
প্রমি রায় যদি সাধুপাড়ায় থাকে
এই কথা মনে পড়লো, মনের বাইরে এসে, কেনো বেরিয়ে এসেছি, একবার। একবার কেনো, বারবার বেরিয়ে এসেছি, কোথাও যাবার জন্য। এতো যদি পথ, এতো যদি যাবার পদ্ধতি তবে বাইরে না বেরিয়ে মনের ভেতর কেনো বসে থাকা। যেতে যেতে নারী, একাধিক; যেতে যেতে পুরুষ, একাধিক। একে নারী নয়, একাধিকে নারী; একে পুরুষ নয়, একাধিকে পুরুষ। একাধিক নারীর, একাধিক পুরুষের দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে একবার, একাধিকবার। যখন মন পুরনো হয়ে যায়, ঘর পুরনো হয়ে যায়, যাত্রা শুরু হয় একাধিক নারী তোমার দিকে, একাধিক পুরুষ তোমার দিকে। আমার ভেতর একাধিক আমি লুকিয়ে থাকলে কখনো বলবো আমি’র কথা কখনো বলবো আমাদের কথা।
এ শহরে আমাদের পাড়ার নাম সাধুপাড়া। আমাদের সাধুপাড়ায় হঠাৎ একদিন একটা বাড়ি আবাসিক হোটেল হয়ে গেলে আমাদের কৌতুহল সৃষ্টি হয়। আমরা আমাদের মন থেকে, ঘর থেকে বের হয়ে নানান পথে যাবার সময় এ আবাসিক হোটেলটা দেখি। হোটেল প্রমি রায়। হোটেলের নাম প্রমি রায় হলে পাঁচতলা আবাসিক হোটেল ভবনটিকে আমাদের আর ভবন মনে হয় না। হোটেল ভবনটিকে প্রমি রায় মনে হয়। হোটেলটিকে প্রমি রায় মনে করলেও অন্য কোথাও তাকে খোঁজ করি। পথে পথে প্রমি রায় পড়ে না থাকলে আমরা ফেসবুকে প্রমি রায়কে সার্চ করি। ফেসবুক কি চমৎকার পথ যে- সে পথে সবাইকে পাওয়া যায়। প্রমি রায় দাঁড়িয়ে আছে ফেসবুকের সকল জানালায়। প্রমি রায় বই হাতে কি চমৎকার দাঁড়িয়ে কার জন্য। আমরা তাকে বন্ধু হিসাবে পেতে চাইলে, তার ড্রয়িং রুমে যেতে চাইলে সেন্ড করি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। সে যে কতো ভালো মেয়ে তার বর্ণনা দেয় আমাদের সকল অভিধান। ভালো সে তার ভালো চেহারার মতো। যে চেহারা নিয়ে জয় হয় অচেনা সকল আকাশ। সে আমাদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলে আমরা কি দারুণ ধন্য হই। আমরা দেখি ফেসবুকের ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড কি ভীষণ চমৎকার। এ ওয়ার্ল্ড কোথায় যে থাকে প্যারালেল ওয়ার্ল্ড হয়ে। এবার স্মরণ করি, স্মৃতির ভেতর, স্মৃতির বাইরে, আমাদের চোখের সামনে, চোখের বাইরে কতো যে প্যারালেল ওয়ার্ল্ড আছে আমাদের। আমরা বিজ্ঞানের দিকে, বিনোদনের দিকে তাকাই। বিজ্ঞান আর বিনোদন কতো যে ওয়ার্ল্ড উপহার দেয় তার গণনা কোথায়।
প্রমি রায়ের সঙ্গে রাতে চ্যাটিং করার জন্য আমরা সারাদিন কথা জমাই। পরিবারের যারা সদস্য এর ফলে আমাদের নিকট থেকে পর্যাপ্ত কথা পায় না। কথা পর্যাপ্ত আদান-প্রদান না হলে সম্পর্কের ভেতর বাতাস থাকে না। আর যদি বাতাস থাকে অপর্যাপ্ত তবে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কের শ্বাসকষ্ট হয়। যদি ভাই ডাকি, বোন ডাকি, স্বামী ডাকি, বৌ ডাকি, মা ডাকি, বাবা ডাকি কতো দূরের সে সকল ডাক নিকটে আসে কোন বাতাসে। প্রমি রায়কে ছবি সেন্ড করার জন্য কতো সব ছবি তুলি, কতো কিছুর ছবি তুলি। ধানক্ষেত, পাটক্ষেত, পুকুর, নদী, সাগর, আকাশের বিদ্যুৎ ক্যামেরার ভেতরে এসো, ফেসবুকের ভেতরে এসো, তারপর যাও প্রমি রায়ের দেয়ালে, প্রমি রায়ের টাইমলাইনে। প্রমি রায় লাইক দিলে আমরা আয়নায় মুখ দেখি। আয়নার ভেতর রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে যায় বনের ভেতর। বনের ভেতর গাছের নিচে এতো আলো। প্রমি রায় বসে আছে বনের সকল গাছের নিচে। আর প্রমি রায় কতো রূপে যে নিজের ছবি ফেসবুকে আপলোড করে তার কথা কিভাবে বর্ণনা হয়। তার সে সকল ছবির ভেতর আমাদের ইহকাল ঢুকে যায়, পরকাল ঢুকে যায়। আর আমরা তো সাত সমুদ্র-তের নদী পেরিয়ে তার ছবির ভেতর প্রবেশ করে ঘোড়া হারিয়ে ফেলেছি। আর ঘোড়া হারিয়ে তার ছবি থেকে বের না হতে পারলে ক্রমাগত তার কথা বলতে থাকি।
আমরা প্রতিদিন হোটেল প্রমি রায় আবাসিকের নিকট দিয়ে যাই বিদ্যালয়ে যেতে যেতে, বাজারে যেতে যেতে, প্রার্থনাগৃহে যেতে যেতে, রাজনীতিতে যেতে যেতে, অর্থনীতিতে যেতে যেতে। আমরা কেনো শুধু দেখে সন্তুষ্ট হবো। আমাদের শরীরের তো কেবল একটা ইন্দ্রিয় নয়। শরীরের ইন্দ্রিয় বিষয়ে এখন ভাবনা আসে। মানুষ যদি শরীরের কেবল পাঁচটা ইন্দ্রিয় আবিষ্কার করে থাকে তবে সে আবিষ্কারকে ভীষণই অপর্যাপ্ত জ্ঞান হয়। আমরা ভাবি শরীরকে সঠিকভাবে পরিপূর্ণভাবে আবিষ্কার করতে না পারা আমাদের বড় ব্যর্থতা। আমাদের মনে হয় আমাদের শরীরের অনাবিষ্কৃত অজস্র বিষয় প্রমি রায়ের সাহায্যে আবিষ্কার করা সম্ভব। প্রমি রায়কে মনে হয় শরীর মাধ্যম। যেমন গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম তেমন শরীর মাধ্যম। গণমাধ্যমে, সামাজিক মাধ্যমে যদি হাজার খবর তবে শরীর মাধ্যমেও প্রচারিত হোক আমাদের হাজারো খবর। শরীর মাধ্যমে এখন হাতের কথা বলি। হাত যদি স্পর্শের একটা উপায় হয় তবে হোটেল প্রমি রায় আবাসিকের দেয়ালে আমরা হাত রাখি, স্পর্শ রাখি। প্রমি রায় আবাসিককে কিন্তু আমরা দিনের বেলা প্রমি রায় জ্ঞান করি। হোটেল প্রমি রায় আবাসিক ভবনের পাঁচ তলাকে আমরা প্রমি রায়ের পঞ্চ ইন্দ্রিয় জ্ঞান করি। হাতের স্পর্শ সেখানে রেখে বলি এ স্পর্শ যাক বহুদূর নদীর পাড়ে। নদীর জল ছলাৎ ছল, এ ছল ধরো না কেউ। এ স্পর্শ যাক পাহাড়ের চূড়ায়। চূড়া পড়ে যেয়ো না। চূড়ার পাখি উড়ে যেয়োনা। এ স্পর্শ যাক আকাশের মেঘে। আকাশের মেঘ পর হয়ো না। আকাশের মেঘ গলে যেয়ো না। আমরা এ স্পর্শ হাতে ধরে রাখি, আমাদের শরীরে ধরে রাখি। হাতের স্পর্শে যে সাত সমুদ্র-তের নদী পার হওয়ার স্বাদ ছিলো তা প্রমি রায় আবাসিক হোটেলের দেয়াল স্পর্শের আগে জানতাম না। প্রার্থনা করি চিরকাল জমা থাক সে স্বাদ আমাদের শরীরে। শরীরকে মনে হয় পৃথিবীর বৃহত্তম ভাণ্ডার। এ ভাণ্ডার কখনো পূর্ণ হয় না। আমরা দেখেছি শরীরের ভাণ্ডার পূর্ণ করার জন্য আমরা কতো কিছু আহরণ করেছি, জমা করেছি। কিন্তু হায় কতো বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললে শরীরের সে শূন্যতাকে বোঝানো যায়।
