
প্রসঙ্গ ‘উড্ডয়নসূত্র’ : প্রতিকথায় ধারাবাহিক-প্রকাশনা বন্ধ হবার নেপথ্যে লেখকের কৈফিয়ত
জয়, মোহন, আকতার, জুয়েল এবং আমাদের গল্পকথক (যার নামটি আমরা কোনদিন জানবো না)—পূর্ব নাখালপাড়ার এই পাঁচটি উড়নচণ্ডী তরুণ এবং তাদের গলিতে ভাড়াটিয়া হিসেবে আসা রাখী নামক এক আশ্চর্য সুন্দরী তরুণী যখন নড়ে চড়ে উঠল আমার ক্যানভাসে, তখুনি আমি জানতাম, এরা একটা অঘটন ঘটাবে। সংঘটিত হবে একটা কোন ভয়ংকর অপরাধ—কিন্তু কী সেটা— তার কোন পূর্বানুমান আমার ছিল না। ঘটনার মাত্রা-আকার-প্রকরণ—কিছুই জানা ছিল না বলে যখন ঘটনাটি ঘটল, ঘটাল এই তরুণেরাই—তখন আমি হকচকিয়ে গেছি, যেমন হকচকিয়ে গিয়েছিল ঐ পাঁচ তরুণ—কারণ, যা ঘটতে চলেছিল, তার কোন পূর্ব-পরিকল্পনা ওদের ছিল না। এবং উড্ডয়নসূত্রের লেখক হিসেবে নিয়তির ঐ সুনির্দিষ্ট ক্ষণটির কোন পূর্বাভাস আমি ওদেরকে দিতে পারিনি।
কিন্তু সেভাবে চিন্তা করতে গেলে, ওদের দৈনন্দিনের কোন ঘটনাটির পূর্বাভাসই বা আমি দিতে পেরেছি পুরো উপন্যাস জুড়ে? এমনকি ওদের চারিত্রিক যে বৈশিষ্ট্যগুলো—এই যেমন, মোহন যে সুন্দর গান গায়—সেটা তো আমি লোডশেডিংয়ের আঁধারে কাজেম মিয়ার পতিত জমিনটাতে ওদের সাথে বসে নিজাম বেকারির চা আর বাখরখানি খেতে খেতে আবিষ্কার করি। মহল্লার কোণায় ওদের সাথে সাথে আড্ডা দিতে দিতেই তো আমি সুরমনের মুখে ওদের মতোই প্রথমবারের মতো জানতে পারি—সতের নাম্বার বাড়ির দোতলায় একটা ‘লাল্লু’ মেয়ে ভাড়াটিয়া হিসেবে এসেছে—যার নাম রাখী।
এমনটা ঘটে, ঘটেছে উড্ডয়নসূত্রের পুরো অবয়ব জুড়ে। এ উপন্যাসে আমার ভূমিকা ছিল যতটা না লেখকের, তারো চেয়ে বেশি হয়তো একজন উৎসুক অবজার্ভারের। আমার কাজ ছিল পাড়ার ঐ প্রায় বখে যাওয়া পাঁচটি তরুণের কর্মকাণ্ডে চোখ রাখা, এদের গতিবিধির উপর উৎসুক্য দৃষ্টি মেলে লিপিবদ্ধ করে যাওয়া ওদের রোজনামজার খতিয়ান। তাই ওরা যখন তর্ক করছিল হুমায়ূন আজাদ এবং হুমায়ুন আহমেদ নিয়ে—সেটা যেমন আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছি, ওরা যখন তামাক ফেলে দিয়ে সে জায়গায় গাঁজা পুরে ভাগাভাগি করে সিগারেট টানছিল—তার নিষিদ্ধ মৌতাতের আমেজ আমিও পেয়েছি যথারীতি। ওরা এগুচ্ছিল, আমিও এগুচ্ছিলাম, তৈরি হচ্ছিল উড্ডয়নসূত্র—কিন্তু এ যাত্রার কোন অংশেই আমি নেতৃত্ব দেইনি, পথ দেখাইনি কোন ঘটনার।
