
প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর বাহির-রকিবুল হাসানের নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা
কোন বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে যখন লেখকের বুদ্ধিবৃত্তিমূলক গদ্যসৃষ্টি রচিত হয় তখন সেটি হয় প্রবন্ধ। এরই পাশাপাশি কোন লেখক যখন নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর গঠনমূলক আলোচনা করেন তখন সেটি হয় সমালোচনা সাহিত্য। একজন লেখক এক বা একাধিক গ্রন্থ সমালোচনা করতে পারেন। বর্তমান বাংলা সমালোচনা সাহিত্য ধারার এক অনন্য নাম রকিবুল হাসান (১৯৬৮)। মূলত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও তিনি দীর্ঘদিন যাবত গবেষণা কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তাঁর লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ জাতীয় দৈনিকে, সাহিত্য পত্রিকার, সমালোচনা গ্রন্থে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। শুধু সমালোচনা নয় মৌলিক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টিতেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন। কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, গবেষণা ও সম্পাদনা গ্রন্থ মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশের অধিক। শুধু লেখালেখিতে নয় তিনি শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। দেশে-বিদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি বিভিন্ন সময় অংশগ্রহণ করেছেন। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ লালন সাঁই পদক, কবি ওমর আলী স্বর্ণপদক, স্যার সলিমুল্লাহ পুরস্কারসহ অসংখ্য সাহিত্য পদক ও সম্মাননা প্রাপ্ত হয়েছেন। আমাদের আলোচ্য বিষয় রকিবুল হাসানের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর বাহির’। যেটির প্রথম প্রকাশ ২০১৯ সালে, আমরা আমাদের আলোচনা অংশে প্রাবন্ধিকের বিশ্লেষিত প্রবন্ধগুলোর উপর আলোকপাত করবো।
রকিবুল হাসান তাঁর ‘প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর বাহির’ নামক প্রবন্ধগ্রন্থে বাংলা সাহিত্যের দুইজন বিস্ময়কর প্রতিভা মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) ও কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রাবন্ধিক ‘মধুসূদন নজরুল বাংলা সাহিত্যের বিস্ময় প্রতিভা’ শিরোনামের প্রবন্ধের মাধ্যমে এই প্রবন্ধগ্রন্থের যাত্রা শুরু করেন। প্রাবন্ধিক তাঁর এই প্রবন্ধে দুইজন বিদ্রোহী চেতনার অধিকারী কবির জীবন ও সাহিত্যকর্মের নানাদিক সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল তিনজন ব্যক্তি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। মূখ্যত, মাইকেল ও নজরুলের সাহিত্যজীবন দীর্ঘদিনের নয়। ক্ষণিক সময় তারা সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তবুও বিষ্ময়ের বিষয় স্বল্প সময়ের ভেতর তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যকর্মগুলো সাহিত্যসমাজে খ্যাতির উচ্চশিখরে আরোহণ করেছিলো। প্রাবন্ধিক চমৎকারভাবে মাইকেল-নজরুলের দুর্বিষহ জীবন বর্ণনার পাশাপাশি পৃথিবীর খ্যাতনামা সব সাহিত্যিকের কষ্টের জীবনেরও একটা বিবরণ দিয়েছেন তাঁর প্রবন্ধে। উক্ত প্রবন্ধ পাঠে আমরা জানতে পারি খ্যাতনামা সব ব্যক্তিদের জীবন কুসুমাকীর্ণ নয় বরং কন্ঠকাকীর্ণ ছিলো। মরুভূমির মাঝে যেমন একবিন্দু পানি প্রাণের সঞ্চার করে তেমনি দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র্যতার মাঝেও এসকল কবি সাহিত্যিকদের প্রতিভা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মধুসূদন-নজরুলও সে পথের অভিযাত্রী।
মাত্র সাত বছরের সাহিত্যজীবনে মাইকেল বাংলা সাহিত্যকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ব্যক্তিজীবনে উচ্চাকাঙ্খার আশায় স্বদেশ, স্বধর্ম ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন কিন্তু একটা সময় তাঁর এ ঘোর কেটে যায়। তিনি উপলদ্ধি করেন মরীচিকার পেছনে তিনি দৌঁড়িয়েছেন। তাই নিজের ভুলকে শুধরে নিয়ে আবার স্বদেশ, স্বভাষার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্যচর্চা শুরু করলেন এবং আমাদের উপহার দিলেন উৎকৃষ্ট সব সাহিত্যকর্ম। আধুনিক কবিতা, আধুনিক নাটক এমনকি মহাকাব্যের মতো সাহিত্যকর্ম তাঁর হাতে নবরূপ লাভ করলো। দাম্পত্যজীবনে রেবেকার সাথে থাকাকালীন তারা সুখে ছিলো কিন্তু ত্যাজ্যপুত্র মাইকেলের আর্থিক দৈন্য কোনদিনও ঘোচেনি। অর্থকষ্টে ভুগলেও তিনি আড়ম্বর জীবনযাপন করতেন এবং নিয়মিত মদ্যপানে আসক্ত থাকতেন। ব্যারিস্টারি পড়া শেষ করেও তিনি কর্মক্ষেত্রে সফল হতে পারলেন না। জীবনের সর্বক্ষেত্রে জাতি-আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের দ্বারা তিনি প্রতারিত হয়েছেন। একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছাড়া কেউ তাঁকে আর্থিক সাহায্য করেনি। বেহিসেবি মাইকেলের স্ত্রী-সন্তান থাকা সত্ত্বেও গোপনে হেনরিয়েটার সাথে প্রণয় তৈরী হয় যার ফলশ্রুতিতে রেবেকার সাথে তাঁর সম্পর্ক চিরদিনের মত ছিন্ন হয়। হেনরিয়েটাও পরিবার, পরিজন ত্যাগ করে ভালোবাসার টানে মাইকেলের কাছে চলে আসে এবং তাঁরা একসাথে বসবাস করে। ব্যক্তিগতভাবে মাইকেল যে অর্থের চেয়ে যশ বেশি অর্জন করতে চেয়েছিলেন সেপ্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক বলেছেন, ‘ইংরেজি কবিতা ছেড়ে বাংলা কবিতায় ফিরে আসাও ছিল এই প্রশংসার কারণেই।’
মাইকেলের এই দুর্বিষহ জীবনের সাথে শার্ল বোদলেয়ারের জীবনের একটা সাদৃশ্য খুঁজেছেন প্রাবন্ধিক। আর্থিক কষ্ট জীবনের গ্লানি মাইকেলের শেষ জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলো। ফলে হেনরিয়েটার মৃত্যুর তিন দিন পর তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিরল প্রতিভার অধিকারী এই লেখক একই সাথে নাটক-প্রহসন-কবিতা লিখতে পারতেন। একারণে বাংলা সাহিত্যে তিনি একটি নিজস্ব অধ্যায় তৈরি করে নিয়েছেন।
মধুসূদনের পরে আরেক ট্রাজেডী অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। মধুসূদন উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও নজরুল জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক দরিদ্র পরিবারে ঝড়ো রাতে। তিনিও মাত্র ২৩ বছর সাহিত্যচর্চার সাথে নিজেকে যুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। প্রাবন্ধিকের মতে, ‘নজরুলের মেধার যদি পূর্ণ বিকাশ ঘটতে পারতো বাংলা সাহিত্যের সম্মান ও মর্যাদা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পেতো।’ লেটোগানের দলে যোগ, রুটির দোকানে কাজ, মসজিদের মুয়াজ্জিন, সৈনিক জীবনসহ নানা পেশায় জীবন চালনা করার পর তিনি ১৯১৯ সালের দিকে সাহিত্যজীবনে প্রবেশ করেন।
প্রাবন্ধিক এখানেও নজরুলের জীবন ও সাহিত্যভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি দেখিয়েছেন, নজরুলের জীবন ও কর্ম বিদ্রোহী চেতনাবোধে জাগ্রত । ফলে তাঁর সাহিত্যকর্মেও বিদ্রোহের স্বরূপটি ধরা পড়ে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি শক্ত হাতে কলম ধরতে পেরেছিলেন বলেই ‘বিদ্রোহী’র মতো কবিতা রচনা করে ভারতবর্ষের মানুষের মনে অগ্নিশিখা জ্বালাতে পেরেছিলেন। প্রাবন্ধিক তাঁর প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, নজরুল প্রেমে ব্যর্থতা, পারিবারিক জীবনে অর্থনৈতিক কষ্ট, অসুস্থতা সব দিক থেকেই তাঁর জীবন প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছে। নার্গিসের সাথে বিয়েতেও রচিত হয় এক ট্রাজেডী। মাইকেলের মতোই নজরুলকেও অর্থের জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করতে হয়েছে। তবে তিনি মাইকেলের মতো বেহিসেবি ছিলেন না। অর্থ উপার্জনের জন্য তিনি হণ্যে হয়ে ঘুরেছেন, গ্রামোফোন কোম্পানীর কাছে নিজেকে বিকিয়ে পর্যন্ত দিয়েছেন। অর্থের অভাবে প্রিয় পুত্র বুলবুলের কবরটি বাধাই করতে পারেননি।