আমরা কারা এই ব্যাখ্যাটা এখন প্রয়োজন হয়। আমরা খেয়াল করি এই আমরা শব্দের ভেতর নারী নাই। আমরা শব্দের ভেতর আমাদের সাধুপাড়ার সকল পুরুষ। কিশোরদেরকেও পুরুষ বলে সম্বোধন করা হলো এখানে। আমরা টের পাই, দেখি প্রমি রায় আবাসিক হোটেলকে প্রমি রায় জ্ঞান করে তার স্পর্শ নেয় এ পাড়ার কিশোর, তরুণ, বৃদ্ধ জীবিত সকল শরীর।
আমাদের সাধুপাড়ার টপ টেরর হাত কাটা জলিলের কোনো হাত না থাকলে সে তার ওষ্ঠপুটের সাহায্যে হোটেল প্রমি রায় আবাসিকের স্পর্শ পেতে চায়। হোটেলের দেয়াল চুম্বনে সে তার শরীরে নিয়ে আসে স্পর্শের মহিমা। টপ টেরর হাত কাটা জলিল প্রতিবার হোটেলের দেয়াল চুম্বন করার মুহূর্তে অনুভব করে সে তার হারানো হাত ফিরে পেয়েছে। আর যখন সে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলে তখন সে ফটোশপ ব্যবহার করে দু’হাত লাগিয়ে নিজের ছবি পোস্ট করে। সে দেখে তার ভেতরে কতো কতো হাত। সে সকল হাতের প্রমি রায় আবাসিক হোটেলের স্পর্শ পাবার জন্য কি ব্যাকুল হাহাকার।
টপ টেরর হাত কাটা জলিলের হাতকাটা বিষয়ে ছোটো ছোটো গল্প চালু হয় সাধুপাড়ায়। একটা গল্প আমাদের বলতে ও শুনতে ভালো লাগলে সেটাকে গ্রহণ করি সত্য হিসাবে। সে কোনো একদিন আমাদের পাশের পাড়ায় এক সুন্দরী মেয়ের শরীরে হাত দিলে মেয়েটির ভাই তার দু’হাত কেটে নেয়। সে মেয়েটিকে জোর করে আংটি পরাতে চেয়েছিলো জোর করে বিয়ে করার জন্য। মেয়েটির ভাই ছিলো সে পাড়ার টপ টেরর। হাত দু’টো কেটে নেয়ার পর সে হাত দু’টো নাকি সে পাড়ার দু’টো কুকুরকে খাওয়ানো হয়েছিলো। জলিলের হাতের আঙুলে দু’টো আংটি ছিলো। হাত দু’টো হারানোর চেয়ে নাকি আংটি দু’টো হারানোর শোক তার অধিক ছিলো। কারণ জলিল বলতো সে আংটি দু’টি আঙুলে রেখেছিলো তার হবু স্ত্রীর জন্য। আর আংটি দু’টি কুকুরে খেয়ে নিলে মনে হয় কুকুর দু’টি তার হবু স্ত্রীকে খেয়ে নিয়েছে। হাত ও আংটি হারাবার পর সে আংটির খোঁজে পাশের পাড়ার দশটা কুকুর অপহরণ করে তাদেরকে হত্যা করে, বুক চিরে দেখেছে তাদের ভেতর তার গিলে খাওয়া আংটি খুঁজে পাওয়া যায় কি না। আরো কথা এই যে সে হাত হারানোর পর মুখ ও পা দিয়ে হাত ও পায়ের কাজ আয়ত্ত করেছে।
আমরা দীর্ঘকাল পর ফেসবুকের কল্যাণে জানতে পারি আমাদের সাধুপাড়ায় আছে ফেসবুকের কবি, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, ফটোগ্রাফার, প্রেমিক, প্রেমিকা, রাজনীতিবিদ, ধর্মবিদ, মাস্তান। আর আমরা একই সঙ্গে লক্ষ্য করি আমরা কাগজের বই পড়ছি না, কাগজের বই লিখছি না। আমাদের সকল সাধনা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডকেন্দ্রিক। আমাদের সাধুপাড়ার একজন ফেসবুক বিজ্ঞানী জানায় এ মহাবিশ্বে আছে অসংখ্য প্যারালেল শরীর, পারালেল মুখ, প্যারালেল মন। আমাদের সাধুপাড়ারও আছে প্যারালেল সাধুপাড়া।
