
নদী নারী শাড়ির দেশ
শাড়ি সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা পরোক্ষ ও অপ্রচুর। এর আদি উৎস পাওয়া যায় পুরনো লেখমালায়, মূর্তি-বিগ্রহ, পোড়া মাটির শিল্প, সাহিত্যের উপাদানে। অস্ট্রিক যুগ থেকেই শাড়ির প্রচলন ছিল বলে ধারণা করা হয়, তবে তার প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ নেই। গুপ্ত যুগের স্থিতি কাল (৩০০ খ্রি.-৫০০ খ্রি.) এ যুগের কবি ছিলেন কালিদাস। তার কুমারসম্ভব ও অভিজ্ঞান শকুন্তলম গ্রন্থে শাড়ির উল্লেখ রয়েছে। অবগুণ্ঠন, অঞ্চল শব্দ দুটি সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় বার বার যা শাড়ির পরিচয়বাহী। গুপ্ত যুগের অজন্তা ইলোরার চিত্রাবলিতে পাওয়া যায় শাড়ি জাতীয় পোশাক। পাল আমলের স্থিতিকাল মোটামুটিভাবে ৭৫০ খ্রি.-১১৬২ খ্রি.। এ আমলের স্থাপত্য, মৃত্তিকা শিল্প বিশ্লেষণ করে শাড়ির ব্যবহার নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে গুপ্ত আমলের শাড়ি ঠিক পরবর্তী সময়ের মতো নয়। তখন অধবাস ও উত্তরবাসের জন্য দুটি পৃথক বস্ত্রখণ্ড ব্যবহার করা হত। পরবর্তীতে বস্ত্র খণ্ড দুটি সংযুক্ত হয়ে শাড়িতে বিবর্তিত হয়েছে।
চর্যার সময় ৬৫০ খ্রি.-১২০০ খ্রি, এ সময়ে শাড়ি শব্দের উল্লেখ না থাকলেও তার আভাস রয়েছে। চার্যাপদগুলো যখন রচিত হচ্ছিল তখন বাংলায় চাষ হচ্ছিল কার্পাস, পাওয়া যায় তাঁতি শ্রেণীর উল্লেখ।
তান্তি বিকনহ ডোম্বী অবর মো চাঙ্গিড়া।
তোহের অন্তরে ছাড়ি নড়পেড়া।
মধ্য যুগের কবি বিদ্যাপতি বলেন—
নীল শাড়ি মোহন কারী
উছলিতে দেখি পাশ।
ফুল্লরার বর্ণনায় মুকুন্দরাম বলেন—
হুংকার ছিণ্ডিয়া দড়ি পরিয়া পাটের শাড়ি
ষোল বৎসর হইল রামা।
আর সি মজুমদার বলেন, তখন মেয়েরা আংটি, দুল, আর এ সবের সঙ্গে পায়ের গোছা পর্যন্ত শাড়ি পরত। উপরে জড়ানো থাকত আধনা।
নীহাররঞ্চন রায় বলেন, মাড়ি শব্দের উৎস সন্ধানে যেতে হয় সুদূর আর্য যুগের প্রারম্ভে ১৫০০ খ্রি.পূ.। শাড়ি শব্দটি কোথাও পাওয়া যায় সাটকা কোথাও শাটিকা। কোথাওবা সাটী। তিনি আরো বলেন, পূর্ব দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে সেলাই করা কাপড় পরার রেওয়াজ আদিম কালে ছিল না। তাই অখণ্ড বস্ত্র পুরুষের বেলায় ধূতি আর মেয়েদের বেলায় শাড়ি নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু ড. ফার্বি সেলাইবিহীন বস্ত্র খণ্ডটিকে শাড়ি বলে মেনে নিতে চান না। এমনকি তিনি দ্রৌপদীর বস্ত্রটিকেও শাড়ি বলে মেনে নিতে নারাজ। তিনি সেই বস্ত্রটিকে ধূতি বলতে চান। রাধার নীলাম্বরীও তার মতে শাড়ি নয়। কবিতার কথা ইতিহাস নয়-এই তার মত। কিন্তু ড. ফার্বির কথা আমরা মেনে নিতে পারি না কেননা নারী ও পুরুষের পোশাক এ দেশে সর্বদা পৃথকই ছিল। নারী-পুরুষের পোশাককে একই সাথে ধূতি বলা বাস্তব সম্মত নয় কখনই।
শাটকা বা শাটিকা পালি শব্দ, শাটি সংস্কৃত হওয়ায় বলা চলে শাড়ির ব্যবহার ন্যূনতম সাড়ে তিন হাজার বছর পুরনো। মধ্যযুগে শাড়ির ব্যবহার আরো দেখা যায় রামায়ন, মহাভারত, মঙ্গল কাব্য, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন, পদাবলী প্রভৃতি সাহিত্যে। দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ সর্বজনবিদিত কালজয়ী কাহিনী।
