
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ২৭
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২। রোববার। সকাল।
ঘুম ভাঙল দেরিতে। বিছানা থেকে জিজ্ঞেস করি, আজ কত তারিখ?
একজন বলল, ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২। রোববার।
দূর থেকে ভেসে এলো, সরকারি খাই আর মসজিদে ঘুমোই, আঠারো মাসে হয় বছরই।
এ কার কণ্ঠস্বর? মামুজি নয় তো? হলেই-বা কী! আমার কানের দোষ! কানের কি উচিত সবকিছু পিক-আপ করা? মানুষের বাক্স্বাধীনতা বলে একটা জিনিস আছে, তাকে সম্মান করা উচিত। তখনই এসে উপস্থিত হলেন আমার এক ভগ্নীপতি- মাসতুতো ভগ্নীপতি- ফখরুল ইসলাম। লন্ডন থেকে বেশ দূরে তার বসতি- ব্রাডফোর্ড শহরে। রাজধানী শহরে এসেছেন একটি কাজে, তাই আমার সংবাদ পেয়ে দেখতে এসেছেন। না এলে যদি ভবিষ্যতে কোনও কথা উঠে তখন কী করবেন, তাই আগেভাগে নিজেকে বাঁচানোর জন্যই এখানে আসা! মাসি এখনও বেঁচে আছেন। আমি যে তার আদরের বোনপো সেকথা অবশ্যই আমার ভগ্নীপতির জানা আছে। ভগ্নীপতি ফখরুল ইসলামকে দেখে স্পষ্টই বোঝা যায়, তার মনে বিজয়ী বিজয়ী ভাব। তার প্রথম প্রকাশ ঘটল যখন তিনি বললেন, আপনার এদেশে আসা একেবারেই ঠিক হয়নি। বিলেত আপনার মতো মানুষের জন্য নয়। এখন আপনার দেশে ফিরে যাওয়াই উচিত। লন্ডনি রুজি আপনার ভাগ্যে নেই। আর তার চোখদুটো নীরবে প্রকাশ করছে, যেমনই আপনার মাসতুতো বোন আপনার জন্য যোগ্য ছিল না, তেমনই লন্ডনও না। দেখতে পাই, তার নেত্রকোণে হাসির রেশ লেপটে রয়েছে। মনের বল্গা টেনে ধরে বলি, এসেই যখন পড়েছি তখন কিছুদিন না হয় আপনার অতিথি হয়েই থেকে যাই।
আমার হারমানা কথায় ভগ্নীপতি খুশি হলেন, প্রতিদ্বন্দ্বীর পরাজয়ে কেই-না খুশি হয়? মানিব্যাগ থেকে কচকচ কড়কড়ে একটা নোট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমার আপত্তি মামুজির নির্দেশে ভেসে গেল। অতঃপর বলেতে শুরু করলেন তার স্ত্রীর গুণগাথা- পঞ্চমুখ প্রশংসা; উদ্দেশ্য- আমার পরাজয়ের পাল্লাটা আরও ভারী করা; প্রকারান্তরে বলা- দেখো কেমন রত্ন তুমি হারিয়েছ; সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়- যে রত্নমালা তোমার গলে শোভা পাওয়ার কথা ছিল, সম্ভাবনা ছিল ষোলোআনা, তাকেই আমি ছিনিয়ে নিয়েছি, সঙ্গে সুপ্রসন্ন ভাগ্যটাকেও- ভালো বেতনের চাকুরি করছি, দেশে দালানকোঠা নির্মাণ করিছি, জমিজামা, চাকরনকর আরও কত কী!
