
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ৬
ট্রেন চলতে শুরু করল আবার। ইংরেজ ভদ্রলোক চা পান শেষ করে ফিরে এসে নিজ আসনে বসলেন। একটা দিয়াশলাই জ্বেলে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলেন। ভদ্রলোকটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আড়চোখে দেখতে থাকি। তিনি যে একসময় সুপুরুষ ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নাকটা চিকনসরু। টানাটানা চোখ। নম্র চোখদুটোকে উজ্জ্বল করে বললেন, চায়ের স্বাদটা মোটেই ভালো ছিল না। আজকাল ভালো চা পাওয়া যায় না। ইন্ডিয়া ও সিলোনের চা-বাগানের তত্ত্বাবধানে আমাদের লোক যখন ছিল তখন চায়ের স্বাদ ছিল ভিন্ন, এখন আর পাওয়া যায় না।
কথাগুলো স্বগতোক্তির মতো শোনাল। এর অর্থ কী তা সহজেই বুঝতে পারি। সুবুদ্ধি ইংরেজের জমাখাতার হিসেবনিকেশ। অবশ্য এই হিসাবের মধ্যে অনুপস্থিত চা-বাগানের ঋণগ্রস্ত কুলিদের ইতিবৃত্ত; তাদের বিবৃত্তি; ইংরেজ ম্যানাজারদের কুব্যবহার। কিন্তু স্পষ্ট করে কিছুই বলা হলো না। তার আগেই একটি স্টেশনে ট্রেনটি থামতেই ভদ্রলোক তাড়াহুড়ো করে ওভারকোট গায়ে জড়িয়ে গুড বাই বলে নেমে পড়লেন। অথচ বলতে ইচ্ছে ছিল- ইংরেজদের জন্যই আমাদের যে কত বড়ো ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। ইংরেজ-ধর্ম, ইংরেজ-আদর্শ, ইংরেজ-ঐহিত্য- এসব বৈশিষ্ট্যকে আশ্রয় করেই তো আজ ভারতবর্ষ জুড়ে নানা সমস্যা, নানা ব্যর্থতা, কোটি কোটি মানুষের দুঃখদারিদ্র্য, স্বাস্থ্যহীনতা, উপযুক্ত সুযোগের অভাব ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের যে-বৈশিষ্ট্য, যা আমাদের নিজস্ব সেগুলোকে বাদ দিতে গিয়েই তো আজ ভারর্তবর্ষে জনগোষ্ঠীর কপাল সর্বদিক থেকে ব্যর্থ, বঞ্চিত। অবশ্য ভদ্রলোকের কথার উত্তর না দিতে পেরে নিজেকে ধন্যবাদ দিই; কারণ, উত্তর দিতে গেলেই ভদ্রলোকের মনজুড়ে একটা খারাপ ধারণা জন্মা নিত আমার দেশ সম্বন্ধে; ভারতবর্ষকে নিয়ে একটা বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হতো।
স্টেশনের নাম নিউনিটন। তাহলে আরও কয়েকটি স্টেশন ফেলে এসেছি। আমার সেদিকে খেয়াল ছিল না। এভাবে দেশের ভাবনায় তন্ময় হয়ে থাকলে চাকরি করব কী করে? সম্ভব নয়। তাই ধৈর্য ধরতে হবে। সাধনা, পরিশ্রম ও ধৈর্য ছাড়া এই বিশ্বসংসারে কোনও উন্নতি হয় না। যদিও মনাত্মা চিরকালই স্বদেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তবুও মনঠাকুরকে শক্ত রাখতে হবে। বিদেশে এমনই সবাই করে। সাম্যক পারদর্শিতা লাভ করতে হলে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়। রাতারাতি কেউ বড়ো আকারের মানুষ হতে পারে না। অন্তর শক্তিকে ক্ষুদ্র করলে চলবেন না। কিছুদিনের জন্য আসা, দুদিন পর তো স্বদেশে ফেরতে হবে। আমার অন্তরের মধ্যে যেন একটি আনন্দের উৎস প্রবাহিত হতে থাকে। অন্যমনস্কের মতো চিন্তা করতে থাকি, ট্রেন থেকে নামব কিনা।
