
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী’র আলোচনা : উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী- লড়াই সংগ্রামের চুয়ান্ন বছর
উন্মেষকাল
দুনিয়া কাঁপানো (১৯১৭ সাল) অক্টোবর বিপ্লবের পর বিশ্ববাসী নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে শোষণ মুক্তির। বুঝতে শুরু করে পুঁজির শৃঙ্খলই শেষ কথা নয়। শামিল হতে থাকে জাগরণের মিছিলে- প্রগতির মিছিলে। সে মিছিলে যোগ দেয় ভারতবর্ষের মানুষেরাও। এক নতুন আলোকে বিশ্বটাকে এরা দেখতে পায় নতুন করে। বিশ্ববীক্ষণের নতুন আবেগে গড়ে ওঠে নতুন শিল্প-সাহিত্য-কবিতা-গান-নৃত্য-নাটক-চলচ্চিত্র-চিত্রকলা-ভাস্কর্য। এই নবধারার শিল্পকলা বিকশিত হয় কোথাও প্রগতিশীল রাজনীতির অগ্রগামী, কোথাও সহগামী, আবার কোথাও অনুগামী হয়ে।
এরই ধারাবাহিকতায় চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষে একে একে গড়ে ওঠে Youth’s Cultral Institute, সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি, প্রগতি লেখক সংঘ, ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রভৃতি। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ-এর ঢাকা শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৯ সালে। এর নিয়মিত সদস্য ছিলেন সতীশ পাকড়াশী, সোমেন চন্দ, রণেশ দাশগুপ্ত, কিরণশংকর সেনগুপ্ত, সত্যেন সেন, মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম। এদের মধ্যে দু‘জন সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্ত উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা এবং দুজন মুনীর চৌধুরী (শহীদ) ও সরদার ফজলুল করিম উদীচীর অন্যতম উপদেষ্টা। এঁদের সবারই যোগ ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে।
সত্যেন সেন উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। রণেশ দাশগুপ্তের ভাষায়- গণকথাশিল্পী সত্যেন সেন ‘উপমহাদেশের জাতীয় মুক্তি ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও লক্ষ্য নিয়ে অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থানে যাঁরা নিরন্তর (বিশ শতকের প্রায় গোড়া থেকে আশির দশক পর্যন্ত) একটার পর একটা দায়িত্ব পালনে ব্রতী ও উদ্যোগী থেকেছেন’ সেই কর্মীদেরই একজন। রণেশ দাশগুপ্ত যদিও নিজের কথা বলেন নি, কিন্তু এও আমরা ভালো করেই জানি- তিনিও তা-ই ছিলেন। এই চেতনাই ছিল সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্তের জীবন ও শিল্পবোধের মূল প্রেরণা।
এই প্রেরণাই সত্যেন সেন ১৯৪০ সনে নারী আত্মরক্ষা সমিতির জন্য গান লেখেন- ‘ওঠো ভারতের নারী’, ১৯৪২ সালের নভেম্বরে লেখেন ‘লীগ কংগ্রেস এক হও’, ১৯৪৩ এ দুর্ভিক্ষের ওপর বেশ কিছু জনপ্রিয় গান লেখেন, যার একটি ‘চাউলের মূল্য চৌদ্দ টাকা, কেরোসিন তেল নাইরে, কী করি উপায়’। ১৯৪৩ সনে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ এবং ১৯৪৪ সনে গণনাট্য সংঘের স্বতন্ত্র বাংলা শাখা গঠিত হয়। একই উদ্দেশ্যে সত্যেন সেন-রণেশ দাশগুপ্ত গঠন করেন উদীচী- কিন্তু সে আরও পরের কথা। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর পূর্ববঙ্গের প্রগতিশীলদের উপর নেমে আসে নির্যাতনের স্টিম রোলার।
এরও আগে ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষক ও ছাত্রের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল প্রগতিশীল ধারার সংগঠন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’; তাদের বার্ষিক মুখপত্র ছিল ‘শিখা’। তাদের চেতনায় ছিল উনিশ শতকের বাংলা ও ইউরোপের নবজাগরণ। এই বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ। এরাঁ ‘শিখাগোষ্ঠী’ নামেও ইতিহাসে পরিচিত।
