
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ২
স্টেশনের ভেতর পৌঁছে দেখি, করাচির রেলস্টেশনের চেয়ে অনেক উন্নত মানের বিলিব্যবস্থা। ম্যানচেস্টারগামী ট্রেনটি ষোলো নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে, দশ মিনিট পরে ছাড়বে। ব্যাগটি হাতে নিয়ে ড্রাইভারের নির্দেশ মতো একটি কামরায় উঠে পড়ি। করাচির ইন্টারসিটি ট্রেনের মতোই মনে হলো, একটি কামরা থেকে অন্য কামরায় যাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে, সিটগুলোও বেশ আরামদায়ক। ড্রাইভার আমার পাশে বসে ধীরে ধীরে বলল, টিকেটের সঙ্গে ভাঙতিগুলোও রেখে দাও। ম্যানচেস্টারে নেমে ট্যাক্সি করে তোমাকে হাইড যেতে হবে, তখন খুচরো পয়সা কাজে আসবে।
পেনস, শিলিং সম্বন্ধে আগেই কিছু জ্ঞান অর্জন করেছিলাম, তবে স্বচক্ষে কখনও দেখিনি। মনে মনে হিসাব মিলিয়ে নিই, সে আমাকে ঠকায়নি, বরং কমই রেখেছে। হাতের মধ্যে ভাঙতিগুলো ঝক্ঝক্ করছে। ড্রাইভার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাত বাড়াতেই আমি দুহাতে তার ডান হাতটিকে কাবু করার চেষ্টা করি, কিন্তু তার পাঁচ আঙুল আমার দশ আঙুলের মধ্যে আটকিয়ে রাখতে পারিনি! এক-একটা আঙুল যেন আমার দুটোর সমান, তার হাত ও আঙুলের ত্বক বাঙরি ফলের মতো ফাটা ফাটা।
ইঞ্জিন সংযোগ করতেই গাড়ি সজীব হয়ে উঠল। ড্রাইভার খুশি হয়ে আমার শুভযাত্রা কামনা করে ট্রেন থেকে নেমে বন্ধুর মতো হাত উঁচিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাল। এ লক্ষ করে আমার সামনের আসনে বসা গোরাটি ঘোরচোখে একবার দেখে নিল। কী আশ্চর্য তার দৃষ্টি! রোগ্নচোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। চোখদুটো ছোটো কি বড়ো, টানা কি গোল ঠিক বোঝা গেল না। মনে হচ্ছে এই চোখদুটোতে অন্ধকারও প্রবেশ করতে ভয় পাচ্ছে। তার দৃষ্টি অনুসরণ না করেই আমার নবলব্ধ ছেড়ে যাওয়া ড্রাইভার বন্ধুটির কথা ভাবতে থাকি। সবদিক বিবেচনা করলে লোকটিকে ভালোই বলতে হয়। বাইর থেকে আমরা ইংরেজ জাতিকে যতই মন্দ মনে করি না কেন, সবাই তো আর একরকম নয়, ভালোমন্দ নিয়েই এক-একটি জাতির সৃষ্টি। ইংরেজ আমলে মুখবোজে যতদুঃখ আমাদের সহ্য করতে হয়েছিল তা যদি মূলভূমির ইংরেজরা জানত তাহলে হয়তো-বা ভিনদেশির প্রতি এতঘৃণা সঞ্চিত হতো না তাদের মনোজগতে। ড্রাইভারের ব্যবহার একটি শুভলক্ষণ বলে আমার মনে হলো, পরক্ষণে ভাবি, ধুত্তোর চাই, ওসব ওমেনটমেন, লক্ষণটক্ষণ আমি বিশ্বাস করি না। শুভ-অশুভলক্ষণ নিয়ে ভেবে মাথা ঘামানোর সময় নেই। সবই কুসংস্কার। এসব কুসংস্কারই তো দায়ী আমাদের অধোগতির জন্য। মানুষের মন দুর্বল বলেই সহজে কুসংস্কারে আকৃষ্ট হয়। আর বাঙালি সমাজেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কুসংস্কার বিরাজ করছে। কুসংস্কারের অণুর-পর-অণু জমে সৃষ্টি হয়েছে বাঙালির জগৎ আর পৃথিবী- বায়ু-জল-মাটি। আমরা বিশ্বাস করতে পারি না, আমাদের ধারণাশক্তির বাইরেও বিরাজ করছে অবাধ-অগাধ জ্ঞানের জগৎ। তাই আমরা আজ বিশ্বদরবারে কোণঠাসা, অপাঙ্ক্তেয়, আতরাফ, অস্পৃশ্য হরিজন। কাজেই সর্বপ্রকার কুসংস্কার সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য।
