
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ৩
যে-লোকটিকে নিয়ে এই গল্প, সে নিরন্তর দাঁড়িয়ে আছে একটি রুই মাছের সামনে। মাছের ডালায় অস্থির রুই। তারই পাশে শান্ত জলে ঘুরে ঘুরে মরছে শিং-মাগুর। চিংড়িগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে একটি মাছের থালায়। মাছবিক্রেতার সামনের মাছের ডালায় নানা মাপের, নানা বয়সী, নানা রঙের মাছ চিত হয়ে রয়েছে। লোকটি ঠিকই থমকে দাঁড়ায় রুইমাছের ডালাটির সামনে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আর বিড়বিড় করে কিছু আওড়াতে আওড়াতে গভীর মনোযোগে রুইমাছে রূপালি আঁশ পরীক্ষানিরীক্ষা করে চলেছে। মাছটির দামাদামির সঙ্গে ভিড় জমে উঠতে থাকে।
আরেকটুকু সময় কাটল। বাজার থেকে ছোটো মাছগুলো আস্তে আস্তে উধাও হতে থাকে। লোকটি অবিচলিত। খানিকটা ক্লান্ত ও খানিকটা উত্তেজনা মেশানো চোখে কয়েকবার দেখে নিল রুইমাছটিকে, মানুষের ভিড়কেও। মানুষ যেমন একা-একাকী হাসে স্মিত ও সুন্দরভাবে, রূপালি মাছটিকে দেখে ঠিক তেমনি লোকটিও একবার হেসে নিল; ধানক্ষেতের সঙ্গে যেন আঁড়ি দেওয়া অদ্ভুত চাঞ্চল্যময় অসংখ্য অগুণতি সাদাকালো দাড়ি নেড়ে। হঠাৎ লোকটি মাছবিক্রেতাকে বলল, মাছটা তুইল্লা দে।
ময়লা ছেঁড়া মোটা সুতোর আদমজি মিলের লুঙ্গি মাছবিক্রেতার পরনে, যেমনতেমন। খালি গা। রোদ আর ছায়া ষোলোগুটি খেলছে তার চওড়া কাঁধে, পেটানো বুকে আর মাংসপেশিতে। গবির গোবরো মাছবিক্রেতাকে লোকটির কেমন যেন লাগছে। ছেঁড়াফাটা চৈত্র মাঠের মতো চামড়া আর চেয়ালভাঙা রুক্ষ মুখের ভাঁজে-অভাঁজে সুদীপ্ত তার খিদের আগুন।
লোকটির পাশে টুকরি হাতে দাঁড়ানো তার ভৃত্য। তাকে বিরক্তিভরা কণ্ঠে হুকুম দিলো, টুকরিটা আগগুয়াইয়া দে!
মাছবিক্রেতা আটকা পড়ে গেল লোকটির রঙিনজালে। তার সমস্ত মনজুড়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য একরকম স্তব্ধতা নেমে এলো। উইপিংট্রির মতো নুয়ে পড়েছে যেন তার অনুতপ্ত অপরাধী মন। লন্ডনি এখন শক্তিশালী, তার সঙ্গে অন্যায় করা মহাপাপ। অন্যায়ও ন্যায় হয়ে যায় পুঁজিপতির অর্থের কাছে; কারণ, টাকার গন্ধই আলাদা, দেহমন বিগড়ে দেয়, ন্যায় অন্যায় বোঝে না, অন্যায়কে ন্যায় বলে চালিয়ে দেয়। মাছবিক্রেতা কাঁচুমাচু করে বলল, টেকাগুইন লন্ডনিসাব?