শাড়ি বর্তমান রূপ পেয়েছে কালের বিবর্তনের পথ ধরে। কালিদাসের শকুন্তলার শাড়ি আর বিদ্যাসুন্দরের শাড়ি এক নয়। আবার রর্বীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারুলতার শাড়ি আর নজীবর রহমানের আনোয়ারার শাড়ি এক নয়। আদিতে শাড়ি পরার ধরণ আজকের মতো ছিল না। শাড়ি নামক বস্ত্র খণ্ডটি তখন মেয়েরা পরতেন কোমর জড়িয়ে, পরার ধরণ ছিল অনেকটা তৎকালীন পুরুষের ধূতি পরার মতোই যদিও মেয়েদের পরার ধরণে কোনো কুঁচি থাকত না। নারীরা পোশাকটি পরতেন উত্তরবাস ও অধবাসের সমন্বয়ে। আত্তরবাসের খণ্ড কাপড়ের অংশটি দিয়ে রক্ষাবরণ ও অবগুণ্ঠনের কাজ চলতো। পরবর্তীতে ধনী পরিবারে অবগুণ্ঠনের জন্য পৃথক কাপড়ের চল হয় কিন্তু সাধারণ পরিবারের নারীরা অধবাসের কিছুটা অংশ টেনে ঘোমটা দিতেন; যাকে বলা হত ‘সেওটা‘। এই সেওটা বা আধনাই পরবর্তীতে বর্তমানে আঁচল, ব্রজবুলিতে আঁচর, মৈথিলিতে অন্ধল, সংস্কৃতে অঞ্চল হিসেবে খ্যাতি পায়।
প্রাচীন কালে অধবাসের একটা অংশ সামনে বা পেছনে ঝুলে থাকত পরে সেটাই রমনী তনু বেয়ে উপরে উঠে আসে লতিকার মতো। অধবাস আর উত্তরবাস একীভূত হয়ে দীর্ঘকায় রূপ পায়। আবার পূর্বের উত্তরবাসটিও থেকে যায় পূর্ববর্তী স্থানে স্তনপট্ট হিসেবে যা রূপান্তরিত হয় কাঁচুলিতে সেমিজের চল হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে—সেমিজ দ্বিখণ্ডত হয়ে ব্লাউজ ও পেটিকোটে পরিণত হয়েছে। সেমিজের পূর্বে নারীরা রক্ষাবরণের জন্য স্তনপট্ট ব্যবহার করতেন, প্রাচীন চিত্র লিপিগুলোতে তার নিদর্শন আজও দেখা যায়। কালিদাসের স্তনাংসুক বা স্তনপট্টই আজকের ব্লাউজের আদি রূপ; তবে সেমিজের আবির্ভবের পর ব্লাউজের রূপ আরও উন্নত হয়। এ ক্ষেত্রে চোলির কথা স্মর্তব্য আজো অনুন্নত সমাজে চোলি প্রচলিত রয়েছে। চোলি অর্থ খাটো ব্লাউজ। একশত বছর পূর্বেও নারীদের দেহে অন্তর্বাস ছিল না, ব্লাউজ পরা ছিল ভয়ানক নিন্দার ব্যাপার কিন্ত আজ এটা ছাড়া চলার উপায় নেই।
শাড়ি পরার ধরণেও এসেছে বিবর্তন—একপ্যাঁচ পদ্ধতি, দুপ্যাঁচ পদ্ধতি, কুঁচি পদ্ধতি উল্লেখযোগ্য। এক প্যাঁচ পদ্ধতির ক্ষেত্রে সেমিজ বা পেটিকোটের উপর শাড়িকে লাগিয়ে প্রথমে ডানে পরে বাঁয়ে লম্বা ভাঁজ দিয়ে জড়িয়ে টেনে এনে ডান হাতের নিচ দিয়ে আলগা করে বাঁ কাঁধে আঁচলের সামান্য অংশ রাখার যে ধরণ তার নাম ‘একপ্যাঁচ পদ্ধতি’। এভাবে শাড়ি এমনভাবে পরা হত যে তাতে দেহের ভাঁজ প্রকাশ পেত না। বেগম রোকেয়ার শাড়ি পরার ধরণ লক্ষ্যণীয়। ঘোমটা দেওয়া হত বড় করে, চাবির গোছা বাঁধা থাকত আঁচলের গোড়ায়। গ্রামীণ পরিবেশে প্রাচিন পরিবারগুলোতে এখনও এক প্যাঁচ পদ্ধতির চল দেখা যায় কিন্ত কুঁচি পদ্ধতির জনপ্রিয়তায় এটি তার স্থান হারাতে বসেছে।
