
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ১৯
চতুর্থ অধ্যায়
৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২। রোববার। সকাল।
ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ হলো, কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তিন সপ্তাহ হয়েছে লন্ডন এসেছি, ঘুর ঘুর করে ঘুরছি চাকুরি নামের সুন্দরীর সন্ধানে, সোনার হরিণ যে সে; হুরপরি চাই না, শুধু একটা চাকুরি চাই, লন্ডনের অলিগলি আঁতিপাঁতি করে খুঁজছি কিন্তু পাত্তা পাচ্ছি না। মনটা ভালো নয়।
গতকাল বিওএসি থেকে একটা অফার এসেছিল। সোমবার সকালে হিথরো বিমানবন্দরের আফিসে ইন্টারভিউ, চাকুরি পাওয়ার ষোলোআনা সম্ভাবনা, কিন্তু মামুজি বেঁকে বসলেন; কারণ, মেয়েপুরুষের সঙ্গে কাজ করা কোনওমতেই চলবে না। শিশুর হাত থেকে খেলনা কেড়ে নিলে তার মনের যে অবস্থা হয় সেই রকমই ব্যথাবিধুর অন্তরে মিনতিভরা কণ্ঠে বলেছিলাম, আপনি যেসব মেয়েপুরুষকে দেখেছেন কাজ করতে, তারা এয়ারপোর্ট ক্লিনার অথবা এই ধরনের কাজে লিপ্ত। আমার কাজ হবে এরোপ্লে¬নের ভেতর, পায়লটের সামনে যে যন্ত্রপাতি থাকে, যেগুলো বিমান চালাতে সাহায্য করে, এমনকি অটোপায়লট নামীয় যন্ত্র যা পায়লটের সাহায্য ব্যতিরেকে উড়োজাহাজ চালাতে পারে, সেগুলোকে সচলকার্যকর রাখা। মেয়েপুরুষরা থাকবে ক্যান্টিনে, আর আমি থাকব অফিসে। ওদের ওখানে আমার না গেলেও চলবে।
দেখো রূপমিয়া, তার স্বরে দৃঢ়তা সুস্পষ্ট, আমি তোমার আগে এই দুনিয়ায় এসেছি। বিলেতের বেলায়ও তাই। কাজেই তোমাকে মেনে নিতে হবে যে, তোমার চেয়ে আমার অভিজ্ঞতা বেশি। তাছাড়া তোমার বাবা নেই। এমন অবস্থায় তোমার মাইজিকে কাঁদাতে পারি না। তোমার মতো শিক্ষিত ছেলেদের সম্বন্ধে আমার জানার কিছুই বাকি নেই।
মাইজি কাঁদবেন কেন, বরং খুশি হবেন, যখন দেখবেন এক বছর পরপর আমি বাড়ি যেতে পারছি। এয়ারলাইনে একটা বড়ো সুবিধে হচ্ছে এই-যে, বেতনভাতাসহ দুই বছরে একবার দুই মাসের জন্য দেশে যেতে পারব, বিনা ভাড়ায় শ্রীহট্ট পৌঁছে যাবÑ ফ্রি রিটার্ন টিকেট। লন্ডনিদের বড়ো একটা সমস্যার সুন্দর সমাধান হয়ে যাবে। চিন্তা করে দেখুন আজ চার বছর ধরে আপনি কি দেশে যেতে পারছেন?