দাম্পত্যজীবনে হিন্দু মেয়ে প্রমীলাকে বিয়ে করাটা তৎকালীন হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজ বিষয়টিকে সহজে মেনে নিতে চায়নি। তবুও নজরুল নিজ ধর্মে অটুট থেকে প্রমীলার বেলাতেও চাননি সে যেন তার আপন ধর্ম ত্যাগ না করে। প্রেমিক কবি নজরুল ফজিলাতুন্নেসা ও প্রতিভা বসুর প্রেমে পড়ে ব্যর্থ হন এমনকি প্রেমের জন্য শারিরীকভাবে নির্যাতিতও হন। কোন এক বিশেষ নারীর প্রতি ক্ষোভ দেখিয়ে কবির লেখা ‘পূজারিণী’ কবিতার উদ্বৃতিও ব্যবহার করেছেন প্রাবন্ধিক। মাইকেল, রবীন্দ্রনাথের মতো নজরুলও সাহিত্য চর্চাকালীন অনেক বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হন। তবুও শেষপর্যন্ত বিজয়মাল্য তার গলাতেই উঠেছে। নজরুল সারাজীবনেও দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। এমনকি অর্থের জন্য মধুসূদনের মতো নজরুলও পাওনাদারদের কাছে অপমানিত হয়েছিলেন। তবুও তার কলম অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে থেমে থাকেনি। দুর্বার বেগে তিনি শোষিতের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লিখে গেছেন। ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই নজরুল জীবনের এক বেদনাহত অধ্যায়। তিনি আজীবনের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। ১৯৭২ সালে নজরুলকে স্থায়ীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ১৯৭৬ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই দুরন্ত পথিক ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরুকে অতিক্রম করেছেন।’
প্রাবন্ধিকের মতে, ‘কবি মধুসূদন দত্ত ও নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের আকাশে মধ্যগগণে প্রখর রোদ্দুর উজ্জ্বলতায় এসেছিলেন এবং বিদ্যুৎ ঝলকের মতো চমকে দিয়ে বিস্মিত করে দ্রুতই অস্ত গিয়েছেন’। তবে এই দুইজন যদি স্বাভাবিক জীবন ও পূর্ণ সাহিত্যসেবা পেতো তাহলে বাংলা সাহিত্য বিশ্বদরবারে আরও শক্তিশালী হতো।
রবীন্দ্রনাথ যে কয়া গ্রামে এসেছিলেন— সে তথ্য উঠে এসেছে প্রাবন্ধিকের ‘কয়ায় রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামের প্রবন্ধে। যে কয়া গ্রামে বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় হেমন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, শরৎশশী, বিনোদবালা, আকবর হোসেন, রবীন্দ্রনাথ রায়, বাঘা যতীনের মতো বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের জন্ম হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৭১ সালে আলিমুদ্দীন মোল্লা ও তার দুই ছেলে পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। এমন একটি গ্রামে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মহান ব্যক্তির পদধূলি পড়েছিলো তা সত্যিই এই গ্রামের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। প্রাবন্ধিক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের আগমনের বিষয়টি স্পষ্ট করতে চেষ্টা করেছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের এ গ্রামে আগমনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, বোটে করে শিলাইদহ যাত্রাকালে উপন্যাসিক আকবর হোসেনদের বাড়িতে যাত্রাবিরতির কথা। এ-গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও মানুষের শিল্পকর্ম দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে ‘ধুলামন্দির’ নামক কবিতাটি রচনা করেন। এছাড়া এগ্রামের কৃতী সন্তান বাঘা যতীনের মৃত্যু সংবাদে কবিগুরু ব্যথিত হয়ে রচনা করেন ‘অগ্রণী’ নামক কবিতাখানি। কয়ার চাটুজ্যে পরিবারের সঙ্গে কবিগুরুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো, আর সে-সূত্রেই গ্রামটির প্রতি তাঁর ভালোলাগা কাজ করে। তবে প্রবন্ধে উল্লেখিত কবিকে সাত বছরের বালক আকবার হোসেনের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি আবৃত্তি করার বিষয়টি প্রবন্ধিক প্রশ্নবিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে আকবর হোসেন যে রবীন্দ্র আশীর্বাদেই বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় কথাশিল্পী হয়েছিলেন এ-কথা দ্বিধাহীনভাবে উচ্চারণ করেছেন। সর্বশেষ কয়া গ্রামের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের গভীরতার বিষয়ে আরও গবেষণার বিষয় উল্লেখ করে প্রবন্ধটি শেষ করেন।
পরবর্তী প্রবন্ধ ‘নজরুলের কুহেলিকা: বিপ্লবপন্থা ও পরিণাম’-এ প্রাবন্ধিক নজরুলের ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সাথে বাস্তবে কয়েকটি চরিত্রের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি নজরুলের দেশাত্মবোধ ও বিদ্রোহীসত্তা জাগরণে তাঁর পূর্বসূরীদের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র যাদের কথাই আসুক না কেন তারা তাঁদের সাহিত্যকর্মে সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধিতার কথা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারেননি যেমনটি পেরেছিলেন নজরুল। আর নজরুলের এই সাহসিকতায় যারা অনুপ্রেরণাদাতা হিসেবে ছিলেন তাঁদের মধ্য অন্যতম হলেন বিপ্লবী বাঘা যতীন। এছাড়া সাহিত্য মহলে যে একজন লেখক অন্য লেখক দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে সে-প্রসঙ্গটিও প্রাবন্ধিক এখানে তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাস দ্বারা যে নজরুল প্রভাবিত হয়ে ‘কুহেলিকা’ রচনা করেছিলেন সে-কথাও এখানে উঠে এসেছে। এ-কারণে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনই এই উপন্যাসের মূলজীব্য হয়েছে। প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন, শরৎচন্দ্রের সব্যসাচীর সাথে নজরুলের প্রমত্ত’র চরিত্রের মিল আছে আবার কখনো নজরুলের বিপ্লবী শিক্ষক নিবারণ ঘটকের সাথে প্রমত্ত’র চরিত্রের মিল আছে। প্রাবন্ধিক যুক্তির মাধ্যমে বাঘা যতীনকে কুহেলিকার বজ্রপানি আর বজ্রপানির শিষ্য প্রমত্ত’ই যে এম.এন রায়, এই বিষয়টাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। কারণ বাস্তব জীবনে নজরুল বাঘা যতীনের বড় ভক্ত ছিলেন— ফলে তাঁর বীরত্বগাথাকে কেন্দ্র করে তিনি রচনা করেন ‘নব ভারতের হলদিঘাট’ নামক কবিতাটি। যেটি ‘প্রলয় শিখা’ কাব্যগ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়। এরপর ‘কুহেলিকার’ জয়তী চরিত্রের সাদৃশ্য পাওয়া যায় বাঘা যতীনের দিদি বিনোদবালা চরিত্রের মধ্যে। এ-কারণে প্রাবন্ধিক যে নজরুল জীবনে বাঘা যতীনের প্রভাবের কথা বলেছেন তা আমরা কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারিনা। আর এ-কারণে প্রাবন্ধিকের সাথে আমরা সহমত পোষণ করে বলতে পারি, নজরুলের এই ব্রিটিশবিরোধী ‘কুহেলিকা’ উপন্যাস রচনার পেছনে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ উপন্যাস এবং বিপ্লবী বাঘা যতীনের জীবনদর্শের প্রভাব অনস্বীকার্য।
