
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ৭
দ্বিতীয় অধ্যায়
ছোটোমামা মানে মামুজির বাড়িতে কোনও খাট নেই। অবশ্য এ মামুজির বাড়িও নয়। ভারাটে বাড়ি। মালিকের গ্রামের বাড়ি সিরামিশি অর্থাৎ শ্রীরামশ্রী। মানুষ নিজের সুবিধে মতো নাম বদলিয়ে নেয়; যেমন ইংরেজরা কলকাতাকে ক্যালকাটা, ঢাকাকে ডাক্কা, চট্টগ্রামকে চিট্টাগাং প্রভৃতি করেছিল, তেমনি আমাদের লোকজন বিলেতে এসে এদেশের অনেক শহরবন্দর, রাস্তাঘাটের নাম নিজের ভাষায় নিজরূপে রূপান্তর করেছে; সহজকরণ করার প্রচেষ্টা যেন; রাসেল স্কোয়ারকে রসুল স্কোয়ার, লেস্টার স্কোয়ারকে লেচু স্কোয়ার, কেলোডনিয়ান রোডকে কালাদুনিয়া রোড প্রভৃতি। এমনকি বার্মিংহাম শহরের হামের স্থলে বসিয়ে দিয়েছে আমাদের সুপরিচিত শব্দ গ্রামটি। আহা কী মজা! বোঝার অসুবিধে অনেকখানি দূর করে দিয়েছে তারা। শব্দকে সহজ ও কথাকে সংক্ষেপ করতে কে না চায়, ইংরেজরা ইংলিশ-নাম মার্গারেটকে বানিয়েছে মাগি আর গভর্নরকে গাভনার, তাই বোধ হয় আমাদের লোকজন যখন ল্যান্ডলর্ডকে লেঙলুট বলে তখন ইংরেজরা ঠিকই বোঝে নেয়।
৪৩ নম্বর সেন্টল স্ট্রিটের লেঙলুট নিজ দায়িত্বে একখানা খাটের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বসানো হয়েছে খাবারের কামরায়। প্রথম রাতেই অসুবিধেটা টের পাই। রাত দুটোয় দুইজন লোক তাদের কাজ শেষে এই কামরায় এসে উপস্থিত হলো। ভাত-তরকারি গরম করার সময় শুরু হলো অপ্রত্যাশিতভাবে হাঁড়ির টুনটুন, কথার তুকতাক। ঘুমকে করল তারা রাজধানীর সন্ত্রাসীদের নিত্যদিনের হাইজ্যাকের মতো। আমার নেত্রদ্বয় বোরকা-ঢাকা মোল্লার বউয়ের আঁখির মতো উঁকিঝুকি দিলো তাদের কর্মকাণ্ড দেখার জন্য। নতুনকে আবিষ্কার করার কৌতূহল কার না মনে জাগে!
সকালে মামুজির ডাকে ঘুম ভাঙল। লোকজনের গত রাতের আচরণ আমাকে কষ্ট দিলেও প্রতিকারের কোনও উপায় আছে কিনা তা জানি না। অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বে, অকস্মাৎ অভাবিতভাবে মামুজিকে শুধাই, এভাবে খাবারের কামরায় কতদিন আমাকে থাকতে হবে?
মামুজি বললেন, দিনকয়েক সহ্য করতে হবে।
কেন? তারপর কী হবে?
আমার এক বন্ধু একটি ঘর—শ্রীভূমির মানুষ থ্রেরেজ্ হাউসকে বাড়ি বলে না, ঘর বলে; আর এরকম কয়েকটি ঘরের সমষ্টিকে বাড়ি বলে—খরিদ করেছে। ডেকোরেশন সম্পূর্ণ হতে কয়েকটা দিন লাগবে। আমাদের সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আমার মনে কেবলই প্রশ্ন। জিজ্ঞেস করি, খাটপালঙ্ক কিনতে হবে না?
