
পরদেশে পরবাসী ॥ পর্ব ১৩
তৃতীয় অধ্যায়
মামুজির ডাকে ঘুম ভাঙল। আমার আশ্রয়স্থল ৪৩ নম্বর সেন্টল স্ট্রিটের খাবার কামরায় সকলের অবাধগতি। প্রাইভেসি বলতে কিছুই নেই। পরের বাড়ি, অনেক ঝামেলা। চোখ রগড়ে দেখি, মামুজি একা নন, সঙ্গে একজন অপরিচিত মানুষ। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আদাব জানাতেই অতিথি বললেন, কেমন আছো বাবা?
ভালো। তারপর মামুজির দিকে তাকিয়ে বলি, হাতমুখ ধুয়ে আসছি মামুজি।
হাতমুখ ধুয়ে যখন ফিরে আসি তখন টেবিলের ওপর ধূমায়িত এককাপ চা আমার জন্য অপেক্ষা করলেও ভদ্রলোকটি করেননি। এরই মধ্যে কেটে পরেছেন। জানালা দিয়ে বাইরে চোখ যেতেই দেখি, বৃষ্টি পড়ছে। দেশের মতো নয়। আকাশে মেঘ গাঢ়তর হলেও মুষলধারা বৃষ্টি হচ্ছে না।
মামুজি বললেন, আগামীকাল কাজ নেই। ভাবছি, বাজার করব। আজ স্নান সেরে শুধু এক পাউন্ড লেগ সঙ্গে নিয়ে এসেছি। বিলেতে ভেড়ির মাংসই বেশি। কষিয়ে রান্না করলে খুব সুস্বাদু হয়।
আমার সঙ্গে মামুজির বয়সের ব্যবধান বেশি না হলেও তার চুলে পাক ধরেছে। স্বাস্থ্যও তেমন ভালো নয়। বাতে পঙ্গু। মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছেন। প্রধান কারণ, মামাতুতো ভাইবোনসহ মামিজিকে রেখে এসেছেন শ্বশুরবাড়িতে। মামুজির মুখের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে মনে মনে বলি, চাকরি হলে মামুজিকে দেশে পাঠিয়ে দেবো। মাসকয়েক দেশে কাটিয়ে এলে মনটা চাঙা হবে।
খালি চায়ের কাপে সিগারেটের ছাই ফেলতে ফেলতে মামুজি বললেন, শনি-রবি দুদিন তুমি বাড়ি থেকে কোথাও যেয়ো না। পরিচিত অনেকই আসবে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। সকলেই তোমাকে এক-দুই পাউন্ড করে দেবে। কে কত দেয় তা কিন্তু লিখে রাখবে। তাদের বাড়ি যাওয়ার সময় বা ফিরে আসার পর হিসাব করে টাকাগুলো ফেরত দিতে হবে।
ভাবি, ব্যবস্থাটি মন্দ নয়! প্রয়োজনের সময় কয়েকটি পাউন্ড পাওয়া গেলে ভালোই হয়।
১৫ জানুয়ারি ১৯৬২।
সোমবার।
ভোর রাতেই ঘুম ভেঙে গেল। লন্ডনে ভোরের সঙ্গে সূর্য উঠার কোনও সম্পর্ক নেই। বাংলার দুর্নীতিবাজ নবাবদের মতো শ্রমবিমুখ এই বিলেতি সূর্যটি। মদ্যপান করে ঘুমোয় কিনা, জেগে উঠার কোনও তাড়া নেই। বিলেতে অবশ্য ভোর হয় ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। সূর্য না জাগলেও ক্ষতি নেই। আকাশ তো দিনরাত ঘোমটা পরেই থাকে। বিদ্যুৎ আবিষ্কার করে মানুষ অন্ধকারকে পরাস্ত করেছে। এদেশের অফিসারদের সাধারণত আটটা-পাঁচটা কাজ করতে হয়, প্রতিদিন, বাধ্যতামূলক। শ্রমিকদের কাজের সময় বিভিন্ন প্রকার, অনির্দিষ্ট কর্মঘন্টা; শিপটওয়ার্ক। কেউ কেউ সূর্য উঠার আগেই রওয়ানা দেয় কর্মস্থলের উদ্দেশে। আবার সূর্য ডোবার পরপরই কর্মস্থল ত্যাগ করে। কেউ কেউ আবার সারা রাত কাজ করে সকালে বাড়ি ফেরে। শনি-রবি দুদিন ওভারটাইম- ইচ্ছাধীন। অবশ্য জীবিকার জন্য যাদের কাজ করতে হয় না, তাদের কথা আলাদা। শীতকালেই সূর্যের আলসেমিটা বেশি। শুনেছি, গ্রীষ্মকালে গা-ঝারা দিয়ে ওঠে খুব ভোরে, বিশেষ করে জুনের মাঝামাঝি সময়ে; তখন পৌনে চারটার আগেই নাকি জেগে ওঠে আর বিশ্রামে যায় সোয়া আটটার পর। ক্যালেন্ডারও তা-ই বলে। যাক, দেখে নেওয়া যাবে মাসকয়েক পর, তার গতিবিধির হেরফের।
আস্তে আস্তে কিচেন ও ডাইনিং রুম ভর্তি হতে লাগল পরদেশে পরবাসীর উপস্থিতিতে। কেউ প্লেটে ডিম চটকাচ্ছে। কেউ চটকানো ডিমে ব্রেড ডুবিয়ে ফ্রাইপ্যানে বাটার ঢেলে ভেজে নিচ্ছে। কেউ-বা আবার পৃথক করে ডিম ভাজছে। যার যে রকম রুচি সেই ভাবে নাশতা তৈরি হচ্ছে। অন্যরা আবার সঙ্গে টিফিন নেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করছে। শুনেছি, শনি-রবি একসঙ্গে এত লোক নাকি কিচেনে সাধারণত আসে না। যাদের কাজ নেই তারা বেশ বেলা পর্যন্ত নাক ডাকায়।
মামুজি সবেমাত্র রেখে গেলেন আমার সামনে একটি নাশতার প্লেট। আরেকজন এনে দিলো এককাপ চা, সঙ্গে সিগারেটের অফারও। মামুজির সামনে সিগারেটের অফার উভয়কে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিলো। আমার প্রায় সমবয়স্ক মামুজির সামনে ধূমপান করব না, এমন মান্যতা লোকটি মেনে নিতে পারেনি। জানি, শ্রীভূমির কোনও কোনও পরিবারে উপযুক্ত বয়সে বাপ-কাকার সামনেই তামাক টানে, অবশ্য একটু পেছন ফিরে। বিলেতে তো আরও অবাধ ব্যবস্থা; তাই ধূমপান করার অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
নাশতা শেষে একে একে নিজ নিজ বেডরুমে চলে যেতে লাগল; কেউ কেউ কাপড় পালটিয়ে কাজে যাওয়ার জন্য, আর কেউ কেউ বিশ্রামে। মামুজিও বেডরুমে চলে গেলেন। ফিরে এলেন গরম কাপড় পরে। বাইরে যাওয়ার আগে বললেন, একান্তই বেরুতে হলে ফিরতে দেরি কোরো না। বেরুনোর আগে নতুন খরিদ করা গরম পোশাক গায়ে জড়িয়ে নিতে ভুলো না। তারপর দরজার সামনে থেকে ফিরে এসে ভাত-তরকারি দেখিয়ে বললেন, ফিরে এসে এগুলো গরম করে খেয়ে নিয়ো।
১৬ জানুয়ারি ১৯৬২।
মঙ্গলবার।
বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এরকম যুবকের সন্ধান সাধারণত বাঙালি বাড়িতে পাওয়ার কথা নয়। শুনেছি, সে এই বাড়িতে ভাড়া পেয়েছিল তার বরাত জোরে। এখানে বেশিরভাগ ভাড়াটেরা অল্প ভাড়ায় বসে আছে, কেউই নড়তে চায় না, নড়ানো সম্ভবও না। আচমকা এখান থেকে একজন ভাড়াটে চলে গেল; আর তখনই যুবকটি বাড়ির মালিককে বলল, একটি ঘর দেবেন আমি থাকব?
