
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ২৪
ছাত্রজীবনের স্মৃতিখণ্ড
মুখতা আর চরিত্রহীনতা দিলদারের বিশেষ সম্পদ, এবং কেউ যদি তার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাতে যায় তাহলে সে একটি গর্দভ বলে বিবেচিত হয়। তবুও দিলদারের আগমন প্রত্যাশায় অনেক রাতই জেগে থেকেছি। দেরি হলে তার অমঙ্গল অশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়েছি, যদিও তার দিবসের কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না; কারণ, আমি ছাত্র আর সে ছিল দোকানি। দিবসের কাজ শেষে সে আমার সঙ্গে রাত কাটাতে আসত, মহাবিদ্যালয়ের ছুটিতে আমি যখন বাড়ি থাকি তখন। তখনই যার জীবনে নারী ও সম্পত্তির বিশেষ কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই, তার সঙ্গেই দিলদার এই দুটি বিষয়ের গুণাবলি নিয়ে আলোচনা করে বেশ উত্তেজনা নিয়ে। ধনিকরা মিতব্যয়িতার মূল্য কী তার ওপর বক্তৃতা দেয় আর শারীরিক পরিশ্রমের সম্মান কতটা তা নিয়ে মনোভঃভাষায় কথা বলে।
গ্রামে আমার বন্ধু খুব কম ছিল বলেই বোধ হয় দিলদারের সাহচর্য কামনা করি। উল্লেখ করার মতো দিলদার ব্যতীত আরও দুজন বন্ধু ছিল। একজন ফুলবাড়ি আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ত। মতের অমিল থাকা সত্ত্বেও মনের মিল ছিল অনেক। মহাবিদ্যালয়ের ছুটিতে তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই তর্ক শরু হয়ে যেত। ব্যক্তিবিশেষের বিকাশে তার ইচ্ছে শক্তির স্বাধীনতায় স্রষ্টার স্বীকৃতি, তকদির ব্যাখ্যায় বিকৃতি, বিভিন্ন মজহাব ও তরিকার প্রবর্তনে জনমনে বিভ্রান্তি ইত্যাদি বিষয়ে আলাপ-আলোচনার সময় চড়া স্বরে বাদবিতণ্ডার পর মায়ের দেওয়া পিটা একই থালায় হাসি মুখে খেতে কোনও অসুবিধে হতো না আমাদের। মা বলতেন, নোমান ও রূপকে একত্রে দেখলে বেহেশতি আনন্দে মন উদ্বেলিত হয়। বিভাগপূর্ব শ্রীভূমি অঞ্চলে কলকাতায় পস্তুত নাসিরুদ্দিন বিড়ি ধূমপায়ীদের মধ্যে অত্যন্ত প্রিয় ছিল। সাতচল্লিশোত্তর পূর্ব-বাংলার কালোবাজার এ বিড়ির চাহিদা পূরণ করত। হিন্দুস্তানকে পাকিস্তানের বিপরীতে পাপীস্থান বললেও নাসিরুদ্দিন বিড়ির লোভ সামলাতে পারত না নোমান। পঁচিশটা বিড়ির একটা প্যাকেট একদিনে শেষ করে দিত। বাঁধা দিলে মানত না কোনও বারণ। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো- ক্যানসার। শত চেষ্টায়ও তাকে ধরে রাখা যায়নি। মৃত্যুর নির্দিষ্ট দিনক্ষণ আছে- একথাটা গ্রামের সরল মানুষ কত সহজে মেনে নিয়েছে! তাছাড়া রোগেশোকে তাদের সান্ত্বনার আর কিই-বা আছে! জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য মানুষ ধর্মপ্রাণ হয়; না, ধর্মপ্রাণ মানুষ সফল সংসারী হয়- সঠিকভাবে জানার সুযোগ হয়ে উঠেনি আজও।