সেকেন্ডহ্যান্ড দোকান থেকে খাটপালঙ্ক অল্পদামে কিনে নেবে লেঙলুট। তারপর দোকানদার এসে সব ফিট করে দিয়ে যাবে। এত মাত্র ঘণ্টা দু-একের ব্যাপার।
এমনভাবে হঠাৎ করে এক মেস থেকে অন্য মেসে চলে যাবেন কি করে?
শোবার অসুবিধে না হলে তো আর যেতাম না। তবে একটা কথা মনে রেখো, এটি মেস নয়। একটি কামরায় আমরা যে কজন বসবাস করি, সবাই মিলে সেই রুমের স্থিরকৃত ভাড়া লেঙলুটকে দিই। কেউ কেউ আবার বেড হিসাবেও ভাড়া দেয়। আমরা যার যার রান্না করি। অনেক সময় রান্নার অসুবিধে হলে দু-চারজন একসঙ্গে খাওয়ার ব্যবস্থা করে। কিচেনে সকলের সমান অধিকার। তবে কোনও পাচক নেই। আমাদের দেশের মেসের মতো এখানে সেই সুব্যবস্থা নেই। সব চেয়ে বড়ো কথা কেউ একে মেস্ বলে না।
মামুজির ব্যস্তসমস্ত ভাব। তবুও বললেন, আমি নাশতা সেরে কাজে চলে যাব। তুমি কি পারবে একা পাবলিক বাথে গিয়ে বাথ সেরে আসতে? সকালের দিকে গেলে ভালো হয়। বিকেলে প্রচণ্ড ভিড় হয়।
মামুজি উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই কিচেনে চলে গেলেন, ব্রেকফাস্ট তৈরির অভিপ্রায়ে। মনে মনে বলি, ঠিকানা জানলে অবিশ্যি যেতে পারব। লোকে বলে না, জিজ্ঞেস করে করে মুলতানও পৌঁছানো যায়! শ্রীভূমির লোকজন মুলতান শব্দটি বড্ড বেশি ব্যবহার করে। তবে কি হযরত শাহজালাল (রা.) মুলতানের বাসিন্দা ছিলেন? শুনেছি তাঁর ওস্তাদ ও মামা সৈয়দ আহমদ কবীরের মাজার সেই শহরে অবস্থিত। কতটুকু সত্য তা কে জানে? যাকগে, এখন এর সত্য-অসত্য না খুঁজে পাবলিক বাথ খোঁজা করাই জরুরি। একা পায়ে হেঁটে গেলে রাস্তাঘাট নিরর্গল-নিরুপণ-নিরীক্ষণ করতে সহজ হবে।
কিচেনে উপস্থিত হতেই দেখি, মামুজি ব্রেড ভাজা শেষ করে একটি পাইন-আপেলের টিন কাটছেন। চা তৈরির জন্য এগিয়ে যেতেই তিনি বাধা দিয়ে বললেন, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। দু-চারদিন দেখে নাও কীভাবে কী করতে হয়। তাহলে সহজে শিখে নিতে পারবে। প্রয়োজনে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে বই কি!