প্রতিকথার সম্পাদক হানিফ রাশেদীনের সঙ্গে আমার যখন ধারাবাহিক এই উপন্যাসটি নিয়মিত ছাপা হবার ব্যাপারে কথা হয়, তখন এর মাত্র দুইটি অধ্যায় লিখিত হয়েছিল। তার মানে, একটি প্রচণ্ড ঝুঁকি আমি নিয়েছিলাম। ঝুঁকি নিয়েছিলেন হানিফ রাশেদীনও। তার হয়তো আস্থা ছিল আমার উপর যে লেখাটি চালিয়ে যেতে পারবো। কিন্তু সত্যি বলতে—আমার নিজের উপর নিজের আস্থা ছিল না। বেশ কয়েকটি উপন্যাস এবং গল্প শুরু করে দিয়ে শেষ করার উৎসাহ পাইনি আমি—যার চরিত্ররা এখনো সময়ে অসময়ে আমার দৈনন্দিনে বাগড়া দিয়ে জানান দেয় যে—আমি ওদের নিয়তি নির্দিষ্ট করিনি বলে ওরা পড়ে আছে অনির্দিষ্ট নিয়তিতে। স্বভাবতই নিজের খামখেয়ালিপনার এই শংকাটি আমার মনে ছিল পুরো মাত্রায়। তবে ঐ যে লিখিত হয়ে যাওয়া দুটো অধ্যায়—তাতে পূর্ব নাখালপাড়ার তরুণেরা এমন সতেজ উদ্দীপনা নিয়ে হাঁটাচলা করতে শুরু করেছে আমার একুশ ইঞ্চি ডেস্কটপের স্ক্রিণ জুড়ে—আমার কাছে মনে হয়েছিল, আমি হয়তো ওদের উপর আস্থা রাখতে পারি। তার মানে ঘটনা দাঁড়িয়েছিল এই—আমি একটা করে অধ্যায় শেষ করি, আর সেটা শেষ হতে না হতেই প্রতিকথায় ছাপা হয়, বেশ কিছু সহৃদয় পাঠক সেটা পড়েন, আমি এবং পাঠকরা একসঙ্গে আবিষ্কার করতে থাকি দুইহাজার চার সালের দিকে বেড়ে ওঠা পাঁচটি তরুণের খবরাখবর, পূর্ব নাখালপাড়ার গলি-ঘুপচির সংবাদ।
এই করতে করতে যখন উনিশটি পর্ব ছাপা হলো প্রতিকথায়, তখুনি হঠাৎ ঘটনাটি ঘটলো—আটাশ রমজানের রাতে খুন হয়ে গেলেন পাড়ার সাদেক ভাই। ঐ যে বলেছিলাম, আজ থেকে পনের বছর আগে পাঁচটি তরুণ একটি ভয়ংকর অপরাধ করেছিল—এমন একটি পূর্বধারণা আমার ছিল, কিন্তু সেটা যে ‘খুন’— তা আমি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি। যার ফলে খুনটা সংঘটিত হয়ে গেলে আমি এবং তরুণেরা যুগপৎ ভীত এবং বিস্মিত হয়ে পড়ি। আমরা আঁতকে উঠি, দিশেহারা হয়ে পড়ি, এবং হঠাৎ খেয়াল করি—উড্ডয়নসূত্রের ক্যানভাস আচমকা পাল্টে গেছে। বেশ ঢিলেঢালা ভাবে গড়ে তোলা প্লটে অতি আচমকা ‘থ্রিলারের’ আমেজ ঢুকে পড়েছে। কেননা, কে-না জানে, খুন ঘটিয়ে ফেলা খুব কঠিন কিছু নয়, কিন্তু খুন পরবর্তী কর্মকাণ্ড—এই যেমন, লাশ গায়েব করা থেকে শুরু করে ঘটনা হজম করা—সেটাই মূল ব্যাপার। আমার তরুণেরা এখন আর স্রেফ পাড়ার উঠতি উড়নচন্ডী তরুণ নয়, রীতিমত খুনির তকমা লেগে গেছে ওদের প্রোফাইলে। আমার এবং তরুণদের অন্যতম দায়িত্ব হয়ে পড়ে— এই ভয়াবহ অপরাধটি ধামাচাপা দেয়া, একটি জলজ্যান্ত খুনের অস্তিত্ব মুছে ফেলা নিপুণ হাতে।
