
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ১
প্রথম অধ্যায়
আমার নাম রূপমিয়া, রূপ না থাকলেও কেউ কোনোদিন আপত্তি তোলেনি।
হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য পিআইএ এরোপ্লেন চক্কর দিচ্ছে। প্রথমবারের মতো দেখতে থাকি, আলোতরঙ্গসজ্জিত লন্ডন নগরটিকে; এ-যে আমার স্বপ্নের শহর; তারকারাজি যেমনি আকাশকে সাজিয়ে সুন্দর করে তোলে আলোর মালা পরিয়ে, তেমনি রাত্রির লন্ডনকে মনে হচ্ছে- আলোর শহর, বিয়েবাড়ি যেন, বরের আগমনের প্রতিক্ষায়; বরেরও মন জুড়ে কত কল্পনা থাকে, বাস্তবের সঙ্গে মিলে কিনা এ নিয়ে ওর ভাবনা নেই, তবে নিছক কল্পনার মধ্যেও আনন্দ বিরাজ করে।
প্লেনটি রানওয়ের একপ্রান্তে এসে থামল। সেফটি ব্যালট খুলে সহজ হয়ে বসতেই চোখের দৃষ্টি বাইরে চলে গেল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। শিশিরের মতো উড়োজাহাজের ডানায় এসে ভিড় জমাচ্ছে, কিন্তু টিকে থাকতে পারছে না, পিছলে পড়ছে। ক্যাপটেন ঘোষণা করলেন, রাত আটটা, লন্ডন টাইম, বুধবার, ১০ জানুয়ারি ১৯৬২।
সঙ্গে রাখা কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকায়, নির্ঝঞ্ঝাটে পাসপোর্ট চেকপয়েন্ট অতিক্রম করে পা ফেলি কাস্টমস চেকপয়েন্টে; সঙ্গে তেমন মালপত্র নেই, শুধু একটি ব্যাগ, তাই ঝামেলা নেই। নিয়মকানুন পালন করে কাস্টমস চেকপয়েন্ট পেরিয়ে আসতে তেমন সময়ই লাগল না। মনেও কোনও অস্বস্তি নেই, কেউ তো আর আমার জন্য অপেক্ষা করছে না, লন্ডন পৌঁছানোর দিনক্ষণ কাউকে জানানো হয়নি, জানালে অবশ্য পরিচিত দু-একটি মুখের সন্ধান পাওয়া যেত; নিজ গ্রামের বেশ কজন লন্ডনি আছেন বিলেতে, মাসখানেক আগে আমিই দুজনকে করাচি বিমানবন্দরে পিআইএ প্লেনে তুলে দিয়েছিলাম, ছোটোমামাও এখানে আছেন, ঠিকানা অবশ্য সঙ্গে এনেছি, রেখেছি বুক পকেটে।
এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের বিশাল চত্বরে নাকানিচুবোনি খেয়ে অবশেষে বেরিয়ে আসি, যাত্রীদের অনুসরণ করে, গাড়ি রাখার উন্মুক্ত মাঠে। রাত্রি সাড়ে নয়টা। গা কেমন যেন করছে। অপ্রত্যাশিত বৃষ্টিভেজা শীতল এক ঝাপটা বাতাস এসে আঘাত করল পাঁজরে। যাত্রীদল এক এক করে অভ্যর্থনাকারীর গাড়িতে উঠে অদৃশ্য হতে থাকে, শুধু আমি- একা-একাকী দাঁড়িয়ে আছি; বুঝতে পারছি, কাউকে না জানিয়ে বিদেশবিভুঁইয়ে এমনি হাড়কাঁপুনি শীতরাত্রিতে এসে হাজির হওয়ার কোনও যুক্তি ছিল না; আত্মবিশ্বাস থাকা ভালো, কিন্তু অধিক থাকা অমঙ্গলই বটে; তবে এর জন্য কি দায়ী আমার পরনির্ভরশীল না হওয়ার যে-সংকল্প ছেলেবেলা থেকে জন্মেছে তা-ই? ঘাতপ্রতিঘাতে আত্মীয়স্বজনের কাছে সাহায্যের আবেদন প্রত্যাখান হওয়ার ফলে যে-অভিমান সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনও ক্ষুব্ধ অন্তরে দানা বেঁধে আছে। এমন সময় আমার ভাবনায় যতি টেনে সামনে এসে দাঁড়াল একটি ট্যাক্সি। ড্রাইভার লক্ষ করল আমার অসহায় অবস্থা, প্রশ্ন করল, কোথায় যাবে?