মালিক বললেন, একটাই সমস্যা, খাবারঘরে থাকতে হবে, শেয়ারে।
সে আপত্তি করেনি। সেই থেকে খাবারঘরেই তার আশ্রয়। পরবর্তীতে আমিও তার সঙ্গী হই। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে—বিলেতি রাতের অন্ধকার ভেদ করে কাজ ফেরত লোকগুলো আমাদের খাটের চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, এটি-ওটি নাড়ে, ভারী পায়ে শব্দ তুলে, সারাদিনের উপচে পড়া কিছু গল্পের ভগ্নাংশ একে অপরকে শোনায়। শীতের বিছানায় কম্বলের নিচে আমাদের রক্তে তখনওই চলে এই বাড়ির মানুষগুলোর বিরুদ্ধে ঘুমন্ত প্রতিবাদ, তুষের আগুন যেন। মনে হয়, সকলই আমাদের উত্যক্ত করতে সবসময় প্রস্তুত। গতরাত ফিসফিস করে জাবেদ বলেছিল, আমাদের বিরক্ত করা কি তাদের উচিত?
বলেছিলাম, ইচ্ছে করে তো আর করছেন না।
জাবেদ প্রত্যুত্তরে বলেছিল, নিস্পন্দ এতিমের মতো নীরব থেকে কান সজাগ রাখি, সবই শুনি, আর ভাবি, আমার তো সংসার নেই, নারী নেই, বাচ্চা নেই, এই বাড়ির মানুষগুলোর মতো দুশ্চিন্তাও নেই। আমার সঙ্গে এই বাড়ির বিবাহিত পুরুষগুলোর অল্পই পরিচয়, তা সত্ত্বেও কিছুটা হলেও ওরা আমাকে নিয়ে চিন্তিত। গতকাল ল্যান্ডলর্ড বলেই ফেললেন, ‘তোমার মতো ব্যাচেলর যুবকের পাখির ছানার মতো নীড়ের ভরসা নেই, নিরাপত্তাও নেই-ই।’ উত্তরে বলেছিলাম, আমি নারীর প্রতি সম্মান রেখেই নিরাপদ দূরত্বে চলি। সেইজন্য আমার নীড়ের ভরসা ও নিরাপত্তা দুটোই রয়েছে। কিন্তু আপনি, বিবাহিত পুরুষ হয়েও ভুলে যান, আপনার স্ত্রী থেকেও নেই। শুধু এই বিদেশবিভূঁই জীবনে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বাঙালিকে নিয়ে একটি নিকেতন তৈরির ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এখানে পুরুষগুলো রাঁধে, সকালের চা-নাশতা করে দেওয়ার জন্য কাজের লোকের প্রয়োজন পড়ে না, সবকিছুই নিজেকে করতে হয়; তবুও মেঘযুক্ত আকাশের মতোই আবছা, স্যাঁতস্যাঁতে একটি নিঃসঙ্গতা বাড়ির দেয়ালে নকশি কাটে। রাত যখন ঘনীভূত হয় তখন আস্তেধীরে এই নিকেতনের কেউ কেউ অন্ধকারের পাখা ধরে নিজ নিজ ঘরে আশ্রয় নেয়। ঘুম থেকে উঠেই আবার যার যার কাজে ছুটে। আজ সকালেও কেউ কেউ ছুটেছে, শুধু বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে জাবেদ অল্পজলে হাত ডুবিয়ে সাবান পরিষ্কার করছে, আর বারকয়েক আয়নার মধ্য দিয়ে নিজেকে দেখছে; এতবার দেখার পরও যেন তৃপ্তি পাচ্ছে না। তার দৃষ্টি যত আনন্দদায়ক ততই সকরুণ, নবীন পাতার আশ্চর্য আকর্ষণ যেমন আছে তেমনই তেঁতুল পাতার চিরল ছায়াও। সরষের হলুদ স্নিগ্ধ ধরা নেশার এবং অবশ হওয়া ঝিঙেলতা ও সন্ধ্যা নদীর নীরব মিলাতির সন্ধানও পাওয়া যায়। ওর দৃষ্টি যেন আখের রসের মতো গড়িয়ে পড়ছে ঠোঁটে, মুখে; তবে তার নিরীহ ভাবটি শেভিং ক্রিমের মাঝে সগর্বে আত্মপ্রকাশ করতে ভুলছে না। ওকে দেখলেই মনে হয় সে অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির মানুষ; মাংসপেশিতে পাকামু নেই, অহংকার তো নেই-ই। গড়নে শুধু কয়েকটি প্রবল যৌনোদ্দীপক রেখার রাজত্ব। বেসিনের ওপর রাখা বাটিতে সাবানের গায়ে শুয়ে থাকা সাবান লাগানো ব্রাশটির ওপর থেকে চোখ সরিয়ে জাবেদ আবার শেভিংয়ে মনোনিবেশ করল। টেপ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে জল গড়াচ্ছে। তার গায়ের রং সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়, মাঝে মাঝে তাকে বিদেশি বলে মনে হয়, আবার কখনও মনে হয় সে খুবই ফর্সা ধরনের এক বাঙালি; হয়তো গৌরীর গর্ভে, বাঙালির ওরসে জন্ম তার। তার স্বরে যুবকসুলভ উগ্রতা নেই, মনে হয় সে অল্পভাষী, আসলে ব্যাপারটি উলটো, খুব বেশি কথা বলে সে; চোখঠোঁট সবসময় খেলা করে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জাবেদ একমনে তলোয়ার মার্কা ব্লেডের ছোঁয়ায় শেভিং করে চলেছে; আর আমি বেশ কষ্ট করেই জেগে আছি, যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে উঠতে হবে। ভেবে পাই না, একটি মানুষ সারাক্ষণ এত টেনশন-ফ্রি থাকে কীভাবে! তার চেয়ে আশ্চর্যের কথা, শত চেষ্টা করেও আমি টেনশন-ফ্রি থাকতে পারি না। জীবন নিয়ে জাবেদের মতো এতটা শীতল নই আমি। একটু অস্থির বলেই হয়তো বালিশ থেকে নিঃশব্দে মাথা তুলে বাইরের জগৎটি দেখার চেষ্টা করি; স্তব্ধ-নিঝুম-বিপুল অন্ধকারের রাজত্ব চলছে সেখানে, যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছে তার চেয়েও অনেক অনেক দূর পর্যন্ত। সেখান থেকে আমার কিঞ্চিৎ রোষায়িত ও মৃদু অনুযোগে ভরা দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো রান্নাঘরের ভেজানো দরজার ফাঁকে, সেদিকে তাকাতেই দেখি—খুব সন্তর্পণে দরজার ফাঁক দিয়ে বিদ্যুৎবাতির আলো জাবেদের চুল ঘেঁষে আয়নার সঙ্গে হৃদয়ঘটিত একরকম ভাব রচনা করে চলেছে। জাবেদ রান্নাঘরের বিদ্যুৎ-বাতিটি জ্বালিয়ে ছিল আমার ঘুম না ভাঙার জন্য, কিন্তু বাতির কারণেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। ভেবে পাচ্ছি না, আয়নার সঙ্গে রান্নাঘরের আলোর এত উতল-উল্লাস খেলা কেন? অদ্ভুত! মাথাকে বালিশে শুইয়ে, শরীরকে টানটান করে বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। শ্রান্তি যখন শরীরকে দখল করতে পারছে না তখন জোর করে চোখদুটো বন্ধ করে রাখাই উচিত। চোখ বন্ধ করে জটিল জিনিশ নিয়ে চিন্তা করতে ভালোবাসি; সারাদিন নানারকম ব্যস্ততায় ভাবার সময় পাই না। সকালটাই আলাদা করে রাখি; চিন্তা করার জন্য, টেনশন করার জন্য। তাই হয়তো চোখদুটো বন্ধ রাখতে পারছি না। চোখ খুলে গেল। তখনই দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ছাদে—যেখানে আয়না থেকে ছিটকে পড়া আলোর প্রতিফলনপ্রতিসরণ মৃদুমন্দ আলো-অন্ধকারে কয়েকটি অসমাপিকা ক্রিয়াপদের সাহায্যে একরকম অস্ফুটভাব রচনা করে চলেছে সেখানে। শুয়ে শুয়ে এই খেলা দেখতে ভালোই লাগছে।
চট করে শেভিং শেষ করে নিল জাবেদ। হাতমুখ ধুয়ে গায়ে একটি গেঞ্জি চাপিয়ে তার ওপর শার্ট চেপে টাই পরতে শুরু করল। তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, টাই-আপ করতে তোমার কি কোনও অসুবিধে হয়?
তার ভাষায় একসেন্টে আছে। মায়ের ভাষা যেমন শিখেছে তেমনই তার বাবার জন্মস্থান শ্রীহট্টেও অনেকদিন বসবাস করেছে। স্বরে যুবকসুলভ উগ্রতা নেই। নম্র ও ভদ্র। তার কথার উত্তরে বলি, এয়ারফোর্সে বারোটা বছর বাধ্যতামূলক টাইকে টাইট করতে হয়েছিল।
চলবে…