মামুজির আচরণ পরিমিত, কথা স্বল্প, ব্যবহার ভদ্র কিন্তু মিষ্ট। তার সঙ্গে আমার একপ্রকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একটু সরে দাঁড়াই। কিছু বলতে পারি না। মামুজি বললেন, এখন তুমি একটা প্লেটে আনারসের টুকরোগুলো ঢেলে নাও।
টিনের গায়ে পাইন-আপেল শব্দের সঙ্গে আরেকটি শব্দ লেখা রয়েছে— আনানাছ। ভাবতে অবাক লাগে, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার এই ফলটি ভারত উপমহাদেশে এসেও স্বনাম বজায় রাখল কীভাবে! তবে বাঙালি এই নামের শেষাংশ নাছকে কেটে করেছে রস। এতে বোঝা যায়, বাঙালির রুচিজ্ঞান অনেক।
চা-নাশতা শেষ হতেই মামুজি বললেন, আমি কাজে যাচ্ছি। তুমি ঘরে থেকো। বাইরে যে-ঠান্ডা পড়েছে, তাতে না বেরুনোই ভালো। আগামীকাল তোমাকে নিয়ে যাব পাবলিক বাথে।
জানি ঘরে বসে বিশ্রাম নেওয়া আমার জন্য কঠিন। চাকরি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করতেই হবে। দেখতে দেখতে সময় ফুড়ুৎ হয়ে যাবে। সময়ের অপচয় সহ্য করতে পারি না। তার ওপর অনাটনের লাগাতার দাপট কেমন করে সামাল দেবো। দেশে মাসমাইনে পেয়েই দিন কাটত কষ্টে—ঘাটতি আর ঘাটতি, বকেয়া থেকে যেত দোকানে দোকানে। বাকির খাতায় নাম উঠাত দোকানি। ছয় টাকার জিনিশ সাড়ে ছয় টাকা লিখত। ফুটো বালতির ভরসা নেই, যা ফেলা হয় তা একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যেত। বাতিল মানুষকে কেউই তখন চিনে না। হতাশার পথে একমাত্র চাকরিই সম্বল। তাছাড়া চাকরি না পেলে মামুজিই আমার অন্নদাতা, রক্ষাকর্তা, দুর্দিনের অবলম্বন। তা চাই না। চাই অতল সমুদ্রতল থেকে মুক্তো আরোহণ করে নিতে। উপযুক্ত সুযোগের আশায় দারিদ্র্য বোঝা মাথায় নিয়ে ঘরে বসে সময় নষ্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পারবও না। যে করেই হোক একটি কাজ খুঁজে বের করতেই হবে। যেকোনও কাজ। প্রথমে হয়তো-বা উপযুক্ত কাজ পাব না, পরিশ্রম সার্থক হবে না, তবুও নিরাশ হওয়া নিষ্প্রয়োজন। অনেক চিন্তা করে ধীরে ধীরে বলি, মামুজি, আজই স্নানের কাজটা সেরে নেওয়া ভালো। আগামীকাল তাহলে চাকরির সন্ধানে বেরুতে আর-কোনও সমস্যা থাকবে না।
না বাপু, দুদিন বিশ্রাম নাও। সোম-মঙ্গলবার চাকরি খোঁজার চেষ্টা করো। তুমি শিক্ষিত ছেলে, একটা-না-একটা পেয়ে যাবে। চিন্তার কোনও কারণ নেই।
মাথা নেড়ে সায় দিই। আমার সকল উচ্ছ্বসিত আনন্দকলরোল একমুহূর্তে নিভে গেল। তা লক্ষ করে মামুজি বললেন, যদি আজই স্নান সেরে নিতে চাও তাহলে চেশায়ার স্ট্রিটেই রয়েছে একটি পাবলিক বাথ।
মামুজি, একে পাবলিক বাথ বলে কেন? সব পাবলিক মিলে কি এই স্নানাগারটি স্থাপন করেছে?
