
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ৪
রাত দুটোর পর, আমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছি। ফুটপাতের সঙ্গেই লাগানো দরজা। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করি। কয়েকবার ডাকাডাকিও। কিন্তু কারও পাত্তা পাই না। অল্পক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। ঘুমজড়ানো চোখে এক ব্যক্তি এসে দাঁড়াল। মুখ দেখেই চিনতে পারি। শরিয়তউল্লা। গ্রাম আমার মামার দেশে। ভারি নিরহংকারী মানুষ। পরনে সুতির লুঙ্গি। গায়ে ময়লা-ধরা একটি গেঞ্জি। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল আমাকে।
ড্রাইভার পুলিশ অফিসারের কথানুযায়ী এক পাউন্ড নিতে নারাজ, চায় দুই পাউন্ড। কথা কাটাকাটি না করার জন্যই তাকে দুই পাউন্ড দিতে বাধ্য হই। বিদায়বেলা একে অপরকে ধন্যবাদ বিনিময় করতে ভুলিনি। সে অবিশ্যি ইংরেজ নয়, ইংরেজ হলে এমনটা করত না; সঙ্গে সঙ্গেই এ কথাও স্মরণে এলো, ইংরেজ সহজসরল হলে কি ভারতবর্ষকে পৌনে দুইশত বছর শোষণশাষণ করতে পারত!
বহুদিন পর আমাকে পেয়ে শরিয়তউল্লা বড্ড খুশি। বলল, বাথরুমে সিংক আছে- হাতমুখ ধুয়ে নিন। রান্নাঘরে যাচ্ছি। আপনি আসতে আসতেই ভাত, তরকারি গরম করে ফেলব।
তার আর দরকার কীসে? তোমাকে পেয়েই তো আমার পেট ভরে গেছে।
আপনাকে কিছু-না-কিছু অবিশ্যি খেতে হবে। পেট খালি থাকলে ঘুম আসবে না। আর আপনার এখন সবচেয়ে প্রয়োজন, কয়েক ঘণ্টার সুখনিন্দ্রা।
বাথরুমের কাজ সেরে রান্নাঘরে উপস্থিত হতেই দেখি, এক ডেকচি জল গ্যাসের আগুনের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে শরিয়তউল্লা। তার ওপর ছিদ্রওয়ালা একটি পাত্রে অর্থাৎ কেলেন্ডারের মধ্যে ভাত চাপানো হয়েছে। ডেকচির ফুটন্ত জলের বাষ্প কেলেন্ডারের ছিদ্রপথে প্রবেশ করে ভাতকে গরম করে তোলে, ভাপাপিঠা তৈরির প্রণালির মতো। সালনের ডেকচি অন্য চুলায়। কুকারে চারটি চুলা। এইভাবে ভাত ও তরকারি গরম করে পাশের একটি টেবিলের ওপর এনে রাখল সে। টেবিলটি ছোট কিন্তু চৌকো। একদিক দেয়ালের সঙ্গে ঠেকানো। তাই তিনজন বাদে চারজনের জায়গা হওয়া কঠিন। প্লেট বিছালো সে। হাতে সার্ভিংচামচ। ঘাড় বাঁকিয়ে একরকম তৃপ্তির হাসি মুখে এনে বলল, বসে পড়ুন।
এই দৃশ্যটি বুকের এক গোপন জায়গায় আঘাত করল। মনের পর্দায় ভেসে উঠল ফেলে আসা সংসারের কথা। প্লেট থেকে চোখ তুলতেই দেখি, শরিয়তউল্লার কানের পাশের চুলগুচ্ছ এলোমেলোভাবে বাতাসে ঝুলছে। তার দিকে তাকিয়ে, খেতে খেতে বলি, অসম্ভব ভালো খাবার তৈরি করেছ ভাই। অবিকল দেশের মতো স্বাদ।
সে মিটিমিটি হাসল। পেট ভরে না খাইয়ে সে ছাড়ার মতো মানুষ নয়। খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর, বেডরুমে নিয়ে আসতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াই। সিংকে হাতমুখ পরিষ্কার করে নিঃশব্দে তার পিছু পিছু একটা রুমে এসে উপস্থিত হই। ছোটো কামরা। দুটো খাট। শয্যা পাতা। একটি ডাবল, অন্যটি সিংগল। দুই বিছানার মধ্যে হাতদেড়েক ফাঁকা জায়গা। একটি লুঙ্গি এগিয়ে দিয়ে শরিয়তউল্লা বলল, এটা পরে ইজি হয়ে একটা ঘুম দেন।
কথা বলার ফাঁকেই ডাবল বেডে আমার স্থান করে দিলো। আমার দিকে চোখ নিবদ্ধ করে বলল, এ বিছানায় আমরা দুজন থাকি।
জিজ্ঞেস করি, আরেকজন কোথায়?
