
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ২৮
আমি একজন অতিশয় সাধারণ পিতৃহীন যুবক। আমার জীবনে কোনো কল্পনার প্রসার নেই। আমার আকাঙ্ক্ষা অত্যন্ত সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ। আইএ ফাইনেল পরীক্ষা দিয়েছি মাত্র। মাইজির স্নেহের অন্ত নেই আমার প্রতি—মুক্ত হস্তে তিনি টাকা খরচ করেন মনের আনন্দে। গ্রীষ্মের ছুটিতে মামার বাড়িতেই আসা। আর মাইজি আমার পথ চেয়ে দিন গুণছেন। মামার বাড়ি থেকে মাসির বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমার মাথায় অনেক চিন্তা ভিড় করে এলো। আসার আগে খবর দিয়ে যেন যাই—প্রতিবারই এমন কথা মাসি বলেন, প্রতিবারই আমি এর ব্যতিক্রম করি, কেননা আসার খবর দিলে মাসি ও মেসোমশায় এমন ঢাকঢোল আর বিশেষ ব্যবস্থা করেন যা ভীষণ বিশ্রী লাগে আমার কাছে। আজকের দিনটা শুধু মাসির বাড়িতে কাটানোর ইচ্ছে। মামার বাড়ি ও মাসির বাড়ি একটা ছোটো মাঠের এ প্রান্ত আর ও প্রান্ত, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোটো স্রোতস্বিনী, কলকল প্রবাহিতা।
দুপুরে দুই ও তিন নম্বর স্নান করতে গেল মহল পুকুরে। বাড়িতে কনিষ্ঠ নম্বর তখন কান্নাজুড়ে দিলো, দিদিদের সঙ্গে স্নান করার ইচ্ছায়। মাসি ব্যস্ত তখন মাছ রান্নাবান্না নিয়ে। তাই ডেকে বললেন, যাও তো পুত (পুত্র) একবার শেলিকে নিয়ে পুকুরে।
দিব্যি শেলিকে নিয়ে পৌঁছে যাই পুকুরঘাটে।
মাঝপুকুরে ও সাঁতার কাটছে। তৃতীয়টি ভেজা কাপড় পালটাচ্ছে পুকুরঘাটে।
এই শেলিকে স্নান করিয়ে দে।
বাহ রে, আমার শুকনো কাপড় ভেজাব নাকি?
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলল—আমি চললাম।
হাঁটা শুরু করল বড়ো বড়ো পায়ে। চতুর্দশীর গমনপথপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। তারপর চোখ ফিরিয়ে ওর প্রতি তাকাই। ওকে ষোড়শী বলাই ভ্রম। পুকুরের জলে বেখেয়ালে বোয়ালের মতো ভাসিয়ে দিয়েছে দেহটা। কখনও উবুড়, কখনও-বা চিত হয়ে সাঁতার কাটছে। কখনও এপারে, কখনও ওপারে। আবার ওপার থেকে এপারে। গুবাকের মতো উঁকি দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। মাঝেমধ্যে জলের ওপর মুখ তুলে মুচকি হাসছে। মিহি সুতার শাড়ি দেহের সঙ্গে একেবারে লেপটে মিশে আছে। আর নিতম্বের পিচ্ছিল ভাঁজে অভাঁজে চিত্রভানুরশ্মি ছড়াচ্ছে বিচিত্র। চোখ সরানো দায়। আমার চোখে ওর চোখ পড়তেই সে ডুব দিলো, কেশ আবৃত শ্রেণিদেশ। অবশেষে বুকের সৌন্দর্যে আমাকে মোহিত করার উদ্দেশে বোনকে স্নান করানোর অজুহাতে আস্তেধীরে পুকুরঘাটের সিঁড়ি ভেঙে আমার কাছে এগিয়ে এলো, জলদেবীর উত্থানের মতো। ষোড়শীর বক্ষোজ কত আর্কষণীয় হতে পারে তা-ই তার উৎকৃষ্ট নমুনা। অর্ধেক করে কমলালেবু কেটে কে যেন বসিয়ে দিয়েছে উভয় পাশে। সামনে এসে স্মিতমুখে দাঁড়ল। মনে মনে বলি, একটুখানি পরশ লাগি, ফেরেশতাও এসে দাঁড়াবে অনুমতি মাগি।
টুকটুক করছে গাল—বিন্দু বিন্দু জলে ভরা কপাল। হঠাৎ চোখ লাল করে ও বলল, লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া হচ্ছে বুঝি?
