
পারিজাতের ছায়ায়
রাস্তার পাশে সবুজ লাউয়ের মাচায় মানুষের চোখমুখ আঁকা, কালিঝুলি মাখা মাটির হাঁড়ি। মাচার নিচে তাকাতেই চোখে পড়ে কচি কচি লাউয়ের ঝুলে থাকা। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এসব দেখছে আলেয়া ফেরদৌসি আলো। একটা ফিঙ্গে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ গমক্ষেতে আধাপাকা গমের শীষের মাথায় বসন্তের পড়ন্ত বেলার রোদ। দূরের আমগাছগুলো থেকে ভেসে আসা মিষ্টি সুবাস আলোকে কবিগুরুর কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে হয়, কোন এক ফাল্গুনে এরকম পাগল করা ঘ্রানে আন্দোলিত হয়েই হয়তো কবিগুরু লিখেছিলেন—ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে…। দৌড়ে এসে পাশে দাঁড়ায় ১০/১২ বছর বয়সী আকাশ। আলেয়া জানতে চায়—কিরে কি হইছে?
তোমারে হোসনাদাদী ডাকে; আমি যাই। পাশে দাঁড়ানো ২/৩ জন কিশোরের সঙ্গে খেলতে চলে যায় আকাশ।
ঢাকা থেকে বাওনদি এসেছে গতকাল। বাবা-মা মারা যাবার পর গ্রামের বাড়িতে আসা-যাওয়া কমে গিয়েছে আলোর। নিজের সংসারে প্রতিদিনের ব্যস্ততা, নয়টা পাঁচটার চাকরি, ইচ্ছা থাকলেও বছর/ছয় মাসে বাড়িতে আসা হয় না। দেখি বুবু কি বলে? বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই চোখে পড়ে হেলেদুলে চলা হাঁসের ঝাঁক, রাস্তার ও পাশটা ধরে দুটো মহিষকে নিয়ে বাড়ি ফিরছে ভাতিজা শামীম। আলোকে দেখে প্রশ্ন করে—ফুপু কি করো? আলো হাসিমুখে জবাব দেয়—এই একটু হাঁটাহাঁটি করি। দুজনের কথার ফাঁকে এগিয়ে আসে শামীমের ছেলে আকাশ। শামীম ছেলেকে বলে—বাড়ি যায়া দেখ তো মোষের জন্য তোর মা পানি দিছে কিনা!
আলো খেয়াল করে হাসিখুশি মাখা মুখটা আঁধারে ঢেকে গেছে আকাশের। মনের কথা বুঝতে পেরে আলো বলে—আকাশ, এখন বাড়ি যা, সন্ধ্যার পর দাদীর বাড়ি আসিস। তোর মাকেও আসতে বলিস। সাইকেলে করে পাশ দিয়ে যাবার সময় গ্রামপুলিশ সেন্টু আলোকে সালাম দিয়ে বলে—বড়সাহেব মোবাইল করছে এখন যাই; পরে আসবো আপা। বাড়ির কাছে আসতেই আকাশের দুই বোন সীমা লিমা দৌড়াতে দৌড়াতে আসে—ফুপু, মা তোমার জন্য কি দিছে দেখো? বাটি খুলে অবাক হয় আলো। কালাইর রুটি! কতদিন খাই না! বাড়ির আঙিনা থেকে বেরিয়ে আসে রোজি—কই গো আলো, তুই কই বেড়বার গেছিস?
—আরে রোজি ভাবি, তুমি কেমন আছো?