একবার ইচ্ছে হলো বলতে, আমার প্রতি তোমার দহনবৃষ্টি বন্ধ করো। আমি ভাগ্যদেবীর প্রসন্নতা বা অপ্রসন্নতায় যেমন বিশ্বাস করি না, তেমনই মানি না তকদিরের লিখন- নিয়তির বিধান; কারণ, আমিই যে তকদিরের নিয়ন্তা; কিন্তু বলতে পারিনি।
মামুজির সঙ্গে গ্রামের বিষয়াদি নিয়ে ফখরুল ইসলামের আলাপ-অলোচনা শুরু হলো। পাশাপাশি গ্রামে তাদের বসতি। আমার বাড়ি তাদের থেকে অনেক দূর। মামুজি ও ফখরুল ইসলামের আলোচনায় শরিক হতে পারিনি বলেই হয়তো ডুব দিই অতীত স্মৃতি সরোবরে।
দহনবৃষ্টি
যে-কথাটি এতক্ষণ ধরে মনের মধ্যে গুনগুন করছিল, যে-ইচ্ছে মনের অবচেতনে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তা-ই মূর্তি হয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়াল। ওকে দেখেই মুখটি নিচু করি। তারপর একটু ইতস্তত করে দুপা ঘরে ভেতরে দিয়ে বলি, মাসি কোথায়?
বাড়ি নেই।
তা তো দেখছি। কোথায় গেছেন?
পাশের বাড়ি।
এই অসময়ে? গ্রীষ্মের দুপুর। রোদ ঝাঝা করছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে যোগ করি, পুড়ে যাচ্ছি, একগ্লাশ জল হবে?
আমার ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সত্যি ওর কষ্ট হলো। টেবিলেই জলপাত্র ছিল, একগ্লাশ জল আমার সামনে তুলে ধরল, তারপর বলল, এই রোদে কেউ বেরোয়!
না বেরুলে কি তোমার সঙ্গে দেখা হয়?
সকালে কিংবা বিকেলে আমি বাড়ি থাকি না বুঝি?
থাকতে পার, তা তো আমার জানা ছিল না।
কী করেই বা জানলে আমার সঙ্গে দেখা করার এটাই উৎকৃষ্ট সময়?
হেসে বলি, সত্যি বলতে এইমাত্র কথাটা জানলাম; কারণ, দুদিন হয়েছে আমি মামার বাড়ি এসেছি। তোমাদের দেখা পাইনি। আসতেও পারিনি। দুদিন পরে আবার চলে যেতে হবে। তাই আজ মনে হলো, একবার দেখে যাই।
হঠাৎ আমার লক্ষ হলো ও জলের গ্লাশটা হাতেই ধরে আছে, হেসে বলল, জলটা খেয়ে নাও।
কী আশ্চর্য, এখানে এসেই এত ঠান্ডা হয়ে গেছি যে, যে-জলতৃষ্ণায় আমার শুধু প্রাণটাই বেরিয়ে যেতে বাকি ছিল, সেই তৃষ্ণা মিটে গেছে।
টকঢক করে সমস্ত জল একসঙ্গে খেয়ে নিয়ে ঠাশ করে গ্লাশটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখি, তারপর বলি, তাহলে একটু বসে মাসির জন্য অপেক্ষা করি। রোদের মধ্যে এতটা পথ এলাম, ক্লান্তি লাগছে।
বেশ তো বিশ্রম করো। সহজ হওয়ার চেষ্টায় একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো। বসতে বসতে বলি, তুমি মাসিকে ডাকো।
ডাকব, তবে তার আগে জলখাবার নিয়ে আসি।
আমি কি জলখাবারের জন্য এসেছি?
ওর মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হলো, ওর বলতে লোভ হচ্ছে, তাহলে কীসের জন্য এসেছ? চেপে গিয়ে বলল, তা কেন? মাসিকে দেখার জন্য আসা।
তার চেয়েও যাকে বেশি ভালোবাসি সে তো এই বাড়িতেই থাকে।
চকিতে চোখ তুলেই নামিয়ে নিল, নিচু চোখে বলল, একটা পাখা নিয়ে আসি।
তোমার আসল উদ্দেশ্যই দেখছি আমার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলি, পাখার দরকার কী? আমিই বরং চলে যাই।
কী আশ্চর্য! খাটের পাশে বসে পড়ল ও, তারপর বলল, হলো এবার, বসো।
বলাই বাহুল্য, আমাকে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করতে হলো না। বসে বলি, আচ্ছা, আমাকে দেখলে কি একটা রাক্ষসশ্রেণির জীব বলে তোমার মনে হয়? তা না হলে প্রায় এক বছর পর এসেছি, অথচ একটি কথাও জানতে চাইলে না। আমার মনে হচ্ছে এখানে এসে আমি হয়তো তোমাকে যথেষ্ট অসুখী করছি।
অস্ফুটে বলল, একথা কেন বলছ? একমাত্র কথা বলাটাই কি সখু বা অসুখের লক্ষণ?
