
নিঝুম দ্বীপে
আমরা এখন কর্ণফুলীতে ভেসে চলেছি। ঢেউগুলো ছোট থেকে বড় হচ্ছে। জাহাজখানি নদীর মোহনা ধরে সাগর অভিমুখে যাত্রা করেছে। আমরা যাচ্ছি নিঝুপ দ্বীপে। নামটার মধ্যেই কেমন শান্ত, স্নিগ্ধতা, নিরবতা। আমরা প্রায় এক যুগ পূর্বের শান্ত, নির্জন ও কোলাহলবিহীন এক নিঝুম দ্বীপের কথা বলছি। খুব বেশি মানুষের যাতায়াত শুরু হয়নি। সুন্দর একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ দ্বীপ। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এই দ্বীপ দারুণ রোমাঞ্চের হাতছানি দিয়ে ডাকলেও এখনো পর্যটনের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেনি। নিঝুম দ্বীপে পর্যটনের জন্য ভাল যাতায়াত ব্যবস্থা, হোটেল-মোটেল, নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল। যদিও নিঝুম দ্বীপে রয়েছে সমুদ্র বিধৌত বন অর্থাৎ ম্যানগ্রোভ বন। রয়েছে হরিণ, বানর এবং আরো নানা বন্যপ্রাণী। নিঝুমদ্বীপে জেগে উঠছে বিশাল এক ভূ-খন্ড। যেন আরেক বাংলাদেশ। ভ্রমণসঙ্গী বন্ধু টিটু এবং বাকি মিলে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার জন্য একটা দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলি। এবারও সাথে যুক্ত হন ইউসুফ ভাই।

নিঝুম দ্বীপ কোন পথে?
পথ একাধিক থাকতে পারে। তাই যে কোন যাত্রার পূর্বে পথ ঠিক করে নেয়াটা জরুরী। ঢাকা থেকে তিনভাবে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায়। একটি হচ্ছে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে জাহাজে চড়ে হাতিয়া ও হাতিয়া থেকে ট্রলারে নিঝুম দ্বীপ। আরেকটি পথ হচ্ছে ঢাকা থেকে নোয়াখালী হয়ে। তৃতীয় পথ সবচাইতে সহজ পথ ঢাকার সদরঘাট থেকে সরাসরি লঞ্চে চড়ে হাতিয়া। হাতিয়া থেকে নিঝুম দ্বীপ। এখন আমরা সহজ পথ ছেড়ে অপেক্ষাকৃত ঘুরপথে যাচ্ছি কেন? মূলত চট্টগ্রাম থেকে খানিকটা সমুদ্রযাত্রার স্বাদ নিতে চাই। গভীর সমুদ্রে বড় জাহাজে যাওয়ার কখনো সুযোগ হয় কীনা, তাই একটু দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো বলা যায়। এছাড়া আমাদের এক বন্ধু চট্টগ্রাম হয়ে জাহাজে করে হাতিয়া ঘুরে এসে জাহাজযাত্রার যে চমৎকার বর্ণনা দিলেন, সেটাও আমাদের দারুণ আগ্রহী করে তোলে। আমরা ফিরব না হয় অন্য পথে।
ঢাকা থেকে রেলযোগে দুপুরে যাত্রা শুরু করে রাতে রাতে আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছে যাই। স্টেশন সংলগ্ন একটি হোটেলে আমরা রাত্রি যাপন করি। সমুদ্র যাত্রার জন্য ভোর সকালে বের হতে হতে হবে। তাই যতটা পারা যায় আগেভাগেই রাতের খাবার সেরে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।
শুরু হয় সমুদ্র যাত্রা!
সকাল ৮টায় চট্টগ্রামের সদরঘাটের বিআইডব্লিউটিসি ঘাটে পৌঁছে যাই। খুব ব্যস্ত একটি ঘাট। ব্যস্ততা মূলত হাতিয়াগামী জাহাজ বারো আউলিয়াকে কেন্দ্র করেই। মধ্যম আকৃতির একটি জাহাজ। এর মধ্যে একাধিকবার ঢাকার সদরঘাট থেকে বরিশালগামী বিশাল বিশাল লঞ্চে চড়েছি। মধ্যম আকৃতির হলেও বারো আউলিয়াকে সত্যিকার অর্থে জাহাজই মনে হচ্ছে। এটি সাপ্তাহে দুই দিন শনি ও বুধবার সন্দ্বীপ ও হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আবার হাতিয়া থেকে রবি ও বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে একই সময়ে অর্থাৎ সকাল ৯টায়। আমরা চট্টগ্রাম সদরঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে প্রথমে বন্দর এলাকা, তারপর ইপিজেড অতিক্রম করে এসেছি। দূরে দেখা যায় পতেঙ্গা বীচ। ইতোমধ্যে কর্ণফুলী নদীর মোহনা অতিক্রম করে আমরা সমুদ্রের দিকে যাচ্ছি। যাত্রীতে বোঝাই গোটা জাহাজ। আমরা যখন নদী থেকে সাগরে প্রবেশ করছিলাম তখন ঘোলা পানি ও পরিষ্কার নীল পানির পৃথক প্রবাহ দেখা গেলা। ঔৎসুক যাত্রীরা রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই বৈচিত্র্য দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দূরে বিশাল বিশাল কয়েকটি সমুদ্রগামী জাহাজ দেখতে পাই। এগুলো বিদেশী জাহাজ। চট্টগ্রামের বন্দরের গভীরতা কমে যাওয়ায় এগুলো বহির্নোঙ্গরে অবস্থান করছে। ছোট ছোট লাইটার জাহাজে করে মালামাল তখন আনা নেয়া