সত্যেন সেন ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর ১৯৪৯ পর্যন্ত আত্মগোপনে, ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত কারান্তরালে থাকতে বাধ্য হন। সহ্য করেন অমানবিক নির্যাতন। এমনি একজন সর্বস্বত্যাগী নেতা ছিলেন সত্যেন সেন। তিনি কাজ করতেন কৃষকদের মধ্যে। কাজ করতে গিয়ে দেখলেন বক্তৃতার চেয়ে কৃষকদেরকে গান দিয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করা যায়। তিনি চল্লিশ পঞ্চাশের দশকে অজস্র গণসংগীত লিখেছেন, সুর করেছেন, গেয়েছেন। নিজে ছিলেন শিল্পী।
জন্মকথন
১৯৫৬’র ঢাকা জেলা কৃষক সম্মেলন থেকে সত্যেন সেন এমন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরির তাগিদ হৃদয়ে লালন করেন- যে সংগঠন গান, নাটকের মধ্যে দিয়ে সমাজ ও সংস্কৃতি বদলের আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। ১৯৫৮ সালে একটি গানের দল তৈরি করলেন। এই দল তৈরি করার পরপরই সত্যেন সেন কারারুদ্ধ হন এবং বেশিরভাগ সময়ই তাঁকে জেলে কাটাতে হয়। কিন্তু তাঁর তৈরি এ দলটির কর্মকাণ্ড চলতে থাকে। এই গানের দলের হাল ধরেন গোলাম মোহাম্মদ ইদু ও সাইদুর রহমান। সাথে ছিলেন আবদুল করিম, আবদুল খালেক প্রমুখ। এর সাথে যুক্ত হন জাহিদুর রহিম, শুভ রহমান, মোজাম্মেল হোসেন মন্টু, আবেদ খান, নিয়ামত হোসেন, ইউসুফ পাশা, ইয়াহিয়া বখত প্রমুখ। এঁরা সবাই ছিলেন লেখক, সাহিত্যিক কবি ও গল্পকার। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত এই নামহীন দলটি বিভিন্ন কৃষক সমাবেশে ও শ্রমিক জমায়েতে গান গেয়েছে। ১৯৬৫-৬৭-তে এর সাথে যুক্ত হন বদরুল আহসান খান, মোস্তফা ওয়াহিদ খান, রাজিয়া বেগম, আখতার হুসেন, পারভেজ শামসুদ্দিন, মজনু মনির প্রমুখ। এ দলের গানগুলোর বেশিরভাগই ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের দেশ পর্যায়ের গান, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের তৎকালীন প্রচলিত কিছু বাংলা ও হিন্দী গণসংগীত এবং সত্যেন সেনের নিজের লেখা ও সুর করা গান।
প্রথমে নারিন্দায় সাইদুর রহমানের বাসায় মহড়া শুরু হয় স্থানীয় ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে পরে মুক্তধারা, আবেদ খানের বাসা, হাশেম খানের বাসা- সর্বত্রই প্রায় একই অভিজ্ঞতার পর শান্তিনগরে পীর হাবিবুর রহমান, মোর্শেদ আলী ও মোনায়েম সরকারের মেস যা ন্যাপের মেস নামে পরিচিত ছিল- সেখানে দলটি উঠে আসে। এই বাসাটি ছিল রহিমা চৌধুরানীর বাসা। এ সময় একদিন সত্যেন সেন দলটির নামকরণের প্রস্তাব দেন এবং নিজেই নাম রাখেন ‘উদীচী’।
পাকিস্তানি শাসন শোষণের বিরুদ্ধে যখন ফুঁসে উঠছিল বাংলার আপামর মানুষ, প্রতিভাত হচ্ছিল কালজয়ী গণঅভ্যুত্থানের আভাস; এমনি সময়ে, ১৯৬৮ সালের ২৯শে অক্টোবর, বাংলার গণসংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ ও বিশিষ্ট সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক সত্যেন সেনের নেতৃত্বে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সত্যেন সেনের মত নিবেদিতপ্রাণ, আদর্শবাদী, সৎ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির নেতৃত্বের জন্যে উদীচী দ্রুত বিকশিত হতে থাকে। গণনাট্য আন্দোলনের সময় যেমন ব্যাপক সংখ্যক বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সাহিত্যিক তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, বাংলাদেশে উদীচীর ক্ষেত্রেও সেটাই সম্ভব হয়েছে। সংগঠনের গঠনতন্ত্র প্রস্তুত করেন সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতা জগতের আরেক দিকপাল রণেশ দাশগুপ্ত। উদীচীর আদর্শের সাথে মিল রেখে কাস্তে-হাতুড়ি-একতারা সংবলিত একটি মনোগ্রামের নকশা আঁকেন শিল্পী আমিন আহমেদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর উদীচীরও একটি পতাকার আকাক্ষা তৈরি হয়। শিল্পী আনোয়ার হোসেন আঁকলেন সেই পতাকা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত লাল সূর্য, স্বাধীনতার প্রতীক, সূর্যের নীচে রক্তিম সাগর। এ যেন রক্তসমুদ্র পার হয়ে উদিত স্বাধীনতার সূর্য। আর সূর্যের পেছনে মানুষের চির আকাক্ষিত শান্তির শুভ্রতা। প্রথম থেকেই এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকেন বা সহায়তা করেন আবুল ফজল, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সার, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শেখ লুৎফর রহমান, আনিসুজ্জামান, সনজীদা খাতুন, সুখেন্দু চক্রবর্তী, জহীর রায়হান, আবু জাফর শামসুদ্দিন, সুফিয়া কামাল, আলতাফ মাহমুদ, জাহিদুর রহিম, আবদুল লতিফ, অজিত রায়, জিতেন ঘোষ, জ্ঞান চক্রবর্তী, অনিমা সিংহ, লায়লা হাসান,পান্না কায়সার গোলাম মোহাম্মদ ইদু প্রমুখ।
একথা আজ সত্য যে, ‘বাংলাদেশে নব সংস্কৃতি বিশেষত গণসংগীতের ক্ষেত্রে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক ঘটনা’। সত্যেন সেন ছিলেন উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। উদীচীর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হওয়ার পূর্বে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়; আহ্বায়ক ছিলেন কামরুল আহসান খান। সদস্যবৃন্দ ছিলেন সত্যেন সেন, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, মোস্তফা ওয়াহিদ খান, ইকরাম আহমেদ, আখতার হুসেন, বদরুল আহসান খান, রাজিয়া বেগম, মঞ্জুর মোরশেদ প্রমুখ।
প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটি
সভাপতি : সত্যেন সেন
সহ-সভাপতি : গোলাম মোহাম্মদ ইদু
সাধারণ সম্পাদক: মোস্তফা ওয়াহিদ খান
সহ-সাধারণ সম্পাদক : ইকরাম আহমেদ। অন্যান্যরা ছিলেন রাজিয়া বেগম, ইকবাল আহমেদ, আখতার হুসেন, মাহফুজ আলী মল্লিক, তাজিম সুলতানা প্রমুখ ।
উদীচী’র স্বকীয়তা
উদীচী শুধুই একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়। উদীচী একটি আন্দোলনের নাম। উদীচী কেবল সংস্কৃতিচর্চা করে না, গণমানুষের সংস্কৃতি চর্চার পথও নির্দেশ করে। সত্যেন সেন খুব সচেতনভাবেই উদীচী নামটি নির্বাচন করেছিলেন। ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, উদীচী অর্থ উত্তর দিক বা ধ্রুবতারার দিক। দিকহারা নাবিকেরা যেমন উত্তর দিকে ধ্রুবতারার অবস্থান দেখে তাদের নিজ নিজ গন্তব্য স্থির করেন- তেমনি এদেশের সংস্কৃতি তথা গণমানুষের সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সবকিছুই উদীচীকে দেখে চলার পথ চিনতে পারবে। এ জন্যেই উদীচী অপরাপর সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে আলাদা। উদীচীর সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে রণেশ দাশগুপ্ত বলেছেন, উদীচী নামকরণের মূলে রয়েছে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য। উদীচী পৃথিবীগ্রহের সেই দিক, যেখানে ধ্রুবতারা জেগে থাকে। মাতৃভূমির সর্বাঙ্গীণ মুক্তিকে ধ্রুবতারা করে শিল্পীগোষ্ঠীর নাম হয় উদীচী। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর একটি কবিতায় যে ‘উদীচী ঊষা’ নামক যুগল শব্দ ব্যবহার করেছেন, সেটিকেও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী তাদের নামের অর্থ হিসেবে ধ্রুবতারার মতোই অন্তরে রেখেছে। নতুন পৃথিবী গড়ার জন্য বিশ্ব-মানবের প্রগতির পথের মশাল হলো উদীচী।