আলো আর হোসনার চাচাতো ভাইয়ের বৌ রোজি। সাদা পাকা চুল ষাটোর্ধ্ব রোজি উঠানের কোনায় ডালিম গাছের গোড়ায় পানের পিক ফেলে বলে—হোসনা তো রুটি বানায় নাই কায় বানাইছে।
—ওই শামীম এর বউ লাভলি বানাইছে। উঠানে শুকনা লাকড়ি জড়ো করার ফাঁকে জবাব দেয় হোসনা।
—গুড়ের বৈয়াম কই রাখছো বুজি? ঘরের ভেতর থেকে আলো জিজ্ঞেস করে। কলপাড়ে হাত ধুয়ে ঘরে এসে হোসনা গুড়ের বৈয়াম আলোর হাতে দেয়। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সান্ধ্যকালীন কাজকর্ম গোছানোর জন্য। আলো আবারো ডাক দেয় —রুটি খাইয়া যাও বুজি।
—নারে, তুই তোর ভাবি আর নাতিনগো নিয়া খাওয়া-দাওয়া কর দেখি। মোর মেলা কাজ আছে। হুসনা বানু জবাব দেয়। আলো ঘরের মেঝেতে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে সবাইকে বসতে দেয়। সবাই মিলে খাওয়া আর গল্প-গুজব জমে উঠে। রোজী জানতে চায়—আলো তুই জামাই ছেলেমেয়ে নিয়ে আসিস নাই কেন?
—আমারে দেখি ভালো লাগে না; নন্দাই খোঁজ করো? আলোর কথা শুনে ছোট-বড় সবাই হেসে ওঠে।
হোসনা বানু টুকটাক গোছগাছ করে আর আপন মনে ভাবে—বাড়ির ছোট বেটি বেড়বার আসছে; আব্বা-আম্মা বাঁচি থাকলে কত খুশি থাকতো। মনের অজান্তে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।
জব্বার আলী ও সালেহা বানুর দুই মেয়ে হোসনা ও রাশিদার পর দুই ছেলে হয়ে মারা যায়। দীর্ঘদিন পর মেয়ে আলেয়া ফেরদৌসীর জন্ম। জব্বার আলী আদর করে ছোট মেয়ের নাম রাখলো আলো। জব্বর আলী আকবর আলী দুই ভাই আজ নেই। দুই ভাই এর ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি রয়েছে। দুই ভাইয়ের বংশধররা আজও একই আত্মিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ।
হোসনা বানু মুরগি ও ছাগলের ঘর বন্ধ করে; হাত-মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে চুলা জ্বালাতে যায়। ভাতিজা বৌ লাভলী আর আকাশ এসে জিগ্যেস করে—কি রান্না করেন? রাতের বেলা খালি ভাত আর আলু ভর্তা। ওরা গল্প শোনার জন্য ঘরে যায়।
হোসনার মনের মধ্যে নানা ভাবনা চক্কর দিতে থাকে। হোসনা বানুরা তিন বোনের মধ্যে এখন বেঁচে আছে দুইজন মেজ বোন রাশিদার কথা সে ভাবতে চায় না। বাবা-মা শ্বশুর-শাশুড়ি কেউই বেঁচে নেই। স্বামী হারানোর পর থেকে দুই ছেলে নিয়ে বাপের ভিটায় বাস করে হোসনা। ছেলেরা যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে ফোন করে হঠাৎ কিছুটা টাকা পাঠায়; এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না সে। সন্তান বড় হবে সংসার করবে এই তো দুনিয়া জুড়ে চলছে। সংসারে সব মায়া-মমতা এক সঙ্গে শেষ হয় না। কিছু কিছু অবশেষ রয়ে যায়। হোসনা বানুর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। চাচাতো ভাইয়ের বউ তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি এরাই তাকে ঘিরে রেখেছে। অন্যদিকে বাবা-মা মারা যাবার পর ছোট বোনও তার খবর রাখে। স্বামী-সন্তান-সংসার চাকরি সামলানোর পর বড় বোনের জন্য তার ভাবনা কম নয়। প্রতি বছর না পারলেও ২/৩ বছর পর পর বাড়িতে আসে। হুসনা বানু ও ছোট বোনের কাছে বেড়াতে যায়। আলো বাড়িতে এলে আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিয়ে হাসি আনন্দে কয়েকটা দিন কাটিয়ে তারপর আবার ফিরে যায় গৎবাঁধা জীবনে।
ভাত সিদ্ধ হলে ভাতের ফ্যান ফেলে দিয়ে অল্প আঁচে চুলায় বসিয়ে ঘরে যায় হোসনাবানু। বোনকে জিজ্ঞেস করে—আলো চা খাবু?