করা হয়। আমরা ধীরে ধীরে কর্ণফুলী নদীর মোহনা অতিক্রম করে সমুদ্রের দিকে যাচ্ছি। আমি নীল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম সমুদ্র, সমুদ্র বন্দর, ছোট-বড় জাহাজ, সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য জেলেদের দীর্ঘ আয়োজন এসব কিছুর মধ্যেই একটা বিশালতা রয়েছে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞ দেখা যায় সমুদ্রের কাছে এলে। বিশাল সব নির্মাণ চোখে পড়ে। আবার প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞও খুব বিশালভাবে আঘাত হানে সমুদ্র বিধৌত অঞ্চলেই। আমার ভাবনার ছেদ পড়ে বন্ধু টিটুর গানে। হঠাৎ করেই সে গেয়ে গেয়ে উঠে ‘ওরে নীল দরিয়া আমায় দে রে দে ছাড়িয়া।’ আমরা ততক্ষণে দিগন্ত বিস্তৃত নীল দরিয়ায় প্রবেশ করেছি।।

ঋতুর পালাবদলে শীত প্রায় বিদায় নিয়েছে। রোদ্রের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা জাহাজের ছাদ থেকে নিচে ডেকে নেমে আসি। যাত্রীতে পরিপূর্ণ প্রতিটি আসন। চা, নাস্তা, পান, সিগারেট থেকে ভাতের ব্যবস্থা পর্যন্ত রয়েছে লঞ্চের দীর্ঘ যাত্রা পথে। হকাররা নানা রঙ বেরঙের পসরা সাজিয়ে হাঁকডাক, দৌঁড়াদৌঁড়ি করে বাদাম, চানাচুর, চকলেট, বরই, ডাব ইত্যাদি বিক্রি করছে। তাদের বিচিত্র পণ্যের বিচিত্র শব্দ করে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা জাহাজের একতলা, দোতলা ও তিনতলা সরগরম হয়ে উঠে। কয়েক ঘন্টার জন্যে বারো আউলিয়া জাহাজটি তৈরী করেছে তার এক নিজস্ব জগত। আপাতত এই জগতের সাথে মূল ভূ-খন্ডের কোন সম্পর্ক নেই।
যাত্রা বিরতি সন্দ্বীপে
বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন চট্টগ্রাম থেকে হাতিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে প্রথমে যে বড় দ্বীপটি পড়বে সেটিই সন্দ্বীপ। সন্দ্বীপ এক সময় নোয়াখালীর অন্তর্গত একটি থানা ছিলো। এখন চট্টগ্রামের অন্তর্গত। আমাদের বারো আউলিয়া সন্দ্বীপ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বেলা ১টার দিকে এখানে নোঙ্গর করে।সন্দ্বীপে নির্দিষ্ট ঘাট না থাকায় নোঙ্গর করতে হয় বেশ দূরে। ট্রলার বা ছোট নৌকাযোগে যাত্রীরা ঘাটে গিয়ে উঠছেন। সন্দ্বীপের অনেক মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরী করেন। লঞ্চে উঠেই তাদের লক্ষ্য করেছি । সুটকেস আর বাক্সপ্যাটরা নিয়ে তারা অনেক কষ্ট করে সন্দ্বীপের ঘাটে গিয়ে উঠেন। জীবিকার প্রয়োজনে দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে মানুষকে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় দেশ থেকে দেশান্তরে। এই মানুষগুলোর রক্ত-ঘাম ঝরা টাকায় বাংলাদেশের চাকা সচল থাকে।
সন্দ্বীপে কতক্ষণ যাত্রা বিরতি এটা জানতে গিয়ে জানা গেলো নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। যাত্রী নামতে ও উঠতে যতক্ষণ লাগে। বন্ধু বাকি’র কাকাবাবু মুজাফফর আহমদ এবং কবি আব্দুল হাকিমের স্মৃতি বিজড়িত সন্দ্বীপের মাটি ছুঁয়ে দেখার ভীষণ ইচ্ছে। সে ট্রলারযোগে সন্দ্বীপের ঘাটে গিয়ে এক পাক খেয়ে চলে আসে। তার ইচ্ছে ছিলো থানা শহর অবধি যাওয়ার। যা ঘাট থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। কিন্তু যেহেতু বারো আউলিয়া কর্তৃপক্ষ কোন নির্দিষ্ট সময় দিতে অপারগ, তাই বন্ধুটি সন্দ্বীপের মাটি ছুঁয়েই সন্তুষ্ট থাকে! কখনো কখনো আমাদের অনেক সাধের ইচ্ছেকে অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়! না হলে বিপদ।
এবার গন্তব্য হাতিয়া
প্রায় ঘন্টাখানেক সন্দ্বীপে অবস্থান করে বারো আউলিয়া তার শেষ গন্তব্যস্থল হাতিয়ার উদ্দেশ্যে আবার যাত্রা শুরু করে। ততক্ষণে আমরা লঞ্চের ডাইনিং রুমে দুপুরের খাবার সেরে এসেছি। দীর্ঘ যাত্রা জনিত ক্লান্তিতে কেউ কেউ ঘুমিয়ে আছে। কারো তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব। কেউ শুধুই চোখ বুঁজে আছে। বেলা সাড়ে ৪টা নাগাদ হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে পৌঁছাবে জাহাজখানি। আমি ইতোমধ্যে বারো আউলিয়ার টিকেট মাস্টার ও আরো দু’একজন কর্র্মচারীর কাছ থেকে এই জাহাজের সময়সূচী, রুট ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য জেনে নেই। ফিরতি পথে কীভাবে কী রুট ব্যবহার করব সে সম্পর্কে আগাম তথ্য নিয়ে রাখি।
