
বাংলাদেশের সমকালীন কবিতা : অনির্দেশ্য পথচলা
কবিতার সাথে আমার ব্যক্তিগত ও মনস্তাত্ত্বিক সংযোগটি গড়ে ওঠে ছাত্রজীবন থেকেই। দুর্নিবার এক আকর্ষণ আছে কবিতার। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থী হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও কবিতা পড়তে হয়েছে, পড়েছি এবং সেটা হৃদয়-মন দিয়েই করেছি। কবিতার আকর্ষণে ক্রমাগত জড়িয়ে পড়লে আমার পাঠ-পরিক্রমা রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ পেরিয়ে শামসুর রাহমানে পৌঁছালে অনুভব করেছি, কবিতা শুধু ইনার বিউটি বা আত্মগত ভালো লাগাই তৈরি করে না; কবিতায় থাকে বাহ্যজীবনের অনিবার্য সংশ্লেষণ। কবিতাও বাস্তব জীবনের কথা বলে; শব্দগত মোহ কিংবা সৌন্দর্য সৃষ্টিই কবির একমাত্র কাজ নয়। দৈনন্দিন জীবনের কথাও অবলীলায় উঠে আসতে পারে কবিতায়। ফলে ‘বন্দী শিবির থেকে’ বের হতে গিয়ে দেখি স্বাধীনতার জন্মযন্ত্রণার ক্ষয়-ক্ষতি এবং রক্তক্ষরণে আমাদের কবিতার মানচিত্রও দেশের মতোই বদলে গেছে। রাহমানের কবিতার কাল অতিক্রম করলে আমার সামনে ষাটের একঝাঁক তুর্কি তরুণের অবক্ষয়বাদী কাব্য থরে-বিথরে সাজানো দেখি। কখনো দু’পা পিছিয়ে কখনো-বা একটু সামনে এগিয়ে কবিতার পাঠ অব্যাহত রাখি। ফলে নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ পাঠপ্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হলে বিস্মিত হই; বলি বাংলাদেশের কবিতার নতুন ডাইমেনশন পেয়েছে। অতঃপর রক্তনদীতে স্নান করে বাংলাদেশের আকাশে স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিত হলে বিষময় অভিজ্ঞতা হয় এবং বলি ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। এই জন্মপাপের পশ্চাতে আর্থ-সামাজিক, ভৌগোলিক রাজনীতি যে কতটা দায়ী, সেকথা আবুল হাসান বেশ দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন। তাঁর সাথে গলা মিলিয়ে উচ্চারণ করি ‘রাজা যায় রাজা আসে’। রেখে যায় ক্ষয়-ক্ষতি আর অমোচনীয় রক্তচিহ্ন। অথচ তারও অনেক আগে ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ অতিক্রম করে দেখেছিলাম ‘রৌদ্র করোটিতে’ ম্লান সূর্যালোক বিষণ্ন ছায়া ফেলেছে। তখন মনে মনে যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়ে ভেবেছি ‘নিজ বাসভূমে’ আমরা পরবাসী হয়েছি; এ ঘোরলাগা সময়ের উত্তরণ দরকার। অবশ্য ততোদিনে বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এক বাঙালি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দৃপ্ত পদে এগিয়ে গেছেন স্বাধীনতা অর্জনের শেষ ধাপে। বাঙালির অধিকার আদায়ের দাবি একমুখিন গতি লাভ করলে, সন্নিকটবর্তী হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা; আর বাংলার কবি নির্মলেন্দু গুণের কণ্ঠে ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ শ্লোগান আমাদের রক্তে স্পন্দন তোলে; আন্দোলন আরো বেগবান হয়। পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারে বংলার জনজীবন কতটা অতিষ্ঠ হলে হিটলারের নাৎসি কনসেন্ট্রশন ক্যাম্পের সাথে তুলনা করা যায়! অথচ সেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে (বন্দী শিবির থেকে) বসেও শামসুর রাহমান কবিতার চাষাবাদ করেন। কথাবাহুল্য, ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে রহমান তাঁর কবিতায় বিশুদ্ধ নন্দনচেতনার পরিবর্তে প্রাত্যহিক জীবনকথা তুলে ধরলেন; কবিতায় নিয়ে এলেন জনমানুষের কথা। অথচ এই রাহমানই মগ্ন ছিলেন ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’র ‘রৌদ্র করোটিতে’। তিনি বেরিয়ে এলেন; শক্তি, সুনীল, শঙ্খ ঘোষ সে পথে হাঁটলেন না। অথবা তাঁদের আর্থ-সামাজিক, ভৌগোলিক বাস্তবতা তাঁদেরকে বরুণার বুকে রাখা রুমালের সৌগন্ধ থেকে দূরে যেতে দিল না। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তো স্পষ্ট করে জানিয়েই দিলেন ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব’। ওপার বাংলা অর্থাৎ পশ্চিম বাংলার কবিরা বিশুদ্ধ কাব্যচর্চার গণ্ডি পার হলেন না, সচেতনভাবেই। ফলে আমাদের (বাংলাদেশের) কবিতার পথ আলাদা হয়ে উঠল ক্রমেই।
একাত্তরে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ কোন দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, কিংবা পরিণামে কি হবে- তা ছিল অনিশ্চিত। হুমায়ুন আজাদ বোধহয় সেজন্যই কল্পনা করে নিয়েছিলেন এক ‘অলৌকিক ইস্টিমার’ তাঁকে পৌঁছে দেবে গন্তব্যে! সেই অলৌকিক জলযান হয়তো সক্ষম হবে বিপন্ন দেশবাসীকে কিংবা সমগ্র জাতিকে প্রত্যাশিত গন্তব্যের সোপানে নিয়ে যাবে। অবশ্য তাঁর কথায় আমরা সম্পূর্ণ ভরসা পাই না কিংবা একথা পুরোপুরি বিশ্বাসও করা যায় না; কেননা আমরা তো অবগত ছিলাম ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’। তারপরও আশা থাকে, থাকে জীবন এবং সামনে এগিয়ে চলার প্রত্যয়। আশার বিন্দু বিন্দু অভিজ্ঞতা আমাদের হৃদয়ে সঞ্চিত হতে থাকলেও ‘এই গৃহ, এই সন্ন্যাস’ কাব্যগ্রন্থে মহাদেব সাহার চাঞ্চল্যের সাথে কিংবা তাঁর অব্যক্ত শূন্যতার সাথে ঐক্য অনুভূত হয়। উন্মূল ও উদ্বাস্তু গৃহহীন কবি যেমন শরণার্থী শিবিরের বিপন্নতা মাথায় নিয়ে থিতু হতে পারেননি; তেমনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন কী সুখকর ছিল! অথবা স্বাধীনতার পরও ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মানচিত্রে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলতায় ঠাঁই মেলেনি অনেকের।