তাছাড়া আর কী বলব, তুমিই বলো? সত্যি বলতে, এই বাড়িটি আমাকে এত আকর্ষণ করে তার প্রধান কারণই হলে তুমি। একথা কি তুমি কখনও মনে করো না?
লাল হয়ে উঠল ও। শাড়ির আঁচলটা অনর্থক খুঁটতে খুঁটতে বলল, কী করে জানাব? তোমার মনের কথা তো আমার জানা নেই।
ঠিক। আমি পরম দার্শনিকের মতো মুখ করে বসে থাকি। চুপচাপ কাটল কিছুক্ষণ। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে আবার মুখ মুছতে থাকি, বলি, সত্যি বড্ড গরম পড়েছে।
রাগ না করলে একটা হাতপাখা নিয়ে আসি।
আমার রাগে কিছু যায়-আসে নাকি?
ও হাসল। উঠে গিয়ে একটা হাতপাখা এনে হাওয়া করতে যেতেই বাধা দিয়ে বলি, সে কী, আমাকে দাও।
আমি করি না।
পাগল নাকি?
একহাতে ওর হাত ধরে অন্যহাতে হাতপাখাটি কেড়ে নিয়ে বলি, আমাকেই বরঞ্চ বাতাস করার সুযোগটা দাও। আমিই হাওয়া করি। তুমি আমার সামনে বসে থাকো।
ওর হাতের স্পর্শে আমার বুকের মধ্যে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। কথা বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ। তারপর আস্তেধীরে হাতপাখাটি নাড়তে নাড়তে হেসে বলি, রাগ করলে নাকি? কী করব বলো, মনে মনে সর্বক্ষণ এতই কাছের মানুষের কথা ভাবি যে, তোমাকে কর্মব্যস্ত দেখলে অস্বাভাবিক ঠেকে। কথা বলছ না কেন?
কী বলব?
বলার কি কিছুই নেই?
কতই তো আছে, সবই কি মুখে বলা যায়?
একটা চাকুরির সন্ধান পেয়েছি। সেই খবরই দিতে এসেছি।
বেশ তো।
দুদিন পরেই চলে যেতে হবে।
একটা চাকুরি কি অবহেলার যোগ্য?
ওরে বাবা, তুমি একেবারে গুরুজনের মতো কথা বলছ, কিন্তু তুমি কি জানো না যে, পৃথিবী উলটে গেলেও আমি…।
হঠাৎ ভীষণ গরম বোধ করি। মনে হলো কান দুটো যেন জ্বলে যাচ্ছে! কথাটি শেষ না করেই হাতপাখাটি নাড়তে নাড়তে বলি, অসময়ে এলাম বলে রাগ করোনি তো?
রাগ করলেও কি তুমি তা শুনতে?
বারে, তুমি দেখছি আমাকে বেশ প্রশ্রয় দিচ্ছ। কিন্তু আমি দুদিন পর চলে যাব কি যাব না সে সম্বন্ধে তো কিছু বলছ না।
এর মধ্যে আমার কি কিছু বলার আছে?
একমাত্র তোমারই আছে।
আশ্চর্য! ও অন্যপ্রসঙ্গ তোলার অভিপ্রায়ে বলল, মাইজি বোধ হয় এখনই এসে পৌঁছবেন। আমার জলখাবার তৈরির তাড়া আছে?
