
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ১৭
তারপর তিনি অবুঝ স্বামীর মতো মাথা দুলিয়ে কিন্তু শক্ত গলায় বললেন যে, আমি যেন এক্ষুণি তার বাসায় চলে যাই। তার স্ত্রী আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ভুরু কুঁচকে আমি মৃদু হাসি। আমার শরীর-মন জুড়ে চলছে এক তীব্র লড়াই। আমাকে এই যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে। যতদূর সম্ভব নাসরিনের কাছ থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখাই উচিত। নিজেকে প্রয়োজন হলে আরও গভীর অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে হবে বই কি! আমি রাজি হচ্ছি না দেখে তিনি তার চোখদুটো সরু করে, মুখে হাসির প্রলেপ মেখে বললেন, গতকাল আমি বাজার করতে পারিনি। ফলে বাসায় মাছ, মাংস কিছুই নেই। আমাকে আসার সময় নাসরিন বলেছিল কিছু একটা দিয়ে যেতে। এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছিল, তাই তাকে বলেছি—আপনি যাওয়ার সময় কিছু নিয়ে যাবেন। আপন না হলে কি আপনাকে দিয়ে বাজার করানোর কথা ভাবতে পারি?
আমি কোনও উত্তর দিতে পারিনি, শুধু কপালে গভীর সন্দেহের ভাঁজ ফুটে ওঠে, এক অজানা শঙ্কায় আমার মুখ শুকিয়ে উঠল। আমার অনুভব ও অনুমতির ওপর যেন নাসরিনের জীবনকাহিনি নতুনভাবে লেখা হবে। নীরবে মাথা নেড়ে হাঁটা শুরু করি।
রাস্তার পিচে মুখ দেখে নিল আকাশ। সূর্য একটু সময়ের জন্য রুপালি মেঘের আড়ালে আশ্রয় নিল। একটি শঙ্খচিল সমুদ্রের পথ ভুলে, আকাশে, মুক্তভাবে সাঁতার কাটতে কাটতে হঠাৎ ক্লান্তি দূর করার জন্য নাসরিনদের বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিল। তখনই তার পালকে ফিরে-আসা সূর্যের ঝাপসা আলপনা তৈরি হতে থাকে। সূর্যের এই আলপনা আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি, গুম হয়ে দরজায় নক করি। কপাট খুলে দিলো নাসরিন, তার শাড়ির আঁচলে হলুদের রাজত্ব। আমার চোখে হলুদের রং বর্শার মতো বিঁধতে থাকে। তবে একে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা এখন আমার পক্ষে অসম্ভব। আমাকে দেখে নাসরিন খুবই খুশি, মুখে হাসি ফুটিয়ে অভিবাদন করে বলল, আসুন, ভেতরে আসুন।
আপনার রহস্যটা কী! যখনই দেখি তখন মনে হয় আপনি খুশিতে টগবগ করছেন। এত আনন্দ কোথায় কুঁড়িয়ে পান?
উত্তর দিলো না সে, শুধু দুলে দুলে হাসতে থাকে, এই হাসির মধ্যেই যেন সে খোঁজে বেড়াচ্ছে আমাদের সম্পর্কের মূল শিকড়টিকে, তা আমার অজানা, এর সন্ধান পেলে হয়তো নাসরিন মাত্রাতিরিক্ত আদরাপ্যায়নে আপ্লুত হয়ে, গাঢ়ভাবে গভীরভাবে যত্ন নিতে পারত, তবে এখন অকারণে হইচই, প্রাণখোলা হাসি হেসে চলেছে সে, মনে হচ্ছে আমি যেন তার বিস্তীর্ণ মরুভূমির একমাত্র আবেযমযম। তার প্রাণঢালা হাসির পীড়ন আমাকে মনে করিয়ে দিলো—এই হাসিটি তার জন্য মারাত্মক বিপদসংকেত—এই সরলমনা নারীর আন্তরিক হাসিটিকে তার স্বামীর বন্ধুদের খিদেতেষ্টা ভুলিয়ে দিতে পারে, এবং অবিশ্যি তারা এর ভুলব্যাখ্যা করতে দ্বিধা করবে না।
শোবারঘর থেকে একটি সংগীতের মূর্ছনা ভেসে আসছে, এক অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠি, বললাম, আপনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন বুঝি? তাহলে থাক। আমি না হয় আবার সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসি। বাজার রেখে যাচ্ছি।
সঙ্গে সঙ্গেই নাসরিন আবার শব্দ করে হেসে উঠল, হাসিতে দুষ্টমি রয়েছে, বলল, তা হয় নাকি! এসেই যখন পড়েছেন… ইস, খুব ঘেমে গেছেন, ভরদুপুরে কাউকে এমনভাবে ফিরিয়ে দিতে পারি!