শেষ বাক্যটির প্রতিক্রিয়া উলটো হলো। সিগারেট আনার অজুহাতে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হাবিজ সাহেবকে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন আমাকে কাবু করার জন্য। বুঝলাম, আমার বোল্ড আউট হওয়া ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। মামুজির অধীনে এসে সত্যি সত্যিই ফেঁসে গেছি। এই বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে যাওয়া সহজ নয়।
হাবিজ সাহেব ক্যাপসটেন সুখা দিয়ে বিড়ি তৈরি করে আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, নেন একটা।
রোল করা সিগারেট আমার বড্ড কড়া লাগে, তাই খাই না। আপনি খান।
অন্য সিগারেট তো আমার কাছে নেই।
আমার কাছে আছে, পরে খায়ে নেব।
আপনারা খান বলেন কেন? উর্দু ভাষায় কেমন সুন্দর শব্দ রয়েছে পিয়ো।
কথাটা ঠিক নয়; কারণ, জল গলাধঃকরণ করতে যখন একই শব্দ পিয়ো ব্যবহার করেন, তখন কি ভেবে দেখেছেন জল আর ধোঁয়া এক জিনিস নয়! অন্যদিকে ইংরেজি ভাষায় দেখুন- কঠিন দ্রব্যের বেলায় ইটিং, পানীয় দ্রব্যের বেলায় ড্রিংকিং আর বায়ুবীয় পদার্থের বেলায় স্মোকিং শব্দ ব্যবহার করা হয়। তাহলে কি স্বীকার করবেন না যে, ইংরেজের ব্যবস্থাই উত্তম! তাদের রীতিনীতি, চিন্তাচেতনার অনুকরণ করা উচিত!
না, তা করব কেন? পাকিস্তানের আদবকায়দা ও বিলেতের আদবকায়দায় প্রভেদ আছে।
ইংরেজি হচ্ছে রাজভাষা, রাষ্ট্রভাষা। তা বাদ দিয়ে সেপাইয়ের ভাষা শিখতে যাব কোন দুঃখে? নিচু লোকরাই সেপাইয়ের খাতায় নাম লেখায়। আগডোম বাগডোম ছড়াটির কথা কি মনে আছে? তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় প্রাচীনকালে ডোমশ্রেণির লোকরাই সেপাই হতো, ওদের ভাষা মিলেই তো সৃষ্টি হয়েছিল উর্দু।
আমার বিক্ষুব্ধ মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, মহাকবি আল্লামা ইকবালের কথা জানেন তো?
অবশ্যই। তিনি উর্দুকে উন্নত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অনেক চেষ্টার পর তিনি নিজেই উপলব্ধি করেন যে, এসব পণ্ডশ্রম। অপদার্থ গোলামকে আপ্রাণ চেষ্টা করে নায়েবি পদে উন্নীত করা যায়, তার বেশি নয়; সে কোনও অবস্থাতেই নবাবের গুণাবলি অর্জন করতে পারে না, তাই আমরা দেখতে পাই ইকবালের প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থগুলো পারসি ভাষায় অথবা পারসিশব্দসমৃদ্ধ উর্দুতে রচিত।
তবে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের ভব্য ও ভদ্রসমাজে বাংলা যে একেবারে অচল, বরং উর্দুই সচল। পাঞ্জাব ও সিন্ধুদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত লোকের সাহিত্যের ভাষাও উর্দু।
হতে পারে। তবে সিন্ধ, পাঞ্জাব, বেলুচ ও পাঠান প্রভৃতি অঞ্চলের জনসাধারণের মৌখিক ভাষা উর্দু নয়। তাছাড়া পূর্ব-বাংলার নিজস্ব ভাষা বাংলা। বাঙালির কাছে উর্দু হচ্ছে একটি বিদেশি ভাষা। পূর্ব-বাংলার মুসলমানদের পক্ষে উর্দুর মতো একটি বিদেশি ভাষা শিক্ষা করা একান্তই অচল, অমঙ্গল ও কুফলপ্রসূ। রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।
তাহলে আল্লাহর ভাষা আরবি শিখুন।
আপনি কি আরবি ভাষা শিখেছেন?