একরাতে আমাদের সাধুপাড়ায় প্রচুর পরিমাণে গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেলে আমাদের জুতা-স্যান্ডেল হারিয়ে যায়। আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে অক্ষত অবস্থায় বাড়ির দরজা বন্ধ করার পর দেখেছি আমাদের জুতা-স্যান্ডেল নাই আমাদের পায়ে। জুতা-স্যান্ডেলকে আমরা কেউ কেউ পায়ের সাহস ভেবেছি। তাইতো ঘর হতে বের হয়েই আমরা জুতা-স্যান্ডেল পায়ে দিয়েছি। জুতা-স্যান্ডেল হারিয়ে গেলে আমাদের কেউ কেউ ভেবেছি আমরা আমাদের সাহস হারিয়েছি। সকল হারানো বিষয়ের প্রতি আমাদের শোক থাকলে আমরা ফেসবুকে হারিয়ে যাওয়া জুতা-স্যান্ডেলের ছবি পোস্ট করি। পোস্ট দেবার সময় ভাবি আমাদের সাহসেরও ছবি ছিলো যা কিনা এখন জুতা-স্যান্ডেল দ্বারা প্রকাশিত। অসংখ্য লাইক ও কমেন্টে আমাদের চোখ আর্দ্র হয়। জুতা-স্যান্ডেলের জন্য সবার এমন দরদ ও ভালোবাসা থাকলে আমাদের নিজেদেরকে হারাবার ইচ্ছা হয়। গুলি ও ককটেলকে আহবান করি আমাদের বুক বরাবর।
পূর্ব দিক থেকে ভোর আসে। সাধু পাড়ার পূর্ব দিক থেকে খবর আসে। আমাদের পাড়ার টপ টেরর দু’হাত কাটা জলিল গতরাতে বিয়ে করেছে। তার বিয়ে উপলক্ষ্যে ফোটানো হয়েছে এক হাজার একটা গুলি ও এক হাজার একটা ককটেল। টপ টেরর জলিলের বহু দিনের স্বপ্ন ছিলো তার বিয়ের সময় সে গুলি ও ককটেল উৎসব করবে। আরো একজন জানালো এটা সে তার বৌকে উপহার হিসাবে দিয়েছে। তার স্ত্রী জেনেছে তার স্বামী জলিল একজন প্রাচীন যোদ্ধা। যে কিনা যুদ্ধে সবাইকে পরাজিত করেছে।
আমরা এবার তার বিয়ের বিষয়ে আগ্রহী হই। ফেসবুকে তার স্ত্রীর ছবি দেখি। তার স্ত্রী দেখতে প্রমি রায়ের মতো হলে আমরা ভাবি ফেসবুকের প্রতি আমাদের সকল আগ্রহ হারিয়ে যাবে। তারপর আরো জানলে জানি তার স্ত্রী আমাদের প্রমি রায় নয়। যদিও চেহারায় প্রমি রায়ের সঙ্গে তার সাদৃশ্য আছে। আমাদের কেউ কেউ বলে, দেখো, একটা পাতার সঙ্গে আরেকটা পাতার কতো মিল তবুও তারা এক নয়। জলিলের বউ প্রমি রায় নয় এই কথা জানার পর জানা হয় জলিল তার বিয়ে ও বৌ নিয়ে অসন্তষ্ট। সে তার স্ত্রীর শরীরে আবিষ্কার করেছে শিথিলতা। বাসর রাতে, যে রাতে সে ককটেল ও গুলি বিস্ফোরণ করে বিয়ে জয় করতে চেয়েছিলো, আবিষ্কার করে তার স্ত্রীর শরীর শিথিল। শিথিল শরীর দেখে তার মনে হয়েছে তার স্ত্রীর রয়েছে একাধিক প্যারালেল ওয়ার্ল্ড। অনেকে শিথিল শরীর বলতে কি বোঝায় তা বুঝতে না পেরে বিষয়টা স্পষ্ট করতে বললে সে জানায় তার স্ত্রীর স্তনদ্বয় শিথিল এবং বরফের চাইতে ঠাণ্ডা। হাতকাটা জলিল জানায় এই শিথিলতা দর্শন তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরাজয়। পরাজয়ের কথা বললে আমাদের মনে হয় হাত কাটা জলিল কি তবে আমাদের মতো এবার তার জুতা কিংবা স্যান্ডেল হারিয়েছে। আমাদের সবার জুতা কি এখন রাস্তায় পড়ে আছে।
