
প্রাকৃতজনের ইয়াসিন এবং বাংলা কবিতার সৌন্দর্য
একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ নির্বাচিত ৯ গ্রন্থের আলোচনা প্রকাশ করা হল। গল্প ও কাব্যগ্রন্থ মিলিয়ে ৯টি গ্রন্থ নির্বাচন করেছি আমরা। উল্লেখ্য যে, এগুলো প্রতিকথার বাছাই এবং অভিরুচি।
গ্রন্থগুলো হল : কোথায় কোথায় ঘুমিয়েছিলাম– কবীর রানা, চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ– তাপস বড়ুয়া, আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান– বিজয় আহমেদ, জীবগণিত– আনিফ রুবেদ, জীবন এখানে এমন– মারুফ ইসলাম, ধর্ম নিরপেক্ষ বসন্ত– অনার্য নাঈম, শেকলের নূপুর– হানিফ রাশেদীন, আমাজান লিলি– নাজনীন সাথী, ভিন্ন দিনের জীবনায়ন- আকিম মহমদ।
বই : আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান ॥ ধরন: কাব্যগ্রন্থ ॥ লেখক : বিজয় আহমেদ
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২০ ॥ প্রকাশনা : কবিতাভবন ॥ প্রচ্ছদ : আরফান আহমেদ
কবিকে চেনার সবচেয়ে সেরা উপায় হচ্ছে তাঁর লিখিত অভিজ্ঞতা এবং শব্দসম্পদের ভেতরে স্থাপিত চিরায়ত চিন্তা ও সৌন্দর্যের ভেতরে প্রবেশ করা। কবিতা মূলত চিন্তা ও ছবির অর্জিত আশ্রম। পথ খুঁজতে খুঁজতে কবি একসময় ঢুকে পড়েন নিজের অমৃত জগতে। কল্পনা ও ভাষার নিত্যতায় সে জগতে সত্যের ধারক তিনি; সে জগতে তিনি একা ও ধীমান। সে জগতে ‘জলের বুকেতে জাগে চর মাতৃসমা’। লেখক-জীবনে এমন ঘটনাও ঘটে যেতে পারে যার ফলে কবির অভিজ্ঞতায় বিচিত্রতা এসে যায়; মনের দিগন্ত হয় প্রকৃত ও প্রসারিত। পদ্মার পলিতে জাগ্রত জীবন এবং জল-ধানের অভিজ্ঞানে মিশতে মিশতে রবীন্দ্রনাথ সোনার তরীতে ফেরেন। জীবিকাসূত্রে বিহারের জঙ্গলমহালে এসে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় লেখেন আরণ্যক। দেখা-অদেখার নিত্য জনজীবনের সান্নিধ্যে, বিনিময়ে কবির মন-মাধুর্যে প্রবেশ করে সত্য-অনুভব। কর্মসূত্রেই কবি বিজয় আহমেদ টাঙ্গাইল এসেছেন। এসে যমুনার বিস্তীর্ণ পলিতে মিশে গেছেন। জল-শাপলার যে জমিনে তিনি দাঁড়িয়েছেন সে জমিনে বোরো ধানের সুবাস। সে জমিনে গোচরে-অগোচরে সাদা শাপলার মতো উড়ে পরীর কাহিনি। সে জমিনে হাঁটবারে বিক্রি হয় গোলাপি-আতর। সে জমিনে জিকিরে জিকিরে ফর্সা হয়ে যায় জিন-পেতনি, রাক্ষস-খোক্ষস। রক্ত-মাংসের একটা গজার কানাওলা হয়ে ইয়াসিনকে সারারাত যমুনা কিংবা জল্লির বিলে ঘুরায়। প্রাকৃত-বিশ্বাসের এইসব মহাসঙ্গীতের সুর উঠে আসে বিজয়ের কবিতায়।
ইয়াসিনকে আবিষ্কার কিংবা ইয়াসিনের জীবনের দিকে তাকিয়ে বিজয় আহমেদের কবি-বোধটাই পাল্টে গেছে। নিজস্ব বোধের দিকে তাকিয়ে কবি ‘সার্কাস তাঁবুর গান’ কিংবা ‘মুচকি হাসির কবিতার’ জগত থেকে ফিরে নতুন কাব্যপথে হাঁটতে থাকেন। কবিতার যে পথে এসে তিনি দাঁড়িয়েছেন সে পথকে অনেকেই গ্রামীণ বলেন; পুরাতন কাব্যভাবনা বলে সে পথকে অনেকেই নতুন এবং নবাগত কবিতার পথ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মাটিকে ধারণ করেই মানুষের জীবিকা ও সংস্কৃতি। জৈবিক রঙে মানুষ মাত্রই অভিন্ন। জনপদের রীতি ও বৈশিষ্ট্যে, আচার ও ধর্মে অভিন্ন মানুষেরও ভৌগোলিক নিজস্বতা থাকে। সেই নিজস্বতাকে অস্বীকার করে, জাতির