কুঁচি পদ্ধতি—এই পদ্ধতিতে কোমর জড়িয়ে সামনের অংশে কুঁচি দিয়ে পেটের দিকে লতিয়ে বুক ঘিরে ছন্দময় ভঙ্গিতে উপরে উঠে বাঁ কাধ ছুঁয়ে আঁচল আছড়ে পড়ে বুকে। আর অবগুণ্ঠন পর্দার প্রয়োজনে যতটা তার চেয়ে বেশি সৌন্দর্য বর্ধনের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। অবগুন্ঠনের আড়ালে মুখ থাকে অর্ধ চন্দ্রের মতোই আড়াল। শাড়ি এখানে নারী দেহের সম্পূর্ণ অংশকে আবৃত করে ফেলে না বরং শাড়ি যখন পেঁচিয়ে উপরে উঠে যায় তখন দেহের ভাঁজগুলো যেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে তেমনি দেহের কিছু কিছু অংশ অনাবৃত থেকে সৌন্দর্য প্রকাশ করতে থাকে। তবে বর্তমানের এই ছিমছাম পদ্ধতিটি এসেছে জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অনেক পরে। কুঁচির ধারণা এসেছে অবাঙ্গালিদের নিকট থেকে, এতে রয়েছে ঘাগড়ার প্রভাব। প্রথম দিকে কুঁচি হত সামনের দিকে ফুলের মতো পরে তার স্থান দখল করে নেয় ভাঁজ পদ্ধতি। কুঁচি পদ্ধতি আজকের রূপ পায় জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী এবং মেজ বৌদি কাদম্বিনী দেবীর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য।
… নানা নামে চিনি তারে হৃদয়ে বাস যার
পরি হংস মিথুন আঁকা শাড়ি ঝিলিমিল
এসো ডাগরচোখে মাখি সাগরের নীল।
সীতা পরতেন সূক্ষ্ম-সুন্দর অমুকা শাড়ি। রাধা পরতেন মেঘাম্বরী কখনও বা নীলাম্বরী। ভিলেন নারীদের পরতে দেখা যায় অগ্নিপট্ট, নাটকের উৎসব দৃশ্যে নারীরা পরেন মনোজপুষ্প, তরুণী নারীর দেহলতা শোভা পায় ময়ুরকণ্ঠী শাড়িতে।
প্রথম মাতৃত্ব অর্জনকারী নারীরা পরেন অধ্যয়া যার রঙ লাল। স্বামী বিদেশ থেকে বা তীর্থধাম থেকে ফিরলে রমনীরা পরেন বীরাঞ্জলী। নব বধূ পরেন মৎস-পুঠ যাতে থাকত দু’মাথা যুক্ত মাছ আর ফুলের নকশা। আর বিধবাদের জন্য ছিল পদ্মলতা।
রামধনু রঙ শাড়ির নাম ধনুশ্রী, সাদা বর্ণের শাড়ির নাম রাজবেলী। হংসের ছবি আছে এরূপ শাড়ি হল হংস লক্ষ্মী।
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত বা কৌটিল্যের সময় চার ধরণের শাড়ির প্রচলন ছিল-দুকূলা, কুসুম, কার্পাসিকা, পত্রোল। এসব তৈরি হত বিক্রমপুর, সিলেট, আসামে। কবি জসীম উদদীন পূর্ববঙ্গের নকশী কাঁথা ও শাড়ি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ৪০-৫০ ধরণের শাড়ির নাম দেন। এর মধ্যে রয়েছে-জামের শাড়ি, কাদির শাড়ি, ফরাসি শাড়ি, জলে ভাসা, কাচ পাইড়, কাল পিন, সোনা ঝুরি, গোলাপ ফুল, কুসুম ফুল, রাস মঙ্গল, লক্ষী বিলাস, কৃষ্ণ নীলাম্বরী, মধু বালা, কলমী লতা। আরো রয়েছে-মিরপুরের কাতান, ববি কাতান, বাঁশ কাতান, ডিনার কাতান, পাল্লু কাতান, বার্মিজ কাতান, ইরানি কাতান প্রভৃতি।
রাজশাহীর সিল্ক, নারায়নগঞ্জ ও কুমিল্লার খাদি, স্ক্রিন সিল্ক, ওয়ার্প প্রিন্ট সিল্ক, বেনারসী সিল্ক, টাঙ্গাইল সিল্ক, গাজী সিল্ক, কাঞ্চু সিল্ক, জামদানি, টিস্যু কাতান, টিস্যু বেনারসী, টাঙ্গাইল তাঁত, আমেরিকান জর্জেট, ফেঞ্চ জর্জেট, সলিড গোল্ড, শোলে জর্জেট, সিলসিলা, ঝংকার, পদ্মিনী, ক্লিওপেট্টা, রোজীনা, ববিতা, ডিলাক্স, লাখো মে এক, পেপার সিল্ক, দিলরুবা, রজনী গন্ধা, মেঘদূত, লেডি হ্যামিলটন, সেভেন ডলার, মাই চয়েস, কোরবানি, ঠাকুগাঁও সিল্ক, মনিহার, আনার কলি, দিলরুবা, মায়া পাবনা। সিনেমা নায়ক নায়িকা ছাড়াও খাদ্যের নামে রাখা হয়েছিল শাড়ির নাম-রসগোল্লা, রসমালাই, সন্দেশ, চকোলেট ইত্যাদি। কাব্যিক নামের মধ্যে রয়েছে-হংস মিথুন, অগ্নিপট্ট, মেঘডুমুর, বলাকা, ধনুশ্রী, পদ্মাবতী।
নদী নারী শাড়ির দেশ