উদীচী দেশ ও জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষাসমূহকে উপলব্ধি করবে, মানুষের দুঃখ-কষ্টের কারণসমূহকে উদঘাটন করে এ সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন করবে এবং এই দুঃখ-কষ্টের কারণসমূহ মোকাবেলা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা যোগাবে। এভাবে দেশ ও জনগণের ইতিহাসের ক্রান্তিকালসমূহ অবলোকন (Monitor) করবে- তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে পরিণতির দিকে এবং প্রতিনিয়ত নতুনতর সংগ্রামের জন্য তৈরি করবে পথধারা। এসবই করবে উদীচী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। উদীচীর কর্মীরা শুধু নিজেরাই সচেতন হওয়া নয়, জনগণকেও সচেতন করাকে কর্তব্য মনে করে। মানুষের প্রতি এই দায়বদ্ধতার জন্যই উদীচী আর সবার থেকে আলাদা।
সংস্কৃতিতে গণজীবনের প্রতিফলন শুধু ঘটে না, গণমানসের অভীপ্সা-এষণা, আশা-আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্ন কল্পনার প্রতিফলনও ঘটে তাতে। অর্থাৎ যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা সংস্কৃতিচর্চা নয়; যা হওয়া উচিত, সেই আলোকে সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমকে হতে হবে ইঙ্গিতবহ আর পথিকৃৎ। বুর্জোয়া ধনবাদী সমাজের সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে শোষণহীন তথা সমাজতান্ত্রিক অভিমুখিন সংস্কৃতিচর্চার রয়েছে বিরাট ব্যবধান। এ সংস্কৃতি শুধু গণমুখী নয়, জীবনমুখীও। অর্থাৎ সর্বস্তরের জীবনের সঙ্গেই এর সম্পর্ক; এর মাধ্যমে সব মানুষের জীবনের অভিব্যক্তি তথা আশা-আকাক্ষা আর স্বপ্ন-কল্পনা রূপলাভ করে। এ কারণে মানুষের জীবিকার সঙ্গে, তার প্রতিদিনের জীবন-সংগ্রামের সঙ্গে রয়েছে এর সম্পর্ক। এসবকে বাদ দিয়ে সংস্কৃতি চর্চা কেবলই বিলাস। এমনধারা বিলাসের স্থান নেই উদীচীর সংস্কৃতিচর্চায়। তাই উদীচীর সকল শিল্পী-কর্মীর সংস্কৃতি চর্চার পরিধিকে সেভাবে সম্প্রসারিত এবং রূপায়িত করার কাজে ব্রতী হতে হবে।
উদীচী মনে করে, সমাজ সংস্কৃতির প্রকৃত নির্মাতা জনগণ। অথচ তারাই সমাজ সংস্কৃতির সকল প্রকার সুফল থেকে বঞ্চিত থাকে। এই বঞ্চিত মানুষের হাতে তাদের শ্রমের সার্বিক ফসল তুলে দেয়ার পরিবেশ রচনা করতে হলে বর্তমান শোষণমূলক সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন দরকার। এই ইতিবাচক পরিবর্তন গণমানুষের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া সম্ভব নয়। গণমানুষকে আপন অধিকার সম্পর্কে সচেতন এবং তা আদায়ে সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার প্রেরণা দেয় উদীচী। এ আলোকেই জন্মলগ্ন থেকেই উদীচী গণসংগীত, নাটকসহ নানা মাধ্যমে গণমানুষকে দুঃখ-দুর্দশা ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে আসছে। উদীচীর সকল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বারবার ধ্বনিত হয়েছে কৃষক শ্রমিকের ন্যায্য দাবির কথা। শুধু তাই নয় দেশ এবং দেশের মানুষ যখনই সংকটময় অবস্থার মধ্যে পড়েছে, তখনই উদীচীর কার্যক্রম মানুষকে পথ চলতে প্রেরণা যুগিয়েছে, সাহস যুগিয়েছে। স্বাধীনতার পরও দেশীয় দখলদার-মজুতদার-মুনাফাখোর, কালোবাজারীরা যখন বিনষ্ট করতে চেয়েছে দেশের সম্মান, আপন স্বার্থে বিকিয়ে দিতে চেয়েছে দেশের সম্পদ, তখনও তার বিরুদ্ধে গণমানুষের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন উদীচীর শিল্পীরা গেয়ে উঠেছে গণসংগীত। উজ্জীবিত হয়েছে সাধারণ মানুষ। পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে স্বার্থান্বেষী মহল।