এমনভাবে নাসরিন কথাগুলো বলল, আমি আর ‘না’ বলতে পারিনি। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করি, অলকনন্দা রূপবতী নারীর সমারোহে। খাবারঘরে এসে বসি; এর আগে, একবারই, যখন এই বাড়িতে এসেছিলাম তখন বসারঘরেই বসেছিলাম। খাবারঘরকে এক নিমিষে প্রদর্শন করে বুঝে নিই যে, এক সদ্যবিবাহিত দম্পতি আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে স্বর্গকে খোঁজে পাওয়ার জন্য, অথচ কীসের জন্য যেন স্বর্গটি তাদের ধরা দিচ্ছে না। না, এ আমারই ভুল; মানুষ তো স্বর্গের ঠিকানা জানে না, স্বর্গের সন্ধান করাই তো হচ্ছে একরকম হাস্যকর ব্যাপার। নাসরিন এক গ্লাশ শরবত আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, চুপটি করে সবটুকু শেষ করুন, পরে কথা হবে।
গ্লাশে চুমুক দিতেই ক্লান্তি যেন সরে গেল, আরাম এলো; আরাম লাভের উপাদানই হচ্ছে মনের শ্রান্তি, মস্তিষ্কের প্রশান্তি; বুঝতে পারি, তরমুজের শরবত, গ্লাশের ভেতর এক মধুরসৌরভ ম-ম করছে। পরদা সরিয়ে ভেতরে চলে গেল নাসরিন, হয়তো-বা বাজার গোছগাছ করে রাখার জন্য, তবে তা পরেও করতে পারত; তার কথাতেই তো যখন আসা, এখন সে যদি কোনও কথা বলতে চায় না, তাহলে আমি নাক গলিয়ে বলতে যাব কেন?
খাবারঘরের চারপাশে চোখ বুলাতে থাকি। মেঝেকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে। দেওয়ালে বড়ো এক নকশি-কাঁথা ঝুলানো। এরই পাশে সুঁতোর তৈরি একটি মানব-মানবীর পট, তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ, দূর থেকে মনে হয় চুম্বনরত, এরই নিচে লেখা আছে ‘প্রমোদকানন’। মানব-মানবীর মাথার ওপর একটি ডাল থেকে ঝুলছে গণ্ডম যেন, অমৃতফল; এরকম একটি ফলভক্ষণের কারণেই মানুষ স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। জীবন জুড়ে তাই তো আজ দুঃখ, যন্ত্রণা আর আঘাত। ‘প্রমোদকানন’-এর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটি কথা মনে পড়ে গেল—
আনন্দের, সুখসাগরে অবগাহন করার মধ্যেই কি লুকিয়ে থাকে দুঃখের স্বাদ! পরদা সরিয়ে ফের খাবারঘরে উপস্থিত হলো নাসরিন। একটি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, আজ না খাইয়ে ছাড়ছি না।
ক্ষণিক নীরব থেকে তার মুখের দিকে চোখ তুলে বলি, ঠিক আছে তা-ই হবে। তবে কী রান্না করছেন?
ইলিশ, নারিকেলের দুধ দিয়ে।
আহমদ সাহেব না বললেন, তিনি বাজার করেননি। তাহলে ইলিশ এলো কোথা থেকে?
