
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ৯
জাহাজে করে চট্টগ্রাম থেকে করাচি পোঁছানো মাত্র আমাকে মিলিটারির গাড়িতে করে নেওয়া হয় মৌরিপুর বিমানঘাঁটিতে। এক বিশাল, লম্বা দালানে বাথরুম ও টয়লেট। হাতমুখ ধোয়ার জন্য এই দালানে ঢুকে ডজনখানেক পাঞ্জাবিকে দিগম্বর বেশে দেখতে পেয়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ব্যাপারটি তেমন কিছুই ছিল না, তবে নিঃশব্দে ফিরে আসি ব্যারাকে। ইংরেজের সংস্পর্শে এসে হয়তো-বা পাঞ্জাবিরা এইভাবে নাঙ্গা হয়ে স্নান করার স্বাদ পেয়েছিল।
ভাবনা থেকে ফিরে এসে ডান হাতের তালুর সাহায্যে দেহ থেকে ময়লা তুলতে থাকি। ঘামগন্ধভরা নোংরাগুলো মরাগাছের পাতার মতো ঝরতে থাকে বাথটাবে, যেখানে-সেখানে। যতই ঘষছি ততই লোমের ভেতর থেকে নিঃশব্দে খসে পড়তে থাকে ধূসর রঙের ময়লাগুলো। ঠান্ডা বাতাস অগভীর হিমজলের ওপর ভর দিয়ে মৃদুভাবে আমার চোখমুখ ছুঁয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গেই শিউরে উঠি। সেই সকালেও আমি শিউরে উঠেছিলাম। হিমেল বাতাসও বইছিল। সূর্যের ঝাপসা আলো বৌদির চুল বেয়ে তার মুখের সঙ্গে মিতালি পাততে লজ্জা পাচ্ছিল না।
খেটে-খাওয়া রমণীর মতোই বৌদির ভরভরন্ত শরীর। পায়ে রুপোর নূপুর, হাতে রুপোর কংকন। মেদহীন, কোমলাঙ্গী বৌদিকে দেখতে দেখতে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মনে কিছুটা উদ্বেগ, কিছুটা আবেগের সৃষ্টি হয়। না পাওয়ার চরম অসন্তোষের ছায়াও হতে পারে! আমার পাশে পড়ে থাকা বাসি গোবরের ডেলার ওপর মাছি দৌড়াদৌড়ি চলছে। একটি বিড়াল ঠোঁট চেটে ম্যাঁও ম্যাঁও করে গোরুঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে তার পাশ দিয়ে চলে যায়। তারপর উঠোন পেরিয়ে তারাফুলের ঝোপঝাড়ের পাশে গিয়ে লেজ গুটিয়ে বসে পড়ে। আমাকে ভাঙা জানালার পাশে বকুলতলার ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বাসিফুলের গন্ধ স্থির থাকতে দেয়নি, মাতাল করে তোলে। গোবর-এঁটু-হাতে জানালার চৌকাঠ ধরে বাইরে থুতু ফেলতে গিয়ে, মাথা ঘুরোতেই বৌদির দৃষ্টি স্থির হয় আমর ওপর।
ওখানে দাঁড়িয়ে এমনভাবে কি দেখছ?