বহুদিন ধরেই আমি একটি ‘পারফেক্ট মার্ডার’-এর গল্প লিখতে চেয়েছি। পারফেক্ট মার্ডার বলতে বোঝানো হয় সেই খুনটিকে যেটি যে একটি খুন—সে কথাটি খুনি ভিন্ন আর কেউ জানতে পারেনি, এবং খুনিও কখনো ধরা পড়েনি। তবে সত্যি বলতে—‘পারফেক্ট ক্রাইম বা মার্ডার’ বলে জগতে কিছু নেই। ক্রিমনোলজিতে এমন কোন টার্মও নেই। ফিকশান কিংবা মুভিতেই এমন কিছু দেখানোর চেষ্টা করা হয়। হঠাৎ করে আবিষ্কার করলাম, উড্ডয়নসূত্র আমার সামনে এই সুযোগটি এনে দিয়েছে। আর তা করতে গিয়ে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, এই বিশেষ উদ্দেশ্যটি সাধন করতে গেলে পুরো উপন্যাসটির নানান জায়গায় কাটাছেঁড়ার দরকার হবে।
আমার লেখালেখির একটা বড় অংশ (এবং বেশিরভাগ সময় সেটিই প্রধান অংশ) হলো ‘এডিটিং’। একটা গল্প বা উপন্যাসের প্রথম ড্রাফট শেষ হলে আমার জন্য মূলত ঐ লেখাটির ‘মূল লেখালেখি’ শুরু হয়। যারা একবার লিখেই এবং প্রায় কোনরকম কাটাছেঁড়া না করে সেটা প্রকাশ করতে পারেন—তারা নমস্য, কিন্তু আমি সে দলে পড়ি না। একটা লেখাকে বহুবার কাটাছেঁড়া করার পরই প্রকাশ করার কথা আসে আমার ক্ষেত্রে। কিন্তু উড্ডয়নসূত্রের কথা ভিন্ন। এক্ষেত্রে যেহেতু লেখাটি শেষ হতে না হতেই প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছিল, এবং সেই (প্রায়) আধাখেঁচড়া লেখাই পড়ছিলেন অসংখ্য পাঠক—ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে হয়ে পড়ে। একটা গল্প বা উপন্যাসের শুরুতে একজন লেখক সচেতনভাবেই তার পাঠককে শেষ পর্যন্ত যা জানাতে চান—সে অনুযায়ী প্রস্তুত করে নেন। পরিণতির নিয়তি খোলাসা করার আগে সূক্ষ্মভাবেই ধাবিত করে নেন পরিণতির দিকে। তা না করলে শেষ পর্যন্ত গল্পে টুইস্ট দেবার নাম করে ‘ভেলকি’ দেখানোর কারিগরি ঢুকে পড়ে। আর কে না জানে, ভেলকি এবং ম্যাজিক—এরা জাতে একই হলেও পার্থক্য শিল্পে। প্রথমটির উদ্দেশ্য চোখে ‘ধান্ধা’ লাগানো, পরেরটিরও তাই, তবে—‘শিল্পসম্মত ধান্ধা’। আমি ভেলকির চেয়ে ম্যাজিক পছন্দ করি বেশি।
তাই যখন প্রথম থেকে কাঁটাছেড়া করতে বসি উড্ডয়নসূত্র—যেসব অংশ ইতিমধ্যে পাঠকরা পড়ে ফেলেছেন—সেসব অংশ যখন আবার পূর্ণনির্মাণ করতে বসি—সহসা বুঝতে পারি—বাকি অংশগুলো প্রকাশ করে যাওয়া স্রেফ লোক ঠকানো হয়ে যাচ্ছে। একটা মাত্র উদাহরণ পেশ করি—তাতেই এর পূর্ননির্মাণের একটি ধারণা পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস। প্রতিকথায় প্রকাশিত হওয়া উপন্যাসটির প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পাতা—যেখানে পূর্ব নাখালপাড়ার ১৭/বি/১ নম্বর, হলদে রঙ করা বাড়িটার দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা রাখীর মুখে গোধূলির আলো পৌঁছেনি বলে তরুণদের সশব্দ আক্ষেপ শোনা যাচ্ছে—সে অংশটি চলে গেছে বর্তমান উপন্যাসের পয়ঁতাল্লিশ নাম্বার পাতায়! তার মানে, বর্তমান অবস্থায় রেখে আমি যদি ধারাবাহিক উপন্যাস হেতু স্রেফ শেষ করার দরকারে এভাবে প্রকাশ করে যেতে থাকি বাকি অংশ—তাতে পাঠক বড়জোর ঘটনাটা জানবেন, মূল উপন্যাসটি থেকে যাবে বহুদূর, এবং তারচেয়ে বড় কথা—পাঠক হয়তো পাবেন ভেলকি দেখার আমেজ, কিন্তু শিল্প তাতে অনুপুস্থিত থাকবে—আর তাই যদি হয়, তবে আর গল্প উপন্যাস লিখে লাভ কী আমার! পাঠককে স্রেফ কোন ঘটনা জানানোর জন্য আমি লিখি না, কখনো লিখিনি। উড্ডয়নসূত্র স্রেফ খুনের গল্পও তো নয়, ওটা বেড়ে ওঠার, প্রেমের, বিরহেরও। একই সঙ্গে এ শতাব্দীর শুরুর দিকে ঢাকার পাড়া-মহল্লায় তরুণদের বেড়ে উঠার একটি অতি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু নির্ভরযোগ্য—দলিলও তো বটে।
তাই এই সিদ্ধান্ত। প্রতিকথায় আর লিখবো না উড্ডয়নসূত্র। যারা এতদিন ধরে এই উপন্যাসটির উপর চোখ রেখেছেন (এই যুগে ধারাবাহিক উপন্যাস পড়ার মতো ‘বোরিং’ হয়তো আর কিছু নেই) তাদের কাছে সনির্বন্ধ ক্ষমা চেয়ে এই আশ্বাস দিতে চাই, উড্ডয়নসূত্র শিগগীরই পূর্ণাঙ্গ বই আকারে পাওয়া যাবে বাজারে। এবং বইয়ের উড্ডয়নসূত্র আপনাদের নিরাশ করবে না—এ আন্তরিক আশ্বাসবাণীও থাকলো সেই সঙ্গে। তখন খোলনলচে বদলে ফেলা এই উপন্যাসটিকে আপনাদের অনেকটাই অচেনা লাগবে—কেননা, এর নানান জায়গায় এতটা কাঁটাছেঁড়া হয়েছে যে আমার নিজেরই উপন্যাসটিকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে, তবে সেই অচেনা উড্ডয়নসূত্রই আমি আসলে লিখতে চেয়েছিলাম, সেই অচেনা উড্ডয়নসূত্রের গল্পই আমি আপনাদের বলতে চেয়েছিলাম। শত হলেও, নাখালপাড়ার ঐ পাঁচটি তরুণ আমার বন্ধু। আর বন্ধুদেরকে—হোক না তারা খুনী—সংকট থেকে উদ্ধার করা আবশ্যকীয় কর্তব্য বলেই নিয়েছি আমি।
উড্ডয়নসূত্র একটি ‘পারফেক্ট মার্ডার’-এর গল্প। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার বন্ধুদের ঐ মার্ডারটি কতটুকু পারফেক্ট হয়েছে—সে বিচার আপনাদের উপরে দিতে চাই। সুতরাং, এই যে হঠাৎ প্রতিকথায় উড্ডয়নসূত্র প্রকাশ বন্ধ করে দেয়া, সেটা বড়জোর তীর ছোঁড়ার আগে ধনুকের ছিলাকে পেছনে টেনে ধরার দরকারী প্রক্রিয়া মাত্র।
একটু অপেক্ষা করুন দয়া করে। আস্ত ‘উড্ডয়নসূত্র’ আপনাদের পাতে দেয়ার জন্য নিরলস কাজ করছি আমি। আমার প্রিয় পাঠকদের ‘পূর্ণাঙ্গ উড্ডয়নসূত্র’ পাঠের আগাম নিমন্ত্রণ।