
পাতাদের পরিবার
গাছে নতুন পাতা হয়েছে কয়েকটা। সুন্দর একদম চকচকে সবুজ। গাছের মন ভালো লাগছে। গা ভরা নানারকম পাতা ফুল ফল। পথিক ছায়া পায়। ক্ষুধার্ত খাওয়া পায়। মানুষ অক্সিজেন পায়। এজন্য নিজেকে সার্থক মনে করে। কিন্তু নতুন পাতাদের কথা শুনে মন খারাপ হল। আগে কোনো পাতা কোনো পাতাকে এভাবে কথা বলত না। সবাই মিলেমিশে থাকতো। আজ সকালে ছোট্ট সবুজ পাতা হলুদ শুকনো পাতাকে বলছিল, তুমি বুড়ো হয়ে গেছো। দেখতে ভালো লাগে না। তুমি আমাদের থেকে একটু দূরে থেকো। বাতাস হলেই তুমি গা নেড়ে নেড়ে আমাদের কাছে মিশে যাও কেন? তোমাকে দিয়ে গাছের আর কি কাজ? আমাদের দিয়েই গাছ সেজে থাকবে। দেখ আমরা নাচি গাই হাসি। আমাদের সবুজ রংয়ের জন্যে গাছটাকে কি সুন্দর দেখা যায়! তুমি এখন আমাদের মত আর পারবে না নাচতে আর গাইতে। দেখতেও তোমাকে আর আমাদের মত ভাল লাগবে না। একটু বাতাসেই ঝরে যাবে। শুকনো পাতা মন খারাপ করে বলে, আমিও তোমার মতো ছিলাম আর তুমিও আমার মত হবে।
সবুজ পাতা অহংকারে হেসে বলে, হাহ, সে কবেকার কথা এখন বলে আর কি হবে? বর্তমানটাই মূল্যবান। এখনকার সময়টা নিয়ে ভাবো।
হলুদ পাতা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে। বুকটা কষ্টে ভারী হয়। নিজের দিকে তাকায় আর মনে মনে ভাবে কেন সবুজ পাতা আমাকে এমন করে কথা বলে? কথা না বাড়িয়ে গাছকে বলে, ও গাছ, তুমি আমাকে ঝরিয়ে দাও। গাছ কিছু বলে না। বুঝতে পারছে কষ্টে হলুদ পাতা এমন করে বলছে। তখন একটা পাখি এসে ঠোঁটে করে তুলে নিল পাতাটাকে। নিয়ে যত্ন করে আরও অনেক শুকনো পাতা কচিপাতা খড়কুটো মিলিয়ে সুন্দর এই গাছেই একটা বাসা বানালো। সে এখানে থাকবে তাই সুন্দর আর মনের মতো করে বাসাটা বানিয়েছে। নিজের বানানো বাসা দেখে খুব ভালো লাগছে পাখিটার। ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে অনেক রকম করে দেখছে। সঙ্গীদেরও ডেকে এনে দেখালো। কিচিরমিচির কথা বলে গান গেয়ে ওদের আনন্দ দিল। গাছ থেকে আরো অনেক শুকনো পাতা নিচে পড়েছে। সেগুলো থেকে বেছে বেছে ছোট ছেলেমেয়েরা কিছু পাতা কুড়িয়ে নিয়েছে। ওরা নাকি এসব দিয়ে কি কি তৈরি করবে। ওটাকে নাকি কুটিরশিল্পের কাজে লাগাবে। এতকিছু জানেনা সে। তবে গাছের খুব ভালো লাগে এসব দেখে। আসলে সবাই সবার প্রয়োজন বোঝে না। কেউ কেউ বোঝে। শুকনো বাদামি পাতা, হলুদ আর সবুজ পাতা সবাইকে নিয়েই তো গাছ সুন্দর হয়। পাতা বুঝি হলুদ হয় না? সব গাছের পাতাই তো শুকিয়ে যায়। এমনকি একদিন গাছও মরে যায়। এটাই তো জীবনের নিয়ম। জন্ম হবে। ছোট থেকে বড় হতে হতে তারপর একদিন মরে যাবে। কে কি কাজে লাগল সেটাই বড় কথা।