আড়চোখে একবার দেখে নিই আমার সামনে বসা গোরাটির মুখ। তার মুখের ওপর বাস করছে কত যন্ত্রণা, যদিও কোনওটাই স্পষ্ট নয়; তার ওপর ট্রেনের ভেতরের তরল আলোছায়ায় তার মুখমণ্ডলটিকে দেখাচ্ছে ভরাক্রান্ত, সঙ্গে বর্ষার শীতলতা যেন লুকচোরি খেলছে; ফলে মুখের প্রতিটি রেখাতে অন্ধকার ও আলো আর আলো-অন্ধারের নিষ্ঠুরতা স্বগর্বে আত্মপ্রকাশ করছে, যেন বেদনা-ব্যর্থতা-যন্ত্রণার চন্দ্রবিন্দুর পৃথিবীটির নিশ্চিত প্রতিহিংসার বহির্প্রকাশ। আমি ক্ষুধায়, পিপাসায় কাতর, না অন্যকোনও যন্ত্রণায় অসহিষ্ণু- নিজেই বলতে পারছি না, তবে এইটুকু জানি সম্মুখে সুদীর্ঘ পথ।
ট্রেনের বেগ ক্রমশ বেড়ে চলল। বিলেতি অন্ধকারে ইঞ্জিনটি একটানা আর্তনাদ করে যাচ্ছে। বেমানান যন্ত্রের যান্ত্রিককর্কশ শব্দ থেকে চেতনাকে সজাগ করতেই গোরার দিক থেকে চোখ সরিয়ে বাইরে দৃষ্টিস্থাপন করি, কিন্তু আমার মগজ থেকে ড্রাইভারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির আকস্মিকতার বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছি না। অনিবার্যভাবেই কিছু পরিণতিজনিত পরিবর্তন ঘটতে থাকে আমার অন্তরে। চমকে ওঠে মন। সমস্ত চৈতন্য যেন নড়তে থাকে। একে যদি আমার বিলেতবাসের শুরুতে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলে শুভজ্ঞানে গ্রহণ করি, তাহলে একটা দ্বিধা মনে স্বাভাবিকভাবেই জন্ম নেয়- কী করে এর নিষ্পত্তি করি। ড্রাইভারের সঙ্গে মিথ্যা দিয়ে শুরু করেছি, মিথ্যা বলেছি পাউন্ডের ব্যাপারে, তার সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছি অন্তরে। অর্থাৎ মিথ্যাকে অন্তরে উদ্দীপ্তবিভাস্কর করে শুরু করেছি আমার পরদেশে পরবাসীর জীবন। তওবা করলে নাকি সকল কলুষ ক্ষমা হয়ে যায়, না, তা কী করে হয়? আমি আমার কথা বলছি। স্রষ্টার কাছে অশাস্ত্রীয় কাজ করলে সে-পাপ ক্ষমা করার বা অসহিষ্ণু হওয়ার দায়িত্ব তাঁর, কিন্তু অন্যায়-অপরাধ যখন করলাম বিবেকের বিরুদ্ধে, তখন বিবেককে জাগিয়ে তোলার মধ্যেই তো থাকে সহিষ্ণুতা। স্রষ্টা সেই অপরাধকে অবসান করলে চলবে কেন? তাঁর বিরুদ্ধে তো কোনও অপরাধ করিনি। আমি একজন মানুষের ক্ষতি করেছি, সেই ক্ষতি পূরণ না করে স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম- এ কেমন কথা? এতে কি সমাজে অপরাধ, অসঙ্গতির প্রবণতা বৃদ্ধি পায় না! অবিশ্যি পায়। যদিও আশ্বাস পাওয়া গেছে, স্রষ্টা তাঁর ভক্তের সকল অন্যায়-অপরাধ অবসান করে দেন সহজেই, সেই দুষ্কর্ম ব্যক্তিবিশেষের প্রতি বা সমাজের প্রতিই হোক-না কেন; কিন্তু স্রষ্টার বিরুদ্ধে তো একমাত্র বেআইনি কাজ হচ্ছে ব্ল্যাসফেমি, তিনি তা-ই