
বাংলা বিপ্লবী উপন্যাসের ধারা
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বদেশী আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। অগ্নিযুগ হিসেবেই যেটি বেশি পরিচিত। এই অধ্যায়কে এড়িয়ে ভারতের স্বাধীনতার অপূর্ণ ও অসম্পন্ন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুগান্তকারী হিসেবে বিবেচিত স্বদেশী আন্দোলন। পরাধীন দেশে শাসকের বিরুদ্ধে যেকোনো ধরণের সাহিত্য সৃষ্টি মানেই বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দেয়া। এর ফলে লেখককে যে কোন ধরণের মূল্য দেবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হতো। ফলে অন্য যে কোন সাধারণ সময়ের চেয়ে এ সময়ের সাহিত্য যেমন অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এসব সাহিাত্যকরাও জাতির কাছে চির সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হন।
পরাধীনতার যন্ত্রণার বিষাক্ত ছোবলে নানামাত্রিক সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, অগ্নিফসলের মতো, যা বুলেটের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল। বাংলার প্রায় সব প্রধান লেখকই সে-অগ্নিকালকে ধারণ করে সাহিত্যে আগুনের ফসল ফলিয়েছেন, আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত করেছেন দৃঢ় প্রত্যয়, অপ্রতিরোধ্য জাগরণ। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে সে-সত্য প্রতিষ্ঠিত। তবে সে সময়ে আন্দোলনের ধারা একরৈখিক ছিল না। একদিকে অহিংস বা আপোসকামিতা, অন্যদিকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পরাধীনতা থেকে মুক্তির পন্থা সুনির্দিষ্ট। ধারা দুটি স্পষ্ট। সাহিত্যসৃষ্টিতেও তা লক্ষণীয়। কবিতা, নাটক বা প্রবন্ধে অথবা গল্পে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যেভাবে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে, সে-তুলনায় উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে তুলনামূলকভাবে কম। তখনকার প্রধান লেখকদের মধ্যে এক্ষেত্রে উদাসীনতা বা নীরবতার ব্যাপারটিও সহজেই অনুমানযোগ্য।
স্বদেশী আন্দোলন মূলত গড়ে উঠেছিল আত্মশক্তির ভিত্তির উপর নির্ভর করে। এই আন্দোলন ব্রিটিশশাসিত ভারতের প্রথম ব্যাপক জাতীয় আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। সেসময়ের কবি-সাহিত্যিকরাও কলমের মাধ্যমে এই আন্দোলনকে আরো তীব্র ও গতিশীল রূপদান করেছিল। ফলে সেসব সৃষ্টি অগ্নিময়কে ধারণকে নির্মির্তি পায়। সব দেশেরই যে কোন ক্রান্তিকাল-দুঃসময়-যুদ্ধ-বিগ্রহ-পরাধীনতার যন্ত্রণা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের ব্যাপকভাবে নাড়া দেয়। সেই যন্ত্রণাই তাদের সৃষ্ট সাহিত্য ও শিল্পকর্মে রূপ নেয়। আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। সাহিত্যে এসছিল নতুন রূপ ও ভিন্নতর গতি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্বদেশী আন্দোলনও সাহিত্যের একটি বিরাট অধ্যায় হয়ে উঠেছিল। অসংখ্য কবিতা-গল্প-নাটক-উপন্যাস-প্রবন্ধ রচিত হয়েছে স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। পত্রিকা প্রকাশ হয়েছে এই আন্দোলনকে ধারণ করে। ফলে স্বদেশী আন্দোলন সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি বদলিয়ে নতুন এক অধ্যায় ও ধারা তৈরি করেছিল। স্বদেশী আন্দোলনে প্রবল গতি সৃষ্টি করেছিল বঙ্গভঙ্গ। বঙ্গভঙ্গ বাঙালীর জীবনে বিরাট এক আঘাত, যা সাহিত্যিকের চিন্তা-জগতেও বিশাল এক পরিবর্তন ঘটায়। জাতির সংকট তাঁদের ভাবিত করে। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরাও অনুধাবন করেন জাতির এই সংকটে বিপ্লব ঘটানো অনিবার্য ও অপরিহার্য। এ ভাবনা থেকেই লেখকরা তাঁদের সাহিত্যকর্মে বিপ্লবী মনোভাব সৃষ্টি করে সাধারণ যুবকদের চেতনায় আগুন জ্বালিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের সাহিত্যকর্মে সুনির্দিষ্ট একটা ম্যাসেজ ছিল। সেসময় গতানুগতিক সাহিত্যকর্ম পাঠকের কাছে অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে যে সাহিত্য অগ্নিবারুদের মতো কাজ করে, সেই সাহিত্যই তাঁদের কাছে কাঙ্ক্ষিত ও আদরণীয় হয়ে উঠেছিল। কারণ এটা ছিল সময়ের প্রয়োজন।