বৌদির প্রশ্নে হিম হয়ে যাই। জানালা দিয়ে গলিয়ে আসা সূর্যের ঝাপসা আলো বৌদির বুকের পাশে যেমনটি ষোলোগুটি খেলছে তেমনি আমার পুরুষ্ট ঊরুসন্ধি একনিমিষে মাতাল হয়ে ওঠে। চট করে মাথা নিচু করে বলি, কিচ্ছু না।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, তাই গোরুঘরের কয়েকটি ধাপ এলোমেলোভাবে টপকিয়ে অজানার উদ্দেশে উধাও হয়ে যাই।
জল হিম হয়ে যাচ্ছে। হাঁক ছাড়ি, ফর্টিন প্লিজ।
কোনও সাড়াশব্দ নেই। মনে মনে বলি, কী আর বলে ডাকব? নাম তো নয়ই, শুধু নম্বর। এই নম্বরের মধ্যেই তো হারিয়ে গেছে আসল পরিচয়টি, যেমনটি ঘটেছিল পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে অবস্থানকালে, আমার পরিচয় ৪০২ নম্বরের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল।
প্রথম প্যারেডে দাঁড়াতেই প্রশিক্ষক বলেন, যখন তোমাকে উদ্দেশ্য করে ডাকা হবে তখন তুমি উত্তর দেবে ৪০২ বলে, সঙ্গে স্যার যোগ করতে ভুলো না কিন্তু।
প্রশিক্ষক শিক্ষিত ছিলেন না, তাই শিক্ষিত রিক্রুটদের তিনি তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভর্তি হয়েছিলেন বলে হয়তো-বা তার শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন পড়েনি। অন্যদের মতো তিনি অবশ্য বাঙালিবিদ্বেষী ছিলেন না, যেমন ছিল তার নিম্নপদের কর্পোরালটি, আইয়ুবের মতো দুনছিলা (দুই রূপী) পাঠান, পাঞ্জাবিও ভালো জানত। এক রাতে, পাঞ্জাবি এয়ারম্যানদের সঙ্গে পাঞ্জাবিতে গল্প করে, আমাদের কাছে আসতেই তার মেজাজ বিনা কারণে বিগড়ে গেল। পাঞ্জাবির প্রতি যেমন ছিল তার অগাধ আশাভরসা, তেমনি বাঙালির প্রতি ছিল অপরিসীম সন্দেহ আর ভয়। তার ধারণা, অপদার্থতায় নিখিল পাকিস্তানে বাঙালির সমকক্ষ আর কেউ নেই। সে মনে মনে বাঙালির সদগতির উপায় নির্ধারণ করত। সেই রাতেও সে তা করল, এবং বলল, ডন’ট স্পিক ইন গ্রিক।
কর্পোরালটির কথায় হৃদয়ে আঘাত পড়ে, কালবৈশাখীর মতো। সঙ্গে সঙ্গেই হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ—একে একে সব গভীরভাবে আমার অন্তরে জমা হতে থাকে। তাই সকল সংকল্প অকস্মাৎ ধ্বস্তবিধ্বস্ত করে জানিয়ে দিই, বাংলা হচ্ছে নিখিল পাকিস্তানের প্রধান রাষ্ট্রভাষা, তদুপরি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা।
কর্পোরালটি কোনও উত্তর খুঁজে না পেয়ে মাই বলস্ বলে বেরিয়ে গেল। অবশ্য ভেবেছিলাম এ থেকে যদি পাঠান কর্পোরালটির কিছুটা শিক্ষা হয়—পাকিস্তান পদার্থটি শুধু পাঠান ও পাঞ্জাবির নিজস্ব বস্তু নয়, বাঙালিরও দাবি রয়েছে। পরদিন, কর্পোরালটি প্যারেডগ্রাউন্ডে যাওয়ার আগেই, আমার বিছানার পাশে এসে, লে আউট ঠিক হয়নি বলে লাথি মেরে জিনিশপত্র ফ্লোরে ফেলে দিয়ে বলল, ওসব শ্রেণিবদ্ধ করে সাজিয়ে রাখো। এখন, অবিলম্বে।
তারপর, প্যারেডগ্রাউন্ডে আমার জুতোর প্রতি তাকিয়ে বলল, ঠিকমতো জুতো পালিশ করা হয়নি, তাই তোমাকে শাস্তি দিতে হবে।
কী শাস্তি!