আমরা আমাদের সাধুপাড়ায় একটা নতুন বিষয় দেখে বিস্মিত হই, আনন্দিত হই, ভীত হই। হোটেল প্রমি রায় আবাসিকে আমরা দেখি সুরূপা মেয়েদের প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণ। আমরা অনেক রূপসী মেয়েকে এ হোটেলে ঢুকতে দেখি ও বের হতে দেখি। এতো সব সুরূপা মেয়ে কোথা থেকে আসে। ফেসবুকের মেয়েরা সবাই সুন্দরী হলে ভাবি তারা নেমে এসেছে ফেসবুকের নীড় থেকে, ফেসবুকের গাছ থেকে, ফেসবুকের আকাশ থেকে। তারা তবে ফেসবুকের ডার্লিং বার্ড। তারা উড়ে বেড়ায়, ভ্রমণ করে বেড়ায়, স্বপ্ন ছড়িয়ে বেড়ায়, কথা ছড়িয়ে বেড়ায় আমাদের দেয়ালে দেয়ালে। তাদের হাতের ভ্যানিটি ব্যাগগুলো কি চমৎকার। কতো কতো রঙ সে সকল ভ্যানিটি ব্যাগের। এ সকল রং তৈরি হয়েছে যেনো আমাদের সাধুপাড়ার আমাদের বাস করা বাড়িগুলোর রঙ নিয়ে। যখন সুরূপা মেয়েগুলোর ভ্যানিটি ব্যাগগুলো তাদের হাতে দোল খায় তখন মনে হয় যেনো আমাদের বাড়িগুলো ভিত্তিসহ দোল খাচ্ছে নিরীহ, নীরব গোপন ভূমিকম্পে। নীরব ভূমিকম্প তবে কি আমাদের সাধুপাড়ার সকল বাড়ির তলায় জমে ছিলো দীর্ঘদিন ধরে দীর্ঘশ্বাসের মতো। সম্প্রতি নিভৃতচারী ভূমিকম্প বের হয়েছে, শুরু হয়েছে, প্রকাশিত হয়েছে এ সকল সুরূপা মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগের আন্দোলনের সাথে। ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে যখন এ সকল সুরূপা মেয়ে হোটেল প্রমি রায় আবাসিক থেকে বেরিয়ে আসে তখন মনে হয় যেনো তা বাজারের ব্যাগ, কিংবা যেনো তা টাকার ব্যাগ, কিংবা যেনো গৃহ থেকে বের হয়ে যাওয়া ট্র্যাভেলিং ব্যাগ। আর তাদেরকে মনে হয় চিরকালের জন্য গৃহত্যাগী- ট্র্যাভেলার কিংবা ট্র্যাভেলারের সঙ্গিনী। এরপর মনে হয় আমরা সবাই ট্র্যাভেলার। হোটেল প্রমি রায় আবাসিকে আমরা ভ্রমণে যাই প্রতিদিন, প্রতিরাত।
আমরা এরপর এ সকল সুরূপা মেয়েদের পরিচয় সন্ধান করি। ফেসবুকে সার্চ করি তাদের চেহারা। আমরা জানতে চাই তারা রিয়েল ওয়ার্ল্ড অথবা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের বাসিন্দা। সাধুপাড়ার মুনশী জমির উদ্দীন মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় তাদের মহাবিদ্যালয়ের মেয়েরা তো পরী। এ সকল মেয়েরা মাঝে মাঝেই কলেজ থেকে, ক্লাস থেকে উধাও হয়ে যায়। আবার কয়েকদিন পর কি সুন্দর স্নান সেরে ফিরে আসে কলেজে, ক্লাসরুমে। পরী শব্দে প্রীত হয়ে আমরা লাইক দিই। তারপর সকাল হলে কলেজ টাইমে আমাদের কেউ কেউ পরী দেখতে মুনশী জমির উদ্দীন মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সামনে ভিড় করি। পরীরা নির্জনতা বিলাসী, ভিড়ে থাকে না, ভিড়ে দেখা দেয় না বলে পরী দেখা হয় না। আমাদের ফেসবুকের বন্ধু সাধুপাড়ার মমতাজ বেগমের স্ট্যাটাস থেকে জানা যায় তার চার