জাহাজটির সম্মুখভাগে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করি, দিগন্ত বিস্তৃৃত জলরাশি। অসংখ্য গাঙ্গচিলের ওড়াউড়ি। সবুজ একটি তটরেখা দেখে বয়স্ক একজন যাত্রীর কাছে জানতে চাইলাম কোন চর নাকি চাচা? তিনি বললেন, ওটাইতো হাতিয়া! তখন ঘড়িতে বিকেল চারটা। সবুজ তটরেখা ধীরে ধীরে আমাদের আরো কাছে চলে আসে। যাত্রীদের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। নলচিরা ঘাট আর বেশী দূরে নয়। আমরা আমাদের ব্যাগ-পত্তর গুছিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। এখানেও সন্দীপের মতো ট্রলারে চড়ে ঘাটে যেতে হবে। জাহাজ নোঙ্গর করার মত জেটি নেই। জেটি হবেই’বা কী করে। প্রতি বৎসর হাতিয়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। মূল হাতিয়ার থানা শহর ছিলো নলচিরা ঘাটের দিকে অর্থাৎ উত্তর দিকে। এখন তা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হাতিয়ার বয়স্ক একজন কৃষক জানালেন, গত ত্রিশ বৎসরে হাতিয়ার বেশিরভাগই বিলীন হয়ে গেছে। অবশ্য অন্যদিকে জাগছে বিশাল চর। যাকে বলা হচ্ছে আরেক বাংলাদেশ। কথায় বলে নদীর একুল ভাঙ্গে, ওকুল গড়ে, এইতো নদীর খেলা! এটা প্রকৃতিরই একটি খেলা। কিন্তু আমাদের দেশের সরকারগুলোর লুটপাট ও অবহেলার কারণে এটি ভয়ংকর এক খেলায় পরিণত হয়। এখানে যেন শুধুই ভাঙ্গারই আয়োজন। গড়ার প্রচেষ্টা নেই।
হাতিয়ার রাত
রাজধানীবাসীকে সুস্থ বাতাস উপহার দেওয়ার জন্য ঢাকা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল টু-স্ট্রোক বেবীট্যাক্সী। যেগুলো থেকে পরিবেশ দূষণকারী ধোঁয়া নির্গত হত। এগুলো এখন গ্রামে-গঞ্জে, দ্বীপ-দ্বীপান্তরে নির্বাসিত হয়েছে। উপকুলীয় দ্বীপ হাতিয়াতে টু-স্ট্রোকের ধোঁয়া এবং প্রচন্ড শব্দ শুনে ভাবছিলাম শহরের জঞ্জাল গ্রামবাসীকে কতকাল সহ্য করতে হবে? নলচিরা ঘাট থেকে আমাদের ওশখালী যেতে হবে। প্রায় দশ কিলোমিটার পথ। ভাড়া জনপ্রতি পড়বে ২০ টাকা। কিন্তু রাস্তার অবস্থা ভয়ানক খারাপ। রাস্তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে নয়, চাঁদের দেশে বেড়াতে এসেছি। হয়ত চাঁদের অবস্থা এর থেকেও ভাল। এলাকাবাসীর কাছে শোনা গেল সেই যে এরশাদের সময়ে রাস্তা নষ্ট হয়েছিলো আর মেরামত করা হয়নি! পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক সরকারগুলো’ কেউই তখন পর্যন্ত নেক নজর দেয়নি হাতিয়াবাসীর দিকে!
হাতিয়া থানার কেন্দ্রস্থল হচ্ছে ওশখালী। শান্ত, নির্জন একটি থানা হাতিয়া। আয়তনে নোয়াখালীর বৃহত্তম থানা । হাতিয়ার চারপাশে সমুদ্র আর নদীর বিপুল জলরাশি। হাতিয়া দ্বীপটিকে ঘিরে রয়েছে প্রাকৃতিক সবুজ বেষ্টনী। এই সবুজ বেষ্টনী ঝড় জলোচ্ছাস আর সাইক্লোন থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে। এককালে হাতিয়া ছিল পর্তুগীজ জলদস্যুদের অবসর যাপনের কেন্দ্র! কোথায় পূর্তগাল, কোথায় বাংলা। সাহস ছিলো এই দস্যুদের। কেউ বানিজ্যের নামে দস্যুবৃত্তি আবার কেউ দস্যুতার জন্যই দস্যুবৃত্তি করেইতো সম্পদ গড়ে তুলেছে সারা দুনিয়ায়। ব্রিটিশরা এসেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নিয়ে বানিজ্যের নামে দস্যুতা করতে। পর্তুগীজরা সরাসরিই আসে দস্যুতা করার জন্য। দুটোই দস্যুতা।

আমরা রাত্রি যাপনের জন্যে বেছে নিই মনির চেয়ারম্যানের বোর্ডিং। যার আরেকটি অফিসিয়াল নাম হচ্ছে সালমা গেস্ট হাউজ। এই গেস্ট হাউজের ম্যানেজার খুব করিৎকর্মা লোক। তিনি নিজ হাতে আমাদের বিছানা-পত্তর সব ঠিকঠাক করে দিলেন। হোটেলের ভাড়া একদম নাগালের মধ্যে। রুমের আয়তন ভেদে ডবল তখন ডবল বেড ছিল ১২০ ও ১৫০ টাকা। সন্ধ্যাবেলা আমরা কলেজ এলাকা, বাজার এলাকা ঘুরে বেড়াই। একটি রেস্টুরেন্টে আমরা রাতের আহার গ্রহণ করি। আহার শেষে মহিষের সেই বিখ্যাত টক দই খেলাম। স্বাদটা অতি সুস্বাদু। হাতিয়ার মানুষের মূল পেশা মাছ ধরা এবং কৃষিকাজ। এখানে নারিকেল, সুপারি এবং পানের ব্যাপক চাষ হয়। হোগলা পাতাও প্রচুর পরিমাণে জন্মে। হাতিয়ায় মহিষের দইতো বিখ্যাত। হাতিয়া-নিঝুম দ্বীপ বেড়াতে গেলে ভ্রমণকারীদের খাদ্য তালিকার অন্যতম আকর্ষণ মহিষের টক দই।