বন্দুক মাথার ওপর তুলে ঐ-যে পয়েন্ট দেখছ সেটি ছুঁয়ে আসতে হবে।
হিন্দুকুশ পর্বতের শাখা যেখানে মাথানত করে রানওয়ের শেষপ্রান্তরে এসে মিশেছে, সেটিই সে পয়েন্ট হিসেবে নির্দিষ্ট করে। বাঙালির প্রতি তেরিমেরি যোনি পথের খাসলতে পরিণত হয়েছে এই তির্যকের। তদুপরি সে পায়ুকামী, অন্য অনেক পাঠানের মতো। পাষাণ পাঞ্জাবি হৃদয় তার। সে নরাধম বর্বর। অর্ধমুকুলিত ছিন্নলতার মতো ধরাশায়ী। অনেকে অবশ্য বলে থাকেন যে, পরিবেশ তাদের এমনটি হতে বাধ্য করেছে। এ ধরনের পরিবেশ থেকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানও নাকি মুক্তি পাননি। তাদের বদখাসলতের জন্য পরিবেশ কতটুকু দায়ী তা জানি না; তবে একথা সত্য যে, মেয়েদের স্বল্পতার কারণে বাবারা অনেক দাম হেঁকে মেয়ে বিয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ছেলের যৌবন চলে যাচ্ছে মেয়ের দাম যোগাড় করতে করতে। ফলে কষ্টলব্ধ স্ত্রীকে ভালোবাসার বদলে পিপাসানিবৃত্ত করে নির্বিঘ্নে দাসীরূপে ব্যবহার করে। কোহাট থাকাকালীন আমার পাশের বাড়ির এক পাঠান অফিসার তার স্ত্রীকে এমনভাবে প্রহার করত যে, মেয়েটির চিৎকারে আমাদের ঘুম ভেঙে যেত। আমার স্ত্রী অবিশ্যি ব্যথাবোধ করত মদ্যপ বেপরোয়া অফিসারটির নৃশংসতায়।
জল হিম হয়ে গেছে। বাথটাবে শুয়ে থাকা এখন বে-আরাম। বৌদির চুলোর আগুন যদি এখানে এসে লাগত …। জল এখন বরফবৎ। আবার ডাকি, চিৎকার করে। এবার স্নানাগারপরিচরটি সাড়া দিলো। নক করতেই ভিজে তোয়ালে কোমরে জড়িয়ে দরজা খুলে দিই। সে ভেতরে প্রবেশ করতেই এক কোণে সরে দাঁড়াই। স্নানাগারপরিচর জলে হাত দিয়ে বলল, তোমাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। এতে গরমজল দিলে তেমন সুবিধে হবে না, তার চেয়ে বরং সম্পূর্ণ জল বদলিয়ে দেওয়াই ভালো।
কথা না বাড়িয়ে শুধু বলি, থ্যাংকস।
হড়হড় করে জল বেরিয়ে পড়তে থাকে। স্নানাগারপরিচর বলল, একটু নাড়া দিলে ময়লাগুলো সহজে জলের সঙ্গে বেরিয়ে যাবে।
কথা অনুযায়ী কাজ। জল নিষ্কাশন। আবার গরম জলের আগমন। বাথটাবটা অর্ধেক ভরে যাওয়ার পর, স্নানাগারপরিচর স্নানকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর বাইর থেকে ঠান্ডাজল ছেড়ে বলল, তোমার গা-সহা-গরম হলে বলো। নল বন্ধ করে দেবো।
একসময় ঠান্ডাজলের নল বন্ধ হলো। তৃপ্তির সঙ্গে স্নান শেষ করে, গা মুছে, আগের কাপড়গুলো পরে নিই। দেশে থাকতে পায়জমা-পাঞ্জাবি পরে থাকাটাই আমার প্রিয় ছিল, নিজেকে ফিটফাট মনে হতো, কিন্তু এদেশে তো আর তা সম্ভব নয়। আগের মতো ওভারকোটটি গায়ে জড়িয়ে, ভিজে তোয়ালে দুটো হাতে নিয়ে, বেরিয়ে আসি স্নানকক্ষ থেকে। যখন ভাবছি, তোয়ালে দুটো কোথায় রাখব, তখনই দেখি বাঙালি ভদ্রলোকটি তার হাতের তোয়ালে দুটো বারান্দায় রাখা একটি পেটিকায় ফেলে দিয়েছেন। আমিও তা-ই করি। তারপর, ভদ্রলোকটি ধীরস্থির পায়ে একটি মেশিনের দিকে এগিয়ে যান। মেশিনের গায়ে লেখা— ব্রিলক্রিম; আমাকে ব্যবহার করো।