লোকটি ধমকের সুরে বলল, কাইল বাড়িত গিয়া আনিছ।
ধমকের ধরন দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে জনতা। মাছবিক্রেতা একবার জনতার দিকে চোখ তোলেই নামিয়ে নেয়, একমাথা ঝাঁকড়া চুলের আড়ালে মুখখানা আমসি হয়ে যায়, বুকের মধ্যে ধানকলের শব্দ ওঠে- ঘস ঘস; আশাভরসা চড়চড় করে ভেঙে যায়। মাছবিক্রেতার ঠোঁটে দুঃখ কাঁপতে থাকে, তবুও মিনতিভরা কণ্ঠে বলল, আমরা গরিব মানুষ। মাছ বেইচ্চা পেট বাছাই।
নারাজ হয়ে ভেংচে উঠল লোকটি, বকওয়াছ করিছ না, তরা বড়ো মিছা মাত মাতছ।
কথার ঢঙে চারদিকে থোকা থোকা জনরব গড়াগড়ি গেল। মাছবিক্রেতা বলল, না, লন্ডনিসাব, আল্লার কছম। মাছ বেচ্ছা মাজনের টেকা দিয়া যা লাভ অইব তা ত্থাকি চাউল, লবন, মরিচ কিনিয়া বাড়িত যাইমু। চাউল না লইয়া গেলে ঘরগুষ্ঠি, হাবিগুষ্ঠি না খাইয়া মরব।
লোকটি মানিব্যাগ থেকে কয়েকটি নতুন নোট বের করল। তাদের মধ্য থেকে একটি নোট খুঁজতে খুঁজতে বলল, তরা বড়ো দিগদারি দেছ। তারপর আমজনতার দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করল, হাছানায়নিবা, তোমরা কিতা কউ? অবশেষে অভিনয়ের ভঙ্গিতে বলল, এই নে। বামহাতে একটা নোট ছুড়ে মারল মাছবিক্রেতার দিকে। লক্ষ্যচ্যুত হয়ে নোটটি গিয়ে পড়ল কাদামাটিতে, মাছবিক্রেতার পায়ের কাছে। এবার তার অভাবের জবাব মেঘ হয়ে মুখে নামল। নোটটি কুড়িয়ে নিয়ে কাঁচুমাঁচু হয়ে বলল, ইতায় তো খরিদঐ অইছে না। গরিব মারউক্কানা লন্ডনিসাব্। ই-নোটত আপনার হাতর মইল। আরেক খান দেউক্কা।
আরেকখানা দিমু তরে পরে, খোশ অইয়া।
আইজ বাচাউক্কা।
তাচ্ছিল্যদৃষ্টিতে মাছবিক্রেতাকে একবার দেখে নিয়ে জনতার ভিড় থেকে বেরিয়ে এলো লোকটি। টাই টাইট করতে করতে দৃপ্তপদক্ষেপে এগিয়ে চলল। কিছুটা পথ অতিক্রম করে দোকানের বারান্দায় পা রেখে জনতার দিকে আরেকবার ফিরে তাকাল। মুচকি হাসি মুখে টেনে জনতাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করল লোকটি। একজন প্রৌঢ় বেরিয়ে আসেন দোকান থেকে। তার চোখে লোকটির চোখ পড়তেই বললেন, গরিবর খাসলত অমলাখানই অয়। খুদায় খামাকা গরিব বানাইছন না।
লোকটির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন প্রৌঢ়টি। মুখখানা সত্যিই শিশুর মতো। লোকটিকে ভীষণ গভীর দৃষ্টিতে নিরীক্ষা করে নেন; মনে হচ্ছে তার খুব চেনা চেনা। পৌঢ় বললেন, সাধুহাটির মিয়া বাড়ির রোজগারি না তুমি?
লোকটি কোনও উত্তর দিলো না। তার মুখটি একমুহূর্তে শ্মশান হয়ে গেল। চোখে চিতার আগুন যেন জ্বলে উঠল। লোকটি এলোপাথারি পা ফেলে দোকানে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করল। প্রৌঢ় ‘থ’ হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর, ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বললেন, হায়-রে লন্ডনি! কত খেলা দেখাবে তুমি! আর কত খেলা খেলবে তুমি!
ট্রেন চলতে থাকে আপন গতিতে। রাত্রি বেড়ে চলল। আমার আঁখিপুটে নিদ্রাবেশের কোনও চিহ্ন নেই। চিত্ত উত্তেজনায় অস্থির। সামনের সারিতে বসা একজন প্রৌঢ়ের নাক-ডাকা শুরু হয়েছে। মৃদুমন্দ। মুখমণ্ডল ও হাতের আঙুলগুলো ছাড়া সর্বাঙ্গই কাপড়ে আবৃত্ত। মাথার টুপিটা কেবল বিদ্যুৎ-আলোকে দর্শকের নয়নপল্লব থেকে আগলে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত। আমার পাশে বসা যুবতিটি দিব্যি ঘুমোচ্ছে। কোনওরকম সংকোচ-শরম আছে বলে নিদ্রালস মুখমণ্ডলের কোনও রেখাই প্রমাণ করছে না। পাতলা নায়লনের টাইট-পরা পদযুগল সামনের বেঞ্চে স্থাপিত। স্কার্ট হাঁটুর অনেক ওপর ওঠে গেছে। এতে কি নিদ্রাদেবীর লজ্জা হচ্ছে! বোধ হয় না। অবশেষে নিদ্রাদেবী আমাকেই পেয়ে বসলেন। আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। কতক্ষণ এইভাবে কাটল তা ঠিক বলতে পারি না, অল্পক্ষণই হবে, ট্রেনের একটি ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা টুটে গেল। সামনের সারির গোরাটিও উঠে বসেছে। জানি না, সে কতক্ষণ ধরে জাগ্রত। সে আধো আধো চোখে যুবতির ঊরুর প্রতি গভীরদৃষ্টিতে পরীক্ষারত বলে মনে হলো। যুবতির ডান পা আসন থেকে নিচে নেমে এসেছে। হাঁটু বাঁকা করে গোড়ালি ঠেকেছে মেঝেতে। ফলে পুষ্ট গোছার অবস্থান সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঘুমের ঘোরে সে টেরই পায়নি তার পদযুগলের বিচ্ছিন্ন অবস্থানকেও।
নতুন একজন টিটিই এসে ঢুকল কামরায়। টিকেট দিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ম্যানচেস্টার আর কত দূর?