—তুমি যতবার চা দিবার চাও কোন আপত্তি নাই।
—তোরা বোনেরা চায়ের পাগল, বলে রোজি।
—ভাবি, তুমি কোন বোনের কথা কও হোসনা বুজিতো চা খায় না? রোজির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় আলো।
—তুই আর রাশিদার কথা; আর কার কথা।
দীর্ঘদিনের অনভ্যাসে জংধরা বদ্ধ কপাটের দুয়ার প্রবল ঘূর্ণিতে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তোলে হোসনে আরার করোটিতে—ভাবি তোমরা এত বছর পর রাশির নাম মুকোত আনো কেন? বড় বোনের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে রোজির হাত চেপে ধরে আলো।
—ভাবী রাশিবুর কথা মনে আছে তোমার ? রাশির কথা কেউ ভুলবার পার? দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে রোজি। ছোটবেলা থেকে কেউ রাশিবুর ঘটনা ঠিক মতো কয় না তুমি সবার সামনে কও তো!
বহুদিনের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শকাতর মহাকাব্যের মলাট থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলে পৃষ্ঠা উল্টায় আলো। ছোটরা চুপচাপ হয়ে যায়। রান্নাঘরে চলে যায় হোসনা। আলোর তখন মাত্র বর্ণ পরিচয় হয়েছে। হোসনার এক সন্তান নিয়ে সংসার, আর জব্বার আলী সালেহা ঘর-গেরস্থালি নিয়ে ব্যস্ত। দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর জন্ম হওয়ায় আদর সোহাগের কমতি হয় না আলোর। বড়বু হোসনা বানু বাড়ি এলে বায়নার শেষ থাকে না কিন্তু সে আর কয়দিন! তারপর হোসনা চলে গেলে নাওয়ানো ধোয়ানো নিজ হাতে খাওয়ানো আলোর সবকিছুই রাশির কাছে। একদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে জব্বার আলী ব্যস্ত হয়ে বড় ভাইয়ের বাড়িতে যায়। সে রাতে সবার উৎকণ্ঠার মাঝে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আলো। আলোর রাশিবু আর ফিরে আসে না। কেউ কিছু জানতে দেয় না আলোকে। এরপর থেকে মাকে প্রায়ই কান্নাকাটি করতে দেখে আলো বুঝতে পারে রাশিবুর কিছু একটা হয়েছে। একদিন পাড়া-প্রতিবেশীর কে একজন এসে জানতে চায়—জব্বার ভাই তোমার বেটি-জামাইয়ের খোঁজ নাও না ? জব্বার আলী চেঁচিয়ে ওঠে—ওই শয়তানের নাম কেউ যেন না নেয়।
আলোর শৈশবে ঘটে যাওয়া রাশিদার প্রেম বিয়ে গ্রামের সবারই কমবেশি জানা। সেসব যেন আজ নতুন করে রোমন্থিত হয়। শেষবার রাশিদা যখন ফিরে আসে; আলো সেদিন বাড়িতে ছিল না। মামা বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। তাই সবটুকু তার জানা হয়নি। বাস্তবে কি হয়েছিল সেদিন? আলো প্রশ্ন করে রোজিকে। কথা বলতে আরম্ভ করে রোজি। রাশির কথা কবার গেলে মেলা কথা কওয়া লাগে। সেই সময় দেশ-গ্রামের অবস্থা এখনকার মতো আচলো না! পাকিস্তান থাকি বাংলাদেশে হচে। বাপ-মায়েরা বেশি পড়া-লেখা জানে না, চারিদিকে অভাব- এর মধ্যে নানান দল। অস্ত্রপাতি সবার হাতে হাতে।
