
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ৩০
মামুজির বন্ধু গাভনার শব্দটির দ্বারা সম্বোধিত হতে ভালোবাসেন, তাই তার বদনাকাশ থেকে আষাঢ়ের মেঘ অপসারণ করার প্রয়াসে বলি, গাভনার সাহেব, আপনার এত বড়ো জমিদারি- বাংলোতুল্য বাড়ি, ঝাড়বাতির মতো কত বিজলিবাতি জ্বালিয়ে রাখছেন- রাতদিন, বিরতিহীন, অবিরাম, সময়-অসময়, প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে। এই বিদ্যুৎ প্রস্তুতিপ্রণালিবিষয়ক বিদ্যায় আমি অভিজ্ঞ, কিন্তু তিনি অজ্ঞ। তিনি জানেন না, কীভাবে বাতি জ্বলে। তিনি এটুকুও জানেন না, আপনার সামনে রাখা থালার আনারস টুকরোগুলোকে কীভাবে তিন মাস তরতাজা রাখা হয়েছিল, আরও কত কী।
এই অজ্ঞতা তো শ্রোতাদ্বয়েরও। তাই বুঝি মামুজি চটকানো ডিম নিয়ে কুকারের কাছে চলে গেলেন আর গাভনার সাহেব আনারসের টিন উপুড় করে থালায় ঢেলে খালি টিনটা ডাস্টবিন লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলেন, সজোরে; যেমন শাশুড়িকে আঘাত করতে না পেরে পুত্রবধূ ঝালমিটায় ঘুমন্ত শিশুর ওপর। আমি নীরব দর্শক। উঠেও যেতে পারছি না, কিছুও বলতে পারছি না। নাশতা না করে বেরিয়ে যাওয়াটাও বেয়াদবির অংশ কিনা! অগত্যা দৃষ্টিস্থাপন করি দেয়ালে, যেখানে গ্যাসমিটারের কাঁটা আবর্তিত হচ্ছে সেইখানে; কাঁটাটি আপন মনে পৃথিবীর আবর্তনের মতো এগিয়ে চলেছে।
গাভনারের আনারস দিয়ে লোফ খাওয়ার লোলুপতাজনিত গপাগপ্ আওয়াজ আমার কানে ভেসে এলো। সঙ্গে সঙ্গেই মন ছুটে চলল পাকিস্তানের কোহাট বিমান বন্দরের দিকে; যেখানে রানওয়ের মেরামতকর্মরত পাঠানকে দেখেছিলাম আমরুদ মানে পেয়ারা দিয়ে তন্দুর খেতে। লন্ডনেও সেদিন দেখেছি, বিল্ডিংয়ের গর্ত খননরত কর্মীরা টমেটো দিয়ে ব্রেড খাচ্ছে, তারা উন্নত জাতি কিনা, তাই নাম দিয়েছে উন্নত ধরনের- স্যান্ডউইচ। আসলে দুই স্লাইস ব্রেডের মাঝখানে কাটা টমেটো আর কী! আমাদের দেশে মাটিকামলারা পান্তাভাত মরিচ-পোড়া দিয়ে খেয়ে মাটির সঙ্গে মল্লযুদ্ধে নামে। দুনিয়ার সকল মাটিকামলা রাজার খাওয়াদাওয়ায় স্বাদ পায় না, তারা ভালোবাসে আমরুদ-তন্দুর, টমেটো-ব্রেড, পান্তাভাত-লঙ্কাঝাল; তা দিয়েই পেট ভরে উঠে ওদের। আজ আমার মন একটু মহৎ হতে বড্ড ইচ্ছে করল; অন্তরাত্মা বলতে লাগল- দুনিয়ার সকল মাটিকামলা এক হও। এক হও শোষিত, বঞ্চিত, মেহনতি বন্ধুরা। লৌহকঠিন একাত্মার বন্ধনে আবদ্ধ হও। এই বন্ধন অটুট রাখো যতদিন পর্যন্ত না শোষকসমাজকে ভেঙে তোমাদের বেঁচে থাকার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করছ। তোমাদের শক্তিই হবে নূতন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ।
খারাপ মুড নিয়েই বেরুতে হলো। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমি; হয় চাকুরির সংস্থান, নয় লন্ডন থেকে প্রস্থান- কোথাও-এক অপরিচিত স্থানে। ব্রিকলেন থেকে বেরিয়ে কমার্শিয়েল স্ট্রিট ধরে হাঁটতে থাকি, ফুটপাত ভেঙে, আর ভাবতে থাকি, রেলওয়ে বিভাগে চাকুরির সম্ভাবনা বেশি; শুনেছি- কর্তৃপক্ষ ইউনিয়ন মেম্বারশিপ নিয়ে চাকুরির আবেদকারীকে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করে না, অযথা প্যাঁচাল পারে না। সামনে একজন পুলিশকে পেয়ে জিজ্ঞেস করি, অনুগ্রহ করে বলুন তো এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো রেলস্টেশনটি কোথায়?
