, কৃত্রিমতা বিবর্জিত খাঁটি জীবনের বিশ্বস্ত পরিচয় একমাত্র অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে নিহিত। ‘মৎসজীবীদের জীবন চর্যার এমন অকৃত্রিম আলেখ্য এবং মমতা মাখানো জীবনবেদ অনুরূপ অন্য কোন উপন্যাসে সুদুর্লভ।’ (সুশান্ত, ১৯৯৪ : ৯০) কারণ, গোকর্ণঘাট গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শান্ত স্নিগ্ধ ও অথৈ জলে দুকূল উপচে পড়া ছোট একটি নদী তিতাস। বাংলার বুকে এরকম নদীর সংখ্যা দুর্লভ নয়। মূলত অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের জন্যই তিতাসের আজ এত পরিচিতি। তিতাস নদীর বিশেষ কোনো ঘটনা নেই যা তাকে স্বতন্ত্র মর্যাদার আসনে চিহ্নিত করবে। কোনো ইতিহাস কিংবা রাষ্ট্রবিপ্লবের খাতায় কিংবা ইতিহাসের পাতায় পাতায় তিতাসের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। অদ্বৈতের ভাষায়, ‘তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটা নদী।’ (অদ্বৈত, ২০১১ : ৩৯৯) এ-নদীর পাড়ে অবহেলিত, অবজ্ঞাত, শিক্ষা ও আধুনিক জীবনের সুবিধা-বঞ্চিত গ্রামীণ মানুষের বসবাস। তিতাসকে কেন্দ্র করেই তাদের কষ্ট-বেদনা-হাসি-কান্না-ভালোবাসা উত্থিত হয় আবার মিলিয়ে যায়। এটাই এ-নদীর বিশেষত্ব। পদ্মা মেঘনার বিশালতা প্রচণ্ডতা এ-নদীর নেই কিন্তু লেখকের বর্ণনায় তিতাস পাড়ের মানুষ আর তিতাস যেন এক অপরের পরিপূরক—জল ও জীবনের সেই অনবদ্য ছবি ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। লেখকের ভাষায় :
জেলেদের বৌ-ঝিরা ভাবে অন্যরকম কথা—বড় নদীর কথা যারা শুনিয়াছে। যেসব নদীর নাম মেঘনা আর পদ্মা। কি ভীষণ! পাড় ভাঙ্গে। নৌকা ডোবায়। কি ঢেউ। কি গহীন জল। চোখে না দেখিয়াই বুক কাঁপে! কত কুমির আছে সে সব নদীতে। তাদের পুরুষদের মাছ ধরার জীবন। রাতে বেরাতে তারা জলের উপরে থাকে। এতবড় নদীতে তারা বাহির হইত কি করিয়া! তাদের নদীতে পাঠাইয়া মেয়েরা ঘরে থাকিতই বা কেমন করিয়া! তিতাস কত শান্ত। তিতাসের বুকে ঝড়-তুফানের রাতেও স্বামী-পুত্রদের পাঠাইয়া ভয় করে না। বউরা মনে করে স্বামীরা তাদের বাহুর বাঁধনেই আছে, মায়েরা ভাবে ছেলেরা ঠিক মায়ের বুকেই মাথা এলাইয়া দিয়া শান্তমনে মাছ-ভরা জাল গুটাইতেছে। (অদ্বৈত, ২০১১ : ৪০২)।
আবার পরক্ষণেই লেখক নিজেই জানিয়েছেন জীবন ও জলের এই সম্পর্কের কথা, যা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায় না। পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসের অংশ না হলেও জীবনধর্মের সত্য উচ্চারণে, তিতাস পাড়ের মানুষের মন ও মননে, নিম্নজীবী মানুষের আবেগের ভাষা ধারণে এবং অবহেলিত জেলে সমাজের কথকতায় তা পরিপূর্ণ। লেখকের ভাষায় :
পুঁথির পাতা পড়িয়া গর্বে ফুলিবার উপাদান এর ইতিহাসে নাই সত্য, কিন্তু মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বৌ-ঝিয়েদের দরদেও অনেক ইতিহাস এর তীরে তীরে আঁকা রহিয়াছে। সেই ইতিহাস হয়ত কেউ জানে, হয়ত কেউ জানে না। তবু সে ইতিহাস সত্য। এর পারে পারে খাঁটি রক্তমাংসের মানুষের মানবিকতা আর অমানুষিকতার অনেক চিত্র আঁকা হইয়াছে। হয়ত সেগুলি মুছিয়া গিয়াছে। হয়ত তিতাসই সেগুলি মুছিয়া নিয়াছে। (অদ্বৈত, ২০১১ : ৪১০)।
তিতাসের সঙ্গে তিতাস-তীরবর্তী মানুষের সম্পর্ক এতোটাই নিবিড়। এই উপন্যাসে নির্মিত হয়েছে জল ও জীবনের ঐকতান। জলস্রোতের জৈব-একত্মতায় তিতাস-তীরবর্তী মানুষ পেয়েছে সঙ্ঘবদ্ধ জীবনচেতনার আহ্বান। ‘মালোকৌমের কাছে তিতাস একই সঙ্গে পরম বন্ধু ও চরম শত্রু, একই সঙ্গে সে মাতা ও দয়িতা। জল ও জীবন, নদী ও মানুষের এই নিবিড় একাত্মতায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ খুঁজে পেয়েছেন প্রবহমানতার শাশ্বত সূত্র।’ (বিশ্বজিৎ, ২০০৫ : ২২২)। কারণ কবে, কখন, কিভাবে তিতাস-তীরবর্তী মানুষের সঙ্গে তিতাসের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা তারা জানে না, ভাবে না—‘ভাবিতে বা জানিতেও চায় না’। তিতাসের সঙ্গে তাদের জীবন প্রবহমানতার শাশ্বত সূত্রকে অদ্বৈত উপস্থাপন করেছেন এভাবে: ‘এ যেন চির সত্য, চির অস্তিত্ব নিয়া এখানে বহিয়া চলিয়াছে। এ সঙ্গী তাদের চিরকালের। এ না হইলে তাদের চলে না। এ যদি না হইত, তাদের চলিতও না। এ না থাকিলে তাদের চলিতে পারে না।’ (অদ্বৈত, ২০১১ : ৪০৪)। জীবন আর তিতাসের যেন এক চিরমিশ্রণের সম্পর্ক। পরস্পরের সম্পর্ক যেন পরম নির্ভরতার। ফলে, বলা যায় যে, জলজীবন বা জলসংশ্লিষ্ট জীবনের বিকল্প নন্দন সৃষ্টিতে অদ্বৈতের জুড়ি মেলা দায়। এক্ষেত্রে তিনি এক, অদ্বিতীয় ও অগ্রপথিক। গবেষক-সমালোচক মোস্তাক আহমাদ দীনের বিবেচনায়, ‘অদ্বৈতের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি মৌলিক, লোকস্পর্শী ও জলমাটিআগুনের কাহিনি হলেও আঙ্গিক বিবেচনায় তা কোনোভাবেই লোকায়ত নয়, বরং তা ছিল এক উচ্চাকাক্সক্ষী ধারণারই প্রতিফলন।’ (মোস্তাক, ২০১৭ : ৫৯)। এই মন্তব্যের দুটি দিক খুব গুরুত্বের দাবি রাখে—উপন্যাসের মৌলিকত্ব নিয়ে; এবং উপন্যাসের আঙ্গিক বিবেচনা নিয়ে। উপন্যাসটি ‘মৌলিক, কেননা, বিষয় বিবেচনা বা বিষয়বৈচিত্র্যের দিক থেকে ‘অদ্বৈত মল্লবমর্ণের তিতাস একটি নদীর নাম বাংলাদেশের আঞ্চলিক উপন্যাস-সাহিত্যে একটি অনবদ্য ও যুগান্তসৃষ্টিকারী সংযোজন।’ (গিয়াস, ২০০২ : ১১)। তবে আঞ্চলিক বা বৃত্তিমূলক আখ্যান নিয়ে রচিত হলেও তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের গঠন বা আঙ্গিক আঞ্চলিক নয়। কারণ, ‘শিল্প-সাহিত্যকে অনিবার্যতই স্থানিক ও সাময়িক হতে হয়—দেশকালের দ্রাঘিমা-অক্ষাংশে সে এমনই বাঁধা। সেই স্থানিকতা ও সাময়িকতাকে বিশ্বজনীনে নিয়ে আসাটাই নন্দনসূত্রের প্রধান, বা হয়তো একমাত্র কাজ।’ (দেবেশ, ২০০৩ : ৪৩) কিন্তু কাজটি সহজ নয়। কাজটি লেখককেই করতে হয়। লেখকের জন্য প্রয়োজন হয় অপূর্ব বস্তু নিমার্ণক্ষম প্রজ্ঞার, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গির, জীবনাভিজ্ঞতা ও অপরিমেয় সাধনার। আর সেই কাজটিই যথাযথভাবে করতে চেয়েছেন ও পেরেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে। নিজের অভিজ্ঞতাজাত, নাগরিক জীবন থেকে অগ্রাহ্যকৃত, বাত্যজীবনের রসমঞ্জরীকেই তিনি করেছেন বিশ্বজনীন। তাই এই উপন্যাসের গঠনকল্পে লেখকের ‘উচ্চাকাক্সক্ষী’ একটি মনন সর্বদাই ক্রিয়াশীল থেকেছে—যা তাঁর শিল্পীসত্তার অনন্যদিক বলেই আমাদের ধারণা। সে কারণেই বলছি, অদ্বৈত মল্লবমর্ণের সেই সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনাভিজ্ঞতা ও অপরিমেয় সাধনার জন্যই তাঁর মননচিন্তার ধরন স্বতন্ত্র । তাই তাঁর সাহিত্য আমাদের দেয় বিকল্প জীবনের সন্ধান।
দুই.