মুখ টিপে হেসে নাসরিন বলল, করাচির ইলিশ।
বুঝতে পারি, আমাকে এখানে আনানোর জন্য বাজার ছিল একটি বাহানা মাত্র। নাসরিন চেয়ারে বসে, হাত বাড়িয়ে পরদা সরিয়ে জানাল খুলল। তার ঘামে ভেজা ব্লাউজের ঘ্রাণ আমার নাকে ধাক্কা খেতেই মনের মধ্যে এক শাদা চিল উড়ে বেড়াতে থাকে, নিজের মতো ডানা মেলে ঘুরপাক খাচ্ছে যেন শুধু। খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি, দূরের নীবর পাহাড়টি যেন আলপিন ফুটিয়ে আটকে রেখেছে আকাশটিকে। তারপর বললাম, তাই! ইলিশ আমার খুবই প্রিয়।
জানি। নাসরিনের চোখ দূর্গার মতো উচ্ছ্বল দৃষ্টি।
‘জানি’ শব্দটি আমার মনে ফড়িংয়ের মতো উড়তে থাকে, নাসরিনের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বলি, কীভাবে?
তা জেনে লাভ নেই। এর চেয়ে বরং খাওয়া-দাওয়া সেরে নেওয়া যাক।
খেয়ে-দেয়ে যখন আমার গন্তব্যে ফিরে আসার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠি তখন নাসরিনের এক অস্পষ্ট কথায়, আমার মনে হলো, তার মন জুড়ে কী যেন এক শূন্যতা বিরাজ করছে, হয়তো এ তার বয়সের স্বভাবধর্ম, তবে নাসরিন এই শূন্যতা অন্তরে নিয়ে বাস করতে চায় না, চায় মনের মধ্যে যে অভাব, এই ভয়ানক স্থানটিকে পূর্ণতা দিয়ে পূরণ করে নিতে; হাত বাড়াতে চাচ্ছে আমার দিকে, আমাকে দিয়ে সে পূরণ করে নিতে চায় তার অপূর্ণ বাসনাটি; ওর আচরণে তা-ই উপলব্ধি করি। একবার মনে হলো, মর্মাহত মন নিয়ে একদৌড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই; পরক্ষণে, চোখ তুলে নাসরিনের দিকে তাকাতেই, দেখতে পাই, তার নয়ন সজল হয়ে উঠেছে, ছলনা নয়, সে এমন কোনও অসুবিধায় পড়েছে যা থেকে উত্তরণের জন্য আমার সহযোগিতা তার প্রয়োজন; এমন ধরনের যতসব ভাবনা যখন আমার মাথা জুড়ে খেলা করছে তখন সে আচমকা, কাছে এসে, আমার কপালে চুমু খেলো, তারপর মুখে প্রজাপতির ডানার মতো হাসি ছড়িয়ে, ডানহাত আমার কাঁধে স্থাপন করে আলতোভাবে চাপ দিলো। তাকে স্পর্শ না করেই, যেমনই ছিলাম তেমনই মৌন থেকে, আকাশপাতাল ভাবতে থাকি—বন্ধুর অধিকার আমার মাঝে অনুপস্থিত। সে-ই প্রথমে কথা শুরু করল, অপমান-অভিমান থেকে বেরিয়ে আসার একটি অঙ্কুর যেন, বলল, আমি মস্ত বড়ো এক সমস্যায় পড়েছি; যা বলতেও পারছি না, সইতেও পারছি না।
হয়তো-বা এই সংসারি মেয়েমানুষের প্রকৃতি; অতিসামান্য সমস্যার মুখে পতিত হলে তারা হাতড়ে কূল-কিনারা পাবে না বলে বিশ্বাস করে; ভুলে যায় সংসারে কোনও সমস্যা দেখা দিলে তা শুধু স্ত্রীরই সমস্যা নয়, স্বামী বলে তো একটি প্রাণি আছে; তাই আমি লাজশরম মাথায় ধরে বলি, যেকোনও বিষয়ই হোক-না কেন আপনি আপনার স্বামীকে খুলে বলুন। অবশ্যই তিনি এর সমাধানে সাহাজ্য করবেন।
তার জেদের কণ্ঠই প্রকাশ পেল, না, তাকে সব কথা বলা যায় না।
চমকে উঠি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় আবার—দূরে, একটি গাছে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো; গাছটি চিনতে পারছি না; ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে তার শাখা-প্রশাখায়; কৃষ্ণচূড়ার মতোই মনে হচ্ছে। হাওয়ায় দোল-খাওয়া পাতাগুলো নিরীক্ষা করতে থাকি; অনেক সময় পাতা দেখেও গাছ চেনা যায় না, ফুল দেখে চিনতে হয়, ফুল যখন ফুটবে তখন হয়তো-বা চেনা যাবে। এই অচেনা গাছের নিচে বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে। নাসরিনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলি, তাকে যা বলা যায় না, তা আমাকে বলবেন কেমন করে?