উত্তরে পুলিশ বলল, সামনেই দেখতে পাবেন। বামদিকে যে-রাস্তাটি চলে গেছে তার নাম শরডিচ্ হাই স্ট্রিট, তার শেষ প্রান্তে লিভারপুল স্টিট রেলস্টেশনটি অবস্থিত। পায়ে হাঁটলে বেশ সময় লাগবে। বাসে যাওয়াই উত্তম।
আমার অবস্থা না জেনে, না বোঝে অফিসার একটি সুব্যবস্থা বাতিয়ে দিলো। এ-যেন আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের পিরপুরোহিতের ব্যবস্থা- রোগীর অবস্থা না বোঝে যেকোনও রোগেরই এক ব্যবস্থা- ঝাড়ফুঁক, জলপড়া।
রাজপথ থেকে স্টেশনটি দেখা যায় না। স্টেশনের অবস্থান জেনে নেওয়ার জন্য আবার পুলিশের সাহায্য নিতে হলো। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসতেই দেখি এলাহি কাণ্ডকারবার! চোখ টেকানো দায়। আমাদের জেলা শহরের মতো বিশাল। লোকেল লাইন, ইন্টরসিটি লাইন। অনেক প্লাটফর্ম। ঝলমলে লোভনীয় চেহারা নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বইয়ের দোকান প্রভৃতি। দোকানের বাহার। রেলওয়ের নিজস্ব দুটো স্টোরও রয়েছে। এরকম ভিড় আর-কোনও স্টেশনে দেখেছি বলে মনে হয় না। সমস্ত স্টেশনটাই যেন একটা অবিরাম ব্যস্ততার চালচিত্র। দোকানে অনেক লোক কাজ করছে। শিখ-পাঞ্জাবিই বেশি। বাঙালি একজনকে দেখতে পাই ক্যানিটিনে, তবে কথা বলিনি, কাউন্টারের ভেতর সে ব্যস্ত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখি, কিন্তু নক করে চাকুরি আছে কি জিজ্ঞেস করতে মন সায় দিলো না। কতদিন যাবৎ এই ধরনের প্রশ্ন করতে করতে মনে একপ্রকার লজ্জা দেখা দিয়েছে, যার কিয়দংশ যদি বাংলাদেশের ভিক্ষুকরা পেত, তাহলে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো, আর তার পরিবর্তে সম্মানজনকভাবে জীবন ধারণের ব্যবস্থা আদায়ের জন্য বিপ্লব বা সংগ্রামে লিপ্ত হতো।
লন্ডন শহরেই দেখেছি, এক মদখোর বুড়ো এক পান্থের কাছে হাত পেতে পেনি প্লিজ বলতে। পান্থ উত্তরে বলে, সরি, আমার কাছে নেই। অর্থাৎ তার কাছে ভাঙতি নেই; যেমন- আমাদের দেশে বলে মাফ বা ক্ষমা করো। গিন্নি হয়তো-বা বলেন, হাত অবসর নেই। অর্থাৎ, না দেওয়ার অজুহাত। আবার গিন্নির যদি প্রয়োজন পড়ে ভিক্ষা দেওয়ার; যেমন- শিশুসন্তানের রোগমুক্তি কামনায় অথবা অন্যকোনও কারণে মানত, সেই ক্ষেত্রে ভিক্ষুককে বিমুখ হয়ে ফিরে যেতে হয় না; অন্যকথায় প্রয়োজন ব্যতীত কেউ কিছু দেয় না; ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া কোনও কারবার নেই এই পুঁজিতান্ত্রিক জগতে। দয়াদাক্ষিণ্য, দানখয়রাত- সবকিছুর মূলেই ব্যক্তিস্বার্থই নিহিত- পার্থিব নয়তো পারত্রিক; বিনা প্রয়োজনে কেউ হাতি পোষে না; প্রতিদান পাওয়ার আশায়ই পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের একজন মানুষ অন্যকে সাহায্য করে, কর্মের বিনিময়ে টাকা দেয়, পরলোকে পুরস্কৃত হওয়ার আশা না থাকলে মানুষ কি স্রষ্টাকে সম্মান করত! না, করত না। সম্মানিত, প্রশংসিত ও প্রকাশিত হওয়ার ইচ্ছে ও উদ্দেশ্যে স্রষ্টার কি সবকিছু সৃষ্টির মূল কারণ নয়? কাজেই যে-দোকান বা কারখানার মালিক চাকর রাখতে চায় শুধু তার কাছেই চাকুরি পাওয়া যায়; যার প্রয়োজন নেই, তার কাছে চাকুরির আবেদন জানানো বৃথা; কাজেই দেখা যায়- হে গাভনার, আমাকে চাকুরি দাও- বলে দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দেওয়া নিরর্থক; গাভনার তার প্রয়োজন অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দেবে, কর্মপ্রার্থী তার যোগ্যতা অনুযায়ী আবেদন করবে; ডিমান্ড অনুযায়ী সাপ্লাই- এই সূত্রেই খদ্দের কেনে- এই তো পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম। এসব আকাশপাতাল, মাথামুণ্ডুছাই ভেবে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা শুরু করি। পেট চুইচুই করছে- রাগের মাথায় সকালের নাশতা ঠিক মতো হয়নি।
ব্রিকলেনের মাথায় অজবর্ন স্ট্রিটে পৌঁছতেই দেখতে পাই, ইংলিশ পোশাক পরিহিত মোল্লার গোল টুপির মতো কী যেন একটা শোভা পাচ্ছে এক পৌঢ়ের মাথায়। সেদিক থেকে চোখ ফেরাতেই দেখতে পাই, অজবর্ন স্ট্রেটের সাতাশ নম্বর দালানের গায়ে- সাইন অ্যান্ড ডিসপ্লে ইন্ডাজট্রিজস্ লিমিটেডের নোটিশবোর্ডে একটা কাগজ এঁটে দিচ্ছে একজন গৌরি। দ্রুতপদে ওর কাছে গিয়ে, অবশ্য কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে, দেখতে থাকি বিজ্ঞাপনটি, বিষয়বস্তুটি। অন্তরে এক অভূতপূর্ব আনন্দ নৃত্য করে উঠল। চেয়ে দেখি বিশ ঊর্ধ্ব যুবতীর আবরণহীন মস্তকের সোনালি কেশপাল বাতাসে মাতাল, আমার উতলা অন্তরের সঙ্গে আড়ি পেতে যেন। বিজ্ঞাপনটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যে গৌরির খুব সন্নিকটে এসে দাঁড়িয়েছি সেদিকে খেয়ালই নেই। এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছি যে, আমাদের সমাজের বিবেচনায় বেশরম-বেআক্কেল অবস্থা। যখন সচেতন হই তখন দেখতে পাই, গৌরি পাশ ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে টুকরো টুকরো হাসি ছুড়ছে। সুযোগ পেয়ে বলি, কাজটির জন্য আমি আবেদন করতে চাই।
স্বাভাবিক স্বরে সে বলল, ভালো। এ বিষয়ে তোমার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা আছে?
হ্যাঁ, আছে।
একথা শোনামাত্র তার ডানহাতটি আমার দিকে এগিয়ে দিলো। বিলেতি যুবতীর প্রথম সাদরসম্ভাষণে অভিভূত। এতে বর্ণবাদের কৃত্রিমতা নেই। আছে শুধু মানুষের প্রতি মানুষের প্রীতির প্রকাশ। মনে মনে বলি, আমি চাই তোমার তুলতুলে হাতের স্পর্শে আমার আলাদিনের প্রদীপটা জ্বলে উঠুক। পাতালপুরে রমার আগমনে রমরমা হোক আমার ললাট।
আমার সঙ্গে এসো।
পদ্মিনীকে অনুসরণ করি।
ম্যানেজারের অফিসের দ্বারের কাছে এসে মুচকি হেসে বলল, সার্টিফিকেটগুলো দাও?