তাহলে তিতাস একটি নদীর নাম-এর জন্যই কি অদ্বৈত কেবল স্মরণযোগ্য কিংবা গুরুত্বের দাবি রাখেন? ব্যাপারটি তা নয়। কারণ, ‘তিতাস একটি নদীর নাম এর সঙ্গে অদ্বৈত মল্লবর্মণের নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকলেও এবং এটি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ মৌলিক সাহিত্যকীর্তি হলেও তিনি এই উপন্যাসটি ছাড়াও সাহিত্যের নানা শাখায় প্রচুর কাজ করেছেন।’ (শান্তনু, ১৯৯৮ : ২৩) সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রেই অদ্বৈতের মননচিন্তার ধরনটাই ভিন্ন। তাঁর মননচিন্তার ধরন বিবেচনার জন্য আলাদা নিক্তি প্রয়োজন। কারণ, গড় নিক্তিতে পরিমাপ করলে কায়েস আহমেদের মতো অনেকের মনে হতে পারে, ‘অপেক্ষাকৃত কম শক্তিমান’ লেখক! অদ্বৈতের জীবনকে যাপন, জীবনকে ভেতর থেকে দেখার দৃষ্টি, জীবনকে উপস্থাপন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ব্যাপারটি তাঁর নিজস্ব মানে তাঁর মননচিন্তার স্বরূপটি আরোপিত নয়। কারণ, আমরা যদি খেয়াল করি, তবে দেখব; আমাদের চিন্তার ধরন, চিন্তার পদ্ধতি, কাজের গতি ও প্রকৃতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণপ্রক্রিয়া অস্বাভাবিক রকম আরোপিত ও নিয়ন্ত্রিত। কেননা, আমরা আসলে বাহ্যিকভাবে উপনিবেশ মুক্ত কিন্তু আমাদের মনোজগৎ প্রবলভাবে উপনিবেশযুক্ত ও উপনিবেশের ভাবাদর্শ দ্বারা আলোড়িত ও নিয়ন্ত্রিত। সেক্ষেত্রে অদ্বৈতের চিন্তনপ্রক্রিয়া তাঁর নিজস্ব এই কথাটি বলা যত সহজ, ব্যাপারটি তত সহজ নয়। উপনিবেশমুক্ত মননের অধিকারী অদ্বৈতের চিন্তা ও কর্মতৎপরতার ধরনটি তাহলে কী? বিষয়টি খোলাসা হওয়ার দাবি রাখে। তাঁর মননচিন্তার সঙ্গে দায়বদ্ধতার ব্যাপারটি অঙ্গাঙ্গী জড়িত। কায়েস আহমেদের দ্বারস্থ হয়ে বলতে হয়, ‘খাঁটি জেলে পরিবারে জন্ম ও আত্মপরিচয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ তাঁর মননচিন্তা। অদ্বৈত আত্মপরিচয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কতোটা ছিলেন তা উপলব্ধি করা যায় তাঁর শাদা হাওয়া (১৩৫৫) উপন্যাস পাঠে। শাদা হাওয়া উপন্যাসে তিনি ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শাসন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন-ঘৃণা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অবস্থার পরিচয় দিয়েছেন। একই সঙ্গে সবকিছুর বাইরে উপন্যাসে স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটি ঠাণ্ডা লড়াই। আর তা হলো, প্রাচ্য তথা ভারতবর্ষের দর্শন, রুচি, সংস্কৃতি, সভ্যতা বড় না কি ব্রিটিশের তথা পাশ্চাত্যের দর্শন-সংস্কৃতি-সভ্যতা বড়। রাজায় রাজায় লড়াই হয় আর জীবন দিতে হয় সৈনিককে। কিন্তু ইতিহাস লিখিত হয় রাজার নামেই। প্রজার কাজ কেবল রাজার স্বার্থে জীবন/রক্ত দান। শাদা হাওয়া উপন্যাসে আমরা দেখি সেই অলিখিত ইতিহাসের কথা—যেখানে অদ্বৈত তাঁর সেই চিন্তাকে প্রকাশ করেছেন গোবিন্দ শর্মের ভাবনায় :
মরতে কেন এরা যুদ্ধ করে। দুনিয়ার সব সৈন্য মিলে এক ঝাণ্ডার তলে দাঁড়িয়ে এই বলে স্ট্রাইক কেন করে না : আমরা সব সৈন্য এক—আমাদের দাবীদাওয়া আশা-কামনা সুখদঃখ এক। আমরা সব সৈন্য ভাই ভাই। আমরা দুনিয়ার সবচাইতে সর্বহারা—সবার চেয়ে বেশী এক্সপ্লয়েটেড। যুদ্ধ করে কেবল ভাই ভাইকে মারছি আর ভাইয়ের হাতে মরছি। অন্য কেউ তো মরছে না। এবার আমাদের ভুল ভেঙেছে। […] কাকে পর্যন্ত কাকের মাংস খায় না! আমরা সৈন্যের মাংস সৈন্যেতে খেতে যাই কোন বিবেকের নির্দেশে ! (অদ্বৈত, ২০১১ : ৬৩৮)।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল অদ্বৈত মল্লবর্মণের যুদ্ধবিরোধী মানসিকতা ও মানবমুক্তির আকাঙক্ষা। অদ্বৈতের মননচিন্তার সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তাঁর উপনিবেশবিরোধী অবস্থান ও বি-উপনিবেশায়ন চিন্তা। লেবার লীডারের মৃত্যুপূর্ব মুহূর্তে তার মুখ দিয়ে লেখক বলিয়ে নেন : ‘পরের অধীন থাকবো না, পরকে অধীন রাখবো না, শুধু এ মন্ত্রের মধ্যেই বিশ্বশান্তি বিরাজিত। এর জন্য চাই অহিংসা।’ (অদ্বৈত, ২০১১ : ৬৭৬)। অদ্বৈতের এই বি-উপনিবেশায়ন ভাবনা তাঁর মননচিন্তার এক অনন্যরূপ—যার মিল খুঁজে পাওয়া যায় এডওয়ার্ড সাঈদের বি-উপনিবেশায়ন চিন্তার সঙ্গে। সাঈদের বি-উপনিবেশায়ন চিন্তার চিহ্নায়ক হলো : ‘উপনিবেশকের সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতা এবং তার নেতিবাচক প্রভাব ও বিকৃতি দূর করে প্রাক-ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা ও সঞ্চয়কে কর্মক্ষম করে স্বতন্ত্র যাত্রাপথ তৈরি করে নেয়া।’ (ফয়েজ, ২০০৬ : ৭৫) তাই শাদা হাওয়া উপন্যাসে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যে ঠাণ্ডা লড়াই সমগ্র উপন্যাসের প্রধান ব্যাপার, সেখানে লেখকের অবস্থান আমরা জানতে পারি জীল চরিত্রের মাধ্যমে। জীলের ভাষায় : ‘আমার প্রফেসর বলেছেন, পাশ্চাত্যজগৎ যখন তার মারামারি কাটাকাটির পর্ব শেষ করে বিপুলহারে বর্ধিত এক অশান্তির কবলে ক্লান্ত হয়ে নুয়ে পড়বে, সেদিন নাকি বিশ্বশান্তি আনবে এই গান্ধী আর অরবিন্দ।’ (অদ্বৈত, ২০১১ : ৬৪৫) সাঈদের বি-উপনিবেশায়ন উপায়ের সঙ্গে অদ্বৈতের শাদা হাওয়া উপন্যাসের বি-উপনিবেশায়ন সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হলেও তাঁর রূপটি নিজস্ব। কেননা, ‘সাঈদ বি-উপনিবেশায়নের এই উপায়ের কথা যখন বলেছেন তার অনেক আগেই অদ্বৈতের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে এবং নবশক্তি, মোহাম্মদী প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত লোকসাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য বিষয়ক লেখাজোখায় ও সংগ্রহে তা লক্ষ করা যায়।’ (সাহাবউদ্দিন, ২০১৪ : ১৪২)। এছাড়া শাদা হাওয়া উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর নামকরণ। এই উপন্যাসের নামকরণের মধ্যেও রয়েছে লেখকের মননচিন্তার এক অনন্য স্ফূলিঙ্গ। অদ্বৈত শাদা হাওয়া উপন্যাসের নামকরণের স্বরূপ সন্ধান করেছেন গবেষক অচিন্ত্য বিশ্বাস। তিনি তাঁর সম্পাদিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্র এর ভূমিকায় লিখেছেন :
‘শাদা’ বানানটি দুয়েকবার দন্ত্য-স দিয়ে লিখলেও অদ্বৈতের লক্ষ্য ছিল ‘শাদা’ লেখা। তাই এই বইতে সর্বত্র ‘শাদা’ বানান রাখা হয়েছে। শাদা অর্থে পাশ্চাত্য, হাওয়া অর্থে ভাবাদর্শ। উপন্যাসের শেষে এই অর্থ ভেদ করা যায়। টম এই ভাবাদর্শটিকে সনাক্ত করেছে। ওয়েশিংটন স্কোয়ারের ছাত্র নেতাটির সঙ্গে কথায় বুঝেছে সে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও ভারতবর্ষের তরুণরা ইংরেজি ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সঙ্গে সঙ্গে তার দার্শনিক মন (অদ্বৈত যাকে কখনো সেন্টিমেন্টালও বলতে চেয়েছে) বুঝে ফেলে এই রন্ধ্রপথেই কমনওয়েল্থ রক্ষা করা যাবে। ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের সূত্রেই পরোক্ষে বিশ্বশাসন করার অধিকার পাবে এ্যাংলো স্যাকশান জাতি! ‘শাদা হাওয়া’ আসলে সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী পরিস্থিতি (বলতে পারতাম post colonial situation)-কে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। বাংলা সাহিত্যে এরকম যুগাতিশায়ী লেখা খুব বেশি নেই। (অচিন্ত্য, ২০১১ : ১৫)।
শুধু শাদা হাওয়া উপন্যাস নয়, অদ্বৈতের গল্প, উপন্যাস ও কবিতার নামকরণের ক্ষেত্রেও তাঁর সুচিন্তিত ও সুগভীর মননের পরিচয় পাওয়া যায়। শাদা হাওয়া উপন্যাসে অদ্বৈতের উত্তর-ঔপনিবেশিক ও বি-উপনিবেশায়ন চিন্তার যে পরিচয় আমরা পাই তা একান্তই তাঁর নিজস্ব—কোনো ভাবাদর্শ বা মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবান্বিত নয়। তাই মনে হয় শাদা হাওয়া উপন্যাস অদ্বৈতের মননচিন্তার এক অনন্য উৎসভূমি। এই স্বতন্ত্রচিন্তার যাত্রাপথটি অদ্বৈতের সকল রচনায়ই পাওয়া যায়। কেননা, আত্মশক্তিতে বলীয়ান ও জাতিসত্তার প্রতি প্রবল শ্রদ্ধাবান তাঁর সমগ্র চিন্তাজগৎ।
তিন.