রাতে হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে নিঝুপ দ্বীপ যাওয়ার বৃত্তান্ত আরেকবার জেনে নেই। সকালে ওশখালী থেকে জীপ ছেড়ে যায় জাহাজমারার উদ্দেশ্যে। জাহাজমারা নামটা কেমন অদ্ভূত লাগে! নিশ্চয় কোনকালে বড়োসড়ো কোন জাহাজ ডুবে গিয়েছিলো ঐ স্থানে? তাই ঘাটের নাম জাহাজমারা? নামের তত্ত্বতালাশ পরে হবে। আবার আমাদের ভ্রমণসূচীতে ফিরে আসি। জাহাজমারা থেকে রিক্সাযোগে যেতে হবে মোক্তারিয়া ঘাট। সেখান থেকে ট্রলারে নিঝুম দ্বীপ। মোটামুটি আরেকটি দীর্ঘ যাত্রার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আমরা ক্লান্ত শরীরে রাতে ঘুমুতে যাই। অবশ্য আমাদের ইউসুফ ভাই তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে সাবধান করে দেন ‘ভালো করে খোঁজ-খবর নে। রাস্তাঘাটের অবস্থা বেযুইত হলে আমি যাবো না…।’ আমরা আর কী বলবো। আমরাওতো নতুন। হোটেলের ম্যানেজার বললো ‘যেতে পারেন স্যার, রাস্তা অত খারাপ নয়।’ আবু ইউসুফ সাহস সঞ্চয় করে বলেন ‘চল, মওলা মালিক।’
জীব বৈচিত্র্যের সন্ধানে
সে বহু বছর আগের কথা। ১৯৬৬-৬৭ সালের দিকে আমেরিকার স্পারসো উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি থেকে জানা যায় বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরে জেগে উঠছে একটি বিশাল দ্বীপ। তারও আগে ষাটের দশকের শুরুতে হাতিয়াবাসী মেঘনা মোহনা থেকে একটু দূরে বিশাল একটি চরের অস্তিত্ব বুঝতে পারেন। নিঝুমদ্বীপের পূর্ব নাম চর ওসমান। হাতিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে চর ওসমান বা নিঝুম দ্বীপের অবস্থান। ১৯৬৮ সালে এই দ্বীপে হাতিয়ার নদীভাঙ্গা কয়েকশ পরিবার প্রথম বসতি স্থাপন করেন। কিন্তু প্রকৃতির রদ্র রোষের ভয়াবহ শিকার হন বাংলাদেশের উপকুলীয় মানুষ ১৯৭০ সালে। তখন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এই দ্বীপের মানুষজন। সকল আবাসভূমি। আবার বিরান ভূমিতে পরিণত হয় চর ওসমান। আজকের নিঝুম দ্বীপ।
সরকার এই দ্বীপকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে রোপন করা হয়েছে ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ। হরিণ, অজগর ইত্যাদি প্রাণীগুলো বন্য পরিবেশে বেড়ে উঠেছে এই দ্বীপে। আবারো গড়ে উঠেছে খেটে খাওয়া মানুষের বসতি। বর্তমানে মোট জনসংখ্যা বিশ হাজারের অধিক। হাতিয়ার চরচেঙ্গা বাজার, জাহাজমারা কিংবা নোয়াখালীর চর জব্বার থেকে নিঝুম দ্বীপে সরাসরি ট্রলারযোগে যাওয়া যায়। নিঝুম দ্বীপ হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি ওয়ার্ড।
নিঝুম দ্বীপে দেখার রয়েছে অনেক কিছু। এরমধ্যে পর্যটকদের কাছে সবচাইতে বড় আকর্ষণ হচ্ছে হরিণ। একজন বন কর্মকর্তা জানালেন, বর্তমানে বিশ হাজারের অধিক হরিণ রয়েছে এই বনে। মানুষ আর হরিণের অনুপাত সমান। অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে বানর, বন মোরগ ও বন্য মহিষ রয়েছে নিঝুম দ্বীপের জঙ্গলে। এছাড়া সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর মধ্যে অজগর, গুইসাপ ও বিভিন্ন প্রকারের বিষধর সাপ রয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানালেন, একটি দ্বীপ নাকি আছে, যেখানে শুধুমাত্র বিষধর সাপখোপের বসবাস। এই তথ্য কতটুকু নির্ভরযোগ্য তা জানা যায়নি। নিঝুপ দ্বীপের বনাঞ্চল মূলত কেওড়ার বন। এছাড়া গেওয়া, বাইন, জামরুল ইত্যাদি বৃক্ষও রয়েছে এখানে। হরিণ, বানর, অজগর সাপ ইত্যাদি বনবিভাগ কর্তৃক ছাড়া হয়েছে। সুন্দরবন গেলে লক্ষ্য করা যায় জীব বৈচিত্র্যের পাশাপাশি শত শত নদ-নদী আর খালের ছড়াছড়ি। নিঝুম দ্বীপের আশেপাশে জীব বৈচিত্র্যের পাশাপাশি রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় দ্বীপের সমাহার। জঙ্গলঘেরা কেরিং চর, দমার চর, ঢাল চর, চর মনপুরা সহ আরো বহু ছোট বড় দ্বীপ দেখতে পাবেন এখানে এলে। বর্ষাকালে বঙ্গোপসাগর হয়ে ওঠে ভয়ানক উত্তাল। নিঝুম দ্বীপের লাগোয়া দমার চর এর অর্থ হচ্ছে বড়ো ঢেউয়ের চর। বর্ষায় এই চরের উপর দিয়ে বয়ে যায় বিশাল বিশাল ঢেউ। তাই এর নাম দমার চর। আশেপাশের সবগুলো দ্বীপেই ম্যানগ্রোভ বৃক্ষে পূর্ণ। সবমিলিয়ে নিঝুম দ্বীপ প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম একটি আদর্শ স্থান হতে পারে।