স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার দুর্বার প্রেরণা নিয়ে হেলাল হাফিজ রচনা করেছিলেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। বাংলার বীর সাহসী সন্তানরা কবির আহ্বানের সাড়া দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায়ও প্রতিরোধ গড়ে তুললো। দেশ স্বাধীনতা পেল, বীর বাঙালির অস্ত্রের সামনে পাকবাহিনী পরাজয় মেনে নিল। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতায় কবিরা কী নিরাপত্তা পেলেন! দাউদ হায়দার স্বাধীনতার রূঢ় বাস্তবতা বললেন- বাংলায় জন্মগ্রহণ করাই পাপ; আজন্ম পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে তাঁকে দেশান্তরী হতে হলো। ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’-এর বোঝা মাথায় নিয়ে অনেকেই দেশেই থেকে গেলেন, কিংবা থাকতে বাধ্য হলেন। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ আর বিরহে কাতর হেলাল হাফিজ তাই যুদ্ধ শেষে জন্মভিটায় ফিরেও আত্মীয়-পরিজন এমনকি ভিটেমাটি চিনতে না পেরে ক্রমাগত বিষণ্ন বেদনার নীলখামে নিজের রচনাদি লুকিয়ে ফেললেন। চোখের সামনে দেখলেন, স্বাধীনতার স্থপতি সপরিবারে নিহত হলেন! তারপর, আবার সেই ঔপনিবেশিক আমলের সামরিক শাসন চেপে বসল। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির পুনর্বাসনে হেলাল তাঁর রক্তাক্ত গ্লানির কথা ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র শিল্পিত সুষমায় প্রতীকায়িত করলেন। আবুল হাসান স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় রচনা করলেন ‘রাজা যায় রাজা আসে’। আর রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে পুরনো শকুন’। বঙ্গবন্ধু বাংলার সাধারণ মানুষের যে অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, জনগণের সেই অধিকারের কথা শুধু সংবিধানের পাতায় ছাপা হয়ে থাকল, কার্যকরী হলো না। স্বাধীনতাও বাংলার জনমানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটল না।
বাংলাদেশের কবিরা বসে থাকলেন না। রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সানাউল হক, আবিদ আজাদ, শহীদ কাদরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো সচেতন কবিগণও। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে যখন মানুষের পেটে আগুন জ্বলে উঠল- তখন শিল্প-সাহিাত্য প্রথাগত অলংকার শাস্ত্র অনুসরণ করতে পারল না। এ সময় বাংলাদেশের কবিদের কলম থেকে বেরিয়ে এলো : ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাব।’ সর্বগ্রাসী ক্ষুধা যখন বাঙালির জীবন বিপন্ন করে তুলেছে, তখন এক রাতে সামরিক আরেক জেনারেল জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে নিলে ‘বাতাসে লাশে গন্ধ’ পেলেন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তিনি দেখলেন জেনারেল জিয়ার প্রবর্তিত আইন বলে গণতন্ত্রের নামে দেশে একাত্তরের পরাজিত রাজনৈতিক শক্তিই পুনরায় জেগে উঠল, পুনর্বাসিত হলো। ফলে তারা ‘জাতির পতাকা আজ খামছে ধরেছে সেই শকুনেরা।’ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বছরের পর সামরিক স্বৈরাচারের রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার ঘটনায় বিচলিত হলেন এবং জানালেন আমাদের ‘উপদ্রুত উপকূল’ ক্রমেই নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় নৈতিকতাহীনতার মহোৎসব শুরু হলে কবি মহাদেব সাহা নিজেকে নিজের মাঝে গুটিয়ে নিলেন। তিনি অতঃপর বিরস বিষণ্ন কণ্ঠে জানালেন ‘শূন্যতা আমার সঙ্গী’। তবে তখনো তার অন্তর্গত চেতনায় সুপ্ত থাকে ‘দূর বংশীধ্বনি’। অন্যদিকে শামসুর রাহমান বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় যখন সর্বত্রই অন্ধকার দেখতে থাকলেন স্বীয় বিপন্নতা ক্রমশ তাঁরই চারপাশে দুর্ভেদ্য দেয়াল তুলে তাঁকে বাহ্যজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। ‘মাতাল ঋত্বিক’ হাতে নিয়ে আমরা প্রত্যাশিত গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হলে কবি বুঝলেন তিনি এখনো বিশুদ্ধ কাব্যচর্চা করতে পারবেন না। ফলে দেশে মৌলবাদী তথা একাত্তরের পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। কবি ‘নিজের’ ছায়াকে ফলত অবিশ্বাস করতে থাকলেও তাঁকে ‘ছায়াগণের সঙ্গে কিছুক্ষণ’ না থেকে উপায় থাকে না। অতএব ‘মাতাল ঋত্বিক’ রচনার সময় শামসুর রাহমান পুনরায় কাব্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করতে চাইলে তাঁর কবিতার অনিবার্য বিষয়-উপাদান হিসেবে সমাজ-সংসার-জনগণ যথাবিহীত স্থান করে নেয়। অবশ ইতোমধ্যেই স্বৈরাচারের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন ‘উপদ্রুত উপকূল’-এর কথা। মূলত বাংলা জনপদ স্বৈরশাসকের নির্যাতনে অবরুদ্ধ হলে ‘মানুষের মানচিত্র’ বাক্রুদ্ধ হলে সামরিকজান্তার ‘ছোবল’ থেকে অব্যাহতি কামনা করেন এবং হাঁটুমুড়ে প্রার্থনা করেন ‘ফলে চাই স্বর্নগ্রাম’। সামরিকজান্তার শাসনক্ষমতা বলিষ্ঠ হতে থাকলে ‘কমলের চোখ’ ফিরে দেখে অতীত দিনকাল আর নতুন প্রজন্মের সামনে নিজের স্বচ্ছ অবস্থান তুলে ধরে জানিয়ে দেন, ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’; কিন্তু অতীত গৌরবের কথা বলে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ যতোই নিজেকে ও জাতিকে উদ্বোধিত করুন না কেন পরিণামে তাঁর ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’ করতে হয়। কেননা নিজের বিবেকের নিকট অনুতপ্ত হলে কবি মহাদেব সাহা বেশ সোজাসাপ্টা জানিয়ে দেন ‘শূন্যতা আমার সঙ্গী’। এক ধরনের শূন্যতা, ব্যর্থতা, হাহাকার, ক্রোধ এবং সর্বোপরি সাহস অন্তর্গত রক্তের ভেতর জেগে উঠলে আমরা ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ অতিক্রম করে সূচেতনা আর আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ‘সহিষ্ণু প্রতীক্ষা’ করি। অবশ্য, এসব আয়োজনের মধ্যে আমরা সামরিকজান্তার নির্যাতন-নিষ্পেষণে তবুও আশাবাদী মানুষ নিরন্তর উন্নয়ন ভাবনায় পথ হাঁটেন; তখন আমাদের দৃঢ় মনোভাবে সামনে সামরিকজান্তার ‘মৌলিক মুখোশ’ খুলে পড়লে নূর হোসেন বুকে পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এবং ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে রাজপথে নামলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। আসে গণতন্ত্র। নির্বাচন নির্বাচন খেলা। ভোটের নামে ভেল্কিবাজি আর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র। এসব ষড়যন্ত্র এবং রাজনীতি খেলায় সুন্দর ব্যথিত হয়, সৌন্দর্য বিপন্ন হয়, সুচেতনা ক্রমেই তিরোহিত হতে থাকলে কবিদের ‘অক্ষরে বোন স্বপ্ন’ উবে যায় অনুর্বর মরুভূমিতে।
বাংলাদেশের কবিতার ভবিষ্যৎ কেমন হবে, অথবা সাম্প্রতিক কবিতাচর্চায় বাংলাদেশের কবিতা কোথায় পৌঁছাল- এমন প্রশ্নের খুব সরাসরি কিংবা সহজ উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের কবিতা সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকে বিগত ছয় দশকে কতটা পথ অতিক্রম করেছে, কিংবা সাম্প্রতিক কবিতার প্রবণতাসমূহ চিহ্নিত করার গভীর প্রত্যয়ে আমার পথচলা অব্যাহত রাখি। এ পর্যায় এদেশের প্রধানতম কবি থেকে শুরু করে অনন্য বা অন্যতম কবি আল মাহমুদকেও পড়ে উঠে ষাটের শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন কবির, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ, মাহবুব সাদিক, সিকদার আমিনুল হক প্রমুখের কবিতায় হাতড়ে বেড়াই পরবর্তী দশকের কবি আবিদ আজাদ, দাউদ হায়দার, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতায় কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান হয় কিনা! ঊর্ধ্বশ্বাসে সত্তরের পর আশি-নব্বই দশক পেরিয়ে শূন্য দশকের কবিতা হাতে নিয়ে উপলব্ধি ঘটে- পশ্চাশের-ষাটের কিংবা সত্তর-আশির কবিতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এদেশের সমকালীন কবিতা। এর পরিণতি আগামীতে কেমন হবে, কেমন হবে প্রকরণ কৌশল- ভালো না মন্দ; এ জাতীয় প্রশ্নের সোজাসাপ্টা সদর্থক কিংবা নঞর্থক জবাব নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই। কারণ, প্রশ্নটিই অথবা ভবিষ্যৎ যেকোনো প্রশ্ন সর্বদাই সংশয়াত্মক। হতে পারে আজকের কবিতাই বিকাশিত হয়ে এমন এক পর্যায় উপনীত হবে, যা আগামী বা অনাগত প্রজন্মের পাথেয় হবে; অথবা হবে না কিংবা শূন্যের কবিতার এই কৃৎকৌশল, বিষয়-বিন্যাস ভবিষ্যতের ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করবে। এর উল্টো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা, যা অনাগত; যা ভবিষ্যৎ- তা অনির্ধারিত, নিঃসংশয়ে বলা যায় তা অতি অবশ্যই অনিশ্চিত। সুতরাং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করা নিতান্তই অর্বাচীনতার সামিল। আমরা যুক্তির এসব কথা স্বীকার করে নিয়েও যদি আগামীর বাংলা কবিতার রূপ-আকার-প্রকৃতি-প্রকরণ-বৈশিষ্ট্য কি হবে, কেমন হবে পরিণাম- এ ধরনের ভ্রমাত্মক প্রশ্নের সমাধান করতে উদ্যোগী হই অথবা প্রয়াস গ্রহণ করি, তাহলে কাব্যবিচারের কতিপয় মাপকাঠি বা উপাদান আমরা পূর্বাহ্নেই ঠিক করে নিতে বাধ্য হই। প্রধানতম পরিমাপক উপকরণ হয়- ঐতিহাসিক ধারা-পরম্পরায় পর্যালোচনা বা পর্যবেক্ষণ করা।