যখন কোনও অবস্থায়ই ক্ষমা করবেন না, বরং হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন একাধিকবার, তখন অন্যের বেলায় কীভাবে ক্ষমা করার আশ্বাস দিতে পারলেন, তা ভেবেই পাই না। সত্যসন্ধান যত করা হবে ব্যক্তিস্বাধীনতা তত বৃদ্ধি পাবে, তবে প্রথমে ব্যক্তিবিশেষ নিজেকে যাচাই-বাছাই করে সমাজে নিজের স্বাধীনতার স্থান প্রসারিত করে নিতে হবে। মানুষ সত্যকে সেই মুহূর্তেই আবিষ্কার করতে পারে যে-মুহূর্তে সে তার নিজমন থেকে মিথ্যাভয়, মিথ্যালজ্জা দূর করতে পারবে। আমার চিন্তাজাল ছিন্ন করে দুটো শব্দ কানে প্রবেশ করল, টিকেট প্লিজ।
তন্দ্রাভাব টুটে গেল। চমকে উঠি। চমকে তাকাই। চমকে তাকানোর কোনও কারণ নেই, তবুও কেমন যেন বোকার মতো তাকাই। সামনে টিটিই দাঁড়িয়ে আছে, মাঝারি বয়সের ভদ্রলোক, অন্তত তার চোখেমুখে তাই প্রকাশ পাচ্ছে, স্মার্ট ইউনিফর্মে তাকে বেশ মানিয়েছে। পকেট থেকে টিকেট বের করে দিলে সে হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে তেরচাভাবে কোমরের কাছে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগটি থেকে একটি পাঞ্চ বের করে ছিদ্র করল। তারপর ফেরত দেওয়ার সময় চোখের ইশারায় ধন্যবাদ জানাল।
ট্রেন চলতে থাকে একমনে- তার ভাষা আলাদা, ভাব আলাদা, গতি আলাদা, মেজাজ আলাদা; আশপাশের কোনও ঘটনার প্রতি একটুকুও ভ্রূক্ষেপ নেই, দূর পাল্লার রেলগাড়ি কিনা, ছোটোখাটো স্টেশনগুলোয় থামছে না। স্টেশনের কাছে এসেই শোঁ করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলছে শুধু, নিঃশ্বাসের সাহায্যে জানিয়ে দিচ্ছে- সে এখন একটি ছোটো স্টেশনকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে, বেগবান ট্রেনসৃষ্ট চলমান হাওয়ার ধাক্কায় যাত্রীরা যদি নিজেকে সমালাতে না পেরে স্টেশনের দালানকোঠার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে- এই ভাবনায় সে এই ধরনের সতর্কতামূলক আওয়াজ তোলে। রেলগাড়ির ভেতর যাত্রীসংখ্যা খুবই কম- কেউ শুয়ে বই পড়ছে, কেউ-বা বসে বসে ঝিমুচ্ছে; আর তাদের কোটগুলো মাথার ওপরের ট্রেতে হাই তুলে ঘুমোচ্ছে। কাচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি, দেশের মতো খাবারের দোকানে উনুনের ধোঁয়া, বস্তিবাসীর জটলার মুখ, চাপাকলের সামনে বালতির লম্বা লাইন বা চাপাকলের আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন- কেউ দাঁত মাজছে, কেউ-বা তেল মাখছে, কেউ-বা গায়ে জল ঢালছে- এসব বিচিত্রদৃশ্যের কোনও চিহ্ন নেই; শুধু রয়েছে বৃষ্টিবরফবিহীন বিলেতি প্রকৃতির নীরবতা, মাঝেমধ্যে বিদ্যুচ্চমক, এরই সঙ্গে নিবিড় মেঘাচ্ছন্ন দিগদিগন্ত, যার ভার সামলাতে না পেরে নুয়ে পড়েছে আকাশ, বোরকা-ঢাকা প্রকৃতি যেন, সহজলভ্য হলে যদি সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যায়, সেই ভয়ে স্বকীয় সৌন্দর্যকে লুকিয়ে রাখার কী অপরূপ প্রচেষ্টা!