মুক্তিযুদ্ধ ও উদীচী
আমাদের জনপদে ষাটের দশকের প্রথম দিক থেকে সামরিক শাসন বিরোধী বিক্ষোভ ক্রমে ক্রমইে স্বাধীকার আন্দোলনে রূপ নিতে থকে। পুলিশের পথরোধ, কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ার কুণ্ডলী, ব্যারিকেড ছিল নৈমিত্তিক দৃশ্য। জন্ম নেয় উত্তাল সময়ের। কালজয়ী এক গণ-অভ্যুত্থান উঁকি মারতে থাকে। ঢাকাসহ সারা দেশ উত্তাল হয় মিছিল-মিটিং, শ্লোগান, গণসংগীতে। সেই সময়ে মানুষকে জাগানোর জন্য এবং বৈপ্লবিক আদর্শে অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে কৃষক-শ্রমিকদের সভায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্রাকের উপর চেপে উদীচীর শিল্পীকর্মীরা পরিবেশন করতো গণসংগীত, প্রদর্শন করতো পথনাটক। বাংলার নিপীড়িত মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। এই যুদ্ধের পটভূমি রচনায় রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক-সংবাদিকরাও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন। উদীচীর শিল্পীকর্মীরা একদিকে যেমন নিপীড়িত ছাত্র-জনতা আর শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রামে মেলবন্ধন তৈরি করেছে, প্রেরণা যুগিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে যথাসময়ে রাইফেল হাতে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছে।
১৯৬৯ এর ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদ স্বৈরাশাসক আইয়ুব শাহীর পুলিশের গুলিতে নিহত হলে দেশবাসীকে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে ঢাকা নগর ও শ্রমিক অঞ্চলে উদীচী ‘শপথ নিলাম’ নামে একটি পথনাটক নিয়ে পথে নামে। রাস্তায় তখনো পুলিশের লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস। কিন্তু উদীচীর তরুণ কর্মীরা সকল রকমের নির্যাতন ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে এই পথনাটক নিয়ে উল্কার বেগে ছুটে বেড়ায় এবং গণঅভ্যূত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। নাটকের নায়কের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে ফেটে পড়েছে উপস্থিত হাজারো জনতা। এইভাবে ঊনসত্তুরের গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনায় নাটক ও গণসংগীতের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে প্রেরণা সঞ্চার করেছে, সাহস যুগিয়েছে উদীচী।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরেই রাজনৈতিক ঘটনা পরম্পরায় শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। উদীচীর কর্মীরাও এই প্রস্তুতিতে অংশগ্রহণ করে। কখনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে, কখনো পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এই সময়ে গানের পাশাপাশি উদীচীর নাটক বিভাগও রাস্তায় নেমে আসে নতুন পথনাটক নিয়ে। নাটকের নাম ‘সামনে লড়াই’। নাটকটি ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়সহ আদমজী, কাঞ্চন, ডেমরা, শ্যামপুর, নারায়ণগঞ্জ, রায়পুরা ও নরসিংদির বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক-কৃষকদের মাঝে মঞ্চস্থ হয়। শ্রমিক ও কৃষক এলাকাগুলোতে যখনই এই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে, তখনই সেই এলাকাবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে অভূতপূর্ব সাহায্য-সহযোগিতা।
