
পৌষ সংক্রান্তির ইচ্ছে ঘুড়ি
পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেইদিন
ফিরে আর আসবে কি কখনো?
— মান্না দে
প্রাণের উচ্ছ্বলতাকে হৃদয়ে ধারণ করে বেশ ক’জন উদ্যোগী কিশোর-কিশোরী ঘুড়ি, নাটাই নিয়ে বহুতল ভবনের ছাদে উঠেছে আজ। স্বপ্নডানায় ভর করে ঘুড়িতে সুতো বেঁধে আকাশপানে উড়িয়ে দিয়েছে ওদের ইচ্ছে ঘুড়িগুলো। ভরসা? ওই যে, সুতোর শেষ অংশ তো নাটাইয়েই বাঁধা! হাতের টান, ওড়ানোর দক্ষতা আর বাতাসের গতি ওদের ঘুড়িগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায়।
মনে পড়ল, এমন একটি সোনালী আলোমাখা শৈশব আমারও ছিল। যখন মেঘের ওপারে স্বপ্নস্মৃতিতে ভাসতাম না, আবেগের মোহময়তায় কাঁদতাম না, জীবনের মানেও খুঁজতাম না। না, আমি একদমই ঘুড়ি ওড়াতে জানি না। জানি না আরও অনেক কিছু। তবে ছোটবেলায় অঘ্রাণ-পৌষের বহমান লগ্নে আকাশ জুড়ে বর্ণীল ঘুড়ির মেলার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতাম ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। আবছা হয়ে আসা সেইসব স্মৃতিগুলো তার চাকচিক্য হারিয়ে বড্ড ফিকে হয়ে গেছে এতদিনে। অযত্নে লালিত স্মৃতি তবু্ও এককোনে নিজের দৃঢ়তাকে প্রকাশ করেছিল বলেই হয়তো এতকাল পর তা দৃষ্টির সীমানায় ঝিলিক দিয়ে উঠল!
বাবা আমাদের দুই ভাই-বোনকে কালেভদ্রে দুই-একদিন ছাদে নিয়ে যেতেন অন্যদের ঘুড়ি ওড়ানো দেখাতে। বুড়িগঙ্গা’র কোল ঘেঁষে দাঁড়ানো আমাদের বিল্ডিংটাকে তখন স্থানীয়রা ‘জাহাজ বিল্ডিং’ নামেই চিনতেন। আশেপাশে একটা তিনতলা বিল্ডিংও ছিল না। সব পুরনো আমলের একতলা আর দোতলা ভবন! আর এখন সেখানে (আট-দশতলা) বহুতল ভবনের ভীড়ে ‘জাহাজ বিল্ডিং’টাকে খুঁজে নিতেও বেগ পেতে হয়। যাই হোক, ছাদে উঠলে ঘুড়ি ওড়ানো দেখব কী! ভাবতাম, অন্যের ঘুড়ি ওড়ানো ব্যালকনি থেকেই দেখে নিব। দেখতাম, বুড়িগঙ্গা’র বুকে ভেসে বেড়ানো নৌকা, স্টিমার, লঞ্চ, বেঙ্গল ওয়াটার। পাশের স্কুলের মাঠের চলমান কিশোরদের উচ্ছ্বসিত বল খেলা। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিগুলোর চপল প্রতিযোগিতা। রেইনট্রি গাছের পাতাগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে বিস্ময়ে ফিরে তাকাতাম, গাছটার শাখা-প্রশাখায় সযতনে বাঁধা নীড়ে বসবাসরত পাখির ছানাদের কলকাকলীতে। বাবার সাথে ছাদে উঠলে ওইটুকু সময়েই যেন বিশাল পৃথিবীর ক্ষুদ্র অংশ আমার দু’চোখ বুজে, প্রান ভরে শ্বাস নিয়ে হৃদয়ের মনিকোঠায় সঞ্চয় করতাম। বাবার কড়া শাসনের তোপে আর বিধিনিষেধের গন্ডি এড়িয়ে আমরা দুই ভাই বোন প্রতিবেশীদের আনন্দ উল্লাসের সামিল হতে পারিনি কখনও। পারিবারিক কঠোর নিয়মকে সন্মান দিতে যেয়ে জুজু’র ভয়ে জগতের অনেক কিছুতেই আমরা সাবলীল হতে পারিনি। ভাবতে কষ্ট লাগে, উন্নত প্রযুক্তির পরিবর্তনের ধারায় অবস্থান করেও আমাদের শহুরে সন্তানেরা চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকেই বেড়ে উঠছে। প্রকৃতির উদারতার উষ্ণতার স্পর্শ ওরা পায় না। আত্নিকতার মনন বোধ ওদের অনুভূতির বিকাশে অনুরণন তোলে না।