অদ্বৈত মল্লবর্মণের অধিকাংশ রচনা প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে। জীবৎকালে প্রকাশিত একমাত্র মুদ্রিত গ্রন্থ হলো ভারতের চিঠি—পার্লবাককে২(১৯৪৩)। অপর দিকে অদ্বৈতের ভারতের চিঠি—পার্লবাককে গ্রন্থেও পাওয়া যায় তাঁর উপনিবেশমুক্ত মানসিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। অদ্বৈতের মননচিন্তা কতটা বৈশ্বিক তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারতের চিঠি—পার্লবাককে গ্রন্থে। তিনি নাৎসিপন্থী ও পুঁজিপতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে আলাদাভাবে দেখেননি। তাঁর বিবেচনায় :
সাম্রাজ্যবাদ, নাৎসীবাদ প্রভৃতি এক একটা বিরাট অর্গেনিজেশন জন-শোষণের যা কাজ করছে; তাদের যে অগণ্য সন্ততিসকলে দেশ ছেয়ে আছে, জন-শোষণের ক্ষেত্রে তারাও কম কাজ করছে না। পুঁজিদার, ব্যাবসায়ী, কলমালিক, ভূম্যধিকারী, কৃষক-খাটানে জমি-মালিক—মানুষের শ্রম, সম্পদ ও সুখশান্তি অপহরণে তারা কেউই কম পটু নয়। এরা প্রত্যেকেই বৃহত্তর vested interest-এর অসংখ্য খুঁটি। (অদ্বৈত, ২০১১ : ৫৬৯)।
পঞ্চাশের মন্বন্তর যখন আগ্রাসী রূপ নিয়েছে, অদ্বৈত তখনই বইটি লিখছিলেন। অদ্বৈতের মননচিন্তা কোন মতাদর্শে কিংবা কোন স্বার্থান্বেষী চিন্তায় আবদ্ধ থাকেনি। তাঁর মননচিন্তার মূলে ছিল মানবের মুক্তি ও কল্যাণ কামনা। ভারতের চিঠি—পার্লবাককে গ্রন্থে পাওয়া যায় তাঁর মননচিন্তার মর্মকথা। যেখানে তিনি বলেছেন :
মিলিটারী মেজাজ বিশ্বের বুকে যে-ক্ষতের সৃষ্টি করে চলেছে, তার জন্য শান্তির প্রলেপ তৈরি করার কাজ সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার নয়; সে-কাজ চিন্তাশীল মননশীল জগতের। এ জগতে যারা বিরাজমান তারা যে-কোনো দেশের যে-কোন শক্তিরই অন্তর্ভুক্ত হোক না কেন, তাদের চিন্তা ও ভাবধারায় একটি বিশ্বজনীন কল্যাণ প্রচেষ্টা থাকা চাই। তা না থাকলে মনীষা-জগতের অর্থই অনর্থসূচক হয়ে পড়ে। (অদ্বৈত, ২০১১ : ৫৭২)।
এতে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ, ভয়াবহ মন্বন্তরের বিস্তৃত ছবি, ভারতের স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষার প্রতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের তাচ্ছিল্যভরা প্রতিক্রিয়া, চিয়াং-কাইশেকের ভারত সফরের প্রসঙ্গ, জাপানের কুখ্যাত অধ্যাপক নোগুতির প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত চিঠির কথা। ‘পরাধীন দেশের বিপন্নতা ও দুর্বিষহ বিশ্বপরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল অদ্বৈত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চেতনার যুগলবন্দি প্রেরণায় এই বইটি লিখেছিলেন ১৯৪৪ সালের৩ কাছাকাছি সময়ে।’ (তপোধীর, ২০০০ : ৫০) তাছাড়া অদ্বৈতের কবিতা, ছোটগল্প ও অন্যান্য রচনায় একদিকে স্বদেশের সংস্কৃতির ইতিবাচক দিক যেমন অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসন কিভাবে আমাদের মন-মনন-অস্থিমজ্জার ভেতরকে কলুষিত করছে সে-বিষয়ে তিনি ছিলেন গভীরভাবে সজাগ ও সচেতন। তাঁর এই মননচিন্তার স্বরূপ সন্ধান করতে গিয়ে একজন সমালোচক তাই উল্লেখ করেছেন :
অদ্বৈত মল্লবর্মণ ঔপনিবেশিক শাসনের ভাঙাগড়ার পর্যায়ে সাহিত্যচর্চা করেছেন। এর পাশাপাশি পূর্ববঙ্গের মানুষ হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গীয় আভিজাত্যের পীড়নও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। সঙ্গতকারণেই তিনি সাহিত্যে এবং ব্যক্তিজীবনে উপনিবেশবিরোধী আচরণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভারতের চিঠি—পার্লবাককে গ্রন্থে তাঁর উপনিবেশী জ্ঞানচর্চার প্রতিরোধী বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। তাঁর গল্পে-উপন্যাসেও উপনিবেশবিরোধী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে এই গ্রন্থটি উত্তর-উপনিবেশবাদী রচনার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। (সাহাবউদ্দিন, ২০১৪ : ১৩৫)।
আত্মপরিচয়ের প্রতি কতোটা অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন অদ্বৈত তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সমস্ত রচনায়। অদ্বৈত তাঁর সাহিত্য ও জীবনে উপনিবেশবিরোধী আচরণ করেছেন কিংবা করতে বাধ্য হয়েছেন এধরনের মন্তব্যকেই বরং মনে হয় ঔপনিবেশিক মানসজাত মন্তব্য। কারণ অদ্বৈতের মননচিন্তার ধরনটি ছিল দেশ-কালের মাটি, মানুষ জলভূমির আত্মশক্তির অনুসন্ধান। কিন্তু তিনি কোনোক্রমেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী চেতনায় আচ্ছন্ন ছিলেন না। শাদা হাওয়াসহ তাঁর সমস্ত রচনায় আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই তা সর্বজনীন ও বৈশ্বিক।
চার.
অদ্বৈত মল্লবর্মণের প্রবন্ধের আলাদা কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। তিনি সর্বসাকুল্যে প্রায় ত্রিশটির মতো প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধগুলো যেন তাঁর সাংবাদিক জীবনের সাহিত্যিক ফল। কেননা, তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধ নবশক্তি ও দেশ পত্রিকায় কাজ করার সময় লেখা এবং ঐ দুটি পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রবন্ধের অধিকাংশের আকার-প্রকারও বলা চলে নাতিদীর্ঘ কিন্তু প্রত্যেকটি প্রবন্ধই মেজাজ ও মর্জিতে যেন স্বতন্ত্র। প্রত্যেকটি প্রবন্ধই তাঁর স্বকীয় চিন্তামূলক। ‘টি.এস এলিয়ট’ নামক প্রবন্ধটি অদ্বৈতের সাহিত্য-সমালোচনামূলক প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধ পাঠে যেকোন পাঠকই উপলব্ধি করতে পারবেন, অদ্বৈতের সৃজনশীল ও মননশীল মননের স্বরূপ। সমালোচনামূলক প্রবন্ধ যে কেবল মননধর্মী নয়—সৃজনধর্মী তা সহজেই বুঝতে পারা যায় অদ্বৈতের ‘টি. এস এলিয়ট’ নামক প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধে এলিয়ট সম্পর্কে পরিচিতিজ্ঞাপনসহ বিশ্বসাহিত্যে এলিয়টের প্রভাব, সমালোচক হিসেবে সর্বজনীন স্বীকৃতি, চিন্তাশীল মানবমনে ধর্মবোধ উজ্জীবনার্থে তাঁর প্রতিভা ও অনুশীলন—সবই উল্লেখ করেই এলিয়টের সাহিত্যাদর্শ সম্পর্কে অদ্বৈত লিখেছেন :
কাব্যশাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য অসাধারণ। সর্বযুগের কবিতা সম্বন্ধেই তাঁর অগাধ উপপত্তি। তাঁর ছন্দ ও ব্যঞ্জনা স্বভাবসিদ্ধ স্বতঃস্ফূর্তিতে প্রবাহিত : যেন মনের ঐকান্তিকতা থেকে বিনা চেষ্টায় এগুলি বেরিয়ে আসে। তাঁর রচনা ও জীবন দর্শন ভাষার দিক বিবেচনায় ইংরাজী ও আমেরিকান সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু ভাবের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে বিশ্বসাহিত্যকে। (অদ্বৈত, ২০১১ : ৬৩)।
টি.এস এলিয়ট সম্পর্কে অদ্বৈত মল্লবর্মণের এই বিচেনায় আছে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সাহিত্য ভাবনার পরিচয়। সৃজন ও মননের এক অপূর্ব সম্মিলন হল অদ্বৈতের প্রবন্ধ। অদ্বৈতের বিবেচনাবোধে ছিল অন্তর্দৃষ্টি ও মানবকল্যাণের সমন্বয়। বিচার-বিবেচনা ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সদা-সর্বদাই তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন সময়, সমাজ ও সংস্কৃতিতে ব্যক্তির প্রভাবকে। তাই ‘রোকেয়া জীবনী’ নামক বেগম রোকেয়া’র জীবনীমূলকগ্রন্থের সমালোচনায় অদ্বৈত লিখেছেন : ‘নারীজাতির জন্য তাঁহার অন্তরের দরদই তাঁহাকে নারীদের কল্যাণের জন্য সর্বস্ব সমর্পণে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল। শুধু মুসলমান নারীগণ নহে, হিন্দু মুসলমান সমভাবে সকল নারীগণেরই তাই এই বিশালপ্রাণা মহিলা প্রাতঃস্মরণীয়া।’ (অদ্বৈত, ২০১১ : ১২৬)।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের মননচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তাঁর সংস্কৃতিচিন্তা। অদ্বৈত সংস্কৃতিচিন্তা নামে কিংবা সংস্কৃতি নামে অথবা সংস্কৃতির নানাভেদ নামেও কোন প্রবন্ধ রচনা করেন নাই। কিন্তু তাঁর একাধিক রচনার মধ্যে রয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক স্বকীয় চিন্তার মর্মবাণী। অদ্বৈত মল্লবর্মণের সংস্কৃতিচেতনার সঙ্গে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে ‘শ্রম’ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারটি। তাঁর কাছে শ্রমবিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি কোনো অর্থেই সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না। অদ্বৈত শ্রমবিচ্ছিন্ন নিষ্ক্রিয়তাকে প্রবলভাবে ঘৃণাও করতেন—যা তিনি ‘এদেশের ভিখারী সম্প্রদায়’, ‘সাগরতীর্থে’ ও ‘আম্রতত্ত্ব’ নামক প্রবন্ধে গভীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধমে উপস্থাপন করেছেন। ‘এদেশের ভিখারী সম্প্রদায়’ নামক প্রবন্ধে অদ্বৈত ভিক্ষাবৃত্তিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে অলস, কর্মবিমুখ, সেবার আদর্শ, অতিথি পরায়ণতার আদর্শ, ভিক্ষাবৃত্তিকে সমর্থন করে। তিনি বৈষ্ণব ভিখারী, গেরুয়া আলখাল্লা পরা ‘দেবতার পূজারী’ সাজা ভিক্ষুক, মুসলমান ফকির ও পঙ্গু-ভিক্ষুক—এই চার শ্রেণির ভিক্ষুকের কথা উল্লেখও করেছেন এবং তিনি এদের কাউকেই সমর্থন করেননি। অদ্বৈত লিখেছেন :