উত্তরে পকেটে রাখা ছোটো মামার ঠিকানাটি বের করে তার সামনে তুলে ধরতেই সে কয়েক সেকেন্ড চোখ বুলিয়ে বুঝে নিয়ে বলল, তুমি এদেশে নতুন এসেছ। তারপর ট্যাক্সির দরজা খুলে বলল, ঢুকে পড়ো।
গরম কাপড়ের স্বল্পতা ও শৈত্যের তীব্রতা- দুই কারণেই আমার শরীর বরফপিণ্ড, এই অবস্থায় ড্রাইভারের আহ্বানে ট্যাক্সিতে প্রবেশ করে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেললাম; গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মানুষ বলেই আমরা ইব্রাহিম নবির অগ্নিকুণ্ড আর সীতাদেবীর চিতার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারি, কিন্তু ঠাণ্ডায় ফ্রিজ হয়ে জীব যে পাথরে পরিণত হতে পারে এই ভাবনা আমাদের মাথায় সহজে আসে না, নতুবা বরফকুণ্ডঠাণ্ডা নরকের কথা ভাবলে অনেক বেশি ভয় পেতাম।
ড্রাইভার দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে করকাপাত উপেক্ষা করে। তার মতো দীর্ঘদেহী ইংরেজ করাচিতে অনেক দেখেছি, উচ্চতায় পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে ইংরেজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ না পেলে হয়তো-বা তার সাহচর্যে, প্রায় জনহীন প্রান্তরে স্বস্তি পেতাম না। তার গায়ে লম্বা ওভারকোট, কম্বলের মতো পুরু ও মাওলানার আলখাল্লার চেয়েও লম্বা, হাতে গ্লাভস, মাথায় ফারেন টুপি- এত কাপড় গায়ে জড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও, আমি হলে, এরকম শীতে ঠকঠক করে কাঁপতাম, কঠোর ঠাণ্ডায় দাঁত কটমট করত।
সাদা ধবধবে দাঁতগুলো পাশে-রাখা কালো ট্যাক্সির ওপর পড়তেই বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, একইসঙ্গে মনে প্রশ্ন জাগল, সে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেন? ভেতরে প্রবেশ করে ট্যাক্সিটা স্টার্ট করে আমাকে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দিলেই তো রক্ষে! হাইড শহরটি কোন দিকে? কতদূর? ইংল্যান্ডের অনেক অঞ্চলের নাম জানি, কিন্তু হাইড বলে তো কোনো শহরের নাম শোনেনি। রাজধানীর আশপাশে ছোটো একটি শহর হবে নিশ্চয়! না, হয়তো তা লন্ডন থেকে অনেক দূরে! আর তা-ই-বা বলি কী করে, অন্যথায় ড্রাইভার কি আমাকে তার ট্যাক্সিতে বসতে দিত!
ট্যাক্সি উষ্ণ থাকায় আমার শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো। ড্রাইভারও তার নির্দিষ্ট সিটে ফিরে ট্যাক্সি চালু করার চেষ্টা করছে, কিন্তু হচ্ছে না। ঠাণ্ডায় এঞ্জিন জমে গেছে। এখন কী হবে? আরে, এত সহজে ঘাবড়িয়ে গেলে চলে না কি। জোরে জোরে সাহস মনফানুসে পাম্প করতে থাকি। ড্রাইভারও ট্যাক্সি চালু করার চেষ্টা করতে থাকে, কয়েকবার চেষ্টার পর এঞ্জিন স্টার্ট হলো- বিকট শব্দে, কেঁপে কেঁপে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারি, সে আমাকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছে না, শুধু একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ভেবে পাই না তার মতলবটা কী? ট্যাক্সির উত্তাপে শরীর গরম হওয়ায় মনে যে প্রফুল্লতা এসেছিল তা উবে গেল। শুকনো স্বরে জিজ্ঞেস করি, কতক্ষণে তুমি মনে করো, আমরা হাইড শহরে পৌঁছব?