রেলপথের উভয় পাশে অন্ধকারের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে- গাছগাছড়া, ঝোপঝাড়, বনজঙ্গল- সব কেমন যেন শীতে আড়ষ্ট, অধিকাংশ নুয়ে, তাদের অস্তিত্বই অবাক করে দেয়! রিক্ততার মাঝেও যে-সৌন্দর্য, যে-আকুলতা তা-ই আমাকে এক নতুনবার্তা বয়ে এনে দেয়, তবে এর অর্থ অন্বেষণের জন্য ধৈর্য আর সময় কোনওটাই আমার নেই; আমার চিন্তাধারার ভুল প্রমাণে সচকিত এবং সত্যসন্ধানে ব্যস্ত। আমার ধারণা ছিল, বিলেতের মাটি সহজে চোখে পড়ে না, চারদিকে শুধু দালান আর দালান- দশতলা, বিশতলা; তাদের ঠেসাঠেসিতে সারা জমি ভরপুর, কিন্তু এ কী লীলাখেলা! খোলা মাঠ, সুদূরপ্রসারী। ইংরেজের মধ্যেও কি এমন লোক আছে যারা কৃষিকাজ করে? কৃষক তো নিচুলোক! আমাদের দেশে আশরাফশ্রেণির মুসলমান ও কুলীনশ্রেণির বৈদিক হিন্দুরা অনাহারী হলেও হালচাষ করে না; ইংল্যান্ডে তো কৃষকের মতো নিচুলোক থাকার কথা নয়, যখন তাদের দাসানুদাস ভারতবর্ষের তথাকথিত অভিজাতশ্রেণির মধ্যেই নেই, তবে কি অর্ধেক বিশ্ব একাধিক শতাব্দী ধরে শাসনশোষণকারী বিস্ময়জাগ্রত ইংরেজ জাতি তার স্বদেশে স্বজাতীয় শূদ্রের অলঙ্ঘ্য প্রথার প্রবর্তন করেছে, না, অন্যদেশ থেকে লোক এনে এরকম নিচুকাজ করাছে? শ্রীভূমির লন্ডনিরা তো কোনওদিন এমন কথা বলেনি, শুধু সতর্ক করেছিল, মেয়েপুরুষের আকর্ষণ থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলতে হয়।
করাচি আসার দুইদিন আগে মজমিল আলি, এক পুরনো লন্ডনি, আমার বাড়িতে বসে বলেন, সাবধানে থাকবেন, বাসে-ট্রেনে চলার সময় মেয়েরা এমনি এমনি সোজা কোলে এসে বসে পড়ে। মেয়ে তো নয় রূপসাব, যেন ডানাকাটা পরি।
স্বকর্ণে কথাগুলো শোনে আমার স্ত্রী, রাতে, বালিশ ভিজিয়ে দেয় অশ্রুতে। আমাকে অবশ্য অনেক বেগ পেতে হয় ওকে সান্ত্বনা দিতে, যদিও মজমিল আলির কথা সম্পূর্ণ সত্য ছিল না।
রাগবি-জংশনে ট্রেনটি থামল। একটি নারীকণ্ঠে ভেসে এলো, যেসব যাত্রী কভেন্ট্রি, বার্মিংহাম, উলভার-হ্যামটন যেতে চান তাদের অনুরোধ করা হচ্ছে, এই স্টেশনে ট্রেন বদলির জন্য।
লোক উঠানামা করছে স্বাভাবিকভাবে- দৌড়াদৌড়ি, ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি নেই; চা গরম, পান-সিগারেট বলে হাঁক ছাড়ছে না কেউ। ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে এমন সময় এক যুবতি- বর্ণ গৌর, মাথার চুল এলোমেলো, নাক চিকন লম্বা, দেহ শক্তশীর্ণ, হাতের আঙুলগুলো দীর্ঘসরু, চোখদুটো ভরাভরা- লাফিয়ে ট্রেনের আমার কামরায় উঠল। ডানেবাঁয়ে একবার তাকিয়ে দ্রুতপদে আমার সিটের পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর আমার দিকে দৃষ্টিস্থাপন করে মৃদুকণ্ঠে বলল, আমি কি এখানে বসতে পারি?