সে এখন কাজে। তার এক সপ্তাহ দিনে আর এক সপ্তাহ রাতে কাজ। এই সপ্তাহে একাই এই বিছানায় থাকব।
পাশে শূন্য সিংগল খাটটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করি, আর এই বিছানার লোকটি?
লুঙ্গির খুট দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, সে আমার মামাতুতো ভাই। তার গ্রাম দশঘর। চার বছর আগে জাহাজ থেকে উঠে এসেছিল বিলেতে। উঠেই লাপাত্তা। অনেক খোঁজাখুঁজি পর, গত বছর তাকে ধরে এখানে নিয়ে আসি।
শরিয়তউল্লার মুখ দেখেই বুঝতে পারি, তার স্বাভাবিক সহৃদয়তা ও চিরাভ্যস্ত সহিষ্ণুতার সুযোগ নিয়ে তার মামাতুতো ভাই অকারণ ও অভাবিত এক রূঢ়তায় তাকে আঘাত করেছে। এই আঘাতের কথা স্মরণে আসায় পলকের জন্য তার মুখ বেদনায় পাণ্ডুর চাঁদ হয়ে উঠল। মন দিয়ে শুনি তার কাহিনি। মামাতুতো ভাই একটি কারখানায় কাজ করত। কাউকে কিছু না জানিয়ে যা পেত তা দিয়ে দিত নির্জন নিঃসঙ্গ অপরিচিত এক বুড়িকে। বৃদ্ধাদের জন্য কল্যাণসমিতি সৃষ্টির উদ্দেশে নয়, বরং বুড়ির মেয়ের আত্মাসাধনে। সেই মেয়েটির তখনও ষোলো হয়নি। ভাইটি চেয়ে থাকত রহস্যময়ী এই মেয়েটির দিকে, আর বুড়ি খিচার দিকে। আমি কিছুটা বিমনা হয়ে পড়ি, হঠাৎ খিচা শব্দটি কানে আসতেই সচেতন হয়ে জিজ্ঞেস করি, খিচা মানে?
পে-প্যাকেট। একে আমরা খিচা বলি।
ভাবি, দুর্দশাপন্ন, ঋণগ্রস্ত বুড়ির দুঃসময়ের একমাত্র সম্বলই এই খিচা। নিজ অন্তরের সম্মান প্রত্যাখ্যান করে সামান্য কয়েকটি টাকার জন্য মেয়েটিকে ভিক্ষা দিয়েছে এক ভিনদেশির কাছে। আমার মনে বুড়িটার বিরুদ্ধে একটা কঠিন ঘৃণা পরিপুষ্ট হয়ে জন্ম নিল। শরিয়তউল্লা বলে চলল, অবশেষে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে পাঠিয়েছিলাম দেশে। কিন্তু কাজ হলো না। তার মা-ভাই তাকে আটকে রাখতে পারেনি। বাবা নেই, শাসন করার কেউ আর এই জগতে নেই। ফলে বিয়ে না করেই ফিরে এলো মাকাল ফলের আশায়।
ইংরেজকে মাকাল ফল বলছ কেন ভাই?