—দাদী তোমরা অস্ত্র দেখছো ? বিস্মিত আকাশের কথা বলা ধরনে সীমা, লিমা হাসি চাপতে পারে না। সেদিকে তাকিয়ে লাভলি ধমক দেয়-চুপ কর। আলো খেয়াল করে, হোসনেয়ারা চুপ করে এক পাশে বসে আছে। রোজি আবার আরম্ভ করে—আমরা সারাদিন পরিশ্রম করি, তোর বাপ-চাচারা মাঠে-ঘাটে খাটাখাটনি করে কিন্তু টাকার মুখ দেইখপার পায় না। আলো যোগ করে—দেশ স্বাধীনের পর নতুন দেশ এখনকার মতো মিল ফ্যাক্টরি হয় নি।
—তখন তো আর গার্মেন্টস আচলো না কিস্তির টাকাও আচলো না, দীর্ঘক্ষণ পর কথা বলে হোসনা বানু। রোজি বলতে থাকে—সেই অভাবের টাইমে রাজনীতির লোকজন আসে ভালো ভালো কথা কয়। দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনীতি করার কথা কয়, নারী-পুরুষ সমান অধিকারের কথা কয়। সেই দলে আচলো দেলোয়ার। আমরা দিলু কইতাম। আলো জানতে চায়—দেলোয়ার রাশিবুক তোমরা মেলামেশা করবার দেখছো?
—ওই যে কলাম না, অভাবের সংসার। আমরা আপন ভাইয়ের মতো সবার সাথে চলি; একসাথে খাই। এত ভাগাভাগি আচিলো না। বলতে বলতে হাপিয়ে ওঠে রোজি। লাভলী পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। পানি খেয়ে আবার বলে—মেলামেশা আর কি! দুই-একদিন কথাবার্তা কৈছে। ১৬/১৭ বছর বয়সে কতটুক বা বুজ হৈছে। হোসনে আরা বলতে শুরু করে—হঠাৎ করি দিলুর সাথে বিয়া বসিল রাশি। আব্বা-আম্মা, চাচাতো বড় ভাইয়েরা কেউ মানিল না। তোর দুলাভাই আর আমি মিল করবার চাইলে; সবাই বাধা দিল। রোজির হাত ধরে আলো। ভাবি সেই দিনের কথা কও; যেদিন আমি মামাবাড়িত ছিলাম। বুজি বাড়ি আসছিল।
—হ্যাঁ রে, এক বছর পর রাশি ফেরত আচচিলো—ভরা প্যাট নিয়া। এতদিন পর বলতে গিয়েও আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে রোজি।
—নয় মাসের গর্ভ নিয়া বাড়ি আচচিলো। আমারা মায়েরা গল্প করছো। লাভলী শাশুড়ির কথায় যুক্ত করে। আবেগকে অন্য খাতে প্রবাহিত করতে চায় হোসনা— লাভলী চাইরদিকে চোরের উৎপাত; তোরা সবাই এই বাড়িত গল্প শুনবার লাগছিস! শামীম বাড়িত না বাজারোত?
—তোমার বেটা বাড়িত আচে, লাভলী উত্তর দেয়।
ও ভাবী কও। তারপর কি হইচিলো? আলো তাগিদ দেয়।
—সারাদিন বাঁশের খুঁটি ধরি কান্দিল। কিছ মুখত দিল না। দুই চোখের পানি কেউ দেখিল না। তোর বাপ-চাচারা না, ভাইবেরার্দারা না। খালি চাচী আর আমি কত বুজানু, এই রাশি কান্দিস না !
