
প্রিয় সুকুমার রায়
শিশু-কিশোরদের জন্য অনেক কবি সাহিত্যিকই লিখেছেন তাদের মধ্যে সুকুমার রায় উজ্জ্বল নক্ষত্র বলা যেতে পারে। তাঁর লেখা কবিতার বই আবোল তাবোলের কবিতাগুলো শিশুমনকে চমৎকৃত করেছেন এক কাল্পনিক ও ভিন্ন ধরনের ভাষার ব্যাবহারের কারণে। বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয় ‘রামগরুড়ের ছানা’ কবিতাটি পড়েছ। কি চমৎকার কথা—
রামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা
হাসির কথা শুনলে বলে,
হাসব না-না, না-না।
সদাই মরে ত্রাসে ওই বুঝি কেউ হাসে!
‘গল্প বলা’ কবিতার কথাগুলো যেমন—
এক যে রাজা—থাম্ না দাদা
রাজা নয় সে, রাজ পেয়াদা।
তাঁর যে মাতুল—মাতুল কি সে?
সবাই জানে সে তার পিসে।
শিশু-কিশোরদের কাছে সুকুমার রায় একটি প্রিয় নাম। তিনি শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর পুত্র এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক সত্যজিত রায়ের পিতা। মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা। তিনি ঐতিহ্যবাহী একটি ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ফলে সুকুমারের উপর তাঁরও একটা প্রভাব পড়েছিল। এছাড়াও রায় পরিবারের সাথে বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। সুকুমার রায় বাংলার নবজাগরনের স্বর্ণযুগে জন্মেছিলেন। সুবিনয় ও সুবিমল তাঁর দুই ভাই। তাঁর একটি বোনও ছিল। পারিবারিক পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের সাথে নিজের প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতা নিয়ে তিনি নিজেকে একটা ভিন্ন মাত্রায় তুলে এনেছেন। সুকুমার রায় এর জন্ম কলকাতায় ১৮৮৭ সালের ৩রা অক্টোবর। তাঁদের আদি গ্রাম ছিল ময়মনসিংহের মসুয়া গ্রামে। তাঁর লেখা কবিতা ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ ছোটদের কাছে খুবই জনপ্রিয়।
তোমাদের স্মরণে আনার জন্য কিছু অংশ পরের পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করা হলো:
বাবুরাম সাপুড়ে,
কোথা যাস্ বাপুরে?
আয় বাবা দেখে যা,
দুটো সাপ রেখে যা!
যে সাপের চোখ নেই,
শিং নেই নোখ্ নেই,
ছোটে না কি হাঁটে না,
কাউকে যে কাটে না।
বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী সুকুমার রায় একদিকে বিজ্ঞান, ফটোগ্রাফি ও মুদ্রণ প্রকৌশল বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়েছিলেন ইংল্যান্ড থেকে। তিনি অভিনয়ও করেছিলেন ‘গোড়ায় গলদ’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে। তাঁর প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তিনি অদ্ভুত একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, নাম ছিল ‘ননসেন্স ক্লাব।’ এই ক্লাব থেকে পত্রিকা বের করা হত আর পত্রিকার নাম ছিল ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ এর রচনাগুলোও ছিল অদ্ভুত। বকচ্ছপ, সিংহরিণ, হাসজারু, হাতিমী ইত্যাদি অদ্ভুত কাল্পনিক প্রাণীর নাম তাঁরই সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের মত তিনিও ছোটদের জন্য লিখতে গিয়ে ছোট হয়ে যেতেন। তবে এই দুই জন কবির লেখার মধ্যে নিজেদের বৈশিষ্ট্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। ‘ননসেন্স’ সাহিত্যের প্রবর্তক সুকুমার রায় অপূর্বভাবে তাঁর এই অদ্ভুত ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন বলে এখনও ছোট বড় সকলেই তাঁকে ভালবাসেন ও শ্রদ্ধা করেন।
বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকাটি বেশ কয়েক বছর সম্পাদনা করেছেন সুকুমার রায়। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই ঐ সময় সুকুমার রায়ের সাহিত্য প্রতিভা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছিল। তিনি প্রধানত খেয়াল রসের কবিতা, হাসির গল্প, নাটক ও শিশুতোষ রচনার জন্য সুনাম অর্জন করেছেন। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করেছিলেন এবং এই ব্লক তৈরির একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ রয় নামের এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুকুমার রায় যুক্ত ছিলেন। বাগানের এক উড়ে মালী ছিল, ওকে নিয়েও তিনি লিখেছিলেন—
মালী নয়ত! মেহের আলী
মনের সাধে গাইছে বেহাগ
বেহাগ তো নয়! বসন্ত রাগ।
তিনি ‘বিষম চিন্তা’ কবিতাটিতে লিখেছেন—
মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার—
সবাই বলে, মিথ্যে বাজে বকিসনে আর খবরদার!
অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব?
বলবে সবাই মুখ্যু ছেলে বলবে তোমায় গো গর্ধভ
কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর?
সুকুমার রায়ের ছড়া-কবিতা পড়তে গেলে থামা যায় না। ছোট-বড় যারা বই পড়েন তাদের সংগ্রহে একখানা হলেও সুকুমার রায়ের বই থাকবেই। ‘সুকুমার রায়ের শিশু সমগ্র’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর লেখা যেগুলো এই প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়নি সেগুলোর কিছু নাম এখানে উল্লেখ করছি। বন্ধুরা এগুলো তোমরা সময়-সুযোগ করে পড়ে নিও কেমন? তাঁর লেখা—কুমড়ো পটাশ, হুকোমুখে হ্যাংলা, গোফ চুরি, বড়াই, বাবুরাম সাপুড়ে, সাধে কি বলে গাধা, ভাল ছেলের নালিশ, অসম্ভব নয় এ লেখাগুলো খুবই জনপ্রিয়।
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যায় অনার্সসহ বিএসসি করার পর সুকুমার রায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলাতে যান। ১৯১৩ সালে তিনি উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। সুকুমার রায়ের স্বল্প-স্থায়ী জীবনে নিজ প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ ঘটিয়ে ছিলেন। তাঁর লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশু সাহিত্যে মাইল ফলক হয়ে আছে। তাঁর বহুমূখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তাঁর অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে। প্রথম লেখা আবোল-তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও অনন্য।
ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বিষয়ে কয়েকটি বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখনও নোবেল পুরস্কার পাননি। সুকুমার প্রচ্ছদ শিল্পীরূপেও সুনাম অর্জন করেছেন। তাঁর প্রযুক্তিবিদ্যা আয়ত্তের পরিচয় মেলে নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরি আর ইংল্যান্ডের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রযুক্তিবিষয়ক রচনা থেকে। সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কাজ ছাড়াও সুকুমার রায় ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীর অন্যতম তরুণ নেতা, তিনি সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কাজ ছাড়াও ব্রাহ্ম সমাজের সংস্কারের জন্য অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। এসময় তিনি রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস সহজ-সরল ভাষায় লিখেছিলেন।
ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মন্ডা ক্লাব (মান ডে ক্লাব) নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব গড়ে তোলেন। তিনি জীবনের মধ্যগগন থেকেই ঝরে পড়েন অসময়। কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৯২৩ সালে মাত্র সাইত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র সত্যজিত রায় ভারতের অন্যতম চলচ্চিত্র পরিচালক রূপে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন এবং ১৯৮৭ সালে সুকুমার রায়ের উপরেও একটি প্রামান্যচিত্র নির্মাণ করেন।