না বাবা, স্থানীয় কাউন্সিলই এটি তৈরি করে দিয়েছে, সাধারণ মানুষের স্নানের সুবিধের জন্য। মেয়েদের জন্যও অবশ্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। পুরানো বাড়িগুলোয় গরম জলের ব্যবস্থা না থাকায় বাথ বসানো সম্ভব হয়নি। সেসব বাড়িতে স্নানের কোনও ব্যবস্থা নেই, যদিও বুড়ো ইংরেজরা মাসে একদিনও স্নান করে না। আজকাল অবশ্য জিপি (সাধারণ ডাক্তার) স্নানের জন্য তাগিদ দিচ্ছে। তাই সপ্তাহে যাতে একদিন স্নান করতে পারে সেইজন্য প্রতিটি কাউন্সিল, নিজের এলাকায় সুবিধে মতো একাধিক পাবলিক বাথ চালু করেছে। কালাদুনিয়া রোডে আরেকটি পাবলিক বাথ রয়েছে। তবে চেশায়ার স্ট্রিট নিকটবর্তী হওয়ায় আমরা একেই ব্যবহার করি। বাথে যাওয়ার পথে ব্রিকলেনে আমাদের লোকজনের সঙ্গেও দেখা হয়ে যায়। তুমিও হয়তো-বা পেয়ে যেতে পার।
জি আচ্ছা। তবে আমার জন্য ভাববেন না। আমি ঠিকমতো পৌঁছে যাব।
মামুজিকে বিদায় দিয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে শরীরকে গরম করতে থাকি, সাইবেরিয়া থেকে আসা শীতের মোকাবিলা করার বাসনায়; আর মনে মনে বলি, ইংরেজদের স্নানের প্রতি এত অনিহা কেন? তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠল, পাঠানের পয়মালিরূপ; সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলে যায় স্নানের নামগন্ধ থাকে না। চপ্পল পায়ে জড়িয়ে রাখে ঠিকই, কিন্তু আঙুলের ফাঁকে ধুলো ভরাট থাকে। পায়ের চামড়াও দেখা যায় না। পরনের সালোয়ারে ধুলোবালি জমে এত ময়লা হয় যে, কাপড়ের রংই বদলে যায়। মনে হয় যেন, ঠাকুরদার ব্যবহৃত কাপড় তাদের জন্য রেখে গেছেন। পাঠান ও ইংরেজ আমজনতার খাসলতে এক ধরনের মিল পরিদৃষ্টে একজন নৃবিদ্যাবিদ মন্তব্য করেছিলেন যে, আর্যজাতি সম্ভূত বলে উভয়ের যে-দাবি তা সম্ভবত মিথ্যা নয়। এই ধরনের আনপ্রেডেকটিভ ভাবনা আমাকে কাবু করার আগেই শীতবস্ত্র পরিধান করে বেরিয়ে পড়ি।
বাইরে দারুণ ঠান্ডা। শীতের দাপটে দিন পর্যন্ত জড়োসড়ো হয়ে বারো ঘণ্টার স্থলে আট ঘণ্টায় এসে ঠেকেছে, বাকি ষোলো ঘণ্টাই রাত্রি। পায়ে হেঁটে একটি পেপার শপে এসে পৌঁছি। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করি। আমার সঙ্গে শীত দোকানের ভেতর ঢুকতে পারেনি বলে স্বস্তিবোধ করি। দৈনিক টেলিগ্রাফ পত্রিকা ও ভিজিটরস লন্ডন পুস্তক কিনে ভাঙতি পেনসগুলো হাতে নিয়ে বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করি, ব্রিকলেন কত দূর? প্লিজ।
উত্তরে ছেলেটি বলল, সামনের রাস্তা পেরিয়ে কয়েক গজ এগুলেই দেখতে পারবেন অজবর্ন স্ট্রিট। সেই পথে হাঁটলে আপনি পৌঁছে যাবেন ব্রিকলেনে।
ছেলেটির কথামতো পথ অতিক্রম করতেই দেখতে পাই একটি বাড়ির পাশে লেখা—অজবর্ন স্ট্রিট লিডিং টু ব্রিকলেন। সাবধানে পা চালাই। জানুয়ারির শীত। বরফগলা জলে পিচ্ছিল পথ। আমার জুতোর তলা প্লেন। পিছলে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি। অজবর্ন স্টিট ধরে হাঁটতে শুরু করি। রাস্তাটি প্রায় ফাঁকা। একটি গ্যারেজের গায়ে লেখা—সাইন অ্যান্ড ডিসপ্লে ইংন্ডাস্ট্রি। অপরপাশে গোটা কয়েক দোকান। তারপর ব্রিকলেন। অবহেলিত জনপথ। ডানদিকে আমার খেয়াল বেশি—চেশায়ার স্ট্রিট যদি চোখের আড়াল হয়ে যায়। সামনে বিরাট এক ফ্যাক্টরি, সগর্বে বড়ো বড়ো অক্ষরে শোভা পাচ্ছে—ট্রুম্যান; খ্যাতনামা মদ্য কারখানা। আরও একটু সামনে এগুতেই বাঁদিকে দেখতে পাই একটি মুদির দোকান—তাজ স্টোর। কাচের জানালা দিয়ে তাকাতেই লক্ষ করি দোকানের মহাজন একজন স্বজাতি পৌঢ়। তাকে একজন বয়স্ক গৌরী সাহায্য করছেন। খদ্দেরকে জিনিশপত্র দিচ্ছেন স্মিতমুখে। প্রৌঢ় বাঙালির স্ত্রী হয়তো-বা হবেন।