তাতে তোমার কী?
আমার অসহ্য লাগে, এক্ষুনি ফেলে দাও সিগারেট।
একান্ত বাধ্য ছাত্রের মতো হাতের অর্ধদগ্ধ সিগারেটটি জলে ফেলে দিয়ে বলি, এই দ্যাখো আমি কেমন তোমার কথা শুনলাম, তুমিও এখন নিশ্চয়ই আমার কথা শুনবে।
জবাব না দিয়ে বোনটির হাত ধরল।
এ কী?
বা, তোমার সব কথার উত্তর দিতে হয় নাকি!
তবে আমাকে সিগারেট ফেলতে নির্দেশ দিলে কেন?
ওটা আমার অপছন্দের বস্তু, তাই ফেলতে বলেছি, অপরাধ তো কিছু করিনি।
ঠিক আছে বলেছ, আমিও নির্দেশ মেনে নিয়েছি। এখন আমার কথা তোমার শোনা উচিত।
বলো শুনছি।
এইখানে আমার পাশে এসে বসো, সুন্দর হাওয়া বইছে। বসলেই বলল।
সঙ্গে সঙ্গেই ও বসে পড়ল।
এখন বলো কী বলতে চাও। সহজসরল গলায় বলল ও।
বলব না।
এবার ও চোখ বড়ো করে তাকাল আমার দিকে। হঠাৎ বোধ হয় ভয়ানক ভালো লেগে গেল আমার মুখটি। তাকিয়ে রইল।
কী দেখছে? হেসে বলি।
লজ্জিতভাবে ও চোখ নামিয়ে বলল, তুমি যদি নেহাৎই কিছু বলতে চাও, তাহলে তাড়াতাড়ি বলো, শেলিকে স্নান করানো এখনও বাকি, সেকথা অবশ্য তুমি ভুলে যাওনি?
আমাকে নিশ্চয়ই তোমার পছন্দ হয়েছে?
ও একথার উত্তর না দিয়ে বলল, আমার তাড়া আছে, এখন উঠতে হবে। স্নান সারতে হবে।
আর আমার সঙ্গে আর-একটু বসে সময় কাটাতে বুঝি তোমার মন চায় না।
লজ্জা জীবনে হয়তো ও পায়নি। বিয়ের সম্বন্ধ অনেক আসছে, এটা লজ্জার বিষয় বলে হয়তো ও কাউকে বলতে চায় না, আমাকেও না, তাই কাউকেই বলে না, কিন্তু এখনের লজ্জা তার কোথায় লুকিয়ে ছিল? একজন মানুষের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কটা যে কেমন হওয়া উচিত—একটা অস্পষ্ট অনুভূতি তার ষোড়শী চিত্তে একবার নাড়া দিলো, চুপ করে বসে রইল, জলের দিকে তাকিয়ে।
একটু পরে বলি, কী হলো? রাগলে আবার নাকি!
তুমি ওরকম যা-তা বলো কেন?
যা-তা কী—এমনও তো হতে পারে যে, মেসোর ও মাসি তোমার সঙ্গে আমার…।
ধ্যেৎ…।
আমার কথা তুমি বোঝোনি?
বুঝেছি।
কী বুঝেছ?
বলব না।
বলো না!
না।
বলো না লক্ষ্মীটি। আমি ওর হাতের ওপর নিজের হাত রাখি।
ও একঝটিকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল; বিয়ে আমি করবই না কোনওদিন।
আমাকেও না?
না।
তাহলে তো ভারি মুশকিল!
দুষ্টু হাসিতে আমার সুপুরুষ মুখটি ঝলমল করে উঠল, আর ও দারুণ বিচক্ষণের মতো বসে বসে চিন্তা করতে লাগল, বিয়েতে অনুমতি দেবে কিনা! বলি, মেসোমশায় ও মাসি চান বলেই তো আমি এখানে আসি। তা না হলে আমার সঙ্গে দেখা হতো কেমন করে?
সেই তো; ও একেবারে গলে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল, আচ্ছা তুমি সাঁতার জানো?
নিশ্চয়ই।
কত রকম?
আমি? আমি ডুব সাঁতার জানি, চিত সাঁতার জানি, প্রজাপতি সাঁতার জানি, শিখিয়েও দিতে পারি, যদি আদেশ কোরো।
আমি কি কম জানি? এতক্ষণ দেখোনি?
