
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ২৬
পঞ্চম অধ্যায়
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২। শনিবার। রাত্রি।
আজ পাঁচ সপ্তাহ শেষ হতে চলল, লন্ডন এসেছি; কিন্তু সূর্যের মুখ এখনও দেখতে পাইনি। কে ভেবেছিল- এমন হবে। আমি যে হাইস্কুলে ছিলাম, সেখানকার হেডমাস্টার বলেছিলেন, তুমি স্থানীয় শিক্ষক; স্কুলের প্রতি একটা কর্তব্য তোমার আছে। আমার পরে তোমাকেই স্কুলপরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে। ছেলেরা তোমাকে শ্রদ্ধা করে। এমতাবস্থায় তুমি বিলেতে না গিয়ে বরং তোমার ছোটো ভাইকে পাঠিয়ে দাও।
শিক্ষকতায় আমার মানসিক তৃপ্তি ছিল। একবার ভেবেছিলাম- মাস্টার সাহেবের কথানুযায়ী কাজ করাই উচিত; কিন্তু এখন দেখছি না করেই ভালো করিছি, ভাইকে পাঠালে ভুল হতো, তার অবস্থা হতো- কূল নাই, কিনার নাইরে; নিজে এসেই কূলকিনারা পাচ্ছি না। সবচেয়ে যোগ্যতম ভাগনের অযোগ্যতায় মামুজি অতিষ্ঠ, হওয়ারই কথা, এতদিন ধরে বেকার ভাগনে পোষা কি সহজ কথা! না, অবশ্যই না। হাতি পোষার মতো ব্যয়বহুল, বিরক্তিকর। অবশ্য এখনও মামুজির মতো নিরাশ হইনি; হলে কি দুই রাত্রি আগে লন্ডন দেখতে যেতাম। সেই ঘটনা, ভ্রমণ, আপ্যায়ন কোনওকিছুই মেনে নিতে পারছি না; ওর সঙ্গ নেওয়াটাই হয়তো ভুল ছিল, না গেলেই হতো, ভেতর থেকে কে যেন টিকটিক করে উঠল। ঘটে-যাওয়া ঘটনাটি ঝাপসা অন্ধকারে ও ঝিমঝিম লাগা অবস্থায় মনের মধ্যে চিকচিক করছে; গোটা ঘটনাটি যেন মগজকে কামড়ে ধরেছে।
নেশা
আমাকে প্রায় টেনেই বাড়ি থেকে বের করে একটি ট্যাক্সিতে বসিয়ে দিলো। তার কল্যাণেই শাহিচাল; অন্যদিন হলে বাসে ঝুলতে ঝুলতে ঘুরে বেড়াতে হতো। অক্সফোর্ড স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছতেই ট্যাক্সিওয়ালাকে জাবেদ বলল, স্টপ। দরজা খোলা মাত্রই এপাশ-ওপাশ থেকে যুবক-যুবতীর হইচই আমার কানে ভেসে এলো। রাস্তার পাশের হটডগ দোকানে আগুন জ্বলছে, বাতাসে হটডগ পোড়ানোর গন্ধ। এরই পাশে লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের বন্ধুসভার সদস্যরা জটলা বেঁধেছে। রাত্রি গভীর হয় হয়, তবুও শীতের তীব্রতা নেই, শুধু ঝাপসা কুয়াশার চাদর লেপটে আছে। ট্যাক্সি ছেড়ে আমরা এগুতে থাকি। একটা শুঁড়িখানার সামনে এসে জাবেদ দাঁড়াতেই আমি চমকে উঠি; মনে মনে বলি, আমাকে জাবেদ হঠাৎ করে এখানে নিয়ে এলো কেন? তবুও শাহিমেজাজে চলা জাবেদের পিছু পিছু শুঁড়িখানায় প্রবেশ করি। ইয়ারবন্ধুর ধোঁয়াভরা পরিবেশে সূরাপানের মেলা জমে উঠেছে বেশ। সবাই যেন সাচ্চা মানুষ, সব্বাই হাসিহাসি, খুশিখুশি; বিনা বাক্যালাপে তাদের মধ্যকার অমীমাংসিত সমস্যাগুলো যেন মিটে যাচ্ছে; তবুও আলাদা আলাদা সুরফুর্তির স্বর- আনন্দের ঝংকার, সমবেত সংগীত- শুঁড়িখানার এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে; ঠিক সুর নয়, সুরের ঝরনা যেন। বিয়ে-করা সংসারী মানুষগুলোও সারা সপ্তাহের কুলিগিরি পরিশ্রমের ক্লান্তি দেহ থেকে নিশ্চিহ্ন করতে এই আনন্দসাগরে ডুব দিয়েছে, তবে তাদের ঠোঁটের ফাঁকে ব্যথিত জীবনের ব্যর্থতার ঝিলিক ঠিকই দিচ্ছে; তারা যেন মদ্য খেয়ে অভাবের চাপ ভোঁতা করতে চাচ্ছে। এখানেই, সুরের ঝরনা-ধারা মিলিয়ে যাক-বা-না-যাক, ঠিকই সৃষ্টি হচ্ছে জীবন-নামের চালচিত্রটি। আমার জোয়ান বুকে শক্তিসঞ্চয় করি, চারদিকের দৃশ্য অবলোকন করতে করতে একটি চেয়ার টেনে আঁটসাঁট হয়ে বসি, তবে মনের খুঁত খুঁত দূর হলো না; তাই হয়তো জাবেদ বসতে-না-বসতেই আমার দেহটি দুলে উঠল। তখনই সিগারেটের ধোঁয়ার বিচিত্র জালটি ভেদ করে একটি যুবক ধীরস্থির পদক্ষেপে ও গম্ভীর