এসব সাহিত্য বিপ্লবীদের যেমন অনুপ্রাণিত করেছিল, তেমনি ইতিহাসের স্বাক্ষর হিসেবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই অগ্নিসময়ে স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাহিত্যকর্ম করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অমৃতলাল বসু, রজনীকান্ত সেন, গোবিন্দচন্দ্র রায়, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, কার্তিকচন্দ্র দাশগুপ্ত, সতীনাথ ভাদুড়ি, প্রমথনাথ রায় চৌধুরী, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী এবং সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের সাহিত্যসৃষ্টি যুবসমাজের মধ্যে স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল। ফলে যুবসমাজ ব্যাপকভাবে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছিল। ভারতকে মুক্ত করাই ছিল তাদের একমাত্র প্রতিজ্ঞা। ভারতমুক্তির জন্য তারা হাসতে হাসতে মৃত্যুর সোপানে জীবন লিখে দিয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী বেশ কিছু উপন্যাস সৃষ্টি হয়েছে। সে-সব উপন্যাস বিপ্লবীদের কাছে ‘ধর্মগ্রন্থে’র মতো পবিত্রতা পেয়েছিল।
স্বদেশী আন্দোলনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস রচনা করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ রাজনৈতিক উপন্যাস না হলেও কালের যাত্রায় রাজনৈতিক উপন্যাসের তিলকটিই এ-উপন্যাসের কপালে লেগে গেছে। বঙ্কিমচন্দ্র সচেতনভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পূর্ণাঙ্গ কোন উপন্যাস রচনা করেননি। উপন্যাসের নাম ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮৪)। স্বদেশী প্রেক্ষাপটে রচিত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ একদিকে সাহিত্যিক-চিত্তে যেমন আলোড়ন তৈরি করেছিল, তেমনি বিপ্লবীদের বিপ্লবী-দীক্ষা নিতেও উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই উপন্যাসের মাধ্যমেই বঙ্কিমচন্দ্র নিজেকে ‘জাতিসংগঠক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এই উপন্যাসে ব্যবহৃত ‘বন্দেমাতরম্’ গানটি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ১৮৯৬ সালে সর্বপ্রথম ‘বন্দেমাতরম্’ গানটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্থান পায়। এছাড়া ১৯০৫ সালে সংগঠিত স্বদেশী আন্দোলনকে ‘বন্দেমাতরম্’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ ব্যবহৃত গান ‘বন্দেমাতরম্’-এর অনুসারে। দেশকে মা বলে মনে করে স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে এ গানটি একটির অবদান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে-বাইরে’ (১৯১৬), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৭৬-১৯৩৮) ‘পথের দাবী’ (১৯২৬) কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) ‘কুহেলিকা’ (১৯৩১)- এই তিনটি উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের স্বদেশী আন্দোলনভিত্তিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রটিশশাসিত ভারতবর্ষের নানামাত্রিক আন্দোলন ও ইংরেজের দুঃশাসন সেসময় অনেক লেখকের রক্ত-কালিতে ফণা হয়ে ফুটে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের গল্পে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন কখনো কখনো জায়গা করে নিলেও উপন্যাস হিসেবে পাওয়া যায় ‘ঘরে-বাইরে’। স্বদেশী