তা আর কী করে হবে বলো? ভারী এক দুঃখের ভঙ্গি করে বলি, তুমি তো মোটেই আমার কথায় রাজি হচ্ছো না, তা হলে কত আনন্দই না হতো!
আমাদের গুণগুণ কথায় ঈর্ষাকাতর শেলি স্নানের জন্য অধীর হয়ে উঠল। আর ও অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, কী আবার রাজি হলাম না! একথা বলেই সাংঘাতিক জোরে আমার হাতের ওপর একটি চিমটি কাটল। ও ভদ্রতা জানে না, ভূমিকা না করেই বোনকে নিয়ে পুকুরঘাটে নেমে গেল।
আমি উহু বলে ক্ষত অংশে হাত বোলাতে থাকি, আর ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
দুপুর তখন উত্তীর্ণ। পুকুরঘাট থেকে শেলির হাত ধরে ও ওদের বাড়ির দিকে এগুতে থাকে। ঘাট থেকে বড়োজোর মিনিট দুইয়েকের পথ। মাঝে একটা বিভিন্ন ফলের বাগান। এখানেই নিস্তব্ধতা আশ্রয় করে আছে। এই নিস্তব্ধতা ও পাতার মৃদু হাওয়ায় যেন ওর ভীষণ ভয়। পেছন ফিরে তাকাল, আমাকে পেছন পেছন আসতে দেখে মুচকি হাসল।
ভয় করছে?
হুঁ।
যদি আমি সঙ্গে না থাকতাম তাহলে?
আল্লাহর নাম জপতাম।
তাহলে বুঝি ভয় কেটে যেত?
হুঁ।
তাহলে এখন জপছ না কেন?
তুমি সঙ্গে আছো তাই।
আমি চলে যাই?
ইস!
ইস কী?
কিছু না।
আমি কাছে এসে ওর একটা হাত ধরে বলি, ভারি তো আহলাদি; তারপর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলি, আমি এখনই মামার বাড়িতে চলে যাচ্ছি।
তোমাকে যেতে দিলে তো।
হাসি। বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াতেই ভীষণ উত্তেজিতভাবে বলল, মাইজি, তাড়াতাড়ি খাবার দাও, তোমার বোনপো নাকি মামার বাড়ির চলে যাবে।
মাসি আমার দিকে তাকিয়ে থ হয়ে রইলেন, কিছুক্ষণ। ব্যাপারটা তার বোধগম্য হলো না। হঠাৎ মাসি বলে উঠলেন, পুত আমি ওর কর্মকাণ্ডে বিরক্ত, উত্যক্ত, ভীষণ অতিষ্ঠ। আর পারছি না।
কেন বলুন তো?
যা-তা বলছে লোক। মেয়েটাও বাবা যা হয়েছে!
কেন সে তো বেশ ভালোই। ভারি মিষ্টি।
মিষ্টি? ভালো? দস্যিমেয়ে কখনও মিষ্টি বা ভালো হয়? আমি হাসতে থাকি। মাসি বলে চললেন, মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না। কোনো শাসনও মানে না, একেবারে বুনো হয়ে গেছে।
মাইজির কাছে পাঠিয়ে দেন। তিনি মানুষ করে নেবেন।
মরণ! ও ওর বাপের নয়নমণি। এইজন্যই তো ওর আহলাদে এমন হয়েছে মেয়েটা। তবে তো একটু শাসন দরকার, আমি তো ভাবছি তার ভারটা মাইজিকেই নিতে বলব।
চকিতে মাসি চোখ ফিরে তাকালেন ওর দিকে। পরক্ষণেই প্রসঙ্গ পরিরর্তন করে বললেন, পুত, তোমার মাইজি বলেছেন তিনি এবার তোমাকে যেমন করেই হোক বিয়ে করাবেন, আর তোমার অমত শুনবেন না।
ভালোই তো হলো। হাসতে থাকি।
তবে তুমি বিয়েতে রাজি আছো? মেয়ে দেখবে?
মেয়ে তো দেখাই আছে।
কে?