গোঁফহীন মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। বললেন, জি, আল্লাহর মেহেরবানি।
দেখুন হাবিজ সাহেব, কোরআন শরিফ মুখস্থ করাকে আরবি ভাষা শিক্ষা বলে না। আপনি যে কবিতার অর্থ বোঝেন না, সেই কবিতা ব্যাখ্যার যোগ্যতা আপনার থাকতে পারে না। যোগ্যতা ছাড়া অধিকার বর্তায় না। কাজেই আপনি এমনভাবে দাবি করতে পারেন না, বরং অনুচিতই বটে।
আপনি হয়তো জানেন না যে, একজন হাফিজের মর্যাদা কতটুকু। খোদার সম্পূর্ণ কালামকে আত্মায় ধারণ করার কারণে একজন হাবিজ চৌদ্দজনকে বেহেশতে নিয়ে যেতে পারে।
উত্তম কথা, তাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলি, আপনি তো জানেন না যে, একথার মর্মার্থ। আর একথা কি সত্য নয় যে, কাঠের তৈরি আলমারি জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ ধারণ করলেও সেই কাঠগুলো কোনওদিনই জ্ঞানী হয়ে ওঠে না।
লক্ষ করলাম তার হাসি দাড়ির আড়ালে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। ভুরু কুঞ্চিত করে বললেন, আপনি কি জানেন সব ভাষার সেরা ও শক্তিশালী ভাষা হচ্ছে আরবি। মহানবির যুগে সর্বাপেক্ষায় জনপ্রিয় বিষয় ছিল কাব্যচর্চা। স্থানে-অস্থানে কবিদের জলসামজলিস বসত। এসব জলসায় অংশগ্রহণকারী চারণ ও স্বভাবকবিগণের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা চলত। প্রত্যেকই উত্তম কাব্য রচনা করে প্রাধান্য অর্জন করার চেষ্টা করত। আরবি ভাষায় গদ্য ও পদ্য বাক্রীতিও ছিল অনুপম। অপূর্ব রকম কাব্যসম্ভার সৃষ্টি হয়েছিল আরবি ভাষায়।
আরবি পারস্যে এসে পারসি ভাষার কাছে হেরে গেল কেন? ধর্মীয় শব্দগুলো পর্যন্ত বদলে গেল। সালাত হয়ে গেল নামাজ, অদু হয়ে গেল অজু, রমাদান হয়ে গেল রমজান, তাছাড়াও শতসহস্র উদাহরণ রয়েছে। এমনকি আল্লাহ শব্দেরও একচেটিয়া ব্যবহার অক্ষুন্ন রাখা গেল না। ভারত উপমহাদেশের মানুষ আল্লাহর স্থলে খোদা বলতে পাগল নয় কি?
স্বল্পজ্ঞানী আলেমের মতো ইলম্ প্রকাশ করলেন, পারসি ভাষা শিখতে বাধা কোথায়? পারসি তো রাজভাষা ছিল।
তা মনে করেই যখন পারসি শিখতে গিয়েছিলাম তখন আরেক ঝামেলায় পড়ি, মৌলানা জালাল উদ্দিন রুমির মতো ব্যক্তিত্বকে ইসলামিক সংজ্ঞা দিয়ে ইসলামের ভেতরে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ল।
অসুবিধেটা কী?
তিনি পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিলেন বলে মনে হয়।
মামুলি বিনয় বশে আর তর্ক করলেন না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে উদ্দীপ্ত হয়েই বসে রইলেন, মনের গভীরের পরিতাপকে নিবারণ করার জন্য বোধ হয় আরেকটি বিড়ি মুখে তুলে নিলেন, তারপর বললেন, যাক, আপনার মামুজি হয়তো এক্ষুনি চলে আসবেন। তাই তিনি যে কাজের ভার আমাকে দিয়ে গেছেন সে সম্বন্ধে আলাপ করা প্রয়োজন বোধ করছি।
নির্লিপ্তভাবে বলি, করুন।
বিড়িতে একটা সুখঠান দিয়ে বললেন, আপনার মামুজি যা বলেছেন তা আপনার ভালোর জন্যই বলেছেন।
মামুজির উদ্দেশ্য মহৎ, তা অস্বীকার করছি না। তবে তিনি ভুল করছেন।
কুরআন-হাদিসের কথা ভুল হতে পারে না, ছেলেমেয়ে একসঙ্গে কাজ করা নাযায়েজ। তদুপরি বেজাত-বেজন্মা মেয়ে আরও বিপজ্জনক। আপনি ভেবে দেখুন।
মামুজি ফিরে আসায় কথাবর্তা আর এগুলোতে পারল না। আমাকে নিশ্চুপ দেখে এবং হাবিজ সাবের সফলতা অনুমান করে, মামুজি তাকে পানাহার করানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। মেহমানকে নিয়ে ডাইনিং রুমে চলে গেলেন।
৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২। সোমবার। সকাল।
ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই এয়ারপোর্টের চাকুরির ব্যাপারে গতসন্ধ্যার কথাগুলো দৃশ্যসহ ভিডিও হয়ে আমার মনের পরদায় পুনরায় ভেসে উঠল। নিঃশব্দে চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে নিই। কী লজ্জা! আমার চরিত্র নিয়ে সন্দিহ?