‘চর্যাপদ’ কবিতার তথা বাংলা সাহিত্যে আদি নিদর্শন; পণ্ডিতগণের মত-পার্থক্য স্বীকার করে নিয়েও একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি সময় দাঁড়িয়ে এটা খুব দৃঢ়তার সাথেই বলা যায়, ইতোমধ্যেই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হাজার বয়স অতিক্রম করেছে নিঃসন্দেহে। দীর্ঘ এ পথ পরিক্রমায় বাংলা কবিতার যেসব বিষয়-প্রকরণ-বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে মোটা দাগে বাঁক বদল ঘটেছে তা দৃশ্যমান, বলার অপেক্ষা রাখে না। চর্যাপদ ছিল স্পষ্টতই গীতিকবিতার অন্তরে প্রবহমান বৌদ্ধ সহজযানীদের ধর্মীয় মতাদর্শের প্রকাশক। মধ্যযুগেও ধর্মীয় ফেনোমেনা বাংলা সাহিত্যের প্রধানতম অবলম্বন; আখ্যানধর্মী মঙ্গলকাব্যে সরাসরি দেবোপাসনা বা ভক্তিবাদের প্রকাশ। ব্যতিক্রম খানিকটা বৈষ্ণব পদাবলী। গীতিকবিতার সব বৈশিষ্ট্য বাহ্য-প্রকৃতিতে ধারণ করেও পরিণামে তাও ধর্মীয় মার্গে সমর্পিত। প্রাচীন-মধ্যযুগের দীর্ঘ সময়ব্যাপী বাংলা কবিতায় ধর্ম আর দেবমহিমা কীর্তনের অবসান ঘটল আধুনিক যুগের প্রারম্ভে মাইকেল মধুসূদন দত্তের অনন্য সৃজন-প্রতিভায়। মাইকেল থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত প্রায় শতবর্ষব্যাপী বাংলা কবিতায় ধর্মের বাড়াবাড়ি থাকল না বটে, তবে তা ভাববাদী দর্শনের নির্মোকেই থাকল আবদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের মহীরুহ সৃজন-প্রতিভায় বাংলা কবিতা ভাববাদী চিন্তাচেতনা এতোটাই উৎকর্ষমণ্ডিত ও শৈল্পিক সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে প্রকাশিত হলো যে, তা পশ্চিমা বিশ্বকেও অবাক করে দিল। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির মাধ্যমে বিশ্ব জয় করল বাংলা কবিতা।
রবীন্দ্রনাথ ভাববাদী চিন্তাচেতনা দ্বারা বিশ্ব জয় করলেও বিশ শতকের তিরিশের পঞ্চপাণ্ডব রবীন্দ্রনাথের ভাববাদী গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে চাইলেন না, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের ভাববাদী বলয় ভেঙে বাংলা কবিতায় আমদানী করলেন পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী দর্শনচেতনার। বদলে গেল কবিতার ভাষা, কবিতার বিষয়। দৈনন্দিন ব্যবহার্য শব্দও কবিতায় স্থান দিলেন তিরিশের কবিরা। তাঁরা স্বর্গের অপ্সরা-উর্বশী-মেনকাকে টেনে নামালেন মর্ত্য-পৃথিবীর ধুলো-কাদায়। সমকালের কাব্য-রসিকজন তিরিশের কবিদের এ জাতীয় বিষয় নির্বাচন কিংবা শব্দ ব্যবহারকে অর্বাচীন কবি-প্রতিভার পরিচায়ক বলে এঁদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। বিশুদ্ধ বাঙালি কবি জীবনানন্দের কবিতার বিরুদ্ধে আনলেন অশ্লীলতার অভিযোগ। সমকালের কবিতা-সমালোচক পণ্ডিতগণ বাতিল করে দিলেন গ্রাম্যতার দোষেও তাঁর কবিতাকে। নিভৃতচারী কবি বিরক্তির চূড়ান্ত হয়েও ধৈর্যচ্যুতি ঘটাননি; নীরবেই কলরব আর খ্যাতি প্রাপ্তির কিংবা প্রশংসা প্রাপ্তির প্রত্যাশা না করেই অব্যাহত রেখেছিলেন কাব্যচর্চা। তিনি ধৈর্য হারাননি বলেই একালে বাংলা কবিতার রাজাধিরাজের মুকুট শোভা পাচ্ছে তাঁর মাথায়। বাংলা আধুনিক কবিতার বিগত প্রায় দুশো বছরের যে ইতিহাস, সেখানে রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ দাশ ব্যতিরেকে সকল প্রতিভাই ম্লান।
একালে অবশ্য পঞ্চাশের দশকের কবি শামসুর রাহমানের গায়ে প্রধান কবির তকমা এঁটে দেয়া হলেও রাজনৈতিক বিবেচনা ব্যতিরেকে আল মাহমুদের কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলারই অবকাশ থাকে না। খুব সম্প্রতি অবশ্য তাঁর নামের সাথে অনন্য কখনো বা অন্যতম কবি-প্রতিভা বিষয়ক বিশেষণ প্রায়শই যুক্ত করা হচ্ছে; উপরন্তু শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর আমাদের সামনে থেকে তাঁর প্রধানতম কবির উপাধি ক্রমশ ম্লান হয়ে পড়ছে, পড়েছে। ধূলির আস্তরণ এক সময় হয়তো এতোটা জমা হবে, তা আর দৃশ্যমান থাকবে না। অথবা বাংলা কবিতার ইতিহাস থেকে প্রধানতম কবির উপাধিটিই হয়ে যাবে বিলীন। কেননা, কেউ কেউ রাজনৈতিক কারণে আল মাহমুদের প্রকাশ্য প্রশংসা করতে নারাজ থাকলেও গোপনে তাঁর অসামান্য কবি-প্রতিভার কথা স্বীকার করেন গোপনে, টেবিলে আড্ডায়। স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ দাশ বিষয়-ভাবনায়, কবিতার শব্দ ব্যবহারেও উল্লেখযোগ্য স্বাতন্ত্র্যের পরিচয়ক ছিলেন। জীবনানন্দের পর যদি শামসুর রাহমান কিংবা আল মাহমুদকে অন্যতম কবিপ্রতিভা হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়, সেখানে কি ঘটেছে তা এক নজরে চোখ বুলিয়ে নেয়া দরকার।