আন্দোলনকে ঘিরে এ উপন্যাস রচিত হলেও রাজনৈতিক পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস হিসেবে এটিকে অভিহিত করা যায় না। কারণ স্বদেশী আন্দোলনের প্রকৃত স্বরূপ এ উপন্যাসে ধরা পড়েনি। সন্দ্বীপের ভেতর দিয়ে স্বদেশী আন্দোলন বরং এখানে বিকৃত রূপ লাভ করেছে। স্বদেশী আন্দোলনকে ব্যবহার করে নিজে নেতা হয়ে উঠতে চেয়েছেন- যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ বড় হয়ে উঠেছে। স্বদেশী আন্দোলনের নেতাদের চরিত্রের সঙ্গে যা কোনভাবেই যায় না। কারণ তাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থ তো দূরে থাক, নিজের জীবনের চেয়েও দেশের স্বাধীনতালাভ তাদের কাছে বড়। সন্দ্বীপে আমরা তা লক্ষ করি না। অনুমান করা হয় সন্দ্বীপ চরিত্রটি অরবিন্দর ছায়া অবলম্বনে তৈরি। কিন্তু বাস্তবে অরবিন্দর সঙ্গে সন্দ্বীপের আদর্শিক মিলের পার্থক্য অনেক। যদি সন্দ্বীপ অরবিন্দর ছায়ায় তৈরি ধারণা করি, তাহলে অরবিন্দ এখানে বিকৃত হয়েছে। বিমলা চরিত্রের ভেতর দিয়েই বোঝা যায় সেসময়ের নারীরা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য কতোটা উদগ্রীব ছিল। দেশের মুক্তির স্বার্থে তারা কতোটা নিবেদিত ছিল। নিখিলেশ চরিত্রে উঠে এসেছে সেসময়ের আর এক বাস্তবতা- ব্যবসা বাণিজ্য ও ধীর স্থীর আপসকামিতা। অগ্নিযুগের পুরোপুরি রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে ‘ঘরে-বাইরে’ মান্য করা যায় না। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’ রাজনৈতিক উপন্যাস। শরৎচন্দ্র নিজেও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু খাঁটি রাজনৈতিক উপন্যাস তিনি একটিই লিখেছেন-‘পথের দাবি’। কিন্তু একটিমাত্র কেন- এ প্রশ্নের উত্তর মেলানো ভারি মুশকিল। ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সব্যসাচী বাস্তবতা থেকেই গৃহীত হয়েছিল। স্বদেশী আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা এম. এন. রায়ের চরিত্র অবলম্বনে তিনি সব্যসাচী চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। এম. এন. রায় জার্মানির কাছ থেকে অস্ত্র-বারুদ সাহায্য নিয়ে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে ব্রিটিশ বিতাড়িত কর ভারতকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। ‘পথের দাবী’র মূল চরিত্র সব্যসাচী তৈরি হয়েছে এম. এন. রায়কে কেন্দ্র করে। ‘পথের দাবী’ বিপ্লবীদের কাছে আদর্শগ্রন্থ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছিল। নজরুল অগ্নিযুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে বিশেষভাবে অন্যতম। কবিতা লিখে জেল খেটেছেন। অনশন করেছেন। কবিতার মতো তাঁর উপন্যাসেও সেই অগ্নি-বারুদ ফুটে উঠেছিল। সেই সময়কালই ছিল অগ্নি-বারুদের উপর দাঁড়ানো। নজরুলের ‘কুহেলিকা’ উপন্যাস ‘পথের দাবী’ প্রভাবিত বলেই স্বীকৃত। এ উপন্যাসের প্রমত্ত দা ও বজ্রপাণি মূলত এম এন রায় ও বিপ্লবী বাঘা যতীন চরিত্র অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে।
সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ (১৯৪৫) উপন্যাসটিও বিপ্লবী-ধারা উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ। সতীনাথ ভাদুড়ী একজন সাহিত্যিক হিসেবে যেমন প্রতিষ্ঠিত তেমনি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও সক্রিয় ব্যক্তি ছিলেন।