বাপ ভাইয়ের গালমন্দ শুনি কোন কিছু না খায়া; সন্ধ্যার সময় চলি গেইল। পরের দিন খবর আসিল মরণের।
—সীমা লিমা কই তোরা ? শামীমের ডাকে। রোজির কথা বলা থেমে যায়।
—মা চলো আব্বা আচচে, আকাশের ডাকে সবাই উঠে পড়ে।
—আম্মা তোমার ব্যাটা ডাকপার লাগছে আমরা যাই। লাভলী হোসনার দিকে তাকিয়ে বলে।
সবাই চলে যায় যে যার ঘরে। রোজি যাবার সময় আলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। হোসনেয়ারা রান্না ঘরে রাতের খাবার গরম করতে যায়। রাতের খাবার খেয়ে উঠে সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে সে। চোখে ঘুম আসে না আলোর। বহুদিন আগে ঘটে যাওয়া মেজ বোনের অপ-মৃত্যুর ঘটনা বারবার ফিরে আসে। রাতজাগা পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ আলোকিত করে তোলে। কাল সকালে ঘুরতে যাওয়ার প্রোগ্রাম। একটু হলেও ঘুমাতে হবে; নতুবা জার্নি করা কঠিন হয়ে উঠবে। বিছানা থেকে নেমে পানি খায় আলো। তারপর বোনের পাশে শুয়ে ছটপট করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
খুব ভোরে একটা দুটা করে দোয়েল শালিক চড়ুই এর কিচির-মিচির; কারো কারো চিৎকার চোঁচামেচি আলোর করোটিতে টোকা দেয়। ঘুম ভেঙ্গে যায় এলার্ম বাজার আগেই। নাটোর যাবার প্লান করেই এবারের আসা। সহকর্মীরা অনেকদিন ধরেই নাটোর আসবার জন্য উদগ্রীব ছিল। কয়েকজন মিলে ঢাকায় প্ল্যান হয়। আলো প্রথমে গিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করবে তারপর অন্যরা যাবে। সেই মাফিক আলো সবার জন্য ব্যবস্থাপনা করে রেখেছে। হোসনেবু, জিজ্ঞেস করে কি ঘুম হয়ে গেল? হ্যাঁ, আমার তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে যে। ওই হইল। তোমার লোকজন কয়টায় আসে দেখো। না বু, তুমি তাড়াতাড়ি আমার খাওয়া-দাওয়া রেডি করো। বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে এক চক্কর দিয়ে এসে গোসল সেরে নেয় আলো। বুবুর হাতের কতো রান্না! মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। তৃপ্তি করে সকালের নাস্তা সারে আলো। তারপর বোনের কাছে বিদায় নিয়ে রওনা হয় বাড়ি থেকে। বাড়িশুদ্ধ লোক সবাই তাকে দেখতে আসে। রীতিমতো হোসনা বানুর বাড়ির সামনে ভিড় লেগে যায়। রিকাসায় উঠে রওনা দেয় আলো।
সবার সঙ্গে মিলিত হয় নাটোরের উত্তরা গণভবনের গেটে। প্রথমেই চোখ পড়ে ত্রিশোর্ধ্ব নিপা আর হ্যাপির দিকে। দু’জনে শাড়ি পড়েছে, সাজ্জাদ পড়েছে ফতুয়া। পঞ্চাশোর্ধ আলমগীর সব সময়ের মতো ফুলশার্ট প্যান্ট পড়েছে কেতাদুরস্তভাবে। শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারে না আলো; আজকেও তার অন্যথা হয় নি। পাঁচজনের দলটি উত্তরা ভবনের গেট পেরিয়ে ভেতরে যেতেই পরিস্কার জল, সবুজ গাছপালা, রঙিনফুল সবাইকে স্বাগত জানায়। দলের কনিষ্ঠতম সদস্য সাজ্জাদ গাছের নিচে বাঁধানো বেদিতে বসে পড়ে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে গাছের ডালে বাধা যন্ত্র থেকে সুর ভেসে আসছে—আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও ধুইয়ে দাও…। আলমগীর খান হাসিমুখে প্রশ্ন করেন, সাজ্জাদ কাদিরের দিকে তাকিয়ে। কেমন লাগছে এখানে এসে?