মুখে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। সাজপোশাকে বোঝা যায় সে শুঁড়িখানার একজন কর্মচারী, বিনা প্রশ্নে ও নির্বিচারে গ্রাহকের হুকুম তামিল করে চলার জন্যই যেন তাকে গড়া হয়েছে। তার চোখেমুখে ঘৃণা-অবিশ্বাস-ভয়, বিশেষ করে ভারতবর্ষের মানুষগুলো যেন তার দৃষ্টিতে আবর্জনার স্তূপ। সে যে অস্বস্তি বোধ করছে তা লুকানো থাকে না, কপালের ভাঁজে ও অভাঁজেই তা-ই প্রকাশ পাচ্ছে। সে একরোখাভাবে তার মাথাটি শরীরের মধ্যখানে স্থির করে ঠোঁটের কোণে সুকৌশলে ধারণ করে রেখেছে একটুকরো হাসি। গ্রাহককে মদ্য দিয়ে বেহুঁশ করে রাখাই তো তার কাজ, তাই হয়তো তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও ঠোঁটদুটোয় এর প্রভাব পড়ছে না। ঠিকই বুঝতে পারছিÑ যুবকটি হেসে মনে মনে গালি দিতে পরোয়া করবে না, আবার গালি দিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠতেও সময় নেবে না। গ্রাহকের আসা-যাওয়ার পথে আস্তেধীরে মাকড়সার জাল বোনার মতো আলাপে জড়িয়ে, জীবন সম্পর্কে নিজের অভিমত প্রকাশ করতে করতে, অকারণে অনায়াসে কয়েকবার হাসির চমক তুলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতেও দ্বিধা করবে না, সময়ও নেবে না; তার চেহারাই এর জ্বলন্ত সাক্ষী। তার ভঙ্গিতে যদিও অন্যরকম না শুধানো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন, আন্তরিকতার ইশারা তো নয়ই, তবুও একরকম কৃত্রিম বন্ধুসুলভ ব্যবহার আশা করা অসম্ভব নয়; সে যতই চেষ্টা করুক না কেন, তা গোপন রাখতে পারছে না। যুবকটির দিকে ঘাড় ফিরিয়ে জাবেদ বলল, ভোদকা প্লিজ। জাবেদের কথা শেষ হতে-না-হতেই ভোদকার নাম শুনে কেঁপে উঠি। আমি অপ্রস্তুত। বিব্রতকর অবস্থা। জাবেদের দিকে একটু ঝোঁকে, মনে মনে অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করা সত্ত্বেও, মুখের পেশিতে প্রসন্নভাব ফুটিয়ে বলি, ভোদকা পান করার কথা বলছ? জাবেদ সেই কথায় কান না দিয়ে যুবকটিকে বলল, দুই ভোদকা প্লিজ। আমি প্রতিটি শব্দ ওজন করে উচ্চারণ করি, যাই বলো, আমি এতে অভ্যস্ত নই, বরং আমার জন্য কোকাকোলার অর্ডার দাও। কোকাকোলা অর্ডার দেওয়ার আগেই যুবকটি সিগারেটের ধোঁয়া ভেঙে তাদের সামন থেকে উধাও হয়ে যায়। জাবেদ বলল, এ কী বলছ! কোল্ডড্রিংকস তো মেয়েরা পান করে। পানাহার স্রেফ অভ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। আমার মনের কথা গোপন রেখে, এক মনোরম ভঙ্গিতে হাসতে থাকি। যুবকটি ভোদকার দুটো গ্লাশ দিয়ে গেল, সঙ্গে কিছু বাদামও। চলে যাওয়া যুবকের চুলের ঢেউ তোলা ঝিরঝির হাওয়া দেখতে দেখতে শুরু হলো মদ্যপানের আসর। জাবেদের তীক্ষ্ণ চোখদুটো আমার ওপর যেন তিরের মতো বিঁধে আছে, তবে দৃষ্টিতে স্থান করে নিয়েছে একরকম বিস্ময়কর অনুভূতিও। যদিও তার ঠোঁটদুটো কাঁপছে, তবুও ঠোঁটের ফাঁকে দাঁতগুলো নীরব; আর আমি নেশার দখলে, চোখের পাতাগুলো তাই ভারী দেখাচ্ছে, সবকিছু যেন কেমন কেমন লাগছে। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছি, ঘামে ভেজা আলুথালু চুলে হাত বুলিয়ে কী যেন বলতে চাচ্ছি, কিন্তু পারছি না, আর তাই উৎসুক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। জাবেদ তার লম্বা দেহ সামনের দিকে একটু ঝুঁকিয়ে, নিঃশব্দে একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল, তারপর ভুরুর ওপর গভীর উদ্বেগের সচেতন রেখা ফুটিয়ে, চট করে ভোদকার গ্লাশটি একনিঃশ্বাসে শেষ করে টেবিলে রেখে দিলো। গ্লাশটি থরথর করে কাঁপছে, যেন জীবনের কোলাহল আছড়ে পড়েছে এর ভেতর। তারপর আস্তেধীরে মিটিমিটি হাসি ছড়িয়ে, দুহাতে চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরে, চেঁচিয়ে উঠল জাবেদ, সেরি প্লিজ। যুবকটি ভারী পদক্ষেপে আবারও এগিয়ে এলো। আমাদের সামনে আরও দুটো গ্লাশ স্থাপন করে ফিরে যেতে যেতে আড়চোখে দেখে নিল আমাকে। যুবকের মুখ আগের চেয়েও গম্ভীর, চোখদুটো যেন চুপি চুপি কাঁদছে। হঠাৎ যুবকের পাশ দিয়ে ফ্যাক্টরির গন্ধ ছড়িয়ে দুটো যুবক ব্যস্তভাবে ছুটে গেল। মদ্যবারের পাশে ছেলে-বুড়োর জটলা থেকে তাদের উদ্দেশে কেউ কেউ টিটকারি দিচ্ছে, কেউ-বা উৎসাহও। তারা মদ্যবারের সামনে এসে থামল। তাদের ভারি চিন্তিত চেহারায় ফুটে উঠেছে বিরক্তির কয়েকটি ক্রুদ্ধরেখা। একজন তার ঘাড় ডানদিকে একটু কাত করে অন্যজনের লম্বাচওড়া ভরাটে মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, আর অর্ডারের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জাবেদের ওপর স্থাপন করতেই দেখতে পাই, ওর মুখে একটি অনিশ্চিত ভাব ফুটে উঠেছে; আর জাবেদ তার বিষাদ আর সংশয়ের ছায়া মিশানো তীক্ষ্ণ দৃষ্টির শর দিয়ে আমাকে পাঁতি পাঁতি করে কাটছে, একইসঙ্গে তার বুক অসমানভাবে উঠানামা করছে, যেন এই বুকে মাথাকোটে মরছে এক আশ্চর্য জটিল ব্যথা। এরকম আকুল ব্যথায় ব্যাকুল হতে জাবেদকে কখনও দেখিনি, এই অসহায় অবস্থার বিশ্লেষণ আমার কাছে অজানা। বুকের উঠানামা কিছুটা স্থির হলে জাবেদ গলাকাশি দিয়ে, একবার ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে বলল, আমাদের একটি সুখী পরিবার ছিল। কিন্তু দিন কতক আগে পূর্ব-বাংলা থেকে একজন মৌলানা এসে এমন ফতোয়া দিলেন যে, এখন আমাদের শান্তিকুঞ্জে ঢুকে পড়েছে একটি হিংস্র নেকড়ে, আর তার তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে আমাদের সংসারটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমার মা-বাবার ধৈর্যে, চেষ্টায়, যত্নে, তাদের রক্তমাংসের বন্ধনে, রচিত সংসারটি ভেঙে যেতে বসেছে। দগ্ধ কান্না জড়ানো- ভেঙে-যেতে-বসেছে শব্দগুলো আমাকে বিধ্বস্ত করল। জাবেদের বুকে এতদিন সযত্নে ধরে রাখা হৃদয়মোচড়ানো ও নাভিছেঁড়া গোপন কষ্টগুলো যেন প্রকাশ পেল জ্বলন্ত আগুনের উথলানো উদগ্র উত্তাপরূপে। আমি বুঝতে পারছি, অচলায়তন ও অপ্রকাশিত নির্জনতার মাঝে একটি সংসারকে বিসর্গবিসর্জন দেওয়া হচ্ছে, তবে জানে না এই পরিবারের মূল্য সমাজের কাছে কতটুকু; তাই হয়তো তার আত্মার মধ্যে একটি তীব্র আর্তনাদ সৃষ্টি হয়েছে, তবে মনে হচ্ছে, তার শরীর থেকে আত্ম যেন ছায়ার মতো বেরিয়ে গিয়ে স্থান করে নিচ্ছে মদের গ্লাশে; কিন্তু গ্লাশটি বিচলিত নয়, হয়তো ওর জন্য ঘটনাটি কিছুই না। আমার দৃষ্টি দ্রুতগতিতে ঘুরে বেড়াতে থাকে গ্লাশের মধ্যে; আর গ্লাশের মধ্যেই সিগারেটের ধোঁয়ার অঢেল অণু দৌড়াদৌড়ি করে বাদুরের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে যেন পৃথিবী জুড়ে অধিকারচ্যুত অভিমানী মানুষের অভিযোগগুলো ঝুলে পড়ছে। আমার দৃষ্টি ধূসর, মুখও নিমিষে কেমন যেন শুকিয়ে উঠল। নিজেকে আয়ত্তে এনে বলি, না, তা ভেঙে যেতে পারে না। জাবেদ তার দৃষ্টি নিচু করে, পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে, অতঃপর একটিতে আগুন সংযোগ করে। দীর্ঘটানে অনেকটা সিগারেট ক্ষয় করে বেণির আকারে কুণ্ডলী পাকিয়ে মুখোনিসৃত ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে দিয়ে বিষণ্নভাবে সেই দিকেই তাকিয়ে থাকে- অদ্ভুতভাবে ধূসর ধোঁয়া তার মাথার ওপর উঠে শুঁড়িখানার বাতাসের সঙ্গে মিশে যায় যেন। হঠাৎ বলল, একজন বাঙালি পুরুষ ও একজন ইংরেজ নারীর হৃদয়পটে জমে থাকা প্রেমের উচ্চারিত ও অনুচ্চারিত কথার আদানপ্রদানে যে মিলনসৌধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা কিনা ইসলামিক শাস্ত্রের বিধানে বাঁধা পড়েনি। এরকম বরখেলাপ মৌলানা মেনে নিতে পারেননি। তাই তাদের সম্পর্ক বরবাদ না হয়ে যায় কোথায়! কোলাহলভরা শুঁড়িখানার পরিবেশে জাবেদের কণ্ঠস্বর ক্ষীণই শোনায়। তার অন্তরঙ্গ নীল চোখে যেন ফুটে উঠেছে খুব পরিচিত কিন্তু পরাজিত, নিরীহ এক নারীর ছবি। তিনি যেন সকল আঘাত, উপেক্ষা, শ্লেষ, বিদ্রুপ হজম করে স্তব্ধনির্বিকার পাথরমূর্তি। এই নীরবতার মধ্যেই ঠিক তার রক্তক্ষরিত অন্তরের দ্রোহঘৃণাপ্রতিশোধস্পৃহা সগর্বে আত্মপ্রকাশ করছে। এই নারীর ছবিটির পাশেই ভেসে উঠেছে মানব মনের অঙ্গীকারহীন অবচেতনস্পর্শী এক নিষ্ঠুর মৌলানার প্রতিচ্ছবি; তার চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে ক্রুর, ব্যঙ্গবিদ্রুপ আর একটি সুখী পরিবার ভাঙার বীরত্বসূচক দাপট; তার ঠোঁটে স্থান করে নিয়েছে অর্থহীন-আত্মপ্রতারক-বিস্বাদ-অস্তিত্বহীন আস্ফালনের হাসিটিও। এই হাসির আঘাতে জাবেদের ভুরুদুটো যেন কাঁপছে। সেদিকে তাকিয়ে বলি, আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে রক্তমাংসের আন্তরিকতার মূল্য অনেক বেশি। মৌলানা তার ক্ষয়কারক দিকগুলো প্রকাশ করেছেন মাত্র। তবে তিনি ঠিকই জানেন, যেকোনও শাস্ত্রের বিধান দেখিয়ে তোমার মা-বাবার সম্পর্ক বরবাদ করতে তিনি পারবেন না। উচ্ছ্বাসময়, আবেগপ্রবণ ও একটু আড়ষ্টের ভাব আমার কণ্ঠে প্রকাশ পায়। সঙ্গে সঙ্গেই জাবেদ সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বলছিলাম, মৌলানার মতে বাপ-মায়ের এরকম সম্পর্কের জন্য তাদের ছেলেমেয়ে লজ্জায় মুখ ঢাকতে বাধ্য। জাবেদের নিরুপায় অক্ষমতার অকপট স্বীকারোক্তি প্রকাশ হতে-না-হতেই হঠাৎ যেন একরকম হিমেল বাতাস টেবিলের নিচে সৃষ্টি হয়ে, শুঁড়িখানার কোলাহলের সঙ্গে মিশে, দেয়ালের একের-পর-এক ইটে আঘাত করতে থাকে, তারপর উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে হতে ছাদের সঙ্গে মিশে যায়; অন্যদিকে, গ্লাশের গায়ে আঁকা হতে থাকে জাবেদের অপ্রকাশিত আর্তচিৎকার আর তার মনে ধরে রাখা তীব্র ব্যথার গোপন নকশা। ঝাপসা আলো-অন্ধকারের মধ্যেও স্পষ্ট অনুভব করছি জাবেদের যাতনা, বলি, তোমার মন ব্যথায় ভরে আছে। দেখো, আমরা প্রত্যেকেই কোনও-না-কোনও সময় জীবন-নামের জঠিল পথটি অতিক্রম করতে গিয়ে অবাঞ্ছিত-অনাকাঙ্ক্ষিত অপবাদের তারকাঁটার ওপর দিয়ে নগ্ন পায়ে হাঁটতে হয়, তাই তো দুর্যোগের সময় সহজেই হতাশ হয়ে পড়ি। কথাগুলো বলেই হেসে উঠি, কিন্তু জাবেদ হাসল না, শুধু বলল, তুমি হাসছো কেন? আমার বুক ছ্যাঁদ করে উঠল, বলি, মনে হচ্ছিল- তোমার মনে যে-লোকটি আঘাত করেছেন তিনি এক আস্ত গাধা। তোমার ঘাড়ে এরকম অপবাদ দেওয়া নেহাত মূর্খের কাজই বটে। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে যোগ করি, আমার মা-বাপ যদি দুটো ভিন্নবর্ণের মানুষ হতেন তাহলে আমি গর্ববোধই করতাম। কখনও লজ্জায় আমার মাথা নত হতো না। এর অর্থ খুঁজে না পেয়ে জাবেদ বলল, কেন? আমি বলি, অবিভক্ত বাংলার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামই বলেছেন, মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। সঙ্গে সঙ্গে জাবেদ প্রশ্ন করল, কিন্তু ধর্মগ্রন্থ- কিতাব? জবাব দিই, নজরুলই বলেছেন, মানুষ এনেছে গ্রন্থ কেতাব, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনও। বুঝলে, মানবধর্ম ঠুনকো জিনিস নয় যে, ব্যক্তিবিশেষের বা কোনও-এক ধর্মের জাঁতাকলে পিষ্ট হবে। জাবেদের চোখে অপূর্ব আলো ফুটে উঠল, কোমল কিন্তু কঠিন, একগুঁয়েমির দীপ্তিও হতে পারে; কিন্তু কিছুই বলল না; বরং আমিই বলে চলি, মৌলানার ফতোয়ায় কী ছিল? সিগারেটের ধোঁয়ার কুয়াশায় নিমজ্জিত জাবেদকে আরও গম্ভীর দেখায়, যেন তার চোখ থেকে আলো নিভে গেছে, সেখানে শুধুই নিথর অন্ধকারের রাজত্ব; হৃদয়ে যেন তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ! জাবেদ বলল, একদিন তিনি আমার মাকে সুরা আবৃত্তি করার জন্য বলেছিলেন। মা যখন আবৃত্তি শেষ করলেন তখন মৌলানা বিরক্ত হয়ে বলেন, এভাবে ভুল উচ্চারণে আবৃত্তি করার অর্থই হচ্ছে আল্লাহর কালামের অবমাননা করা। এমতাবস্থায়, আপনাদের বিয়েই হয়নি, আর আপনাদের মিলনজাত সন্তানরা জারজসন্তান বলে গণ্য হওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। সংকোচভারে জাবেদ আর মুখ তুলে তাকাতে পারে না। সে যেন অন্য মানুষ- অচেনা, তার স্বরও অন্যরকম- আগের চেয়ে গভীর কিন্তু নিচু, গমগমে; তার হৃৎপিণ্ডটি কঠিন দুঃখে কুঁকড়েমোচড়ে ভেঙে যাচ্ছে যেন; তার গাল বেয়ে যেন নিঃশব্দে গড়াচ্ছে দুঃখস্রোত; তার মন বিষাদে ভরপুর; তার দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক অজানা ভয় যেন প্রকাশ পায়; তাই হয়তো আমার মনে মমতার সৃষ্টি হয়, এজন্যই টেবিলের ওপর রাখা বন্ধুর হাতটি চুপচাপ তুলে নিই। তুলে নিতেই আমার হাতের মধ্যে দিয়ে সমস্ত শরীরে প্রবাহিত হতে থাকে জাবেদের অন্তরে সংগোপনে রক্ষিত অব্যক্ত কথাগুলো, ব্যথাগুলো। মনে মনে বলি, মন যেখানে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে, থাক-না সেখানে ভিন্ন মত, হোক-না কাজের ধারায় অমিল, কী যায়-আসে! আর প্রকাশ্যে বলি, মৌলানার অভিমতকে শ্রদ্ধা করতে গিয়ে নিজেকে আঘাত করার কোনও যুক্তি আমি খুঁজে পাই না। তার মত ও কর্ম তোমার জন্য বাইরের জিনিস, বরং তোমার বাবা-মা’র মত ও কর্মই হচ্ছে মূল। তাদের অস্তিত্বই বাস্তব। তাদের রক্তমাংসের মিলনই সত্য। ধর্মীয় বাহ্যিকানুষ্ঠানে গরমিল থাকলেও কিচ্ছু যায়-আসে না, বরং রক্তমাংসের অনুভূতি ও বিশ্বাস সর্বদাই পাপমুক্ত ও ভ্রান্তিমুক্ত থাকে। আমার কথাগুলো শেষ হতেই বন্ধুর হাতটি ছেড়ে দিই, টেবিলে রাখা বাদাম তুলতে থাকি, কিন্তু অসচেতনতার কারণে কয়েকটি আঙুলের ফাঁকে কার্পেটের ওপর ছড়িয়ে পড়ে। একইসঙ্গে জাবেদের চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রুও ঝরতে থাকে। তারপর ভেজা চোখদুটো রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে জাবেদ বলল, কিন্তু ফতোয়া শোনামাত্র বাবা দিশেহারা, আর মা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। আমার মুখ দিয়ে রাগেদুঃখে বেরিয়ে এলো, এসব অবাঞ্ছিত, অপ্রয়োজনীয়, অবান্তর, অশ্লীল, বিবেকহীন, মানবধর্মপরিপন্থি ফতোয়ার ভাঁওতাবাজি প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থায় অচল। বর্তমানে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যুগ চলছে, ফতোরার নয়। জাবেদ চমকে উঠল, যেন তার হৃৎপিণ্ডে আগুনের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার শরীর জুড়ে। সুললিত সৌকুমার্যের প্রকাশের নিদর্শন তার চোখদুটোয় ঝলমল করছে একরাশ প্রশ্ন, তবে মুখের চিন্তিত পেশিতে একরকম কোমলকঠিন বাস্তবতাই প্রকাশ পাচ্ছে। সে মৃদুভাবে চুল ঘষতে ঘষতে বলল, মৌলানা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কথা জানবেন কীভাবে? মনে এক বিপুলকূলপ্লাবী আবেগের ঢল সৃষ্টি হলো, চৈত্রের খারায় বৃষ্টি নেমে এলে যেমন হয়, ঠিক তেমনই আমার অন্তর অভিষিক্ত; তাই বলি, এসব নিয়ে আলোচনা করে কোনও লাভ নেই। মৌলানাকে শত বকলেও তার কিচ্ছু হবে না। জ্যাস্ট ফরগেট অল অ্যাবাউট ইট। জাবেদের দৃষ্টিতে একইসঙ্গে বিমূঢ়তা ও শঙ্কা প্রকাশ পেল। তার আহত হৃদয়ের সবটুকু ব্যথা যেন গলে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে তার ঠোঁটের ফাঁকে, তবে এখানেই স্থান করে নিয়েছে একটি মৃদুহাসি, অসহায় মন যে আস্তেধীরে সচল হয়ে উঠছে তারই নিদর্শনই যেন। শুঁড়িখানার পরিবেশও তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রিমঝিম তাল তুলেছে, চিমনির ভেতরের বাতাসও যেন উৎসাহে দিশেহারা। বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজের সঙ্গে দেয়ালঘড়ির কাঁটাগুলো টিকটিক শব্দে অদ্ভুতভাবে খেলা করছে। নিঃশব্দে একটি সচল তরঙ্গ জাবেদের দেহে চমকে উঠতেই সে বলল, ওয়াঞ্চ মোর প্লিজ। সেরি প্লিজ। টেবিলে সেরি পৌঁছতে দেরি হলো না। গ্লাশে চুমুক দিয়ে, একনিঃশ্বাসে শেষ করে জাবেদ বলল, দারুণ। স্বাদই আলাদা। তার সেরিসেবনের তৃপ্তিই আলাদা, কিন্তু আমার মুখ দেখে জাবেদ বোধ হয় কিছুই বুঝতে পারল না, তবে উপলব্ধি করছিÑ অন্তরে সৃষ্টি হয়েছে উত্তাল সমুদ্রতরঙ্গ, বাতাসের একরকম উন্মাদ আলোড়নও, আর দৃষ্টিতে চৈত্রের ঝরাপাতার ওড়াউড়ি- হেমন্তের অপেক্ষায় উদাসী বাউলের একতারার টুংকারই বেশি। হঠাৎ জাবেদ তার গভীরগম্ভীর কণ্ঠে বলল, সত্যিই তোমার সঙ্গ আমাকে খুবই আনন্দ দেয়। তাই তো তোমাকে একরকম জোর করেই আমার সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আর আমি বলি, তোমার সঙ্গলাভে আমিও আনন্দিত। এবার আমাকে আর জাবেদ হারাতে পারেনি। সেরি দিয়ে আবারও গ্লাশ পূর্ণ হলো। ভেবে পাচ্ছি না, বিয়ারের গ্লাশভর্তি সেরি কীভাবে আমার পাকস্থলীতে স্থান করে নিচ্ছে। সময় ঠিকই এগিয়ে চলে টিকটিক করে, সঙ্গে গল্পও। গল্পের রাজ্য হাতড়াতে হাতড়াতে একসময় নারীর প্রসঙ্গে আলাপ শুরু হলো। বোঝা গেল মদের সঙ্গে নারীর কী নিবিড় সম্পর্ক! নারীদেহের অভাব পূরণের ব্যাপারে জাবেদ সত্যি ধন্বন্তরি। যুবক হয়ে উঠা পুরুষ কীভাবে নারীর অন্বেষণ করে, স্বপ্নে কীভাবে নারী এসে উপস্থিত হয়, ফুলের উপত্যকায় কীভাবে নারীকে হাত ধরে নিয়ে যায় সহবাসের আশায়- সবই জাবেদ তার বক্তব্যে অপারমহিমায় সাজিয়েফুটিয়ে তুলল। নগ্ন নারীমূর্তির বর্ণনায় তার আকর্ষণীয় বাক্যজাল অপূর্ব, এই অন্ধকার রাত্রেও সন্ধান পেয়ে যাই প্রমোদচঞ্চল টেমস নদীতীরে সূর্যস্নানের প্রত্যাশায় শুয়ে থাকা একদল অর্ধোলঙ্গ নারীর। জাবেদের মনে যে পুলকানন্দ সৃষ্টি হয়েছে তা উপলব্ধি করে নীরব বাতাসও, বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ ছাড়াই, উন্মত্ত উৎসাহে শুঁড়িখানার পরিবেশকে বিদীর্ণ করতে থাকে। এই পুলকানন্দে, পরিপূর্ণ হৃদয়ে, আত্মহারা জাবেদ বাথরুম যায়, আবার ফিরেও আসে, আগের মতোই তার মন পুলকগাঢ়ছন্দে নাচতে থাকে, তাই হয়তো সে তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত মৃদুমৃদু ভাঁজে, ভারি সুন্দর তার গলা, যদিও তার মুখ থেকে মদের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে, তবুও সে যে সুন্দরভাবে গান ভাঁজতে পারে তা জানা ছিল না। আশ্চর্য! হঠাৎ জাবেদ বলল, চলো, আমরা নাচি। জাবেদ তো এমন স্বভাবের যুবক নয়, সত্যি সত্যিই আমার অধৈর্য চরমে পৌঁছে গেল, তাই হয়তো আমার গালে-গলায় ঘাম দেখা দিয়েছে, আর তাই হয়তো মরিয়া হয়ে বলি, আজ না হয় নাচটা থাক। জাবেদ দিশেহারা, চেয়ারে স্থির হয়ে থাকতে পারছে না; তার ঠোঁটদুটো একপ্রকার কাঁপছে, আনন্দে না কৌতূহলে ঠিক বুঝতে পারছি না, তবে তার দাঁতগুলো অগভীর স্বচ্ছজলের নিচে নুড়ি যেমন চিকচিক করে তেমনই ঝিকঝিক করছে। তুমি তো আমার নাচ দেখোনি? একথা বলেই জাবেদ তার শার্টের বোতাম খুলতে থাকে, তারপর যোগ করল, আই স্যাল ড্যান্স টুনাইট। দুহাত পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে, নগ্ন গায়ে, মাংসপেশি দুলিয়ে নাচতে লাগল। একসময় মদের প্রভাব সামলাতে না পেরে হোঁচট খেয়ে পড়ে। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেঝেয় থেকে তুলে নিই। জাবেদ তার গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বলল, চলো, তার চেয়ে নাচই দেখা যাক। মদ্যবার থেকে বেরুতে পারলে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি, তাই একমুহূর্ত বিলম্ব না করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। শুঁড়িখানা থেকে বেরিয়ে উপলব্ধি করি- হাঁটা ছাড়া গতি নেই; তখন শক্তির দশআনা ও ইচ্ছের ছয়আনাই শেষ, তবে মুক্ত বাতাসের ছোঁয়ায় শরীরে কিছুটা হলেও প্রশান্তি ফিরে এলো। লন্ডনের দিগন্ত ছেয়ে আস্তেধীরে রাত এগুতে থাকে চুপিচুপি- দশতলা, বিশতলা বাড়ির ছাদ ডিঙিয়ে; কোনও চঞ্চলতা নেই, শুধু অন্ধকারের গভীরতাই উপলব্ধি করা যায়, ল্যাম্পপোস্টের আলোও ঝলসে উঠছে না। সামনে তাকাতেই দেখি, দীর্ঘ রাস্তাটি গনগনে অন্ধকারে গলে যাচ্ছে, আর এই অন্ধকার ডিঙিয়ে দুহাত ছড়িয়ে ছুটে চলেছে জাবেদ; মনে হচ্ছে, তার মনে নারীর কোনও বাসনা নেই, অন্ধকারই যথেষ্ট, প্রয়োজন হলে বিলেতি বাতাস ও বাতি, লরি ও ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করবে। ওকে দেখে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না- রাতের লন্ডনই তার আপন। জাবেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়তে থাকি তার চোখমুখ- চোখদুটো ভীষণ উজ্জ্বল, ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি, খেজুরপাতার মতো ঝুলে থাকা শূন্যতা তার চুলের ভাঁজে-অভাঁজে আশ্রয় নিয়েছে, তবে এক-একসময় বড্ড উত্তাল হয়ে উঠছে তার দেহ। আমার ভুল ভাঙল, জাবেদের মন দোদুল্যমান, দোলক যেন; মৌমাছি যেমন ফুলের দিকে ধাবিত হয় তেমনই তার দেহও পেতে চায় আর-একটি শরীর; নারীর শরীর লাভের জন্যই তার দেহে দীর্ঘশ্বাস উঠছে; যদিও সে জানে- ইচ্ছে করলেই যেকোনও নারীসম্ভোগে তৃপ্ত হতে পারে না, কত রকমের দেয়াল চারপাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দুটো রাস্তা অতিক্রম করে তৃতীয় রাস্তায় পড়তে-না-পড়তেই জাবেদ যেন নিজেকে আর সংযত রাখতে পারল না; নিদ্রাহীন রাস্তাগুলো মাড়াতে মাড়াতে সে একটি কথাই চিন্তা করে চলেছে- যে-করেই হোক একটি নারীর শরীর চাই-ই-চাই; তার সমস্ত দেহমন আকুল হয়ে আছে একটি নারীদেহের স্পর্শলাভের জন্য, যেন একটুকরো রং তার মনের মধ্যে মদিরমোহ জাগিয়ে তুলেছে। তৃতীয় রাস্তাটি পেরিয়ে চতুর্থ রাস্তায় যখন পড়বে তখনই সে জোর করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে একটি নাচের ক্লাবে প্রবেশ করল। প্রবেশ করেই দীর্ঘশ্বাস ফেলি। জাবেদ হেসেই চলল, এর বাণে আড়াল হয়ে গেল বিলেতি অন্ধকারও। ক্লাবের টিকেটঘরে ঢুকে দেখি, চারদিকে ঝাপসা আলোর রাজত্ব, ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবে দেয়ালের গায়ে ঝুলে থাকা মাঝারি ধরনের নারীর পটগুলোকে ঘিরে আলোর মেলা বসেছে। পটের সারি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই একটি বিশাল দরজা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে-না-ঢুকতেই জাবেদ বলল, তুমি আমাকে ঘৃণা করো? যদি তাই হয়, তো তুমি চলে যেতে পার। আমি আর কখনও তোমার সামনে আসব না। তোমাকে আর কখনও মুখ দেখাব না। জাবেদের স্বরে এমন এক সিক্ত ঢং ছিল, ফলে আমি মনে মনে হেসে ফেলি; আর এই সুযোগে সে আর-একবার আমার মুখটি দেখে নিল; সঙ্গে সঙ্গেই মনে উদয় হলো- বেমানান কিছু বললে জাবেদের কষ্ট বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া কমবে না; তাই সে নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলে বলি, কী যে বলছ! আমি তোমাকে ঘৃণা করব কেন? আমারও তো কৌতূহল থাকতে পারে, তাই না! নিজের তালরক্ষা করে দ্রুতগতিতে জাবেদের পিছু পিছু এগিয়ে চলি। একটু পরেই সে থমকে দাঁড়াল নৃত্যমঞ্চের সামনে, শুরু হয়ে গেছে নাচ- ঠিক নাচ নয়, অর্ধোলঙ্গ অত্যাধুনিক নৃত্তগীতনৃত্য যেন। ক্ষণিকের মধ্যেই আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। দুই যুবতী বাদ্যের তালে-বেতালে দেহাবরণ খুলে যা আরম্ভ করে তা দেখে ভাবতে বাধ্য হই যে, কাহাতক পৌঁছোবে কে জানে? নৃত্যের ভঙ্গিতে যুবতীদুটো ব্র্যা খুলে ছুড়ে মারল দুইদিকে। এই বুঝি শেষ! কিন্তু না, বেডৌল পয়োধর প্রদর্শনে মশগুল হতে থাকে নৃত্তগীতনৃত্যপটীয়সী যুবতীদ্বয়। বাসশূন্য কটিদেশ প্রদর্শনপর্ব আরম্ভের ইঙ্গিতে দর্শকের আঁখিযুগল উন্মীলিত, অধিকাংশ দর্শকের বয়স মধ্যপ্রাঙ্গণ পেরিয়ে গেছে। যুবতীদ্বয় ঊরুদ্বয়ের মধ্যস্থল থেকে নেংটি টেনে বের করে ছুড়ে যেই-না মারল অমনই দুটো বুড়ো দুপাশ থেকে লুফে নিল; এর সঙ্গে প্রকাশ পেল, আহা, কী আনন্দ! অন্যদিকে, যুবতীদ্বয় বাদ্যের তালে-বেতালে নিতম্ব দুলিয়ে দুখানা হাতপাখার আবরণে সামন-পেছন ঢেকে নৃত্য করে চলেছে। মাঝেমধ্যে নৃত্যের তালে-বেতালে সামন-পেছন প্রায় উন্মুক্তভাবে উঁকিঝুঁকি দিলেও হাতপাখার আবরণটিকে উৎসুক দর্শকের দৃষ্টিভেদ করতে পারল না। মিষ্টিমধুর আলোয় মঞ্চটি অপরূপভাবে আলোকিত এবং যুবতীদ্বয়ের সৌরভে ক্লাবটি আমোদিত। একসময় শেষ হলো নৃত্তগীতনৃত্যটি। নাচের ক্লাব থেকে দুই বন্ধু যখন বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটছি, তখন বঞ্চনার দুঃখ থেকে দপ করে জ্বলে উঠল নারীবিহীন জীবনের মনোবেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকা জাবেদের প্রাণের উষ্ণ নিঃশ্বাস। একটি নারীদেহ ছুঁয়ে দেখার আকাক্সক্ষায় এবং অন্যরকম আনন্দে তার বুক যেন রেঙে উঠল, এ সম্বন্ধে পৃথিবীর কতটি পুরুষই-বা বুঝতে পারে, নারী দেখলেই যেন হৃদয় ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে। হৃদয়ই তো আত্মার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অতৃপ্ত, বঞ্চিত, অপূর্ণ আত্মার মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ নিয়ে জাবেদ বলল, চলো পিক্যাডেলি সাক্রাসে যাই। আমি বুঝতে সক্ষম হই- জাবেদের এখন কীসের প্রয়োজন; তাই বিরক্ত হয়ে বলি, ধ্যেৎ! আর পারছি না। জাবেদ জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট বারকয়েক চাটল; চোখদুটো অতিরিক্ত চকচক করছে; একইসঙ্গে তার গা থেকে একরকম অচেনা গন্ধ যেন বিলেতি বাতাসকে শীৎকারে চিরে আত্মহত্যা করল। জাবেদ তার মনে কামাদ্রিকুসুমপ্রহেলিকার ছবি ধারণ করে বলল, নারীবিহনী যামিনী কেমন করে কাটবে? এ-যেন অন্য-এক জাবেদ, অচেনা মানুষ। প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলি, আর কোনও ঝামেলা করা চলবে না। চলো বাড়ি ফিরে যাই। ধমক খেয়ে জাবেদ ফ্যালফ্যাল করে ক্ষণিকের জন্য তাকিয়ে রইল আমার দিকে; কিন্তু একটা ট্যাক্সি ব্রেক কষতেই তাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিই, একপাশে নিজেকেও। ট্যাক্সিওয়ালা স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জাবেদের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়, তার চোখের আড়ালে ভাবতে থাকি, আবে-যমযমের জলে শরীর ধুয়ে নিলেও চরিত্রকে আর বোধ হয় পরিষ্কার করা যাবে না।
চলবে…