শরিয়তউল্লা সহসা উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তারপর বালিশের নিচে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, যদি সাদা মেয়ে কালো ছেলের পিছু ঘুরে, তবে বুঝতে হবে এর ভেতর কিন্তু একটা আছে।
দিয়াশলায়ের কাঠিটা জ্বেলে শরিয়তউল্লা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করল। আমার ঠোঁটে রাখা সিগারেটেও আগুন ধরাল। একমুখ ধোঁয়া কুণ্ডলী আকারে বের করে জিজ্ঞেস করি, কিন্তুটা কী ভাই?
এসব মেয়েগুলো আসলে ইংলিশ নয়। বেজাত রাস্তার মেয়ে। বাপ সম্বন্ধে তারা অবগত নয়। ঠিক জানে না, কে তার আসল বাপ। এসব মেয়েরা বুঝতে পেরেছে, বাঙালি ছেলেরা সেবাদাসে পারদর্শী আর আফ্রিকানরা শরীরতেজে রাক্ষস। প্রয়োজন অনুযায়ী বেছে নিচ্ছে তাদেরকে নিজেদের রকমফের ক্ষুধা মেটানোর সামগ্রী হিসেবে।
ক্ষণকাল নিঃশব্দে ভাবতে থাকি, তাই তো এসব বাজে মেয়েদের কথাই বোধ হয় মজমিল আলি আমার বাড়িতে বসে আমার স্ত্রীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিলেন, মজা করার অভিলাষে। তারপর চিন্তিত অধোমুখে প্রশ্ন করি, তাহলে এসব বাঙালি ছেলেরা বিলেত আসার কারণকেই পণ্ড করে দিলো? ফেলে আসা পরিবারের দরিদ্রতার লজ্জা ঢাকবে কী দিয়ে যদি সে মেমসাহেবের মহব্বতে বেতাব হয়ে যায়?
শরিফতউল্লা কোনও মন্তব্য করল না। কেবল অন্তরের বেদনায় দুচোখ প্রসারিত করে তাকাল। তার ভাই সম্বন্ধে এরকম অবস্থার সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়, অসংগতও নয়; তা সে জানে। নিরুপায় অনুশোচনায় বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল তার। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, চেষ্টা করছি তাকে ফিরিয়ে রাখতে সেই চুম্বকের আকর্ষণ থেকে। তাই তো আমাদের ফ্যাক্টরিতে কাজ জোগাড় করে দিয়েছি। নাইটশিফট। তবে কতদিন সাদা চামড়ার চকচকানি থেকে নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারবে! যাক, আপনি এখন বিছানায় আসুন, আর দেরি করা ঠিক হবে না।
বালিশে মাথা রাখলেই তো আর ঘুম আসবে না।
আপনার এখন তো তারই প্রয়োজন।
কিছুক্ষণ স্থির থেকে, ধীরে ধীরে বলি, সকালের প্রথম ট্রেনে লন্ডন চলে যাব।
কেন? এখানে অসুবিধে আছে?