প্রাণ কথাকে অস্বীকার করে কবিতায় বৈশ্বিক রঙ হাজির করাটা অসম্ভব। নিজের স্বভাব ও সত্যকে না লিখতে পারলে অন্যকেও লেখা যায় না। নিজের প্রকৃত বোধ ও সত্যের ভেতরেই আছে চিরায়ত প্রকৃতি। মানুষের নিত্য যাপনকে অস্বীকার করলে শিল্পের কোন মৌলিকত্ব থাকে না। ‘যে জীবন ফড়িংয়ের, দোয়েলের……মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা’- জীবনানন্দ দাশের এই কথায় শতভাগ প্রত্যয় রেখেও বলি নিত্য যে জীবনের সাথে দেখা হয় সে জীবনকে কবিতায় প্রকাশ করাই সত্য-কবির কাজ। কবি জীবনের প্রারম্ভে বিজয়ও প্রাকৃত জীবনের সারলিক সত্যকে না লিখে তৈরি করা আরবানিক জীবন পদ্ধতিকেই কবিতায় লিখেছেন। আরবানিক টাইলস-পাথরের সেসব কবিতাতেও বিজয় আহমেদ ছিলেন স্মার্ট ও দুর্দান্ত। কিন্তু যমুনার তীরবর্তী জনজীবনের মাটি কবির চৈতন্যকে পাল্টে দিয়েছে। যে মাটিতে তিনি দাঁড়িয়েছেন সে মাটিকেই ভাবছেন বাংলা কবিতার শেকড়। সে মাটির ইয়াসিন কবিকে কল্পনায় প্রাণিত করছে। ইয়াসিন একটি নাম কিংবা ইয়াসিন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ কিংবা ইয়াসিন সমগ্র বাংলা মুল্লুকের সন্তান। বাহাত্তর পৃষ্ঠার কাব্যপুস্তকে ইয়াসিন বাংলার নিত্য-সংস্কৃতিকেই যেন বলে যাচ্ছেন। জনসংস্কৃতি থেকে ভাষা কখনই হারিয়ে যায় না। লোক-বিশ্বাসের অনেক আড়ালে ভাষা সংগুপ্ত থাকে। মুসলিম সংস্কৃতির পুঁথিপাঠ কিংবা রামায়ণ-মহাভারতের গীতল পরিবেশন কিংবা পালাগানের ভাষা এই জনপদ থেকে হারিয়ে যায়নি। জসীমউদ্দীন কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের মতো প্রকৃত মহাজন এই জনভাষাকেই নবরূপায়ন করেছেন। জনসংস্কৃতির এই ভাষাকে নবরূপায়নের আদর্শিক উত্তরাধিকারী হয়ে বাংলা কবিতায় বিজয় আহমেদের প্রবেশ। ‘আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান’ যেন বাংলা কবিতার নিজস্ব পথের আহ্বান। শক্তি ও হিম্মত নিয়ে বিজয় আহমেদ সে পথেই দাঁড়িয়েছেন; ছুঁতে চাইছেন আবহমান বাংলা কবিতার নিজস্ব পথ।
সব চেয়ে দুর্গম-যে মানুষ আপন অন্তরালে,
তার কোনো পরিমাপ নাই বাহিরের দেশে কালে।
সে অন্তরময়,
অন্তর মিশালে তবে তার অন্তরের পরিচয়।
পাই নে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার,
বাধা হয়ে আছে মোর বেড়াগুলি জীবনযাত্রার।
চাষি খেতে চালাইছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল—
বহুদূরপ্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার
তারি ’পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।
অতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানের চিরনির্বাসনে
সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।
মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে,
ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে।
জীবনে জীবন যোগ করা
না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পশরা।
তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা
আমার সুরের অপূর্ণতা।
আমার কবিতা, জানি আমি,
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।
কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।