প্রাক শিল্প যুগে বাংলা ছিল বস্ত্র শিল্পে সমৃদ্ধ, ঢাকা, কাপাসিয়া, সোনারগাঁও, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, নোয়াখালি, কুষ্টিয়া, খুলনা, কুমিল্লা ছিল বস্ত্র শিল্পের জন্য বিখ্যাত। ‘রিয়াজুল সালাতিন’ গ্রন্থে গোলাম হোসাইন সলিম ১৭৮৮ সালে সোনারগাঁও-এ মসলিন উৎপাদন হত বলে জানান। বস্ত্রের জন্য বিখ্যাত ছিল নোয়াখালির লক্ষ্মীপুর ও কলিন্দা, কুমারখালি, সাতক্ষীরার শাড়িও সুনাম অর্জন করেছিল। কুমিল্লা ময়নামতি এখনও শাড়ির জন্য জনপ্রিয়। টেলরের মতে ১৮৪০ সালে ঢাকায় ৪০ ধরনের শাড়ি তৈরি হত। এখনও মিলের পাশাপাশি শাড়ি তৈরি হচ্ছে টাঙ্গাইল, পাবনা, ডেমরা রুপগঞ্জ, যশোর, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে।
থুইলে শাড়ি পিঁপড়ায় লইয়া যায়
এখানে কোন শাড়ির কথা বলা হচ্ছে তা কারো বুঝতে বাকি নেই। মসলিনকে এক সময় বলা হত ‘ওভেন এয়ার’। দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, সপ্তদশ শতকে তুরস্কের তৎকালীন রাজধানী মোসলে একশ্রেণীর তাঁতি বাংলাদেশর অনুকরনে বস্ত্র তৈরি করত। সেই মোসল থেকে এসেছে মসলিন। অন্যদিকে বলা হয় ইউরোপীয়রা সূক্ষবস্ত্র খণ্ডকে বলত মসূনী বা মসূলীন এর থেকে মসলিন এসেছে বলে অনেকের ধারণা।
শবনম অর্থ ভোরের শিশির। মসলিন তৈরি হওয়ার সময় ধোয়ার পর ভোরের ঘাসের উপর শুকোতে দিলে শিশিরের সঙ্গে এর পার্থক্য ধরা যেত না বলে এর নাম ছিল শবনম। মসলিনের আর একটি নাম তনজেব যার অর্থ অলঙ্কার। আবার তনসুখ ও নয়ন সুখও মসলিনের অপর দুটি নাম। ধারণা করা হয় আইন-ই-আকবরী থেকে শব্দ দুটি এসেছে।
উৎকৃষ্ট দুটি মসলিনের একটি পাওয়া যেত ঢাকায় অপরটি ময়মনসিংহে। ইউলিয়াম বোল্ট বলেন, আওরঙ্গজেব তার কন্যাকে তিরস্কার করেন কারণ সাতটি শাড়ি পরার পরও তার শরীর দেখা যাচ্ছিল। দ্বিতীয় গল্পটি হল, নবাব আলীবর্দী খান এক গরুর মালিককে দেশ থেকে বের করে দেন কারণ তার গরুটি ঘাসের সঙ্গে একটি মসলিন শাড়ি খেয়ে ফেলেছিল। আওরঙ্গজেবের সময়ে তৈরি একটি খণ্ড আব-ই-রওয়ান মসলিনের ওজন ছিল মাত্র ৫ তোলা। ঢাকা মিউজিয়ামে রক্ষিত মসলিন শাড়ির ওজন হল সাত লোল (১০*১ গজ) ১৪৬২ সালে মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের সমাপ্তি কালে অধিকাংশ মমিকে আবৃত করা হত মসলিন দ্বারা। এটা থেকে বোঝা যায় মসলিন সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক সৌন্দর্য অর্জনে অনেকাংশে সফল হয়েছিল।
টেলর বলেন যে কোনো ধরণের মানসিক অস্থিরতা বা দুশ্চিন্তার মধ্যে সুতা কাটা যেত না। শিশির ভেজা আবহাওয়ায় সুতা কাটা হত। শিশির না থাকলে পাত্রে পানি রেখে তৈরি করা হত বাষ্পী মণ্ডল। রৌদ্র তাপে সুতা ছিঁড়ে যেত তাই কেবল সঠিক পরিবেশেই তৈরি করা যেত মসলিন। দু’মাসের কঠোর শ্রমে তৈরি হত এক তোলা সুতা। ১ রতি সুতার দৈর্ঘ্য হত ১৭৫ হাত। এক বিদেশি লেখেন, ইউরোপের সমস্ত উন্নত যন্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার করেও আমরা মসলিনের মতো একখণ্ড বস্ত্র তৈরিতে অপারগ।
…ঘরেতে এল না সেতো, মনে তার নিত্য আসা যাওয়া
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।