—ভালো, খুব ভালো। সাজ্জাদ উৎফুল্লভাবে জবাব দেয়। আলো গাছের ডালে ফুটে থাকা থোকা থোকা ফুল দেখে অবাক হয়ে বলে—ব্রাউনিয়া! আমার মামার বাড়িতে একজন বিদেশ থেকে এনে লাগিয়েছিল; সেখানেই আমি প্রথম এই ফুল দেখেছি। সাজ্জাদ বলে—আমি তো জানি পারিজাত! আলমগীর বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে বলেন—দেখেন, সব গাছের নাম লেখা আছে, বৈজ্ঞানিক নাম ব্রাউনিয়া বাংলায় পারিজাত। নামের ঝামেলা মিটে যেতেই সবাই ফুলের ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এরপর আনন্দ চিত্তে সবাই হাঁটতে থাকে। শুধু পিছিয়ে পড়ে আলো। সাজ্জাদ সেটা খেয়াল করে; আলোর সঙ্গে যুক্ত হয়। দুজন একসঙ্গে জাদুঘর দেখতে যায়। জাদুঘরের দেয়ালে ঝোলানো রাজা মহারাজাদের ছবি, তাদের বংশ তালিকা চোখে পড়ে আলোর। পাশের ঘরে ব্যবহৃত নানারকম আসবাব-পত্র রাজকন্যা ইন্দুপ্রভার সাহিত্যকর্মের স্মৃতি বিজড়িত ডায়েরিসহ আরো অনেককিছু দেখে সে। এসব স্মৃতিচিহ্ন দেখে বরাবরের মতই মনে পড়ে, পৃথিবীতে কেউ স্থায়ী নয়। এক সময়ের প্রতাপশালী রাজা জমিদার, তাদের চাবুকের শব্দ, মানুষের আর্তনাদ, বাতাস ভারী হয়ে থাকতো। অন্যদিকে নাচঘরে শোনা যেতো নূপুরের নিক্কন। দুর্দমনীয় গতিতে প্রাসাদের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে চলতো অশ্বারোহী যোদ্ধা। সেসব আজ ছবি। কোন সোনার কাঠি, রূপার কাঠির ছোঁয়ায়—এইসব ছবির চরিত্ররা আর কখনও প্রাণ ফিরে পাবে না! সবার স্থান আজ ইতিহাসের পাতায়।
জাদুঘর থেকে বেরিয়ে সবাই আম গাছের ছায়ায় বসে। চারপাশে আমের মুকুলের মিষ্টিমধুর ঘ্রাণ সচকিত করে তাদের। ফটোসেশনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে যার মতো। তারপর খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে মিনি চিড়িয়াখানা দেখতে যায়। শান্ত দীঘির পাড়ে এসে দাঁড়ায় নীপা—আপু দেখেছো সে সময়ের রাজা-জমিদাররা নিরাপত্তার ব্যাপারে কতো সচেতন ছিল? হ্যাপি অন্যদিকে তাকিয়ে বলে—কেন এরকম মনে হল তোর?