সাহিত্যের আনন্দের ভোজে
নিজে যা পারি না দিতে নিত্য আমি থাকি তারি খোঁজে।
সেটা সত্য হোক,
শুধু ভঙ্গী দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ।
শান্তিনিকেতনে বসে ২১ জানুয়ারি ১৯৪১ সালে কবিতাটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মৃত্যুর মাত্র চারমাস আগে রবীন্দ্রনাথ এই সত্যোপলব্ধিতে পৌঁছেছিলেন। শুধু ভঙ্গি দিয়ে, স্টাইল এবং প্রকরণ দিয়ে কবিতা হয় না। কবিতা একটা আদর্শ। কবিতা একটা সাধনা। আশ্রমসাধুর সাদা গন্ধরাজের মতো কবিতা কবির নির্জন সাধনা। একটা আত্মপ্রত্যয়ে বিজয় আহমেদ প্রান্তিক জনপদের মানুষ ও সংস্কৃতিকে দৃষ্টি ও অভিজ্ঞানে কবিতায় আদর্শ করেছেন। গত পাঁচ বছর ধরে জীবিকাসূত্রে এই জনপদের মাটি ও মানুষের কাছাকাছি মিশে গেছেন। ‘শস্য ও পশুপালনের স্মৃতি’ কাব্যগ্রন্থের ভেতর দিয়েই জীবনের সাথে জীবন যুক্ত করে কবিতার বিচিত্র পথে প্রবেশ করেছেন তিনি। ‘আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধানে’ এই বোধ সংহত ও পরিপূর্ণ। আরবানিক বন্ধুও এই কাব্যের কোমল দীঘিতে মন ঠাণ্ডা করে নিতে পারেন। কারণ, তার নাড়িটা কোথায়! জীবন-জীবিকায় সেও একজন ইয়াসিন। কিংবা ইয়াসিন তার ভাই। প্রকৃতি নামের জমিনটা সে চাষ করে। সে সবাইকে বাঁচিয়ে রাখে।
দুই
বিজয় আহমেদের একাকী ইয়াসিন সমগ্র কৃষক শ্রেণির ইয়াসিন হয়ে সামনে আসে। মাটির সহজাত কণ্ঠস্বরে ধান যুবকের ঘ্রাণ নিয়ে সে কর্ষণ দুনিয়াকে শোনায় এবং দেখায়। কাব্যগ্রন্থের প্রথম থেকে শেষ পযন্ত ইয়াসিন একটা দীর্ঘ কর্ষণ মুহূর্তের অভিজ্ঞানকেই শুনাচ্ছে। গ্রন্থটা পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে কেউ যেন তাকে জীবন শোনাচ্ছে। একটার পর একটা ঘটনা কিংবা স্বপ্ন শোনাতে শোনাতে মানুষটা আমাদের চিরায়ত বাংলায় নিয়ে যাচ্ছে। পৌষের সকালে কিংবা বর্ষার মায়ায় পরিচিত তিরতির নদীর জলের মতো এই ভাষা সহজ ও নিরাভরণ।
বুকে পাতা সোনা কান কী যে আনচান
লাফাতেছে বুক এই তোমারে স্মরিয়া;
কী-বা পাবে রাখালের গলা কাটো যদি
যদি ভিজে যাও তেড়ে আসা তাজা রক্তে।
কাটা গলা কাছে নিয়ে শোনো ধুকপুক
শুনে নিয়ে রক্ত-স্রোতে প্রবল জিকির;
রাখালে জানে না মানে জল-স্তন-উরু
গজারের বুকে নারী, কেন এত তীরু?
বলি, তুলে নাও চোখ এই রাখালের।
দেখো লেখা পরীদের অসুখ-বিসুখ;
বাথানে ফসলে জাগা গান আল্লাহর
পীরের দরগা বুকে গজার ঝিনুক।।
মমতার জপ ছাড়া কী-বা পাবে আরো?
যদি সোনা গলা কেটে রাখালেরে মারো।
আমাকে গ্রহণ করবে বোরো ধান বলে।
শস্যখেতে থাকি আমি এতিমের দলে;
পূর্ব নয়, পশ্চিমের নয়, মমতার
কাছে দেহ কুর্চি খুঁজি না বারবার।
দুবুকের ভাঁজে আমি গোপন কাঁকই
তোমার নিকটে এসে শিশু রূপ পাই;
পালিত পশুর দলে যদিবা হারাই
মমতা ঋতুতে তবু পোষ মেনে যায়।
পশু শাবকের কোনো ভাষা নেই জেনো
প্রেম পেলে পেতে দেয় ডানা-গলা, ত্বক;
চন্দ্রাভিযানে গিয়েছ মরে, ফিরো নাই-
আর বোশেখেই জাগা চাঁদের রক্ষক।
তবু জোছনার ক্ষীর জমে চক্রাকারে
আধফোটা চাদে জাগে মৃত্যুফাঁদ কোনো।
তিন