সূর্য খানিকটা পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে, কিছুক্ষণ আগেও রোদ ছিল নাসরিনের গা জুড়ে, এখন শুধু তার হাতের পাশে ছড়িয়ে থাকা শাড়ির পাড়ের সঙ্গে খেলা করছে। শাড়ি নাড়তে নাড়তে নাসরিন বলল, আপনি যদি আমার উপকার করতে না পারেন তাহলে মরণ ছাড়া আমার আর কোনও উপায় নেই।
বুঝতে পারি নিশ্চয়ই ঘোরতর কিছু একটা ঘটেছে, দ্বিরুক্তি না করেই বলি, বিষয়টা খুলে বলবেন। কি হয়েছে?
সব কথা তো আর বলা যায় না।
বুঝতে পারি, সম্ভবত যৌনসংক্রান্ত জটিল কিছু। বলি, যতটুকু পারেন বলুন। বাকিটুকু আমি বুঝে নেব। তবে সত্য ঘটনাটি বলতে হবে।
নাসরিন উঠে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিলো, যেন তার মনের কথা আর কেউ শুনতে না পারে, কিন্তু জানালা বন্ধ করল না, এমনকি জানালার লম্বা পরদাটিও টানল না। ফিরে আসার পথে দরজার পাশের বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বলল, সচরাচর তাই তো বলে থাকি।
আমি নিশ্চুপ। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই লক্ষ করছি নাসরিনের মধ্যে একরকম অস্থিরতা বিরাজ করছে, যত সময় যাচ্ছে ততই যেন বেড়ে চলেছে, বৃদ্ধি পাওয়াই বোধ হয় স্বাভাবিক। নাসরিন এক জায়গায় বেশিক্ষণ স্থির থাকতে পারছে না। নিঃশব্দে আরেকটি চেয়ার টেনে, কিছুক্ষণ নীরব থেকে জিজ্ঞেস করল, ওয়াহিদুর রহমানকে চিনেন?
চিনি।
সে আমার স্বামীর অন্তরঙ্গ বন্ধু।
জানি।
এও জানি, যেদিন থেকে নাসরিন তার স্বামীর সঙ্গে করাচিতে বসবাস শুরু করেছে সেইদিন থেকেই এই বাড়িতে ওয়াহিদুর রহমানের আনাগোনা বেড়ে যায়। সে প্রায়ই আসে।
নাসরিন হঠাৎ বলল, আমার স্বামীর নির্দেশে তার বন্ধুর আদরযত্ন করতে শুরু করি। প্রথম প্রথম আসত তার সঙ্গেই, পরে একা একা। জানি না, সে কেমন করে জানত কখন তিনি বাইরে থাকবেন। তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেই সে এসে হাজির হতো। নানা কথা ইনিয়েবিনিয়ে বলত। সব তো আর বলতে পারছি না!