প্রাবন্ধিকের পরবর্তী প্রবন্ধ ‘জনপ্রিয় উপন্যাস: মুসলিম উপন্যাসিকের কীর্তি’ নামক প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধে লেখক বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় সব মুসলিমদের দেখিয়েছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের হাত দিয়ে সফল বাংলা উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়— এরপর শরৎচন্দ্র এসে সেই উপন্যাস ধারাকে আরও জনপ্রিয় করে তোলেন। মুসলিম ঔপন্যাসিকদের ভেতর সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন মীর মশাররফ হোসেন। তিনি তাঁর গদ্যে সাধারণত বঙ্কিমী রীতি ব্যবহার করতেন এবং এ-রীতি ব্যবহার করে সামনে এগুতেন। তবুও তিনি মুসলিম ঔপন্যাসিকদের ভেতর জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করেন তাঁর স্বীয় প্রতিভাবলে। তিনি তাঁর উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে ‘বিষাদ সিন্ধু’র মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস রচনা করতে পেরেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় চৌধুরী মোহাম্মদ আর্জুমন্দ আলী, মোজাম্মেল হক, শেখ ফজলুল করিমের মতো ঔপন্যাসিক উপন্যাস চর্চায় নিজেকে মেলে ধরেন। এরপর মুসলিম জাগরণের আরেক অগ্রপথিক হলেন সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। তিনি সমাজের ভেদ বিচারের পরিবর্তে জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ বেশি করে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি তাঁর উপন্যাসে উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের নির্মম চিত্রগুলো— যেটা প্রাবন্ধিক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। পশ্চাৎপদ বাঙালি নারীদের দুর্দশার চিত্র ও জাগরণের মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের উপন্যাসগুলিতে। কাজী আব্দুল ওদুদ, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, মোহাম্মদ নজিবর রহমানের উপন্যাসে উঠে এসেছে মুসলিম সমাজের রক্ষণশীলতা বা উদারতার দৃষ্টান্ত, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ, ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধাচারণসহ মুসলিম রীতিনীতি আচার-আচরণের বিষয়গুলো। এরপর প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন, কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীনের সাহিত্যকর্মগুলো। তাঁরা কমসংখ্যক উপন্যাস রচনা করলেও কবিখ্যাতির গুণে ঔপন্যাসিকখ্যাতি কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। ফলে তাঁরা পাঠকহৃদয়ে কবি হিসেবেই বেশি সমাদৃত হয়েছেন। বাংলা উপন্যাসধারায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নামের প্রসঙ্গ প্রাবন্ধিক এখানে এনেছেন, তিনি হলেন— আকবর হোসেন। তিনি তাঁর উপন্যাসে সমাজজীবনের বিভিন্ন সমস্যাকে অত্যন্ত সুদক্ষ শিল্পীর মতো এঁকেছেন। তিনি অতীব জীবননিষ্ঠ লেখক বলেই তাঁর রচনাসম্ভার সচেতন শিল্পীর মত পাঠক সমীপে প্রকাশ হয়েছে এবং সাহিত্যসমাজে অত্যুঙ্গ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তিনি নর-নারীর প্রেম-রোমান্স, মধ্যবিত্ত টানাপোড়েন, সাম্যবাদী চেতনাদর্শ এসবই তাঁর উপন্যাসের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রাবন্ধিক তাঁর এই প্রবন্ধে জনপ্রিয় সব মুসলিম ঔপন্যাসিকদের সৃষ্টিকর্মের উপর একটি সামগ্রিক আলোকপাত করবার চেষ্টা করেছেন— যেটা আমাদের সাহিত্য সমালোচনার পথকে অতিক্রম করতে সাহায্য করবে।
শরৎসাহিত্যের একটি জনপ্রিয় উপন্যাস ‘গৃহদাহ’ নিয়ে প্রাবন্ধিকের এবারের আলোচনা ‘গৃহদাহ : শরৎ-সাহিত্যে বৃত্তভাঙ্গা উপন্যাস’। সংস্কারের প্রাচীর ভেঙে এক আলাদা সত্তাধারী নারীরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘অচলা’ নামক চরিত্রটি। এই চরিত্রকে ঘিরে দুটি পুরুষ হৃদয়ের ভালোবাসার বীজ পরিণতি লাভ করেছে— ফলে শরৎচন্দ্রের শিল্প সাফল্যের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে এই ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে। ঔপন্যাসিক যে সমাজস্বীকৃত প্রেমের পাশাপাশি সমাজ-বিগর্হিত নিষিদ্ধ প্রেমকে উপজীব্য করে তুলে ধরে উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে সাজিয়েছেন— তা শরৎচন্দ্রের পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ ও রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন। উক্ত প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’র (১৯০৩) প্রভাব ‘গৃহদাহ’তে রয়েছে। যেমন চোখের বালিতে ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র প্রভাব আছে।” এর পাশাপাশি প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের সাথে ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের চারিত্রিক একটা সাদৃশ্য দেখাতে চেষ্টা করেছেন। প্রেম যে সাধনার ফল— উপন্যাসের সুরেশ সেটি উপলব্ধি করতে পারেনি। সে ছলে-বলে-কৌশলে অচলার শরীরটা পেলেও মন থেকে মেনে নেওয়ার মতো প্রেম পায়নি। পুরো উপন্যাসটি অচলাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে— এজন্য সুরেশ ও মহিমের মাঝে অচলা মধ্যবর্তী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে-কারণে অচলা চরিত্রকে প্রাবন্ধিক ‘দ্বিচারিণী’ বলে উল্লেখ করেছেন। অচলা মহিমকে বিয়ে করে যেমন একনিষ্ঠ স্ত্রী হয়ে উঠতে পারেনি, অপরদিকে সুরেশকে ভালোবেসে একনিষ্ঠ প্রেমিকাও হয়ে উঠতে পারেননি— তাই প্রাবন্ধিক অচলা চরিত্রের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। শরৎ সাহিত্যে ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসটি ব্যতিক্রম। বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও অচলা সুরেশকে ভালোবেসেছে। কারণ স্বামী মহিমের অর্থনৈতিক অবস্থা, নিরুত্তাপ আচরণ, মৃণালের সাথে হাসি-তামাশা— এসবই অচলাকে মহিম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। ফলে এই মানসিক সংকট অচলাকে সুরেশমুখী করে তুলেছে। তবে দু’জনকে একসাথে জীবনে বেঁধে তো জীবন চলতে পারেনা— এই সহজ অঙ্কটি অচলা বুঝতে পারেনি। বিধায় এক চরম মিথ্যার উপর অচলা সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। হাওয়া বদল করতে যাওয়ার সময় অসুস্থ মহিমকে ফেলে অচলা সুরেশের কাছে সতীত্ব বিসর্জন দিয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, অপমানিত হয়েছে। অচলা বেঁচে থেকেও যেন মৃতের মতো অবস্থা। মহিমের সাথে সংসার জীবন শুরু করতে না করতেই সুরেশের প্রেমে মাজে যাওয়াটা ছিলো অচলার চরম ভুল। সে ভুলের মাশুল দিতে সুরেশের মৃত্যুর পর অচলাই তার মুখাগ্নি করতে চেয়েছে। অন্যদিকে বলেছে, ‘আমি তাঁর স্ত্রী নই’। শরৎ সাহিত্যে এই প্রথম কোন নায়িকা সমাজ-সংস্কৃতি ভাঙ্গার স্পর্ধা দেখিয়েছে। সুরেশ-মহিম বন্ধুত্বে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছিলো তার মূলে ছিলো অচলা। আবার মহিম-অচলার বিয়েতে যে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াই সেটা সুরেশ। তবুও মহিম যে অচলা ও সুরেশের জীবনের কোন পর্যায়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি— এটা মহিম চরিত্রের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে। সুরেশ যে সুযোগসন্ধানী ছিলো, তা প্রাবন্ধিক চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কারণ সে মহিম-অচলার দাম্পত্য জীবনের দূরত্বটা বুঝতে পেরেছিলো এবং সময়মতো ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে। ঝড়-বৃষ্টির রাতে সুরেশ-অচলার শারীরিক সম্পর্কের পর সুরেশ বুঝতে পারে, সে শুধু অচলার দেহটাই পেয়েছে মনটা পায়নি। ফলে সে মুক্তি পেতে চেয়েছে এবং মৃত্যুর মধ্যদিয়েই সে-মুক্তি ঘটেছে। এই উপন্যাসে মহিমের নিস্ক্রিয়তা পাঠককে কখনো ভাবিয়ে তোলে। তার ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হলেও সে নির্বিকার, সুরেশের সাথে অচলার গভীর মেলামেশাতেও সে নির্বিকার— তবে কাউকে সে বুঝতে দেয়নি সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণা কতোটা গভীর। এতকিছুর পরও যখন অচলা মহিমের হাত ধরে বলেছে, ‘আর আমি দুর্বল নই, তোমার হাত ধরে যত দূর যেতে বলো যেতে পারবো’। মহিম কিন্তু নিরবে, নিভৃতে অচলার প্রেমকে প্রত্যাখান না করে অচলার সাথে জীবন কাটানোর দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। তবে উপন্যাসের মূল বিষয় ভালোবাসায় যে জোর খাটেনা বা জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায়না— এই সত্যটিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে। আর প্রাবন্ধিক সেই সত্যটিকে উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করেছেন এই প্রবন্ধে।