সামনের দিকে তাকিয়ে মন্থরগতিতে ট্যাক্সি চালানো অবস্থায়, ডানহাত হুইলে রেখে আর বামহাতে উইন্ডস্ক্রিন মুছতে মুছতে বলল, তোমার দেওয়া ঠিকানায় দেখলাম হাইডের সঙ্গে চেশায়ার শব্দটি যুক্ত আছে। এতে মনে হচ্ছে, চেশায়ারের অন্তর্গত কোনও একটি ছোটো শহর হবে। ড্রাইভিংমিররে আমাকে আরেকবার দেখে নিয়ে আস্তেধীরে বলল, শায়ার বলতে এই দেশের একটি অঞ্চলকে বোঝায়। একটি শায়ারে কয়েকটি শহর বা বন্দর থাকে। আমি একবার চেশায়ারের স্টকপোর্ট গিয়েছিলাম। হাইড যদি তেমনি একটি চেশায়ারের অন্তর্গত শহর হয়…। তারপর মনে মনে কী যেন কী ভেবে নিয়ে যোগ করল, সম্ভবত তাই হবে। তাহলে…। বাক্য শেষ না করে, কোমর ঘুরিয়ে, ঘাড় বাঁকিয়ে, মুখ ঝুঁকিয়ে নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল, তোমার কাছে কত পাউন্ড আছে?
একমুহূর্ত ভেবে নিই, আমার কাছে যা আছে তা যদি সে নিয়ে যায়, তাহলে আমি অসহায় অবস্থায় পড়ে যাব, ছোটোমামার সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমার হাতে কিছু-না-কিছু পাউন্ড থাকা বাঞ্ছনীয়, এ-ই তো আমার সম্বল, কাজেই সম্পূর্ণ হাতছাড়া করা অনুচিত, তাই বলি, দশ পাউন্ড।
নিরাশ হয়ে ছুঁচোর ন্যায় মুখ করে মন্তব্য করল, যদি আমার জানা স্টকপোর্টের কাছে তোমার হাইড শহর হয়, তাহলে এ দিয়ে পেট্রোল খরচই হবে না। কী যেন কী ভেবে নিল আবার, তারপর বলল, তাই তো খুঁজছি আরও যাত্রীর। দুজন যাত্রী পেয়ে গেলে তোমাকে নিয়ে যেতে আর কোনও অসুবিধে হবে না, কিন্তু পাচ্ছি না তো।
আমি নিশ্চুপ।
সে মুচকি হেসে বলল, জানি তোমার কাছে এর চেয়ে বেশি পাউন্ড থাকার কথা নয়।
আমি ভীষণ অবাক! বলি, কী করে জানলে?
অনেক ইন্ডিয়ানের সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে। ইন্ডিয়ানরা এদেশে আসে খালি হাতে, কিন্তু দুবছর যেতে-না-যেতেই হয়ে যায় মস্ত বড়োলোক। তোমার অবশ্য আরেকটি বাড়তি সুবিধে আছে। ড্রাইভারের চোখ বড়ো হয়ে উঠল। একইসঙ্গে তার নিঃশ্বাস ঘন ঘন পড়তে লাগল। বলল, কাজেই তোমার উন্নতি ঠেকাবে কে?
অতিরিক্ত সুবিধে মানে? বুঝতে পারছি না।
তুমি ইংরেজি জানো। লিখতে পার তো?