মৃত্যুর হিম শীতল পরশ
হাতিয়ার কেন্দ্র ওশখালী থেকে আমরা প্রায় ২৫ কি.মি. দূরে জাহাজমারা যাই জীপ বা চাঁদের গাড়িতে। জাহাজ মারা থেকে জোয়ার ভাটা ধরে মাছের ট্রলারে অথবা রিজার্ভ ট্রলারে নিঝুম দ্বীপের মূল কেন্দ্র নামার বাজার যেতে হবে। আমরা জাহাজমারা পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভাটার টান শুরু হয়ে গেছে। আবার জোয়ার আসতে আসতে সন্ধ্যা। স্থানীয় এক মুরুব্বী আমাদের বিকল্প পথ বাতলে দেন। জাহাজমারা থেকে রিক্সা করে মোক্তারিয়া ঘাটে গেলে একটি চ্যানেল পাড়ি দিলেই নিঝুম দ্বীপ। এক্ষেত্রে আমাদের নিঝুম দ্বীপে নেমে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আরো ৭ কি.মি. হেঁটে যেতে হবে কেন্দ্রস্থল নামার বাজার। তো অসুবিধা কী? জঙ্গলে ৭ কি.মি. হাঁটা কারো জন্যেই বিশেষ সমস্যা হবে বলে মনে হলো না। ইউসুফ ভাইয়ের জন্যেতো নয়ই। তিনি ঢাকার রাস্তায় পারতপক্ষে যানবাহন ব্যবহার করেন না। তার হাঁটাহাঁটির মাত্রা দেখে মাঝে মাঝে ঢাকা শহরকে ছোট্ট একটি ‘মফস্বল শহর’ বলে মনে হয়। তো সেই বন্ধুটি এই ৭ কি.মি. কেন তিনিতো আমরা রাজী থাকলে ওশখালী থেকে হেঁটেই নিঝুম দ্বীপে চলে আসতেন। ভয়াবহ উৎসাহী লোক! শুধুমাত্র যানবাহনের ধকলটা মাঝে মধ্যে তাকে কাবু করে ফেলে।
আমরা তখন মোক্তারিয়া ঘাট থেকে একটি বড় চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার জন্য ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে বসেছি। ঠাই নাই, ঠাই নাই ছোট সে তরী। মানুষজন কানায় কানায় পরিপূর্ণ হওয়ার পর যাত্রা শুরু হলো। মানুষজন ছাড়াও পশুপাখি, ছাগল-মুরগী, আসবাবপত্র, নিত্যপ্রয়োজনীয় সবই উঠল। আমাদের ইউসুফ ভাই তার লাইফ জ্যাকেটটি পরবেন কিনা ইতস্তত করছিলেন। আমি বললাম, আরে ভাই পরে ফেলুন। বিপদ আপদের কথাতো বলা যায়না? একজন হলেওতো রক্ষা পেলেন! তিনি আর দেরী করলেন না। গোটা ত্রিশেক যাত্রীর মধ্যে একজনের গায়ে কটকটে কমলা রঙের একটি লাইফ জ্যাকেট চাপাতে দেখে বয়স্ক একজন কৃষক হাসতে হাসতে বলেই ফেললেন, মিয়া ভাই, আমাদের রেখে আপনি একা বাঁচতে চান? কী লাভ বলুন এই দুনিয়ায় বেঁচে থেকে ইত্যাদি দার্শনিক ধরণের কথাবার্তা। চাচা মিয়ার কথায় আমরা নৌকার সবাই হেসে উঠি। শুধু হাসেন না ইউসুফ ভাই।
অবশেষে যাত্রা শুরু হলো। চ্যানেলটি একেবারে ছোট নয়। শীতকালে ঢাকার সদরঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা নদী যতবড় দেখা যায় ঠিক তত বড়। আমরা বেশ রোমাঞ্চিত। একটু পরেই আমরা আমাদের কাঙ্খিত দ্বীপে পা রাখতে যাচ্ছি। আমাদের নৌকাখানি ধোঁয়া উড়িয়ে, ভটভট শব্দ সৃষ্টি করে এগিয়ে চলেছে। নৌকাটি যখন চ্যানেলের প্রায় মাঝামাঝি, বলা যায় মাঝ নদীতে, এমন সময় এক ঝটকায় কাত হয়ে উল্টে যাওয়ার উপক্রম হলো। সকলের মাঝে ভীতিকর এক অস্ফূট শব্দ বেরিয়ে এল, ‘কী হলো?’ কয়েকজন সমস্বরে ‘লা ইলাহা ইলাল্লাহু’ পড়ে ফেললেন! আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাঝি তড়িৎ গতিতে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। নৌকাটি ততক্ষণে সোজা হয়ে গেছে। বিপদ কেটে গেছে বলে মনে হলো। কী ব্যাপার, ঘটনাটা কি? মাঝি জানায়, দীর্ঘ বেষ্টনী দিয়ে রাখা মাছ ধরার জালে নৌকা আটকে গেছে। মাঝি এই বেষ্টনী জাল খেয়াল করেনি! যাত্রীরা হুড়োহুড়ি না করায় নৌকাটি ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। আমরা প্রায় ত্রিশটি প্রাণী সলিল সমাধির হাত থেকে রক্ষা পাই। কারণ নৌকাটি ছিল চ্যানেলের ঠিক মাঝখানে। উল্টে গেলে এর নিচেই অনেকের সলির সমাধি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বেঁচে থাকার আনন্দে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস গ্রহণ করি। তখন আমরা অনেকেই এক দৃষ্টিতে আমাদের ইউসুফ ভাইয়ের কটকটে কমলা রঙের লাইফ জ্যাকেটের দিকে তাকিয়ে থাকি। যদিও নৌকা ডুবলে তারও শেষ রক্ষা হতো কিনা সন্দেহ। কারণ বাঁচার জন্যে একসাথে অনেকে তাকে ঝাপটে ধরলে পরিস্থিতি কী হতো বলা বড় মুশকিল।