রবীন্দ্র পরবর্তী প্রধান প্রধান গল্পকারদের অন্যতম এক নাম হলো তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। আর তাঁকে নিয়েই প্রাবন্ধিকের এবারের প্রবন্ধ ‘তারাশঙ্করের গল্প: নিম্নবর্গের মানুষের জীবনচিত্র’। এই প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক আলোচনার মাধ্যমে তারাশঙ্করের চিন্তা-দর্শন, বিষয়বস্তু, চরিত্র, ভাষা, পরিবেশ সম্পর্কে আমাদেরকে সম্যক ধারণা দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, তারাশঙ্কর তাঁর গল্পের বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিম্নবর্গের মানুষের জীবনচিত্রটাই বেশি এঁকেছেন। আর সেসব নিম্নবর্গের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, তাদের জীবনযাপন, জীবনবৈচিত্র, অস্তিত্বকাঠামো, আদিম উচ্চবর্গের শোষণ-শাসন ও তাদের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিবাদ, প্রতিরোধের চিত্র ফুটে উঠেছে। আমরা সকলেই জানি, রবীন্দ্রনাথের হাতে প্রথম ছোটগল্পের সার্থকতা রূপ লাভ করে তবে রবীন্দ্র পরবর্তী ধারার গল্পকাররাও এই গল্পগুলোকে নানা আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল ও বিষয় বিন্যাসে আলাদা আলাদা করে। তারাশঙ্কর ব্যক্তিগত জীবনে নিম্নবর্গের মানুষ না হয়েও নিম্নবর্গের মানুষের সাথে গভীরভাবে মেলামশের কারণে অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি তাঁর গল্পে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। তাঁর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা কল্লোলধারার লেখকরাও নিম্নবর্গের মানুষের জীবনচিত্র গল্পের বিষয় বানালেও তারাশঙ্করের প্রকাশভঙ্গিটা ছিলো স্বতন্ত্র। খুঁটেখুঁটে তিনি সবশ্রেণির মানুষের কাছ থেকে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান অর্জন করে তা গল্পের মধ্যদিয়ে প্রকাশ করেছেন। এ-কারণে বাংলার নানা শ্রেণির চরিত্রগুলো তার গল্পের চরিত্র হয়েছে। তেতাল্লিশ বছরের সাহিত্যজীবনে গল্পকার প্রচুর গল্প লিখেছেন। প্রাবন্ধিক গল্পকারের গল্পের তিনটি সময়কাল নির্ধারণ করেছেন। ১৯২৭-১৯৩২-এ রচিত গল্পগুলোতে বৈষ্ণব-ধর্ম-প্রেম, সূক্ষ বস্তু-বীক্ষণ, পরিবেশের সাথে জীবনের অবিচ্ছেদ্য সম্পৃক্ততা গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। ১৯৩৩-১৯৩৭-এ রচিত গল্পগুলোতে জমিদার শ্রেণির সাথে অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ এসেছে। জমিদারদের অহংকার, গর্ব, দম্ভ-এর পাশাপাশি তাদের পতনের কষ্ট ও যন্ত্রণার চিত্রও দেখিয়েছেন। ১৯৩৭-১৯৭১-এ রচিত গল্পগুলোতে বিশুদ্ধ গল্পের পাশাপাশি ক্রটিযুক্ত গল্পও রয়েছে, অতিকথন রয়েছে এমনকি ঘুরেফিরে একই বিষয়বস্তুর একাধিক ব্যবহার হয়েছে। তারাশঙ্কর যে গল্পের রূপ-বিবর্তন ঘটিয়েছেন সে-প্রসঙ্গে উদাহরণ টানতে গিয়ে প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন ‘কবি’ উপন্যাসের বীজ ‘কবি’ গল্পের মধ্যে ছিলো। তাছাড়া ‘রাইকমল’ ও ‘মালাচন্দন’ গল্প হয়েছে ‘রায়কমল’ উপন্যাস, ‘মন্থনবিষ’ গল্প ‘আগুন’ উপন্যাস, ‘বোবাকান্না’ গল্প ‘আরোগ্যনিকেতন’ উপন্যাস, ‘সমুদ্র মন্থন’ গল্প ‘ধাত্রীদেবতা’ উপন্যাস, ‘শ্মশানের পথে’ গল্প ‘চৈতালী-ঘূর্ণি’ উপন্যাসে রূপ লাভ করেছে। তবে বিশাল গল্পভাণ্ডারের গল্পকার তারাশঙ্কর যে প্রথমশ্রেণির একজন গল্পকার একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আলোচ্য প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কয়েকটি গল্পে নিম্নবর্গের মানুষের জীবনচিত্রটাকে তুলে ধরেছেন এবং তারাশঙ্কর যে একজন অভিজ্ঞতালব্ধ উচ্চমানের গল্পকার সেটি প্রমাণ করে দিয়েছেন। আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, প্রাবন্ধিক এখানে তারাশঙ্করের গল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেছেন— তবে প্রবন্ধের শেষে তিনি যে দুইটি প্যারার মাধ্যমে ‘তিতাস’ উপন্যাসের আলোচনা করেছেন, এ অংশটুকু আমাদের কাছে অতিকথন বলে মনে হয়। যেহেতু তার আলোচ্য বিষয় তারাশঙ্করের গল্প, তাই আলোচনা প্রসঙ্গে উপন্যাসের কথা আসতেই পারে কিন্তু এই অংশটুকু প্রবন্ধের শেষে সংযোজিত না হলেও এ প্রবন্ধের মান এতটুকুও ক্ষুণ্ন হতো না বলে আমাদের কাছে মনে হয়। সার্বিক বিচারে প্রবন্ধটি সার্থকতার রূপ লাভ করে।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। আর বাংলা সাহিত্যে নদী যে অপরিহার্য সেদিক বিবেচনায় প্রাবন্ধিকের এবারের প্রবন্ধ ‘নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসে লোকসংস্কৃতি’। অর্থাৎ বাংলা উপন্যাস নদীকে ঘিরেই মানুষের জীবন ও নদীর কূলে গড়ে ওঠা। মানবসভ্যতার ঐশ্বর্যের এই দিকটি সাহিত্যিকরা যে চমৎকারভাবে উপস্থাপনা করেছেন সেই আলোচনাই প্রাবন্ধিক এই প্রবন্ধে করেছেন। নদীভিত্তিক উপন্যাসগুলোতে লোকসংস্কৃতির প্রভাবের কারণে স্বতন্ত্র মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। প্রাবন্ধিক এ আলোচনায় নদীভিত্তিক উপন্যাস রচয়িতাদের নাম ও উপন্যাসের নাম তুলে ধরেছেন। স্বাভাবিকভাবে উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের চিন্তা ও জীবনদর্শন বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকে। সে-ক্ষেত্রে নদীর বিষয়টি উপন্যাসে কোন না কোনভাবে উঠে আসে। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এমননি আধুনিক যুগের সাহিত্যকর্মে নদীর কথা এসেছে বিচিত্রভাবে। বাংলা সার্থক উপন্যাস সাহিত্যের জনক বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে যেমন নদীর প্রসঙ্গ এসেছে তেমনি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রসহ আধুনিক সব ঔপন্যাসিকের উপন্যাসে নদীর কথা ফুটে উঠেছে। শুধু উপন্যাসে নদীর কথা আসেনি— নদীকেন্দ্রিক মানুষের জীবনাচরণের পাশাপাশি লোক উপাদান তথা লোকসংস্কৃতির প্রভাবের কথাও ফুটে উঠেছে। অদ্বৈত মল্লবর্মন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শিরোনামে একটি উপন্যাস রচনা করেই বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন। সেখানে ঔপন্যাসিক তিতাস পাড়ের মানুষের জীবনচিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বিদেশি সংস্কৃতির দাপটে বাঙালির সংস্কৃতি ভেঙে পড়া, জীবন বদলের ছবি নানাভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে নৌকাবাইচ, বেদেনিদের সাপের খেলা দেখানোর প্রতিযোগিতা, মুর্শিদি, বাউল, মারফতি গানের প্রসঙ্গ ও পুঁথি পড়ার চিত্র উঠে এসেছে। উপন্যাসের বাসন্তী চরিত্রই যেন হয়ে উঠেছে তিতাসের আরেক রূপ। তিতাস আর বাসন্তী যেন একের ভেতর অন্যের প্রকাশ। মানুষের জীবনে প্রেমের উপমা যেন নদীর বহমানতার সাথে একীভূত হয়ে যায়। শুকনো তিতাসকে ঔপন্যাসিক যৌবনহারা নদীর সাথে তুলনা করেছেন। নারী যেমন যৌবনেই আকর্ষণীয়া, নদীও তেমনই। সেই নদীকে নিয়ে ঔপন্যাসিক যে উপন্যাস রচনা করেছেন— তা বাংলা সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস থেকে ভিন্ন মর্যাদার দাবী রাখে। প্রাবন্ধিক তার আলোচনার মধ্যে বিভিন্ন ঔপন্যাসিকের নাম উল্লেখ করে তাঁদের নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস সম্পর্কে আমাদেরকে যে ধারণা দিয়েছেন তা সত্যিই প্রশসনীয়। ফলে নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস ও তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধি আরও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। এর পাশাপাশি প্রাবন্ধিক যে নদীকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির সাথে জীবন সংস্কৃতির সম্মিলনের একটা ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তাতে নদীভিত্তিক লোকসংস্কৃতির ধারা সম্পর্কে পাঠকের চিন্তার পরিধি আরও বিস্তৃত হবে বলে আশা করা যায়।