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে জনগণের হাতে হাত রেখে উদীচীর শিল্পীকর্মীরাও লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। সে লড়াইয়ে যেমন সংগ্রামী চেতনার উপস্থিতি ছিল, ঠিক তেমনি নান্দনিকতাও স্থান পেয়েছে সমভাবে। ২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে উদীচীর ট্রাকস্কোয়াড বের হয়। যার ব্যাকগ্রাউণ্ডে আঁকা থাকে সূর্যের মাঝখানে শৃঙ্খলিত হাত। সূর্যটি যেন কাঁটা তারের বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসছে। পাশে শহীদ মিনার। শ্লোগান লেখা- ‘একুশের শোককে শক্তিতে পরিণত করুন’। এসবের মধ্যদিয়ে শৃঙ্খলমুক্তির লড়াইয়ে উদীচী তার উপস্থিতি একে একে জানান দিতে থাকে। ক্রমান্বয়ে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ঘনীভূত হতে থাকে। উদীচীর শিল্পীকর্মীরাও মাঠে নেমে আসে। ৫ মার্চ ১৯৭১ বাংলার জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সমর্থনে উদীচী এক মিছিল বের করে। মিছিলটি নগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। উদীচীর সভাপতি সত্যেন সেন সভাসমূহে বক্তৃতাকালে দেশের বর্তমান দুর্যোগ মুহূর্তে সকল প্রগতিশীল শিল্পী ও সাহিত্যিকদের গণআন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানান। ১৯৭১ এর ১০ মার্চ উদীচীর সাধারণ সম্পাদক প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলা হয়, সৈনিকসুলভ দৃঢ়তা ও নিষ্ঠা লইয়া বাংলার এই স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আমরা শরিক থাকিব। (দৈনিক সংবাদ, ১১ মার্চ ১৯৭১)। এভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্মুখযুদ্ধ আরম্ভের পূর্ব পর্যন্ত রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি বাঙালির সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে ‘উদীচী’র পথ চলা আরো উজ্জীবিত করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধে নামে উদীচীর শিল্পীকর্মীরা। গেরিলা বাহিনীর প্রথম ব্যাচেই অংশগ্রহণ করেন উদীচীর প্রথম আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক কামরুল আহসান খান। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন উদীচীর অসংখ্য নেতা-কর্মী।
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর। মুক্ত স্বদেশ। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ গৌরবজনক স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের সংগ্রাম। মুক্ত স্বদেশে উদীচীর শিল্পী সৈনিকেরাও অস্ত্র জমা দিয়ে আবার হাতে তুলে নেয় ঢোল, করতাল, হারমোনিয়াম, তবলা, নাটকের পাণ্ডুলিপি। এবার দেশ গড়ার সংগ্রাম। সে সংগ্রামে আর সবার মত শরীক হয় উদীচীর শিল্পীকর্মীরাও।
’৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর সাহসী ভূমিকা
পচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করার পর সমগ্র জাতি স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। এর কিছুদিনের মধ্যেই তেশরা নভেম্বর হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। একের পর এক জাতি প্রত্যক্ষ করতে থাকে হত্যা ক্যু-এর ঘটনা। সারাদেশে বিরাজ করতে থাকে স্থবিরতা। রাজনৈতিক সামাজিক সকল কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ অতিবাহিত করতে থাকে ভীত-সন্ত্রস্ত জীবন। এর মধ্যেই উদীচীর শিল্পীকর্মীরা সংগঠিত হয়। ‘৭৫ এর আগস্ট থেকে ‘৭৫ এর ডিসেম্বর। মাত্র ৫ মাস। সারাদেশ তখনও স্তব্ধ, মুক। কেউ কোনো কথা বলে না। উদীচীর শিল্পীরা শিল্পকলা একাডেমির অনুষ্ঠানে গান ধরেছে সমবেত কণ্ঠে, ‘এদেশ বিপন্ন বিপন্ন আজ।’ সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা থেকে শিল্পী অজিত রায়ের সুর করা গান। পরের গান সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে, ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা।’ পরের গান মুকুন্দ দাশের ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে’। এরপর ১৯৭৬ এর একুশের অনুষ্ঠান। সেন্টু রায়ের পরিকল্পনায় ৬ ফুট উচ্চতায় খালি মাইক্রোফোন, ডায়াসে পাইপ আর চশমা রেখে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ। এর পরপরই মাহমুদ সেলিমের নেতৃত্বে রচিত হয় গীতিআলেখ্য ‘ইতিহাস কথা কও’। লোকজ ফর্মে ও সুরে এই গীতি-আলেখ্যের ভিতর দিয়ে সেই বিরূপ সময়ে প্রচণ্ড সাহসের সাথে বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুর অবদান, তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ তুলে ধরা হয়। এটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৭৬ এর ১৬ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের ইস্পাহানী কলেজের মাঠে। এরপরে ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে রমনা বটমূলে ‘ইতিহাস কথা কও’ এর নির্ধারিত মঞ্চায়ন যখন নিষিদ্ধ হয়, তখন সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সামনের রাস্তায় ১৫/২০ হাজার দর্শকের সামনে মঞ্চায়িত হয়। ১৯৭৮ সালে এই গীতিআলেখ্যটি ক্যাসেট আকারে বের হয়। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ‘ইতিহাস কথা কও’। সারাদেশের আনাচে কানাচে উদীচীর সাড়ে তিনশতাধিক শাখার মাধ্যমে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করার জন্য ‘ইতিহাস কথা কও’ কয়েক সহস্রবার মঞ্চায়িত হয়েছে।
চুয়ান্ন বছরের পথচলায় এদেশের জনমানুষের পক্ষে বারবার উদীচী নেমে এসেছে পথে, রেখেছে সময়োপযোগী ভূমিকা। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
প্রমোদকর মওকুফ ও মুক্তমঞ্চের আন্দোলন
যুদ্ধাপরাধ বিরোধী আন্দোলন-গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় অংশগ্রহণ।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে জনসচেতনতা তৈরি।
স্বাধিনতার ইতিহাস প্রতিযোগিতা
পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণের প্রতিবাদ
ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে সমাবেশ।
লোক সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশ।
’৯০-এ স্বৈরাচার পতনে ভূমিকা।
প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো।
সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সোচ্চার ভূমিকা।
রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকা।
জনস্বার্থবিরোধী সকল চুক্তি বাতিল আন্দোলন।
এছাড়াও সমমনা জাতীয়ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গড়ে তোলা ও বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে উদীচী।
রক্তের আখরে লেখা উদীচীর নাম
