
নিঃশব্দ কোলাহল
মেডিকেল কলেজের হোস্টেল। ১০/৮ ফিট কক্ষে ৭-৮ জন ছাত্রের বসবাস। পুরনো দেয়াল থেকে রং খসে পড়ছে। কক্ষের মাঝখানে দিয়ে আড়াআড়ি করে শক্ত দড়ি বাধা। এই দড়িতেই জামা কাপড় রাখা হয়। কেউ একজন বাহির থেকে সদ্য ফিরে তার সাদা ইউনিফর্মটা ওই দড়িতে ঝুলিয়ে দিয়েছে। এখনো দড়িটা কাঁপছে। প্রতিটি বেডের পাশে একটি ছোট্ট টেবিল। টেবিলে সাজানো নানা রকম বই। এমনই একটা কক্ষে বাস করেন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী এমদাদ। এমদাদ ছোট বেলায় শবদেহ দেখলে দৌড়ে পালিয়ে যেত। এখন প্রতিদিন শবদেহের সাথে দেখা হয়, কথাও হয়। তাই ভয় নেই। ছাত্র হোস্টেল থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে মর্গ। মাঝে মাঝে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের কাজ করতে হয় এমদাদদের। তারাই শবদেহ পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। তারপর তাদের শিক্ষক সে অনুযায়ী রির্পোট প্রকাশ করেন। যেহেতু পরীক্ষা নিরীক্ষার দায়িত্বটা এমদাদেরই তাই পুলিশের কর্তারা প্রায়ই তাদের সাথে ভাব জমাতে থাকে। কারণ রির্পোট পাল্টিয়ে আসামীর শাস্তি কমাতে পারলে ঘুষ খাওয়া সহজ হয়। একবার এক পুলিশ অফিসার তাদেরকে কিছু টাকা দেয়ার চেষ্টা করলো যাতে রিপোর্টা হালকা করা যায়। যা আমাদের নবীন ডাক্তারদের ব্যক্তিত্বে আঘাত করল। তারা টাকা তো নিলোই না। উপর্যপরি তাদের শিক্ষকের কাছে সে পুলিশের নামে বিচার দিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীর লাশ শহরের পাশে ঘন জঙ্গলা থেকে উদ্ধার করল পুলিশ। এই ঘটনা গোটা শহরজুড়ে হৈ-চৈ ফেলে দিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিচারের দাবিতে রাজপথ অবরোধ করেছে। মুখে স্লোগান ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। সাংবাদ মাধ্যমগুলোর সংবাদের শিরোমনি এই ঘটনা। সাংবাদিকরা সর্বত্রই সতর্ক অনুসন্ধান চালাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ কমিশনার প্রত্যেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কেউ সন্দেহ করছে ধর্ষনের পর খুন। কেউ বলছে আত্মহত্যা। চা-দোকান থেকে সর্বোচ্চ অফিস আদালতে এই আলোচনাই চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রীর লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য আনা হলো এমদাদের মেডিকেল কলেজের মর্গে। সেখানে সারা দিন ধরে খুটিয়ে খুটিয়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করা হলো। কিন্তু কোনো আঘাতের চিহৃ পাওয়া গেল না। কিভাবে মারা গেল এই ছাত্রী সে রহস্য অনুসন্ধানে সারাবেলা কেটে গেল। সমাধান এলো না। ক্লান্ত হয়ে ওদিনের মতো ফিরে গেল সবাই। সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বিপুল ভিড় মেডিকেল কলেজের সামনে। নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করার চেষ্টা করল। দায়িত্বরত চিকিৎসক শুধু সময় চেয়েছেন। কোনো জবাব দিলেন না।
এমদাদ কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। সারা সন্ধ্যায় রুমের বাতি নিভিয়ে বসে আছে। প্রতিদিন এই সময় মেডিকেল কলেজের পাশে একজনের বাসায় টিউশন করতে যায়। আজ সেখানেও সে গেল না। রাতে সহপাঠিরা টেনে টেনে ক্যান্টিনে নিয়ে গেল কিন্তু এমদাদের খাওয়ায় মন নেই। শরীর যেন অবস হয়ে গেছে। মুখে খাবার নিয়ে বসে আছে। চিবুতে ইচ্ছে করছে না। কোনো মতে ক্যান্টিন থেকে রুমে ফিরে এলো। ঘুমানোর চেষ্টা করল। দেয়ালের গায়ে ঝুলানো গিটার নিষ্পলক চেয়ে আছে। এমদাদের বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। অন্য সময় হলে মন ভালো করতে একমনে গিটার বাজিয়ে যেত। আজ মনের মধ্যে শুধু উকি ঝুঁকি মারছে বিবস্ত্র শবদেহ। প্রাণহীন, তবু অনেক কথা কয়। এমদাদের শান্তি কেড়ে নিয়েছে। রাজপথে মানুষকে টেনে নামিয়ে এনেছে। যে জনতা নিজের প্রয়োজনেও পথে নামে না। তাদের এই শবদেহ টেনে পথে নামিয়ে এনেছে। কথা বলতে শিখিয়েছে। জীবিত থাকতে কেউ চিনতো না। এখন সারাদেশ তার জন্য লড়াছে। সবার অতি আপনজন।
রাত অনেক হয়েছে সবাই ঘুমে অচেতন। এমদাদ আস্তে আস্তে তার বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। জুতা পরে নিল। চারদিকে টানা ঝি ঝি শব্দ। গাড় অন্ধকার। মৃদু পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে দরজা খুললো। বীরদর্পে হেঁটে যাচ্ছে মর্গের দিকে। মর্গের পাহারাদার গভীর রাতে কাজ ফাঁকি দেয়। রাত গভীর হলে সেও একটু ঘুমিয়ে নেয়। আজ এই সুযোগে মর্গে ডুকে পড়লো এমদাদ। মর্গে লাশের সারি স্ট্রেতে রাখা। এমদাদ নির্ভয়ে লাশগুলোর পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য ওই শিক্ষার্থীর লাশের কাছে যাওয়া। এমদাদ ওই লাশের স্ট্রের কাছে এসে একটু ঘাবড়ে গেল। স্ট্রে খালি, লাশ কোথায়? শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত রুমের চারপাশে এমদাদ চোখ বুলালো। উত্তেজনা ও আতঙ্কে সে ঘামতে শুরু করেছে। হঠাৎ ঠক ঠক পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়। উৎকন্ঠা নিয়ে এমদাদ তাকায় সে দিকে। নিমিষেই এমদাদ হিতাহিত বোধ হারিয়ে ফেলে। লাশটা সারা ঘরময় হেঁটে বেড়াচ্ছে। এমদাদ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তবে ভয় পায় না। সেও লাশটাকে ধরার জন্য ছুটে যায়। লাশ আরো দ্রুত বেগে দূরে সরে যায়। এমদাদ ভাবে কাল মিডিয়ার প্রশ্নের কি জবাব দিবে তারা। সে লাশের পিছে পিছে ছুটে। লাশ আরো দ্রুত দূরে সরে যায়। এক সময় লাশ রুম থেকে বের হয়ে দৌড়ায়। এমদাদও পিছু পিছু ছুটতে থাকে। লাশকে ধরার কোনো ক্ষমতাই এমদাদের নেই। জীবিত মানুষ থেকেও মৃত মানুষের শক্তি অধিক। এমদাদ হার মানে। এক সময় ক্লান্ত হয়ে এমদাদ ফিরে আসে রুমে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এমদাদ আর ভাবতে পারে না। কালরাতে কি হয়েছিল।