জামদানি ঢাকার বিশেষ ঐতিহ্য। জামদানি শব্দের উৎপত্তির ইতিহাস জানা যায় না তবে এই নামের সাথে জড়িয়ে আছে আভিজাত্য ও সৌন্দর্যের ছোঁয়া। আদিকাল থেকে জামদানির শিল্পীদের বাস ঢাকার ডেমরা ও রূপগঞ্জ উপজেলায়। এই শিল্পীদের অন্যত্র নিয়ে গিয়ে জামদানি শিল্পের বিকাশ ঘটানোর প্রচেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু তা সফল হয়নি। এর কারণ পারিবারিক পরিমণ্ডলের বাইরে তারা বেড়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া শীতলক্ষার শীতল পানি থেকে উদ্ভুত বাষ্প সুতা প্রস্তুতের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী বলে ধারণা করা হয়।
জামদানির বিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তবে বর্তমানে জামদানি বলতে যা বোঝানো হয় তার সূচনা মূলত মূঘল আমল থেকে। রাজপরিবারের সম্রাজ্ঞী ও রাজকন্যাদের মন ভোলাতেই এসেছে নকশার বাহার। এক সময় জামদানিতে নকশা থাকত—ময়ূর প্যাচ কলমি লতা, পুঁই লতা, কচু লতা, গোলাপ চর, কলকা পাড়, কাঠ পাড় ইত্যাদি। শাড়ির জমিনে থাকে-গোলাপ, জুঁই, পদ্ম, তেসরা, কলার মোচা, আদার ফাদা, সাবু দানা। এসব প্রাকৃতিক নকশার বাহার দীর্ঘ কাল রমনীদের মন ভুলিয়ে এসেছে; বর্তমানে জগৎ সংসার হয়ে উঠেছে আরো বেশি জটিল, কোনো কিছুতেই সরলতা নেই-সবই জটিল আর অনিশ্চয়তায় ভরা তাই শাড়ির ডিজাইনেও এসেছে জটিলতা এসেছে বিমূর্ত শিল্প। শিল্পীরা তাদের উপস্থিত বুদ্ধিমত শাড়ির জমিন ও পাড়ে এঁকে দিচ্ছে নানা ধরণের নাকশা যার সুনির্দিষ্ট কোনো মানে নেই, প্রতিটি সৃজনশীল মন সেখান থেকে খুঁজে নেয় ভিন্ন ভিন্ন মানে। নকশা তৈরি করতে শিল্পীগণ ব্যবহার করেন বিশেষ বিশেষ ধরণের বুলি-ইহরে বাড়ে/ প্যাডে বাড়ে/ গ্যাডের খেও বাধে গ্যাডে/ গ্যাডের খেও বোধে প্যাচে/ প্যাডে বাড়ে।
কঙ্খ শালিক আর ডানা মেলা চিল
টাঙ্গাইলের শাড়ির সুনাম রয়েছে সারা ভারত জুড়ে। নাগরিক জীবনের ক্লেদ ধুইয়ে দেয় টাঙ্গাইলের শাড়ির মনোহর নকশা, সুতার কারুকাজ। সৌন্দর্য ও ফ্যাশনের দৌরাত্ম্যের সঙ্গে স্থান করে নিচ্ছে বাংলার ঐতিহ্য-সরু-মোটা ডুরে কাটা, টুকটুকে লাল রঙ, ঘি রঙের মিশেল যা বউ কথা কও পাখির রঙে সাজিয়ে তোলে নারীকে। বাংলার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে যখন এর পাড় বা জমিনে স্থান পায় হাতি, শঙ্খ, মাছ, পাখ-পাখির চিত্রল ডানা, গ্রামের শ্যামল ছবি, শালিক আর শঙ্খ চিলের সমাবেশ। তবে জামদানির মতো টাঙ্গাইলের এই শাড়িগুলোতেও স্থান করে নিচ্ছে বিমূর্ত চিত্র। নিজের মনের গোপন কথাটিকে যেন কেউই সহজে জানতে দিতে চায় না।
রেশম পোকার ভালোবাসা
টলেমি, প্লিনী প্রমুখ চীন দেশকে রেশম পোকার আদি নিবাস বলে মনে করেন। কিন্তু জেমস টেলর বলেন যে বাংলাদেশই হল রেশম পোকাদের আদি আবাস ক্ষেত্র। এই উপমহাদেশে চীনের পাঁচ হাজার বছর পূর্বের সাহিত্যে রেশমি-পশমি বস্ত্রের উল্লেখ আছে। রেশমি বস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায় রামায়ন, মহাভারতে। মনুসংহিতায় তসর ও রেশমের উল্লেখ আছে। রামায়নের কিষ্কিন্ধ্যা ৪০২/৩ শ্লোকে বগুড়ায় রেশম উৎপাদনের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ছোট এই পোকাগুলো যুগ যুগ ধরে বাংলার