তাড়া তো তুমিই করছ দেখছি। বিরক্ত বোধ করলে আমি নিশ্চয়ই উঠে যাবে। হঠাৎ চেয়ার ঠেলে শব্দ করে উঠে দাঁড়াই।
দুপা এগুতেই ও বলল, এই রোদে আবার ফিরে যাবে? তারপর যদি কোনও অসুখবিসুখ করে তাহলে আমাকে দায়ী করা হবে।
অসুখ বলতে তুমি দেখছি কেবল শরীরটাই বোঝো।
যাই বুঝি না কেন, তুমি রোদ না পড়লে যাবে না এই আমার অনুরোধ।
ওর কথায় গ্রাহ্য না করে বলি, আমার ভালো লাগছে না, কোনওরকমে মামার বাড়ি গিয়ে উঠতে পারলেই বাঁচি। অনর্থক এলাম, তোমাকে বিরক্ত করলাম…।
বিরক্ত হয়েছি একথা তবুও বলবে?
বলব না?
না।
সত্যি?
রাগ করে মুখ ঘোরাল ও। সঙ্গে সঙ্গেই আমার একটি হাত ওর কাঁধের ওপর রেখে বলি, কথায় কথায় এমন রাগ করলে চলে কি?
ও চমকে উঠল। ওর স্তম্ভিতভাব দেখে হঠাৎ থতমত খেয়ে যাই। হাত উঠিয়ে নিয়ে অত্যন্ত মৃদু গলায় বলি, মাঝেমধ্যে নিজেকে একেবারেই সামলাতে পারি না। তোমাকে বলাই ভালো যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আরক্ত হয়ে ও কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আস্তেধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকি। আল্লাহ কি আছেন? এই বিশ্বব্রহ্মণ্ডের সহস্রকোটি প্রাণীর মনের কথা কি তিনি শুনতে পান? যদি পান তাহলে আজ আমারও একটি প্রার্থনা রইল তার কাছে। তখনই মাসির কণ্ঠ শোনা গেল। ও বলল, তোমার বোনপো এসেছেন।
কখন এলো? আমাকে ডাকলি না কেন? তার কণ্ঠ শুনে মনে হলো ওকে ভুরু কুঁচকে জেরা করছেন। ও বলল, এই তো। আমি দেখতে পেয়েই জলখাবারের ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি।
তাই বল। জলখাবার নিয়ে আয়? আমি ওঘরে গেলাম।
জলখাবারের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়েই মাসি আমার ঘরের দিকে আসতে লাগলেন, তার পদধ্বনি তা-ই বলছে।
ও দুই নম্বর। এক নম্বর শ্বশুরবাড়িতে। গ্রামের মধ্যে ওর স্বনামধন্য। ওকে চেনে না এমন কে আছে? দশমশ্রেণির বাড়ন্ত মেয়ে আঁটোসাঁটো গড়ন, সরলসুন্দর চোখদুটো। কোমরে কাপড় জড়িয়ে কোঁকড়া কালো চুল মেলে দিয়ে দিব্যি মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। ঘুড়ির দিনে ঘুড়ি উড়ায়, ধানের দিনে ধান ভাঙে, আমগাছে চড়ে আম তুলে- এমন কোনও দুরূহ কর্ম নেই যা ওর দ্বারা অসম্ভব। মেসোমশায়ের গভীর স্নেহচ্ছায়ায় তার এই সরল সদানন্দতা দিনের-পর-দিন অবাধ প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠছে। মেসোমশায় তার মেয়ের এই দস্যিপনা এমন সস্নেহ হাসির সঙ্গে উপভোগ করেন যে, সেই সময় তার মুখটি দেখলে মনে হয়, এর চেয়ে সুখ আর কোথাও নেই। কিন্তু গ্রামে এ নিয়ে ভয়ানক আলোচনা চলে। প্রথমে রেখেঢেকে চললেও ক্রমে তা প্রকাশ্য শত্রুতায় দাঁড়িয়ে যায়। একবার মাসি এ নিয়ে মেসোমশায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে মেয়ের শাসনভার নিজের হাতেই গ্রহণ করেন। প্রথমে মিষ্টিমুখে, তারপর চড়-চাপড়টাও। মাসির এই নিষ্ঠুরতায় ও একটু অবাক হলো বটে, কিন্তু ফল হলো না কিছুই, বরং আগুনের মতো লকলকে হয়ে উঠল ওর দস্যিপনা।