সতীনাথ ভাদুড়ী ‘আগস্ট আন্দোলন’-কে (১৯৪২) কেন্দ্র করে রচনা করেন- ‘জাগরী’ (১৯৪৫)। ১৯৪২ সালে ৯ আগস্ট ‘ইংরেজ, ভারত ছাড়’ গান্ধীজির এই অগ্নিগর্ভ উদাত্ত আহ্বানে অসংখ্য মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে এসে আগস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। পরিণতিতে তাদের কারাবরণ করতে হয়েছিল। ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছিল। এসব নিয়েই ‘জাগরী’ সৃষ্টি। গঙ্গাচরণ নাগের মতো প্রাজ্ঞ লেখক স্বদেশী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে কলম-যুদ্ধ করেছেন। স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তিনি লিখেছেন ‘রাখী-কঙ্কণ’ (১৩১৪ ব.) উপন্যাস। ১৩১৪ বঙ্গাব্দে বরিশাল থেকে গ্রন্থকার কর্তৃক এটি প্রকাশিত হয়। অবশ্য উপন্যাসটি সম্পূর্ণ নয়, প্রথম খণ্ড মাত্র। তখন বরিশালে থেকে নীরবে নিভৃতে বসে এ ধরণের উপন্যাস লেখা হয়তো সম্ভব ছিল, কিন্তু সেখান থেকেই এটি প্রকাশ করা কতোটা অসাধ্যকে সাধন করার মতো ব্যাপার ছিল, তা ভাবাও কঠিন। নিঃসন্দেহে লেখক একটা দুঃসাহসিক কাজ সম্পন্ন করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। কারণ সেময় বরিশালের স্বদেশী-আন্দোলনের সঙ্গে যেসব তরুণ-তরুণী যুক্ত হয়েছিল, স্বদেশদ্রোহী আত্মীয়-স্বজনের কাছে তাঁদের ভয়ঙ্করভাবে নিগৃহীত হতে হয়েছিল। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ‘রাখী-কঙ্কণ’ লেখা হয়েছিল। ফলে বরিশালে উপন্যাসটি প্রকাশ করে পাঠকের কাছে পৌছানো ব্যাপারটি সহজসাধ্য ছিল না। এও এক বিপ্লব সাধন করেছিলেন গঙ্গাচরণ নাগ।
নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্যও স্বদেশী আন্দোলনকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর উপন্যাসের নাম ‘নববিধান’ (১৩১৪ব.)। এ উপন্যাসের প্রধান দিক হলো উপন্যাসটিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং ব্রিটিশদের অত্যাচারের জবাব দেয়ার জন্য জনগণের মধ্যে আন্দোলন গড়ে তোলা। সে বিবেচনায় উপন্যাসটির গুরুত্বপূর্ণ।সেই সময়কালে এই উপন্যাসটি ‘সুলিখিত উপন্যাস’ হিসেবে প্রশংসিত হয়েছিল। তিনি মূলত গল্পকার ছিলেন।
এসব কীর্তিমান লেখক ছাড়াও আরো অনেক লেখক অগ্নিযুগ বিশেষ করে স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। এসব লেখকও সময়কালে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রমণীমোহন ঘোষ, রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়, গঙ্গাচরণ দাশগুপ্ত, জীবেন্দ্রকুমার দত্ত, ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রমুখ। এঁদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। মূলত এঁদের অধিকাংশই কবিতার মাধ্যমেই স্বদেশী আন্দোলনকে জনগণের মধ্যে চেতনার অগ্নিবারুদ করে ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। তবে এখানে নজরুলের নামটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। কারণ নজরুলের মতো করে আর কেউ ব্রিটিশ-মসনদ তছনছ করা কবিতা লিখতে পারেননি। কবিতায় তিনিই সবচেয়ে বেশি আগুন জ্বালিয়েছিলেন। ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতা লিখে তিনি জেল খেটেছেন। ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্য বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বিপ্লবী বাঘা যতীনকে নিয়ে লেখা ‘নব-ভারতের হলদিঘাট’ কবিতার জন্য ‘প্রলয়-শিখা’র উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। নজরুল ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’, ‘আগমনী’, ‘ধুমকেতু’ সহ অসংখ্য বিদ্রোহাত্মক ও প্রতিবাদী কবিতা লিখে ব্রিটিশদের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। নজরুলকেও এজন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছিল।