কর্মহীন অলস জীবনযাত্রায় আর আত্মার এবং দেহের অবমাননাকর ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যে ভগবানের কোন সত্তাই যে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না একথা তাহাদিগকে বুঝাইয়া বলিবার দিন আজ আসিয়াছে। নিজের শ্রমদ্বারা অর্জিত অন্ন দ্বারা ঠাকুরের ভোগ লাগাইলে ঠাকুর যে তাহা অধিকতর পরিতৃপ্তির সহিত গ্রহণ করিবেন তাহাতে সন্দেহ নাই। (অদ্বৈত, ২০১১ : ১১৩)।
শুধু তাই নয়, অদ্বৈতের চিন্তার মৌল দিক হলো সমস্যা নিরূপণ এবং সমাধানের পথনির্দেশ। এক্ষেত্রেও তার ব্যতায় ঘটেনি। তিনি এই ভিক্ষুকদের নানা কর্মমুখী, দৈহিক খাটুনি ও কুটির শিল্পে নিয়োগের মাধ্যমে কর্মের আসক্তি যোগানের কথাও বলেছেন।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ কোনো শিক্ষাবিদ, শিক্ষা গবেষক কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে না থেকে, না গিয়েও আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্গতির কথা ভেবেছেন ও মুক্তির পথও নির্দেশ করেছেন। ‘ছোটদের ছবি আঁকা’ নামক প্রবন্ধে অদ্বৈত মল্লবর্মণ বলেছেন :
শিশু প্রকৃতির মাধুরীতে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে আপনা থেকেই শিক্ষিত হয়ে উঠবে—শিক্ষক থাকবে শুধু তাকে পথ দেখিয়ে দেবার জন্য—তাকে নানা ইঙ্গিত দেখিয়ে সাফল্যেও পথে চালিয়ে নেবার জন্য। […] শিক্ষাকে এখন গ্রন্থ মুখস্থ করানোর মধ্যে আবদ্ধ রাখলে চলবে না। শিক্ষা বলতে এখন আত্মবিকাশ বলে মেনে নিতে হবে। এ বিকাশ তিক্ততার মধ্যে, জটিলতার মধ্যে, অনিচ্ছার মধ্যে হতে পারে না। (অদ্বৈত, ২০১১ : ১২০)।
তারচেয়েও বড় কথা হলো, অদ্বৈত তাঁর জীবনকে দেখেছেন গভীরভাবে, নানা বাস্তব অভিজ্ঞতার অভিজ্ঞান তাঁর চিন্তাস্রোতকে করেছে তীক্ষ্ণ। তিনি জীবনকে দেখেছেন জীবনের ভিতর দিয়ে। তাই তিনি তাঁর সেই উপলব্ধির কথাই বলেছেন ‘প্রাচীন চীনা চিত্র-কলার রূপ ও রীতি’ নামক প্রবন্ধে। তিনি ঐ প্রবন্ধের এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন : ‘মানুষই হোক আর প্রকৃতিই হোক, একান্ত কাছে এসে না দেখলে তাকে ঠিক ঠিক দেখা হয় না।’ (অদ্বৈত, ২০১১ : ১১৬) তাঁর এই ভাবনা যে কতোটা মূল্যবান; তা কেবল দিয়ে উপলব্ধি করলেই বোঝা যাবে—নচেৎ নয়।
যে-কোনো শিল্পী বা লেখকের মননচিন্তার অন্যতম প্রধান দিক হলো লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি। সময়, সমাজ, সংস্কৃতি, জীবনযাপন এবং জীবনমান নিয়ে ভাবনা-চিন্তায় লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। অদ্বৈতের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া য়ায় দেশ, কাল, সমাজ, সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট তাঁর নানা রচনায়। ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের সংঘাতকে যে ‘সাম্প্রদায়িক’ সংঘাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, সে সম্পর্কে অদ্বৈত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছেন :
কারণ যাহাই হোক—বিরোধ-বিদ্বেষ ও ঈর্ষার বিষবাষ্পে বাংলার আকাশ-বাতাস আজ প্রধূমায়িত হইয়া উঠিয়াছে। […] যাহারা মনে করেন, বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের মধ্যে যে বিরোধ আজ মূর্ত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা এমনই একটা সংস্কৃতিগত বিরোধ যে ইহার কোন সমাধান নাই—তাহাদের সহিত আমি একমত নই। আমাদের মতে এই বিরোধ এমনই একটা ঠুন্কো কাল্পনিক ভিত্তির উপর দাঁড়াইয়া আছে যে আমাদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হইলেই এই বিরোধের অবসান ঘটান যাইবে। প্রকৃতপক্ষে ইহা সাম্প্রদায়িক বিরোধ নহে, মুষ্টিমেয় লোকের স্বার্থের সংঘাত মাত্র। (অদ্বৈত, ২০১৫ : ৯৫৪)।
এই নিবন্ধের মাধ্যমে অদ্বৈতের মননচিন্তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অত্যন্ত স্বচ্ছ ধারণা আমরা পাই—যেখানে কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদজ্ঞান কাজ করে না। অদ্বৈতের মননচিন্তার কেন্দ্রে ছিল মানব ও মানবের কল্যাণ। মানব কল্যাণ ও মানবমুক্তির বোধই তাঁর সাহিত্য চিন্তার মৌাল বিষয়। তাই অদ্বৈত-গবেষক ইসরাইল খানের বিবেচনাটি এরকম : ‘পূর্ববঙ্গের মুসলিম অধ্যুষিত নিম্নবর্গের হিন্দু হিসেবে তাঁর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণ ও ধর্ম বৈষম্যবোধ বা বিকার বিকৃতি সৃষ্টি করতে পারেনি। এক অসামন্য নির্লিপ্ততায় তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজের হত-দরিদ্র কৃষক, শ্রমিক, জলমজুর ও বিত্তহীন অশিক্ষিতদের উন্নতি কামনা করেছেন।’ (ইসরাইল, ২০০৮ : ১৯) মূলত তাঁর ছিল এক ‘অখণ্ড’ ও নিঃশর্ত মানবমন এবং নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। মানবের মননচিন্তার প্রধান উৎস হল ‘অখণ্ড’ মানবমন। অদ্বৈতের এই নির্মল, নিঃশর্ত ও ‘অখণ্ড’ মানবমনের খোঁজ আমরা পাই তাঁর সকল রচনায়। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর ‘অপ্রকাশিত পল্লী গীতি’ শীর্ষক রচনায় লিখেছেন : ‘শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেই পল্লী-সঙ্গীতের আদর করেন। তার কারণ এগুলি মনন, চিন্তা, বা কল্পনা দিয়া গড়া নয়; পল্লীবাসীর নির্ভেজাল মনের উৎস হইতে উৎসারিত; এগুলিতে পাওয়া যায় খাঁটী প্রাণের স্পর্শ।’ (অদ্বৈত, ২০১১ : ৬৪) অদ্বৈতের সাহিত্য সাধনার মূলেই ছিল ‘অখণ্ড’ মানবমনের প্রাণের স্পর্শের সন্ধান। কারণ অদ্বৈতের মননচিন্তার ধরন ও গড়ন অন্য যে-কোনো লেখক-শিল্পীর থেকে আলাদা। ইসরাইল খান অদ্বৈতের মনন উৎসের সন্ধান করেছেন এভাবে : ‘তাঁর সাহিত্যভাবনা ও গবেষণার মৌল-উপাদান উপকরণও সংগৃহীত হয়েছে পূর্ব বাংলার জীবন ও জগৎ থেকে। শিল্পী-স্রষ্ট্রার যে-মনন অদ্বৈতের, তাও গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ ও বাঙালি-সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে।’ (ইসরাইল, ২০১৫ : ০৫) অদ্বৈতের মননচিন্তার গড়ন পূর্ব বাংলার জীবন, জগৎ ও বাঙালি-সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে হলেও তাঁর মননচিন্তার রূপায়ণ ছিল বৈশ্বিক। অদ্বৈতের মননচিন্তার মেজাজটি সর্বজনীন ও সর্বকালিক। আর তাঁর ‘অখণ্ড’ মানবমনের কেন্দ্রে ছিল মানুষ এবং সে মানুষ হলো দেশ-কাল নিরপেক্ষ, নিঃশর্ত মানুষ।
পাঁচ.
অদ্বৈত মল্লবর্মণের মননচিন্তার অন্যতম উৎসভূমি হলো তাঁর লোকসাহিত্য সংগ্রহ এবং লোকসংস্কৃতি ও লোকসাহিত্য বিবেচনা। লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও লোকসংস্কৃতি বিবেচনার ক্ষেত্রে অদ্বৈতের যে অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায় তাতেও তিনি ছিলেন স্বচ্ছ, স্বতন্ত্র ও দূরদর্শী। তাঁর সংগৃহীত লোকসাহিত্যকে তিনি স্থান-কাল ও পরিবেশ অনুযায়ী তাঁর রচিত সাহিত্যে উপাদান হিসেবে ব্যবহারও করেছেন। কারণ, ‘তিতাস একটি নদীর নাম পড়লে বোঝা যায় লোকসংস্কৃতি বিষয়ে গভীর অর্ন্তদৃষ্টি ছিল অদ্বৈত মল্লবর্মণের। একাজে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছাত্র বয়স থেকেই উদ্যোগী ছিলেন।’ (অচিন্ত্য বিশ্বাস, ২০১৪ : ৩৭) কিন্তু কোন কোন গবেষক মনে করেছেন তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস লেখার ‘মহৎ ও বৃহৎ’ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই লোকসাহিত্য সংগ্রহ করেছিলেন অদ্বৈত। একজন সমালোচক তাই দাবি করেছেন :
তাঁর সব লিখিত রচিত কবিতা প্রবন্ধে, গল্পে উল্লিখিত সংগৃহীত সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক-লৌকিক উপাদান উপকরণের পরিচয় নেবার পরে তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি পাঠ করলে মনে হয় লেখক এই সব তথ্য বা বক্তব্য সুর ও সৌন্দর্য আগে বর্ণনা করেছেন। এই যে প্রথম জীবনে খণ্ড-খণ্ড অল্প-অল্প করে সংগ্রহ করে বিপুল সম্পদের ভাণ্ডার গড়ে তোলার প্রয়াস-প্রযত্ন—তা ছিল স্থায়ী মহৎ ও বৃহৎ কিছু করার পরিকল্পনারই অংশ। মোহাম্মদীতে প্রকাশিত সাত কিস্তির তিতাস উপন্যাসের পরিবর্জন-পরিবর্তন-পরিমার্জনার নথিপত্র আমাদেরকে সে প্রমাণই দেয়। (ইসরাইল, ২০১৫ : ৩৩)।
কিন্তু অন্য আরেকজন সমালোচক এই মত মানতে নারাজ। তিনি মনে করেন :
অদ্বৈত মল্লবর্মণ-আহরিত লোকসাহিত্য সংগ্রহের কিছু অংশ তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত হলেও এগুলো কখনো উপন্যাসে ব্যবহৃত হবে এই লক্ষ্য নিয়ে সংগৃহীত হয়নি, কারণ এক্ষেত্রেও তাঁর ছিল স্বচ্ছ ও স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি। […] পত্রিকায় প্রকাশের সময় এগুলোকে কেন্দ্র করে পৃথকভাবে দীর্ঘ ভূমিকা লেখেননি সত্য বরং অন্যান্য সংগ্রাহকের তুলনায় তাঁর ভাষ্যগুলোও ছিল ছোট, তবে তা মূল্যায়নধর্মী ও প্রাসঙ্গিক এবং তাতে কখনো-কখনো অন্যান্য আলোচকের মূল্যায়নের সমালোচনাও রয়েছে। বোঝা যায়, তাঁর সংগৃহীত উপাদানগুলো হৃদয়স্পর্শী বলেই সংগৃহীত আর তার উৎসস্থলের সঙ্গে উপন্যাসের স্থান ও বিষয়-অনুষঙ্গগত নিবিড়তার কারণে স্থানে-স্থানে তা যথাব্যবহারের দৃষ্টান্তে পরিণত হতে পেরেছে। (মোস্তাক, ২০১৭ : ৫৮-৫৯)।