জীবন-পরিধি আর অভিজ্ঞতার পরিসর থেকে উঠে আসে কবিতা। কবির কবিতা কবে, কেন, কখন পাঠকের দরবারে গৃহীত হয়; তা নির্ধারণের কোন সূত্র নেই। কবিতা মূলত যোগাযোগ; সময়ের সাথে, জনপদের সাথে গোত্রভাষার মাধ্যমে গোত্র কবির যোগাযোগ। বিশ্বায়ন আর আধুনিকতার হাল-হুজুগে মেতে গোত্রের কবিতা লেখা যায় না। যাপিত ভুবনকে অস্বীকার করে বিশ্বায়নের মন্ত্রণায় কান ও কল্পনা তৈরি করতে করতে অনেক কবিই নিজের ভূগোল থেকে হারিয়ে গেছেন। নিজের ভূগোলে জায়গা না হলে কোন ভূগোলেই কবি আর জায়গা পান না। বাংলার জল-মাটি, বাংলার হৃদয়ধর্ম, বাংলা সংস্কৃতির সাথে সমকালের কোন কবি যদি কাব্যের যোগাযোগ না রাখেন তবে তিনি বিশ্বকবি হতে পারেন; বাঙালির কবি নন।
কল্পনার তপস্যা-ভূমিতে কবি নিজের জীবনটাই লেখেন। লক্ষ্য সবারই থাকে। কবি নিজের লক্ষ্যে স্থির ও সচল। জীবন-চর্চায় কবির জগৎটা নিজের রচিত আশ্রম। সত্যিকার অর্থে জীবন নিয়ে কবি কখনই প্রতিযোগিতায় নামেন না। ‘জীবন-ধর্মের’ নিত্য চর্চায় কবি কখনই হারেন না। হারে রেসের জোকার কিংবা দ্রুত গতির স্প্রিন্টার। হার-জিতের দিকে না তাকিয়ে ম্যারাথন দৌড়ের সবচেয়ে পেছনের মানুষটি হয়ে কবি একা একা দৌড়াতে থাকেন। কবির দৃষ্টি কখনই কবিকে বঞ্চিত করে না। আমার কাছে মনে হয় কবির ‘কবি-দৃষ্টি’-টাই কবিতা। সেই দৃষ্টি দিয়েই কবি দেখেন—
মাছরাঙা শিকারের দিকে যে ভঙ্গিতে
যায়- মনে রেখো, এরপর মাছ তার
আপন শিশুর রূপে ধরা থাকে ঠোঁটে
কোনো বেহেশত নয়, সজাগ বৈশাখে।
চার
কল্পনার আশ্চয মুহূর্তে কবিতা নেমেছে। কল্পনাটাই কবির প্রকৃতি ও সাধনা। কবিতা হচ্ছে মাধ্যম। মানব-গানকে মানবের মাঝে পৌঁছানোর মাধ্যম। জীবনের দৃষ্টি ও ছক সব মানুষের এক হয় না। কবিও নিজের দৃষ্টি ও যাপনকেই লিখেন। কবি বিজয় আহমেদ কীভাবে এই কাব্যচৈতন্যে পৌঁছুলেন তার জবাব কিংবা অনুসন্ধান আমরা কবির লেখা থেকেই জানতে পারি। কবি বিধান সাহা এক অনুষ্ঠানে কবিকে তার প্রকাশিত নতুন কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। বিধান সাহার জিজ্ঞাসা ছিলো এরকম— ‘আপনার নতুন শেষ বই দুটোর যে ফর্ম, তা আপনার আগের বই দুটোর ফর্মের চাইতে আলাদা। আমার ব্যক্তিগত অবজার্ভেশন হলো, আগের বই দুটো আপনাকে বেশি অ্যাড্রেস করে। নতুন এই ফর্ম কেন বেছে নিলেন? আপনি নগরে বেড়ে ওঠা মানুষ। কাজ করছেন লোকজ ফর্ম নিয়ে। এই বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন’। কবি বিধান সাহার এই প্রশ্নের জবাবে কবি একটি দীর্ঘ উত্তর লিখেন। কবি বিজয় আহমেদের কবি মানসকে বুঝতে সুবিধা হবে ভেবে এই দীর্ঘ উত্তরটিই আমি তুলে দিচ্ছি—
“বিধান, আমার জন্ম গ্রামে। শৈশব গ্রামে। কৈশোরের অদ্ভুত সময় কেটেছে নানার বাড়িতেই। তারপর হাইস্কুল ও কলেজ ঢাকায়। ইউনিভার্সিটি জীবনে পুনরায় এক গ্রামেই ফিরে যাই আমি। কেননা চুয়েট চট্টগ্রাম শহর থেকে অনেক দূরে, রাউজানের গ্রামেই অবস্থিত। ক্যাম্পাসের দেয়াল পেরুলে সুবিস্তীর্ণ ধানখেত, সুবিশাল পাহাড়শ্রেণী আর এক মহাদরদী নদী, যার নাম কর্ণফুলী।
আচ্ছা তারপর পড়ালেখা শেষে চাকরীজীবনের ১ম তিন বছর কেটেছে ঢাকায়। এরপর আবার গ্রামেই ফেরত এসেছি আমি। চাকরীসূত্রে। সেও প্রায় ৮ বছর৷