অপর বন্ধু আব্দুস শহিদ অর্থাৎ শহিদ মোল্লা। বন্দরবন গায়ের জামে মসজিদে ইমামতি করত। মসজিদ সংলগ্ন মক্তবে কোরআন তেলাওতের কায়দা শিক্ষা দিত উভয় পাড়ার ছেলেমেয়েকে। শাদিশুধা ইমামের অসাধু হওয়ার সংগত কারণ না থাকায়, সাধারণ ত্রুটিবিচ্যুতির কারণে সন্দিহান হওয়া সমীচীন নয় জ্ঞানে সুন্দরী মেয়ে যুতির মা স্বস্তিবোধ করতেন। কিন্তু সময় থেমে থাকে না- সে চিরগতিময়, ইত্যবসরে সেতুর নিচ দিয়ে গড়িয়ে যায়, ভরা বর্ষা যেন। অপেক্ষা করা ছাড়া কারও করার কিছু করার থাকে না। বিয়ে-করা বৌকে খড়মাস্থ বউল্লার মতো ইচ্ছেমতো বদলানোর বিধান দিয়েছে মৌলা। এ ইল্ম এনায়েত করা হয়েছে ইমামকেই প্রথম। এহেন ইমামের বদৌলতে বউকে একনিঃশ্বাসে তিন তালাক বা বাইন দিয়ে বিশ্বাসীর খাতায় নাম লেখায় শহিদ মোল্লা, নববধূ পাওয়ার আশায়। কিন্তু হায়! যুতির পিতা আরাফাত মোল্লার ফতোয়া মোতাবেক পঞ্চায়েত পিছিয়ে যায় পূর্বওয়াদা থেকে। শহিদ মোল্লার স্বীকৃতিতে তখন আর কাজ হয় না। পঞ্চায়েত বলল, অপকর্মের জন্য গর্ভবতীকে দোররা খেতে হবে এক এক করে একশত একটা। গুণে গুণে পাছা-পাকে। এ দুঃসংবাদে শহিদ মোল্লা দৌঁড়ে গিয়ে পৌঁছে অন্দরে। যুতি মুষড়ে যায়। এক্কেবারে জিমিয়ে গিয়ে শয়নকক্ষের দরজায় খিল দেয়। শহিদ মোল্লার উপস্থিতি জটিল করে তোলে এ অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিকে। জীবনের চাওয়াপাওয়া দানবীয় অট্টহাসি হেসে দুদিক থেকে আজরাইল বেশে রোষে এসে যুতির কণ্ঠরুদ্ধ করে, চেপে ধরে গলা। স্পষ্ট যুতি শুনতে পায় ইসরাফিলের শিঙার নিনাদ। পৃথ্বী কম্পিত করে জানিয়ে দেয় কিয়ামতের আলামত। যমদূত শিয়ারে দণ্ডায়মান- আর দেরি নেই। শহিদ ও দুজন মেম্বারসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মেয়ের আত্মহত্যায় ক্ষুব্ধক্রুদ্ধ পিতা আরাফাত মোল্লা হত্যার মামলা দায়ের করেন, দায়রা জজের দরবারে। শহিদ করাচিতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়, বক্তাখ্যাত পাসপোর্ট দালাল চান্দভরাঙ্গ গ্রাম নিবাসী ছোটো মিয়ার সহকারিরূপে সফলতা অর্জন করে। আমার আগেই তার লন্ডন আসার কথা লোকমুখে প্রচার হয়েছিল, কিন্তু করাচিতে এক বারবিলাসিনীকে উদ্ধারের কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার ফলে সেই জীবন নিয়ে তৃপ্ত হওয়ার নতুন উপলক্ষ্য আবিষ্কারে বিলেত আসার পরিকল্পনা পরিহার করে।
৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২। শক্রুবার। ভোররাত্রি।
সেহেরির সময় খেতে বসে দিলদারকে বলি, আর নয়। তোমাকে বলব কিনা সেকথা জানি না। চাকুরির ব্যাপারটা এতটাই বিরক্ত যে, এই বিষয়টি মনোযাগ দিয়ে ভাবা উচিত। এ কয়েকদিন কত চেষ্টা তদবির করিছি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখন ফিরে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করছি। মনে হয়, লন্ডনে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা বার্মিংহামের চেয়ে উজ্জ্বল।
আমার ব্যর্থতায় মনে হলো দিলদার চিন্তিত। মুখ বেজার করে বলল, আরও দুদিন চেষ্টা করে দেখো। আমি কয়েকজনকে বলে রেখেছি একটা কাজের পাত্তা লাগানোর জন্য। আস্টন-মরিস্ কার কোম্পানিতে শ্রমিক শীঘ্রই নেবে। থাকো না আমার কাছে কিছুদিন। অস্থির হচ্ছো কেন? এখানে এসে কি জলে পড়েছ?
বর্তমানে আমি পালিয়ে যাচ্ছি না, বিশেষ করে তুমি যখন থাকতে বলছ। আমি থাকলে নিশ্চয় তোমার কোনও অসুবিধে হবে বলেমনে করছি না। হবে কি?