প্রশংসাপত্রসহ সার্টিফিকেটগুলো ওর হতে তুলে দিই। এগুলো হাতে নিয়ে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, একটু অপেক্ষা করো, প্লিজ।
কোনও অসুবিধে নেই।
সে নক করে ম্যানেজারের অফিসের ভেতরে উধাও হয়ে গেল। তাদের নাকে নাকে কথাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে এলো আমার কানে, দ্বার ভেদ করে; কিন্তু সঠিক অর্থ বোঝা গেল না। মিনিট পাঁচেক পর, মেয়েটি বেরিয়ে এসে আমাকে ভেতরে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানাল। ভেতরে প্রবেশ করতেই সে বলল, মিস্টার অ্যাইভার, জেনারেল ম্যানেজার।
বলি, গুড আফটারনুন।
ম্যানেজারের টেবিলের সামনে উপস্থিত হতেই একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে মেয়েটি বলল, বসো।
ধন্যবাদ। বসতে বসতেই ম্যানেজারের উদ্দেশে বলি, হাউ ডু ইউ ডু।
তিনি হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর দিয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। তারপর দুটো মামুলি প্রশ্ন ও উত্তর, তারপর তিনি বললেন, আমার সেক্রেটারি তোমার সম্বন্ধে ভালো রেফারেন্স দিয়েছে।
সার্টিফিকেট ও প্রশংসাপত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখছেন, কিন্তু কোনও মন্তব্য করলেন না, বরং বললেন, আমি তোমাকে চাকুরি দিচ্ছি। আশা করি আমার সেক্রেটারির প্রত্যাশার কোনও ঘাটতি হবে না, বরং যোগ্যতা প্রমাণে সচেষ্ট হবে।
কৃতজ্ঞতায় গলে যেতে ইচ্ছে করল মন। চোখে জল আসতে চাইলে তাকে সামালে নিয়ে বিনয়নম্রস্বরে বলি, চেষ্টার কোনও ত্রুটি হবে না।
বললেন, আজই তুমি কাজ শুরু করতে চাও?
উথলানো গলায় বলি, ইয়েস প্লিজ। যদি দেরিতে আবার কোনও বিপত্তি দেখা দেয়, সোনার হরিণের খুঁজে প্রাণপণ দৌঁড়াচ্ছি গত ছয় সপ্তাহ ধরে, এখন সোনার হরিণ পেয়ে যদি হারাই; মুহূর্তেই স্মরণ হলো, পূর্বপুরুষদের কালজয়ী উপদেশে- শুভস্য শীঘ্রম।
আমার মনের কথা বোঝে নিতেই ম্যানেজারের ঠোঁটে মৃদুমধুর হাসি দেখা দিলো; পরক্ষণেই ভাবি, না হাসিটি তার স্বভাবজাত বোধ হয়। এই হাসি ঠোঁটে ধারণ করেই বললেন, ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স অফিস থেকে কার্ড নিয়ে এসো। এখন তুমি মিস ফারনিনের সঙ্গে যাও। সে তোমাকে সবকিছু ফিকশ করে দেবে।
অসংখ্য ধন্যবাদ, মিস্টার অ্যাইভার।
সন্তুষ্ট মনে তার অফিস থেকে নিষ্ক্রান্ত হই। অফিসের বাইরে এসে দেখি, স্বজাতি বাঙালি একজন ভদ্রলোক অভ্যর্থনা অফিসের সামনে বসে আছেন। আমার মুচকি হাসির প্রত্যুত্তর না পেয়ে তার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফারনিনের পিছু পিছু ছুটতে থাকি।
আগন্তুককে ম্যানেজারের কাছে নিয়ে যাও। অভ্যর্থনাকারিণীকে নির্দেশ দিয়ে ফারনিন আমাকে সঙ্গে নিয়ে তার ছোটো অফিসঘরে এসে উপস্থিত হলো। একটা চেয়ার আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, বসো। তারপর নিজ চেয়ারে গিয়ে বসল, অতঃপর টেলিফোন ডায়াল করল।
হ্যালো, মিস্টার বাকের, আমি ফারনিন, সাইন অ্যান্ড ডিসপ্লে ইন্ডাজট্রিজস্ লিমিটেড থেকে বলছি।
অপর প্রান্ত কথা বলে যাচ্ছে।
এই প্রান্ত থেকে হঠাৎ ফারনিন বলল, মিস্টার বাকের কেমন আছেন?