এগুলো প্রাসঙ্গিক আমাকে জানানোর জন্য। যদিও আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য এত কথা না বললেও হতো। ‘আমি বেড়ে উঠেছি শহরে আর লিখছি লোকজ ফর্ম’-এ বিষয়টি আমি ভাবি অন্যভাবে বিধান। আমার লেখালেখির দ্বিতীয় ভাগে যা লিখছি, তা লোকজ ফর্ম বলে খাটো কইরেন না আসলে। আমার মনে হয়, এটা কোনো ফর্ম না বিধান। এটা নিজের পা, ভূমি, পায়ের তলায় যে মাতার মত মাটি তার কথা লেখা। নিজের ভূমির দিকে ফেরত যাওয়া। আমাদের এখানে বহু চর্চিত কলকাতার প্রভাবকে অস্বীকার করতে চাই আমি। অন্য দেশের জীবন, প্রেম লিখতে রাজী নই আমি।
বিধান, এটা অনেক পুরানো কথাই। আল মাহমুদ বলতেন, ‘কবিদের একটা দেশ লাগে।’ সেই দেশ অন্য দেশের কবিতার বই থেকে বা অন্যের মুখ থেকে শোনা কোনো দেশ নয়। সেই দেশ হল বাংলাদেশ। সেই দেশ হইল একটা ভূখণ্ড।
বিধান, নিজের দেশ যে সাহিত্যে বা কবিতায় নেই সেটা সাহিত্যবাচ্য/কবিতাবাচ্য হতে পারে বলে আমি মনে করি না এখন। বিদেশ সারাজীবন বি-দ্যাশ। মনে করে দেখেন দূর ফ্রান্স থেকেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দেশের মজিদের কাছে ফেরত আসেন। আসতে বাধ্য হোন। একটা দীর্ঘ সময় লন্ডনে থাকার পরেও, সৈয়দকেই (সৈয়দ শামসুল হক) লিখতে হয় ‘পরানের গহীনের ভিতর’ নামক কাব্যগ্রন্থ। আর এই মহাপ্রাজ্ঞ সাহিত্যিক মৃত্যুর পর ফেরত যান কুড়িগ্রামে। আমাদের সবচে বড় কবি আল মাহমুদ ফেরত যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। আপনিও যেমন মাতৃ-স্মৃতি নয়, মায়ের উষ্ণতার খুঁজে যেতে চান সিরাজগঞ্জে ফিরে। আমি আসলে বিধান, একটা ভূখণ্ডের খোঁজ করতে বেরিয়ে পড়েছি। এখানে সাহিত্য করতে চাওয়ার কোনো সম্পর্ক নাই। এখানে দেশ, মাটি আর দেশের মানুষের জীবনের কাছে যাওয়াই মূল সত্য।
ধন্যবাদ বিধান, দেখেন বোরোধান কাটার সময় ইয়াসিনের সাথে আপনার সাক্ষাৎ হয়েছিল কী না কোনোদিন? যদি দেখা হয় এরপর, সিরাজগঞ্জের এক সন্ধ্যায়, ধুনট নামক কোনো পল্লীতে, তাইলে তাকে আমার কাব্যগ্রন্থের কথা বইলেন। বইলেন, তাঁর কথা আমি লেখার চেষ্টা করেছি।”
প্রতিদিনের যাপনের ভেতরে আমাদের অনেক মোহ থাকে। সেই মোহে ইয়াসিন যেমন ‘গজারের মোহে পড়ে পাপ কিনে’ কিংবা ‘কুফরি কালাম জপে ছুঁয়ে দেয় দেহ’। কিন্তু কবির কল্পনায় কোন মোহ থাকে না। থাকে সত্য-যাপন। বিজয় আহমেদের কবি মানসকে বোঝার জন্য উপরের কথাগুলো খুব জরুরি। জনপদের একটা অকৃত্রিম জীবনাখ্যানকেই কবি লেখার চেষ্টা করছেন।
পাঁচ
কবিতা লিখে পাঠক-বন্দিত হওয়া খুব কঠিন। অমোচ্য কালিতে মনের খাতায় পাঠক কোন কবিতাকে লিখবেন এটা বলা খুব কঠিন। কবিতা মূলত ‘সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি’। সময় যে কতো রূপে প্রবাহিত হয়; উত্থান হয়, পতন হয় কিন্তু সময়ের ঘড়িটা থাকে। মেঘ-নির্জনতা ছিঁড়ে সে ঘড়িটাকে কোন-না-কোন পাঠক আবিষ্কার করবে। পাঠক আবিষ্কার করবে বিজয় আহমেদের এই কবি দৃষ্টিটিকে। পাঠক বুঝতে পারবে ফসলের হাসির মতো এই কলমটায় ঋতুর গন্ধ; সমকালের কবি বন্ধুদের কাফেলা রেখে এসে এই কলমটা আলাদা।
সত্য মূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি
ভালো নয়, ভালো নয় নকল সে শৌখিন মজ্দুরি।
রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধির সাথে কবি মূলত মিশে গেছেন। কবিতা লিখতে এসে কবি শৌখিন মজ্দুরি করেননি। সমালোচকগণ প্রশ্ন তুলতে পারেন ইয়াসিন কিংবা ইয়াসিনের সোসাইটি কি এই কবিতা পড়বেন? কবিতা কখনোই কারো জন্য লেখা হয় না। তাহলে কি কবিতা অবলুপ্ত হয়ে যায়? না; কবিতা ফুরিয়ে যায় না। কবিতা থাকে। কোন এক আশ্চর্য জীবনের মোহরছাপ হয়ে কবিতা থাকে। পথের ভাঁটফুলের সাথে কবিতায় লেগে থাকে সময়ের ঝরনার ছাপ। ইয়াসিনকে অস্বীকার করে বাংলার কোন আলাদা সোসাইটি নেই। সোসাইটি ছাড়া, ভূগোল ছাড়া কোন কবিতাতেই আত্মা থাকে না। সোসাইটির বোধ ও সংস্কৃতিই আত্মা হয়ে কবিতায় প্রবেশ করে। এই সোসাইটির বোধ ও দর্শনকে সময়ের ইয়াসিন কিংবা নতুন দিনের ইয়াসিন অবশ্যই পাঠ করবেন।
বিজয় আহমদের শব্দজগৎ আর বলবার কৌশল এই সময়ের কিংবা বিগত সময়ের কারো সঙ্গেই মেলে না। কিন্তু তিনি যে খুব নতুন শব্দ বলেন কিংবা নতুন চিত্রকল্প ও বয়ান তৈরি করেছেন এমন নয়। পরিচিত জীবনের একটা সারলিক সৌন্দর্যই বিজয়ের কবিতার শক্তি। আমাদের প্রত্যেকের শেকড়ই গ্রামে। জীবিকার স্তব্ধ নাগরিকতায় আমারা কেউ কেউ আরবানিক আয়নায় মুখ দেখি। কিন্তু আমাদের শান্তি ও শেকড় প্রোথিত আছে গ্রামে। ইয়াসিন সেই অকৃত্রিম জীবনের সহচর।
ছয়
একটা বৃত্তাবদ্ধ চলমান পরিমণ্ডলে আবৃত থেকে নিরন্তর অনুকরণ করে যাওয়া কোন যোগ্য কবির ভবিতব্য হতে পারে না। সব দেশের সাহিত্যের একটা সাধারণ লক্ষণ হলো তাদের সৃষ্টিতে সময় ও দেশ কালের প্রবণতা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, রঙ ও নিসর্গ, ব্রতপার্বন, গার্হস্থ্য জীবন, শ্রমজীবী মানুষের নিত্যকথা, লোকায়ত জীবনের অভিরূপ তুলে ধরেন কবিতায়। দেশকালোত্তীর্ণ হবার উদ্বেগ-আয়োজন দিয়ে গোত্রভাষার কবিতা লেখা যায় না। গোত্রভাষার কবিতায় মাটির একটা মৌলিক গন্ধ থাকে। বলবেন, মাটির আবার মৌলিকত্ব কি? ভাষা ও নৃ-বৈশিষ্টের সাথে সাথে মাটির স্বভাবেই ভিন্ন হয় প্রাণ ও প্রকৃতি।
দেশ ও দেশীয় চিন্তার প্রকৃতি ও প্রকরণকে গুরুত্বহীন ভেবে একটা উলটো ঝোঁক গড়ে উঠেছিলো তিরিশের দশকে। এই বোধকে প্রতিজ্ঞায় নিয়ে অনেকেই আধুনিক কবিতার স্নাতক হয়েছেন। তবে পশ্চিমবঙ্গের কবি ও কবিতাকে বাদ দিলে বলা যায়, ত্রিশের দশকের কাব্যচিন্তাকে বাদ দিয়ে জসীমউদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদের মতো মহৎ কবিরা ঠিকই মাটির সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছিলেন। ‘আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান’-তারই উত্তরাধিকার।
বিজয় আহমেদের ‘ইয়াসিন’ নিসঙ্গ নন। একাকী ইয়াসিন সমগ্র কৃষক শ্রেণির ইয়াসিন হয়ে সামনে আসেন। মাটির সহজাত কণ্ঠস্বরে, ধান-যুবকের ঘ্রাণ নিয়ে সে কর্ষণ দুনিয়াকে দেখায় এবং শোনায়। পরম মমতায় শৈল্পিক চক্ষুতে কবি সময় ও দুনিয়ায় ইয়াসিনের স্বপ্ন ও লড়াইটা লিখতে থাকেন। আমাদের নিত্য-নৈমিত্তিক পৃথিবীতে কবি শব্দটাই বিদ্রোহবাচক। অনেক প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠানের সাফল্য চেয়ার রেখে কবি নিজের কাছেই ফিরে আসেন। যতই মুখচোরা একাকী থাকেন না কেন কবি স্বার্থ ও অচল নিয়মকে প্রত্যাখ্যান করেন। দৃষ্টি ও কল্পনায় নিজের আত্মার কাছে সমর্পিত হতে হতে কবি নিজের কাছে সত্য থাকেন। সত্যকে অস্বীকার করলে কবিতায় জীবন দেখা যায় না।
আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান এই
আমাকে গ্রহণ করো। অতৃপ্ত আত্মার
মতো। বেরহম জিন ভেবে। কোনো মার
বুকের উত্তাপ থেকে খসে পড়া তারা…
আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান এই
ভূমি থেকে বিল নদীনালাখাল থেকে
গজার শোলের পেট থেকে নিভৃতের
জেগে ওঠা সন্তানের মতো বেপরোয়া’।
সাত
বাংলা কবিতায় লোকায়ত জীবনের এক মগ্নরূপ আছে জসীমউদ্দীনের কবিতায়। চেতনাগত দিক থেকে জসীসউদ্দীন কিংবা ‘রূপসী বাংলার’ সাথে মিল থাকলেও বিজয় আহমেদের কবিতার পথ সম্পূর্ণ তার নিজস্ব। ‘রূপসী বাংলা’ কিংবা ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কিংবা ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’ কাব্যগ্রন্থের প্রভাবও তার কবিতায় পড়েনি। তবে এইসব কাব্যগ্রন্থের ভাষা, চরিত্র, ও বিষয় কবির চিন্তার পরিসরকে সমৃদ্ধ করেছ। ইয়াসিনের মতো সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের ভাষা ও সৌন্দর্য তার কাব্যের বিষয় ও প্রকরণ হয়ে এসেছে। প্রতিদিনের নিত্য ভাষা ও আটপৌরে কথনভঙ্গিই এই কবিতাগুলোর শক্তি।
সব মিলিয়ে ‘আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান’-এ আছে প্রেম, জীবিকা, আচার-বিশ্বাস ও যাপিত জীবনের অকৃত্রিম লড়াই। বাহাত্তর পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থে বাষট্টিটি কবিতা আছে। প্রত্যেকট কবিতাই বাংলার চিরায়ত গল্প ভঙ্গিতেই বলা। চার-পাঁচটি কবিতা বাদ দিলে প্রায় প্রত্যেকটি কবিতাই সনেট। আট-ছয় মাত্রার বিন্যাসে অক্ষরবৃত্তের প্রবহমান গতিতেই প্রত্যেকটি কবিতা এগিয়েছে। গল্পের গতিতে কোন কোন কবিতার বিস্তৃতি ও পরিসর চৌদ্দ পঙ্ক্তিকেও অতিক্রম করে গেছে। ছন্দের ক্ষেত্রে কবি যে সর্বাংশে সফল হয়েছেন একথা বলা যাবে না। কোন কোন শব্দের প্রতি অধিক দরদে শব্দটির শক্তি অনেকাংশে ম্লান হয়ে গেছে। যেমন ইয়াসিন যখন তার প্রিয়াকে সম্বোধন করে এতোবার ‘সোনা’ ‘সোনা’ উচ্চারণ করেন, তখন শব্দটিকে খুব ক্লিশে লাগে। শুনতেও ভালো লাগে না খুব।
এই সব দু’একটা আলগা শব্দ কিংবা ছন্দত্রুটিকে ছাপিয়ে প্রাকৃতজনের যাপিত স্বপ্ন ও লড়াইটাই এই কাব্যের শক্তি। যে কোন লেখায় একটা স্থানপট থাকে। থাকে সময় ও ভূগোলের আলিঙ্গন। সময় ও ভূগোলের নিজস্ব শক্তিতে ‘আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান’ বাংলা কবিতার নিজস্ব ও চিরায়ত সম্পদ।
আমি ইয়াসিন ডাকো বোরো ধান বলে;
হামাগুড়ি দিয়ে বিল-কাদা মাতৃক্রোড়
ছেড়ে, আধফোটা চাঁদ কাঁধে পৌঁছে যাব
ঠিক-পদ্মজলে গাঢ় নিদে থাকা এই
সজল বাংলা বুকে। আমিও সন্তান
তার, যেই ভাবে, তোর পদ্মের নাভিতে
মুখ দিই দম টানি। একই ভঙ্গিতে
যদিও তোমার স্তনবৃন্ত ঢেকে যায়
ফুলে। বৈশাখের ধান ঘ্রাণে, অবারিত।
আট
‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’ কাব্যগ্রন্থ পড়ে পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছিলেন, “আমি হিন্দু। আমার নিকট বেদ পবিত্র, গীতা পবিত্র, কিন্তু ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’ পুস্তক তাহার চাইতেও পবিত্র। কারণ ইহাতে আমার বাঙলা দেশের মাটির মানুষগুলির কথা আছে। আমার গ্রামগুলির বর্ণনা আছে।” যমুনার স্নেহে একটা জনপদ ভাষা ও আচারে যতটা সমৃদ্ধ তার সবটা পরিচয় উপস্থিত আছে ‘আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান’ কাব্যগ্রন্থে। দেশ ও দেশের মানুষের কথা সমকালে এমন দরদি ভাষায় আর কেউ লিখেননি।