মোটামুটি।
আর কি চাও? একেবারে সোনায় সোহাগা! এখন তোমার দশ পাউন্ডের নোটটি আমাকে দাও তো বন্ধু।
মুখ নিচু করে বসে আছি, কিছুই বলতে পারছি না, যক্ষের ধন দশ পাউন্ডটি মানিব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে না। আমার ইতস্ততা লক্ষ করে, সম্ভবত আমাকে নিশ্চিত করার জন্যই বলল, হাইড শহরটি অনেক দূরে। সেখানে ট্যাক্সি ভাড়া করে একা গেলে পোষবে না। তোমাকে নিয়ে যেতে হবে ইউস্টোন রেলস্টেশনে। বিমানবন্দর লন্ডন থেকে বেশ দূরে। লন্ডনের রেলস্টেশনগুলো শহরের একেবারে মধ্যখানে। লন্ডন বেশ বড়ো শহর কিনা, তাই রেলস্টেশনের সংখ্যাও কম নয়, কম পক্ষে সাত-সাতটি। ভাগ্য ভালো হলে প্রথমে যে-স্টেশনে যাব সেখানেই পেয়ে যেতে পারি হাইড শহরের সন্ধান, নতুবা বেশ ঘোরাঘুরি করতে হবে। যা-ই হোক, আমি তোমাকে ঠকাব না, বরং তোমার একটি ব্যবস্থা করে দেওয়ার চেষ্টা করব।
সে হাসল মোলায়েম হাসি। ঠোঁটের কোণ ছেয়ে গেল হাসির আভা, ছড়িয়ে পড়ল চোখেমুখেও। সে দশ পাউন্ডের নোটটি পকেটে পুরে সোজা হয়ে বসে ট্যাক্সি চালাতে লাগল। মোটরযানের গতিবেগের সঙ্গে আমার গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর অনিশ্চিয়তায় হৃদয়াবেগ বেড়ে গেল। শীতের রাত্রির আলো-অন্ধকার আমার সর্বাঙ্গে এসে বিঁধছে। অন্তর্মুখী মনোকাননকে বহির্দেশে প্রসারিত করতেই দৃষ্টিনন্দন চারদিকের দৃশ্যাবলি অবলোকন করতে শুরু করে। যতই দেখছি ততই অন্তর পুলকিত; পরিবেশ ঝাপসা আলোমেলায় আপ্লুত; প্রকৃতিকে পরাজিত করার কী অপরূপ খেলা! শ্বেতাঙ্গ নরনারী, মাঝেমধ্যে হুরিবৃন্দ একজন আদমকে ঘিরে খেলা শুরু করে, এদের সৃষ্টিতে স্রষ্টার নৈপুণ্য প্রকাশ পাচ্ছে- সর্বাধিকে। অসাধারণভাবে বিচরণ করছে তারা লন্ডনের নন্দনকানন।
স্টেশনে পৌঁছোতেই চালক বলল, তুমি ট্যাক্সিতে বসো, দেখি তোমার জন্য একটা টিকেটের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা?
ট্যাক্সির দরজা ঠাস্ করে বন্ধ করে দিয়ে ক্ষণিকের মধ্যে ড্রাইভারটি অদৃশ্য হয়ে গেল। ট্যাক্সির ভেতরে আমি যেন নিশ্চল পাথরের মূর্তি, শুধু চোখদুটো কাচকে ভেদ করে বাইরের জনপদ দেখতে ব্যস্ত। যেমনি শুভ্রসুন্দর মানুষ তেমনি তাদের আবাসভূমিও। স্রষ্টার করুণার প্রকৃষ্ট নিদর্শন যেন ইংরেজ জাতি, এদের রাজত্বে একসময় সূর্যাস্ত যেত না, শৌর্যবীর্যসমৃদ্ধ ইংরেজ জাতি ভারতবর্ষীকে শাসনশোষণ করেছে প্রায় দুইশত বছর, সেই ১৭৫৭ থেকে শুরু করে আজও কি ইংরেজের আধিপত্য থেকে মুক্তি পেয়েছে ভারতবর্ষ? না, পায়নি। প্রাকৃতিক নিয়মের নিয়ন্তা সর্বশক্তিময় আল্লাহ- কুদরতের শান, তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো কিছু ঘটে না। ঘটতেও পারে না। কিন্তু তিনিই তো অসামঞ্জস্যের সমষ্টি। তিনিই ক্ষুধার্ত মানুষকে বঞ্চিত করে অসাম্য, শোষণ, বঞ্চনার নিয়ম তৈরি করেছেন।
ড্রাইভার ফিরে এসে বলল, ইয়াংম্যান।
তার কথায় ধ্যান ভাঙল। তার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করি। সে স্মিতমুখে বলল, হাইড শহরে কোনও রেলস্টেশন নেই। আমার মুখ শুকিয়ে গেছে দেখে সে যোগ করল, কোথাও নিশ্চয় হাইডিং করে আছে, খুঁজে বের করতে হবে বই কি!