নীরব। ফারনিনও কোনও কথা বলছে না। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, ফাইন, থ্যাংক ইউ।
আবারও নিঃশব্দ।
ফারনিন বলল, হ্যাঁ, একজন ভদ্রলোককে পাঠাচ্ছি। মিস্টার বাকের অনুগ্রহ করে কার্ডটা দিয়ে দেবেন।
আবারও নীরব, মনে হচ্ছে মিস্টার বাকের কিছু জিজ্ঞেস করছেন।
ফারনিন বলল, হ্যাঁ, আজই আমরা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহ থেকে কার্ডে স্টাম্প দেওয়া হবে।
আবারও নিঃশব্দ।
হঠাৎ ফারনিন বলল, থ্যাংকস। তারপর টেলিফোন রেখে একটুকরো কাগজ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এতে ব্লক লেটারে তোমার নাম ও ঠিকানা লিখে দাও; সারনেম (বংশ নাম) প্রথমে প্লিজ।
সে দুই লাইন লিখে আমার নাম ও ঠিকানা যুক্ত করা কাগজের সঙ্গে একই খামের ভেতরে রাখল। অতঃপর খামের মুখ বন্ধ করে তার গায়ে ঠিকানা লিখল। ঠিকানা লেখা শেষ করে আমার হাতে খামটি দিয়ে বলল, এই ঠিকানায় চলে যাও। ফেরত এসে কার্ডটা আমাকে দিয়ে কাজে লেগে যাবে। ওকে। কার্ড পেতে যাতে অসুবিধে না হয় সেইজন্য ইন্স্যুরেন্স অফিসের কর্মকর্তা মিস্টার বাকেরের সঙ্গে ফোনালাপ করেছি। চিঠিখানা তার হাতে দিলেই কাজ হয়ে যাবে।
অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ইন্স্যুরেন্স অফিসের উদ্দেশে রওয়ানা হই। কমার্শিয়াল রোড ক্রস করে পোস্ট অফিসের সামনে এসে ফুটপাতের একপাশে দাঁড়িয়ে ম্যাপ দেখে ঠিক করছি কোন রাস্তায় যাব, এমন সময় সাইন অ্যান্ড ডিসপ্লে ইন্ডাজট্রিজস্ লিমিটেডের অফিসে দেখা সেই স্বজাতি বাঙালি ভদ্রলোকটি আমার সামনে এসে হাজির হলেন। বললেন, আপনি কি বাঙালি?
এ প্রশ্নে সত্যি থতমত খেয়ে যাই- আমাকে অমন প্রশ্ন! বলি, আমার চেহারাই তো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। সন্দেহের অবকাশ কোথায়?
ক্ষমা করবেন, কোনও কোনও গুজরাটির চেহারাও বাঙালির মতো দেখায়।
আপনি কি আমাকে মহাত্মার আত্মীয় করতে চান? ভালো কথা। কিন্তু তিনি শুধু পারসিক ফিরোজকে তার উপাধি প্রদান করেছিলেন, নেহরুতনয়া ইন্দিরার মুখ রক্ষার্থে। আমার কিন্তু তাড়াহুড়ো আছে। বেশি কথা বলতে পারব না। আমাকে এখনই ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স অফিসে যেতে হবে, ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কার্ডের জন্য।
তাহলে আমিও যাব আপনার সঙ্গে।
কেন? কী করতে?
কার্ড আনতে?
কার্ড তো গেলেই দেবে না। তারপর পকেট থেকে চিঠিটি বের করে বলি, এ ধরনের একখানা চিঠির প্রয়োজন আছে।
নিরাশ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চিঠির জন্য কার কাছে যেতে হবে?
ম্যানাজারের কাছে। তবে তার সেক্রেটারির সঙ্গে প্রথমে দেখা করতে হবে।
আচ্ছা, আপনি থাকেন কোথায়?
চল্লিশ নম্বর চেশায়ার স্ট্রিটে।
আপনার নাম?
মনে হলো এ-যে এক নাছোড়বান্দা। না, তা ঠিক নয়- আমার মতোই হয়তো তিনিও বেকার, বিপদে পড়েছেন। একটুখানি সাহায্যের সম্ভাবনার পেছনে দৌঁড়াচ্ছেন। তাকে আমার সাহায্য করা উচিত। বলি, রোববার সকালে আপনি আমার বাসায় এলে আলাপ হবে। নাম- রূপমিয়া।
আস্সালামু-আলাইকুম। লোকটি চলে গেলেন। আর তখন আমার মন ময়ূরপঙ্খী ঘোড়ায় চড়ে উড়ে যেতে উদ্যত হলো ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স অফিসের দিকে।
চলবে…