সাজ্জাদ ওদের দু’জনের কথার মাঝখানে বলে উঠে—রাজবাড়ির চারিদিকে পরিখাগুলো দেখে।
আলমগীর খান তাড়া দেন—দুপুর হয়ে যাচ্ছে চলেন; দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি যেতে হবে আমাদের। আবার দিঘাপতিয়া যাবার প্রস্তুতি। উত্তরা গণভবন থেকে বের হতেই কড়া রোদের তাপ। তাড়াতাড়ি মাইক্রোবাসে উঠে পড়ে তারা। বাসের জানালা দিয়ে নাটোরের ইতিহাস সম্পর্কিত বই কিনে সাজ্জাদ। বাস চলতে থাকে। দূর থেকে ভেসে আসে সময়ের ঘণ্টাধ্বনি। আলমগীর নিজের মনে বলে—একশো বছর আগে ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল এই ঘড়ি। নিরবিচ্ছিন্নভাবে আজও নাটোরবাসীকে যা সময় গত হবার জানান দিয়ে যাচ্ছে।
বাস চলতে থাকে রানী ভবানীর রাজপ্রাসাদ এর উদ্দেশ্যে। চোখবন্ধ করে আলো। আলমগীর সাজ্জাদ কি নিয়ে যেন আলোচনা করছে; ভালো করে শোনা যায় না । জীবনানন্দ ও বনলতা সেনকে নিয়ে তর্কে মেতে উঠেছে নিপা হেপী। নাটোরের রাজবাড়ি পৌঁছে যায় সবাই। নাটোরের রানী ভবানীর রাজ্য ঘুরে আসতে পায়ে হেঁটে ৩৫ দিন সময় লাগতো। কথিত আছে ১৭৫৭ সালে রানী ভবানী নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সহযোগিতার জন্য বাহিনী পাঠিয়েছিলেন কিন্তু পৌঁছানোর পূর্বেই পতন ঘটেছিল নবাবের। এসব ভাবতে গিয়ে কোনে কূল-কিনারা খুঁজে পায় না আলো। দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির পাশে দীঘির পাড়ে বসে আলো, তখন দীঘিতে দেখতে পায় একটা পানকৌরি মাছ ধরছে।
আলমগীর খান এগিয়ে আসে আলোর কাছে—চলেন ঘুরে দেখি। আপনারা সবাই দেখুন, আমি একটু জিরিয়ে নিই। আলো একা বসে থাকে। সবাই তাকে রেখে ঘুরতে যায়। খুব বাতাস বইছে; আলোর মধ্যেও ঝড় বইতে থাকে। গত রাতের কথা তার মনে পড়ে। তার মেজবোন বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে স্বপ্ন দেখেছিল নতুন পৃথিবীর। একজনকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল। গর্ভবতী হবার পর আবার ফিরেও এসেছিল পরিবারের কাছে। সবার অপমান লাঞ্ছনা তাকে বিপর্যস্ত করেছিল। মায়ের ভালোবাসার চাদর কতটুকু যে, তার উপর ভরসা করবে সে! আলোর মনে পড়ে সেই চিরন্তন সত্য। মাতৃত্ব যা নারীকে সম্মানিত করতে পারে আবার তাকে বিপদগ্রস্তও করতে পারে। রাশিবু’র জীবনে বিপদ হয়েই এসেছিলো মাতৃত্ব। বাতাস মন উথলা করলেও বসে থাকার আর সুযোগ ঘটে না। সবাই এসে পড়ে; আবার উঠতে হয়। এবার শহরের উদ্দেশ্যে ফেরা।
সারাদিনের ঘোরাঘুরি শেষে সহকর্মীরা রাজশাহী শহরে ফিরে যায়। বানেশ্বরে নেমে যায় আলো। অটো রিকশা দরদাম করে রওনা দেয় বাওনদি গ্রামের উদ্দেশ্যে।
হোসনেয়ারা বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। আলোকে দেখে বলে—কিরে বেড়াবেড়ি হইল? আলো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। ঘরে এসে ব্যাগ রেখে মেঝেতে রাখা ঢাকা তরকারির ঢাকনা খুলে অবাক হয়। মোচার তরকারী কচুশাক! চামুচে করে মুখে দেয় আলো। হোসনা হাসে—তোর রোজি ভাবি পাঠাইছে।
—বুজি, কালকে সবাইকে ডাকো; এক পাতে খাব।
—তোর ভাইবউ ভাতিজা ভাতিজিদের কি খাওয়াবু?