ঠোঁট কামড়ে ধরল দিলদার, তারপর বলল, তোমার কথা শুনে তাজ্জব লাগছে আমার। আমার ইচ্ছে নিশ্চয়ই তুমি আমার সঙ্গে থাকো।
নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলি, তোমার অনুরোধ অগ্রাহ্য করা কষ্টকর, কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে। চাকুরি না হলে তো পাঠাতে পারব না।
মৌলবি কথা বলার সুযোগ পেয়ে বুজরকি চালে বললেন, মাস্টার সাহেব, আপনি তো জানেন, আপনার রিজিক আল্লাহ যে শহরে রেখেছেন, সেখানেই আপনার চাকুরি হবে।
এই নির্দিষ্ট শহরের পাত্তা লাগানোর সহজ পন্থা যদি আপনার জানা থাকে তো বলে দিলেই উপকৃত হই।
তিনি ভাব গম্ভীর স্বরে বললেন, সেই সময় আসলে আল্লাহ নিজেই আপনাকে বলে দেবেন, অথবা পিরেকামেল বুজুর্গানে দ্বীনের (আল্লাহর প্রতিনিধির) মারফত জানিয়ে দেবেন।
তার আগ পর্যন্ত আমাকে দিয়ে এই বানর নাচ কি দর্শকমণ্ডলীর আনন্দ দানের জন্য।
বুজুর্গানে দ্বীনের (আল্লাহর প্রতিনিধির) সাহায্যে কষ্ট লাঘব হয় মাত্র।
আপনার বর্ণিত এই তথাকথিত বুজুর্গানে দ্বীনের (আল্লাহর প্রতিনিধির) শিক্ষার ফলেই ধর্মবিশ্বাসে অবিশ্বাসীর প্রাধান্য, তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি জগৎ জুড়ে আর আমরা ভিক্ষুকের মতো তাদের দ্বারে দ্বারে ধণা দিচ্ছি।
এ ধরনের হাফ-মোল্লার সঙ্গে তর্ক করে কোনও ফায়দা নেই। আল্লাহ নাকি এদের অন্তরে অজ্ঞানতার শীলমোহর মেরে দিয়েছেন, তাই তাদের সত্যোপলব্ধি কস্মিনকালেও হওয়া সম্ভব নয়। আমার ভাবনার মাঝখানে সৈয়দ মহরম আলি এগিয়ে এসে বলল, আমি আপনার জন্য দুটো সাবান মাছের মাথা এনেছি।
আব্দুল জলিল যোগ করলেন, দেশের রুই মাছের চেয়েও সাবানের মাথার স্বাদ অনেক, অত্যন্ত চর্বিযুক্ত তেলাল মাছ কিনা!
মাছের নাম অবশ্যই সাবান নয়। অন্যান্য অনেক শব্দের মতো এও বিকৃত নাম হবে নিশ্চয়। উঠে গিয়ে আমার ইংরেজি অভিধানটি নিয়ে এসে খোলতেই দেখি- শব্দটি হচ্ছে সালমন, ল বর্ণের উচ্চারণ নেই বলে ইংরেজ সামন বলে। নিরক্ষর বাঙালি নিজের ভাষার আদলে নামটিকে করেছে সাবান। এই মাছটি প্রশান্ত ও আটলান্টিক উভয় মহাসাগরে বসবাস করে। ডিম পাড়ার সময় তারা মিষ্টজলে চলে আসে। ভিন্ন পরিবেশ যেমন মানুষের প্রবৃত্তিপ্রকৃতিকে বদলে দেয়; তেমনই উভয় বারিধির সামন মাছের প্রকৃতি অভিন্ন নয়। প্রশান্ত মহাসাগরীয় সামন মাছ নদীর জলে ডিম ছেড়ে নোনাজলে ফিরে যায় না। প্রজনন প্রক্রিয়ায় তার জীবনের অবসান ঘটে। আর আটলান্টিকের সামন মাছ ডিম প্রসবের পর প্রায়শ ফিরে যায় মহাসাগরে এবং এক-দুইবছর পরে ফিরে আসে মিষ্টজলে।
সৈয়দ মহরম আলি ও আব্দুল জলিলের উদ্দেশ্যে বলি, তাহলে কাল আর লন্ডন যাওয়া হচ্ছে না। এমন সুস্বাদু মাছের মুড়িঘণ্ট খাওয়ার লোভ কি সহজে সামলানো যায়!