পায়ের চিহ্ন নিঝুম দ্বীপে
শুরু হলো সমতল ভূমিতে ট্রেকিং। বেলাভূমিতে ট্রেকিং। স্বপ্নের নিঝুম দ্বীপের জঙ্গলে ট্রেকিং। সিডিএফসি ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে বন্দরটীলা নামক একটি ছোট্ট বাজারে চা বিরতি। আমরা খোঁজ করি ডাক্তার সাহেবকে। যার মাধ্যমে আমাদের নিঝুম দ্বীপে থাকার ব্যবস্থা হবে। ডাক্তার সাহেবের খোঁজ দেন আমাদের এক বন্ধু। যিনি দীর্ঘদিন নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া এলাকায় ব্যবসায়িক কারণে থেকে গেছেন। জানা গেল রেস্ট হাউজ খালি আছে। যাক, আবাসন সমস্যার সমাধান হলো। ঠা ঠা রোদ্দুরে ক্লান্তিটা একটু বেশিই লাগছে সবার। তাই কিছুটা পথ পাড়ি দেওয়ার জন্যে রিক্সা নিলাম। মাইল দুয়েক রিক্সায় চড়ার পর আর পথ নেই। এরপর ডান পাশে জঙ্গল। বামদিকে ধু ধু চরাঞ্চল। দূরে বঙ্গোপসাগর। এইদিকেই জেগে উঠছে আরেক বাংলাদেশ। আমরা জঙ্গল ধরে নিঃশব্দে হাঁটতে লাগলাম। ইস্, যদি হরিণের দেখা মেলে। অনেকদূর যাওয়ার পর থামতে হলো। স্থানীয় এক লোক জানালেন আমরা ভুল পথে চলে এসেছি। নামার বাজার যেতে হলে ডানদিকের পথ ধরতে হবে। জঙ্গল থেকে রাস্তায় উঠে আরো মাইল দুয়েক হাঁটার পর দূরে টিনের চালার কয়েকটি ঘর দেখতে পেলাম। বুঝলাম নামার বাজার এসে গেছি। প্রায় ৫ কি.মি. হেঁটে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর। নামার বাজার ঢোকার মূহুর্তে একটি সুঠামদেহী তরুণ এগিয়ে আসে আমাদের দিকে। এসে বলে ‘কেমন আছেন? আমি ভেবেছি এই সিজনে আর পর্যটক আসবে না, চলুন আমার সাথে।’
তরুণের নাম আলতাফ হোসেন। নামার বাজারে তার খাবার রেস্টুরেন্ট এবং বোর্ডিং আছে। জানতে চাই কী ব্যাপার, আমরা যে আসবো আপনি জানলেন কী করে? আলতাফ জানায়, আমরা যে নৌকায় এসেছি তার কয়েকজন যাত্রী আগে এসে খবর দিয়েছে। খুবই অবাক হই নিঝুম দ্বীপের আলতাফের এই পর্যটন মানসিকতার পরিচয় পেয়ে। পরবর্তীতে আলতাফের আতিথিয়েতায় আমাদের মনে হয়েছে নিঝুম দ্বীপ এক সময় সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মতো পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠলে আলতাফ একজন ভালো স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী হবে। ততদিন অবশ্য আলতাফকে টিকে থাকতে হবে। নিঝুম দ্বীপকেও পর্যটন-বান্ধব অঞ্চল করতে হবে।
ভ্রহ্মাণ্ড রোদে জ্বলছে। আমরা ক্ষিধায় জ্বলছি। তাই সময় নষ্ট না করে বিশাল বিশাল বোলে ভাত, তরকারী, চেওয়া মাছ, সব্জী যা ছিলো গোগ্রাসে গিলতে থাকি। রাতের আহারের আগাম অর্ডার নিয়ে নেয় আলতাফ। আলতাফকে জিজ্ঞেস করি ‘রান্না-বান্না কোথায় হয়?’ জবাবে আলতাফ জানায়-‘বাড়িওয়ালী সব রেঁধে দেন।’ বাঃ, কী চমৎকার বোঝাপড়া। রান্নার মতো গুরু দায়িত্ব স্ত্রীর, আলতাফ বাদবাকি সামলাচ্ছে। আলতাফের রেস্টুরেন্টের কাছেই আমাদের জন্যে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। আমরা সেখানে উঠলাম।

নিঝুম দ্বীপের নিঝুম রাত
সী বীচের সন্ধানে যেতে যেতে সন্ধ্যা নামে। নিঝুম দ্বীপের নিঝুম সন্ধ্যা। নিঝুম দ্বীপে আমরা মাত্র চারজন পর্যটক! বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করি। দূরে দেখা যায় আবছা আলোয় ঘন কালো একটি চর। এটি চর মনপুরা। এটি ভোলার একটি থানাও বটে। আমরা রাত হওয়ার পূর্বেই ডেরায় ফিরে আসি। শহুরে মানুষের খুব বেশি নিস্তব্ধতাও অস্বস্তিকর লাগে। না পেতে পেতে অমৃতে অরুচি ধরে গেছে আমাদের! তাই সর্বত্র গরল চাই। হারিয়ে যাচ্ছে সহজ সরল সবকিছু।