শামসুর রাহমান কিংবা আল মাহমুদের সময়ে কবিতা লিখেও শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘প্রধানতম’ অথবা ‘অন্যতম’ বিশেষণ অর্জন করতে পারেননি। কিন্তু তাঁদের কবিতার শৈল্পিক শক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলার ধৃষ্টতা নেই। অথচ, তাঁরা থাকলেন অপাঙ্ক্তেয়। এজন্য ভৌগোলিক, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কারণ যে অন্যতম অনুষঙ্গ বাংলা কবিতার ইতিহাসের পট-পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মূলত সাতচল্লিশের দেশ-বিভাজনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জনসমষ্টি দু’টি পৃথক রাষ্ট্রের অন্তর্গত হলে বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোতে পরিণত হয় বাংলাদেশ। অর্থাৎ শামসুর রাহমান কিংবা আল মাহমুদের কবিতায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে সময় ও সমকাল; আর্থ-সামাজিক পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা। এঁদের মাধ্যমে শুধু শব্দগত নয়, বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে আটপৌরে দৈনন্দিন জীবন যেভাবে স্থান করে নিতে সক্ষম হলো- তা পশ্চিম বাংলার শক্তি, শঙ্খ, সুনীলের কবিতায় ভৌগোলিক, রাজনৈতিক-সামাজিক কারণেই সম্ভব হলো না। ফলে শামসুর রাহমানের বসবাস পশ্চিম বাংলায় হলে, তাঁর বেলায় কি ঘটতো তা বলা মুশকিল। তবে একথা সত্য যে, দেশ-বিভাগ এবং বাংলাদেশের সৃষ্টির রাজনৈতিক প্রেরণার সুযোগে পঞ্চাশের দশকে এসে বাংলা কবিতায় সব ধরনের বিষয়-উপাদান বা শব্দ প্রবেশ করল অবাধে। পরিপার্শ্বের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন হয়ে উঠল কবিতার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। এরপরে ষাটের কবিতায় উঠে এলো সম্মিলিত কণ্ঠস্বর; স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, দেশপ্রেম, ব্যক্তিজীবনের বিপন্নতা- তাঁদের কবিতাকে খানিকটা ভিন্নখাতে, ভিন্নধারায় প্রবাহিত করল। এজন্য সম্ভবত, বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাসে ষাটের একক কোনো কবি-প্রতিভা কিংবা একক কবির কৃতিত্ব অন্য সবাইকে ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। এজন্য ষাটের কবি ও কবিতার পরিচয় দিতে গেলে নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, আবুল হাসান, সিকদার আমিনুল হক- প্রমুখ একদল প্রতিভাবান কবির নাম বলতে হয়, যাঁদের মধ্যে এককভাবে কোনো কবিরই ভূমিকা কম নয়।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি অথবা অব্যবহিত পরেই সামরিক শাসনের চাপে খুব বেশি কবি বেরিয়ে আসেন নি- আবিদ আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, মান্নান সৈয়দ কিংবা দাউদ হায়দার প্রমুখ গুটিকয়েক নাম ছাড়া, খুব বেশিসংখ্যক কবির অস্তিত্ব দৃশ্যমান হয়নি। ঐ অর্থে বাংলাদেশের কবিতায় আশির দশকে অনেক কবির নাম কাগজে কলমে করা গেলেও একক প্রতিভাবান কোনো কবি অদ্যাবধি আমাদের সামনে উজ্জ্বলতর হয়ে প্রকাশ লাভ করতে পারেননি। তাছাড়া আশির কবিরা এখনো অধিকাংশ কবিই লিখে চলেছেন, ফলে তাঁদের সম্বন্ধে চূড়ান্ত কথা বলারও সময় আসেনি। এ সময়ের কবিদের রচনায় সামরিক শাসনের নিষ্পেষণজনিত ভয়াল-চিত্রের পাশাপাশি ইউরোপীয় সাহিত্যে তত্ত্বগত যেসব বিপ্লব ঘটেছে তাও কমবেশি অনুষঙ্গী হয়েছে। অন্যদিকে আবার একথা সত্য যে, নব্বই দশকের বাংলা কবিতায় একটা নতুন সুর, চিন্তাচেতনা, আবহ, ব্যঞ্জনা তৈরি হলো; ফলে চাইলেও যা, পূর্ববর্তী ষাট-সত্তর-আশি এই তিন দশকের কবিতার সাথে মেলানো যায় না। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন ঘটায় আপাত অর্থে জনগণের জীবনে এক ধরনের স্বস্তির সুবাতাস বইতে শুরু করলেও দলবাজি আর রাষ্ট্রীয় শোষণ-নির্যাতন, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করল। একইসময় স্বৈরাচারের করাল কালো থাবার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। স্বৈরাচারের ভূত জনগণের ঘাড় থেকে নামলেও দলবাজি আর মৌলবাদী আগ্রাসনে জনজীবনে নেমে এলো বিপর্যয়; প্রভাব সঞ্চার করল মারাত্মক। এ সময় কবিতার বিষয় এবং নির্মাণ কৌশল একেবারেই ব্যক্তির অন্তর্গত হয়ে ওঠায় অনিবার্যভাবে প্রচলিত রেওয়াজ-রীতির দেয়াল ধসে পড়ল। নব্বইয়ে শুরু হলেও তা ফুলে-ফলে পল্লবিত হতে সময়ে প্রয়োজন; ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই নব্বইয়ের কাব্যচেতনা, চিন্তাধারা, প্রাকরণিক কৌশল এবং কাব্যিকতা সম্প্রসারিত হলো শূন্য দশকে এসে। শূন্য দশকের তরুণ কবিদের হাতে এ নবতর ধারা কাব্যচেতনা ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। সবটাই হয়ে গেছে, এরকম মন্তব্য করতে সময় লাগবে কিংবা সে সময় এখনো আসেনি।
নব্বইয়ে প্রচল প্রথা ভেঙে বাংলাদেশের কবিতা যে যাত্রা শুরু করেছিল- মোটামুটিভাবে তার একটি রূপরেখা ইতোমধ্যেই স্ফূটতর হয়ে উঠেছে। অগ্রগমন অথবা অতিক্রমণের সেই রেখা সন্ধান করে খানিকটা সামনে এগিয়ে গেলে দেখতে পাই- শূন্যের কবিতা প্রধানত চিত্রকল্পময়। সেই অর্থে বাংলাদেশের ষাট-সত্তর অথবা আশির কবিতায় যে বিস্রস্ত বিবৃতি কিংবা এলিয়ে পড়বার ঝোঁক ছিল, তা সাম্প্রতিক সময়ের কবিতায় বলা যায় একেবারেই অনুপস্থিত। একালের কবিতার শব্দ-গাঁথুনি দৃঢ়, বিষয়-ভাবনা সংহত, শিথিল নয়। বেশ আঁটসাঁট; গুটিকয় চরণের মধ্যে নিষ্ঠ সংহতিতে কবি তাঁর ব্যক্তিজীবন কিংবা অভিজ্ঞানের কথা প্রকাশ করতে চান। এসব কবিতার অধিকাংশগুলোতে বিদ্যুতের ন্যায় ঝলকানি দেয় শব্দচিত্র, কখনো চিত্রকল্প; বিপ্রতীপ উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রতি কবির সনিষ্ঠ পক্ষপাত। অনেক ক্ষেত্রেই এসব কাব্য-ইমেজ একটা ঘোর-লাগা দ্যোতনা পাঠকের মনে সৃষ্টি করলেও পাঠক সত্যিকার অর্থে কল্পচিত্রটি মনের পর্দায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হন। সুপ্রচুর কল্পচিত্রের জটিলতায় পাঠক ক্লান্ত হয়ে পড়েন। উল্লেখ করা দরকার, নব্বইয়ের সম্প্রসারিত এই ধারার কবিতা সাধারণত আকারে ছোট। কখনো কখনো খুবই ছোট। প্রসঙ্গত এটাও জেনে রাখা ভালো যে, কবিতার পাঠোদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে অথবা ন্যূনতম বিষয়-ভাবের উপলব্ধি পাঠক-হৃদয়ে প্রবেশ না করায় এ সময়ের কবিতা থেকে পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তাতে কবির যায়-আসে না; কারণ জীবনানন্দ দাশের কালেও তাঁর কবিতাকে অশ্লীলতার পাশাপাশি দুর্বোধ্যতার দোষেও দুষ্ট চিহ্নিত করা হয়েছিল; এক ধরনের অপাঠ্য হিসেবেই বর্জিত হয়েছিল খোদ জীবনানন্দ দাশের কবিতা। এতে ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়নি তাঁর; কিংবা লেখাও বন্ধ করেননি তিনি। অথচ প্রায় এক শতাব্দীকাল [তাঁর প্রথম কাব্য ‘ঝরাপালক’ ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল] পার না হতেই তিনি বাংলা ভাষার অবশ্যপাঠ্য কবি হয়ে উঠেছেন; যদিও সম্পূর্ণ জীবনানন্দীয় রহস্যের সবটুকু কূলকিনারা এখনো করা সম্ভব হয়নি। এসব ঘটনাকে সামনে রাখা হলে এ প্রজন্মের কবিদের জটিলতাও এখন নয়, এক শতাব্দী পরের পৃথিবীতে কাব্য-রসিকজ্ঞরা হয়তো আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন। এক শতাব্দী পর এঁদেরও কেউ কেউ হয়তো জীবনানন্দের মতো সৌভাগ্যবান কিংবা জনপ্রিয় হবেন আবার সেটা নাও হতে পারেন। সুতরাং দুটোই হতে পারে; হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন, নয় লাভ করবেন গৌরবময় খ্যাতি। সুতরাং আগামীর রূপরেখাটা এরকমই অনিশ্চিত, অনির্ধারিত, সংশয়পূর্ণ।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভবিষ্যতের ভিত্তিভূমি অতীত; একইসাথে বর্তমানও বটে। আমরা এতোক্ষণ যে আলোচনা করেছি- তার মধ্যদিয়ে অতীতের একটা সারসংক্ষেপ জানতে পেরেছি। এ পর্যায় বর্তমানের বাংলা কবিতার রূপ-রঙ-রেখা-প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্য প্রকরণ কৌশল বিচার করে দেখা যেতে পারে।
নব্বই-উত্তর শূন্য দশকের এবং পরবর্তী দশকের কবিতার কিছু মৌল বিষয়-উপাদান এবং কৃৎকৌশল নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা দরকার। বাংলা কবিতার আদি-নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ ভিন্ন ভিন্ন ২৩ জন পদকর্তার রচনা হলেও সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ জুড়েই একটা সাদৃশ্য রয়েছে; ফলে শুধু পদকর্তাদের নামবিহীন পদগুলো যদি কোনো একজন পাঠকের সামনে দেয়া হয়- তাহলে তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে কোন্ পদের রচয়িতা কে! এর কারণ হচ্ছে- ভাষাগত পার্থক্য কিংবা স্বাতন্ত্র্যতা চর্যাপদে নেই বললেই চলে। উপরন্তু বৌদ্ধ সহজযান মতাবলম্বীদের দার্শনিক ঐক পদগুলোকে একই সুতোয় গেঁথে দিয়েছে। চর্যাপদের পদকর্তাদের স্বাতন্ত্র্য নির্ণয় যেমন দুরূহ কাজ, একই সংকট একালের কবিতা সম্পর্কেও উচ্চার্য। বিষয়গত সাদৃশ্য, প্রাকরণিক বিন্যাস প্রকৌশলেও যে ধরনের সাধারণীকরণ সম্ভব হয়, তার ফলে এ শংকা অমূলক নয়- শূন্য দশকের কবিদের কবিতা থেকেও যদি শুধু কবির লিখিত নামটি মুছে দেয়া হলে- কোন্ কবিতার রচয়িতা কে, তা সুনির্দিষ্ট করে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া অসম্ভব। অর্থাৎ সব রচনাই একজনের মনে হবে। এরকম ঘটবার কী কারণ, তা আলোচনা হয়েছে ইতোমধ্যেই। শূন্যের কবিতায় এই জেনারালাইজেশন নিঃসন্দেহে আমাদের আরোপিত নয়; উপরন্তু জেনারালাইজেশন বা সাধারণীকরণের ব্যাপারটিকে উড়িয়ে দেয়ারও সুযোগ নেই। তাহলে শূন্য দশকের কবিদের পরিচয়ের ব্যাপারটিও চর্যাপদের কবিদের মতো স্বাতন্ত্র্যহীন নয় কী! প্রসঙ্গত বলা কর্তব্য বলে মনে করি, শূন্য দশক থেকে যে বাংলা কবিতার চর্চা শুরু হয়েছে, সেখানে বিষয় নির্বাচন কিংবা করণকৌশলে কবির ভিন্নতায়ও পার্থক্য এতোটাই ক্ষীণ বা নগণ্য যে, তা অস্বীকার করা হলেও খুব বেশি বড় ত্রুটি কিংবা বিষয়টি একেবারেই অযৌক্তিক হয়ে ওঠে না। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে- শুধুমাত্র কবি-নাম এবং কবিতার শিরোনামের পার্থক্য দৃশ্যত প্রকারন্তরে কাব্যস্বরে কিংবা ভাষায় বিশেষ কোনো বিভাজন প্রায় অসম্ভব। বিশদভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের শত-সহস্র কবি মিলে যেন মাত্র একটিই কবিতা লিখছেন; রচিত হচ্ছে সামষ্টিক চিন্তাপ্রসূত ‘কমন’ একটিই মাত্র কবিতা। রচয়িতা ভিন্ন ভিন্ন জন কবিতাটির বিভিন্ন অংশ রচনা করছেন মাত্র। এর পরিণাম কোথায়, অথবা কখন এই কবিতাটি রচনা শেষ হবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব। প্রজ্ঞাপিত এই প্রকল্প থেকে বলা যায়, শূন্য দশকের কবিতার বিষয়-প্রকরণ পুনরায় কি তাহলে চর্যাপদের আমলের সামষ্টিক চেতনায় প্রত্যাবর্তন করেছে! বৌদ্ধ সহজিয়া পদকর্তাদের মতো একালের তরুণ কবিরাও সামষ্টিক কবিতা রচনা করছেন! এই সমষ্টির যোগফলে নির্মিত হচ্ছে একটি দীর্ঘকবিতার অথবা একটি অনিঃশেষ কাব্যনাটক। যে কাব্যনাটকের বিভিন্ন চরিত্র হিসেবে এক একজন স্বতন্ত্র কবি তার রচনাটি সংযোজন করছেন।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধ গ্রন্থে আধুনিক বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর দেখেছিলেন ‘দীর্ঘকবিতা’ ও ‘কাব্যনাটক’-এ; তিনি অবশ্য নিজে বেশকিছু দীর্ঘকবিতা রচনা করলেও কাব্যনাটক লেখার অবসার পাননি; লিখেছিলেন ‘কনভেনশন’ নামের একটি অসামান্য নাট্যকবিতা। জীবনানন্দের এ কথার প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়, বাংলা কবিতার সত্তর-আশি দশকের কোনো কোনো কবির রচনায়। কিন্তু সম্ভাবনাময় ‘দীর্ঘকবিতা’ রচনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল নব্বইয়ের কবিরা। এঁদের কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে দু’একটি কাব্যনাটক রচনা করলেও সামষ্টিকভাবে কাব্যনাটক চর্চা নব্বইয়ের কবিরা করেননি। পরবর্তী শূন্য দশকের কবিরা তো একেবারেই দীর্ঘকবিতা থেকে ফিরিয়ে নিয়েছেন মুখ।
এ প্রসঙ্গে অতীব জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে, তা হচ্ছে- আধুনিক গীতিকবিতার যুগে জীবনানন্দ দাশ দীর্ঘকবিতা বা কাব্যনাটকের সম্ভাবনার কথা কেন বলেছিলেন? এর ব্যাখ্যা জানা কর্তব্য। আসলে জীবনানন্দ চেয়েছিলেন কবিতায় গল্পের স্বাদ প্রয়োজন একালে। ঊনিশ শতক পেরিয়ে বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে ততোদিনে গল্প-উপন্যাস জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে; ক্রমেই গল্প-উপন্যাসের চাহিদা বাড়ছে সাহিত্য-রসিকজনের মাঝে। এমতাবস্থায় কবিতা যদি ব্যক্তিগত নির্মোক ছেড়ে বেরিয়ে আসতে না পারে তাহলে ক্রমেই কবিতা হারাবে তার গ্রহণযোগ্যতা। এমনিতেই বিশ শতকের প্রথমার্ধে লিরিকের ব্যক্তিগত বক্তব্যে পাঠক নিজেকে খুঁজে ব্যর্থ হচ্ছিল, তার উপর ছিল দুর্বোধ্যতার আরেক অজুহাত। কবিতার এই দুর্দিনের দুঃসময় থেকে উত্তরণের উপায় কি অথবা কিভাবে এই বৃত্ত থেকে কবিতার মুক্তি ঘটবে? একথা মাথায় রেখেই জীবনানন্দ কবিতায় অনুভব করেছিলেন নতুন আঙ্গিকের প্রয়োজনীয়তা; যেখানে [দীর্ঘকবিতায়] গল্পের কাহিনীকেও ‘একোমোডেশন’ বা স্থান করে দিতে পারবে কবিতা। এটা সম্ভব হলে, পাঠকও ফিরে আসবে কবিতার কাছে; কেননা পাঠক তখন কবিতায়ই খুঁজে পাবে নিজেকে- গল্প-উপন্যাসের মতোই। লিরিকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি অথবা চিন্তচেতনার প্রকাশ ঘটে; অপরের জীবনভাষ্য নয় লিরিক। কবিরা যদি স্বীয় সত্তাকে ব্যক্ত করার আবেগ খানিকটা সংযত করতে পারেন এবং দীর্ঘকবিতার মধ্য দিয়ে অথবা কাব্যনাটকের মাধ্যমে অপর-জীবনের ভাষ্যও কবিতায় তুলে ধরতে পারেন, তাহলে কবিতা ফিরে পাবে হৃত গৌরব, হারানো জনপ্রিয়তা। অন্যদিকে পাঠক পাবেন কবিতার সংহত, সংক্ষিপ্ত দেহাবয়বেই গল্পের স্বাদ; খুঁজে পাবেন নিজেকে। আমি পূর্বেই বলেছি যে, জীবনানন্দ দাশ আশাবাদ ব্যক্ত করলেও বাংলাদেশের কবিরা দীর্ঘকবিতার দু-একটি বিচ্ছিন্ন চর্চা ব্যতীত সামগ্রিক অর্থে ব্যাপক চর্চা করেননি; অবশ্য বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা কাব্যনাটক রচনাকে রীতিমতো আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি কবিরা। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম- রাম বসু, গিরিশঙ্কর, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, উত্তম দাশ প্রমুখ। তবে বাংলাদেশের কবিদের গায়ে কাব্যনাট্যান্দোলনের এই হাওয়া লাগেনি; এর পেছনে অবশ্য ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ক্রিয়াশীল ছিল অনিবার্যভাবেই।
