
পূর্বাপর সমালোচনা সাহিত্য
১
সম্প্রতি হরহামেশাই শোনা যায়, আমাদের দেশে সমালোচনা সাহিত্য-ধারা নাকি গড়ে ওঠেনি। তখন মনে পড়ে যায় কবি মোহিতলাল মজুমদারের (১৮৮৮-১৯৫২) কথা। সমালোচনা-সাহিত্যের ধারাটি বলা যায় তার হাতেই গোড়াপত্তন ঘটেছিল। আধুনিক বাংলা সাহিত্য (১৯৩৬) থেকে শুরু করে বঙ্কিমবরণ (১৯৪৯) পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ সমালোচনা-সাহিত্য সৃজন করেছিলেন তিনি। কিন্তু এই সাহিত্য সমালোচকের পরিণতি খুব একটা সুখকর হয়নি। জীবদ্দশায় তিনি হয়েছিলেন অযুত উপেক্ষার শিকার। দারুণ কিছু কাব্যকবিতা রচনা করলেও কেউ তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় এগিয়ে আসেনি। রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) চেয়ে বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪) এবং মধুসূদনকে (১৮২৪-১৮৭৬) মোহিতলাল গুরুত্ব দিয়েছিলেন বেশি। রবীন্দ্রকাব্য-সাহিত্যের বিষয়শৈলী বিশেষত ভাষাপ্রসঙ্গে মোহিতলাল দারুণ সমালোচনা করেছেন। এতেই ভীষণ রুষ্ট্র হয়েছিল রবীন্দ্রভক্তকুল। রবীন্দ্রভক্তরা নানাভাবে মোহিতলালকে বয়কটের চেষ্টা করেছিল। এমনকি নামিদামি পত্রপত্রিকার তার লেখা প্রচারপ্রকাশ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর মাস কয়েক আগে দুঃখ করে মোহিতলাল লিখেছিলেন- ‘এ কয় বৎসর আমার মুখ একেবারে উহারা বন্ধ করিয়া দিয়াছে, তাহা বোধহয় আপনারা লক্ষ্য করিয়াছেন। দেশের কোনো সুপ্রচারিত পত্রিকায় আমার একটি লেখাও প্রকাশিত হয় না, আমাকে উহারা বয়কট করিয়াছে।’ অথচ মোহিতলাল ছিলেন দারুণ নিষ্ঠাবান সাহিত্য সমালোচক। মোহিতলালের সমালোচনা-দৃষ্টি প্রসঙ্গে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দকে (১৯৪৩-২০১০) লিখতে দেখি- ‘মোহিতলালই হচ্ছেন প্রথম দ্রষ্টা ও দর্শয়িতা, যিনি বুঝেছিলেন রবীন্দ্রকাব্যের অন্ধ অনুবর্তনে-অনুসরণে বাংলা কবিতার মুক্তি হবে না।’ সজনীকান্ত দাস অথবা সুরেশ সমাপতির অবস্থাও আমাদের অজানা নয়।
২
বাংলাদেশ আমলে আহমদ শরীফ (১৯২১-১৯৯৯) রবীন্দ্রসাহিত্য প্রসঙ্গে ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মের রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। আহমদ শরীফের প্রতিও বিপুল বিদ্বেষতীর এসেছিল। কিন্তু আহমদ শরীফের প্রবন্ধের যুক্তি খণ্ডন করতে এগিয়ে আসেনি কেউ। কেননা, ভক্তদের সেই ক্ষমতাটি ছিল না, সেই ক্ষমতা থাকে না। সমসাময়িক সময়ে আহমদ ছফা (১৯৪৩-২০০১) ছিলেন দুর্দান্ত সমালোচক। ধরেধরে সাহিত্যগ্রন্থ সমালোচনা না করলেও সাহিত্য সমাজের নানারকম অসাধুতা-অসততার কথা বেশ বলিষ্ঠকণ্ঠেই উচ্চারণ করেছিলেন। একজন লেখক হিসেবে সাহিত্য সমাজের অন্দরের কথা ভালোই জানতেন তিনি। দেশ ও সমাজের স্বার্থেই সেসব কথা পাঠক-সম্মুখে ফাঁস করে দিয়েছিলেন। অনেকটা হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গার মতো করে। বিবেকের তাড়নায় বাধ্য হয়েই কাজটি করতে হয়েছিল তাকে। এজন্য তাকে কম যন্ত্রণা সইতে হয়নি। এ-প্রসঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২) প্রবন্ধগ্রন্থটি স্মরণযোগ্য। পঁচিশ বছর পর ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা’ লিখতে গিয়ে আহমদ ছফাকে লিখতে দেখি- ‘এই লেখাটির জন্যই আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর রোষ আমাকে পেছন থেকে অভিশাপের মত তাড়া করছে। অদ্যাবধি আমি জীবনে স্বস্তি কি বস্তু তার সন্ধান পাইনি।’ বাস্তবিকই আহমদ ছফা সত্যিই স্বস্তিতে ছিলেন না। মরণোত্তরকালে তাঁর সাহিত্যকর্ম বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেলেও জীবদ্দশায় আহমদ ছফা ছিলেন উপেক্ষিত। বেঁচে থাকতে তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় এগিয়ে আসেনি কেউ। অথচ তিনি লিখে গেছেন বিপুল সাহিত্যকর্ম।