—তোমার যাকে যাকে বলতে মন চায় বলো আগে তারপর কি খাওবো ভাবি।
পরের দিন সবাই মিলে খাওয়া হয়। দিনব্যাপী উৎসবে মেতেছিল হোসনাবানুর বাসা। দু’বোন এখন ক্লান্ত। সবাই চলে গেলে কেমন খা খা করে ঘরটা। বাবা মা মারা যাওয়ার পরে বাড়িতে আনন্দোৎসব কমই হয়। কাল সকাল সকাল বেরুতে হবে বলে গোছগাচ করতে থাকে দু’বোন। রোজি হাঁসের ডিম রেখে গেছে, লাভলি দুটো কচি লাউ দিয়ে গেছে, চালের আটা আর আচার দিয়ে গেছে রোশনা। আলো সবার ভালোবাসার জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখে আর অবাক হয়।
গুছানো শেষ হলে তারা রাতের খাওয়া সারে। হোসনা বলে, অনেক আগে মা একটা কথা কইছিল। বলছিলো, হোসনা আলোরে কোনদিন কষ্ট দিবু না। তুমি আমাক আদর করি বড় করছো আর আজকে এইসব কী কও বুজি! হোসনা কোন কথা না বলে কিছু বিবর্ণ জামাকাপড় পুরনো ছবি একটা খাতা আলোর সামনে রাখে। আলো সবকিছু সরিয়ে খাতাটা হাতে নিয়ে পড়তে থাকে। খাতার ভেতর কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা, নিচে নাম, পুরনো হয়ে রাশিদা নামের রয়ের ফোটা আবছা হয়ে গেছে, দেখতে দেখতে রাত গভীর হয়। হোসনা ঘুমিয়ে পড়েছে সেদিকে তাকিয়ে ডায়রিটা একপাশে রেখে দেয় আলো। চোখের সামনে দেখে বাঁশের খুঁটি ধরে বসে আছে রাশিবু। শরীরের চেয়ে বড় পেটটা একবার উঠছে একবার নামছে, মাথায় হাত রেখে ভাবি বলছেন—কান্দিস্ না। তার চোখের পানি গাল বেয়ে, কোল বেয়ে বৃষ্টির মতো মাটিতে ঝড়ছে তো ঝড়ছেই। তারপর হঠাৎ একা বেরিয়ে পড়ে রাশিদা। আলো পিছন পিছন যায়—বুবু কই যাও? মা আর ভাবী ডাকে—ভরাপেট নিয়া সাঁঝের বেলা কই যাইস রাশি? বাড়ির সামনের আল পথের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে সে, অনেক দূরে গিয়ে একবার পিছন ফিরে তাকায় এরপর সোজা হেঁটে যায়। ঘুম ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসে আলো। নরম দুর্বাঘাসের উপর শিশিরের প্রলেপ। ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে একটা সরুপথ। চারদশক আগে নয়, যেন এখন এই মাত্র তার রাশিবু অভিমানী এক মেয়ে। এই পথ ধরে বাড়ি-ঘর প্রিয়জন ছেড়ে গর্ভের সন্তান নিয়ে হেঁটে গেল যেন! অনেক দূর গিয়ে একবার পিছনে তাকালো! তারপর আত্মহত্যা, গর্ভের সন্তানের মৃত্যু, পুলিশ, মামলা এসব সত্য নয়, সত্য ভাবতে কষ্ট হয় আলোর।
পৃথিবীতে কত সংখ্যাহীন জীবন! তাদের কতশত লড়াই এর মাঝেই তো বেঁচে থাকে মানুষ। সেখানে আলোর রাশিবু ও তার অনাগত সন্তানের স্থান নেই! আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আলো কোনভাবেই তা মেনে নিতে পারে না। রাশিবু’র মতো আরো সহস্র নারীর সুখ স্বপ্নের কথা বাস্তবায়নে স্বপ্নের আগামী সময়টা কেমন হতে পারে সেটাই ভাববার চেষ্টা করে সে।