এই মাত্র আমরা স্টোকসিটি পেরিয়ে এলাম। এক ঘণ্টা লাগবে না, খুব সম্ভব পঞ্চাশ মিনিটেই ট্রেন পৌঁছে যাবে ম্যানচেস্টারে।
যুবতিকে না জাগিয়েই টিটিই চলে গেল। দরজাটা একটু জোরে বন্ধ হওয়ায় একটা বিকট শব্দ হলো। আর সেই শব্দে ঝটপট বসনকে ভূষণে পরিণত করে কটমট করে যুবতি তাকাল নতশির গোরার দিকে। যেন সাঁড়াশি দিয়ে তার আঁখিতারা উপচে বেরিয়ে আসতে চায়। একজন সুন্দরী, সুভাষী যে, একমুহূর্তে অমন চামুণ্ডারূপিণী হতে পারে তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
আমার মন আলোড়ন সৃষ্টি করে দিলো ম্যানচেস্টার শব্দটিকে ঘিরে। এই শব্দটি বাঙালির কাছে বড়োই বেদনাদায়ক। ম্যানচেস্টারের লুমে তৈরি কাপড় যাতে অবাধে ভারতবর্ষের বাজারে বিক্রি হতে পারে, সেইজন্য ঢাকার বিখ্যাত মসলিন-নামক মিহিন বস্ত্রের প্রস্তুতকারী তাঁতিদের বৃদ্ধাঙ্গুলি কর্তন করে দিয়েছিল দুর্ধর্ষ ইংরেজ বণিকগোষ্ঠী। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, এতকাল ভারতবর্ষে বসবাস করেও বাঙালি ধরতে পারেনি ইংরেজ বণিকগোষ্ঠীর সঙ্গে তার সম্পর্কটা কী। ইংরেজ বণিকগোষ্ঠী ভারতবর্ষকে স্বার্থপরের মতো ভোগদখল করে নিয়েছিল। সে তৈরি করেছিল নানারকম জটিলতার বেড়াজাল, সংকীর্ণ ও আত্মমগ্ন জাতীয়তাবোধ। কিন্তু বাঙালি ভুলে গেছে তার এক বিশাল ভূখণ্ড ছিল, অফুরন্ত সম্পদ ছিল- এসবকে যত্ন করে সঞ্চিত রাখা উচিত। বাঙালি আজ পৃথিবীর এক সরল, গরিব, উদ্বিগ্ন জাতি। তাকে বোকা বলে বর্তমান পৃথিবীর উন্নত জাতিগুলো প্রত্যাখ্যান করছে। এই অপমান অবশ্য বাঙালির গায়ে লাগে না।
এই পথে বহুদিন ধরে যাতায়াত করছে বলে স্টেশনটা চিনতে ভুল হলো না যুবতির। ভুল হওয়ারই কথা ছিল। বরফের কারণে বাইরটা বড্ডই আচ্ছন্ন-আবছা। তার ওপর গোরার ব্যবহারে ছিল অন্যমনস্ক। সে ঠিকই, সময়মতো, প্ল্যাটফর্মে পা দিলো। প্ল্যাটফর্মে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চুপ। তার যেন কোনও তাড়াহুড়ো নেই। উপভোগ করছে বরফভেজা বাতাসকে। বরফভেজা বিলেতি মাটিকে।
ট্রেনটি আবার সচল হলো। বাইরে তাকালেই দেখি, ইংল্যান্ডের রাত্রির চমৎকার পরিচ্ছন্ন পল্লি। এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই একসময় আমার গন্তব্যস্থানে এসে পৌঁছল ট্রেনটি।
কালেক্টরের হাতে টিকেট দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখি, তিনটা প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া ভারাটে কোনও ট্যাক্সি নেই। চারপাশে বরফ। ভাবি, অল্পক্ষণেই আমার হাতপা বরফঠাণ্ডা হয়ে যাবে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে চাকরিকালে প্রাপ্ত গরম পোশাক এখন পরনে থাকলে হাড়কাঁপুনি শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেত। কিন্তু এখন চিন্তা, মাতৃদত্ত প্রাণটি নিয়ে হাইডে, মানে চেশায়ারে অবস্থিত আমার নিরাপদস্থানে যাওয়ার উপায় কীভাবে অনুসন্ধান করব! এমন সময় ট্রেনের সেই গোরাটি কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী খুঁজছ?