প্রাবন্ধিকের পরবর্তী প্রবন্ধ ‘অবাঞ্চিত: উপন্যাসের ভিতর বাহির’। এই প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক মূলত প্রথম অংশে একটি উপন্যাসের বিষয় বৈচিত্রের দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন এবং পরবর্তী অংশে আকবর হোসেনের ‘অবাঞ্চিত’ উপন্যাসের গঠনগত অংশ তুলে ধরেছেন। প্রাবন্ধিক উপন্যাস প্রসঙ্গে প্রবন্ধে বলেছেন, “উপন্যাসের বিস্তৃত অধ্যায়ে ব্যক্তির যে সামাজিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক আখ্যান ফুটে ওঠে তা অন্তত সে-সময় অন্য কোন মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি।” প্রকৃতপক্ষে, আমরাও প্রাবন্ধিকের সাথে সহমত প্রকাশ করছি এ-কারণে যে, উপন্যাসে বিস্তৃত পরিসরে যেভাবে বর্ণনা করা যায় অন্য কোন মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। ফলে চলমান জীবনের নানা দিক উপন্যাসে ফুটিয়ে তোলা যায়। দ্বিতীয় অংশে আলোচিত হয়েছে কথাসাহিত্যিক আকবর হোসেনের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘অবাঞ্চিত’ নিয়ে। এখানে ফুটে উঠেছে আকবর হোসেনের লেখা এই প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশ নিয়ে নানা বিড়ম্বনার প্রসঙ্গ। আকবর হোসেনের বি.এ ক্লাসে অধ্যয়নকালে রচিত প্রথম উপন্যাস এই ‘অবাঞ্চিত’। লেখক আঠার দিনে গ্রন্থটি রচনা করে প্রথমে হিন্দু চরিত্রের নামাঙ্কিত করলেও পরবর্তীতে মুসলিম চরিত্রের নামাঙ্কিত করেন। প্রথম রচিত এ উপন্যাসটি প্রকাশ করার জন্য তিনি তৎকালীন খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকদের কাছে যান, কিন্তু তাঁদের কাছ থেকে হতাশা নিয়ে ফিরে আসেন। শুধু এস. ওয়াজেদ আলী তাঁকে উপদেশমূলক কয়েকটি কথা বলেন, যেটার মাধ্যমে আকবর হোসেনের হতাশার মোহ কেটে কিছুটা আশার আলো দেখতে থাকেন। সেই আলোকে আরও উজ্জ্বল করে দিয়েছিলেন সুশীল মজুমদারের স্ত্রী। তিনি এবং তাঁর স্বামী দুজনেই পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ভাগ্যদেবী অপ্রসন্ন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রোষানলে লেখককে পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তবুও লেখক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বপ্নের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন। এরপর লেখক উপন্যাসটি প্রকাশের জন্য ‘দিলরুবা’ সম্পাদককে দেন। সেখানেও ঘটে বিপর্যয়। অনেক ঝড়-ঝামেলার পর ডাস্টবিন থেকে তিনি পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করে এক প্রফেসরের কাছে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করতে যান। সেখানে জানতে পারেন উপন্যাস প্রকাশে তাঁর নাম ব্যবহৃত হবে না— বিধায় তিনি সেটি বিক্রি না করে ফেরত নেন এবং অবশেষে পাইওনিয়ার প্রেসের মালিক উপন্যাসটি প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শর্ত থাকে যে, কাগজের দাম বাবদ লেখককে ১৩০০ টাকা দিতে হবে ফলে লেখক নিজের বসতবাড়ি বিক্রির প্রতিশ্রুতিবাবদ ১৩০০ টাকা প্রকাশককে দেন। এ-কারণে বলা যায়, এই উপন্যাসটি প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখককে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। উপন্যাসটি লেখকের যে কিছুটা কাঁচা হাতের লেখা সেটার প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন প্রাবন্ধিক। উপন্যাসের কাহিনী গ্রন্থনে সরলতা ও দুর্বলতা উভয়ই রয়েছে। কিছু অতিব্যঞ্জক কাহিনীও সংযোজিত হয়েছে এখানে— তা উপন্যাসটি পরিপূর্ণ সার্থক হতে কিছুটা বাধা সৃষ্টি করে।
‘অবাঞ্চিত’ একটি সন্তানকে ঘিরে উপন্যাসটির আখ্যানভাগ গড়ে উঠেছে। জমিদারপুত্র ফিরোজ ও গোমস্তা ওসমানের নাতনি রোকেয়ার বিবাহবহির্ভূত প্রেমের ফসল মহব্বর নামক সন্তানটি। ভাগ্যক্রমে তাদের বিয়ে না হলেও দু’জন দুইভাবে জীবনযাপন করতে থাকে। ফিরোজ রেখাকে নিয়ে সংসার করছে অপরদিকে রোকেয়া কামুক আমীরকে ঘিরে নতুন করে বাঁচার আশা করছে। ফিরোজের জীবনে রেখা আসলেও রেখা চরিত্রে মানবিকতার ছোঁয়া লক্ষ্য করা গেছে, কিন্তু রোকেয়ার জীবনে আসা আমীর প্রথমে কামুক, লম্পট ছিলো যে কিনা জোর করে রোকেয়ার সতীত্ব হরণ করেছে। তবে ঔপন্যাসিক আমীর চরিত্রকে পরবর্তীতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা হিসেবে তৈরী করেছেন— ফলে দোষে-গুণে আমীর একটি সক্রিয় চরিত্র হয়েছে উপন্যাসটিতে। এ-কারণে প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন, ‘দোষে-গুণে আমীর চরিত্র একটি শক্তিশালী সৃষ্টি। যে চরিত্রের কাছে স্লান হয়ে গেছে ফিরোজের চরিত্রটি।’ ঔপন্যাসিক যে সামাজিক এক সমস্যার পাশাপাশি রাজনৈতিক সমস্যার বিষয়টিও তুলে এনেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। বিষয়গত কারণে যে উপন্যাসটির নামকরণ ‘অবাঞ্চিত’ হয়েছে সে সার্থকতার দিকটি এ প্রাবন্ধিক তুলে ধরেছেন। বৈচিত্রময় কাহিনী, আবেগময় সংলাপ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, সক্রিয় চরিত্র— সার্বিক বিচারে প্রাবন্ধিক উক্ত উপন্যাসটিকে কালোত্তীর্ণ উপন্যাসের মর্যাদা দান করেছেন।
শহীদুল্লা কায়সারের ইতিহাসবোধ ও সংগ্রামী জীবনচেতনার শিল্পরূপধর্মী উপন্যাস ‘সংশপ্তক’কে নিয়ে প্রাবন্ধিকের এবারের প্রবন্ধ ‘সংশপ্তক: চেতনাস্পর্ধিত অগ্নিপ্রত্যয়’। মূলত প্রাবন্ধিক এখানে সমাজতান্ত্রিক বৈপ্লবিক ধারার কথা সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের জনপ্রিয় এই উপন্যাসের শিল্পরূপ বর্ণনার চেষ্টা করেছেন। বলা হয়ে থাকে, ঔপন্যাসিক আর কোন সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি না করলেও এই সংশপ্তকের জন্য তিনি উচ্চতর মর্যাদায় আসীন হতে পারতেন। কারণ উপন্যাসের ভেতর সমাজজীবন ও রাষ্ট্রিক জীবনের নানামাত্রিক বিষয়গুলো নিখুঁতভাবে খুঁটেখুঁটে তিনি তুলে ধরেছেন। যা নানাকৌণিকভাবে অন্য কোন উপন্যাসে এত দীর্ঘ ক্যানভাসে ধরা পড়েনি। প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন, উপন্যাসের কাহিনীর সময়কাল ১৯৩৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময় সামাজিক ও রাষ্ট্রিক যে জীবনসত্য তা এ উপন্যাসে শিল্প সুষমায় সত্যালোকে ধরা পড়েছে। উপন্যাসের কাহিনী গ্রাম থেকে শুরু করে কলকাতা, ঢাকা আবার গ্রামে এসে শেষ হয়েছে— ফলে এর ভেতর নানা শ্রেণির চরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে। অপকর্মে লিপ্ত সমাজপতি ফেলু মিঞা, রমজানদের মতো ভদ্রতার মুখোশধারীদের কাছে যে রানু, হুরমতিদের মতো নিরীহ লোকেরা যুগে যুগে প্রতারিত ও নির্যাতিত হয়ে আসছে— তারই নির্মম চিত্র তুলে ধরেছেন আলোচ্য উপন্যাসে। পাশাপাশি সেকান্দার মাস্টার, জাহিদের মতো প্রতিবাদী চরিত্ররাও এসব অব্যবস্থাপনার