৩
সমালোচনা প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদের (১৯৪৭-২০০৪) নামটি নিঃসন্দেহে স্মরণযোগ্য। সৃজনশীল সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি প্রবন্ধসাহিত্যে তিনি দারুণভাবে জ্বলে উঠেছিলেন। এই সমালোচনার কারণে তার নিন্দুকের অভাব ছিল না। অনেকেই তাকে অপছন্দ করতে চাইতেন। অথচ তার প্রবন্ধনিবন্ধ অথবা সমালোচনা সাহিত্য দারুণভাবে সুখপাঠ্য। মাঝেমধ্যে ভাবি, মোহিতলাল থেকে আহমদ শরীফ, আহমদ ছফা অথবা হুমায়ুন আজাদের ন্যায় সাহিত্য ও সমাজ সমালোচক কি আর পাব? বর্তমানে সলিমুল্লাহ খানকে আমরা কতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছি? সমালোচনা সাহিত্যকে বিশেষ শিল্পস্তরে উন্নিত করেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪)। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথসহ সমসাময়িক কবিদের কাব্যকর্ম সম্পর্কে পাঠককে জানার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে কবি শঙ্ঘঘোষ (১৯৩২-২০২১) এ-ধারায় স্মরণযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। সাতচল্লিশ উত্তর কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ ও কবি মজিদ মাহমুদ গদ্যসাহিত্যে তাৎপর্যপূর্ণ কাজ করেছেন। কমবেশি প্রায় সব কবিই দু-একটি গদ্যগ্রন্থ রচনা করলেও সমালোচনা সাহিত্যে সবাই সমভাবে এগিয়ে আসেনি। আসতে পারেননি। আসলেও অন্যপথে, অন্যভাবে। নানা বলয়-বিভাজন ও সিন্ডিকেটের আলপথ ধরে ধরে। ক্ষুব্ধকণ্ঠে আহমদ ছফা লিখেছিলেন- ‘আমরা শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকেরা সকলেই তোষামোদের জগতের বাসিন্দা। আমরা যা পড়ি, তোষামোদ, যা লিখি তাই তোষামোদ, ওতে শক্ত কিছু ঘন কিছু গভীর কিছু নেই।’ এই প্রকৃতির তোষামোদে সমালোচনা একেবারে নতুন নয়। আগেও নিশ্চয়ই ছিল। অন্তত গদ্যকার প্রমথ চৌধুরীর (১৮৬৮-১৯৪৬) বক্তব্য তো তা-ই বলে। পেশাদার লেখকের সমালোচনা সাহিত্য প্রসঙ্গে একদা তিনি লিখেছিলেন- ‘আমার মাল তুমি যাচাই করে পয়লা নম্বরের বলে দাও, তোমার মাল আমি যাচাই করে পয়লা নম্বরের বলে দেব’- এই প্রকৃতির সমালোচনা সাহিত্য কম নয়। বরং এই ধারাই অব্যাহতভাবে বেড়ে চলছে। খোলামেলা ডকুমেন্টারি স্বজনপ্রীতি।
৪
বলে রাখা ভালো, আমি লেখালেখি জগতের বিশেষ কেউ নই। তবে টুকটাক গদ্যসাহিত্য (প্রবন্ধনিবন্ধ) পড়তে পছন্দ করি। মাঝেমধ্যে গ্রন্থবিতান থেকে দুচারটা গ্রন্থ খরিদ করি। অবসরমত একটু-আধটু পড়তেও চেষ্টা করি। কিছু কিছু মন্তব্য অথবা মত-অভিমত দেখে কেমন যেন খটকা লেগে যায়। কবি শামসুর রাহমানের (১৯২৯-২০০৬) ন্যায় প্রধান কবিকেও লিখতে দেখি- ‘ভালোবাসি রক্তচোষা অন্ধ বাদুড়কে/ কেননা সে সমালোচকের চেয়ে ঢের বেশি অনুকম্পাময়।’ প্রশ্ন জাগে- লেখক কেন অনুকম্পা চাইতে যাবেন? আর সেটি না দিলেই কি সমালোচক ‘রক্তচোষা অন্ধ বাদুড়’ থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে যাবে? শামসুর রাহমানের কোনো কোনো কবিতায় ‘বাছুর কবি’ অথবা ‘বেয়াড়া পাঠক’ এমন শব্দেরও প্রয়োগ দেখা যায়। ‘প্রৌঢ় অধ্যাপকের মতে’ কবিতাটিতে কবিকে লিখতে দেখি- ‘বাছুরের মতো সব নাবালক কবিরা এখন / ঢুঁ মেরে বেড়ায় যত্রতত্র আর কচি তীক্ষ্ণ খুরে / লন্ডভন্ড করে দেখি কাব্যের প্রশান্ত বাগান।’ এই ‘বাছুর কবি’ শব্দবন্ধের মধ্যে নবীন-প্রবীণের মধ্যকার বিরুপ সম্পর্কটা নির্দেশ করে। সেই সঙ্গে নবীন কবিদের প্রতি তাচ্ছিল্যও বোঝায়। শামসুর রাহমানের লেখায় তবু খানিকটা কবিপ্রতিভার পরিচয় আছে। কিন্তু কবি অসীম সাহার লেখায় সেটি কই? প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারা (১৯৭৬) গদ্যগ্রন্থে তাকে লিখতে দেখি- ‘যে সকল সুযোগ সন্ধানী, আত্মবিক্রিত, মধ্যপন্থী সুবিধাবাদী সমালোচকেরা নিরপেক্ষতার নামে মূলত সাহিত্য ও শিল্পের দ্যোতনাকে স্তব্ধ করে দিতে তৎপর, তাঁদের বিরুদ্ধে তীব্র আঘাত হানা অত্যন্ত জরুরী।’ এই জরুরী কাজে অনেকেই পিছিয়ে নেই। কবি অসীম সাহা সমালোচকের জন্য দয়াপরবশ হয়ে যেসব বিশেষণ বরাদ্দ করেছেন সেগুলো কি অনেক মৌলিক লেখকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়? কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’ পড়তে গিয়ে একজায়গায় চোখ স্থির হয়ে গেল। ‘কোন ছিঁচকে পাঠক, কোন মূর্খ প্রকাশক, কোনও সস্তা জনপ্রিয়তা যেন কবিকে কখনও স্পর্শ না করে।’ কবি পুর্ণেন্দু পত্রী (১৯৩১-১৯৯৭) প্রসঙ্গে উল্লেখিত মন্তব্যটি করেছেন কবিবর। কবির প্রতি কবির ভালোবাসা থাকতেই পারে। কিন্তু পাঠকের প্রতি এহেন আচরণ কেন? আবু হাসান শাহরিয়ারের গদ্য পড়তে ভালোই লাগে। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয়, যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রাবল্য বেশি। তাহলে এটিও কি আবেগের প্রকাশ?
৫
সমালোচক-সম্পাদক এবং প্রকাশকের প্রতি লেখকের আক্রোশ থাকতেই পারে। কেননা, সেখানে ব্যবসায়িক ব্যাপার-স্যাপার থাকতে পারে। থাকতে থাকে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি অথবা যোগবিয়োগের খেলা। কিন্তু পাঠকের প্রতি এতো আক্রোশ কেন? পাঠক কেন ‘ছিঁচকে পাঠক’ অথবা ‘বেয়াড়া’ হতে যাবে। নাকি প্রকাশক, সম্পাদক-সমালোচকের ন্যায় পাঠককেও কেউকেউ বেছে নিতে চান? সেখানেও কি স্বার্থগত ব্যাপরস্যাপার আছে? মাঝেমধ্যে প্রায়ই প্রশ্ন জাগে- পাঠক কেন আপনার লেখা পড়তে যাবে? নাকি আপনার লেখায় এমন অমূল্য সারবস্তু আছে যার পাঠ নিলে পাঠকের গড়আয়ু বেড়ে যাবে? পাঠকের জন্যই লেখক। একজন প্রকৃত লেখক তো পাঠকের কাছেই পৌঁছতে চায়। জাতি, ধর্মবর্ণ, গোত্রগোষ্টী নির্বিশেষে সমুদয় পাঠকের কাছে পৌঁছানোই লেখকের অন্তিম-অভিপ্রায়। পাঠকই লেখকের গন্তব্যস্থল। পাঠক ছাড়া লেখকের যাবার জায়গা কোথায়? পাঠক ছাড়া লেখকের কি আর কোনো সুজন থাকতে পারে? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তো পাঠকের কাছেই পৌঁছতে চেয়েছিলেন। জাতি, ধর্মবর্ণ, স্বদেশ-বিদেশ সর্ব গণ্ডি পেরিয়ে তিনি বিশ্বমানবের হতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন ‘পৃথিবীর কবি’ হতে। হয়তোবা হয়েছিলেন হয়তোবা নয়। অথবা হলেও যেভাবে চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবে হয়নি। এই পৌঁছতে না পারার জন্য, তার কবিতা ‘সর্বত্রগামী’ না হওয়ার জন্য তার মধ্যে অতৃপ্তি ছিল; ছিল দুঃখবোধ। ‘ঐকতান’ কবিতাটি তো তার ঐ দুঃখবোধেরই পরিচয়। লেখাটি শেষ করতে চাই মাহফুজামঙ্গলের কবি, কবি মজিদ মাহমুদের একটি উক্তি দিয়ে। কেন কবি কেন কবি নয় (২০০৩) গদ্যগ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন- ‘আমরা সব পাঠককে ছুঁতে পারি না; এটি আমাদের সীমাবদ্ধতা, পাঠকের নয়।’ এই শিল্পবোধ কি লেখকের জন্য জরুরী নয়?