মেয়ে হঠাৎ হঠাৎ পরী হয়ে যায়। কোনো কোনো রাতে তাদেরকে বাসায় খুঁজে পাওয়া যায় না। মমতাজ বেগম দাবী করে তার চার মেয়ের পাখনা গজিয়েছে। সে আরো লেখে সে শিশুকালে বইয়ে পড়েছে পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে। আমরা আবিষ্কার করি কতো আগে থেকে আমাদের জীবনে কতোসব প্যারালেল ওয়ার্ল্ড ছিলো। পরীকেন্দ্রিক প্যারালেল ওয়ার্ল্ড কতো যে প্রাচীন। পরীর পাড়া আমাদের সাধুপাড়ার সমান বয়সী। পরীর জগতে আমরা কতোবার গিয়েছি, কতোবার ফিরে এসেছি। একজন তো ফেসবুকের কবি। সে জানায় বহুকাল থেকে সাধুপাড়ার কবিরা পরীর জগতে যাবার উপায় খুঁজেছে কবিতার মাধ্যমে। একজন তো ফেসবুকের গল্পকার। সে জানায় বহুকাল থেকে সাধুপাড়ার গল্পকারেরা পরীর জগতে যাবার উপায় খুঁজেছে গল্পের মাধ্যমে। আরেকজন তো সাধুপাড়ার চিত্রকর। সে জানায় বহুকাল থেকে সাধুপাড়ার চিত্রকরেরা গুহার দেয়ালে ছবি এঁকে এঁকে পরীর জগতে যাবার উপায় খুঁজেছে চিত্রের মাধ্যমে। আর যারা ফেসবুকের পাঠক তারা জানায় বহুকাল থেকে সাধুপাড়ায় এ নিয়ম চালু বিয়ের মাধ্যমে পরী খুঁজতে যাওয়া।
হোটেল প্রমি রায় আবাসিক আমাদের মাঝে এখন ভয়ের জন্ম দেয়। মনে হতে থাকে যেনো এ আবাসিক হোটেল আমাদেরকে ও আমাদের বাড়িগুলোকে ভয় দেখাচ্ছে। আমরা আমাদের বাড়িতে এসে আমাদের বোনেদের, মেয়েদের, স্ত্রীদের দিকে তাকাই। কোথায় তারা। তারা কি আমাদের সঙ্গে আছে অথবা পরী হয়ে চলে গেছে পরীর জগতে। তখন পুনরায় মনে হয় টপ টেরর জলিলের আবিষ্কারের কথা। সে তো আবিষ্কার করেছিলো তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর শিথিল শরীর এবং আরো আরো ব্যাখ্যায় বলেছিলো স্ত্রীর শিথিল স্তনের কথা। আমরা আরব্য রজনীর গল্প জেনেছি। এবার শিথিল স্তন বাক্যে আরব্য রজনীর সন্দেহ, অবিশ্বাস, পতন, যাদু ঢুকে পড়ে। তখন আমাদের সাধুপাড়ার আমাদের বাড়িগুলোকে অনাবাসিক খাবার হোটেল বলে মনে হয়। আমরা আমাদের বাড়ির তখন তিন বেলা খাবার কাস্টমার। আমাদের বাড়িগুলোকে শুধু খাবার হোটেল বলে বোধ হলে আমরা কোথায় পাবো আমাদের শয়ন, আমাদের ঘুম। কোথায় পাবো মাথার ওপরে আমাদের ছায়া। পাশাপাশি বসার ছায়া। আমার ছায়া তোমার উপরে পড়ুক, তোমার ছায়া আমার উপরে। অথবা দরদী বন্ধু, তোমার বিশ্বাস আমার উপরে পড়ুক, আমার বিশ্বাস তোমার উপরে পড়ুক।
আমাদের সাধুপাড়ায় কোথাও কোথাও দু’একটা পুরাতন বৃক্ষ থাকলে আমরা সে সকল বৃক্ষের নিকটে যাই। এ সকল বৃক্ষ জমা রেখেছে সাধুপাড়ার প্রাচীন সাধুদের ছায়া। আমরা সে সকল ছায়া আবিষ্কারের জন্য অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকি সে সকল বৃক্ষের নীচে।
একদিন রাতে ঘুমাতে যাবার আগে, ফেসবুক বন্ধ করার আগে পড়ি এক স্ট্যাটাস। প্রমি রায়ের স্ট্যাটাস। হোটেল প্রমি রায় আবাসিকের মালিক সাধু পাড়ার টপ টেরর দুই হাত কাটা জলিল সাধুপাড়ার শাসক।