শৈশবে সাকরাইন উৎসব ঘনিয়ে এলে শীতের হিমেল বাতাস গায়ে মেখে সূর্যটা যখন স্নিগ্ধ আলোয় ভুবন ভোলাতো তখন আকাশ জুড়ে রঙিন ঘুড়ির ওড়াওড়ি আমার দুচোখে আনন্দদীপ্তি ছড়িয়ে দিত। প্রতিবেশী দূরন্ত কাকা-মামাদের দেখতাম, সুতোয় রং করে, কাঁচের গুড়োতে জড়িয়ে, সুতোয় ধার এনে (মাঞ্জা দিয়ে) তা শুকিয়ে নাটাইয়ে পেঁচিয়ে ছাদে উঠে শূন্যে উড়িয়ে দিতো তাদের স্বপ্নঘুড়ি। নাটাই হাতে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করত সেই ঘুড়ির এগিয়ে চলা। প্রতিপক্ষের কাটাকাটিতে সুতো ছিঁড়ে গেলে ঘুড়িটা টলতে টলতে শূন্য থেকে নীচে পড়ে যেত। তখন চারদিক থেকে কলরব ভেসে আসত- ভোকাট্টা, ভোকাট্টা। তারপর কেউ অভিমানে খেলা সাঙ্গ করে নাটাই গুটিয়ে চলে যেতে, কেউ আবার নতুন ঘুড়িতে সুতো বেঁধে পূনরায় ঘুড়ি ওড়ানোর খেলায় মাততো। কেউ বা সুতাছিন্ন ঘুড়িটাকে পরম যত্নে তুলে নিয়ে আনাড়ি হাতে ওড়ানোর বৃথা চেষ্টায় আত্নমগ্ন হতো।
দিনব্যাপী ঘুড়ি ওড়ানো শেষে সাকরাইন সন্ধ্যায় পাড়ার উদ্যোগীগণ মশাল জ্বালিয়ে মুখে কেরোসিন নিয়ে ফুঁ দিয়ে সেই মশালের আগুনকে লেলিহান শিখায় পরিণত করে তা দিয়ে অবশিষ্ট ঘুড়ি, সুতো, নাটাই সব পুড়িয়ে ফেলত। যেন বা ঐ বছরের মতো ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবের সমাপ্তি টানা হলো। পরের দিন থেকে আকাশে ঘুড়ির তেমন আনাগোনা আর দেখা যেত না।
সেই সময়টায় পৌষ সংক্রান্তিতে আমাদের পরিবারে উৎসবমুখর আবহ বিরাজমান ছিল। গৃহের সব সজ্জা ধুয়ে মুছে ঝকঝকে, পরিপাটি করা হতো। উৎসবের অনুষঙ্গ হিসেবে বাবা তিলাই, কদমা, নিমকি, মুরলী, খেজুরের রসের গুড়, নারকেল, দই, চিড়ামুড়ি কিনতেন। পিসিমনির উদ্যোগে নতুন চালের গুড়ি দিয়ে পাটিসাপটা, ধুপি পিঠা, দুধপুলি, দুধচিতই, কলাপাতায় মোড়ানো কলার পিঠা, দৌল্লা পিঠা, চুসির পায়েস অথবা কাওন চালের পায়েস তৈরির আড়ম্বর দেখা যেত।
কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা,
তারি মধ্যে চিরজীবন বইবো গানের ডালা।……….
শান্তি কোথায় মোর তরে হায়, বিশ্বভুবন মাঝে-
অশান্তি যে আঘাত করে, তাই তো বীণা বাজে।
— রবি ঠাকুর
কালের আবর্তে সব কিছুরই পাট চুকেছে। কোন প্রান্তে এর ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। শূন্যতা বড্ড নিষ্ঠুর! সব কেড়ে নেয়। শুধু অলক্ষ্যে আমার স্তব্ধ শ্রবণেন্দ্রিয়তে ভেসে আসে একটি প্রতিধ্বনিত শব্দ- ভোকাট্টা.. ভোকাট্টা… ভোকাট্টা…..! চোখে ভেসে ওঠে- সুতো ছিঁড়ে টলতে টলতে পড়ে যাওয়া ঘুড়িটার আকুতি ভরা, আঁকড়ে থাকার অন্তিম ইচ্ছেটুকো..……! না, কোথাও কেউ নেই! তাই ঘুড়িটার আকাশে ওড়া হয় না। কেউ তুলে নিয়ে নতুন করে রঙিন সুতোয় বাঁধেনি যে! নাটাইয়ের সুতোর বাঁধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পড়তে কখনও দণ্ডায়মান বৃক্ষের শাখায় খোঁচা লেগে ছিঁড়ে গেছে তার নবনীত কাগুজে আভরণ। কখনও বা পথে জমে থাকা পানিতে পড়ে ভিজে গেছে তার স্নিগ্ধ অবয়ব। প্রয়োজন ফুরিয়েছে, নেই কোন আয়োজন, তাই সে মূল্যহীন…..!
পারবি না কি যোগ দিতে এই ছন্দে রে
খসে যাবার, ভেসে যাবার
ভাঙবারই আনন্দে রে।
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তবুও আশার আলোকশিখাকে প্রজ্জ্বলিত করে স্বপ্নঘুড়িগুলো শূন্যে উড়ুক। পৌষের আকাশ ভুলে যাক তার বেদনগাথা। শত সহস্র রঙের ইচ্ছে ঘুড়ির সফল পদচারণাতে মুখরিত হোক স্বপ্নীল আকাশ।