প্রতি প্রতিবাদ করতে দ্বিধান্বিত হয়নি, কিন্তু বারবার তারা বাধার সম্মুখীন হয়েছে। উপন্যাসের শুরুটা যে হয়েছে এক কদর্য-বীভৎস রূপ তুলে ধরার মধ্যদিয়ে। প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন, ঔপন্যাসিক কিভাবে নির্যাতিত হুরমতি চরিত্রের মধ্যদিয়ে বর্তমান সমাজের নারীদের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছেন। হীন মানসিকতার এক শ্রেণির পুরুষ কিভাবে নারীদের পায়ের নিচে পিষে মারে। আধুনিক জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার সেকান্দার মাস্টারের কাছ থেকে জাহিদ কিভাবে রাজনীতিতে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী ভূমিকায় অংশগ্রহণ তার চিত্রও ঔপন্যাসিক তুলে ধরেছেন। জাহিদ জীবনের চরম সত্যটি অনুধাবন করে মানবকল্যাণে সে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। লেখক এখানে অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন— যা উপন্যাসকে সার্বিক বিচারে পরিপূর্ণতা দান করেছে। বৈচিত্রময় চরিত্রের পাশাপাশি যে বাঙালির জীবনে হাজার বছরের লোকজ জীবনব্যবস্থা, সংগীত, ঐতিহ্যচেতনা মিশে আছে— তারও প্রকাশ আলোচ্য উপন্যাসে আমরা লক্ষ্য করি। প্রাবন্ধিক বলেছেন ‘ধর্মের গোঁড়ামি দূর করে সব মানুষ যে এক-মানুষই সত্য— এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যয় এখানে উচ্চারিত হয়েছে।’ সত্যিকার অর্থে লেখক মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ এই সত্যের বলে বলীয়ান হয়ে তিনি আলোচ্য এই উপন্যাসখানি রচনা করেছেন। উপন্যাসের আলোচনা করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক লেখকের ভাষা প্রয়োগের দক্ষতার কথা বলেছেন। এছাড়া তিনি চমৎকারভাবে উপন্যাসের উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাস, রূপক, প্রবাদ, চিত্রকল্প, আঞ্চলিক শব্দসমূহ নিখুঁত দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে বের করেছেন— যা প্রাবন্ধিকের দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। সংশপ্তক উপন্যাসটি যে শিল্পগুণে গুণান্বিত তা গবেষকের আলোচনায় উঠে এসেছে এবং শহীদুল্লা কায়সারের এই শিল্পকর্মটি যে এক বিশিষ্ট মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের অন্যতম জনপ্রিয় শাখা হলো উপন্যাস। আর সেই জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোই এনে দেয় ঔপন্যাসিকদের জনপ্রিয়তা। এমনই এক বিষয় নিয়ে প্রাবন্ধিকের পরবর্তী প্রবন্ধ ‘জনপ্রিয় উপন্যাস: ঔপন্যাসিকের জনপ্রিয়তা।’ এই প্রবন্ধের ভেতর প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় সব ঔপন্যাসিকদের উপন্যাসের বিষয় সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছেন। বঙ্কিমিধারার প্রথম মুসলিম ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন তাঁর ‘বিষাদসিন্ধু’ উপন্যাস রচনা করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। মূলত তিনি তাঁর উপন্যাসগুলোতে মুসলমানদের উগ্রতা ও সংস্কার চেতনার পাশাপাশি তৎকালীন আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতিক চর্চার জন্য তখন অনুকূল পরিবেশ ছিলোনা। এ-কারণে নানা প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে তাঁকে সম্মুখে অগ্রসর হতে হয়েছে। আর এই অগ্রসরতার কারণে পরবর্তী ধারার ঔপন্যাসিকদের চলার পথটি আরও মসৃণ হয়েছে। মোজাম্মেল হক, শেখ ফজলুল করিম, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, নজিবর রহমান, কাজী নজরুল ইসলাম, সিকান্দার আবু জাফর, আকবর হোসেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, জহির রায়হান, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ প্রমুখ সাহিত্যিকদের সৃষ্ট কর্মের মধ্যে এক আলাদা ইমেজ তৈরি হয়েছে— যা সমাজ চেতনার পাশাপাশি জনচিত্র জয় করতে সক্ষম হয়েছে। প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন, কোন ঔপন্যাসিক কিভাবে সমাজের অন্ধত্ব, অপসংস্কৃতি, ধর্মান্ধতাসহ সমাজের নানা ব্যাধিকে কিভাবে তাঁদের উপন্যাসে চরিত্রের বা বর্ণনার মাধ্যমে সাজিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন উপন্যাসের শিল্পমূল্যের বিষয়টিও তাঁর আলোচনায় উঠে এসেছে, এ-কারণে পাঠকের বোধ এবং বোধির জায়গাটি আরও পাকাপোক্ত হয়ে যায়। এরপর প্রাবন্ধিক একটি গুরুত্বপূর্ণ কথার মাধ্যমে প্রবন্ধটি শেষ করতে চেয়েছেন যে, অতীতে লেখকের নামের চেয়ে লেখার গুণগতমান যাচাই করা হতো, কিন্তু বর্তমানে সেটা হয় না। এখন মিডিয়া বা অন্যান্য মাধ্যমে লেখকের নামের জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব— তবে নামের জনপ্রিয়তার মানেই যে লেখার গুণগত মান ঠিক থাকবে এমনটি বলা অসঙ্গত হবে। সেক্ষেত্রে নামের থেকে কর্মটাকে বড় করে দেখা উচিত অর্থাৎ লেখকের নামের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি তাঁর গুণগতমান সম্পন্ন লেখা লিখে জনপ্রিয়তা অর্জন করাটা একান্ত জরুরি।
‘প্রবাদ’-এর ব্যবহার যে একটি সার্থক উপন্যাস সৃষ্টিতে কতটা সহায়তা করে সে-বিষয়টিকে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রাবন্ধিক তাঁর পরবর্তী ‘তিন কথা কবিদের উপন্যাসে প্রবাদ প্রয়োগ’ প্রবন্ধে। বলা যায়, আর এই উপাদান ব্যবহারের ফলে উপন্যাস হয় শিল্প সুষমামণ্ডিত। প্রাবন্ধিক মূল খাতা তাঁরা হলেন, মীর মশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ নজিবর রহমান ও আকবর হোসেন। এই তিনজন ঔপন্যাসিক তাঁদের উপন্যাসে পরিবেশ বা চরিত্র উপযোগী প্রবাদ ব্যবহার করে উপন্যাসের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করেছেন। তাঁদের পূর্বসূরী এবং সমসাময়িক ঔপন্যাসিকরাও এই প্রবাদ ব্যবহারের ফলে উপন্যাসের চমৎকার্য রক্ষা করেছেন। মীর মশাররফ হোসেনের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘বিষাদসিন্ধু’। প্রাবন্ধিক তাঁর আলোচনাতে দেখিয়েছেন, এই উপন্যাসে প্রবাদ ব্যবহারের ফলে উপন্যাসের বিষয় ও চারিত্র্য বিকাশের মাধ্যমে অর্থবহতাকে গভীরতর করেছে। প্রাবন্ধিক উপন্যাসের প্রবাদগুলোকে উল্লেখ করে তার সাথে কাহিনীর সংশ্লিষ্টতা ব্যাখ্যা করেছেন। কোন চরিত্র কিভাবে প্রবাদটির সাথে সম্পর্কযুক্ত সে-বিষয়টিও এনেছেন। মীর সাহেব যে তাঁর ওই উপন্যাসে প্রবাদ ব্যবহারে মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন সে-বিষয়টি স্পষ্ট। এরপর নজিবর রহমানের উপন্যাসগুলো আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমে এসেছে ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের কথা। বাঙালি মুসলিম রচিত সাহিত্যে নজিবর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন— যে-কারণে তিনি ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর শিল্পোৎকর্ষ উপন্যাসের নান্দনিক ব্যবহারগুলো উঠে এসেছে গ্রামীণ লোকজীবন থেকে। তাঁর ব্যবহৃত প্রবাদগুলো চেনা-জানা পরিবেশ থেকে পাওয়া গেছে। ফলে দেখা যায় ‘ঢিলটি মারলে পাটকেলটি খাইতে হয়’, ‘সংসার বড় কঠিন স্থান’, ‘এ কথা সে কথা দে-লো বু একটা পান পাতা’, তাছাড়া ‘গরীবের মেয়ে’ উপন্যাসে ‘খোপা বড় যার ভাগ্য বড় তার’, ‘আমার সর্ব্বনাশের উপর সর্ব্বনাশ’ এমন সব প্রবাদের সফল ব্যবহার তাঁর উপন্যাসে উঠে এসেছে। বাস্তব জীবন থেকে উপাদান সংগ্রহ করে উপন্যাস লেখার খ্যাতি রয়েছে কথা সাহিত্যিক আকবর হোসেনের। তিনি নিজস্ব শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাঁর উপন্যাসের শৈলী নির্মাণ করেছেন। গ্রামীণ পরিবেশ চিত্রকল্প থেকে শুরু করে আঞ্চলিক ভাষা পর্যন্ত সবকিছুই লোকজ জীবন