আপন পরিবারের গণ্ডির বাইরে কোনও মেয়ের মনুষ্যত্ব মুসলমান মেনে নিতে পারে না, কেন পারে না তা ভেবে পাই না। এজন্যে মাদ্রাসাশিক্ষা কতটুকু দায়ী! পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। মামুজি ও হাবিজ দুজনই মাদ্রাসাশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন বলেই কি ছেলেমেয়ে একসঙ্গে কাজ করার বিরুদ্ধে এরকম কটূক্তি করতে তাদের ধাতে বাঁধেনি। ছেলেমেয়ে সহশিক্ষার পরিবেশে শিক্ষিত হলে বোধ হয় এত সহজে এরকম কথা বলতে পারতেন না। শুধু কি তাই- তারা আমার দাম্পত্যজীবনের একান্ত একনিষ্ঠ প্রেমকে নিয়েও ছিনিমিনি খেলা করতে সাহস পেতেন না। এও জানি, যেকোনও মানুষের চরিত্রের ভালোমন্দ নির্ধারণনির্ণয়নিরূপণ করে দেখা তাদের মতো মাদ্রাসাশিক্ষিত লোকের ধাতে নেই।
আমার অন্তর্দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে আজরাফ এসে সংবাদ দিলো, বার্মিংহাম থেকে দিলদার আলি নামে একজন ভদ্রলোক আপনার খুঁজে এসেছেন।
একটি শব্দও প্রকাশ করিনি। শুধু ভাবি, এত ভোরে একশত এগারো মাইল কী করে সে ভ্রমণ করল! এদিকে আমি এখনও বিছানায় শুয়ে। উঠেই-বা কী করব- সারাক্ষণ শুধু ভাবা আর ভাবতে ভাবতে সারা!
বেডরুম থেকে অবতরণ করে মাটির পুতুলের মতো নিঃশব্দে বসারঘরে এসে উপস্থিত হই। ভূমিকা আর আড়ম্বর ছাড়াই বলি, কেমন আছো?
দিলদার আলি চেয়ার ছেড়ে উঠে সবলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কোলাকুলি করল। যেন পুরাতন দিনের মতো বন্ধুভাবাপন্ন সে। প্রীতি ভালোবাসায় উদ্বেলিত। আমার হৃৎপিণ্ডে কিন্তু একটা ওয়ার (যুদ্ধ) চলছে। পরস্পরবিরোধী ভাবধারার আবির্ভাবে অন্তর আন্দোলিত, তনমনপ্রাণ জনপ্রাণহীন অন্ধকারে আচ্ছন্ন রাত্রি যেন। প্রধান সেনাপতি- ঘনিষ্ঠ আত্মীয়- মীরজাফর যখন নবাবের কাছে গিয়েছিলেন যুদ্ধবিরতির আদেশ আদায়ের উদ্দেশে, তখন মহাবঙ্গের (বঙ্গ-বিহার-উড়িশ্যা-আসাম-ত্রিপুরা-আরাকানের) শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ্দৌলার মনে যেমন বিশ্বাস-অবিশ্বাস, প্রীতি-ঘৃণা, আস্থা-অনাস্থা একসঙ্গে উদয় হয়ে তাকে বিব্রত- কিংকর্তব্যবিমূঢ়- করে তুলেছিল, তেমনই আমার মনের অবস্থা; আর তাই ভেবে চলি, কীভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানানো যায়।
সে কিন্তু কালবিলম্ব না করেই তার স্বভাবসিদ্ধ অভিনয় আরম্ভ করে দিলো। মামুজিকে সম্বোধন করে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে ঘরভরা মানুষের সামনে বলে উঠল, মামুজি, আপনার এই ভাগনে আমার সর্বনাশ করেছে। গত সাড়ে তিন বছর ধরে আমার কষ্টার্জিত চকমকে পাউন্ডগুলোকে কুটিকুটি করে নর্দমায় ফেলে দিয়েছে। একটুকুও দ্বিধাবোধ করল না! যদিও সে আমার বাল্যবন্ধু, কৈশোর-যৌবনের ভালোমন্দ ও হাসিকান্নার সঙ্গী, তবুও পরবর্তীতে আমার সঙ্গে মনোমালিন্যের অজুহাতে প্রতিপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছে কী করে আমাকে সায়েস্তা করা যায়। আপনিই বলুন, বিভীষণের কি উচিত আপন বন্ধুকে সায়েস্তা করার জন্য ভিখারি রামের শরণাপন্ন হওয়া?