কেন এই দস্যি মেয়েটাকে, যাকে শাসন করার ভার মাইজি নেবেন।
মাসি কিছুক্ষণ কোনও কথা বললেন না, ভালো করে আমাকে নিরীক্ষণ করতে থাকেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, অত্যন্ত সহজসরলভাবে। আমার মন! এই মন যা গ্রহণ করে তাতে মাইজি ও মাসির বিশ্বাস আছে। আমার ঔদার্যে মাসি মুগ্ধ হয়ে যান। অবশেষে বললেন, আর দেরি নয়। খেতে বসো। আসন পাতা আছে।
কারুকার্যের তামার একটি বড়ো থালা ভর্তি খাবার এনে মাসি বললেন, তোমরা একসঙ্গে বসে খাও। আমরা চারটি মানুষ থালা ঘিরে বসি। আদর-আপ্যায়নে আমাকে মাসি অভিভূত করে ফেলেন। আর ও বিনয়ে লজ্জায় হাতে হাত ঘষতে থাকে, তারপর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মাথার আঁচল ঈষৎ টেনে মৃদুস্বরে বলল, তোমার খণ আমি সমস্ত জীবন দিয়েও শোধ করতে পারব না।
হ্যাঁ, আমি শুনেছি সেকথা, তুমি পারলে আজকেই মেসোমশায়কে একবার আমার কথাটা জানিয়ে দিয়ো।
উৎফুল্ল মুখে বলল, অবশ্যই—তোমার আদেশ আমার শিরোধার্ষ।
বলি, পাগলি।
সঙ্গে সঙ্গেই ও একহাত জিভ বের করে ভয়ানক অপরাধীর মতো বলল, ও মা, কী হবে?
কী?
একদম ভুলে গিয়েছি। মাইজি বলেছিলেন খেতে বসে লজ্জা করতে হয়।
কী আর হবে! আমাদের পুকুরে এবার সাঁতার কাটবে!
ধ্যেৎ!
ওর মুখ একমুহূর্তে লাল হয়ে উঠল।
শোনো, অমি ওর একটা হাত ধরে টেনে যথাসম্ভব কাছে এনে বলি, তুমি খুশি হয়েছ?
ও নিশ্চুপ।
না, বলো, বলতে হবে…।
ওর সলজ্জ মুখ তুলে ধরে।
ও-ঘর থেকে মাসি বললেন, তোমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠো। আমাদেরও তো খেতে হবে।
মেসোমশায় দুপুরের খাবারের পরও আটকে রাখলেন আমাকে, জলখাবার না খেয়ে যেতে দিলেন না।
দুদিন পর, মাইজির কাছে ফিরে আসি। ফেরার পর, সকালবেলা আমার যখন ঘুম ভাঙে কেমন একটা প্রত্যাশায় ভরে ওঠে মন। প্রতিমুহূর্তে চমকে চমকে উঠি। সময় আমার পক্ষে অত্যন্ত দীর্ঘ হয়ে যায়। রাত্রিতে যখন সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ তখন হৃদয়জোয়ারে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কূল-অকূলে। ভয়ানন্দে বুকের মধ্যে হাত চেপে অভিভূত হই। শুনেছি, অনেক ছেলেমেয়েই পরস্পরকে ভালোবেসে বিয়ে করছে, কিন্তু তা আমার পক্ষে একটা কল্পনার বিষয়। ওরকম অসত্য ঘটনা যে সত্যি সত্যি ঘটতে পারে একথা অনেক বিশ্লেষণ করেও বিশ্বাস করতে পারি না। অথচ ওর কথা চিন্তা করলেই আমার সমস্ত রাতের ঘুম উড়ে যায়। বারবার উঠে জল পান করি, আর হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করি। একদিন মেসোমশায়ের আকস্মিক মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছে আমাদের কাছে। মাইজি ও আমি ছুটে যাই, মুহ্যমান পরিবারকে দেখতে, কিন্তু ওদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না; কারণ, ফখরুল ইসলাম ও তার পিতার দাবি অগ্রগণ্য। তারা এক বংশের লোক। আমার মাসতুতো আর ফখরুল ইসলামের কাকাতুতো বোন ও। তবু মাসির ইচ্ছে ছিল না দেবরের পুত্রের সঙ্গে ওর বিয়ে হোক, মেসোমশায় নাকি তার ভ্রাতুষ্পুত্রের সঙ্গে তার দস্যিমেয়ের বিয়ে দিতে নারাজ ছিলেন। আমাকেই তার পছন্দ ছিল। কয়েক বছর পরে লেখাপড়া শেষ হলে আমাদের বিয়ে হবে, এমনই একটি অঘোষিত ঘোষণা তিনি করেছিলেন, আত্মীয়স্বজনও তা জানত। কিন্তু তা আর হয়নি, ফখরুল ইসলামই তা হতে দেয়নি। আর আমার মধ্যে চলতে থাকে দহনবৃষ্টি।
চলবে…