এই মন্তব্যগুলো যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণের দাবিদার। কারণ, লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি সংগ্রহের মধ্য দিয়ে অদ্বৈতের ভিন্ন পরিচিতি ও গভীর গভীরতর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় মেলে। আর অদ্বৈতের ‘অখণ্ড’ মানবমন, নির্লিপ্ত অন্তর্দৃষ্টি ও দেশ-কালের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতার পরিচয়ই ফুটে ওঠে তাঁর লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মধ্যে। তাই তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস লেখার জন্য ‘মহৎ ও বৃহৎ’ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই যে লোকসাহিত্য সংগ্রহ করেছেন তা মানা যায় না এবং তা যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা বলে মনেও হয় না। তিনি তাঁর সাহিত্যে বিভিন্ন অনুষঙ্গে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করেননি—ব্যবহার করেছেন তাঁর নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন হিসেবে। আবার শুধু সংগৃহীত ‘উপাদানগুলো হৃদয়স্পর্শী বলেই’ তিনি তাঁর উপন্যাসের নানা অনুষঙ্গে ব্যবহার করেছেন তাও ঠিক নয়। তিনি শুধু লোকসাহিত্য সংগ্রহই করেননি, সেগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিচার বিশ্লেষণের মধ্যেই পাওয়া যায় তাঁর স্বতন্ত্র ও স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়। অদ্বৈতের লোকসাহিত্য সংগ্রহের সব থেকে বড় উদ্দেশ্য হলো বঙ্গীয় শক্তির অনুসন্ধান, নাগরিক জীবনের বাইরে পল্লি-জীবনের অমূল্য সম্পদের অনুসন্ধান-উপস্থাপন—যার মাধ্যমে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিপরীতে প্রাচ্যের নিজস্ব শক্তির প্রমাণ উপস্থাপন। আর ছিল প্রাণের স্পর্শের অনুসন্ধান। যার কারণে তাঁর সাহিত্যে পরিলক্ষিত হয় দেশের পল্লি-জীবনের প্রতি গভীর টান। পল্লির এই অমূল্য সম্পদকে সংগ্রহের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন বঙ্গের নিজস্ব শক্তি আরো খোলাসা করে বলতে হয় গ্রামীণ-জীবন শক্তির তথা বাঙালির আত্মশক্তির। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার জন্যই লোকসাহিত্য সংগ্রহের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। এই কারণেই তিনি ‘ব্যক্তিগতভাবে ছাত্র বয়স থেকেই উদ্যোগী ছিলেন’ লোকসংস্কৃতির উপাদান সংগ্রহ ও বিচার-বিশ্লেষণের জন্য। তার চেয়েও বড় কথা; তিনি ছিলেন ‘অখণ্ড’ ও নিঃশর্ত মনের অধিকারী। যার কারণে তিনি খাঁটি প্রাণের স্পর্শ সন্ধান করেছেন এই লোকসাহিত্যের মধ্যে। তিনি উল্লিখিত ‘অপ্রকাশিত পল্লী গীতি’ শীর্ষক লেখায় বলেছিলেন, এগুলো নির্ভেজাল মন থেকে উৎসারিত হয়েছে বলেই এতে পাওয়া যায় খাঁটি প্রাণের স্পর্শ। খাঁটি প্রাণের স্পর্শের সন্ধান করাই ছিল অদ্বৈতের পল্লি-সম্পদ সংগ্রহের মৌল উদ্দেশ্য। ‘অপ্রকাশিত পল্লী গীতি’ শীর্ষক রচনায় তিনি যে-মন্তব্য করেছিলেন তাতে লোকসাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘নির্ভেজাল মন’ আর ‘খাঁটী প্রাণের স্পর্শ’-র মধ্যেই নিহিত অদ্বৈতের ‘অখণ্ড’ মনের পরিচয়। এটিই অদ্বৈতের মননচিন্তার অন্যতম প্রধান ব্যাপার। এদেশের জল, মাটি, বায়ু, পল্লি-প্রকৃতির প্রতি অদ্বৈতের যে দেশপ্রেম ও দায়বদ্ধতা তা অন্য যেকোনো লেখক ও শিল্পীর থেকে আলাদা। লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও লোকসংস্কৃতির প্রতি তাঁর এই গভীর দরদের কারণ কী—এর জবাব পাওয়া যায় তাঁর ‘পল্লীসঙ্গীতে পালা গান’ নামক রচনায়। যেখানে অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছেন :
ভাটিয়াল গান, বারমাসী গান, মহাজনী গান প্রভৃতি ‘পালা’-গানগুলিও পূর্ববঙ্গের পল্লী অঞ্চলের নিজস্ব সম্পদ। পল্লীর লোক-সাহিত্যের উপকরণ অন্যান্য গান পাঁচালী প্রভৃতি প্রাচীন সম্পদের মত ‘পালা’ গানগুলিও অধুনা লোপ পাইতে বসিয়াছে। নিতান্ত অজ পাঁড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত লোকেদের মেয়েরা এখনো নানা জায়গায় এগুলিকে বাঁচাইয়া রাখিতেছে। পরিশ্রম স্বীকার পূর্বক ঐ সকল জায়গা হইতে এগুলিকে সংগ্রহের চেষ্টা করিলে প্রাচীন বাংলার পারিবারিক জীবনযাত্রার সুখ-দুঃখের অনেকখানি ইতিহাসের যে পুনরুদ্ধার করা যায় ইহাতে সন্দেহ নাই। […] বঙ্গ পল্লীর সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা ইহাদের এক-একটিতে মূর্ত হইয়া রহিয়াছে! আমাদের খাঁটি জাতীয় জীবনের হাসি কান্নায় ইহাদের এক একটি সমুজ্জ্বল। (অদ্বৈত, ২০১১ : ৭৭)।
লোকসাহিত্য বিবেচনায় অদ্বৈত মল্লবর্মণের দৃষ্টিভঙ্গি কতোটা স্বচ্ছ ও স্বতন্ত্র তার পরিচয় মিলে উল্লিখিত এই মন্তব্য থেকে। তিনি লোকসাহিত্যকে ‘পূর্ববঙ্গের পল্লী অঞ্চলের নিজস্ব সম্পদ’ বলে অভিহিত করেছেন। কতোটা মূল্যবান তাঁর এই কথাগুলো—তা সহজেই অনুমান করা যায়। আর কেন তিনি লোকসাহিত্য সংগ্রহ করেছেন বা কেন সংগ্রহ করা জরুরি তাও উল্লেখ করেছেন। কারণ, তিনি মনে করেন : ‘বঙ্গ পল্লীর সুখ-দুঃখ আশা-আকাঙ্ক্ষা ইহাদের এক-একটিতে মূর্ত হইয়া রহিয়াছে! আমাদের ‘খাঁটি জাতীয় জীবনের হাসি কান্নায় ইহাদের এক-একটি সমুজ্জ্বল।’ (অদ্বৈত, ২০১১ : ৭৭) এই মন্তব্যেই পাওয়া যায় তাঁর দরদী মনের পরিচয়। এই ক্ষেত্রেই মিলে লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও বিচার বিশ্লেষণে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, স্বচ্ছতা, স্বতন্ত্রতা ও নির্ভেজাল খাঁটিমন এবং দায়বদ্ধতার পরিচয়—যা তাঁকে অনবদ্য লেখক, সংগ্রাহক ও খাঁটি-দেশনাগরিক হিসেবে পরিচিত করে। লোকসাহিত্য সংগ্রহে অদ্বৈতের দায়বদ্ধতা সবচেয়ে প্রবল ছিল পল্লিসমাজের জন্য। পল্লির অমূল্য এই সম্পদ শিক্ষিত নাগরিক চোখে কতোটা গুরুত্বের দাবি রাখে সেটা তাঁর কাছে প্রাদান্য পায়নি—প্রাধান্য পেয়েছে পল্লিসমাজের প্রতি প্রগাঢ় দায়বদ্ধতা ও গভীর আন্তরিকতা। সে সম্পর্কে তিনি তাঁর ‘দুইটি বারমাসী গান’ শীষক রচনায় লিখেছেন :
শিক্ষিত সমাজের মত মহলা দিয়া বা বৈঠক বা আসর গুলজার করিয়া ওস্তাদি লাইনের গান চর্চা করিবার মত সময়, সঙ্গতি এবং ক্ষমতা তাহদের এতটুকুও নাই। তাহারা গান গায় কাজ করিতে করিতে। গানে যশ লাভের স্বপ্ন তাহাদের মধ্যে খুবই কম। প্রাণের সহজ স্ফূর্তিতে তাহারা আবেগভরে গানগুলি গাহিয়া যায়। তাহাদের ঠিক প্রাণের দাবি অনুযায়ী গান রচনা করিবার ক্ষমতা আমাদের নাই, পল্লীর অজ্ঞাত অখ্যাত নাম-হারা কবিরা গ্রাম্য ভাষায় এবং গ্রাম্য সুরে গ্রাম্য বিষয়বস্তু লইয়া গান রচনা করিয়া গেছে। (অদ্বৈত, ২০১১ : ৭০)।
লোকসাহিত্য কিভাবে সৃষ্টি হয় তা খুব সহজ ভাব ও ভাবে তিনি উপস্থাপন করেছেন। লোকসাহিত্যে কোনো জটিলতা, কুটিলতা নাই কিংবা নাই কোনো খাতি বা যশ লাভের আকাঙ্ক্ষা—আছে কেবল নিঃশর্ত আবেগ এবং ‘প্রাণের সহজ স্ফূর্তি’। অদ্বৈতের এই ভাবনার মূলে ছিল তাঁর গ্রাম নিয়ে প্রবল এক অহংবোধ। গ্রামের শ্রী, শোভা, সৌন্দর্য, ঐশ্বর্য, মাধুর্য এবং প্রাণপ্রাচুর্য সম্পর্কে অদ্বৈত ছিলেন ওয়াকিফ। এই শক্তিই তাঁকে করেছে আত্মশক্তিতে বলীয়ান। অপরদিকে, অদ্বৈতের ‘লোকসাহিত্য সংগ্রহের মনস্তত্ত্বেই প্রান্তজনের রাজনৈতিক-সংস্কৃতির প্রতি সম্পৃক্ততা ও অহং প্রকাশ পায়। সূক্ষ্ম একটা বিরোধ ও গোষ্ঠীগত অহং তিনি নাগরিক জীবনের ভেতর বাঁচিয়ে রাখেন, বাঁচিয়ে রাখেন জনমানুষের সম্পৃক্তার বোধ।’ (সিরাজ : ২০১৪ : ১৩) অদ্বৈতের এই জনমানুষের প্রতি সম্পৃক্ততার বোধ-ই তাঁর মননচিন্তাকে করেছে স্বতন্ত্র। কারণ, তিনি গ্রাম, গ্রামীণ সংস্কৃতি, সৌন্দর্য, শক্তি ও প্রাণপ্রাচুর্যকে এমনভাকে হাজির করেছেন যা গ্রামীণ আত্মমর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত ও নাগরিক শক্তিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখে। তিনি লোকসাহিত্যের মাধমে গ্রামীণ এমন শক্তি ও সংস্কৃতির সন্ধান দিয়েছেন যা বিকল্প জীবনের সন্ধান দেয়। এই বিকল্প জীবনশক্তি ও যাপনপদ্ধতি কেবল নগরকে অগ্রাহ্য করার শক্তি রাখে না, একই সঙ্গে তা উপনিবেশ উত্তর কিংবা বি-উপনিবেশায়ন চিন্তারও প্রস্তাব করে। বঙ্গীয় লোকজীবনের এই সৌন্দর্য, শক্তি ও প্রাণপ্রাচুর্যের সন্ধানের মধ্যদিয়েই লোকসাহিত্য সংগ্রহ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা, অন্যনতার পরিচয় পাওয়া যায়। কারণ, তিনি মনেই করেন এটা অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ। তিনি উল্লেখ করেন : ‘পল্লীর লুপ্ত সম্পদ যিনি যাহা সংগ্রহ করিবেন তাহাই অক্ষত রাখিয়া প্রকাশ করিবেন।’ (অদ্বৈত, ২০১১ : ৭৭) এক্ষেত্রে সবচেয়ে জোর দিয়েছেন ভাষার ‘অক্ষত’ রূপ বিষয়ে। বহুসংগ্রাহক যে নিজের মতো করে, নিজের ভাষায়, নিজের নামে সংগৃহীত গানগুলি চালিয়ে দেয়, সে সম্পর্কেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। সে বিষয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছেন :
পল্লীর গানে বা গাথাগুলি সংগ্রহপূর্বক উহাদের মধ্য হইতে পল্লীবাসীদের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখের ইতিহাসের উদ্ধারের চেষ্টা না করিয়া কোন কোন নামকরা পল্লী কবি সাপ্তাহিক ও মাসিকের পৃষ্ঠায় সেগুলিকে বেমালুম নিজের নামে চালাইয়া দিতেও বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না এমন উদাহরণ বিরল নহে, ইহাতে আর কিছু না হোক রচিয়তাদের প্রতি নিশ্চয়ই অবিচার করা হয়। (অদ্বৈত, ২০১১ : ৭৭)।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের এই কথাটি কতোটা খাঁটি, নির্মম ও সত্য তার প্রমাণ আমরা পাই কবি জসীমউদ্দীনের নিজের স্বীকারোক্তিতেই। জসীমউদ্দীন লিখেছেন :
আমার আর এক রকমের সাহিত্যকর্ম আছে। এগুলি আমার লেখা গ্রাম্য-গান। এই গানের সাহায্যে আমি দেশের, জনগণের মনে প্রবেশ করিতে চাই। গ্রামদেশে ঘুরিতে ঘুরিতে আমি কোথাও দেখিয়াছি কোন গানের প্রথম কলিটি ভারি সুন্দর। কিন্তু পরবর্তী লাইনগুলিতে জনগণের কুসংস্কারকেই রূপ দেওয়া হইয়াছে। আমি সেই গানের প্রথম লাইনটি গ্রহণ করিয়া বাকি লাইনগুলি নিজে রচনা করিয়া দেই। এই ধরনের গান যখন রেকর্ড যন্ত্রে বা জলসায় গীত হয় তাহা জনগণের মনে খুব প্রভাব বিস্তার করে। (জসীমউদ্দীন, ১৯৭২ : ১৪-১৫)।
লোকসাহিত্য বিষয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও জসীমউদ্দীনের এই মন্তব্যগুলো পাশাপাশি রেখে বিচার-বিশ্লেষণ করলে সহজেই ধরা পড়ে অদ্বৈতের দৃষ্টিভঙ্গিও স্বচ্ছতা ও বিবেচনাবোধের নিজস্বতা ও স্বদেশ প্রেমের বিষয়টি। কেননা, অদ্বৈত মল্লবর্মণ ও জসীমউদ্দীন দুজনই বাংলা লোকসাহিত্যের অন্যতম সংগ্রাহক। অদ্বৈতের কাছে যা ‘পল্লীবাসীদের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখের ইতিহাস’ জসীমউদ্দীনের কাছে তা-ই ‘সুন্দর’ ও ‘জনগণের কুসংস্কার’। পল্লির সাধারণ মানুষের জীবন থেকে উৎসারিত অমূল্য এই সম্পদকে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়াকে অদ্বৈত মনে করেছেন ‘অবিচার’ আর জসীমউদ্দীনের কাছে তা ‘দেশের জনগণের মনে’ প্রবেশের হাতিয়ার। পল্লির লুপ্ত-সম্পদ সংগ্রহে অদ্বৈত মল্লবর্মণ যে ‘অক্ষত’ রেখে প্রকাশের কথা বলেছিলেন তা কতোটা দূরদৃষ্টসম্পন্ন চিন্তা তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলার প্রবাদপ্রতিম লোকসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯১২-১৯৮৭)-এর কথায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর গানের বাহিরানা (১৯৯৮) বইয়ে উল্লেখ করেছেন, লোকসংগীতের কোনো কিছু পরিবর্তন বা পরিমার্জন করলে যেমন সুর, তাল, লয়-এর ছন্দপতন ঘটে, ঠিক তেমনি জল, মাটির গন্ধও হারিয়ে যায়। লোকসংগীতের মূল চরিত্র হলো আঞ্চলিকতা। গায়কীর কাছে তা যেন শিশুর মাতৃভাষা শেখার মতোই ‘ব্যাকরণহীন’। এ প্রসঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন :
চারিদিকের কর্ম-জীবন, মাটি, জল, রোদ, বৃষ্টি, পাহাড়পর্বত সামগ্রিকভাবে হলো লোকসংগীতজ্ঞের শিক্ষকহীন শিক্ষালয়। […] অনেক শহুরে-সুকণ্ঠ লোক সংগীতের melodic structure-টা সুরের কাঠামোটা ঠিকই আয়ত্ত করতে পারেন—কিন্তু তবু আঞ্চলিকতার সেই কণ্ঠভঙ্গীটি আয়ত্ত করতে না পারাতে তাঁদের গানে কাদামাটিহীন পরিচ্ছন্নতায় মাটির গন্ধটি—অর্থাৎ জনজীবন-ঘনিষ্ঠতাটি হারিয়ে যায়। […] কিন্তু ভাটিয়ালী বা ভাওয়াইয়া সুরের সত্যিকারের শিল্পী যখন সুরে টান দেন তখন তাঁর মানসচক্ষে যে জনপদের, যে প্রকৃতি ও প্রান্তরের ছবি ভেসে ওঠে তা সুস্পষ্ট এবং তার communication বা ভাবানুষঙ্গটিও সর্বজনীন। সেখানে ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’, মৈষাল বন্ধু’ বা ‘গড়িয়াল ভাই’ কথাগুলো না থাকলেও চলে, শুধু সুরের মধ্যে যে association বা অনুষঙ্গ তার অনুভূতি সর্বজনীন। সেখানে যে আর্তি, তাতে পাই শ্রমজীবী মানুষের একটানা বঞ্চনার অভিব্যক্তি। সেখানে মিশে থাকে ঘাম এবং কান্না আবার জীবনের অসীম আকুতি ও আশাবাদ। (হেমাঙ্গ, ১৯৯৮ : ১২৪-১২৫)।
ফলে, একথা স্পষ্ট যে লোকসংগীতের কোনোরূপ পরিবর্তনন-পরিমার্জন কাম্য নয়। লোকসংগীতকে ‘অক্ষত রেখে’ সংগ্রহের যে কথা অদ্বৈত বলেছিলেন তার মর্মবাণীই যেন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। খেয়াল করার বিষয় হলো, অদ্বৈত কোনো লোকসংগীত শিল্পী বা কোনো পেশাদারী লোকসংগ্রাহক কিংবা লোক-গবেষক না হয়েও যে স্বচ্ছতা, সচেতনা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন তা কেবল প্রশংসার দাবিদার নয়—অনুসরণীয়ও বটে। তাই তিনি এই বিষয়ে সংগ্রাহকদের অসচেতনতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ত্রিপুরার ‘জলভরা’ গান কিভাবে ‘জলভরণী’ হয়ে যায় সে দৃষ্টান্তও৪ দিয়েছেন। কারণ, লোকসাহিত্যকে ‘অক্ষত রেখে’ উদ্ধার করতে না পারলে ঘটে বিকৃতি। ফলে মাটি, জল ও জনজীবনের ঘনিষ্ঠতা হারিয়ে যায়। লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির এই বিকার-বিকৃতি নানাভাবে-নানারূপে প্রতিনিয়ত ঘটছে। লোকসংগীতের এই বিকৃতি প্রসঙ্গে শিল্পী খালেদ চৌধুরী লিখেছেন :
এই গ্রামীণ স্তর থেকে লোকসংগীতকে সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রায়শই এর বিকৃতি ঘটছে। বিকৃতি ঘটছে কথায়, বিকৃতি ঘটছে সুরে। কখনও ইচ্ছাকৃত। লোকভাষাকে ফেলে দিয়ে গানকে শহুরে করে তোলার জন্য ব্যবসায়িক কারণে মার্জিত করা হচ্ছে। কখনও ডায়ালেক্ট না বুঝে নিজের কথা বসিয়ে দেবার জন্যও বিকৃতি ঘটছে। অর্থাৎ অজ্ঞতার কারণেও বিকৃতি হচ্ছে। (খালেদ, ২০০৪ : ০৫)।
কিন্তু তারপর প্রতিনিয়ত ঘটছে লোকসংগীতের বিকৃতি। নানারূপে, নানানস্বার্থে, কারণে-অকারণে ঘটছে-ঘটাছে লোকসংগীতের যে বিকৃতি তার নমুনা বহজন৫ দেখিয়েছেন। লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ে জসীমউদদীন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও খালেদ চৌধুরীর প্রসঙ্গ এখানে উপস্থাপন করলাম এই কারণেই যে, কোনো একটি ‘স্থায়ী মহৎ ও বৃহৎ’ উপন্যাস রচনার পরিকল্পনায় নয়—নয় কোন সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গে ব্যবহারের জন্য। অদ্বৈত মল্লবর্মণের লোকসাহিত্য সংগ্রহ করেছিলেন সমাজের ও দেশের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা থেকে, গ্রামীণ জীবনের প্রাণপ্রাচুর্যকে সংরক্ষণের জন্য, নাগরিক জীবনের বাইরে গ্রামীণ বিকল্প জীবনের সন্ধান দিতে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বাইরে প্রাচ্যসংস্কৃতির শক্তি প্রমাণ দিতে আর খাঁটি প্রাণের স্পর্শের সন্ধানে। কারণ, লোকলোকসাহিত্য সংগ্রহে দরকার হয় জনজীবনরে সঙ্গে গভীর গভীরতর ঘনিষ্ঠতা, কঠোর অধ্যাবসায়, গভীর অন্তর্দৃষ্টি, দরদী ও নির্মল মন। সংগ্রাহক হিসেবে তিনি যে পরিশ্রম স্বীকার করেছেন, দেশপ্রেম ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। তিনি সে কারণে বিশিষ্ট গবেষক দেবীপ্রসাদ ঘোষ লিখেছেন :
মাত্র বাইশ বছর বয়সে লোক সংস্কৃতি বিষয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণ কী গভীর অনুসন্ধানী ছিলেন। বর্তমান সময়ে একাজ যতটা সহজ ও প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে, আজ থেকে পঞ্চাশেরও বেশি বছর আগে সেটা ছিল দুরূহ। এবং প্রতিষ্ঠানের বাইরে বসে কাজের ধারাকে অক্ষুণ্ন রাখাকে নিতান্ত বিলাস ছাড়া আজ আর কিছু মনে হতে পারে না। সৌভাগ্যের বিষয় অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছিলেন ঠিক এর বিরোধী। দেশজ গবেষণাধর্মী বিষয় নিয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল যথেষ্ট। (দেবীপ্রসাদ, ২০০৮ : ৭৯)।
দেশজ বিষয় নিয়ে অদ্বৈতের উৎসাহ ও আগ্রহ যথেষ্ট বললে বরং খানিক কম বলা হয়; কেননা, তাঁর আগ্রহ ও উৎসাহ ছিল আজকের কালের বিচারে নয়, সে কালের বিচারেও বিষ্ময়কর ও অনুকরণীয়। কারণ তিনি দেবীপ্রসাদ ঘোষের মত লোকসাহিত্যকে কেবল ‘দেশজ গবেষণাধর্মী’ বিষয় ভাবেননি, ভেবেছেন আমাদের ‘জাতীয় জীবনের অমূল্য সম্পদ’ হিসেবে। আর তিনি ক্ষেত্রসমীক্ষা, ক্ষেত্রগবেষণা, সূত্রের সাহায্যে উপস্থাপন ও তথ্যপঞ্জি তৈরিতে যে অনন্যতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে, তাঁকে ‘স্বতন্ত্র লোকসংস্কৃতিবিদ হিসাবে গ্রহণ করতে, স্বীকার করতে বাধ্য করেছে’ (অচিন্ত্য, ২০১৪ : ৩৮) বলেও অনেকে মনে করেন। তবে, তিনি ‘স্বতন্ত্র লোকসংস্কৃতিবিদ’—এই ধরনের অভিধায় অভিহিত কিনা সেটা বড়কথা নয়—বড় কথা হলো লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও লোকসংস্কৃতি বিবেচনায় তাঁর স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি, মেজাজ-মর্জি ও স্বতন্ত্রতার পরিচয়। লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও লোকসংস্কৃতি বিবেচনায় তাঁর চেতনাভূমি হিসেবে কাজ করেছে গভীর গভীরতর স্বদেশপ্রেম। এক্ষেত্রে পাওয়া যায় অদ্বৈতের নিঃশর্ত, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, দেশ-কালের প্রতি গভীর দায়বোধসম্পন্ন ও বিচার বিশ্লেষণে প্রাজ্ঞ মন-মননের পরিচয়—যা তাঁর ‘অখণ্ড’ মননচিন্তারই উৎসভূমি।
ছয়.