ডাক্তার সাহেবের ছোট ভাই মিরাজ। তিনিই ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার। সবকিছু গুছিয়ে রেখেছেন তিনি। দোতলা ডাকবাংলো। সাইক্লোন ও জলোচ্ছাস থেকে সুরক্ষার জন্য নিচে শুধু পিলার। এই অঞ্চলে স্কুল, কলেজ, সরকারি স্থাপনা সবই সাইক্লোন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এক একটা সাইক্লোন সেন্টার। বন বিভাগের এই ডাকবাংলোয় মোট কক্ষ ৪টি। ভাড়া জনপ্রতি প্রতি ৪০ টাকা। বিদুৎ নেই। যদিও নামার বাজারের ব্যবসায়ীরা রাত ১০টা পর্যন্ত বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছেন জেনারেটরের মাধ্যমে। হাতিয়াতে রাত ১টা পর্যন্ত বিদুৎ থাকে। সেটাও স্থানীয়ভাবে জেনারেটরের সাহায্যে উৎপাদিত। দ্বীপবাসী ধরেই নিয়েছেন, সেই সময়ে সারা দেশে যখন বিদুৎ নেই, চারিদিকে হাহাকার, ক্ষােভ-বিক্ষোভ সেখানে এই বিচ্ছিন্ন ভূ-খন্ডে বিদ্যুৎ চাওয়া দৃষ্টতামাত্র। হারিকেনের আলোতেই চার বন্ধুর বিচিত্রি বিষয়ে আড্ডা চলে। চলে জীবন যাপনের নানা দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকট নিয়ে আলোচনা। আলোচনার বিষয় ধরে পর্যালোচনা। সমুদ্র আর প্রকৃতির মাঝে এলে নাকি মানুষ দার্শনিক হয়ে উঠে। আমরাও তাই হয়ে উঠেছিলাম। রাতে ছোট ছোট কয়েকটি ছেলেমেয়ে আসে হরিণের শিং নিয়ে। পর্যটকদের কাছে ওরা এগুলো বিক্রি করে।
নিঝুম দ্বীপের বাদাবনে
সকালে নাস্তা সেরে সমুদ্র সৈকত অভিমুখে যাত্রা করি। এত কাছে থেকে সাগর স্নান না করলে কী চলে? যদিও নিঝুম দ্বীপের অবস্থান বেশীর ভাগ মোহনা জুড়ে। নদী ও সমুদ্রের মিলনে এখানে যেন কাদার মাখামাখিটা একটু বেশি। সাগরের দিকে যেতে পথে পড়লো শুঁটকি আর শুঁটকি। এগুলো চেঁওয়া মাছের শুঁটকি। সমুদ্র বা নদীর ধারে শুঁটকিগুলো পোলট্রি ফিড হিসাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। আমরা একটি ‘শুটকির পাহাড়ে’ উঠে ছবি তুলি। তখন ভাটা চলছে। বীচের কিনারায় একটি গাছের তলায় দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকি জোয়ারের। অবশেষে মধ্যাহ্নে জোয়ার আসে। পানিতে নেমে দীর্ঘ সমুদ্র স্নান শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ডাক বাংলোয় ফিরে আসি। আমাদের স্থানীয় গাইড ইব্রাহীম সবসময় আমাদের সাথেই ছিলো।
দুপরের খাবার শেষে আমরা নিঝুম দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ হরিণ দেখতে বের হই। ইব্রাহীম একটি বৈঠার নৌকাও জোগাড় করে ফেলে। মাঝি একজন নয় দুজন। এরাও ইব্রাহীমের মতোই ছোট্টটি। কিন্তু দুষ্টুমিতে আর অতুলনীয়। আমাদের নৌকা ছোট একটি খাল ধরে ম্যানগ্রোভ বনের ভেতর প্রবেশ করে। দুই দিকে নিরব নিস্তব্ধ কেওড়ার বন। মনে হলো যেন সুন্দরবনের সরু খাল দিয়ে যাচ্ছি। খুব কসরত করে ক্ষুদে মাঝিরা এক জায়গায় নৌকা ভিড়িয়ে আমাদের নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করে। জঙ্গলে ঢুকেই দূরে খোলা জায়গায় শত শত হরিণের দেখা মেলে। শত শত না বলে হাজার হাজার বললেও বাড়াবাড়ি হবে না। এতো হরিণ! জানতে পারি নিঝুম দ্বীপে হরিণ উল্টো এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্বীপবাসীর জন্যে। ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণ এসে মরিচ, আলু, তরিতরকারীর খেত রাতের বেলা সাবাড় করে দিয়ে যায়। পর্যাপ্ত কেওড়া গাছ না থাকায় তীব্র খাদ্যাভাবে ভুগছে প্রাণীগুলো। প্রতিটি ক্ষেতের পাশে কৃষকরা সরু নেট নিয়ে বেড়া দিয়ে রেখেছেন। রাতে কিশোর তরুণরা টিন ড্রাম বাজিয়ে হরিণ তাড়ায়। তারপরও কেউ হরিণ শিকার করে খাওয়ার শখ করে না। অনকে ঝামেলা সহ্য করেও নিঝুমদ্বীপবাসী হরিণ সংরক্ষণে সহযোগিতা করছেন। কিন্তু হরিণগুলো খাবার না পেলে বাঁচবে কী করে? কিছুক্ষণ জঙ্গলের গভীরে হাঁটাহাঁটি করে আমরা আবার নৌকায় উঠে বসি।
ডাকবাংলোর পাশেই বাজার। বাজারের মধ্যে আলতাফের খাবার ঘরই জমজমাট। আলতাফ বিশাল একটি রঙ্গিন টেলিভিশন ও ভিসিডি রেখেছে তার দোকানে। বিটিভি’র খবর ছাড়াও বাংলা ও হিন্দি সিনেমা বিরামহীনভাবে চলছে। লোকজন আসছে যাচ্ছে। কেউ চা পান করছে। কেউ নাস্তা খাচ্ছে। কেউ এমনিতে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আড্ডা দিচ্ছে। কেউ কিছু না খেলেও অসুবিধা নেই। আলতাফ তার জন্যে এতটুকু মনঃক্ষুন্ন হয় না। এই খাবার ঘরের উপরে কাঠের দোতলায় রয়েছে আঠারো জন থাকার মতো একটি বোর্ডিং। আলতাফ আরো দুটি পাকা ঘর ভাড়া নিয়ে রেখেছে আগামী বৎসরের প্রস্তুতি হিসাবে। পর্যটক দিন দিন বাড়ছে। পূর্ব প্রস্তুতি না নিলে চলবে কী করে। আরো দু’একজন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী আলতাফের প্রতিদ্বন্দ্বী উঠছে। তবে সবাই পর্যটক আকর্ষণের জন্য সুন্দরভাবে চেষ্টা করছে। নোংরামি চোখে পড়ে নি। যেমন একটি রেস্টুরেন্টের মালিক আমরা যখন বীচে যাচ্ছি তখন তিনি অত্যন্ত বিনীতভাবে তার রেস্টুরেন্টে একবেলা খাওয়ার জন্যে অনুরোধ করেন। তিনি খাবারের সাথে বাড়তি আকর্ষণ হিসাবে তার একটি বিশেষ ধরণের ‘সালাদের’কথা বলেন। আমরা আলতাফের মায়াজাল থেকে বের হয়ে ভাত খেতে না পারলেও ওই ব্যবসায়ীর হোটেলে সকালের নাস্তা করি। সব মিলিয়ে মনে হয়েছে নিঝুম দ্বীপে চর জাগার মতো পর্যটন ব্যবসাও এক সময় জেগে উঠবে। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণেই নয় এখানকার মানুষের অকৃত্রিম আতিথিয়েতার জন্যেও মানুষ আসবে।
