
‘পরমাণু গল্প’ : জীবনের বয়ানে অভিনবত্বের ছোঁয়া
লেখা যখন হৃদয়ের তন্ত্রীতে অনুরণন তোলে তখন সেটা শিল্পের নান্দনিক শোভাযাত্রায় সহযাত্রী হয়ে যায়। আর শিল্পোপভোগকারী তৃপ্তির অনেকটুকু পেয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে—এ কেমন তৃপ্তি? উত্তর : চিন্তার খোরাক পাওয়া। এটা ব্যক্তি ভেদে ভিন্ন হয়। তাত্ত্বিক একভাবে, রসবোদ্ধা একভাবে আর সাধারণ পাঠক একভাবে। তাই শিল্পীর দায়িত্ব অনেক।”শিল্পীকে হতে হয় রূপকার। শিল্পীর আর এক নাম ‘রূপদক্ষ’।”(বিমলকুমার মুখোপাধ্যায়)
রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, ” . . . রচনার মধ্যেই লেখক যথার্থরূপে বাঁচিয়া থাকে।” ঠিক আছে তবে করণকৌশলের বিষয়টা কী? ক্রোচে বলছেন, “The confusion between art and techniques is especially beloved by impotent artists.” আর এসব বিষয়ে তলস্তয়ের কথাটাও দেখে নেওয়া যাক। “রূপসচেতন শিল্পী শিল্পকে ক্রমশ রূপসর্বস্ব করে তোলে সাধারণ মানুষের অনধিগম্য প্রদেশে নিয়ে যান।” কথাটা সর্বজনগৃহীত না হলেও বেশ। শিল্পকে মনের অন্দরে ঢুকতে হবে আড়ম্বর দিয়ে নয় অনুভূতির তীব্রতা দিয়ে। সাথে যদি কিছুটা সজ্জা চলে আসে আসুক না…
অপরাহ্ণ সুসমিতো তাঁর বিশেষ আঙ্গিকের লেখা ‘পরমাণু গল্প’, (ফেব্রুয়ারি ২০২০) নিয়ে পাঠকের হৃদয়বীণার তারে সপ্তসুরের ঝঙ্কার তুলেছেন। সাহিত্যের অতি আদুরে মাধ্যম ছোটগল্প। আমরা সময়ের বিনির্মাণ করতে গিয়ে সেই ছোটগল্পের ফর্মকে বারবার ভাঙছি। আসলে আমরা জীবনকে ভাঙছি। তাই জীবনের রূপায়ণে ভাঙা-গড়ার খেলা চলছে অহর্নিশ। ‘পরমাণু গল্প’ গ্রন্থটি তেমন এক নিরীক্ষাধর্মী রচনা। এটা লেখকও বলেন।
গল্পগ্রন্থটি বিষয়বৈভবে অনন্য। এখানে লেখক সমকালীনতা, পরম্পরা, আচরিত বিশ্বাসকে উপজীব্য করে জীবনের বয়ান এঁকে চলেন গল্পের শরীর জুড়ে। জীবনের প্রতিদিনের টুকরো টুকরো উপকরণ আর অনুভূতিরা জায়গা পেয়েছে এখানে। আবার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মসম্পর্কীয় জটিল সমীকরণগুলো ভীষণ অনায়াসে বলে গেছেন। আরেকটি বিষয় এই লেখার চরিত্ররা। যারা অনেকেই রক্তমাংসের গড়া নয় কিন্তু কথা বলে ওদের মতোই। যেমন : চুম্বক, আমলকি, সূর্যমুখী, সমুদ্রসৈকত, কাগজ, সন্ধ্যা, টিপ, কিসমিস, ধান ক্ষেত, আলু, চিপস, রুই, সুতো, ডিমের ঝোল, পাউরুটি, তিতলি ঝড়, মুনমুন প্রজাপতি এমন আরও বিচিত্র সব বিষয় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। এদের সাথে হাত ধরাধরি করে আছে নেতা, উচ্চপদস্থ আমলা, সাহিত্যশিল্পী, আমি ও আপনি। প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এবং গভীরতলসঞ্চারী বোধে যাপিত জীবনের চেনা কথাগুলো উপস্থাপিত হয়েছে। ভঙ্গি দিয়ে ভোলানো নয় মগজের গভীরে রেখাপাতের এই আয়োজন পাঠকের শতভাগ মনোযোগ দাবি করে। নইলে রসভঙ্গের সমূহ সম্ভাবনা রয়ে যাবে। ভীষণ সুখপাঠ্য গল্পগুলো তবে মোটেও সহজপাচ্য নয়। পাঠকের চিন্তনের জগতে আলোড়ন তুলতে সক্ষম এরা।
এই গল্পগ্রন্থের গল্প বলার ভঙ্গি নিয়ে বিশেষ করে বলার আছে। অণু গল্পের ফর্ম নিয়ে যথেষ্ট মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। উইকিপিডিয়া অণু গল্পের বিষয়ে যা বলে, “Flash fiction is a fictional work of extreme brevity that still offers character and plot development.” এর প্রকাশ এখানে পরিলক্ষিত হয়। বিস্তারকে রুখে দিয়ে বিস্তৃত জীবনকে ধরে রাখার এই প্রয়াস পাঠকের হৃদয়ে মুগ্ধতা ছড়াতে বাধ্য। হয়তো শব্দেরা প্রাণ হারাচ্ছে বলে অনুচ্চার্য বা অনুল্লিখিত বিষয়ে আমরা বেশি আগ্রহ বোধ করছি। আধুনিক মানুষের জটিল আঁকিবুঁকিতে ভরা জীবনের বিন্যাস তাই দুএকটা রেখায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টাকে স্বাগত জানাতেই হয়। আমরা কী শব্দ দিয়ে পুরোটা বোঝাতে পারি? হয়তো পারি না। বিমুখ প্রান্তরে সূর্যের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলি অনির্দিষ্ট গন্তব্যের পথে। এই চলাটার নামই জীবন। আর এই জীবনের বয়ানে ভীষণ ক্ষিপ্রতার পরিচয় দিয়েছেন অপরাহ্ণ সুসমিতো। বলছি তাঁর ভাষার গতিময়তার কথা। অযথা আড়ম্বরকে এড়িয়ে গেছেন। একটি গল্প পাঠ করা যাক। ১২ সংখ্যক গল্প, নাম ‘বিস্তার’ :