অদ্বৈত সব থেকে সচেতন ছিলেন তাঁর নিজের সম্পর্কে। নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা ছাড়া আত্মপরিচয় সম্পর্কে বলবান হওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)-এর পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬) নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণের মন্তব্যটি তাঁর আত্মপরিচয়ের সব থেকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অদ্বৈত মল্লবর্মণের বন্ধু সুবোধ চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন :
প্রথম যখন পাণ্ডুলিপি জমা দিয়েছিলেন, আমি বলেছিলাম—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ আর কি তোমার বই মানুষ নেবে?’ বলেছিলেন অদ্বৈত : ‘সুবোধদা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বড় artist, master artist, কিন্তু বাওনের পোলা—রোমান্টিক। আর আমি তো জাউলার পোলা’ আর কিছু বলেননি। পরিচয়ের এই প্রত্যক্ষতাই ছিল তাঁর গৌরবের ভিত (সুবোধ, ১৯৯৪ : ২৭)।
নিজের সস্পর্কে এরকম পরিচ্ছন্ন ধারণা খুব কম মানুষেরই থাকে। নিজেকে ‘জাউলার পোলা’ হিসেবে পরিচয় দিতে তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন। সে কারণেই হয়তো নিজে গা ভাসিয়ে দেননি রোমান্টিক ভাবমানসে কিংবা কোনো তত্ত্ব বা মতাদর্শে। তাই তো সাইত্রিশ বছরের চিরকুমার তরুণ হয়েও প্রেম, ভালোবাসা, কাম, ঈর্ষা কিংবা ব্যক্তিগত ক্ষোভ, ব্যথা-বেদনায় মধুর করে তোলেননি তাঁর সৃষ্টিকর্মকে। ‘জাউলার পোলা’ বলে নিজেকে জানতেন বলেই নাগরিক গোষ্ঠীবদ্ধ শিল্প-সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে নিজেকে জাহির কিংবা আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাকুলতা দেখাননি। তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মে নৈর্ব্যক্তিকভাবে উপস্থাপন করেছেন সমষ্টিকে। কারণ, তাঁর ছিল দূরদর্শী ও কল্যাণকামী সমষ্টির বোধ। তাই ‘জাউলার পোলা’ হয়েও একদিকে যেমন আত্মপরিচয়ে দ্বিধাহীন, অন্যদিকে স্বদেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ তাঁর মননভূমি। শরীরের জল ও কাদা মাটির ঘ্রাণকেই করেছেন শিল্পের উপজীব্য। ফলে তাঁর সৃষ্টিকর্ম হয়েছে কৃত্রিমতাবর্জিত ও সামষ্টিক জীবনের মুক্তি প্রয়াসী। আমরা একটি চিঠিতে তাঁর সেই আত্মপ্রত্যয়ের আভাস পাই, যেখানে তিনি অন্যজনকে (কবি মতিউল ইসলামকে লিখিত পত্রে; তারিখ ২৮ শে বৈশাখ ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ) লিখেছেন :
কাহাকেও follow করিবেন না। সর্ব্বদা সর্ব্বত্র আপন ব্যক্তিত্ব, বৈশিষ্ট্য এবং স্বতন্ত্র বজায় রাখিয়া চলিবেন। অনুসরণ এবং অনুকরণ-এর প্রভেদটুকু আপনি অবশ্যই জানেন। আপনি মধুসূদনের Blank Verse-এর অনুসরণ করিতে পারেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অতীন্দ্রিয়তা বা মরমীবাদ বা Mysticism-এর অনুকরণ করিলে ইহা দোষের কারণ হইবে। আর একটি মাত্র কথা বলিয়াই চিঠি শেষ করিব। সাধনা না করিয়া আত্মপ্রকাশ করিতে নাই। আর যাহা সাধনা করিবেন নীরবে নীরবেই করিবেন। আগুন কখন ছাই ঢাকা থাকে না। আপনার প্রতিভাও একদিন সুধীজন সমাজে আদৃত হইবে। ইহা আমি জোর করিয়াই বলিতে পারি। (অদ্বৈত, ২০১১ : ১৩২)।
অদ্বৈত মল্লবর্মণের মননচিন্তা যেন কবি শঙ্খ ঘোষের বাবরের প্রার্থনা (১৯৭৬) কাব্যের ‘মহাজন’ কবিতারই প্রতিধ্বনি—‘কথা বলেই বা কী হচ্ছিল/ না-ই বললেন কথা—/ চুপচাপ থেকে দেখুন না আজ/কদ্দুর যায় রথ। […] তারপরে কোনো শুভদিন এলে/ সময় লগ্ন বুঝে/ছড়িয়ে দেবেন স্ফুলিঙ্গ কিছু/কিছু ওঁ তৎসৎ।’ (শঙ্খ ঘোষ, ২০০৬ : ৫৬) অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাহিত্য ও সাহিত্যচিন্তা ঠিক স্ফুলিঙ্গ হয়েছে কিনা তা বলা মুশকিল। কিন্তু আজকের দ্বিধাগ্রস্ত ও গন্তব্যহীন সমাজে যে অগ্নিদিশারূপে প্রজ্জ্বলমান তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। শিল্পের মান অক্ষুণ্ন রেখে, তিনি এই স্বদেশ ও স্বভূমিকে যে অকৃত্রিমভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বাংলা সাহিত্যে তার জুড়ি মেলা ভার। অদ্বৈতের ছিল ভেতর থেকে দেখার দৃষ্টি আর ‘অখণ্ড’ ও নিঃশর্ত মানব-মন, যা সর্বকালে, সবদেশেই দুর্লভ।
টীকা
১. অভিজিৎ ভট্ট ও মিলনকান্তি বিশ্বাসের এর সম্পাদনায় দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় অগ্রন্থিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ নামক গ্রন্থটি। অগ্রন্থিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ নামক বইয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণের অনেক নতুন রচনার সন্ধান পাওয়া যায়। এখানে সংকলিত অগ্রন্থিত লেখাগুলি হলো : কবিতা ১২টি, গল্প ৪টি, রম্যরচনা ২টি, ১টি, মোট : ১৯টি। সম্পাদকদ্বয়ের দাবি, ‘মোট লেখার এক তৃতীয়াংশ অগ্রন্থিত অবস্থা থেকে সংকলিত হচ্ছে। আর এই অগ্রন্থিত ১৯টি লেখার মধ্যে ১৩টির প্রথম প্রকাশ ঘটেছে প্রাক্-কলকাতা পর্বে বা কলকাতায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে। এর মধ্যে আছে ১১টি কবিতা, ১টি রম্যরচনা এবং ১টি প্রবন্ধ। বিষয়বস্তুও দিকে তাকালে সবকটিতেই পল্লিজীবন ও পরিবেশকে পাওয়া যায়, কোথাও শহরকে বা শহুরে মানসিকতাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।’ (অদ্বৈত, ২০১৬ : ১৬)
২. অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবৎকালে প্রকাশিত একমাত্র মুদ্রিত গ্রন্থ হলো ভারতের চিঠি—পার্লবাককে। কিন্তু এটি কী ধরনের রচনা? পাঠকের মনে এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। কারণ, অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্র (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ : ২০০০ এবং পুনর্মুদ্রণ : ২০১১)-এর সম্পাদক অচিন্ত্য বিশ্বাস এই গ্রন্থটিকে সূচিপত্রে ‘কথাসাহিত্য’ অংশে রেখেছেন। আর ভূমিকায় (পৃষ্ঠা. ১২-১৩) উল্লেখ করেছেন,‘‘ ‘ভারতের চিঠি পার্ল বার্ককে’ : সাংবাদিক অদ্বৈতের সার্থক রচনা। এটি রিপোর্টাজ ধরনের লেখা।’’ অপরদিকে অচিন্ত্য বিশ্বাস রচিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ (সাহিত্য অকাডেমি, নতুন দিল্লি, প্রথম প্রকাশ : ২০০৬, দ্বিতীয় মুদ্রণ : ২০১৪, পৃষ্ঠা. ৪০-৪১) নামক জীবনীগ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘‘অদ্বৈত মল্লবর্মণের অন্য একটি রিপোর্টাজ জাতীয় রচনা— ‘ভারতের চিঠি—পার্ল বাককে’; তাঁর জীবৎকালে প্রকাশিত একমাত্র মুদ্রিত গ্রন্থ।’’ এবং ভারতের চিঠি—পার্লবাককে গ্রন্থটির নামের বানানের দ্বৈততাও চোখে পড়ার মতো। গবেষক মোঃ সাহাবউদ্দিন (২০১৪) তাঁর এক গবেষণা প্রবন্ধে (সহায়ক প্রবন্ধ তালিকায় উল্লেখিত প্রবন্ধ) লিখেছেন, ‘ভারতের চিঠি-পার্লবাককে একটি পত্র বা চিঠি প্রবন্ধ’ আর তাঁর গবেষণার শিরোনামেও( শিরোনাম : অদ্বৈত মল্লবর্মণের পত্র-প্রবন্ধ ভারতের চিঠি পার্ল বাককে : একটি উত্তর-উপনিবেশবাদী রচনা) তা স্পষ্ট করেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাবলী (জন্মশত বর্ষ সংস্করণ, সূচীপত্র, ২০১৫)-এর সম্পাদক ইসরাইল খান সূচিপত্রে ভারতের চিঠি—পার্লবাককে গ্রন্থটিকে ‘প্রবন্ধ’ অংশে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