সৌন্দর্য একটি অক্ষয়, অমৃত ও অবিনাষী ধারণা। কবিতা শেষ পর্যন্ত শান্তি ও সৌন্দর্য-ই তৈরি করে। প্রজ্ঞা ও কল্পনা মেশানোর পর জীবনের বিবরণে যিনি যত নিখুঁত তিনি তত বড় শিল্পী।
তুমি জংলার ফুল কানে গেঁথে রাখি
সুবাস লুকায়ে রাখি গামছা পিরানে
যেখানে বৃষ্টির তীর করে না আহত
যেখানে পক্ষীর রাজা মৃত–বনবাসে;
যেখানে ষাঁড়ের খুলি ঝোলাই গোয়ালে
যেনবা শত্রুর মুখ পোড়া গান বাজে।
জর্দার কৌটায় রাখা গোপন আয়না
থেকে, যার মুখ উঁকি মারে, তার নাম
দূর্বাঘাস, দুয়োরানি বলে প্রেমে পড়ো-’
নয়
ভবিষ্যতের কবিতা ঘাসফুল না মাছরাঙা হবে এ সম্পর্কে আগাম উচ্চারণ অসম্ভব। ভূমির ভাষা ও ঘ্রাণ মিশিয়ে সময়ের যন্ত্রণা ও সৌন্দর্য মাখতে মাখতে ভবিষ্যতের কবিতা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বিদ্বেষ ও কদর্যতাকে জয় করবে ভবিষ্যতের কবিতা। সভ্যতার সঙ্গে বর্বরতার একটা দ্বন্দ্ব থাকেই; ভবিষ্যতের কবিতা সমাজ ও মানুষের অধঃপতন ঠেকিয়ে শান্তি ও আশার আলো দেখাবে। একটা আদর্শিক ও বাস্তবিক সমাজের গন্ধরাজ ফুল ভবিষ্যতের কবিতা। সুবিধাভোগীরা কখনই লাভজনক প্রকল্পগুলো মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেবে না; সুন্দরের আহ্বানে ভবিষ্যতের কবিতা মানুষকে একত্রিত করে এইসব অপ্রকৃত নিয়মকে রুখে দিবে।
কবিতার খেয়াঘাট ভবিষ্যতে কোন দিকে যাবে কে বলতে পারে। কবিতার পক্ষে, কবির পক্ষে ভূমির মানুষকে স্বপ্নে স্বপ্নে আশাবাদী করাই প্রকৃত কবির কাজ। কবিতা মূলত বাস্তবতার ‘রি-প্রেজেন্টেশন’। ‘রি-প্রেজেন্টেশন’ বলছি এই কারণেই, যেখানে কাল থেকে অনাদিকালে একই বাস্তবতার বিভিন্ন বৈচিত্রকে নতুন রঙে আঁকতে থাকেন নতুন দিনের কবি। বাস্তবতাকে সময় মিশিয়ে নিজের রঙে বলাটাই নিজের কবিতা। সময় ও প্রাকৃত জনের কাছে ‘সবার উপরে কবিতা সত্য; তাহার উপরে নাই’। কারণ কবিতাই আচার-বিশ্বাস-শক্তি। কবিতাই সংস্কৃতি। নিজের রঙ মিশিয়েই বিজয় আহমেদ বাংলা কবিতা লিখছেন। এই কবিতায় অনেক প্রাকৃত-কবির উত্তরাধিকার আছে। কিন্তু ভাষাটা, বয়ানটা, জনপদের ভেতর থেকে ইয়াসিনকে আবিষ্কার করাটা সম্পূর্ণ মৌলিক ও নিজস্ব। জনপদের ভেতরেই ছড়িয়ে ছিলো এই ভাষা। দক্ষ শিল্পী হয়ে কবি পুরো কাব্যগ্রন্থে বোরো ক্ষেতের ঢেউয়ের মতো এই ভাষাকেই ছড়িয়ে দিয়েছেন।
কবিতা মূলত যোগাযোগ। সময়ের সাথে জনপদের সাথে, গোত্র ভাষাভাষীর সাথে গোত্র কবির যোগাযোগ। একটা দায়ের ভেতরে বসবাস করেন যে শিল্পী সে শিল্পীর ফসল ও অঙ্গীকার ‘আমি ইয়াসিন আমি বোরো ধান’। এই দায় থেকেই বিজয় আহমেদ বলেন— ‘বোরোধান কাটার সময় ইয়াসিনের সাথে আপনাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল কি কোনোদিন? যদি দেখা হয় এরপর, সিরাজগঞ্জের এক সন্ধ্যায়, ধুনট নামক কোনো পল্লীতে, তাইলে তাকে আমার কাব্যগ্রন্থের কথা বইলেন। বইলেন, তাঁর কথা আমি লেখার চেষ্টা করেছি।’ দরদ, মমতা, মনন দিয়ে বাংলা কবিতায় ইতোপূর্বে আর কে ইয়াসিনকে এঁকেছেন!