কীভাবে ব্যবহার করতে হয় সেই পদ্ধতিও লেখা রয়েছে—ছিদ্র দিয়ে এক পেনি ঢালুন, তারপর নলের মুখে হাত রেখে বোতাম টিপুন।
ভদ্রলোক লেখা অনুযায়ী কাজ করলেন, তবে তার হাতের তালুতে কোনও ব্রিলক্রিম এলো না। ক্রিম না পাওয়ার ব্যর্থতা মুখে মেখে, মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন আমার দিকে। এই ফাঁকে আমি আরেকবার দেখে নিই তাকে, তার মুখটিকে। সেই মুখে আগের মতোই শ্বাসরুদ্ধকর স্তব্ধতার বিস্ফোরণ ঘটছে। মেশিনটির বিরুদ্ধে, না কি তার মা-ভাই, তার ভালোবাসার মানুষটির বিরুদ্ধে হিংস্রঘৃণা জড়িত প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভদ্রলোকটি একপলক সুগভীরতীব্র আবেগপূর্ণ বেদনা প্রকাশ করে, ঘাড় বাঁকিয়ে, ঠোঁটের ফাঁকে অস্ফুট ভাষার প্রলেপ মেখে, দেহে শীতকালের সূর্যের বঞ্চিত বাসনার স্ফুলিঙ্গ ধারণ করে দৃঢ়পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলেন স্নানাগার থেকে। তবে তার ব্যর্থজীবনের শ্রান্তি ও দুর্বলতার দীর্ঘনিঃশ্বাসটি স্নানাগারের দরজায় লেপটে রইল।
ওভারকোট খুলে কোথায় রাখব ভেবে না পেয়ে বিছানার এককোণে ছুড়ে দিই। একইসঙ্গে বিছানায় এলিয়ে দিই শরীরটা। ক্লান্তি অনুভব করছি। ঘর গরম থাকা সত্ত্বেও হাড়ে ঢুকে পড়া কাঁপুনি থামছে না। ভাবি, কি করা যায়—তখনই একজন আমার সামনে রাখা টেবিলে বিস্কুটসহ এক কাপ ধূমায়িত চা এনে রাখল। চায়ের সুগন্ধে সমস্ত ঘরটা মাতোয়ারা হয়ে গেল।
সে আমার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে উলটো দিক থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, আমি আরমান আলি। কিতা অইছে আপনার? মনমরা দেকাইতাছে যে?
না, কুছসতা অইছে না।
চা খাউকা। একটু পরই আমি ভাত পাক করমু। ছালন যেতা আছে অতা দিয়া আমরা দুইজনে খাইলাইমুনে। ছালন খারাপ অইছে না। গতকাইল রাইনছি। বাক্কা মজা অইছে। দুপুরর খাওয়াদাওয়া করইয়া কাম যাইমুগিয়া। তখন আপনে ঘুমাইয়া তাকতা পারঐন।
আপনে আমারে খাওয়াইতা কেনে?
চায়ের কাপে চুমুক দিলো। একটা বিস্কুট হাতে নিয়ে ভিজাল চায়ে। চায়ে ডোবাতেই বিস্কুটের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্ধিসন্ধিতে ঢুকে গেল চায়ের রস। চায়ে একটু সময় সে ধরে রাখল। চায়ে-বিস্কুটে যেন প্রেমভালোবাসা বিনিময়ের জন্য একটু সময় দিলো। তারপর, দেখতে দেখতে দুটোয় মিলেজুলে টুসটুসে হয়ে গেল। বিস্কুটটা নিজেই যেন ছ্যাদড়ানো রসগোল্লা। চায়ে টুসটুসে বিস্কুটটাকে চোখ বুজে মুখে ঢোকাল, যেন অমৃত। আমার সমবয়স্ক লোকটি। টেবিলে রাখা কিছু চিঠিপত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলল, আপনে দেশ তনে আইছইন গতিকে হকলেই আপনারে এক অক্ত দাওয়াত দিয়া খাওয়াইব। তবে আমি আপনারে দাওয়াতর হিসাবে খাওন খাওইরাম না। আপনার মামুজি ও আরেকজনরে লইয়া তিনজনর বিশু আমরার। এক্কানঅ বাজার, যে যেসময় শেব পাই পাক করি। হাপ্তা হেষে ভাগ করিয়া পয়সা দেই।