৩. অধিকাংশ গবেষক-সমালোচক উল্লেখ করেছেন, ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবৎকালে প্রকাশিত একমাত্র মুদ্রিত গ্রন্থ হলো ভারতের চিঠি—পার্লবাককে।’ কিন্তু এর প্রকাশ সাল নিয়ে ভিন্নমত লক্ষণীয়। অচিন্ত্য বিশ্বাস অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্র -এর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, ‘‘প্রথম সংস্করণ প্রকাশ পায় ১৯৪৩ নাগাদ। প্রকাশকাল প্রকাশকরা দেননি; আভ্যন্তরীণ সূত্রে কালটি অনুমান করা যায় সহজেই। পঞ্চাশের মন্বন্তরের চিত্র গ্রন্থমধ্যে বিদ্যমান। আছে ২২ জুন ১৯৪১ তারিখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার ‘আচমকা ও আকস্মিক’ যোগদান ও তার ‘সুদূর প্রসারী’ ফলের কথা। বইখানা এক হিসাবে অদ্বৈত মল্লবর্মণের প্রথম ও জীবিতকালে প্রকাশিত একমাত্র গ্রন্থ। বন্ধুদের সঙ্গে মিশে অদ্বৈত একটি প্রকাশন সংস্থা গড়ে তোলেন—চয়নিকা পাবলিসিং হাউস; ঠিকানা ৪২ সীতারাম ঘোষ স্ট্রীট। ১৯৪১ নাগাদ সতী নাগ, সনৎ নাগ-এর সঙ্গে এই প্রকাশন সংস্থা গড়ে ওঠার পর ‘দলবেঁধে’ শীর্ষক গল্পের সংকলন প্রকাশ করা হয়। সনৎবাবু মারা গেলে ‘সনৎ স্মৃতি সিরিজ’ বের হয়—তার প্রথম বই ‘ভারতের চিঠি—পার্লবাককে’।’’ কিন্তু তপোধীর ভট্টাচার্য তাঁর রচিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ (২০০০) নামক গ্রন্থে দাবি করেছেন, ‘মোটামুটি এই সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে পরাধীন দেশের বিপন্নতা ও দুর্বিষহ বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল অদ্বৈত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চেতনার যুগলবন্দি প্রেরণায় এই বইটি লিখেছিলেন ১৯৪৪ সালের কাছাকাছি সময়ে।’ তবে পরবর্তীতে সকলেই অচিন্ত্য বিশ্বাসের উপস্থাপিত যুক্তিকেই মান্য করে ভারতের চিঠি—পার্লবাককে গ্রন্থটির প্রকাশ সাল ১৯৪৩ হিসেবে গ্রহণ করেন।
৪. অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছেন, ‘‘উদাহরণ স্বরূপ বলা যাইতে পারে, ত্রিপুরা জেলার বহু স্থানে গীত একটি ‘জলভরা’ গান কোন পল্লী কবি কোন এক তৃতীয় শ্রেণীর সাপ্তাহিকের পৃষ্ঠায় ‘জলভরণী’ নামে ল্যাজমুড়া ছাঁটিয়া উহার সহিত রচয়িতা হিসাবে নিজের নাম সংযোগ করিয়া চালাইয়া দিয়াছেন।’’ (অদ্বৈত, ২০১১ : ৭৭)
৫. বাংলা লোকসংগীতের বিকার-বিকৃতির প্রসঙ্গ বহু শিল্পী-গবেষক তথ্য-প্রমাণসহ উপস্থাপন করেছেন। এক্ষেত্রে আমরা অনন্ত তিনজনের কথা উল্লেখ করতে চাই। গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯১২-১৯৮৭) তাঁর গানের বাহিরানা (১৯৮৮) নামক বইয়ে দেখিয়েছেন, ভাষা, শব্দ পরিবর্তন-পরিমার্জন করার ফলে কিভাবে লোকসংগীতের বিকার-বিকৃতি ঘটে তা রাগরূপ, গীতরীতি, উপভাষা, উপমা, ও উচ্চারণসহ নানা বিষয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। অপরদিকে শিল্পী খালদ চৌধুরী তাঁর লোকসংগীতের প্রাসঙ্গিকতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০৪) নামক বইয়ে দেখিয়েছেন, ব্যক্তিস্বার্থে লোকসংগীতকে সংগ্রাহক কিভাবে সামান্য পরিবর্তন-পরিমার্জন করে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ায় দেহতত্ত্বের গান প্রেমের গান হয়ে যায়। অপরদিকে, গবেষক মোস্তাক আহমাদ দীন তাঁর ‘জসীম উদ্দীন’ (উৎস : উলুখাগড়া, সম্পাদক : সিরাজ সালেকীন, সংখ্যা : ২৩ ॥ এপিল-জুন ২০১৭) নামক প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, লোকসংগীতের সংগ্রাহক জসীমউদ্দীন তাঁর সংগৃহীত শেখ ভানুর রচনা ও শচীন দেববর্মণের-গাওয়া ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে’ গানটি সামান্য পরিবর্তন-পরিমার্জন করে নিজের নামে ‘গ্রাম্য-গান’ হিসেবে উপস্থাপন করায় মূল ভাব ও সুর থেকে কিভাবে বিকৃত হয়েছে।
সহায়কপঞ্জি
অচিন্ত্য বিশ্বাস (২০১৪), অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সাহিত্য অকাডেমি, নতুন দিল্লি, ভারত।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ (২০১১), অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাসমগ্র, সম্পাদনা : অচিন্ত্য বিশ্বাস, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ (২০১৬), অগ্রন্থিত অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সম্পাদনা : অভিজিৎ ভট্ট ও ড. মিলনকান্তি বিশ্বাস, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ (২০১৫), অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচনাবলী (অখণ্ড), জন্মশতবর্ষ সংস্করণ, সংগ্রহ ও সম্পাদনা : ইসরাইল খান, সূচীপত্র, ঢাকা।
অনীক মাহমুদ (২০০৫), ‘চর-ভাঙ্গা চর : নদী ও জীবন’, উলুখাগড়া, (সম্পাদক : সৈয়দ আকরম হোসেন), বর্ষ : ০১ ॥ সংখ্যা : ০১, ঢাকা।
ইসরাইল খান (২০০৮), অদ্বৈত মল্লবর্মণ : জীবন ও কর্ম, সূচীপত্র, ঢাকা।
কায়েস আহমেদ (২০০১), কায়েস আহমেদ সমগ্র, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।
খালেদ চৌধুরী (২০০৪), লোকসংগীতের প্রাসঙ্গিকতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা।
গিয়াস শামীম (২০০২), বাংলাদেশের আঞ্চলিক উপন্যাস, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
জসীমউদ্দীন (১৯৭২), যে দেশে মানুষ বড়, পলাশ প্রকাশনী, ঢাকা।
তপোধীর ভট্টাচার্য (২০০০), অদ্বৈত মল্লবর্মণ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা।
দেবীপ্রসাদ ঘোষ (২০০৮), অদ্বৈত মল্লবর্মণ : একটি ভিন্ন প্রতিস্রোত, গাঙচিল, কলকাতা।
দেবেশ রায় (২০০৩), উপন্যাস নিয়ে, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
ফয়েজ আলম (২০০৬), উত্তর-উপনিবেশী মন, সংবেদ, ঢাকা।
বিশ্বজিৎ ঘোষ (২০০৫), ‘তিতাস একটি নদীর নাম : জল ও জীবনের বিকল্প নন্দন’, উলুখাগড়া, (সম্পাদনা : সৈয়দ আকরম হোসেন), বর্ষ : ০১ ॥ সংখ্যা : ০১, ঢাকা।
মোস্তাক আহমেদ দীন (২০১৭), মাটির রসে ভেজা গান, চৈতন্য প্রকাশন, সিলেট।
মোঃ সাহাবউদ্দিন (২০১৪), ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণের পত্র-প্রবন্ধ ভারতের চিঠি পার্ল বাককে : একটি উত্তর-উপনিবেশবাদী রচনা’, বঙ্গবিদ্যা, (সম্পাদক : মো. আতাউর রহমান), বর্ষ : ০১ ॥ সংখ্যা ০১, বাংলা গবেষণা সংসদ, বাংলা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।
শঙ্খ ঘোষ (২০০৬), বাবরের প্রার্থনা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।
শান্তনু কায়সার (১৯৯৮), অদ্বৈত মল্লবর্মণ : জীবন, সাহিত্য ও অন্যান্য, নয়া উদ্যোগ, কলকাতা।
সিরাজ সালেকীন (২০১৪), ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ : জীবন যখন সাহিত্য’, সাহিত্য পত্রিকা, (সম্পাদক : বেগম আকতার কামাল), বর্ষ : ৫২॥ সংখ্যা : ০১, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
সুবোধ চৌধুরী (১৯৯৪), ‘খাঁটি সোনা তাই ভেঙ্গে গেল’, চতুর্থ দুনিয়া, [দলিত সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ক ত্রৈমাসিক], মুখ্য সম্পাদক : অচিন্ত্য বিশ্বাস, দ্বিতীয় সংকলন, অদ্বৈত মল্লবর্মণ বিশেষ সংখ্যা, কলকাতা।
সুশান্ত হালদার (১৯৯৪), ‘তিতাস একটি গ্রন্থের নাম’, চতুর্থ দুনিয়া, [দলিত সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ক ত্রৈমাসিক], মুখ্য সম্পাদক : অচিন্ত্য বিশ্বাস, দ্বিতীয় সংকলন, অদ্বৈত মল্লবর্মণ বিশেষ সংখ্যা, কলকাতা।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস (১৯৯৮), গানের বাহিরানা [সংকলিত সংগীত-বিষয়ক রচনা], সম্পাদনা : মৈনাক বিশ্বাস, প্যাপিরাস, কলকাতা।