অকস্মাৎ সামনে দাঁড়ানো একটি স্ফূরিত আভার ঝলসে উঠা নারীকে দেখে আমার ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত কণ্ঠ কাঁপতে লাগল। মনও জলে ডোবা পাটাতনের মতো ভাসছে। মনে হলো সে আমার পাশের সিটটি ছাড়া আর-কোনও খালি জায়গার সন্ধান পায়নি, তাই এখানে এসে হাজির হয়েছে। সহসা কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো, অবিশ্যি।
আধখানি হাসি ছড়িয়ে এবং পুরো একটা ধন্যবাদ জানিয়ে আমার পাশের সিটে বসে হ্যান্ডব্যাগ থেকে এক প্যাকেট সিগারেট বের করল, সঙ্গে লাইটারও। সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া ট্রেনের ছাদের দিকে ছুড়ে মেরে দৃষ্টিনিবদ্ধ করল হাতঘড়িতে। দেখে নিল কটা বাজে। আমিও আড়চোখে দেখে নিই সময়টাকে। এগারোটা পনেরো। অবশ্য আমার ঘড়িতে চারটে পনেরো। পাঁচ ঘণ্টা এগিয়ে। করাচির টাইম। করাচির সঙ্গে লন্ডনের সময়ের ব্যবধান এমনি বাস্তব যে, তার সত্যতা নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। অকাট্য প্রমাণ যে, পৃথিবী অসমতল। দেশে থাকতে কত যুক্তি দিয়েও বোঝাতে পারিনি হবিগঞ্জের এক মৌলানাকে যে, পৃথিবী প্রায় কমলালেবুর মতো। পালটা জবাবে মৌলানা বলেন, আল্লাহ বলেছেন, আমি পৃথিবীকে কার্পেটের মতো বিছিয়ে দিয়েছি। যা যৌক্তিক তাই বাস্তব- দৃষ্টান্তটি কি ভুল? না, ভুল নয়। প্রচলিত কুসংস্কারযুক্ত বিশ্বাসই অবাস্তব। মানুষ বিজ্ঞানের বিকাশের মাধ্যমে জ্ঞানারোহণে কুসংস্কারমুক্ত সত্যকে অবিষ্কার করছে। মিথ্যাবিশ্বাসই করজোড়ে অবাকবিস্ময়ে তাকিয়ে আছে সত্যসন্ধানের পথে। মৌলানা বলেন, আল্লাহর বাণীর বিপক্ষে সমস্ত যুক্তিতর্কই অচল।
জ্ঞানসমৃদ্ধযুক্তি যেখানে অচল, সেখানে চলার সকল পথ বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। যেখানে স্রোতবিহীন বন্দর, সেখানে নোঙর ফেলা জাহাজ ভিন্ন পণ্যদ্রব্য আদানপ্রদানের সুযোগ থাকে না। খুঁটিতে বাঁধা উটকে মুক্ত মরুদ্যানে বিচরণ করতে না দিলে, তাকে অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে হবে বই কি! নদীতে স্রোত না থাকলে প্রথমে অনাব্যতা, পরে মোহানায় পলি জমতে জমতে সমুদ্রের সঙ্গে নদীর যোগাযোগ বিনষ্ট হয়ে যায়; কালক্রমে মরা নদীর খ্যাতি লাভ করে।
ট্রেনের মৃদুমন্দ ঝাঁকুনিতে দোলনার শিশুর মতো ঘুম আসা স্বাভাবিক; তার ওপর ক্লান্ত মন, শ্রান্ত মাথামগজ। স্নান নেই, আহার নেই, ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় অবসাদগ্রস্ত দেহ, অবসন্ন। তবুও ঘুম আসতে চায় না আঁখিপাতে। মনের মধ্যে উদীয়মান সূর্যের মতো নানারকম ভবনার উথালপাথাল চলছে, পথ-চেয়ে-থাকার আকাঙ্ক্ষা যেন। লন্ডন আসার স্বপ্নের সফলতায় দেহমন পুলকিত, উদ্বেলিত। ভাবতে শুধু আনন্দই লাগছে- কত যুগের কত কথা, নতুন নতুন সব কল্পনা; কিন্তু চোখের পাতায় যখন ভেসে উঠল- স্বদেশে লন্ডনির ঠাটকাণ্ডকারখানার স্মৃতিগুলো, তখন মনের মধ্যে একটা ঘেন্না জন্মে, বিশেষ করে তারা যখন বাজারে গিয়ে মাছের এমন দাম করে বসে, যা বাংলার সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না, ঠিক তখন। বাহাদুরি দেখানোই প্রথম উদ্দেশ্য; দ্বিতীয় উদ্দেশ্য অবশ্য ভিড় জমানো, নতুন পয়সায় কত বিশাল মাছ কত বেশি টাকায় খরিদ করা যায়। এমনি একটি ঘটনায় আমি আটকা পড়েছিলাম সরকার বাজারে।
চলবে…