নারীদের মন কেড়ে আসছে। রেশম ফারসি শব্দ যার অর্থ গরদ। সংস্কৃত সাহিত্যে একে বলা হয়েছে-কৌষেয়, পট্ট, অংশ পট্ট, কীটতন্তু, কীটজ প্রভৃতি। রাজশাহীর সিল্ক তৈরি হয় এক ধরণের রেশম গুটি থেকে। চলতি ভাষায় এর নাম পলু। পলুদের একমাত্র খাদ্য তুঁত গাছের পাতা। গুটি থেকে একটি শাড়ি তৈরি করতে প্রায় ৬ হাজার রেশম পোকার আত্মত্যাগের প্রয়োজন হয়। তারা মারা যায় কিন্তু রেখে যায় ভালোবাসার ছোঁয়া। বর্তমানে কৃত্রিম সিল্ক তৈরি হলেও পলুর জন্যে স্থান সর্বদাই নির্দিষ্ট।
পিরামিডের শিল্পী
মিশরের পিরামিড তৈরির পশ্চাতে রয়েছে অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনী, তাদের কথা ইতিহাস ভুলে যায়নি। কিন্তু তাঁত শিল্পের শিল্পীদের জীবন যন্ত্রণার কাহিনী চিরকাল থেকে গেছে অজানা। তাঁতিরা ছিলেন অস্পৃশ্য-শূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত। যে বুণন নৈপুণ্য ও কারু শিল্পের গুণে তারা ব্যাকুল করেছিলেন দূর দূরান্তের বণিক প্রিয়াদের, ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন রাণী রাজকন্যাদের; সেই ঘুম কেড়ে নেওয়া শিল্পের শিল্পীদের জীবন ছিল সর্বদা বেদনায় নীল। ড. আবদুল করিম জানান, বাদশাহের কাছে পেশকৃত প্রত্যেক খণ্ড মসলিনের মূল্য ২৫০ টাকা বা তার বেশি দেখানো হলেও তাঁতীরা পেতেন তার অনেক কম। ১৮০০ সালে জঙ্গল বাড়ির তাঁতিরা জন টেলরকে জানান যে দারোগারা তাদের মসলিনের প্রতিটির মূল্যের ৫০ টাকা আত্মসাৎ করত। সব চেয়ে নিপুণ কারিগরেরা কাজ করত মোঘল কারখানায়, কারো পক্ষে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ ছিল না। ১৭৫৭ খ্রি. তাঁতিরা কোম্পানির নিকট দালাল, পাইকদের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিল। পৃথিবীর ইতিহাস : প্রাচিন যুগ’ বইটিতে দেখা যায় মিশরে তাঁতিরা সারা দিন ধরে আবদ্ধ ঘরে নোংরা পরিবেশে কাজ করতো-একটু মুক্ত শ্বাস নেবার জন্য তারা নিজের শেষ খাদ্যটুকুও ঘুষ হিসেবে দিয়ে দিত। ভারত উপমহাদেশের অবস্থাও বিশেষ উন্নত ছিল না, গোমস্তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো মূল্য নির্ধারণ করে দিত। গোমস্তাদের মুকীমরা দিনরাত তাঁতিদের ঘরে বসে থেকে তাঁদের পারিবারিক চলাফেরায় বাঁধা দিত। এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে পালিয়ে যেত অনেক তাঁতি। ইংরেজ উচ্চ পদস্ত কর্মচারি রিচার্ড ফরওয়েল বলেন, দালাল, পাইক ইত্যাদির অত্যাচার ছিল ঢাকার বস্ত্র শিল্প হ্রাসের প্রধান কারণ। ড. করিম বলেন, সহকারী বা শিক্ষানবীশিদের কোনো বেতন ছিল না। তারা ছিল ধনীর গৃহ পরিচারিকার মতো, দিনে দু বেলা আহার আর বছরে দু খণ্ড বস্ত্র নিয়েই তাদের তুষ্ট থাকতে হত। টেলরের মতে, ১৭৬০ সালে এক জন সাধারণ তাঁতির আয় ছিল এক থেকে দেড় টাকা যা পরিবার চালানোর জন্য মোটেই পর্যাপ্ত ছিল না।