মাসি ঘরে পৌঁছেই অবাক হয়ে গেলেন। ভর্ৎসনা করলেন খবর না দিয়ে আসার জন্য। আমি হাসিমুখে অপরাধ স্বীকার করে মাসিকে আদর করি। কথাবার্তায় ও জলখাবারে অনেক বেলা হয়ে গেল। কী এক মাধুর্যতায় সমস্ত মন আচ্ছন্ন হয়ে রইল।
এটা মেসোমশায়ের পৈতৃক বাড়ি। বাড়িটি বেশ, যদিও আমাদের বাড়ির চেয়ে ছোটো। আলাদা আলাদা ঘর, আর যেটি বৈঠকখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সেটি অন্তঃপুর থেকে একেবারে স্বতন্ত্র। এই অঞ্চলের খাঁটি বনেদি পরিবার মেসোমশায়দের; অর্থ চলে গেলেও ক্ষয়ে ক্ষয়ে বৈঠকখানার চালটি ঠিকই রক্ষা পেয়েছে। মেসোমশায় দশটা-পাঁচটা কাছাড়িতে পড়ে থাকেন- ফিরে এসে খেয়েই বেরিয়ে যান তাসের আড্ডায়, কাজেই বৈঠকখানা নামমাত্র বৈঠকখানা। বরং বৈঠকখানাটি পাঠশালায় পরিণত হয়েছে। শুনেছি, হয়তো মাইজির কাছ থেকেই শুনেছি, একদিন নাকি কাছারিতে যাওয়ার মুখে মেসোমশায়ের দেখা হয়ে গেল গ্রামের পাণ্ডা মৌলভির সঙ্গে। হাসিমুখে সম্ভাষণ জানিয়ে এগিয়ে গিয়েই মেসোমশায় থমকে গেলেন। মৌলভি গভীর মুখে বলে উঠলেন, এটা কি আপনাদের উচিত হচ্ছে! অতবড়ো মেয়েটা আপনাদের পাঠশালার সকল ছেলেদের সঙ্গে অমন দামালি করে বেড়ায়, এতে কি একটুও লজ্জা করে না। সমাজকে কি আপনাদের একটুও ভয় নেই? আমি গতকাল নিজ চোখে দেখেছি আপনার মেয়ে আপনাদেরই পাঠশালার একটা বাড়ন্ত ছেলের সঙ্গে গল্প করছে।
তাতে কী হয়েছে?
কী হয়েছে! অবাক করলেন! ও মেয়ের কি জাতজন্ম আর বাকি আছে নাকি? তা ওসব বিবিয়ানা আপনারা সমাজের বাইরে চালালেই হতো।
মেসোমশায় একটু চুপ করে থেকে বললেন, তাহলে আপনি কী করতে বলছেন?
আমি আর কী বলব, ঐ সতীসাবিত্রী মেয়ের একটা গতি করুন, আমার মেয়ে হলে গলায় কলসি বেঁধে ডুবিয়ে দিতাম।
তা জানি, মেসোমশায় চড়া গলায় বললেন, ডুবিয়ে কি কাউকে দেননি? নিজের একফোঁটা মেয়েকে যদি স্বেচ্ছায় এক লন্ডনি বুড়োর হাতে দিতে পারেন টাকার লোভে, তাহলে আপনার জন্য কিছুই অসম্ভব নয়। ঘৃণা ভরে মেসোমশায় পা বাড়ালেন যাওয়ার জন্য।
মৌলভি এবার হঙ্কার দিয়ে উঠলেন, আস্পর্ধা! কাকে কী বলতে হয় তা জানেন না। আমিও দেখে নেবো কত ধানে কত চাল, আমার নামও রহমত মোল্লা…।
আর না শুনে হনহন করে চলে যান মেসোমশায় কাছারির দিকে। মনটা বড়োই খারাপ হয়ে যায় তার। ভাবেন, মেয়েকে বিয়ে দিলেই রক্ষা। তখন থেকেই তিনি পাত্রের সন্ধান করছেন। ডানে, বাঁয়ে, উত্তরে, দক্ষিণে তাকাচ্ছেন; কিন্তু সুপুরুষ, লম্বা, রাজপুত্রের মতো কাউকে পাচ্ছেন না।
চলবে…