খুশি হয়ে মহরম আলি বলল, দোয়া করুন পিরসাহেব, যাতে মাস্টার সাহেবের একটা কাজ হয়ে যায়।
বুঝতে পারি, মৌলবির পির হতে অসুবিধে নেই। কারণ, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বই তো অন্যকিছু নয়।
টেবিলের পাশে বসা যে যুবকটি ভেড়ির সিনা চিবুচ্ছে, সে সামনের চারটা অমসৃণ দাঁত বের করে বলল, মৌলবি সাহেবের দোয়ায় কাজ হলে কি তিনি বেদ্বীনের দেশে এসে চোখের জিনা করার সুযোগ পেতেন?
ঘরের লোকের আর বোঝার বাকি নেই যে, এই মৌলবি আমার অপছন্দের মানুষ। তাই বোধ হয় তারা এরকম কথা বলতে সাহসী হয়ে উঠেছে।
আমার থালায় মুরগির একটা রাং দিয়ে আব্দুল জলিল বললেন, মিয়াসাবের ঘোরাতে অসুবিধে নেই তো- শুনেননি সেই গল্পটি? উত্তরের অপেক্ষা না করেই আব্দুল জলিল বলতে লাগলেন, বহুবার শোনা সেই গল্প। একদিন এক ছাত্রীকে পশ্চিম মুখো হয়ে প্রস্রাব করতে দেখে মিয়াসাহেব তাকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন যে, কখনও যেন সে এভাবে কাবামুখো হয়ে প্রস্রাব না করে। কয়েকদিন পর মিয়াসাহেবকে সেই একই অবস্থায় দেখতে পেয়ে মেয়েটি যখন জিজ্ঞেস করে, তখন এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি স্মিতমুখে বলেছিলেন, বেটি, আমি যে ডানে বায়ে ঘোরাতে পারি, তুমি কি তা পার!
মৌলবির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ভদ্রলোক এর জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না।
৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২। সকাল।
ঘুম ভাঙল দেরি করে। রবিঠাকুরের পাত্তা নেই। এককালে বলা হতো- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না, আজ সেদিন আর নেই, সেই মধ্যাহ্নের সূর্যও নেই, এখন খোদ ইংরেজের দেশেই সূর্যোদয় হয় না। তাই অসহনীয় দুঃখভারাক্রান্ত অন্তরে ইংল্যান্ডের আকাশ অজস্র আঁখি দিয়ে অনবরত অশ্রুপাত করছে, তবু কি দিবাকরের অভিমান ভাঙছে!
পদখালির বিজ্ঞাপন পকেটে নিয়ে কত দ্বারে ধর্ণা দিই, কিন্তু বিফলমনোরথ নিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হই। এদেশে গায়ের চামড়ার রং দিয়ে যোগ্যতার বিচার করা হয়। যদি আমার গাত্রবর্ণ সফেদ হতো তবে প্রথম দরখাস্তেই চাকুরি মঞ্জুর হয়ে যেত। আমাকে শ্যামলা করে সৃষ্টি করার মূলে কি স্রষ্টার বৈষম্যবোধ কাজ করেনি! আমার কর্মফলের শাস্তিস্বরূপ আমাকে শ্বেতাঙ্গ করা হয়নি- একথা তো মুসলিম হিসেবে স্বীকার করা যায় না। পুনর্জন্ম মেনে নিলে একথা বলা যেতে পারত, নতুবা নয়। অশ্বেতাঙ্গরূপে জন্ম নিয়ে আজ আমি যে-লাঞ্ছনা ভোগ করছি, তা কার ভুলে? আমার জন্মের জন্য তো আমি দায়ী হতে পারি না। তবে কি পিতার খামখেয়ালিপনা? না, কারও সুষ্ঠু পরিকল্পনা? তাহলে, কে সে পরিকল্পনাকারী? কোন সে স্রষ্টা? বিছানায় শুয়ে শুয়ে ধূমপান করছি আর এসব শুধু ভাবছি। তাছাড়া করবটাই-বা কী? অন্তরে ব্যর্থতার অসহ্য ব্যথা। হ্যাঁ, তাই হয়তো, বুকের ডানদিকটা চিনচিন করে