থেকে সংগৃহীত। ফলে তিনি ‘অবাঞ্চিত’ উপন্যাসের মতো জনপ্রিয় উপন্যাস লিখে জনমনে সাড়া ফেলেছিলেন। তাঁরও বাস্তবনির্ভর প্রবাদগুলো চরিত্র ও কাহিনীর সাথে মিলে একাকার হয়ে গেছে। গ্রামীণ মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে ‘ভাই আপন ভাবী পর’, ‘ঢিল মেরে ফল পাড়া‘সহ আরও অনেক জীবনঘনিষ্ঠ প্রবাদ। তাই বলা যায়, শিল্পমানে উত্তীর্ণ ও কালোত্তীর্ণ উপন্যাসগুলোতে প্রবাদের ব্যবহার সফলভাবে করা হয়েছে। প্রাবন্ধিক এখানে ক্ষুদ্র পরিসরে তিনজন ঔপন্যাসিকের উপন্যাসে প্রবাদের ব্যবহার দেখালেও মূলত সকল সফল উপন্যাসে কম-বেশি যে প্রবাদের ব্যবহার হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রাবন্ধিকের এবারের প্রবন্ধ ‘নজরুল, বাঘা যতীন এবং নব ভারতের হল্দিঘাট’। মূলত প্রাবন্ধিক এখানে দু’জনের বিদ্রোহী চেতনার দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন। একজনের বিদ্রোহের সরঞ্জাম কলম, আরেকজনের সরঞ্জাম হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। দু’জনই দুই মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। বাঘা যতীনের মতো বীরপুরুষ যে কিনা মাত্র চারজন বিপ্লবী শিষ্যকে নিয়ে বালেশ্বরের বুড়িবালাম নদীর তীরে বিশাল ব্রিটিশবাহিনীর সাথে প্রথম সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে এক অভিনব ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন। সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে নজরুল রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ‘নব ভারতের হলদিঘাট’ নামক কবিতাটি। এছাড়া নজরুল তাঁর কলমে আগুন ঝরিয়ে গণজাগরণের মাধ্যমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। বাঘা যতীনের থেকে নজরুল বয়সে ১৬ বছর ছোট হলেও বাঘা যতীনের বিপ্লব নজরুলের মনে সাড়া জাগিয়েছিলো। এ-কারণে দেশমাতাকে রক্ষা করার জন্য, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য তিনি শক্ত হাতে কলম ধরেন। রচনা করতে থাকেন ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী সব কবিতা, গান। অন্যদিকে অদম্য সাহসী বাঘা যতীন যে বীরত্বব্যঞ্জক সম্মুখযুদ্ধে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে নিজের ব্যান্ডেজ ছিঁড়ে ফেলে আত্মাহুতি দেন— এখানেই তিনি হয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়। বুড়িবালাম নদীর তীরে হলদিঘাট বাঘা যতীনের সাহসিকতার স্বাক্ষর বহন করে, ফলে নজরুল তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে উক্ত কবিতাটি রচনা করেন। বাঘা যতীন ও নজরুলের বিদ্রোহ ভিন্নভাবে প্রকাশিত হলেও তাঁরা একই পথের পথিক। তাঁরা বিপ্লবী-বিদ্রোহী। তাই ভারতমাতার মুক্তির মূলমন্ত্রকে ললাটে ধারণ করে তাঁরা তাঁদের অবস্থান থেকে বিদ্রোহ চালিয়ে গেছেন। এখানেই তাঁদের সৃষ্টির সার্থকতা।
নিঃসন্দেহে জীবনানন্দ দাশের রচিত কবিতাবলীর মধ্যে ‘বনলতা সেন’ শ্রেষ্ঠ এবং বহুল পঠিত একটি কবিতা। আর এই কবিতার রহস্যময়তা নিয়ে প্রাবন্ধিকের এবারের প্রবন্ধ ‘বনলতা সেন: কবিতা ও কবিতার নারী’। কবিতায় আলোচিত নায়িকা বনলতা সেন আজও যে রহস্যে ঘেরা সেকথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়। প্রাবন্ধিক তাঁর আলোচনা অংশে এই কবিতাটির পোস্টমর্টেম করেছেন অর্থাৎ কবিতার আদ্যোপান্ত খোঁজার চেষ্টা করেছেন। মানুষের হাজার বছর ধরে চলে আসা কামনা-বাসনার পথটিতে যে কবি হাজার বছরের হাঁটা পথের কথা বলেছেন সে প্রসঙ্গ এসেছে। সেই হাজার বছর চলার পথে কবি সত্যি কি বনলতা সেনের দেখা পেয়েছিলেন— সেটা আজও গবেষণার বিষয়। কারণ কবি জীবিতাবস্থায় এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দিয়ে শুধু মিষ্টি হেসে মৌন থেকেছেন মাত্র। কবির কবিতায় কখনো বাস্তবতা এসেছে আবার কখনো কল্পনার রং মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যে-কারণে পাঠক হৃদয় এখনো রহস্যের জাল ছিঁড়তে পারেনি। প্রাবন্ধিক বলেছেন, ‘বাংলা কাব্য সাহিত্যে দু’তিনটি বিখ্যাত ও কালজয়ী কবিতার মধ্যে বনলতা সেন একটি।’ প্রকৃতপক্ষেই তাই। কবির ঘনিষ্ঠ বন্ধু গোপাল চন্দ্র রায়ের কাছেও তিনি এই রহস্যের উম্মোচন করেননি। প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, গ্যেটে এসকল ব্যক্তিবর্গের জীবনে গোপন প্রিয়া আসলেও তাঁরা তাঁদের লেখনীর যে-কোন মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, কিন্তু জীবনানন্দের জীবনে আসলেই কোন বনলতা সেন এসেছিলো কিনা তা জানা যায়না। কারণ কবির নাটোরে যাওয়ার এখনো কোন উপর্যুক্ত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে জীবনানন্দ দাশ যে একটি মেয়েকে ভালোবাসতেন তার কথা তাঁর দিনলিপিতে পাওয়া যায়। সেখানে তিনি মেয়েকে ‘ণ’ বর্ণের আড়ালে গোপন রেখেছেন। যা হোক, প্রাবন্ধিক এই কবিতার শরীরকে ‘পুরোই কল্পনা’ বলেছেন এবং কবি যে রহস্যময়ী নারীকে বাস্তবতা দানের জন্য নাটোরের নাম ব্যবহার করেছেন সে প্রসঙ্গেও এসেছে। তাছাড়া কবি যে অন্যান্য নায়িকাদের নাম ব্যবহার করেছেন তাদের সাথে স্থানের নাম নেই— তবে বনলতার সাথে নাটোর নামক স্থানের নাম থাকায় রহস্যের জাল আরও ঘনীভূত হয়েছে। তাই এই রহস্যের ঘোর না কাটার কারণে প্রাবন্ধিকও ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিকে চির মানবীর রহস্যে ঘেরা, রহস্যময়ী, আখ্যা দিয়ে প্রবন্ধের ইতি টেনেছেন।
জসীমউদ্দীনের পল্লীকেন্দ্রিক চারটি কাহিনীকাব্য নিয়ে প্রাবন্ধিকের এবারের প্রবন্ধ ‘জসীমউদ্দীনের কাহিনীকাব্য: চারিত্রসন্ধান’। প্রাবন্ধিক তাঁর প্রবন্ধের প্রথমে পল্লীকেন্দ্রিক বিষয়, উপাদান এমনকি পল্লীজীবনকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন সাহিত্যিক ও তাঁদের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আমাদেরকে সম্যক ধারণা প্রদান করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি করুণানিধান, যতীন্দ্রমোহন, কুমুদরঞ্জন প্রমুখ সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মে পল্লী জীবনপ্রকৃতির কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু এসব কিছুকে ছাড়িয়ে যিনি ‘পল্লীকবি’ হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি হলেন জসীমউদ্দীন। কারণ তাঁর মতো করে পল্লীজীবনকে আর কেউ সাহিত্য তুলে আনতে পারেননি। একমাত্র তিনিই গ্রামীণ সমাজচিত্রকে নিপুণভাবে জীবন্ত করে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। নাটকের ট্র্যাজেডিটাকে তিনি কাহিনীকাব্যে প্রয়োগ করে মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর রচিত চারটি কাহিনীকাব্যেই ট্র্যাজেডির চমৎকার প্রয়োগ ঘটেছে। প্রাবন্ধিক গ্রিক ট্র্যাজেডি ও শেকসপীয়রীয় ট্র্যাজেডির পাশাপাশি জসীমউদ্দীনের কাব্যে ব্যবহৃত ট্র্যাজেডিকে আধুনিক ট্র্যাজেডি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কারণ তাঁর কাব্যের ট্র্যাজিক চরিত্ররা নিয়তি নির্ধারিত কষ্টে ভোগেনি বরং নিজস্ব কর্মফলের জন্য বেঁচে থেকেও অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেছে। ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কাব্যে যেমন রূপাইয়ের চিন্তায় ধুঁকেধুঁকে সাজু কষ্ট পেয়ে মারা গেছে এবং সেই মৃত্যুতে সাজুর মায়ের গগণবিদারী আর্তনাদ ও আহাজারি গভীর ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছে। ফলে জসীমউদ্দীন ট্রাজিক রূপায়নে ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ এ সার্থকতা দেখিয়েছেন। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে সোজন-দুলীর প্রেমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্ম। যে-কারণে দুলী বাধ্য হয়ে নিজ ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করে। সোজন অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুলীর দেখা পেলেও সমাজের ভয়ে দুলী না দেখার ভান করে চলে গেলে সোজনের হৃদয়ে যে বেদনাক্ষত ও হাহাকারের সৃষ্টি হয় তাতেও এক ট্র্যাজেডির সার্থক রূপায়ন ঘটে। দুলী পরবর্তীতে সোজনের ভালবাসার কাছে পরাজিত হয়ে ফিরে আসলেও মৃত্যুর দুয়ার থেকে সোজনকে ফেরানো যায়নি। ফলে তাদের ভালোবাসাটিও ট্র্যাজেডিকে অতিক্রম করতে পারেনি। ‘সখিনা’ কাব্যে আদিলের সতীত্ব সংস্কার চিন্তাই ট্র্যাজেডির রূপ নির্মাণ করেছে। সখিনার প্রতি আদিলের অবিশ্বাসটাই কাব্যের ট্র্যাজেডি তৈরি করেছে। পরবর্তীতে আদিল ভুল বুঝতে পারলেও সখিনা আর ফেরেনি। যা সখিনা চরিত্রকে আরও দৃঢ় করেছে। মূলত সখিনার ট্র্যাজেডি এই কাব্যে মুখ্য হয়ে ধরা দিয়েছে। ‘মা যে জননী কান্দে’ কাব্যে আমিনার মাতৃত্ব লাভের আশায় জমিদারকে ছেড়ে ড্রাইভারের হাত ধরে চলে যাওয়া এবং সেখান থেকে প্রতারিত হওয়াটা— পাশাপাশি সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে পাদরি সাহেবের কাছে হস্তান্তরই এ-কাব্যে ট্র্যাজেডির সৃষ্টি করেছে। শতকষ্টের পরও আমিনা সন্তানকে নিজ বুকে আগলে রাখতে পারেনি— এ-কারণে তার হৃদয়ে এক হাহাকারের সৃষ্টি হয়েছে। যা কাব্যের ট্র্যাজেডি নির্মাণে সহায়তা করেছে। জসীমউদ্দীন যে গ্রামীণ জীবনস্নাত বিষয় নিয়ে গ্রাম্য চরিত্রের আলোকে কাহিনীকাব্যে তুলে এনেছেন— তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আর এখানেই তাঁর পল্লীকবি হওয়ার সার্থকতা।
এই প্রবন্ধগ্রন্থের প্রাবন্ধিকের শেষ প্রবন্ধ ‘ওমর আলীর কবিতা, ঐতিহ্যের প্রলুব্ধতা ও আধুনিকতার সম্বিৎ’। আলোচ্য প্রবন্ধের প্রথম দিকে প্রাবন্ধিক বাংলা কাব্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্র উত্তরসূরী কবিদের সম্পর্কে আমাদেরকে একটি ধারণা দিয়েছেন। তাছাড়া রবীন্দ্রবলয় থেকে বের হয়ে এসে যে একদল কবি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করে কবিতা রচনা শুরু করলেন সে-কথাও এসেছে। তাঁদের কবিতাতে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, বিশ্বযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক ডামাডোল, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মানবতাবাদ পল্লীজীবন নানা বিষয় অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কবিতা যখন এমন আধুনিকতায় রূপ নিয়েছে তখন পল্লীজীবনকে অনুষঙ্গ করে নিয়ে আধুনিক কবিতা রচনা করতে চেষ্টা করলেন কয়েকজন কবি। তাঁদের মধ্যে বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দীনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। এরই ধারাবাহিকতায় পল্লীজীবনকে কেন্দ্র করে আরেকজন কবি তাঁর কাব্যের ভিত রচনা করেছেন। আর তিনি হলেন এই প্রবন্ধের আলোচ্য কবি ওমর আলী। পূর্বসুরীদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ওমর আলী গ্রামীণ জীবন-সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে কবিতা রচনা করেন। তিনি গ্রাম আর গ্রামের মাটিকে কবিতায় গ্রহণ করেন। সেই গ্রামের হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা, হতাশা-নিরাশা— সব বিষয় তিনি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি নিজে গ্রামের মানুষ তাই গ্রামীণ জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি সেটা কাব্যে রূপ দেন। তাঁর সেই চিত্ররূপময় কবিতার ভেতর যেন পুরো বাংলাদেশের গ্রাম ফুটে ওঠে। গ্রামীণ জীবনের ঘৃণা-ক্ষোভ, জৈবিকতা বা শরীরী সম্পর্ক, শব্দবিন্যাস— সবই যেন কবিতার প্রতি পঙ্ক্তিতে ফুটে উঠেছে। তবে সেটা শালীনভাবে। এই প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদের বসু, শামসুর রাহমানদের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, তাঁরা কখনো সমালোচিত হয়েছিলেন সমাজে কিন্তু ওমর আলী এক্ষেত্রে বেশ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। যেহেতু তাঁর কবিতার গ্রাম জীবন এসেছে আর বাংলাদেশের প্রাণই হলো গ্রাম তাই বলা যায়, গ্রামীণরূপ বর্ণনার মাধ্যমে তাঁর কবিতায় স্বদেশপ্রেমের দিকটিও স্পষ্ট। তিনি দেশ-কাল-সময়সচেতন কবি। তিনি কবিতাতে যেমন অসহায় মানুষের জীবনচিত্র এঁকেছেন তেমনি সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নও দেখেছেন। কবিতা রচনায় তিনি সত্য-সুন্দরকে ধারণ করেছিলেন। প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন অনেক কবি-সাহিত্যিকের মতো তিনিও কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশকে এবং সনেটের ক্ষেত্রে মধুসূদনের দ্বারা অনেকটা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ-কারণে জীবনানন্দের মতো তাঁর কবিতাতে অনেক নারীর নাম এসেছে। তবে সেসব নামগুলোও গ্রাম্য মেয়েদের নাম। এই কবির কবিতার বিষয়বস্তু গ্রামীণ জীবন-সমাজ ও পরিবেশনির্ভর হলেও চেতনাগতভাবে তাঁর বহুমাত্রিকতা আছে। ফলে গ্রামীণ অনুষঙ্গ কবিতায় আসলেও তা আধুনিক কবিতায় আদলেই নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের অস্তিত্বের সন্ধান করতে গেলেই আগে আসবে তাঁদের গ্রামীণ জীবন। আর সেই গ্রামীণ জীবন যখন কোন কবির কবিতায় মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে— তখন সেটা হয়ে যায় হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করে ওমর আলী যে কবিতা রচনা করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার।
আমরা এতক্ষণ যে প্রবন্ধগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম তা আমাদের বাংলা সাহিত্যের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। কারণ প্রাবন্ধিকের এই প্রবন্ধগ্রন্থে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কিছু সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রাবন্ধিক তাঁর নিজস্ব চিন্তা, মনন ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে সেসব সাহিত্যকর্মের আঁতের কথাকে টেনে বের করতে চেষ্টা করেছেন। যুক্তির মাধ্যমে সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করেছেন এবং সমস্যা সমাধানের উত্তরও দেবার চেষ্টা করেছেন। ড. রকিকুল হাসান দীর্ঘদিন যাবত লেখালেখি ও গবেষণার সাথে যুক্ত থাকার কারণে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুড়ি অনেকটাই সমৃদ্ধ। আর সেই অভিজ্ঞতার ফসল এই ‘প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর বাহির’ নামক গ্রন্থখানি। প্রাবন্ধিক যে প্রবন্ধগুলো এখানে বিশ্লেষণ করেছেন সেখানে অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়ও আলোচিত হয়েছে। যা অনেক গবেষকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে দীর্ঘ কোন আলোচনা করতে গেলে লেখকের বা কম্পোজারের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় কিছু ত্রুটি রয়েই যায়। প্রাবন্ধিকের এই গ্রন্থের ক্ষেত্রেও সেটির ব্যতিক্রম নয়। হালকা কিছু শব্দবিন্যাস, বানান ও কোনক্ষেত্রে অতিকথনের ব্যবহারও আমরা লক্ষ করেছি তবে তাঁর নিখুত গবেষণা ও প্রকাশভঙ্গির কারণে সেগুলো ছাপিয়ে প্রবন্ধগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমার বিশ্বাস, আলোচ্য প্রবন্ধগ্রন্থ পাঠে সাহিত্যপ্রেমী, পাঠক ও গবেষকরা অনেক উপকৃত হবেন এবং এটি একটি সমৃদ্ধ গবেষণাসহায়ক গ্রন্থ হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। আমি এই গ্রন্থের ব্যাপক প্রকাশ ও প্রসার কামনা করছি।