বাধা রয়েছে। দ্বিধা রয়েছে। অথচ ভেতরে ভেতরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেও তা প্রকাশ করতে পারছি না। প্রশ্নটা আমার মনের মধ্যেই থেকে গেল। সেই দ্বিধা প্রকাশ করতে পারছি না বলেই বোধ হয় আমার মানসিক চাপটা বেড়ে গেল। সিদ্ধান্ত মতো আমাকে চলতেই হবে। নিজের বিশ্বাসের প্রতি আস্থা আর অপরের ওপর নিজেকে সমার্পন না করার দ্বন্দ্ব এখনও যায়নি।
না। তবে…।
বাধা দিয়ে শরিয়তউল্লা বলল, এত তাড়াহুড়ো কীসের! আপনার মামা এখানে না থাকলেও আমরা তো আছি। আপনার কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
না, তা নয়।
তাহলে থেকে যান দিনকয়েক। তারপর যাওয়ার চিন্তাভাবনা করা যাবে।
ক্ষণকাল তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলি, আবার যখন আসব তখন তোমাদের সঙ্গে দিনকতক কাটানো যাবে। এখন সকালে যেতে পারলেই ভালো।
আচ্ছা দেখা যাবে। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।
সকালে চোখ মেলতেই দেখি, বেডরুম শূন্য। আশপাশে কেউ নেই। আমি একা। আমার ঘুমে যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সেইজন্য কেউ এই রুমে আসেনি। নাইটশিফট করে যারা ফিরে এসেছে তারা নিজ বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়নি। আমার জেগে উঠা পর্যন্ত অপেক্ষায় ডাইনিং রুমে বসে গল্প করছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনতে পাচ্ছি তাদের ঝাপসা কথাবর্তা। বিলেতি জীবনের প্রথম সুখনিদ্রায় মগ্ন আমি। জানালাপথে যেটুকু আকাশ দেখা যাচ্ছে তা বেশ পরিষ্কার। সুর্য দেখা না গেলেও তার জ্যোতি অনুভব করা যাচ্ছে। বিলেতে এই আমার প্রথম সকাল। আঁখিভরে তা উপলব্ধি করছি, ব্ল্যাংকেটের নিচে শুয়ে শুয়ে। ভাবনার জগৎ জুড়ে স্থান করে নিয়েছে আমার মামার গ্রামের লোকগুলো। তারা আমার জন্য ঘুমোতে যায়নি। মনে মনে লজ্জা পাই। আমার দেহটা খুবই স্বার্থপর। সারারাত তারা কাজ করে ঘরে ফিরেছে আর আমি দিব্যি ঘুমিয়ে রয়েছি। পরক্ষণে উপলব্ধি করি, তাদের আত্মার টান আমার জন্য কত গভীর। মনটা ভেতরে ভেতরে স্নেহ-উচ্ছ্বসিত-আবেগে ভরে উঠল। মামার গ্রামের অনেক লোকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় রয়েছে। তাদের প্রাণের টান আমাকে লৌহকঠিন একাগ্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করে। এমতাবস্থায় আমার কি উচিত তাদের সামনে না গিয়ে শুয়ে থাকা! না, উচিত নয়। উঠে বসি। বসার ঘরের দরজা ফাঁক করতেই একসঙ্গে অনেকেই আনন্দপ্রকাশ করল। আমার মধ্যে মাতৃভূমির পবিত্র মৃত্তিকার সোঁদা সোঁদা গন্ধ শুঁকে তৃপ্তি পেতে চায় তাদের শোষিত বঞ্চিত মেহনতি আত্মা। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি তাদের যে-গভীর আকর্ষণ এই তার বহিঃপ্রকাশ। প্রত্যেকের সঙ্গে কুশল সংবাদ আদান-প্রদানের পর একে একে নিজ নিজ বিছানায় চলে গেল। লতিফউল্লা রয়ে গেল আমার দেখাশোনার দায়িত্বে। শুধু আজকের জন্য। একটি দিনের জন্য সে ডেইলি নিয়ম ভেঙেছে।
লতিফউল্লার আসল নাম আব্দুল লতিফ। তার গ্রামের লোকরা তাকে ডাকে লতিফউল্লা বলে; কারণ, তাদের মতে এতে বোঝানো হয় যে, সে তালুকদারশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত নয়। এরকম ধারণা থেকে অনুমান করা সহজ যে, শ্রীভূমির লোকরা অত্যন্ত জাতপাতে নাক উঁচু। তারা ভূমিহীন, কৃষক, ক্ষেতমজুরদের জন্য তৈরি করেছে স্বকীয় পদ্ধতি। যেন উজান স্রোতে বেঁধে দিয়েছে জীবনভেলা; ফলে তা ক্ষণস্থায়ী।
প্রত্যেকেই এক পাউন্ড করে আমাকে দিলো। লতিফউল্লা আমার জন্য নাশতা তৈরি করতে গেল কিচেনে। দেশে থাকতেই জেনেছি, বিলেতে সবাই নিজের রান্না নিজেই করে। আমাকেও করতে হবে। আমি তার পিছু পিছু কিচেনে এলাম। সে বাধা দিলে বলি, শীঘ্রই শিখে নেওয়া ভালো।
চলবে…