ডান দিকের মোড়েই চেশায়ার স্ট্রিট। সেদিকে মোড় নেই। রাস্তার শেষপ্রান্তে অবস্থিত একটি পাবলিক বাথ। অবশেষে, আধমাইল পথ পেরিয়ে, নিশ্চুপে ব্রিকলেনের বাঙালির মুখের দিকে একটু তাকিয়ে, পুরাতন একটি ফ্যাক্টরির পাঁচিল ঘেঁষে, মাথাভাঙা ওক গাছটিকে পাশ কাটিয়ে, জুতোর শব্দের সঙ্গে রাস্তায় ছুড়ে ফেলা পত্রিকার পাতাগুলো শীতের ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে এলোমেলোভাবে উড়িয়ে, মামুজির দেওয়া ঠিকানায় এসে উপস্থিত হই। স্নানাগারের বাতাস হুঁকোর ফুটোয় মুখ লাগিয়ে দম ধরে থাকা অবস্থা যেন। গরম করে রাখা স্নানাগারে প্রবেশ করে, অসহনীয় শীতের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। কী শীতরে বাবা! আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে যেন। শীতের দারুণ রোষের বিরুদ্ধে শক্তি ব্যয় করে স্নানার্থীরা এখানে এসেছে। উপায় নেই! সতেজ থাকার আয়োজন কেই-বা রুখতে করতে পারে! আজ স্নানার্থীর সংখ্যা কম। উত্তেজনা নেই। উচ্ছ্বাসও নয়। সবেমাত্র শুরু হয়েছে বোধ হয়। এখানে পৌঁছতেই আমার মনে সৃষ্টি হলো—হেমন্তের নরম রোদে পাকাধানের গড়াগড়ি।
তোয়ালে-সাবান-শ্যাম্পুর দর-লেখা ঝুলন্ত বোর্ডের নিচে একজন মধ্যবয়সী গোরা কাউন্টার জুড়ে বসে আছে; তার গায়ে ময়লাযুক্ত, এলোমেলো দাগকাটা একটি টি-শার্ট। লাইন ধরে এগুতে থাকি। হঠাৎ জানালার পাশ থেকে একটি বিড়াল ঝাঁপিয়ে পড়ল টেবিলের ওপর, পাতাঝরার মতো নিঃশব্দে। তারপর পা টিপে টিপে, সন্তর্পণে এগিয়ে এলো গোরাটির দিকে। ফিকে-নিকষ-হিমেল আলো ভেঙে গোরা হাত বাড়িয়ে বিড়ালের পিঠ ছোঁয়াতেই সে যেন কেমন নড়ে উঠল; পশমে ছোটো ছোটো তরঙ্গ, মৃদু কাঁপুনি। ক্ষণিকের জন্য সে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থেকে গোরাটির হাত ও বাহু বেয়ে টেবিলের নিচে লুকিয়ে যাওয়ার মতলব খুঁজতে থাকে। তারপর মৃদুভাবে টেবিলের ওপর ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা কাগজগুলো নাড়িয়ে, টুপ করে মেঝেয় পড়ে দৌড়াতে থাকে, দৌড়ানোর চাল সে জানে। এমন অদ্ভুত বিড়াল কখনও হাত বুলিয়ে দেখিনি, জীবনান্বেষণে এরকম অদ্ভুত প্রাণীকে আপন করে নেওয়ার কথা হয়তো-বা এর আগে কখনও ভাবিনি। বিড়ালটি অদৃশ্য হয়ে গেল চেয়ারের পেছনে, কিছুক্ষণের জন্য। আবার ফিরে এলো। সে জানে সচেতনভাবে পা ফেলে দ্রুত হাঁটতে। কখনও সামান্য বেগে, আবার কখনও তার মাঝামাঝি—সবই যেন আমার কাছে এক আশ্চর্য অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
চলবে…