আমার ইংরেজি উচ্চারণ তাকে আকৃষ্ট করেছে বলে মনে হলো। সে এক পা অগ্রসর হয়ে আমার মুখের কাছে মুখ এনে বন্ধুর মতো বলল, দেখলে তো রমার কাণ্ড; একেবারে মারমুখী। কোন কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে দেয় সেই ভয়ে আমি নীরব ছিলাম। তুমিই বলো, এ কেমন কাণ্ড! সে নারী হয়েছে বলে কি পুরুষের মাথা কিনে ফেলেছে? নারী হয়ে তুমি যা ইচ্ছে তা-ই করবে আর পুরুষ শুধু বাহ্বা দেবে? তুমি আনভিজ বের করে শুতে পার, কিন্তু আমি তা দেখে ফেললেই লজ্জায় তোমার মাথাকাটা যায়। এর আগে লজ্জানুভূতি কোথায় ছিল?
গোরার কথায় আমার মনে কোনও রকম দাগ কাটল না, তা অনুভব করেই বলল, ট্যাক্সির জন্য ভেবো না। এক্ষুনি এসে পড়বে। না হয় ওই যে আলো দেখছ, ও-ই যে।
কিছুই চোখে পরছে না। দূরে একটা বিদ্যুৎ-বাতির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলল, ওই-যে দালানের ওপর বিদ্যুৎ-বাতিটি জ্বলছে তাই হচ্ছে স্থানীয় পুলিশফাঁড়ি। সেখানে গেলে তারা একটা ট্যাক্সি ডেকে দেবে।
অসংখ্য ধন্যবাদ। তাহলে আসি।
আরে যাচ্ছ কোথায়? এখানে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলেই ট্যাক্সি পেয়ে যাবে। আমি তারই জন্য অপেক্ষারত।
আমার বড্ড ঠাণ্ডা লাগছে। হাঁটলে শীত লাঘব হবে।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই হাঁটা শুরু করি। তার সাহচর্য আমার পছন্দ হয়নি। ট্রেনে প্রায় তিন ঘণ্টা একটানা বসেছিলাম। একটি কথাও আমার সঙ্গে হয়নি। সে বলতেও চায়নি। এখন যুবতিকে গালমন্দ করার উপলক্ষ্যে আমাকে উপদ্রব করা আর কি! পাজির হদ্দ! একশ্রেণির লোক আছে, যাদের বয়স যত বাড়ে তাদের মন তত নোঙরা হয়। ঘুমন্ত সুন্দরীর জঘন দেখার চেষ্টা জঘন্য নয় কি? অবিশ্যি জঘন। ঊরুদ্বয়ের সংযোগস্থলে চোখ গেড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা চোখের জিনা নয় কি! সংগমের প্রকারভেদ মাত্র। একশত একবার দোররা খেতো, মোল্লার ফতোয়া মোতাবেক, যদি পাকিস্তানে বসবাস করত।
সামনেই পুলিশফাঁড়ি। ইংল্যান্ডের পুলিশ নাকি বন্ধুসুলভ প্রকৃতির। কিন্তু পাকিস্তানে পুলিশ দেখলে আমজনতা ভয় পায়, না জানি কোন ফ্যাসাদে ফেঁসে দেবে- এই ভেবে! হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকি, পুলিশের সঙ্গে শুরুটা কীভাবে করা যায়! মনে পড়ল- করাচির উপশহর কোরঙ্গিক্রিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর উচ্চতর ট্রেনিং স্কুলে কারিগরি শিক্ষার একজন প্রশিক্ষক মিস্টার কারম্যানের কথা। তিনি স্বদেশীয় পুলিশের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। তার কাছ থেকে বিলেতি প্রচলিত কায়দাকানুন অনেকটা নিজ আয়ত্তে নিয়ে এসেছি। একদিন…
মিস্টার কারম্যান বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাকে অফিসার বলে সম্বোধন করলে তাদের উপযুক্ত সম্মান দেখানো হয়। সর্বদা মানুষের উপাধি দিয়ে সম্বোধন করবে। একজনের উপাধিকে উপেক্ষা করে কেবল স্যার বলা হীনমন্যতার পরিচায়ক।
কেন?