ফিরতি যাত্রা অন্য পথে
আগেই বলেছি নিঝুম দ্বীপে তিনটি পথে যাওয়া যায়। আমরা যেহেতু একটি পথে এসেছি, এবার ফেরার পথ ধরতে চাই অন্য রুটে। হাতিয়ার চরচেঙ্গা বাজার থেকে সী ট্রাকে নোয়াখালী এবং নোয়াখালী থেকে বাসযোগে ঢাকায় ফিরব। সকালের নাস্তা সেরেই আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম। বিদায় নিলাম অপরূপ নিঝুম দ্বীপ এবং বন্ধুবৎসল নিঝুমদ্বীপবাসীদের কাছ থেকে। আজ আমরা হাতিয়াতেই থাকব।
আবার দীর্ঘ পথ হেঁটে বন্দরটীলা। সিডিএফসি ঘাট এবং চ্যানেল পাড়ি দিয়ে মোক্তারিয়া ঘাট। এবার মোক্তারিয়া ঘাট থেকে সরাসরি রিক্সায় চরচেঙ্গা বাজার। দীর্ঘ রিক্সা ভ্রমণ। ভাড়া ৪০ টাকা করে নিয়েছে একেকটি রিক্সা। কিন্তু পথের হিসেবে ভাড়া অনেক কম। পথিমধ্যে একাধিক বিরতি দিয়ে বিকেল নাগাদ চরচেঙ্গা বাজারে আমরা পৌঁছাই। হাতিয়ার চরচেঙ্গায় আমরা যে রেস্টুরেন্টে বিকালবেলা দুপুরের খাবার সারি সেই হোটেলের মালিক আমাদের খুব খাতির যত্ম করেন। নাম কামাল উদ্দিন। স্থানীয় আ.লীগ রাজনীতির সাথে যুক্ত। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই চিরাচরিত বিএনপি বনাম আ.লীগ তীব্র বিতর্ক শুনতে পাই। হোটেলে বসেছিলো স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতা। অত্যন্ত বুদ্ধীদীপ্ত ভাষায় স্যাটায়ার করে একে অন্যকে সমালোচনা করছিলেন তারা। যা এই সময়ে খুব বিরল। তো এই রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কামাল ভাইয়ের সাথে আমাদের বেশ ভাব হয়ে যায়। অবশ্য সাথে যেখানে ইউসুফ ভাই আছেন সেখানে কারো সাথে সম্পর্ক হতে এবং আড্ডা জমতে সময় বেশি লাগে না।

রেস্টুরেন্টে বসে দীর্ঘ আড্ডার পর আমরা বেশ বড়োসড়ো বন্দর বাজার চরচেঙ্গা ঘুরে ঘুরে দেখি। নদীর ঘাটের গিয়ে সূর্যাস্ত দেখা হয়। ছবি তোলা হয়। চরচেঙ্গা বাজার ওশখালী থেকেও বড়ো ও ব্যস্ত । মূল কারণ নদী বন্দর। রয়েছে সী ট্রাকের জন্যে ব্যস্ততা। ঘাটে দেখলাম বেশ কয়েকটি মাছের আড়ত। জোয়ার ভাটা ধরে সী ট্রাক নোয়াখালীর চর বাটার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। রাত ৯ টার দিকে সী ট্রাক এসে পৌঁছায় নোয়াখালী থেকে। এখান থেকে নোয়াখালীর চরবাটার ভাড়া ৫৫ টাকা। এটি ভোর ৫টায় নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। কামাল ভাই খুব করে বলেন তার বাসায় রাত্রি যাপনের জন্য। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা সী ট্রাকেই রাত্রি যাপন করি। অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা। একটি ছোট্ট স্টাফ কেবিনে আমরা চার জন রাত্রি যাপন করি। আসলে ঘুমতো নয় আড্ডা দিয়ে সময় পার করা।
সকালে কখন যে সী ট্রাক চলতে শুরু করেছে আমরা বুঝতে পারিনি। বাইরে এসে দেখি অথৈ পানি আর পানি। আমরা ততক্ষণে বিশাল মেঘনায় ভেসে চলেছি। দীর্ঘ চার ঘন্টার যাত্রা শেষে আমরা চরবাটায় পৌঁছে যাই। এখানেও নদীবন্দর কেন্দ্রীক ব্যস্ততা। বলা যায় সী ট্রাক যাওয়া-আসা কেন্দ্রীক ব্যস্ততা এখানে। চরবাটা থেকে বেবী ট্যাক্সী অথবা লোকাল বাস ধরে নোয়াখালী যেতে হবে। আমরা নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে লোকাল বাসে চড়ে বসি। নোয়াখালীর একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সেরে সোনাপুর থেকে ঢাকাগামী বাস ধরি। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায়। রাতেই পৌঁছে যাই চিরচেনা, কখনো চঞ্চল, কখনো স্থবির ঢাকা নগরীতে। স্মৃতির ভান্ডারে জমা হয় বিচিত্র মানুষ আর বিশাল, বিস্তৃত প্রকৃতির অকৃত্রিম সান্নিধ্যের বহ সুখস্মৃতি।