ছোট থেকে বড় হতে হতে একটা পাতা গাছের কত সুখ দুঃখের সময়ের সঙ্গী থাকে এটা গাছ বোঝে। পাতা নিজেও জানে গাছের অনেক গল্প। প্রতিটা পাতার এমন গল্প আছে। সব পাতারই সব পাতাকে সম্মান করা উচিত। কেন যে বোঝে না কোনো কোনো পাতা এটা ভেবে গাছের খারাপ লাগে। সম্মান দিলে সম্মান পাওয়া যায় কেন যে এটা বোঝে না গাছ জানে না। জন্ম থেকে পাতাকে এগুলো শেখানোর চেষ্টাও করেছে গাছটা। নতুন পাতাগুলোকে নিয়ে গাছ আর পারছে না। খুব বিরক্ত সে। কিভাবে এদের বোঝাবে তা নিয়ে গাছ খুব চিন্তা করছে।
দেখতে দেখতে ঝড়ের দিন এলো। হঠাৎ ঝড় আসে আকাশ কালো করে। জোরে বাতাস বইতে লাগল। তখন সবুজ পাতাটার মাথা ঝড় এলোমেলো করে দিচ্ছে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে ঝড়ের বাতাসে টিকে থাকতে। পারছিল না। তখন হলুদ পাতা বাসা থেকে বলল, তুমি এসো আমি তোমাকে আড়াল করে রাখি। হলুদ পাতাকে সে বলে, আরে শুকনো পাতা কি বল! লাগবে না তোমার সাহায্য। আমি একাই সামলাতে পারি। বুড়ো নিজের ভাবনা ভাবো। দেখতে দেখতে ঝড় বেড়ে গেল। শিলাবৃষ্টিতে সেই সবুজ অহংকারী পাতাটা ছিঁড়ে কয়েক ভাগ হয়ে গেল। তারপর টুকরো টুকরো হয়ে ঝড়ের বাতাসে উড়ে গেল। শুধু বোঁটাটা রয়ে গেল। ইশ কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে! কদিনেই শুকিয়ে কালো হয়ে গেল। কারো কোনো কাজেই লাগলো না। আর সেই পাখির বাসার পাতাগুলো তখন বৃষ্টিতে পরিষ্কার ও সুন্দর হয়ে গেছে । কোনো ধুলোবালি নেই, সব ধুয়ে নিয়েছে বৃষ্টির পানি। সেই হলুদ পাতা দেখেছে সবুজ পাতাটার খুব খারাপ পরিণতি। সবুজ পাতা আর কোথাও নেই। অথচ শুকনো পাতাদের অনেকেই শিল্প হয়ে রয়ে গেছে অনেকের সাজানো ড্রয়িং রুমে। অনেক পাতায় বানানো হয়েছে পাতার ঠোঙ্গা, পাখির বাসা, কেউ কেউ শুকনো পাতায় ছবি এঁকে রেখেছে, পাতার নকশা করে দেয়ালে সাজিয়ে রেখেছে, পাতা দিয়ে বানিয়েছে মেয়েদের গহনা। কেউ কেউ শুকনো পাতায় আগুন জ্বালিয়ে ভাত রান্না করছে। শীত নিবারণ করছে। মনে মনে খুব তৃপ্তি পেল, সম্মানিত বোধ করল হলুদ পাতা। তার জীবন সার্থক। সে কোনো না কোনো ভাবে মানুষের কাজে লেগেছে। তবে হলুদ পাতার মনে খুব মায়া হল সবুজ পাতার জন্যে। আহারে কোথায় না জানি হারিয়ে গেছে সবুজ ছোট্ট পাতাটা!
গাছ সুন্দর হয় সবুজ, হলুদ, বাদামি সব পাতাদের নিয়ে। ওরা সবাই গাছের আপন। সবাই মিলেমিশে থাকাতেই আনন্দ। এটা হল গাছের সংসার। পাতাদের পরিবার।
ছেলে, মেয়ে, বাবা, মা, দাদাদাদী, নানানানী, সবাই মিলে পরিবার সুন্দর হয়। ছোট বড় সবাই মিলে একটা পরিবারকে সার্থক করে তোলা যায়।
পরিবারও একটা ফুল, ফল, পাতায় ভরা গাছের মত। সবাই ভালোবেসে একসাথে থাকাতেই শক্তি, সাহস এবং আনন্দ।