বলছিলাম দীর্ঘকবিতার কথা, কাব্যনাটকের কথা। বিশ শতক পেরিয়ে আমরা এখন প্রবেশ করেছি একুশ শতকে; দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল তারও প্রথম দশক। এদেশ এখন কবির সংখ্যা সম্বন্ধে সঠিক গাণিতিক সংখ্যা দেয়া প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে নেটভিত্তিক লেখালেখির অবারিত সুযোগ হওয়ায়- এখন মফস্বল, শহর বলে কথা নেই; ইচ্ছে থাকলেই নিজের রচনাটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফেসবুক কিংবা ব্লগে অথবা নেটভিত্তিক ই-সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশ করা সম্ভব। ভার্চুয়াল এই মাধ্যমে প্রকাশিত লেখাটি পৃথিবীর সব প্রান্তেরই বাংলা ভাষাভাষী পাঠের সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে একজন লেখক এখন আর দৈনিকের সাহিত্য পাতার সম্পাদকের পিছন-পিছন না ঘুরে নেটভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকায়, ব্লগে অথবা ফেসবুকের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারছেন। যার অনিবার্য ফল হয়েছে, কবির সংখ্যা এখন আর হাতে গোনা নেই কিংবা সঠিক পরিসংখ্যানও দেয়া সম্ভব না।
ভার্চুয়াল মিডিয়ার এ সুবিধা ছাড়াও বাংলাদেশের সাহিত্যে বিগত এক-দেড় দশকে হাজার খানেকের বেশি ছাড়া কম নয় সাহিত্য পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ পেয়েছে। এখান থেকে যেমন প্রতিভাবান লেখক উপরে উঠে আসছেন, তেমনি ভার্চুয়াল মিডিয়া জগতেরও অনেকেই নজর কাড়তে সক্ষম হচ্ছেন পাঠকমহলের। আমাদের উপরের এ ব্যাখ্যা থেকে বুঝতে পারা যায়, একালে কবিতা তো বটেই সামগ্রিক অর্থেই সাহিত্যচর্চা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। প্রশ্নটা অন্যত্র- এরকম একটি বাস্তবতায় সামগ্রিক বাংলা কবিতাচর্চার ভবিষ্যৎ কী! সুনিশ্চিত বলা না গেলেও আমরা এই দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি যে, ব্যাপক এই কবিতাচর্চা বিচ্ছিন্ন বা একক অথবা স্বতন্ত্র কোনো ব্যাপার নয়; বর্তমান কবিতার বিষয়-প্রকরণ-কৌশলের পর্যবেক্ষণে আমাদের মনে হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে রচিত হচ্ছে একটি কবিতা; যা একইসময় ইনফিনিট দীর্ঘকবিতা অথবা কাব্যনাটকের লক্ষণযুক্ত। কেননা ইনফিনিট এই দীর্ঘকবিতা রচনায় যাঁরা অংশগ্রহণ করছেন, তারা প্রত্যেকেই কাব্যনাটকটির একেকটি পৃথক চরিত্রের ভূমিকা পালন করছেন মাত্র। ফলে আমরা নিঃসংশয় হয়ে বাংলা কবিতার এই ধারার ব্যর্থতার কথা যেমন বলতে পারি না, তেমনি ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ ব্যর্থতার বিপক্ষে সার্থকতার সিদ্ধান্তের সাথেও একমত হতে পারি না। এর প্রকৃত বিচারক অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম; যাদের গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে আজকের রচনার সার্থকতা কিংবা ব্যর্থতা নির্ণীত হবে।
বাংলাদেশের কবিতার সাথে এভাবে প্রতিবেশ পৃথিবীর সমসাময়িক সামাজিক বাস্তবতা জড়িয়ে গেলে সিকদার আমিনুল হকের মতো দু-একজন কবি ছাড়া কেউই বিশুদ্ধ কবিতার ‘সতত ডানার মানুষ থেকে’ অথবা ‘কাফকার জামা’য় নিমগ্ন থাকেন না। ফলে একইসময় বাংলাদেশের কবিতায় প্রাত্যহিক জীবনের দৈনন্দিনতা যেমন থাকে তেমনি মিলেমিশে একাকার হয় সৌন্দর্য চেতনা বা বিশুদ্ধ কাব্যচেতনা। আর এজন্যই পার্শ্ববর্তী বাংলাভাষী অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কাব্যধারা স্বতন্ত্র হয়ে যায় কিংবা বাংলাদেশের [সাতচল্লিশোত্তর] কবিতার সাথে সর্বগ্রাসী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে না। বাংলাদেশ যেমন স্বতন্ত্র দেশ, তেমনি বাংলাদেশের কবিতা এবং সাহিত্যও পৃথক পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে- ভালো হোক অথবা মন্দ হোক আলাদা গড়ন নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে পশ্চিমবঙ্গের সুনীল মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, নীরেন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখ কবি তাঁদের কবিতায় জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী আর্ট ফর আর্ট সেক [সাহিত্যের জন্য সাহিত্য] কাব্যধারা নির্মাণ করলেও বাংলাদেশের সাহিত্য জীবনানন্দ দাশের উত্তরপ্রজন্ম হিসেবে বিশুদ্ধবাদী শিল্পচর্চার পাশাপাশি জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং কবিতায় সমাজ-জীবনের প্রাত্যহিকতাও তুলে এনে এক ভিন্ন ধারা নির্মিত হয়েছে। এ ধারা এখন সন্দেহাতীতভাবেই বাংলাদেশের সাহিত্যের নিজস্ব অর্জন হিসেবে স্বীকৃতি লাভের যোগ্য। ইতোমধ্যে, অনেকেই অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের চেয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ ঘোষণা করতেও দ্বিধা করছেন না। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, যদি ধরেও নেয়া হয় আমাদের [বাংলাদেশের] সাহিত্য এখনো পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যকে অতিক্রম করতে পারেনি, তাহলেও স্বীকার করতে হবে আমরা অল্পদিনের মধ্যে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্বতন্ত্র পরিচয়ে সমাদর পাবো এবং সংঘাত-সংশ্লেষণ-প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের কবিদের উন্নতি সাধন অনিবার্য।