ছোটো স্টেশন। পত্রিকার কোনও দোকান প্লাটফর্মের দেখা গেল না। নামব নামব বলে ইতস্তত করছি এমন সময় ট্রেনই ছেড়ে দিলো। কোনও কিছু ঠিক করতে আমার বড্ড দেরি হয়। তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভ্যেস করা একান্ত প্রয়োজন। এই-যে ভদ্রলোকের সিগারেট অফার ফিরিয়ে দিয়েছিলাম- স্মোক করি, তবে অল্প; এখন স্মোক করতে ইচ্ছে হচ্ছে না বলে; তার ফল হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। শরীরে টনটনানি শুরু হয়ে গেছে। তাই লতিফউল্লার দেওয়া প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দিয়াশলাই জ্বেলে অগ্নিসংযোগ করে দীর্ঘ একটা টান দিই, গাঁজায় দম দেওয়ার মতো। মনে হলো নিকটিন রক্তের সঙ্গে মিশে শিরাগুলোকে সতেজ করে তুলছে। আহা, কী তৃপ্তি! তাই বোধ হয় লিখে দিয়েছে প্যাকেটের গায়ে- সিনিয়র সর্ভিস সেটিসপেক্ট্রি। এক প্যাকেটের দাম কত? কে জানে! এফোর্ড করতে পারলেই হয়।
ট্রেনের বেগ কমে এলো। বিশাল রাগবি জাংশন স্টেশনে এসে ট্রেনটি থামল। রাগবির ঘোড়দৌড় বিশ্ববিখ্যাত। করাচিতে দেখেছি, এই ঘোড়দৌড়েরর টিকেট বিক্রি হতে। শুনেছি, লাইগ্যা যায় তো ছাপ্পর মাইরা দেবো- একেবারে কোটিপতি। এই জুয়ার স্পৃহা আমার নেই। ছেলেবেলার স্মৃতি এখনও জাগ্রত। একবার অন্য ছেলেদের সঙ্গে সরকার বাজারের বারুণি মেলায় গিয়েছিলাম এক টাকা নিয়ে; ঘুড়ি ও উকড়া কেনার জন্য। জুয়ার ফাঁদে পড়ে টাকাটি হারিয়ে কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরতে হয়। মেলার মূল আকর্ষণ- পেরেক ঢুকিয়ে জিহ্বাকে ছিদ্র করে ধারালো কিরিচের ওপর দাঁড়িয়ে মেলাপ্রদক্ষিণ করা- আমার দেখা হলো না। এ নিয়ে কত দুঃখ করেছি।
ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গেই নেমে পড়ি। একটা পত্রিকা কিনতেই হবে। সামনেই পেপার শপ। কোন পেপার কেনা যায়? পাকিস্তানি এয়ারফোর্স রিডিংরুমে বিদেশি পত্রিকার মধ্যে গার্ডিয়ানই ছিল আমার পছন্দের। গার্ডিয়ান পত্রিকাটি হাতে তুলে নিই। কত দেবো? এখনও ইংলিশ মুদ্রার হিসাবটা সঠিক মতো মিলাতে পারছি না। ভাবি, এক পাউন্ডের একখানা নোট দিলে হয়। ফেরত ভাঙতি ভালোভাবে গোনে নিলেই বোঝে নেব পেনস আর শিলিংয়ের হিসাবটা। পেপার শপের পাশেই ফলের দোকান। আঙুর, আপেল নানাবিধ ফলের সম্ভার। কলাগুলো বিশাল। সাগরকলার চেয়েও উত্তম। দেশে থাকতেই জানি, ইংল্যান্ডে ষাট দিন শুধু ফসল ফলে, বাকি তিনশত পাঁচ দিনের খাদ্য আমদানি করতে হয়। কথাটি এখন দেখছি সত্য নয়। কী বিরাট মাঠ দেখছি; এক-একখণ্ড জমি তিন একরের চেয়েও বিশাল। আর আমাদের তিনখণ্ড জমিতে এক একরও হয় না। যাক, কিছু আঙুর কিনে নিলে ভালোই হয়। দোকানিকে বলি, আমাকে আধা পাউন্ড দেন তো প্লিজ।
এই বলে মনে হলো এই বাক্যের একাধিক অপ্রয়োজনীয় শব্দ বাদ দিলেও হতো। যতকম শব্দে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, ততই ভালো। ভাষার সৌন্দর্যই এখানে। যেমন, এক্ষেত্রে বলা যেত- আধ পাউন্ড প্লিজ। প্লিজ শব্দটি অনুরোধ, আহ্বান ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ব্যবহার্য। তবে যত্রতত্র ব্যবহার করা আবার অশোভনীয়; যেমন, আপনি কেমন আছেন? বাক্যটির সঙ্গে প্লিজ যোগ করা সঠিক নয়।
গার্ড বাঁশি বাজাল। গ্রিন ফ্লাগ উড়ল। ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি পত্রিকা ও আঙুর নিয়ে গাড়িতে উঠি। সিটে বসে পত্রিকা হাতে নিতেই চোখে পড়ল, পাকিস্তান থেকে আগত ইশমত খান বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে ব্রাডফোর্ড হাসপাতালে অন্তরীণ। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সম্পাদকীয় পড়ে আর বুঝতে বাকি থাকেনি যে, এখন পাকিস্তানি মানেই সন্দেহের পাত্র। পত্রিকার সম্পাদক অবশ্য আহ্বান জানিয়েছে, সরকারকে অবিলম্বে যথাবিহিত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। জনসাধারণ যাতে আতঙ্কিত না হয় সেজন্যই এমন উপদেশ সম্পাদকীয় প্রবন্ধে দেওয়া হয়েছে। মনে হলো, সম্পাদক যেটুকু বলেছেন, জনসাধারণের পক্ষে আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পত্রিকায় চোখ রেখেই দেখি, ওয়াটফোর্ড স্টেশনের মধ্যে ট্রেনটি ঢুকে পড়েছে।
ট্রেনটি থামল। লক্ষ করি, যাত্রীদের উঠানামা। নামার আগে কেউ ট্রেনে উঠতে চেষ্টা করছে না। একদলের নামা শেষে হলেই অন্যদল ট্রেনে উঠছে। আমার সামনের আসনে এসে বসলো একজন নারী। বাঁ হাতের আঙুলের ফাঁকে একটি জ্বলন্ত সিগারেট। নখগুলো অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ। দুঠোঁটে কড়া লিপস্টিক। ভুরু সজ্জিত। বয়স পঁচিশের চেয়ে কম হবে না। পঁয়ত্রিশও হতে পারে। আন্দাজ করা ভারি কঠিন। সঠিক বয়স রংঢঙে ঢাকা পড়েছে, লাবণ্যশূন্য চাকচিক্যে। স্কাট হাঁটুর ওপর। বাঁ হাঁটুটি ডান হাঁটুর ওপর তুলে শক্ত হয়ে বসেছে সে, যেন বরোয়া-বাঁশ। চুল বাঁশের কঞ্চির মতোই আলগা আলগা, এলোমেলো। আসনের সঙ্গে অ্যাশট্রে যুক্ত থাকা সত্ত্বেও ছাই ফেলছে মেঝেয়। কেমন এক অস্থিরতায় ভরা তার ধরনধারণ।
ট্রেন বেগ বাড়িয়ে দিলো। কীসের তাড়ানায় কে জানে! বিশ মিনিটের মধ্যেই এসে পৌঁছল ইউস্টোন স্টেশনে। আমার কাঙ্ক্ষিত লন্ডন শহরে। এখানেই ট্রেনের যাত্রা শেষ। তাই ধীরেসুস্থে নামতে কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার মধ্যে প্রিয়ামিলনের একটা তাগিদ অনুভব করি। ব্যাগটি হাতে তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি ট্রেন থেকে নেমে পড়ি।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসার সময় বাঁ দিকে তাকাতেই দেখি, একটা রাস্তা নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। সাইনবোর্ডে লেখা- আন্ডারগ্রাউন্ড, অর্থাৎ পাতাল রেলস্টেশন। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম বিস্ময় টেমস নদীর সুড়ঙ্গপথ। তবে কি এ-ই সেই সুড়ঙ্গপথ! পরে দেখে নেব বলে মনকে সান্ত্বনা দিই।
ভিড়ের সঙ্গে হাঁটিহাঁটি পা পা করে প্রধান রাস্তায় এসে পৌঁছি। একই রাস্তা ধরে হাঁটাতে হাঁটতে কয়েক মিনিট পর, বাঁদিকে তাকাতেই দেখি, মন্দিরচূড়ার মতো উঁচু একটি দালানের মাথায় লেখা- সেন্ট প্যানক্রাস। রাস্তা থেকে যে-সিঁড়ি ওপরে ওঠে গিয়েছে তারই পাশে বসে একজন বুড়ো আর একজন বুড়ি বোতল থেকে কী যেন গড়গড় করে গলদেশে ঢালছে। মদ হবে নিশ্চয়। সেদিকে আর পা বাড়াতে মন চায়নি। মন্দিরচূড়ায় স্থাপিত ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখি, সাড়ে সাতটে বাজছে। পত্রিকায় দেখেছিলাম, সূর্যাস্ত সোয়া চারটায়। তবে কি বেশ রাত হয়ে গেছে! আর দেরি করা উচিত হবে না, একটি ট্যাক্সি নিয়ে ছোটো মামার বাসায় চলে যাওয়াই উচিত। তখনই একটি কালো রঙের গাড়ি আমার দিকে এগিয়ে এলো। সামনে লেখা- ট্যাক্সি। শব্দটিকে আলোর সাহায্যে উজ্জ্বল করে রাখা হয়েছে। হাত ইশারায় কাছে ডাকি। কাছে আসতেই বলি, ৪৩ নম্বর সেন্টল স্ট্রিট প্লিজ।
ড্রাইভার দরজা খুলে বলল, ভেতরে প্রবেশ করুন।
মিনিট ত্রিশের মধ্যে ট্যাক্সিটি ৪৩ নম্বর সেন্টল স্ট্রিটের সামনে এসে দাঁড়াল।
দশ শিলিং নিয়ে সে বিদায় নিতেই দরজায় নক করি। কপাট খুলে আমাকে অনেকেই লুফে নিল। মনে হলো আমি যেন তাদের অসময়ের আম্রমুকুল!
চলবে…