নাসরিনের মুখের দিকে না তাকিয়েই বলি, ঠিক আছে, যা পারেন তাই বলুন।
একদিন আমি ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। সে বলে, আমার হাসির দাম নাকি আমার অপদার্থ স্বামী দিতে পারছে না। এই পর্যন্ত বলেই আবার থেমে গেল নাসরিন। তার বুকের ধকধক শব্দ শুনতে পারছি। চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলাম, তার মুখ বেদনায় পাণ্ডুর আঁকার ধারণ করেছে। গৌরবর্ণ মুখে রক্তের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বলি, আপনি শান্ত হন। ওর গোঁয়ার্তুমি তো আর আমি নতুন দেখিনি।
নাসরিন জানালার দিকে তাকাল। চোখের জল অনেক কষ্ট করে আটকে রেখেছে, কিন্তু পারছে কোথায়, বরং দুই চোখ ভরে উপচে পড়ছে, তবুও যন্ত্রমূর্তির মতো বলতে লাগল, আমি গালি পারলে সে বেরিয়ে যায়, গলাকাটা মানুষের মতো গোঙানো শব্দে। ভেবেছিলাম আপদ গেছে, কিন্তু সেদিন আমাকে শাসিয়ে গেছে, তার কুমতলবে আমি যদি রাজি না হই তাহলে সে আমার এমন ব্যবস্থা করবে যাতে আমার স্বামী আমাকে তালাক দিতে বাধ্য হন।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। তারপর চেয়ার ছেড়ে নাসরিনের কাছে এসে তার মাথায় আলতভাবে হাত বুলিয়ে বলি, এখন আর কোনও কথা নয়। শান্ত হয়ে চেয়ারেই শুয়ে পরেন। এ নিয়ে পরে কথা হবে।
চোখ তুলে কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে, চোখদুটো যেন কড়মচা, মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
নাসরিন নিঃশব্দে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, বুক হালকা করার জন্য। এক নরাধমের কুব্যবহারে তার মনে বড্ড চাপ লেগেছে। চোখের জলে শাড়ির আঁচল, চেয়ারের কোশন ভিজে যাচ্ছে। তার মনের অবস্থা উসকোখুসকো যেন। উদ্ভ্রান্তের মতো তার চেহারা। আমার মন কেমন যেন করে উঠল। আমার মনের ভাব সে বুঝতে পারছে না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই নাসরিন বলল, একটু জল দেবেন?
টেবিলের একপাশে রাখা পাত্র থেকে জল ঢেলে নিয়ে, জলভরা গ্লাশটি এগিয়ে দিই। সে চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে ঢকঢক করে জলপান করে গ্লাশটি ফিরিয়ে দিলো। সে কিছুটা শান্ত হওয়ার পর আমি বলি, আপনি ভাববেন না, ওর একটি বিহিত আমি করে ছাড়ব।
জানি, ওয়াহিদুর রহমানকে এই বাড়ি থেকে তাড়ানো এমন কিছুই না, কিন্তু তাকে তাড়াতে গেলে যদি নাসরিনের আরও ক্ষতি হয় তখন কী হবে, বলি, আমি দেখছি ওকে কীভাবে আজীবনের জন্য এই বাড়ির দরজা বন্ধ করা যায়, ততক্ষণ ওকে একটু সামাল দিয়ে চলতে হবে বই কি!
নাসরিনের চোখে আবারও জল দেখা দিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে, মুখ একটু নিচু করে বুদ্ধিমতীর মতো বলল, ঠিক আছে।
বিদায়ের সময় নাসরিন গেট পর্যন্ত এগিয়ে এলো। আমার দীর্ঘশ্বাস অনেকক্ষণ আটকে রেখেছিলাম, আর পারিনি, হুঁশ করে বেরিয়ে এলো। আকাশের দিকে তাকাই—দূরের সেই অচেনা গাছের দিকে দৃষ্টিতে পড়ে; পাতার আঁড়ালে সূর্যটি অস্তে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, হঠাৎ দেখলে মনে হয় গাছ ভরা বুঝি থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়া ফুটে রয়েছে, আর এই রক্তলাল ফুলের রক্তালো দিগন্ত ছাপিয়ে, ঝরে পড়ছে নাসরিনদের গেটের সামনে। দাঁড়িয়ে থাকা নাসরিনকে দেখে মনে হচ্ছে, সে যেন অলকনন্দার কুঞ্জতলের আরেকটি কৃষ্ণচূড়া।
একটা ঝাকুনি দিয়ে ট্রেনটি থেমে গেল, আর এই ঝাকুনির সঙ্গে আমার স্মৃতিসমুদ্রের মন্থনক্রিয়াও বন্ধ হয়ে গেল। চেয়ে দেখি, সুড়ঙ্গপথের দেয়ালে লেখা : অলগেট ইস্ট। তবে প্লাটফর্মে ট্রেন এখনও পৌঁছোতে পারেনি, কিছুটা দূরেই আছে। ট্রেন থামার কারণ জেনে নেওয়ার আগেই আবার চলতে শুরু করল। পাতালস্টেশন থেকে বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গেই ঠান্ডা বাতাস আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরল।
চলবে…