ইউরোপে শিল্প বিপ্লব, ভারতে উপরিবেশিক শাসন, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব তাঁত ধ্বংসের অন্যতম কারণ। ড. করিম বলেন যে, তাঁতিদের ওপর নির্যাতন এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, কোনো কোনো স্থানে তাঁতিরা এই অত্যাচার থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য নিজেদের আঙুল কেটে ফেলত। তিনি আরো বলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারিরা ঢাকার নিপুণ শিল্পীদের হাত কেটে দিত। সোনারগাঁও এর লোকেরা এখনও একটি পুকুর দেখায় যেখানে মসলিন শিল্পীদের কাটা আঙুল নিক্ষপ করা হত। এই সব লোককথার সত্যতা যাই হোক, নীলচাষীদের মতো তাঁত শিল্পীদের ট্রাজেডিপূর্ণ জীবনের কাহিনী সকলের জানা।
তুয়া অনুরাগে হাম পরি নীল শাড়ি
নারীর সৌন্দর্য কোমলতার পরিচয় বহন করে শাড়ি, রাধার এই নান্দনিক উক্তির মধ্যে এর সত্যতা পাওয়া যায়। নারী তার সৌন্দর্যের সঠিক রূপটি খুঁজে পায় না শাড়ির মোহনীয় স্পর্শ ছাড়া; প্রকৃতির উপাদান আর নয়নের অঞ্জন এ দুয়ের সমন্বয়ে নারীর বসন বর্ণালী হতে থাকে ধাপে ধাপে। নীহাররঞ্জন রায় বলেন, নারীরা গলায় পরতেন ফুলের মালা, খোঁপায় গুঁজতেন ফুল। চর্যার শবরী নারী গলায় পরেন গুঞ্জরী মালা, খোঁপায় থাকে মোরঙ্গী পীচ্ছ। তার কপালে থাকে টিপ, হাতে পদ্মের বালা, কানে রীঠা ফুলের দুল। আরো আছে প্রসাধনীতে চন্দনের গুঁড়া, মৃগনাভি, জাফরান, কর্পূর, লাক্ষারস। এই সৌন্দর্য অনুধ্যান নারীকে করেছে মোহনীয়, কবি তার মানস প্রতিমাকে খুঁজে পায় দুঃখ বেদনাকীর্ণ পৃথিবীতেই। লতার দেত যেমন ফুলের অলঙ্কারে সুশোভিত হয়ে ওঠে তেমনি প্রকৃতির সকল সৌন্দর্যের পরশে নারী তিল তিল করে নিজেকে করে তোলে তিলোত্তমা। এই সৌন্দর্য অনুধ্যানের সমন্বয়ের দায়িত্বটি পালন করে শাড়ি। এটি দেয় পূর্ণতা দেয় স্বকীয়তা। নারীর সৌন্দর্য চেতনা চিরকালের কিন্তু সেটা পূর্ণ থেকে পূর্ণতর হতে থাকে কালে কালে নব নব অনুষঙ্গের যোগফলে। দুটি পৃথক বস্ত্রের সংযোগের মাধ্যমে শাড়ির সূচনা আর এই সংযোগ যেন অপূর্ণ আর বিক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৌন্দর্যের উপাদানগুলোকে একীভূত করে দিল একটা সামগীকতার পূর্ণতা। চঞ্চল রূপের তরঙ্গগুলো প্রস্ফুটিত হল শাড়ির প্রতিটি বক্রে। এই রূপ জ্ঞান আগত সুদূর অতীতের স্বপ্নপুরী হতে, কন্যা উমাকে বর্ণাঢ্য বস্ত্র পরিহিতা রূপে দেখা যায় বেদের মন্ত্রে; লঙ্কা জয়ের পর রামের অভিষেকের উৎসবে সীতার পরিধানে ছিল যে শাড়ি তার রঙ ছিল ফুলের মতো সাদা আর কোমল।
আলাওলের পদ্মাবতীর রূপ বিচ্ছুরিত হয়েছে শাড়িতে, চিকন শাড়ি পরলে তার চারপাশের মাটির পাত্রগুলিও শিহরিত হয়ে ওঠে। সাধাসিধা শাড়ি পরনে হৈমন্তীর বাঁকা পাড়ের নিচেকার দু’খানি পা চিরকালের জন্য স্থান করে নেয় অপুর হৃদয়ে। রাজলক্ষীর রূপ মাধুর্যে শাড়ি দিয়েছে অনন্যতা। ‘পরিয়া আসিয়াছে একখানা নীলাম্বরী শাড়ি, তাহারই সরু জরি পাড়ের সঙ্গে এক হয়ে মিলিয়াছে গায়ের নীল রঙের জামা।’
বৈষ্ণব কবি চণ্ডিডদাসের চোখেও রাধার রূপ বিন্যাসে শাড়ি দিয়েছিল অনন্যতা—
মগন করিয়া গেল সে চলিয়া
সোনার পুত্তলি কায়া
তাহে নীল শাড়ি ভেদিয়া আঁচল
রূপ অনুপম ছায়া।
ফুল্লরার রূপ বর্ণনায় মুকুন্দরাম বলেন—
পরিয়া পাটের শাড়ি ষোল বৎসর হইল রামা।
মৈমনসিংহগীতিকায় প্রেয়সীর মন ভোলাতে বলা হয়—
বসনভূষণ দিব আমি দিব নীলাম্বরী
নাকে কানে দিব ফুল কাঞ্চা সোনায় গড়ি।