প্রগতির পথে চলতে গেলে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর ও হামলার শিকার হতেই হয়। উদীচীও হয়েছে। ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সম্মেলনে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হন, আহত হন দুই শতাধিক। ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনা উদীচী কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলায় নিহত হন ৮ জন, আহত হয়েছিলেন প্রায় ৯২ জন; যাদের অনেকেই এখনো শরীরে স্প্রিন্টার বহন করে দুঃসহ জীবন-যাপন করছেন, অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন এই দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়েই।
স্বীকৃতি, বিস্তার
২০১৩ সালে এই উদীচী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘একুশে পদক’ লাভ করে। উদীচীর অধীনে সঙ্গীত, নাটক, নৃত্য, আবৃত্তি, চারুকলা ও সাহিত্য বিভাগ কাজ করছে। ৭১টি সাংগঠনিক জেলা সংসদ এবং জেলা সংসদের অধীনে ৩১৫টি শাখা রয়েছে। বর্তমানে উদীচীর সদস্য সংখ্যা প্রায় দশ হাজার। দেশের বাইরেও উদীচীর ৬টি শাখা রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স এবং অস্ট্রেলিয়ায়।
আলোকিত পথ নির্মাণে উদীচীর পথচলা হোক দৃঢ়তর
এখনো একটি শক্তি প্রচন্ডভাবে ক্রিয়াশীল, যারা ভৌগোলিকভাবে সম্ভব নয় বুঝেই, চেতনাগতভাবে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিতে চায় দেশটাকে। কিংবা সেটাও সম্ভব না হলে নিদেন পক্ষে ‘ব্যর্থ বাংলাদেশ’ বানাতে চায় এরা। এদের কিছু বিষয়ের সাথে ‘কৌশলগত’ পথ চলায় সামিল হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবীদার অনেকেই। বৈষম্যমূলক বৈশ্যের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তথা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন আপসমূলক পরিস্থিতির উদ্ভব হবেই।
তাই আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়ন করতে হলে, কিছু প্রশ্নের মীমাংসা জরুরি এবং সেগুলো যতোটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে যে চার মূলনীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে একটা লড়াই যে খুব প্রয়োজন, তা যারা মুক্তিযুদ্ধকে সত্যিকারের মুক্তির যুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং এখনও যারা এমনভাবেই মুক্তিযুদ্ধকে চেতনায় ধারণ করেন, তারা সকলেই স্বীকার করবেন। সেই লড়াইটা রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষা স্বাস্থ্য-সহ মানুষের মৌলিক ক্ষেত্রগুলোর জন্যও প্রয়োজন। রাষ্ট্রকে জনমুখী করতে হলে, এর পরিচালন ব্যবস্থাকে বৈষম্যমুক্ত ব্যবস্থায় পরিণত করতে চাইলে, সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হবে; আর এ সবকিছুর জন্য সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের একটা রূপরেখা তৈরি করে লড়াইটা শুরু করতে হবে এবং এখনই।
ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘বিপ্লব শুরু হয় সংস্কৃতি থেকে।’ আমাদের রয়েছে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। সেটিকে বিবেচনায় নিয়ে নতুন পরিস্থিতির আলোকে নতুনভাবে সাজাতে হবে রণকৌশল এবং এর আলোকেই চালাতে হবে লড়াই, যে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমুক্ত, এবং অবশ্যই জনগণের মালিকানায় একটি ব্যবস্থা, তা যেমন রাজনৈতিক, কিন্তু অনেক বেশি সাংস্কৃতিক। এই লড়াইয়ে সাংস্কৃতিক কর্মীদের অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে এবং উদীচীই পারে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে।