
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ২৫
গাড়িতে উঠেই রেডিও অন করল মেয়েটি। রেডিওতরঙ্গে ভেসে আসতে থাকে লুডভিগ ফন বিটোফেনের সপ্তমসুরলহরি (সেভেনথ সিম্ফনি)। মেয়েটি ড্রাইভ শুরু করেছে। গাড়িটি ছুটে চলল রাজপথ ভেঙে। গাড়ির সঙ্গেই যেন তাল মিলিয়ে অর্কেস্ট্রার সুর কখনও উঁচুতে উঠছে, কখনও নিচুতে নামছে। আমার কানে ভাসতে থাকে এই সুন্দর সপ্তমসুরলহরি। লুডভিগ ফন বিটোফেনের এই সপ্তমসুরলহরি কখনও মনে করিয়ে দেয় যেন মানুষ সমুদ্রস্নানে রত। এই সপ্তমসুরলহরি যেন শাশ্বত সময়ের গভীরে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাজতে থাকে, যেন চিরকাল ধরেই বেজে চলবে, কোনওদিনও থামবে না। চুম্বনরত প্রেমিক-প্রেমিকারাও যেন শাশ্বত হয়ে ওঠে এই সুরলহরিতে। এরই মধ্যে আমার দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলো মেয়েটি। আর-একটি নিজের ঠোঁটে স্থাপন করল। আমার পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করে তার সিগারেটটি জ্বালিয়ে দিই। আমারটাও ধরিয়ে নিই। ধূমপান করতে করতে নিজমনে বলতে থাকি, কোথায় নিয়ে চলেছ হে সুন্দরী? আমি স্বর্ণপুরি চাই না, এমনকি স্বর্গপুরিও না, শুধু একটি চাকুরি। গাড়িটি ছুটে চলেছে আপন মনে, আপন বেগে। রাজপথ ছেড়ে গলিপথ ধরে কিছু দূর অগ্রসর হতেই, ঝোপঝাড়ের পাশে আসতেই, হঠাৎ থেমে গেল গাড়িটি। মেয়েটি আমার পাশে এমনভাবে বসল, যেন সে আমার দীর্ঘদিনের শয্যাসঙ্গিনী! আমার কাছে এসে বসার এই নারীসুলভ আচরণে যেন পৃথিবীটাও থেমে গেল।
সে তার উন্মুক্ত উরুর উপরদেশ দেখিয়ে এবং অঙ্গুলি নির্দেশে বলল, তোমার কাছে আসার জন্য তাড়াহুড়োয় স্টিয়ারিংয়ে আঘাত লেগে এ জায়গাটা ফোলে গেছে, হাত দিয়ে দেখো।
মেয়েটির টুকরো টুকরো ব্যবহার, টুকরো টুকরো ছবি, আর টুকরো টুকরো কথা বলার ধরন, আমার মনে হলো, নষ্টমেয়ের জীবনযাপনের একরকম একটা অংশ। ও আমার পৃথিবী থেকে আলাদা। ওর আচরণে যেন ঘোরা বন্ধ ও স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে স্ট্রাইক করে বসল- এ তো ভালো মেয়ে নয়। চোখের সামনে যেন থমকে গেল দৃশ্য-দূষণের সচেতনার যুগের ঘরবাড়ি আর অন্যান্য নগর-দৃশ্য। লুডভিগ ফন বিটোফেনের সপ্তমসুরলহরিও থেমে গেল। নষ্টদের সমুদ্রের জলে অভিসিঞ্চনের পবিত্র হওয়ার দৃশ্যটিও। প্রতি-অভিসিঞ্চনে সমুদ্রের তরঙ্গ যেন উত্তাল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সমুদ্রতটের পাথরের পাহাড়ে। মনের চোখে সেই দৃশ্যটি কল্পনা করার চেষ্টা করি। সমুদ্রের বিস্তৃত জলরাশি আর তীরভূমির পাহাড়ের মিতালি। পাহাড়ের গায়ে যেন দুরন্ত উচ্ছ্বাসে আছড়ে পড়ছে তরঙ্গগুলো কিংবা সমুদ্রসৈকতের বালির বিস্তৃত বিছানায় নির্দ্বিধায় সমুদ্র কিছুটা এগিয়ে এসে আবার ফিরে যাচ্ছে নিজের ঠিকানায়। বুঝতে পারি, এ দিলদারেরই কারসাজি। সতর্ক হতে বাধ্য হই। তার হীন প্রচেষ্টাকে প্রতিহতপরাভূত করতে হবে। মেয়েটির প্রতি কড়া হতে হবে- কর্কশ শোনাবে হয়তো-বা, তবুও সূচনালগ্নে বাধা দিতে হবে। বলি, তোমার মনে যে ভুল ধারণা জন্মেছে তা দূর করতে চাই। এ নীতিগত কথা- ব্যক্তিগত কিছু নয়। আশাকরি কিছু মনে করবে না। মানবের মতো আঙুর ফলও দুইরকম হয়। একটা সাদা আর অন্যটা কালো। সাদা আঙুরগুলো যখন তোমার ত্বকতুল্য সাদা হয় তখন পাংষে হয়, বিস্বাদ হয়; কিন্তু কালো আঙুরের বেলায় এ ধরনের পরিবর্তন ঘটে না; অর্থাৎ, এককথায় বলা যায়, ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল।
প্রথমে স্বাদ গ্রহণ করো, পরে বুঝতে পারবে শ্বেত আঙুর কতটুকু সুস্বাদু।
মেয়েটির কথায়, আমার মনে হলো, সমুদ্রের নিটোল জীবন্ত ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাহাড়ে আবার, কিন্তু প্রতিহত হয়ে ফিরে যেতে গিয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে পরবর্তী ঢেউগুলো, সমুদ্রের জল ছিটকে পড়ছে চারদিকে, সমুদ্রের ভয়ংকর আকর্ষণ সহ্য করতে না পেরে ভিজে যাচ্ছে পাথর, তবে তার মন বিক্ষিপ্ত। পাথরের মতোই আমার মনও এখন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, যদিও মেয়েটি ছাড়া আর কেউ নেই ধারেকাছে, তাই আমাকে এই বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে মেয়েটির সঙ্গে। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলি, যৌনমিলনের প্রস্তাবের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তবে দেখো সুন্দরী, তোমার বন্ধু ডি আলি কি জানে না, পোড়া-খাওয়া আমার অন্তর তোমার মতো কুসুমস্পর্শে দ্রবীভূত হওয়ার সম্ভাবনা অতিঅল্প।
সমুদ্রতরঙ্গ ইউরোপীয় জীবনের সঙ্গে অনেক মিলে যায়, মানিয়ে যায়। সমুদ্র ভীষণভাবে প্রভাব ফেলে ইউরোপীয় জীবনে। ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্যও অনেকটা দখল করে আছে সমুদ্র। এই সমুদ্রই যেন ভেসে ওঠে মেয়েটির কল্পনায়; তাই হয়তো সে অনিশ্চিত সমুদ্রের মতো বলে উঠল, আমি তোমাকে পুলিশে সোপর্দ করতে পারি।
ওপর থেকে জীবনের স্পন্দবিন্দু হিসেবে দেখতে হবে তার কথাটিকে। তাই হয়তো বুঝতে পারি, এ মেয়েটির কৃত্রিম অভিমান, সমুদ্রের মতোই অভিমান, ক্ষনিকের অভিমান। প্রশ্ন করি, কোন অপরাধে?
ধর্ষণের দায়ে?
এরকম একটা মিথ্যা অপবাদের যন্ত্রণায় আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। এক অজানা আশংকায় বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। বলি, প্রমাণ করতে পারবে তো?
না পারলেও পুলিশের হাতে তোমাকে নাজেহাল করতে কোনও অসুবিধে হবে না।
আমি মেয়েটিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিই। প্রথমে নিতে চায়নি। মুচকি হাসি ছুড়ে দিতেই গ্রহণ করল। আমিও নিজের জন্য একটি নিই। ধূমপানের ফাঁকে ফাঁকে ভাবতে থাকি, ওকে রাগানো ঠিক হবে না, বরং প্রেমিকের অভিনয় করে যদি দিলদারের পাতানো জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারি অক্ষতভাবে, তাহলেই খেল্লাফের! সেই চেষ্টাই করা উচিত। তাই বলি, তোমার মতো সুন্দরী যুবতীর কি ঠিক হবে এভাবে সতীত্ব বিসর্জন দেওয়া?
আমার কথায় হিতে বিপরীত হলো। খুশি করতে গিয়ে রাগিয়ে দিতে সক্ষম হই; আমার চিন্তাধারার সংকীর্ণতার কারণেই এমন পরিণতি! এর জন্য একটা গ্লানি এবং অপরাধবোধে ভুগতে থাকি।
মনের মধ্যে শুয়ে থাকা ঘোরা ঘৃণা জাগ্রত হয়ে ওঠে। ঘুরতে থাকে ওর পৃথিবীটা, যা সৌরজগতের কোনও নিয়মই মানে না। তার এই অবস্থা অবলোচন করে আমার মুখ বিস্ময়ে হতবাক এবং থরো থরো করে কাঁপতে থাকে। আমার এই কম্পিত মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, নারীকে সেবাদাসীতে পরিণত করার জন্য পুরুষ আবিষ্কার করেছে সতীত্ব বিসর্জন শব্দদ্বয়। আরও অনেক শব্দের মতো পুরুষ সৃষ্ট সতীত্ব বিসর্জন শব্দদ্বয়ও নারীকে পিষ্ট করার কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। তোমার জানা উচিত যে, একজন নারীর যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য একজন পুরুষ যথেষ্ট নয়। পুরুষের এই অক্ষমতা ঢাকার জন্য অনেক মুসলিম দেশে মেয়েদের খৎনার নামে যৌনাঙ্গের স্পর্শকাতর অংশ কেটে ফেলা হয়, নারীদের আনন্দ অনুভূতিকে বিনষ্ট করার লক্ষ্যে। বিবাহ-নামক বন্ধনে আবদ্ধ করে নারীকে করা হয়েছে পুরুষের সাহায্য প্রত্যাশিনী। যৌনমিলন আনন্দ-উপভোগ-প্রণালিতে অজ্ঞপুরুষ দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাস স্ত্রীকে অতৃপ্ত রেখে দিব্যি কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে পুরুষের সৃষ্ট সমাজে, পুরুষস্বীকৃত ব্যবস্থায়। অন্যায়ের প্রতিকার প্রয়োজন। আমাকে যে সঠিক শৃঙ্গারের মাধ্যমে আনন্দ দান করে তাকে আমি পুরস্কৃত করি। আর যে আমার অতৃপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাকে দণ্ডদান করি, দ্বিগুণ পাউন্ড দাবি করে। পাউন্ড আমার কাছে মুখ্য নয়। আমার স্বামী আছে, চাকুরি আছে।
আমি বুঝতে পারি, মেয়েটির অন্তরে তাণ্ডব ও ক্ষোভ চলছে, যা সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে কিছু মিল আছে। মেয়েটির শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত রক্তে সেই জলোচ্ছ্বাসই যেন সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে জীবনের স্পন্দন থাকলেও সমুদ্রেই বেশি। তাই অবাক স্বরে বলি, তাই নাকি? একইসঙ্গে ভাবছি, কী করে তার কবল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়!
বুক উন্নত করে এবং খুশিতে উত্তাল তরঙ্গের উচ্ছ্বাসের সঙ্গে সংগতি রেখে মেয়েটি বলল, আমি বার্মিংহামের এক বিখ্যাত হোটেলের ব্রেকফাস্ট কুক।
প্রবল ও স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু কৃত্রিম উচ্ছ্বাসে বলি, তাহলে আমাকে একটা চাকুরি দিতে বলো না তোমার হোটেলকে।
যদি তুমি একান্তই চাও, তাহলে আমার ম্যানেজারকে বলে পোর্টারের একটা কাজ দিতে পারি।
তাহলে তো আমি তোমার সহকর্মী হয়ে যাব। সেই আনন্দঘন দিনের জন্য কৃতজ্ঞ অন্তরে তোমার অপেক্ষায় থাকব।
তাহলে এসো, উৎসব করি।
সেই মুড এখন আমার নেই, তা তো বোঝো, মাই লাভ। তুমি তো জানো, প্রত্যেক কাজের জন্য একটা উপযুক্ত পরিবেশ ও মন-মানসিকতার প্রয়োজন রয়েছে।
অন্তত একটা চুমু খাও।
আমি নিরুত্তর।
পুনঃ বলল, রাজি তো?
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ি।
সে তার মুখখানা সরিয়ে নিয়ে বলল, আলিঙ্গন ছাড়া চুমু যেন লবণ ছাড়া ব্যঞ্জন, বিস্বাদময়।
আজ আমায় যেতে দাও। কাল যখন তুমি আমাকে নিতে আসবে, তখন দেখবে আমার ভিন্ন মুড। আমিই প্রথম তোমার অধরের সুধাপান করব। তারপর …।
একথা শুনে মেয়েটি যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল, বলল, আজকের জন্য তোমার এই ধর্নুভাঙা পণ কেন মিস্টার মিয়া?
একটু মিষ্টি আর কিছুটা নরম সুরে বলে উঠি, কারণ, রোজা রেখেছি।
মেয়েটি হাসতে শুরু করল, হাসি যেন থামতে চায় না। অসমান দাঁতগুলো বের করে কী ভীষণ হাসি! বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করি, এত হাসির কী আছে? ইসলাম ধর্মকে যে বিদ্রুপ করছে তা তার অসন্তুষ্ট চোখমুখে প্রকাশ পাচ্ছে। অবশেষে হাসি থামল। সহজভাবে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল, বলল, কিছু মনে কোরো না যদি জিজ্ঞেস করি ফাস্টিং কেন করছ?
পাপমুক্ত হওয়ার জন্য।
আমার কথায় মেয়েটির হাসির গতি আরও বেড়ে গেল। হাসির গতি কমে এলে বলল, তুমি অবিশ্যি অবগত আছো যে, সবচেয়ে বড় পাপ হচ্ছে ব্লেসফেমি, অর্থাৎ জিসাস বা তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে ধর্মমতে অন্যায় কিছু বলা। তাদের রক্ষা করার জন্যই এই পাপ শব্দটির উৎপত্তি। জিসাসের মা ম্যারি যে-কাজটি করেছিলেন চার্চের ভেতর, সেই কাজটি আমি করছি কারের ভেতর; কিন্তু তিনি সতী আর আমি অসতী। তাঁকে অসতী বললেই পাপ হয়- পরিনাম অনন্ত নরকবাস। আজকাল প্রায় সকলেই বোঝে- সামন্তবাদ রক্ষার জন্য স্বর্গ ও নরকের কল্পনা অত্যাবশ্যক। সমাজের শাসকশোষকরাই বাঁচিয়ে রেখেছে পাপ-পূণ্য, স্বর্গ-নরকের ধারণা।
আমি নিশ্চুপ। আমার দিকে দৃষ্টিস্থাপন করে বলল, বুঝলে মিস্টার মিয়া!
আমি ঠান্ডা মাথার মানুষ, ঠান্ডা মাথাই কথা বলতে ভালবাসি, তাই মেয়েটির কথায় না রেগে, ওর সমস্ত কথা ও অভিযোগ শোনার পর বলি, ঠিক আছে, তোমার কথানুযায়ী আগামীকাল রোজা রাখব না। তখন তোমার সঙ্গে লীলাখেলায় অংশগ্রহণে আমার কোনও আপত্তি থাকবে না। এখন তুমি যেখান থেকে আমাকে তুলে এনেছ সেখানে পৌঁছিয়ে দাও লক্ষ্মীটি। আর তুমি যখন আমার চাকুরির ব্যবস্থা করছ, তখন আমি তো কাল আসবই। একত্রে বসবাস চলবে, দীর্ঘদিন। বাহ, কেমন মজা হবে।
আমার মিষ্টি কথাগুলো মনে হলো ওর অন্তরে বিঁধল, বলল, তবে তাই হোক।
সে ড্রাইভিং সিটে ফিরে গেল। আমি আর মেয়েটির দিকে তাকাতে পাড়িনি, তাই দেখিনি ওর বদনে কোনও বিরক্তিভাব লেগে আছে কিনা। আর মনে মনে বলি, আমি কাপুরুষ বা অমানুষ নই বলেই তোমার নোংরা মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিতে পারিনি।
অবশেষে দিলদারের বাসার সামনে এসে গাড়িটি থাকম। নামিয়ে দিয়ে মেয়েটি আলতোভাবে চুমু এঁকে দিলো আমার অপ্রস্তুত গালে। হাত নেড়ে তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে-না-জানাতেই গাড়িটি একটানে অদৃশ্য হয়ে গেল। হতভম্বের মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। ধীরে ধীরে সম্বিত ফিরে পাই। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির আকস্মিকতায় সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। রাস্তা থেকে চোখ ফিরিয়ে রাস্তার পাশেই বসে পড়ি। এই ঘটনার বিশ্লেষণের জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন, তবে অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- এই বাড়িতে প্রবেশ করব কিনা! কে যেন বলে দিলো আমার জীবনে আরও বিষম বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। কী জানি কেন আমার মনে হলো, বিলেতের জীবন আমার জন্য অনির্বচনীয় অবর্ণনীয় দুঃখ জমিয়ে রেখেছে। ভীতু অন্তরেই এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াই। বিবেক যে আমাকে এই কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করছে তা নয়, আমার এই মানসিক অবস্থা বরং কাপুরুষতা। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার মধ্যে কোনওরকম যুৎসই কারণ খুঁজে পাচ্ছি না, তবুও বাড়িতে প্রবেশ না করারই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। লন্ডন থেকে যে কাপড় নিয়ে এসেছি, তার মধ্যে একটি শার্ট ও একটি লুঙ্গি ছাড়া সবই আমার পরনে। ভাবি, লোকগুলোকে বলে গেলে ভালো হতো, কিন্তু কোনও ফায়দা নেই, বরং দেরি হলেই ফেঁসে যাব। না বলে গেলেই বরং তারা তাদের চিন্তার খোরাক পাবে, নিজের মতো করে উপসংহার টেনে নিতে সুবিধে হবে না।
রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসেও স্বস্তি পাচ্ছি না। দিলদারের হীন মনোবৃত্তির পরিচয়ে আমি স্তম্ভিত। সে এত নিচে নামতে পারে তা ভাবতে পারি না। সে যেন একান্ত হৃদয়হীন ও অন্যের সুখদুঃখে সম্পূর্ণ উদাসহীন। আমি শঙ্কিত। না জানি কত ফাঁদ পেতে রেখেছে আমার জন্য। সে জানে- আমার আর্থিক উন্নতিতে আমার প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাবে, তার চেয়ে অনেকগুণ। কিন্তু আমি দিলদারকে কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবি না, বরং বাল্যবন্ধুর উন্নতিতে আনন্দিত হই- একথা তার সু-আলাপি স্ত্রীও ভালোভাবে জানে, তার ভাইরাও তো আমার বৈরী নয়, তবে কেন তার এই অপচেষ্টা? বন্ধু কি তাহলে শুধু সময়ের প্রয়োজনে একত্রিত হয়? জানি, পৃথিবীতে যর্থাথ বন্ধু পাওয়া অত্যন্ত কঠিন, অসম্ভব প্রায়। আমার হৃদয়ে অসংখ্য বেদনার দানা সৃষ্টি হতে লাগল। অধিক যন্ত্রণার মূল্য হয়তো দিতে হবে একদিন। আপাতত নিজেকে আত্মরক্ষা করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। লন্ডনি সবাই জানে, মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রুতা হচ্ছে মেয়েমানুষ ও মদের প্রতি লিপ্সাসক্তি জন্মিয়ে দেওয়া। এই পিচ্ছিল পথে একবার পা বাড়ালে ফিরে আসা যায় না- এ যেন নি-আশার দরিয়া।
চলবে…