উঠল; পাঁজরের নিচে। অদৃষ্টের কাছে মানুষ অসহায়- এই বিশ্বাস যাদের, তাদের সান্ত্বনার তবু একটা কিছু থাকে, কিন্তু আমার তো নেই। নিরালম্বন, একটি কথা আছে না- নিনাইয়ার শত নাও (নৌকো)। বধূকে তবুও আনমনে কলসি কাঁকে নদীঘাটে যেতে হয়, নাইয়ার সন্ধান মিলে বা না মিলে; এমনই আনমনে পোশাক পরে দরজা খুলে একপা এগুতে-না-এগুতেই- বাতাস যেন এতক্ষণ দম বন্ধ করেছিল, এইমাত্র হাঁপ ছাড়ল, তাই হঠাৎ দেখা গেল খোলা হাওয়া; তার চারপাশ থেকেই যেন হুমকি দিচ্ছে। একইসঙ্গে দেখতে পাই, সামনে দাঁড়িয়ে, সেই বুড়ো মজমিল আলির বর্ণিত এক পরি, অবশ্য ডানাযুক্ত নয়; তবে অপরূপা-সুন্দরী-তন্বী, তার পোশাকে কিছুটা ব্যর্থ উড়াউড়ি করছি। ফুলের মতো এই মেয়েটি কেন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে? একথা ভেবেই অনেক ওপরে- আকাশের দিকে তাকায়, সেখানে কয়েকটি মেঘের টুকরো যেন কোথায় ছুটে যাচ্ছে। যুবতীটি যে পথহারাও নয় তা বুঝতে পারি যখন আমাকে সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সেই নবাগত যুবক?
আমার পাশের একটু দেখা জীবন দেখা দিলো, ইংলিশ নাটক, উপন্যাস- এসবের ভেতরের কাহিনির সঙ্গে মনে মনে মেলানোর চেষ্টা করি মেয়েটির এই আবির্ভাবের ব্যাপারটাকে, কিন্তু কোথাও কোনও মিল পাই না- সেকশপিয়রেও না, ডিকেনসেও না, শেরিডনেও নয়। সে হয়তো কারও স্ত্রী, কারও কন্যা হবে, অবশ্য তার চেয়ে তার প্রথম এবং আসল পরিচয় হচ্ছে সে একজন যুবতীকন্যা। আর তাই প্রশ্ন করি, তুমি কে? আর কীভাবেই আমাকে চেনো?
অদ্ভুত সরলতা ঘিরে আছে মেয়েটিকে, বলল, মিস্টার আলি যে বর্ণনা দিয়েছে, তার সঙ্গে তোমার চেহারার এত বেশি মিল যে, বোকার পক্ষেও তোমাকে চেনা কঠিন নয়।
মেয়েটির কথায় আমার মনে হলো, তার সঙ্গে বোধ হয় ইবসেনের দি ডলস হাউস নাটকের নোরার একটু মিল আছে, যদিও নোরার মতো সে বিপ্লবী নয়। তাই বলি, তোমাকে দেখলেই মনে হয়, তুমি একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে।
নিষ্পাপ মুখের সুন্দরীটি বলল, তুমি বেশ ভালো, আমার প্রিয়। তারপর হাইহিল জুতোর আঘাতে একপদ এগিয়ে এসে, নিদারুণ ঝড়ে বিপর্যস্ত বালিকার মতো নির্বিকার চিত্তে আমার হাত ধরে যোগ করল, তোমাকে নিতে এসেছি। চাকুরির একটা ব্যবস্থা হয়েছে, মিস্টার আলির অনুরোধে।
কামনা, বাসনা, সহানুভূতি কতদূর সমান্তরালে এগিয়ে যাবে, না হঠাৎই মিলে যাবে, কে জানে। আমি উদাস ও ভাবুক। আমার চিন্তাভাবনা বাতাসে উড়তে উড়তে স্থির হয়ে গেল, মেয়েটির সাদা পোশাক ও তার সরলতাও। চাকুরি না পাওয়ার কিছুদিনের অভিজ্ঞতার পর, নতুন জীবন শুরু হবে, একজন নারীর মাধ্যমেই আমার জীবন ও পৃথিবী নূতন গল্প রচিত হবে- এই আনন্দ বুকে ধারণ করে ভাবতে থাকি, অনেক কারখানায় তো দেখেছি মেয়েরাই অফিস চালায়। সেরকম একটি মেয়ে হয়তো-বা দিলদার আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর তাই দ্বিরুক্তি না করে তার সঙ্গে এসে গাড়িতে বসি।
চলবে…