আমার বুকের ভেতর ধড়াস করে শব্দ উঠল। আমার মুখ দেখে নিয়ে সে বলল, ভেবো না, তোমার একটা ব্যবস্থা না করে আমি যাচ্ছি না।
আমি চুপ।
আমার নীরবতা ভাঙার জন্য ঠাট্টা করে বলল, তোমাকে তো আবর্জনার মতো রাস্তার পাশে ফেলে দিতে পারি না! তবে মনে রেখো, এদেশের কিছু লোক ভিনদেশিকে তা-ই মনে করে, আর সেইরকম ভাবাটা তাদের জন্য তেমন অন্যায়ও নয়; কারণ, তুমি অন্যের জীবনজীবিকার ওপর ভাগ বসাতে চাইলে সেই ব্যক্তির অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা কি মস্ত বড়ো অপরাধ?
বাইরের ঠাণ্ডা হাওয়া যেন কাচ ভেদ করে আমাকে সফেদ মূর্তিতে পরিণত করল। আমার মুখ শুভ্রকাফন যেন। আমার এই অবস্থাটি চট করে একবার দেখে নিয়ে ড্রাইভার বলল, তোমার কথা আলাদা, বিপদে পতিত প্রাণীকে সাহায্য করা একজন মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। তবে মুশকিল হচ্ছে, হাইড পৌঁছাতে কোন রেলস্টেশনে নামতে হবে তা টিকেটকাউন্টারের লোকদের জানা নেই। এখন সেই তথ্য খোঁজার জন্য আমাকে যেতে হবে ইনকুয়্যারি অফিসে। সেখানে কতক্ষণ লাগবে, কে জানে! তোমাকে বলতে এসেছি, দেরি হলে ঘাবড়িয়ে যেয়ো না।
সে আবার নিরুদ্দেশ হলো। নিজেকে সামালে নিই। ঠোঁট কামড়ে তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, শীতবাতাসে আমাকে যখন পাচ্ছে না, তখন গদি-আঁটা আসনে, ট্যাক্সির ভেতর বসে ঘাবড়ানোর কি কিছু থাকতে পারে! তবে গোরার কোনও কোনও কথা আমাকে নীরবে পীড়া দিচ্ছে। কয়েকবার এপাশ-ওপাশ করি, তারপর হঠাৎ হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে, দুই হাতের ওপর শরীরের ভর রেখে চিন্তা করতে থাকি। বিরক্তি আর বিস্ময়বোধ এক হয়ে কিঞ্চিৎ দার্শনিক চিন্তার উদয় হলো যেন। ভারতবর্ষের মানুষ একটি ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছেও সম্পূর্ণ মানুষ হতে পারল না, প্রাণীই থেকে গেল। তবে গোরা ভুলে গিয়েছে তার বাপ-ঠাকুরদার কথা। তারা জীবিকার অন্বেষণে জোঁকের মতো বাঙালির রক্ত চুষে খেয়েছে। শোষণ করেছে সভ্য একটি জাতিকে অমানুষের মতো। সাধারণ লোক তো আর টের পায় না যখন জোঁকে তাকে ধরে। জোঁক যখন তার কাজ সেরে শরীর বেয়ে নিচে নেমে পড়ে তখনই মানুষ টের পায়। সেই সময় জোঁককে কিছু করা যায় না, বরং রক্তপাত বন্ধ করার জন্য চুনছাই লেপে দেওয়া ছাড়া অন্যকোনও উপায় থাকে না। ইংরেজ কিন্তু জোঁকের চেয়েও চালাক, রক্তপানেই সে ক্ষান্ত হয় না, রক্ত ঝরানোর ব্যবস্থাও করে রাখে। খুন যাতে ঝরতে পারে আজীবন সেই লক্ষ্যে ইংরেজ ভারতবর্ষকে ভাগবিভাগ করেছে। এ তো ব্রিটিশনির্ভর করে রাখার উত্তম ব্যবস্থায়। ভারতবর্ষের অধিবাসীর ইংল্যান্ড আসাটি কিন্তু অন্যরকম, জোঁক হয়ে আসেনি, এসেছে সেবক হয়ে, গোরার গায়ের ঘাম মুছে দিতে; এতে গোরাদের না-খোশ হওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারে না। যাক্গে, ড্রাইভার তো আর খারাপ লোক নয়, সময় নষ্ট করে আমার উপকার করার চেষ্টা করছে। কজন স্বদেশি এরকম করে? সর্বজনীন শিক্ষার ফলে হয়তো-বা বর্তমানে গোরারা মানবতার দিকে অগ্রসর হয়েছে।
ড্রাইভার ফিরে এসে ওষ্ঠাধরে ছুঁয়ে রাখা হাসিটিকে সারা মুখে ছড়িয়ে দিয়ে ট্যাক্সির দরজা খুলে বলল, এবার তুমি নেমে পড়ো। হাইড যাওয়ার জন্য তোমাকে ম্যানচেস্টার নামতে হবে। বড়ো শহর। তোমাদের অনেক লোক সেখানে থাকে। টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজে চাকরি করে। একটু থেমে শূন্যদৃষ্টিতে চারদিক দেখে নিয়ে যোগ করল, তোমার মতো এক ইন্ডিয়ানকে কয়েকমাস আগে ম্যানচেস্টারে পৌঁছে দিয়েছিলাম। তার অবশ্য শিখের মতো লম্বা দাড়ি ও ইহুদির মতো গুল টুপি ছিল। সে নতুন বিলেতে এসেছে বলে মনে হয়েছিল। ইংরেজি ভাষা তেমন জানে না। অনেক কষ্ট করে বুঝিয়ে বলেছিলাম যে, পঞ্চাশ পাউন্ড লাগবে। সে রাজি হয়। তার দেওয়া ঠিকানায় উপস্থিত হতেই দেখি, অনেক লোক তার অপেক্ষারত। তার অভ্যর্থনা উপলক্ষ্যে যেন মেলা বসেছিল। ভাড়ার টাকা চাইতে শুরু হয়ে যায় হইচই। কয়েকজন একসঙ্গে পঞ্চাশ পাউন্ড দিতে উদ্যত হয়। আগন্তুককে আপ্যায়ন করার কী যে আগ্রহ! মনে প্রশ্ন জাগে, এত লোক এক বাসায় কেমন করে থাকে?
দৃঢ়তার সঙ্গে বলি, না ইয়াংম্যান, তোমার ধারণা ঠিক ছিল না। লোকটি হয়তো-বা পির ছিল, ফলে তার দর্শনেচ্ছুক লোকের অভাব পড়েনি। বিভিন্ন বাসা থেকে লোকজন এসে এক জায়গায় জড়ো হয়েছিল তাকে অভ্যর্থনা জানাতে।
যাক্গে, আর কথা নয়। এখন তোমাকে ম্যানচেস্টারগামী ট্রেনে তুলে দিতে পারলেই আমার কর্তব্য শেষ হবে। আমি বেশ কথা বলি, তাই না? আমার স্ত্রীও তা-ই বলে।
চলবে…