এখন থাক্কি তো আমি একজন বাড়তি অইলাম।
তার গায়ে সোয়েটার। সোয়েটারের পকেট থেকে এক প্যাকেট সিগারেট বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, না আপনারে বিশু খরচ দেওন লাগব না, কাম না অওয়া পর্যন্ত। কাম অইলেই দিবাইন।
তে-কি-তা কাম অইলে সব হিসাব করিয়া দিতে অইব।
জি না, যেদিন কাম অইব, অদিন তাক্কি হিসাব। কাম নাই যার, তার রেন্টবিশু নাই। এ অইল আমরার নিয়ম।
মনে মনে বলি, বেশ ভালো ব্যবস্থা। বিদেশ এসে লোকগুলো জনদরদি হয়ে উঠেছে। সদগুণ বিকাশ জাতির জন্য মঙ্গলজনক। মহত্ত্ব ও জীবনসংগ্রামে আজ তারাই জয়ী। বাস্তবজ্ঞান ও মনুষ্যত্বের বিকাশ আজ তাদেরকে একটি বিশাল আসনে বসিয়ে দিয়েছে। জিজ্ঞেস করি, আপনি কিয়ত কাম করইন?
আমার মতন বকলম মানষর লাগি অয় রেস্টন না অয় টেইলরি। আমি ছিরামিশির তোতা মিয়ার রেস্টনর কিচিনও কাম করি।
তার সুরে একটা বেদনার আভাস উদ্ভাসিত। বিদেশে এসে সে বুঝতে পেরেছে যে, শিক্ষার মূল্য অনেক। এই মূল্যবোধটা যদি তার মতো অনেকের মনে স্থায়ী হয়, তাহলে একদিন অবিশ্যি দেখতে পাব, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শত শত বাঙালি ছেলেমেয়েকে। তারা বড়ো বড়ো ডিগ্রিধারী, বড়ো বড়ো চাকরি করে বেড়াচ্ছে। সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা ব্যতিরেকে কোনও জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। জাতিকে উন্নত করতে হলে মানুষকে শিক্ষা ও জ্ঞানের সেবাসাধন করতেই হয়। বর্তমান ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী যে-পথ ধরে একটা অসম্ভব কাজ সমাধান করছে সেই পথকে অবলম্বন করেই পরদেশের পরবাসী বাঙালিকে একটা নতুন স্থান অধিকার করে নিতে হবে। আমার মনের মধ্যে আর-এক ভাবনা এসে ভিড় জমালো—রেস্টুরেন্টের স্থলে রেস্টন যদি আমিও বলি তবে শুদ্ধ শব্দ ওরা শিখবে কেমন করে? কাজেই আমার উচিত নয়, অনাবাসী শ্রীবাসীর মতো সবসময় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা। লোকটিকে শুধাই, কয়টার সময় আপনি রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করেন?
পয়লা শিপটর কাম বারোটা তাকি তিনটা পর্যন্ত। তারপর তিনটা তাকি পাঁচটা পর্যন্ত ছুটি। দ্বিতীয় শিপটর কাম পাঁচটা তাকি একটা পর্যন্ত। দ্বিতীয় শিপটর কাম শেষ করে ঘর আইতে আইতে রাইত দুইটা বা আড়াইটা বাইজা যায়।
আপনি কি কুক?
জি না, আমি কিচিনপাউডার।
বুঝলাম না!
সে উত্তর দেওয়ার আগেই চায়ের কাপগুলো হাতে তুলে কিচেনে চলে গেল। দরজার ফাঁকে দেখতে পাই, সে ভাতের হাঁড়িটা একটা উনুনে চাপিয়ে, হাঁড়িটি চুলোয় ঠিকমতো বসেছে কিনা পরীক্ষা করতে করতে, রান্নাঘর থেকেই হেসে বলল, বউয়ের কাম করি। বরতন দই, আলু ছুলাই। সেফের ফরমাইস হুনি।
বুঝে নিলাম সে কিচেনপোর্টার।
চলবে…