কৃষ্ণের প্রেম ভালোবাসা পেতে রাধা বলেন—তুয়া অনুরাগে হাম পরি নীল শাড়ি (জ্ঞানদাস) শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধার কোমল তনু জড়িয়ে ছিল গভীর নীল রঙের শাড়ি। সেই থেকে নীল হল প্রেম আর বেদনার রঙ। ‘অর্ধেক নারী তুমি অর্ধেক কল্পনা’। কবি নারীকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে আপন মনের মাধুরী দ্বারা নব নব রূপে নির্মাণ করতে পারেন না শাড়ির মনোমুগ্ধকর স্পর্শ ব্যতীত। কল্পনার নারীরাও যেন শাড়ি পরিধান করে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। দৈত্যের কারাগারে বন্দী যে রাজকন্যা সেও যেন শাড়ির কোমল স্পর্শে নিদ্রচ্ছন্ন। সে শাড়ির রঙ কী তা আমাদের জানা নেই।
বৈশাখ আর বাংলার নববর্ষ মুখরিত হয়ে ওঠে ঘি রঙা লালপাড় শাড়িতে, বাসন্তী রঙ লাল পাড় শাড়ি আনন্দ আহ্বান করে বসন্ত ঋতুকে। বর্ষার জলধারায় নারী সজ্জিত হন মেঘমেদুর বর্ণের শাড়িতে। সাদা লাল পাড়ের শাড়ি কল্যাণী পৃথিবীর পরিচয়বাহী, ডুরে শাড়িতে সজ্জিত হয়ে পল্লী বালকের মন কেড়ে নেয় পল্লী বালা। নকশী পাড়ের ঘোমটার আড়ালে বারবার রক্তিম বর্ণ হয়ে ওঠে নববধূ। হলুদ বরণ শাড়ি গায়ে হলুদ উৎসব নিয়ে আসে পূর্ণতার আনন্দ। বিবাহের পিঁড়িতে বধু পরে বেনারসী, সাদা শাড়ি হয় বিধাব নারীর ধূসর জীবনের সাথী। কুমারীর শাড়ির জৌলুস হয় লোক নিন্দার কারণ। তেমনি সমালোচনার শিকার হয় স্বামী পরিত্যাক্তার শাড়ির বাহার।
শাড়ি যুগে যুগে বহন করে চলেছে মানব অনুভূতির সার্থক প্রতিফলন। কান্না হাসির দোলদোলানো পৌষ ফাগুণের মেলায় অবিচ্ছেদ্য ভাবে শাড়ি জড়িয়ে আছে তার ঐতিহ্য নিয়ে। যুগ-কাল নির্বিশেষে শাড়ির বৈচিত্র স্মরণ করিয়ে দেয় তার সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে। শেকড়ে শেকড়ে জড়ানো বটমূলের যত মেলা, তাতে যদি না থাকে ডুরে পাড় শাড়ি পরিহিত পল্লী বালা বা নকশী পাড় শাড়ি পরিহিতা পল্লী বধূর পদচারণা, তবে সেই মেলায় বাঁশি তার সঠিক সুরটি খুঁজে পেত না। শাড়ি মনকে টেনে নিয়ে যায় সুদূর সেই অতীতে যে অতীত সর্বদা অধরা সর্বদা মোহনীয়।
কৌটিল্যের কালে (৩২৪ খ্রি. পূ.) শাড়ির বাহার ছিল ঈর্ষণীয়। কবিগুরু তার ‘স্বপ্ন’ কবিতায় পূর্ব জনমের যে প্রিয়ার কথা বলেছেন তাঁকে আমরা শাড়ি ব্যতীত অন্য কোনো পোশাকে কল্পনাও করতে পারি না। শকুন্তলা পতিগৃহে যাত্রা কালে পরিধান করেছিলেন ক্ষৌম বস্ত্র। ভারতীয় কার্পাস ও রেশমের প্রশংসা না করে পারেননি পেরিক্লিস, আরব বণিক সোলেমান, মার্কো পলো, মা হুযান প্রমুখ। ইবনে বতুতাও সোনারগাঁও এর সুতি বস্ত্রের প্রশংসা করেছেন।
রাজশ্রেণীর নারীর সন্তোষ বিধানের জন্য বহু ব্যয় করে শাড়ি তৈরি হত। সে সব শাড়ির জমিনে থাকত সোনা, রুপা, মনি, মুক্তা। সাধারণ রুচিশীল নারীরা পরতেন তাঁতের বর্ণালী সতার রকমারি কারুকাজের শাড়ি। ষড়ঋতুর মতো নানা বর্ণের নানা রূপের শাড়ি নারীকে দিয়েছে বাহারি রূপ, করেছে গর্বীত। শিল্পী ও তাঁতিরা একাত্মা হয়ে শাড়ির পাড়ে ও জমিনে ছড়িয়ে দিচ্ছেন রাম ধনুর সাত রঙের বাহার। এসবের কোনোটি আভিজাত্যের গৌরবে গর্বিত কোনোটি ফুলের রঙে স্নিগ্ধ, কোনোটি বা নবীনতায় মধুর।
উৎস : হোসনে আরা শাহেদ, শাড়ি, বাংলা একাডেমি