মামুজি মুচকি হেসে বললেন, তোমাদের মান-অভিমানে আমাকে শরিক না করলেও পারো বাবা। এখন চা-নাস্তা খেয়ে দীর্ঘ ট্রেন জার্নির ক্লান্তি দূর কোরো। আর ওভারকোট খুলে হ্যাংগারে রেখে সহজ হয়ে বোসো।
ওভারকোটটি খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তার চেহারাটি পালটে গেল। দামী কাপড়ের ওয়েলকাট স্যুট ওকে মানিয়েছে চমৎকার; জন্তু থেকেই তো মানবের পার্থক্য চিহ্নিত হয় পোশাকে- মানুষের এই আদি আবিষ্কার তার উদ্ভাবনী শক্তি ও রুচিবোধের পরিচায়ক; আর তাই সাধারণত পোশাক মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়; যেমন- মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধির বিখ্যাত বাপুজি রূপটি প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর এক বিশেষ ধরনের ধুতি পরনে, তেমনই দিলদার আলির এই বেশভূষায় অন্তরের সত্যপরিচয়টি গোপন রাখায় বাহবা পাওয়ার যোগ্য; পৃথিবীর ভালো দিকটা যেন এই মানুষের অন্তরে প্রবেশ করতে অনিচ্ছুক; অনন্ত আমার চোখে, তার কলুষিত অন্তর কলঙ্কিত তারার মতো ধপধপ করে আত্মপ্রকাশ করছে। আমার এই ভাবনাচিন্তা দৃঢ় করেছে তার অবস্থানই। সে দীপ্ত গলায় বলে যেতে লাগল আমাদের স্বর্ণযুগের বন্ধুত্বের কাহিনি। তার গৌরবময় অবদানের কথাই প্রধান- আমার মাইজির প্রতি তার শ্রদ্ধা, আমার ভাইবোনের প্রতি তার স্নেহের প্রকাশ, অনেক অনেক ফিরিস্তি। গালভরা বুলির মাঝখানে মামুজি বললেন, তোমরা উভয়ের কথাকীর্তি আমার অজানা নয়। তবু শোনব বাকি গল্প বাইর থেকে ফিরে এসে। এখন আমাকে বেরুতে হচ্ছে।
দিলদার আলির কথাগুলো আমার কানে পৌঁছল না। প্রয়োজনও বোধ করিনি। তবে মামুজি যখন বললেন বেরুতে হচ্ছে তখন জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হই, মার্কেটিং করতে যাচ্ছেন?
মামুজি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বিলেতে দেশের মতো বাজার করাকে মার্কেটিং বলে না, বলে শপিং। আজ মার্কেটে পাইকারি দরে মুরগি বিক্রি হবে। একঝাঁকায় আট-দশটা মুরগি সাধারণত থাকে। একঝাঁকা কিনে দু-তিনজনে ভাগ করে নিলেই …।
বাধা দিয়ে দিলদার বলল, এতে কি আপনাদের সপ্তাহ চলে?
দিলদারের প্রশ্নের উত্তরে মামুজি বললেন, টান পড়লে কিছু মাছ বা ভেড়ির মাংস কিনে নিলেই চলে। সঙ্গে শাক-সব্জি, ডিম, ডাল তো আছেই। ঝাঁকার মুরগি কেনায় আরেকটা লাভ আছে। ঘরে এনে স্বহস্তে আল্লাহর নামে জবাই করা যায়। হালাল গোশ্ত খাবার এই হচ্ছে উত্তম ব্যবস্থা। আবার দামেও কম। তোমরা আলাপ কোরো। ফিরে আসতে তেমন দেরি হবে না।
চলবে…