বারবার স্যার বলে সম্বোধন করাকে বলা হয়- তোষামোদ। প্রত্যেক ভাষায়ই একটা অমার্জিত রূপ আছে। এই অমার্জিত কাজকে ইংরেজিতে বলে টিসি করা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, স্যার বলার প্রবণতা বা ঝোঁক বেড়ে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে। যেমনি স্কুল-কলেজে, তেমনি অফিস-আদালতে, ব্যাংক-বিমায় সর্বত্রই স্যারের প্লাবন দেখা যায়। জনাব, মহাশয়ের আকাল পড়েছে।
তাকে চেপে ধরি, টিসি শব্দের অর্থ কী?
টেকটিকোল সান্ডার । যেমন, আইযুব খানকে সম্বোধন করতে জনাব প্রেসিডেন্ট বলাই যথেষ্ট। শোনোনি আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে সম্বোধন করা হয় মিস্টার প্রেসিডেন্ট বলে। এই স্থলে তোমরা বলো- মহামান্য, দেশবরেণ্য আরও কত কী!
স্মরণ করিয়ে দিই, হার-ম্যাজিস্টি, হিজ-একসেলেন্সি গ্রেট ব্রিটেনেই ব্যবহৃত হয় সবচেয়ে বেশি।
উত্তরে বলেন, ইংরেজ মূলত রক্ষণশীল জাতি। দাসত্ব মনোবৃত্তি পরিহার করতে অক্ষম। তোমরা স্বাধীন হয়েছ, কাজেই এসব ব্যপারে আমেরিকাকে অনুকরণ করা উচিত। ইংরেজ গালভরা উপাধি ধারণ ও বিতরণে ওস্তাদ, উম্মাদ। আমরাই তো কেরানিকে বাবু, মেথরকে জমাদার বলাতে শিখিয়েছি। তেমনি আমাদের দেশেও কনেস্টবলকে পুলিশ অফিসার আর লন্ডন শহরের সর্বোচ্চ পুলিশ অফিসারকে চিফ কনেস্টবল বলে থাকি।
পুলিশফাঁড়িটি দেখতে বেশ সাদামাটা। ভেজানো দরজায় মৃদু করাঘাত করতেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, প্রবেশ করো।
ধাক্কা দিয়ে দরজা খোলতে পারলাম না। ভাবি, এ কেমন পুলিশ স্টেশন বাবা! ধাক্কা দিলে দরজা খুলে না। এ-যে মহাবিপদ! এখন তাহলে কী করি? নজরে পড়ল দরজায় লেখা রয়েছে, পুল, অর্থাৎ দরজায় টান দাও। টান দিতেই দরজাটি খুলে গেল। ভেতরে প্রবেশ করে দেখি, অর্ধবৃত্তাকার একটি টেবিলের পিছনে একটি চেয়ারে বসা একজন পুলিশ অফিসার। টেবিলের পাশে এগিয়ে এসে বলি, গুড মর্নিং অফিসার।
সম্বোধনে পুলিশ খুশি হয়েছে বলে মনে হলো। প্রত্যুত্তরে গুড মর্নিংয়ের সঙ্গে যোগ করল, আমি কী করতে পারি তোমার জন্য?
হাইড যাবো। একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা যদি করে দিতে পার অনুগ্রহ করে।
আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। টেবিলের একপাশে ফায়ার প্লেস। কয়লার আগুন জ্বলছে ধকধক করে। সেদিকে অঙ্গুলিনির্দেশে পুলিশ অফিসারটি বলল, শরীরটা একটু গরম করে নাও।
আমি রাজি হই। আগুনের পাশের একটি চেয়ার দেখিয়ে পুলিশ অফিসারটি বলল, ওখানে গিয়ে বোসো, ততক্ষণে আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে দিচ্ছি। আশা করি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।
ড্রাইভার আসতেই পুলিশ অফিসার আমাকে বলল, ড্রাইভারের সঙ্গে যাও। সে তোমাকে পৌঁছে দিবে তোমার গন্তব্যস্থলে। তাকে এক পাউন্ড দিয়ে দিয়ো।
ড্রাইভারের নাম ও ট্যাক্সির নম্বর ডায়েরিভুক্ত করতে পুলিশ অফিসারটি ভুললো না।
চলবে…