অগ্নিযুগে আগুনভরা অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। স্বদেশী আন্দোলনকারীদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা গানের সুর ও ছন্দ হয়ে তরুণদের রক্তে আগুন জ্বালিয়েছে। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় কাব্যবিশারদ, কামিনীকুমার ভট্টাচার্য, অশ্বিনীকুমার দত্ত, মুকুন্দ দাস, গোবিন্দচন্দ্র দাস, মনোমোহন চক্রবর্তী, প্রমথনাথ দত্ত, বরদাচরণ মিত্র, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, করালী (ছদ্মনাম) এবং রাজকৃষ্ণ রায়-এর নাম উল্লেখযোগ্য। স্বদেশী আন্দোলনে এঁদের রচিত দেশাত্মবোধক গান স্বদেশ প্রেমে বিপ্লবীদের বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেই প্রবল সংকটকালীন সময়ে ছয়টি সংগীত সংকলন- রজনীকান্ত পণ্ডিতের ‘স্বদেশী পল্লী-সংগীত’ (১৩১২ বঙ্গাব্দ), যোগেন্দ্রনাথ শর্মার ‘স্বদেশী-সংগীত’ (১৩১২ বঙ্গাব্দ), যোগেন্দ্রনাথ সরকারের ‘বন্দেমাতরম্’ (১৩১২ বঙ্গাব্দ), যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের ‘স্বদেশ-গাথা’ (১৩১৩ বঙ্গাব্দ), হীরালাল সেনগুপ্তের ‘হুঙ্কার’ (১৩১৫ বঙ্গাব্দ), ও নলিনীরঞ্জন সরকারের ‘বন্দনা’ (১৩১৫ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয়েছিল। এটি সহজসাধ্য কোন ব্যাপার ছিল না।
বাংলা নাটকেও স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব সুস্পষ্ট। স্বদেশী আন্দোলন নাট্যকারের চিত্তে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছিল। নাট্যকারগণ কল্পনাপ্রসূত নাটক লেখা থেকে সরে এসে ভারতে পরাধীনতার যন্ত্রণা ও স্বদেশী আন্দোলনকে নাটকের উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেন। গিরিশচন্দ্রঘোষ-এর (১৮৪৪-১৯১২) ‘সিরাজদ্দৌলা’ (১৩১২ ব.), ‘মীরকাসিম’ (১৩১৩ ব.), ‘ছত্রপতি শিবাজী’ (১৩১৪ ব.); দ্বিজেন্দ্রলাল রায়-এর (১৮৬৩-১৯১৩) ‘প্রতাপসিংহ’ (১৩১২ ব.), ‘দুর্গাদাস’ (১৩১৩ ব.); ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ-এর (১৮৬৩-১৯২৭) ‘প্রতাপ-আদিত্য’ (১৩১৩ ব.), ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’ (১৩১৩ ব.); অমরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ বা Partition of BengalÕ (১৩১২ ব.); কুমুদনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ যজ্ঞ’ (১৩১৪ ব.)- এসব নাটক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গল্পও রচিত হয়েছিল। এক্ষেত্রে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর ‘দেশী ও বিলাতী’ (১৩১৬) গল্পগ্রন্থের তিনটি গল্পে স্বদেশী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। গল্পগুলো ‘উকীলের বুদ্ধি’, ‘খালাস’ এবং ‘হাতে হাতে ফল’। স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সেই সময়কালে উল্লেযোগ্যভাবে প্রবন্ধ রচিত হয়নি। এটা খুব স্বাভাবিক যে, আন্দোলনের সময় যে আবেগ আর উত্তেজনা সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করে, সেসময় চিন্তানিষ্ঠ সাহিত্য পাঠককে খুব বেশি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় না। ফলে লেখকের অগ্রহও সেদিকে কম থাকে। তারপরও সেসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৮-১৯২৫), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬), সখারাম গণেশ দেউস্কর (১৮৬৯-১৯১২), ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় (১৮৬১-১৯১০), শিবনাথ শাস্ত্রী (১৮৪৭-১৯১৯), দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী (১৮৫৪-১৯২০), নিখিলনাথ রায় (১৮৬৫-১৯৩২) ও ধীরেন্দ্রনাথ চৌধুরী (১৮৭০-১৯৩৮) প্রমুখ স্বদেশী আন্দোলনভিত্তিক প্রবন্ধ রচনা করে প্রায় একরকম অসাধ্যই সাধন করেছিলেন।
অগ্নিযুগে সৃষ্ট সাহিত্য বহুমাত্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এসব সাহিত্য বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছে, দেশপ্রেমে অগ্নিস্পৃহা শক্তি যুগিয়েছে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। ফলে এসব সাহিত্য শুধু সৃজনশীলতায় বন্দি নয়- ইতিহাসের উজ্বল স্বাক্ষর হিসেবে সেই সময়ের পুরো ছবিটাও বহন করে।