“মেয়েটাকে দেখেই আমার মুখ উদ্ভাসিত হলো। দিগন্ত প্রসারিত হাসি উপহার দিয়েই হাত বাড়ালাম করমর্দনের জন্য। বললাম;
: আমি রাজা
মেয়েটা অবাক হেসে খুন। হেসেই হাত বাড়াল।
: আমি রানি।
সেই থেকে শুরু। রাজত্ব বাড়ল আর সীমানা।”
গল্পটির বিষয়ের বিষয়ে বিশেষত্বটা আমার কাছে মনে হয়েছে অনায়াস আর ব্যাপ্তিময়। খুব যে গভীরতলসঞ্চারী তা নয় কিন্তু সুখপাঠ্য। আর এর ভাষার আড়ম্বরহীন কমনীয়তা মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। গল্পকারের ভাষায় স্বরবৃত্তের ক্ষিপ্রতা আছে, আছে অক্ষরবৃত্তের প্রজ্ঞাময় স্নিগ্ধতা।
আরেকটি গল্প পাঠ করা যেতে পারে। ১২১ সংখ্যক, নাম ‘ছোট্ট সুত্র’ :
“একটা বড় লোহার টুকরা আরেকটা ছোট লোহার টুকরাকে প্রশ্ন করলো;
: বল তো চুম্বক কি?
ছোটটা মুখ বাঁকিয়ে জবাব দিলো;
: অসহ্য। কেবল টানে। মুক্ত করতে জানে না।”
এমন গভীরতলসঞ্চারী ভাবনার গল্প পাঠককে রসবোধে সিক্ত হতে বাধ্য করবে। সাথে অবশ্যই তার চিন্তনের জগতে অনুরণন তুলতে সক্ষম হবে। ভাষার সারল্যে স্বল্পপরিসরে তির্যকভঙ্গিতে জীবনের এমন উপস্থাপনা দুর্লভ। বুদ্ধিমত্তায় ঘা দেওয়া এমন স্ফুলিঙ্গ চোখে পড়ে বনফুল আর মান্টোর কিছু লেখায়। আরও হয়তো আছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছয় শব্দের গল্পটি “For sale. Baby shoes. Never worn.” কিংবা আরেক আমেরিকান সাহিত্যিক ফ্রেডরিক ব্রাউন এর ‘Knock’ গল্পটি “The last man on Earth sat alone in a room. There was a knock on the door…” এই সর্বজনবিদিত গল্পদ্বয়ের গল্পের নির্যাস পাঠককে অভিভূত করে রাখে। এমন করণকৌশল অপরাহ্ণ সুসমিতোর গল্পে দৃষ্টিগোচর হয়। এছাড়া তাঁর গল্পের পরিণতিতে মোঁপাসাসুলভ চমৎকারিত্ব প্রদশর্নের বিষয়টা লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে ভাষার কারুকাজে লেখকের মনোযোগ কম তিনি বিষয়ের গভীরে ঢুকে যান খুব সহজে। আর সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চলেন মানুষ নামক এক অদ্ভুত বিষয়ের অন্তরালে। অবশ্য সমাজবীক্ষণও কম হয় না।
২০৯টি গল্পের সংকলন ‘পরমাণু গল্প’ গ্রন্থটি। এর বেশিরভাগ গল্প তীব্র, প্রখর, গাঢ় অনুভূতির রসসঞ্চারী। অবশ্য দুএকটা গল্পে গল্প খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাত্ত্বিকরা বলেন গল্প এক বাক্যে লেখ আর শত বাক্যে লেখ তার মধ্যে গল্পটা থাকতে হবে। যদিও অণু গল্পে সবসময় গল্প না-ও থাকতে পারে। গল্পের নির্যাস কিন্তু চায়। পাঠক গল্প খোঁজে। মূক প্রকৃতির বিচিত্র রূপের মধ্যেও গল্প খোঁজে মানুষ। যা-ই হোক, কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রুফরিডারের অসচেতনতা পাঠকের চোখে পড়বে। একধরনের শব্দের যেমন ‘আচানক’ বারবার প্রয়োগ ঘটেছে। যদিও এসব উপেক্ষা করা যায় সহজেই। কেননা এই গল্পগ্রন্থের গল্পের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, বিষয়ের বৈচিত্র্য, ভাষার সারল্যে ভরা সৌকর্য পাঠককে বিমোহিত করতে সক্ষম। কেমন যেন একটা মুগ্ধতা ছড়ানো রয়েছে এর পরতে পরতে! বিস্তৃত জীবনের বিস্তারকে স্বল্প আয়োজনে উপস্থাপনের এই প্রয়াসটি অভিনব।